কাশীধাম – ৯

নারায়ণ সান্যাল

পুব আকাশে আলো ফুটছে। চিহ্নিত সময়কালের আর একটি দিন শেষ হল। সমস্ত রাত্রি চিন্তা করেও শেষ সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।

—রূপমতী বনাম সত্যবতী!

কে ওঁর আদর্শ? রূপমতীর পথ সহজ, সরল। যে মুক্তিপথকে এই দুদিন আগেও বলেছেন ‘হস্তামলকবৎ’! সে মৃত্যু ওঁর হাতের মুঠোয়। চৈতালী পূর্ণিমার চন্দ্রোদয়ের আগে! রূপমতী পেরেছে, সত্যবতীর মা-দিদি-বৌদি পেরেছে! বর্গীর আক্রমণে কোন কোন গাঁয়ের আনপড় মেয়েরা দলে-দলে পেরেছে। এক এক পাতকুয়ায় দশ বিশটি যুবতী নারী। বর্গী দানবেরা তাদের ধর্মনষ্ট করতে পারেনি। সেই সহজ সরল পথটা বেছে নিয়েছিলেন বলে এতদিন নিশ্চিন্ত ছিলেন।

কিন্তু আজ যে স্বপ্নাদেশে সব কিছু গুলিয়ে গেল!

ওঁর আদর্শ রূপমতী নয়—সত্যবতী!

সেটা কি পারবেন?

‘বিনাশায়চ দুষ্কৃতাম্’ জগৎনিয়ন্তা যুগে যুগে ‘সম্ভব’ হন। কখনো পুরুষের বেশে, কখনো প্রকৃতির। হিরণ্যকশিপুর উদর বিদীর্ণ করতে যেমন তিনি তীক্ষ্ণনখরলঙ্কৃত নৃসিংহ, তেমনি মহিষাসুরকে বধ করতে তিনি আবির্ভূতা হয়েছিলেন অপরূপা মাতৃমূর্তিতে! কিন্তু সেসব সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর যুগেব কথা। কলিযুগে সে দৈবশক্তির আবির্ভাব হয় মরমানুষের শুভবুদ্ধিতে।

আজ তেমনই স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন! শহীদ হবার আহ্বান শুনেছেন। ‘শহীদ’ কে? যে দেশের জন্য, দশের জন্য, নিজের প্রাণ বলি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু ‘প্রাণ’ই কি মরমানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ? ‘ধর্ম’ কি তার চেয়েও বড় নয়? মানব সভ্যতার ইতিহাসে দেশে দেশে, কালে কালে কত কত শহীদ তো প্রাণ দিয়েছে—কিন্তু পৃথিবীর ভার লাঘব করতে ধর্ম দিতে পেরেছে কজন?

অত বড় দানবীর, অমন মহান দাতাকর্ণও তা দান করতে প্রস্তুত ছিলেন না—সব কিছু তিনি প্রদান করতে প্রস্তুত—প্রাণ পর্যন্ত; কিন্তু ঠেকে গেলেন ঐখানে : ‘আপন পৌরুষ আর ধর্ম’–তা তিনি দিতে অপারগ!

স্বপ্নাদেশে তাঁকে বলা হয়েছে—বেণীর সঙ্গে মাথা দেওয়া চলবে না। মাথা রেখে বেণীটুকু দিতে হবে!

কিন্তু কথাটা কি ঠিক?

সতীত্বই কি স্ত্রীলোকের সব চেয়ে বড় সম্পদ? ‘ধর্ম’ কি তার চেয়েও বড় নয়? ‘ধর্ম’ কি তাঁর এই নশ্বর নারীদেহের চৌহদ্দীতে সীমাবদ্ধ? কে বলে দেবে? কোন্ শাস্ত্ৰ? কোন্ পুরাণ, সংহিতা, কোন্ মহাকাব্যের অনুশাসন?

মনে পড়ে গেল পিতৃদেবের বহুব্যবহৃত গৌতম বুদ্ধের সেই অন্তিম বাণী :

আত্মদীপো ভব
আত্মশরণো ভব
অনন্যশরণো ‘ভব!

—নিজের বিবেকের নির্দেশে, আত্মদীপের আলোয় পথ খুঁজে নিও। পরের কথায় কান দিও না। তুমিই তোমার গুরু, তুমিই তোমার পথপ্রদর্শক!

কী দিচ্ছেন? কী পাচ্ছেন?

পাচ্ছেন স্বপ্নাদেশে প্রাপ্ত দৈব আদেশ পালনের তৃপ্তি। দেশের মঙ্গল, দশের মঙ্গল। সমগ্র কাশীধাম আজ চাইছে ঐ করাল রাহুগ্রাস হতে মুক্তি পেতে। তিনি স্বপ্নাদেশে আদিষ্ট হয়েছেন পৃথিবীর সেই পাপ স্খালন করতে।

কীসের বিনিময়ে?

নারীর ‘তথাকথিত’ সতীত্ব!

তিনি যদি সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় ধর্ষিতা হতে স্বীকৃতা হন, আর নিজ দেহে সেই যন্ত্রণা সহ্য করে সত্যবতীর মতো সাফল্য লাভ করেন, তবে শত শত মেয়ে রক্ষা পেয়ে যাবে। ঐ যাদের আগামী সপ্তাহে, আগামী মাসে, পরের বছরে মুখে ফেট্টি বেঁধে নিয়ে আসবে পুরন্দরের চেলা-চামুণ্ডার দল তার বাগানবাড়িতে। তাদের স্বামী আছে, পিতা আছে, সন্তান আছে, সংসার আছে। যার বিন্দুমাত্রও নাই হটী বিদ্যালঙ্কারের। তাদের সকলের হয়ে তিনি একা কেন পারবেন না ঐ মরণান্তিক দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করতে? তাদের বিনিময়ে ধর্ষিতা হতে? কেন পারবেন না সেই মরণান্তিক নিগ্রহ সহ্য করে ঐ পশুটাকে মায়ের যূপকাষ্ঠে বলি দিতে?

সিদ্ধান্তে এলেন হটী বিদ্যালঙ্কার—স্বেচ্ছায় তিনি ধর্ষিতা হবেন!

কিন্তু দুরন্ত অভিমানে ঝরঝরিয়ে কেঁদেও ফেললেন। পুব আকাশে তখন উদয়ভানুর আভাস। সেদিকে মুখ তুলে হঠাৎ তিনি পিতৃসম্বোধন করলেন। বললেন, আপনি আমাকে এই আদেশ দিলেন, কিন্তু কই ‘মা’কে তো তা বলেননি? তাহলে তাঁর আঁচলে বিষ বেঁধে দিয়েছিলেন কেন?

.

আমি ক্ষমা চাইছি।

ভুল হয়ে গেল দিদিভাই! তোমাদের এখনো বলাই হয়নি হটী বিদ্যালঙ্কারের বাবার কথা, মায়ের কথা। তাঁর বাল্যকালের কথা!

ব্যাপারটা কী জান বোনটি? ওখানেই তোমাদের সঙ্গে আমার ফারাক। কথা-সাহিত্য একটা যোগের সাধনা—পাঠিকা-পাঠকের সঙ্গে লেখকের যোগ। তোমাদের সঙ্গে রাখীবন্ধনের উৎসবে যোগ দিতেই তো বসেছি। কিন্তু ঠিক এক সমতলে বসিনি। বসা যায় না। প্ৰথম পংক্তিতে কবি যখন বর্ণনা করতে বসেন—তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের চেহারা ভূতের মতন; সে অতি ঘোর নির্বোধ, কবিপত্নীর ধারণা সে ক্রমাগত চুরি করে যাচ্ছে, তখন সেই ‘বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি’র কাণ্ড-কারখানায় আমরা হাসছি—কিন্তু সেই প্রথম পংক্তি রচনা কালেও কবির চোখদুটি অশ্রুসজল! তিনি জানেন, ঐ পুরাতন ভৃত্যটি তাঁর জন্য অন্তিমে প্রাণ দেবে। সে তথ্যটা তুমি-আমি জানি না, কিন্তু তাঁর জানা!

এই যে ‘হটী বিদ্যালঙ্কার’—না সোঞাই গ্রামের বাস্তব মহাপণ্ডিতা নয়, আমি অযোধ্যার শ্রীরামের কথা এখন বলছি না, বলছি আমার মনোভূমির রামের কথা—তাঁর সব কিছু যে আমার জানা। তিনি প্রাণ দেবেন, না সতীত্ব-ধর্ম, কী তাঁর পরিণাম—সব জেনে-বুঝে আমি লিখতে বসেছি। তোমরা আসনপিঁড়ি হয়ে বসেছ, জান না এবার আমি তোমাদের পাতে কী পরিবেশন করব—নিম-বেগুন, না পরমান্ন!

কী বললে? আমি কেমন করে জানলাম?

না দিদিভাই, বাস্তব হটী বিদ্যালঙ্কারের সব কিছু জানতে পারিনি, জানি না তাঁর জন্ম তারিখ, বাবার বা মায়ের নাম। তাঁর তিরোধান 1810—কাশীতে, প্রায় সত্তর বছর বয়সে—তাই আন্দাজে বলেছি তাঁর জন্ম 1742 এর কাছাকাছি। জন্মস্থান : বর্ধমান, সোঞাই।

ইতিহাসকে জিজ্ঞাসা করেছি। তার মনে নেই।

জাতীয় গ্রন্থাগারকে প্রশ্ন করেছি। সে বলেছে খুঁজে নাও—এ গন্ধমাদনে তোমার বিশল্যকরণী আছে কি নেই তার আমি কী জানি!

জানতে চেয়েছি মহাকালের কাছে। উল্টে ধমক খেতে হয়েছে। সত্যই তো, তার জাব্‌দা-খাতায় যে ‘হোমো স্যাপিয়ান’-এর আগের খবরও লিখতে হয়েছে। সে কেমন করে দেবে সোঞাই গাঁয়ের সেই ডাগরচোখো কিশোরীর সন্ধান?

না, মহামহিমময়ী সেই বাস্তব হটী বিদ্যালঙ্কারের কথা বলছি না। বলছি না হটু বিদ্যালঙ্কারের কথাও। তাঁরা দুজনেই তো আমার মা! বলছি আমার ছোট্ট পাগলি মেয়েটার কথা। আমার মনের কোণের এই সোঞাই গাঁয়ে নতুন করে যে জন্মেছে। তিল-তিল করে যে বর্ধমান, বেড়ে উঠছে, তার কথা বলছি। ঘুম- না—আসা রাতে যে এসে আমাকে ইতিমধ্যেই চুপিচুপি বলে গেছে তার সব কথা, স—ব কথা! তার আনন্দের কথা, বেদনার কথা, তার প্রাপ্তি আর বঞ্চনা। তোমাদের সে-কথাই তো শোনাতে বসেছি।

তাই এ জাতের ভুল হয়ে যাচ্ছে। তোমরা তো এখনো জানই না হটীর পিতৃদত্ত নামটা কেন ‘রূপমঞ্জরী’!

বাপের দেওয়া নাম। বাবা মহাপণ্ডিত। চমৎকার নামটি বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর নিজের নাম ‘রূপেন্দ্রনাথ’, স্ত্রীর নাম ‘কুসুমমঞ্জরী’। দুজনে মিলে সৃষ্টি করেছিলেন ঐ মেয়েটিকে : ‘রূপমঞ্জরী’।

না! আবার ভুল হল। হটী বিদ্যালঙ্কারের নামটা তাঁর পিতৃদেব দেননি। সে-কথা সবাই জানে না। আসলে নামকরণ করেছিলেন সেযুগের শ্রেষ্ঠ মহাকবি! সেসব কথা শুধু আমার মনেই আছে। আমাকে লিখতে হবে, এখনো তোমাদের বলা হয়নি!

গল্পের ধরতাইটা ধরতে হলে আপাতত নোঙর তোল,দিদিভাই! অনেক-অনেকটা পথ উজান ঠেলে যেতে হবে।

আমাদের কাহিনী শুরু হয়েছিল 1774 খ্রীষ্টাব্দে। পলাশীর যুদ্ধের সতের বছর পরে। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর উজান ঠেলে আমাদের কেঁচে-গণ্ডূষ করতে হবে।

আমরা আবার নতুন করে শুরু করব রাঢ়খণ্ডে। রূপেন্দ্রনাথের জন্ম-বৎসর থেকে। সেটা 1717 খ্রীষ্টাব্দ।

সকল অধ্যায়

১. কাশীধাম – ১
২. কাশীধাম – ২
৩. কাশীধাম – ৩
৪. কাশীধাম – ৪
৫. কাশীধাম – ৫
৬. কাশীধাম – ৬
৭. কাশীধাম – ৭
৮. কাশীধাম – ৮
৯. কাশীধাম – ৯
১০. সোঞাই – ১
১১. সোঞাই – ২
১২. সোঞাই – ৩
১৩. সোঞাই – ৪
১৪. সোঞাই – ৫
১৫. সোঞাই – ৬
১৬. সোঞাই – ৭
১৭. সোঞাই – ৮
১৮. সোঞাই – ৯
১৯. সোঞাই – ১০
২০. সোঞাই – ১১
২১. সোঞাই – ১২
২২. সোঞাই – ১৩
২৩. সোঞাই – ১৪
২৪. সোঞাই – ১৫
২৫. সোঞাই – ১৬
২৬. সোঞাই – ১৭
২৭. সোঞাই – ১৮
২৮. সোঞাই – ১৯
২৯. সোঞাই – ২০
৩০. সোঞাই – ২১
৩১. সোঞাই – ২২
৩২. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১
৩৩. তীর্থের পথে – ১
৩৪. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ২
৩৫. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৩
৩৬. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৪
৩৭. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৫
৩৮. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৬
৩৯. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৭
৪০. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৮
৪১. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৯
৪২. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১০
৪৩. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১১
৪৪. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১২
৪৫. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৩
৪৬. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৪
৪৭. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৫
৪৮. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৬
৪৯. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৭
৫০. তীর্থের পথে – ২
৫১. তীর্থের পথে – ৩
৫২. তীর্থের পথে – ৪
৫৩. তীর্থের পথে – ৫
৫৪. তীর্থের পথে – ৬
৫৫. তীর্থের পথে – ৭
৫৬. তীর্থের পথে – ৮
৫৭. তীর্থের পথে – ৯
৫৮. তীর্থের পথে – ১০
৫৯. তীর্থের পথে – ১১
৬০. তীর্থের পথে – ১২
৬১. তীর্থের পথে – ১৩
৬২. তীর্থের পথে – ১৪
৬৩. তীর্থের পথে – ১৫
৬৪. তীর্থের পথে – ১৬
৬৫. তীর্থের পথে – ১৭
৬৬. তীর্থের পথে – ১৮
৬৭. ১. ভাগীরথী
৬৮. ২. শান্তিপুর
৬৯. ৩. ফুলিয়া
৭০. ৪. রণারঘাট
৭১. ৫. চক্ৰদহ – প্রদ্যুম্ননগর
৭২. ৬. যশোড়া – কাঞ্চনপল্লী
৭৩. ৭ বংশবাটি
৭৪. ৮. ত্রিবেণী
৭৫. ৯. কুমারহট্ট
৭৬. ১০. নৈহাটি
৭৭. ১১. ভাটপাড়া
৭৮. ১২. মূলাজোড়
৭৯. ১৩. ডিহি-কলিকাতা
৮০. ১৪. পাথুরিয়াঘাটা
৮১. ১৫. মাহেশ
৮২. ১. বঙ্গদেশ
৮৩. ২. সপ্তগ্রাম
৮৪. ৩. হুগলী
৮৫. সতী – 1742-57 – ষষ্ঠ পর্ব

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন