কাছে থেকে দেখা – পল্লব মিত্র

হুগলির জনাই-বাকসা গ্রামে মামার বাড়িতে সুধীরকুমার মিত্রের জন্ম ৫ জানুয়ারি ১৯০৯-এ। পৈতৃকভিটা হুগলিরই জেজুরে। মা রাধারানি দেবী, বাবা আশুতোষ মিত্র। সুধীরকুমারের বিদ্যায়তনিক শিক্ষা গ্রামের পাঠশালাতে শুরু হলেও ১৯১৮-তে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে এসে ভরতি হন। জীবিকার কারণে আশুতোষ মিত্র তখন সপরিবার কলকাতার দর্জিপাড়ার কাছে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে বাস করেন। ১৯২৬-এ এন্ট্রান্স পাশ করে সুধীরকুমার স্কটিশ চার্চ কলেজে আই. এসসি. ক্লাসে ভরতি হন, পরে এই কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হন। শহরবাসী হয়েও জন্মভিটার সঙ্গে সম্পর্ক যে ছেড়ে যায়নি, বোঝা যায় ১৯৩৫-এ তাঁর জেজুরের মিত্র বংশ রচনা প্রকাশের মধ্যে। হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ-এর জন্য তিনি স্মরণীয় হলেও, এই রচনার পূর্বপাঠ যেন জেজুরের মিত্র বংশ। নিজের পরিবার কেন্দ্র করে অঞ্চলচর্চার ধারায় জেজুরের মিত্র বংশ সম্ভবত অন্যতম। উল্লেখ থাকুক, এই সময়েই (১৯৩২-৩৩) দলিত-হরিজন-জাতপাত বিষয়ে সাময়িক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন, যদিও গান্ধী-বাক্য মান্য করে শেষাবধি সে-পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি, আর গান্ধীজির হরিজন পত্রিকার প্রকাশ ১৯৩৫ নাগাদ। দেখা যায়, বিশ শতকের গোড়ায় প্রথম বঙ্গভঙ্গের পর পর বাংলা ভাষায় অঞ্চলচর্চা ক্রমশ ত্বরান্বিত হতে থাকে, এই কার্যক্রমের অনেকেই প্রথাগত ইতিহাস শাস্ত্রের শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে আসেননি। বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে বাংলা প্রদেশ তার রাজনৈতিক অস্তিত্বের স্বরূপসন্ধানী হয়ে ওঠে, অসংখ্য শহিদের আত্মদানের ফলে এযাবৎকালের শ্যামল মাটির কোলের ধারণা বদলে গিয়ে রাজনৈতিক সত্তার চেহারায় দেখা দেয়। এই ‘স্বদেশী’ রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্যতম ছিল দেশ জানা, আত্মশনাক্তকরণের পাঠ, চেতনার সম্বল সন্ধান—বাংলা ভাষায় অঞ্চলচর্চার সময়সূচনা মনে হয় এই ‘স্বদেশী’ রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্তর্গত। সুধীরকুমারদের কাছে দেশ-ইতিহাস বা অঞ্চলচর্চার এক স্বীকৃত মডেল ছিল সাহেব-শাসকদের লেখা গেজেটিয়ারগুলো। প্রশাসনিক ইতিহাস হিসেবে সেইসব গেজেটিয়ারের মাধ্যমে ‘দেশ’ জানতেন সাহেব-প্রশাসকরা, যাদের কাছে দেশ রাজ্য বা জেলায় বিভক্ত প্রশাসনিক ইউনিট; নিজের সঙ্গে, নিজের যাপনের সঙ্গে সব সম্পর্করহিত দূরতর এক অস্তিত্ব। বাংলা ভাষায় অঞ্চলচর্চায় সাহেবদের তৈরি এই গেজেটিয়ার আদিকল্পের সমান্তরালে নিজস্ব স্বরসন্ধানী হয় চর্চাকারীরা। সংগ্রহশালা তৈরি, পুথি সংগ্রহ, গবেষণা পরিষদ গঠন, পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে আত্মশনাক্তকরণের সব চিহ্ন, আত্মনির্মাণের সম্বল অর্জন করতে চাইছিলেন তাঁরা। ততদিনে সমাজ ও গ্রামসমাজ বিভাজনরেখা স্পষ্টতর হয়ে আসছে—সভ্যতা, সমাজ ততদিনে শহর-নির্ধারিত : ছেড়ে-আসা গ্রামে ফিরে গিয়ে আবাল্যের চিহ্নসন্ধানী হতে হয়, নিজ বাসভূম ক্রমশই এক দূরতর স্মৃতি। অঞ্চলচর্চায় স্মৃতি তাই বড়ো জায়গা নেয়/নিতে পারে, স্মৃতি ইতিহাসেরই স্থলাভিষিক্ত—স্পন্দিত এককালের জীবন তখন অক্ষর-আশ্রিত। সুধীরকুমার একা নন, এভাবেই তাঁদের সবাই নিজের বচনে ভিতরের কথা লিখেছেন—যে মাঠে-ঘাটে, পুকুরপাড়ে, অশত্থ-বটের ছায়ায়, দেবদেউলে, পার্বণে, পূজায়, উৎসবে, বাপ-দাদা-পরদাদা-মায়ের কাহিনি-কথায়, রৌদ্রে-জলে স্বেদসিক্ত শ্রমে, আবার অপমানে, লাঞ্ছনায়, দুঃখে তাদের জীবন জড়িয়ে ছিল এই অন্তঃস্থ প্রেরণায় ও বোধে গেজেটিয়ারের বাইরে সেই প্রকরণ-পদ্ধতিতে অগ্রাহ্য না-করেই অস্বীকারের আর-এক জীবনবৃত্তান্ত রচনা করেছিলেন এই পূর্বজরা। আমরা একে ইতিহাস হিসেবে বুঝতে চেয়েছি। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন সুধীরকুমার, সময়-আধারে দেশ তাঁর কাছে প্রাণময় সত্তা; শাস্ত্রীয় বিধিতে ইতিহাস কী তিনি তা বুঝতে চাইছেন না, দলিল-দস্তাবেজ-আকরসূত্রকেও অবান্তর প্রান্তিক করে দিচ্ছেন না, তাঁর কাছে অঞ্চলচর্চা দেশ-নিরপেক্ষ অন্য কোনো ভৌগোলিক খোঁজ নয়, স্মৃতি-মানুষ-ঘটনার সম্মেলকে নিজের সময়ের মধ্য থেকে সময়ান্তরের ‘ইতিহাস’ বুঝতে চেয়েছিলেন। এতটুকুই—কোনো বড়ো প্রকল্প নয়—এভাবেই তিনি লিখেছিলেন। যে-সময়, যে-কথা তাঁর কাছে অস্তিত্বময়, তাকে তার আত্মশনাক্তকরণের জোর দিয়েছিল, স্বেচ্ছায় তিনি সেই পথে পরিব্রাজকের ব্রত নিয়েছিলেন। পূর্বজ তিনি, এই সামান্যটুকু তো দাবি করতেই পারেন।

[১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ প্রাকশতবর্ষ স্মরণ পুস্তিকা-য় প্রকাশিত]

সকল অধ্যায়

১. বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা – রমাকান্ত চক্রবর্তী
২. বাংলার মন্দির-টেরাকোটা – ইন্দ্রজিৎ চৌধুরি
৩. বাংলার মন্দিরগাত্রচিত্র – অঞ্জন সেন
৪. কুলুজি বৃত্তান্তে ইতিহাসের উপাদান – তারাপদ সাঁতরা
৫. বঙ্গে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা প্রসঙ্গে – ড. গোপীকান্ত কোঙার
৬. আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : হাওড়া – শিবেন্দু মান্না
৭. আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : বর্ধমান – বারিদবরণ ঘোষ
৮. আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা – মৃত্যুঞ্জয় সেন
৯. আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : মুর্শিদাবাদ – প্রকাশদাস বিশ্বাস
১০. আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : বীরভূম – পার্থশঙ্খ মজুমদার
১১. নদিয়া মাঝারে অগ্রদ্বীপ একনাম – বারিদবরণ ঘোষ
১২. আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : বাঁকুড়া – শেখর ভৌমিক
১৩. পুরোনো কলকাতার জনগোষ্ঠী : একটি রূপরেখা – দেবাশিস বসু
১৪. আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : হুগলি – বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫. আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : উত্তর চব্বিশ পরগনা – কানাইপদ রায়
১৬. পুরুলিয়ার মন্দির স্থাপত্য – দীপকরঞ্জন দাশ
১৭. অখন্ড মেদিনীপুরের পুরাকীর্তি – তারাপদ সাঁতরা
১৮. গ্রামগবেষণার পথিকৃৎ – নিশীথরঞ্জন রায়
১৯. আঞ্চলিক ইতিহাসের পুরোধা ব্যক্তিত্ব – প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র
২০. জন্মশতবর্ষে সুধীরকুমার – তপন রায়চৌধুরি
২১. অন্তরতর গবেষক – ভবেশ দাস
২২. সুধীরকুমারের জীবন ও ইতিহাসচর্চা – সৌমিত্রশংকর সেনগুপ্ত
২৩. কাছে থেকে দেখা – পল্লব মিত্র
২৪. Tarakeshwar and Its History – Rajat Kanta Roy
২৫. History and Culture Nishith – Ranjan Roy
২৬. ইতিহাস রচনায় সুকীর্তি – শক্তিপ্রসাদ রায়শর্মা
২৭. সুধীরকুমার মিত্রের স্থাপত্য ভাবনা – মণিদীপ চট্টোপাধ্যায়
২৮. বাঙালির দেব-দেবী প্রসঙ্গ – অর্ধেন্দু চক্রবর্তী
২৯. শ্রীচৈতন্যদেবের পথ ধরে – দেবব্রত মল্লিক
৩০. পত্রপত্রিকার আলোকে – নজরুল সুনীল দাস
৩১. ইতিহাস সমাজ সংস্কৃতি – মনীষা রক্ষিত
৩২. অতীত যখন কথা বলে – পার্থ গুহবক্সী
৩৩. সুধীরকুমার মিত্রের গিরিশচন্দ্র মুগ্ধতা – অরুণ মুখোপাধ্যায়
৩৪. অঞ্চলচর্চা বিষয়ক নির্বাচিত গ্রন্থ-তালিকা – অশোককুমার রায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন