ধ্বংসযজ্ঞ – ১

কাজী আনোয়ার হোসেন

এক

অ্যাযোর্স দ্বীপপুঞ্জ।

সান্তা মারিয়া এয়ারপোর্টের টার্মিনাল বিল্ডিঙের বাইরে, র‍্যাম্পের ওপর দাঁড়িয়ে আছে টমাস মার্লো। ১৯৫১ সালের এক ঠাণ্ডা, ভেজা রাত। কুয়াশা আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির চাদরে ঢাকা পড়ে আছে পুরো এয়ারপোর্ট আর দ্বীপ। চামড়ার জ্যাকেটে শীত মানছে না। সামনে, রানওয়ের দু’পাশে নীরবে আলো ছড়াচ্ছে দু’সারি নীল বাতি। মাথার ওপরে খানিক পর পর দেখা যাচ্ছে শক্তিশালী সাদা আলোর রশ্মি, সেটাকে অনুসরণ করছে সবুজ আলোর একটা ঝলক-এয়ারপোর্টের বিকন ওটা। অবশ্য এ-মুহূর্তে ঘন, নিচু মেঘের পরত পেরিয়ে আকাশ থেকে এই বিকন দেখা দুঃসাধ্য।

তিন দিক থেকে সান্তা মারিয়া এয়ারপোর্টকে ঘিরে রেখেছে পাহাড়। দ্বীপটা বিশাল আটলান্টিকের বুকে ছোট্ট একটা কণার মত। বিচ্ছিরি এই আবহাওয়ায় বিমান থেকে দ্বীপটা খুঁজে পাওয়াই মুশকিল, এয়ারপোর্ট তো আরও পরের কথা। রানওয়ে লাইট দেখতে দেখতেই পাহাড়ের গায়ে বাড়ি খাবে বিমান।

কপাল ভাল মার্লোর, দ্বীপে পৌঁছুতে হচ্ছে না তাকে, দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। আবহাওয়ার পরোয়া না করে সে নিজেও চলে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। জানে, এখানে থাকা নিরাপদ নয়। সমস্যা হলো, র‍্যাম্পে দাঁড়িয়ে থাকা লকহিড কনস্টেলেশন বিমানটার মালিক ও পাইলট হওয়া সত্ত্বেও রওনা হবার সিদ্ধান্তটা তার ওপর নির্ভর করছে না।

পকেট থেকে রূপালি একটা কেস বের করল সে। একটা ডানহিল সিগারেট নিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজল। বিশ ফিট অন্তর অন্তর ঝুলতে থাকা নো স্মোকিং সাইনগুলোকে অগ্রাহ্য করে আগুন ধরাল সিগারেটে। আশপাশের যে-কোনও বিমান বা ফিউয়েল লাইন থেকে অন্তত একশো গজ দূরে রয়েছে সে। বৃষ্টিতে চারপাশ ভেজা। কাজেই অগ্নিকাণ্ডের ভয় নেই। তা ছাড়া টার্মিনাল বিল্ডিঙের শুষ্ক, উষ্ণ পরিবেশ ছেড়ে কেউ বাইরে বেরিয়ে আসবে, তাকে নিয়মভঙ্গ করতে দেখে হৈচৈ করবে… এমন সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে।

আয়েশ করে সিগারেটে টান দিল মার্লো। মুখ দিয়ে ঘন ধোঁয়ার মেঘ ছাড়তে ছাড়তে আওয়াজ পেল—পেছনে টার্মিনাল বিল্ডিঙের দরজা খুলে গেছে।

ঢোলা পোশাক পরা একজন মানুষ বেরিয়ে এল সেখান দিয়ে। গোলগাল মুখের অনেকখানি ঢাকা পড়ে আছে খয়েরি রঙের হ্যাটে। রুক্ষ উলের তৈরি জ্যাকেট আর প্যান্ট পরে আছে লোকটা, দেখে মনে হতে পারে সেগুলো রেড আর্মির উইন্টার ক্যাটালগের সারপ্লাস থেকে ধার করা। হাতে গ্লাভস, আঙুলগুলো উন্মুক্ত। লোকটাকে গ্রামাঞ্চল থেকে আসা গরিব পর্যটকের মত দেখাচ্ছে। কিন্তু মার্লো জানে, খুব শীঘ্রি অঢেল প্রাচুর্যের মালিক হতে চলেছে এ-লোক। মানে, সে যদি আমেরিকা পৌছুনো পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে আর কী।

‘আবহাওয়া ভাল হবার কোনও সম্ভাবনা আছে?’ কাছে এসে জিজ্ঞেস করল লোকটা।

জবাব দেবার আগে ডানহিলে আরেকটা টান দিল মার্লো, আরেকবার ধোঁয়ার মেঘ ছাড়ল। তারপর ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘না। আজ তো হবেই না, আগামী এক সপ্তাহেও কোনও উন্নতি হবে কি না সন্দেহ।’

মার্লোর যাত্রী হিসেবে আসা মানুষটা জাতে রাশান, তার নাম কিরিলভ। সোভিয়েত ইউনিয়নের এক রিফিউজি। লাগেজ হিসেবে দুটো স্টেইনলেস স্টিলের ট্রাঙ্ক রয়েছে তার সঙ্গে, পাথরের মত ভারী। এ-মুহূর্তে ট্রাঙ্কদুটো চেইনের সাহায্যে আটকে রাখা হয়েছে মার্লোর বিমানের ভেতরে। ওগুলোয় কী আছে, জানানো হয়নি মার্লোকে। তাকে শুধু একগাদা টাকা দেয়া হচ্ছে সদ্যগঠিত সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ থেকে-কিরিলভ ও তার ট্রাঙ্কদুটো আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছে দেবার জন্যে। সন্দেহ নেই, বাক্সদুটো নিয়ে দেশত্যাগ করার জন্যে রাশান লোকটা আরও বেশি টাকা পাচ্ছে।

এখন পর্যন্ত সবকিছু মোটামুটি ভালভাবেই এগিয়েছে। আমেরিকান এক এজেণ্ট কিরিলভকে পৌঁছে দিয়েছে ইউগোস্লাভিয়ায়। ওটাও কমিউনিস্ট দেশ, তবে ইউগোস্লাভ নেতা টিটোর সঙ্গে স্ট্যালিনের মোটেই সদ্ভাব নেই। মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে সারায়েভোয় বিমান নামানোর অনুমতি পেয়েছে মার্লো, কেউ কোনও প্রশ্ন তোলার আগে ফের উড়ালও দিতে পেরেছে।

সেই থেকে পশ্চিম অভিমুখে উড়ে চলেছে ওরা। খবরটা যে গোপন থাকেনি, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে কিরিলভের ওপর এক দফা হামলায়। পায়ে একটা বুলেট নিয়ে খোঁড়াতে হচ্ছে বেচারাকে।

মার্লোর ওপর নির্দেশ রয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব লোকটাকে পৌঁছে দিতে হবে আমেরিকায়। সৌভাগ্যক্রমে কোনও রুট বাতলে দেয়া হয়নি তাকে, দিলেও সে তা মানত না। এখন পর্যন্ত বড় বড় সমস্ত ইয়োরোপিয়ান শহর এড়িয়ে চলেছে সে, যাত্রাবিরতি করেছে অ্যাযোর্সে-রিফিউয়েলিং করে আবার আকাশে উড়বে। এই দফা কোথাও না থেমে পৌঁছুবে আমেরিকায়। প্ল্যানটা মন্দ নয়, তবে খারাপ আবহাওয়া বা কিরিলভের উড়াল-ভীতি তার হিসেবে ছিল না।

‘আগে হোক, পরে হোক, এখানে বসে থাকলে ওরা আমাদেরকে খুঁজে বের করবে,’ লোকটার দিকে ফিরে বলল মার্লো। ‘সবখানে লোক আছে ওদের। বিশেষ করে সমস্ত বন্দর আর এয়ারপোর্টে।’

‘কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন, এ-জায়গাটা ওদের নজরের বাইরে।’

‘বলেছিলাম। কিন্তু যখন আমাদেরকে নজরের ভেতরে পাওয়া যাবে না, তখন ওরা নজরের বাইরের জায়গাতেই খোঁজ করবে। কে জানে, হয়তো খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে।’

আবারও সিগারেটে টান দিল মার্লো। রাশানরা অ্যাযোর্সে খোঁজ নেবে, এমন কোনও জোরালো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু দু-দু’জন আমেরিকান আর একজন বিদেশি লোক এখানে ল্যাণ্ড করার পর তিনদিন ধরে ঘাপটি মেরে রয়েছে, কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করছে না… বিষয়টা যে-কাউকেই সন্দিহান করে তুলবে।

‘অযথা সময় নষ্ট করছেন,’ কিরিলভকে বলল সে। ‘ভেবে দেখুন, কোটা বেশি ভয়ঙ্কর— সামান্য টার্বিউলেন্স, নাকি মরণ?’

মেঘলা আকাশের দিকে তাকাল কিরিলভ। প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘কিন্তু এ-আবহাওয়ায় কীভাবে উড়বেন আপনি?’

‘উড়তে কোনও সমস্যা নেই,’ বলল মার্লো। ‘খারাপ আবহাওয়ায় ল্যাণ্ডিঙেই যত সমস্যা। অনায়াসে টেকঅফ করতে পারব। চলে যাব পশ্চিমে। ওদিকে কোনও পাহাড়- পর্বত নেই, পুরোটাই খোলা সাগর… আর মুক্তি।’

তাও দ্বিধা দূর হলো না কিরিলভের। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল সে।

অগত্যা মিথ্যে বলল মার্লো, ‘নিউ ইয়র্কের ফোরকাস্ট চেক করেছি আমি। আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টা আকাশ পরিষ্কার থাকবে। কিন্তু এরপর…’ কাঁধ ঝাঁকাল সে, ‘হয় এখুনি রওনা হতে হবে, নয়তো এক সপ্তাহের জন্যে আটকা পড়ে যাব আমরা।’

ফ্যাল ফ্যাল করে রূপালি রঙের কনস্টেলেশনের দিকে তাকাল কিরিলভ। চারটে অতিকায় পিস্টন ইঞ্জিন আর ট্রিপল টেইলের দিকে তাকিয়ে বোধহয় ভরসা পেল একটু।

‘আপনি নিশ্চিত, আমাদেরকে নিরাপদে নিয়ে যেতে পারবেন?’ মার্লোকে জিজ্ঞেস করল সে।

‘পারব,’ দৃঢ় গলায় বলল মার্লো।

নিমরাজি হবার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিরিলভ।

বিমানের ককপিটের দিকে ফিরে হাতের ইশারা করল মার্লো। কয়েক মুহূর্ত পরেই স্টার্টার মোটরের তীক্ষ্ণ আওয়াজ হলো, তিন নম্বর ইঞ্জিনের পেছন দিয়ে বেরিয়ে এল একরাশ ধোঁয়া। জ্যান্ত হয়ে উঠল ওটা, বিশাল প্রপেলার পনেরোশো আরপিএম-এ ঘুরতে শুরু করল, ডানাগুলো বৃষ্টির পানি ছিটাচ্ছে। একটু পর সাড়া দিল এক নম্বর ইঞ্জিনও।

কিরিলভকে রাজি করাতে পারবে, এ-আশায় কো- পাইলট জেরি ওয়ার্নারকে ককপিটে বসিয়ে রেখেছিল মার্লো, নজর রাখতে বলেছিল তার দিকে, যাতে ইশারা দিলেই ইঞ্জিন চালু করতে পারে।

‘চলুন,’ কিরিলভকে বলল মার্লো।

বড় করে শ্বাস নিল রাশান লোকটা, সাহস সঞ্চয় করল, তারপর হাঁটতে শুরু করল অপেক্ষমাণ বিমানটার দিকে। অর্ধেক পথ যেতেই শোনা গেল একটা গুলির আওয়াজ। ভেজা টারমাকে প্রতিধ্বনি তুলল আওয়াজটা। যেন একটা ধাক্কা খেল কিরিলভ, পিঠ বেঁকে গেল, টলমল ভঙ্গিতে দু’পা এগিয়েই কাত হয়ে পড়ে গেল টারমাকে।

‘না!’ চেঁচিয়ে উঠল মার্লো।

দুই লাফে কিরিলভের কাছে পৌঁছুল সে, তাকে টেনে-হিঁচড়ে দাঁড় করাল, কোমর আঁকড়ে ধরে টানতে থাকল বিমানের দিকে। টলমল পায়ে কোনোমতে এগিয়ে চলল আহত লোকটা। আবারও গুলি হলো, তবে সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। ডানদিকে টারমাকের চলটা উঠল বুলেটের আঘাতে। হোঁচট খেল কিরিলভ, পড়ে গেল হুড়মুড় করে। ঠেকানো গেল না।

‘ফর গডস্ সেক, উঠুন!’ চেঁচাল মার্লো। পাগলের মত টানছে লোকটাকে।

পরের গুলিটা মার্লোকেই খুঁজে নিল। কাঁধে ঘুসির মত একটা আঘাত খেয়ে আধপাক ঘুরে গেল সে, দড়াম করে আছড়ে পড়ল টারমাকে। পড়েই গড়ান দিল দুটো, যাতে ওকে স্থির টার্গেট হিসেবে পাওয়া না যায়। অনুমান করছে, টার্মিনালের ছাত থেকে গুলি চালাচ্ছে আততায়ী। শক্তিশালী রাইফেল ব্যবহার করছে।

ঠোঁট কামড়ে কাঁধের ব্যথা অগ্রাহ্য করল মার্লো, কোমরের বেল্ট থেকে বের করে আনল একটা কোল্ট ফোরটি ফাইভ রিভলভার। আন্দাজের ওপর ভর করে বিল্ডিঙের ছাতের দিকে গুলি ছুঁড়ল একের পর এক। চতুর্থ গুলিটার পর মনে হলো, একটা ছায়া যেন বসে পড়েছে রেলিঙের তলায়। ওদিকে আরেকটা গুলি করল সে, তারপর উঠে গিয়ে টানতে শুরু করল কিরিলভকে। এবার আর তাকে দাঁড় করানোর ঝামেলায় যাচ্ছে না, বগলের তলায় দু’হাত ঢুকিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে। বিমানের সিঁড়ির তলায় পৌঁছে থামল।

‘উঠুন,’ কিরিলভকে বলল সে।

‘আ…আমি পারব না,’ দুর্বল গলায় বলল রাশান লোকটা।

‘পারতেই হবে!’

জোর করে কিরিলভকে দাঁড় করাল সে। আর তখুনি ছুটে এল আরেকটা বুলেট। ভীষণভাবে কেঁপে উঠল কিরিলভ, কাটা কলাগাছের মত পড়ে গেল মাটিতে।

ডাইভ দিল মার্লো, কাভার নিল বিমানের সিঁড়ির পেছনে। খোলা দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে চেঁচাল, ‘জেরি!’

জবাব নেই।

‘জেরি!’ আবার ডাকল মার্লো। ‘খবর কী?’

‘যাবার জন্যে রেডি,’ এবার জানানো হলো ভেতর থেকে।

আওয়াজ শুনে বুঝল মার্লো, কনস্টেলেশনের শেষ ইঞ্জিনটাও চালু হয়ে গেল। হামাগুড়ি দিয়ে উপুড় হয়ে থাকা কিরিলভের কাছে গেল সে, তাকে চিৎ করল। কোনও সাড়া দিল না লোকটা। শেষ গুলিটা তার গলা ভেদ করে গেছে। শূন্য চোখের দৃষ্টি। প্রাণপাখি উড়ে গেছে তার।

নিচু গলায় গাল দিয়ে উঠল মার্লো। মিশনের অর্ধেকটাই পণ্ড হয়ে গেছে। তবে ট্রাঙ্কদুটো এখনও রয়েছে তার দখলে। সিআইএ-র হাতে ওগুলো তুলে দিতে পারলে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।

ঘুরে টার্মিনালের দিকে আবারও একটা গুলি করল মার্লো, এরপর এগোল সিঁড়ির দিকে। দু’ধাপ উঠতেই কানে এল নতুন আওয়াজ। ঘাড় ফিরিয়ে দু’জোড়া হেডলাইটের আলো দেখতে পেল—র‍্যাম্পের দূরপ্রান্ত থেকে তুমুল বেগে ছুটে আসছে দুটো গাড়ি। সাহায্য করতে আসছে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই।

পড়িমরি করে বিমানে উঠে পড়ল মার্লো, টেনে দিল দরজা। আর তখুনি একটা গুলি কনস্টেলেশনের নরম শরীর ভেদ করে ঢুকে পড়ল ভেতরে, রিকোশে তুলল।

‘চলো!’ জেরির উদ্দেশ্যে চেঁচাল সে।

‘আমাদের প্যাসেঞ্জার?’

‘অন্য মার্গে চলে গেছে।’

মাথা ঝাঁকিয়ে থ্রটল ঠেলে দিল জেরি। মৃদু ঝাঁকি খেয়ে আগে বাড়ল বিমান। হ্যাণ্ডেল টেনে দরজা লক করল মার্লো। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে তার কানে ভেসে এল কাঁচ ভাঙার আওয়াজ।

ঘুরে দাঁড়াতেই জেরিকে কেঁপে উঠে সেন্টার কনসোলের ওপর ঝুঁকে যেতে দেখল সে। সিটবেল্ট বাঁধা না থাকলে মুখ থুবড়ে পড়ে যেত।

‘জেরি?’ ডাকল মার্লো।

জবাব এল না কো-পাইলটের তরফ থেকে।

ককপিটে ছুটল মার্লো, বিমান তখন গতি পেতে শুরু করেছে। আবারও ছুটে এল গুলি, ককপিটের আরও কাঁচ ভাঙল। মেঝেতে শুয়ে পড়ল সে, ওখান থেকেই হাত তুলে থ্রটল ঠেলে দিল পুরোপুরি। এরপর সিটের তলা দিয়ে পা ঢুকিয়ে চেপে ধরল ডানদিকের রাডার। ইঞ্জিনের গর্জন বেড়ে গেছে। এলোমেলো ভঙ্গিতে চললেও ক্রমেই গতি বাড়ছে অতিকায় কনস্টেলেশনের, ঘুরে যাচ্ছে নাক।

রাইফেলের একটা গুলি ঢুকে পড়ল ফিউযেলাযের দেয়াল ফুটো করে; সেটার পিছু পিছু ঢুকল আরও দুটো। সবগুলোই ককপিটের পেছনদিকে… একটার পেছনে আরেকটা। মার্লো অনুমান করল, টার্মিনালের দিকে লেজ ঘুরে গেছে বিমানের, ককপিট এখন রাইফেলের নাগালের বাইরে। তাড়াতাড়ি পাইলটের সিটে উঠে বসল সে, বিমানকে নিয়ে গেল রানওয়েতে।

কিছুটা সময়ের জন্যে থামতে হলো তাকে, ইঞ্জিনের শক্তি বাড়াবার জন্যে। নইলে টেকঅফ করতে পারবে না। খোলা রানওয়েতে নিজেকে বড়ই অরক্ষিত মনে হলো তার, কিন্তু কিছুই করার নেই। বিমানের গায়ে আরও কয়েকটা গুলি বিধতেই সংবিৎ ফিরল, আর অপেক্ষা করা যায় না। টাওয়ার থেকে ক্লিয়ারেন্স চাওয়ার প্রশ্নই আসে না, ব্রেক রিলিজ করে বিমানকে সোজা ছোটাল লম্বা রানওয়ে ধরে। পেছনে এখনও শোনা যাচ্ছে গুলির আওয়াজ, তবে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই রেঞ্জের বাইরে চলে এল কনস্টেলেশন। রানওয়ে ধরে দানবের মত ছুটছে, পৌঁছে যাচ্ছে রোটেশনাল ভেলোসিটিতে।

কুয়াশা আর বৃষ্টির কারণে এমনিতেই দৃষ্টিসীমা সঙ্কুচিত, তার ওপর ককপিটের ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকছে দামাল বাতাস। চোখ ছোট করে রানওয়ের শেষ প্রান্তের লাল বাতি খুঁজল মার্লো। খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে সেগুলো। ফ্ল্যাপ পাঁচ ডিগ্রি নামাল সে, অপেক্ষা করল লাল বাতিগুলোর মোটামুটি একশো গজের মধ্যে পৌছুবার জন্যে। তারপরেই টেনে ধরল ইয়োক। নাক উঁচু করল কনস্টেলেশন, ক্ষণকাল যেন দ্বিধা করল, এরপর ডানা মেলল বাতাসে। বিমানের পেছনের চাকাগুলো আঁচড় কেটে গেল রানওয়ের শেষ মাথার ঘেসো জমিনে।

ধীরে ধীরে উচ্চতা বাড়ছে বিমানের, পশ্চিমমুখী একটা হেডিং সেট করল মার্লো। ল্যাণ্ডিং গিয়ার তুলে ফিরল তার কো-পাইলটের দিকে।

‘জেরি!’ কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিল সে। ‘জেরি!!’

সাড়া দিল না কো–পাইলট। পালস, চেক করল মার্লো—কোনও স্পন্দন নেই।

‘ড্যাম ইট!’ গাল দিয়ে উঠল সে।

কয়েক বছর আগে শেষ হওয়া বিশ্বযুদ্ধে এভাবে বহু বন্ধুকে হারিয়েছে মার্লো, কিন্তু সেসব মৃত্যুর পেছনে যৌক্তিক কারণ ছিল। কিন্তু এখানে? কী আছে ওই ট্রাঙ্কদুটোয়, যার জন্যে দু-দু’জন মানুষকে প্রাণ হারাতে হলো?

জেরিকে সিটে সোজা করে বসাল মার্লো, মন দিল ফ্লাইঙে। বাইরে ঝোড়ো বাতাস, টার্বিউলেন্স ভয়াবহ। মেঘ ভেদ করে ওপরে উঠছে বলে সামনে ধূসর একটা পর্দা ঝুলছে। দিগন্ত বা আর কিছু দেখা না যাওয়ায় বিমানের ওরিয়েন্টেশন বোঝার কোনও উপায় নেই। শরীরের অনুভূতির ওপরেও ভরসা করা চলে না। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে বিমান ক্র্যাশ করার বহু নজির আছে। হয় বিমান সমান্তরাল আছে ভেবে পাইলট জমিনে গিয়ে আছড়ে পড়ে, নয়তো কাত হয়ে আছে ভেবে কারেকশন দিতে গিয়ে বিমানকে পাক খাওয়াতে শুরু করে।

ঝুঁকি না নিয়ে ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলের দিকে তাকাল মার্লো। যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে লেভেলে রাখল বিমানকে। পাঁচ ডিগ্রির নিরাপদ অ্যাঙ্গেলে ক্লাইম্ব করছে এখন কনস্টেলেশন।

এয়ারপোর্ট থেকে তিন মাইল দূরে, দু’হাজার ফিট উচ্চতায় পৌছুবার পর আবহাওয়া আরও খারাপ রূপ নিল। টার্বিউলেন্সে থরথর করে কাঁপতে থাকল পুরো কাঠামো, দ্বিমুখী বাতাস যেন ভেঙেচুরে দিতে চাইছে ওটাকে। উইণ্ডশিল্ডে ঝাপটা দিচ্ছে বৃষ্টি। তীব্র গতিতে ছোটার কারণে বাতাসের একটা পর্দা তৈরি হয়েছে ভাঙা জানালায়, বৃষ্টির পানি সরাসরি ভেতরে ঢুকছে না, তবে আর্দ্রতা ঢুকছে ঠিকই। ভেজা ভেজা হয়ে যাচ্ছে শরীর। ইঞ্জিনগুলো গর্জন করছে ক্রুদ্ধ দানবের মত।

ভাঙা জানালা আর বুলেটের ফুটোর কারণে বিমানের ভেতরটা প্রেশারাইজ করতে পারেনি মার্লো, তবে সে জানে, চোদ্দ হাজার ফিট পর্যন্ত অনায়াসে উঠে যেতে পারবে ঠাণ্ডায় না জমেই। সিটের পেছনে হাত দিয়ে সবুজ রঙের একটা অক্সিজেনের বোতল বের করে আনল—ওপরে উঠলে প্রয়োজন হবে ওটার।

টার্বিউলেন্সের আরেকটা ধাক্কায় কেঁপে উঠল কনস্টেলেশন। ঘাবড়াল না মার্লো। ল্যাণ্ডিং গিয়ার যেহেতু তুলে ফেলতে পেরেছে, বিমানের চার-চারটে শক্তিশালী ইঞ্জিন ঠিকই ওকে এই ঝড় ভেদ করে নিয়ে যেতে পারবে। আকাশযান হিসেবে কনস্টেলেশনের তুলনা হয় না। হাওয়ার্ড হিউজের সহায়তায় বিশ্ববিখ্যাত লকহিড কোম্পানি ডিজাইন করেছে বিমানটা, সাড়ে তিনশো নট বেগে রিফিউয়েলিং ছাড়া তিন হাজার মাইল পর্যন্ত যেতে পারে। কিরিলভকে যদি আরেকটু পশ্চিমের কোনও জায়গা থেকে তোলা হতো, এই বিমান নিয়ে সহজেই নিউফাউণ্ডল্যাণ্ড বা বস্টনে সরাসরি চলে যেতে পারত সে।

হেডিং চেক করার জন্যে প্যানেলের দিকে তাকাল মার্লো। যতটা চেয়েছে, তার চেয়ে অনেকটা উত্তরে ঘুরে গেছে বিমানের নাক। কারেকশন দেবার চেষ্টা করতেই ঝিমঝিম করে উঠল মাথা। বিমানকে লেভেলে আনল সে, পরমুহূর্তে একটা ওয়ার্নিং লাইট জ্বলে উঠল। এক নম্বর ইঞ্জিনের জেনারেটর অচল হতে বসেছে, থেমে থেমে চলছে ইঞ্জিনটা। কয়েক সেকেণ্ডের ব্যবধানে দু’নম্বর ইঞ্জিনও বন্ধ হয়ে গেল, জ্বলে উঠল মেইন ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্নিং লাইট।

মনোযোগ আনার চেষ্টা চালাল মার্লো। মাথা হালকা হয়ে গেছে তার, হাত-পা চলতে চাইছে না। কাঁধের যেখানটায় গুলি লেগেছে, সেখানটা স্পর্শ করল। ক্ষতটা ব্যথা করছে, কিন্তু কতটা রক্ত ঝরেছে বুঝতে পারল না।

ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলে আর্টিফিশিয়াল হরাইজনটা ঘুরপাক খাচ্ছে—বাইরে কিছু দেখা না গেলে ওটার সাহায্যেই বিমানকে লেভেলে রাখতে হয়। পাশেই ডিরেকশনাল জাইরো-কম্পাস… ওটাও আচরণ করছে মাতালের মত।

কীভাবে কে জানে, মার্লোর শরীরের মত বিমানটাও ধাপে ধাপে অচল হয়ে পড়ছে।

পুরনো কম্পাসটার দিকে তাকাল মার্লো—আদ্যিকালের এই যন্ত্রটাই পাইলটের শেষ ভরসা। ওটা তাকে বলছে পুরোপুরি বাঁয়ে ঘুরে যেতে। আন্দাজের ওপর বিমানকে লেভেলে আনার চেষ্টা করল সে, তাতে অন্যপাশে কাত হয়ে প্রায় খাড়া হয়ে গেল পুরো কাঠামো। তারস্বরে বাজতে শুরু করল স্টল অ্যালার্ম-বাতাসের অবলম্বন হারিয়ে আকাশ থেকে খসে পড়ছে কনস্টেলেশন। এক মুহূর্ত পরেই প্যানেলের সমস্ত বাতি জ্বলে উঠল—যত ধরনের অ্যালার্ম আছে, সব বাজতে শুরু করেছে একসঙ্গে।

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মত ঠিক এমন সময় বজ্ৰপাত হলো। চোখ ধাঁধিয়ে গেল মার্লোর। বুঝতে পারছে না, বিমানকেই ওটা আঘাত করেছে কি না।

রেডিও অন করে মাইক্রোফোন মুখের কাছে আনল সে। সিআইএ থেকে দেয়া শর্টওয়েভে সেট করল ফ্রিকোয়েন্সি, শুরু করল ব্রডকাস্ট।

‘মেড়ে, মেডে, মেডে! দিস ইজ…’

কথা শেষ করতে পারল না মার্লো, বিমানটা ভীষণ এক ঝাঁকি খেল, দুলে উঠল ডান থেকে বাঁয়ে। আবারও বজ্রপাত হলো—পরিষ্কার দেখল, কয়েক লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুৎ আঘাত হানল ডানদিকের ডানায়। বিমানের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল সেই বিদ্যুৎ। মাইক্রোফোন ধরা হাতে শক লাগতেই ওটা ছেড়ে দিল সে। কর্ডে ভর করে ওটা দুলতে থাকল পেণ্ডুলামের মত।

ঝুঁকে মাইকটা ফের ধরতে চাইল মার্লো, দোল খেয়ে সরে গেল ওটা। আরেকটু ঝুঁকল সে, আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছে। দোল খেয়ে নাগালের ভেতর আসতেই আঙুল ভাঁজ করল, আটকে গেল কর্ড। তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে মাইকটা টেনে নিল মুখের কাছে।

আর তখুনি উইণ্ডশিল্ডে চোখ পড়ল তার। চরম হতাশায় লক্ষ করল, মেঘের দল সরে গেছে সেখান থেকে… তার বদলে লাফ দিয়ে উঠে আসছে আটলান্টিকের উত্তাল কালো পানি।

অধ্যায় ১ / ৫২

সকল অধ্যায়

১. ধ্বংসযজ্ঞ – ১
২. ধ্বংসযজ্ঞ – ২
৩. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩
৪. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪
৫. ধ্বংসযজ্ঞ – ৫
৬. ধ্বংসযজ্ঞ – ৬
৭. ধ্বংসযজ্ঞ – ৭
৮. ধ্বংসযজ্ঞ – ৮
৯. ধ্বংসযজ্ঞ – ৯
১০. ধ্বংসযজ্ঞ – ১০
১১. ধ্বংসযজ্ঞ – ১১
১২. ধ্বংসযজ্ঞ – ১২
১৩. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৩
১৪. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৪
১৫. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৫
১৬. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৬
১৭. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৭
১৮. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৮
১৯. ধ্বংসযজ্ঞ – ১৯
২০. ধ্বংসযজ্ঞ – ২০
২১. ধ্বংসযজ্ঞ – ২১
২২. ধ্বংসযজ্ঞ – ২২
২৩. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৩
২৪. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৪
২৫. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৫
২৬. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৬
২৭. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৭
২৮. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৮
২৯. ধ্বংসযজ্ঞ – ২৯
৩০. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩০
৩১. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩১
৩২. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩২
৩৩. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৩
৩৪. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৪
৩৫. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৫
৩৬. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৬
৩৭. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৭
৩৮. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৮
৩৯. ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৯
৪০. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪০
৪১. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪১
৪২. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪২
৪৩. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৩
৪৪. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৪
৪৫. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৫
৪৬. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৬
৪৭. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৭
৪৮. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৮
৪৯. ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৯
৫০. ধ্বংসযজ্ঞ – ৫০
৫১. ধ্বংসযজ্ঞ – ৫১
৫২. ধ্বংসযজ্ঞ – ৫২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন