সোঞাই – ৭

নারায়ণ সান্যাল

গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সংবাদটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল : ব্রজসুন্দরী অন্তর্জলিযাত্রায় যাচ্ছেন!

সোঞাইয়ের কাছে-পিঠে গঙ্গা নাই। গ্রামটি দামোদরের প্রসাদধন্য। গঙ্গাতীরে উপনীত হবার দুটি বিকল্প পথ। স্থলপথে অথবা জলপথে। ডুলি নিয়ে সড়ক ধরে যদি এগিয়ে যাও গলসি, বর্ধমান, মন্তেশ্বর হয়ে মহাতীর্থ নবদ্বীপধামে উপনীত হবে পাঁচদিনের মাথায়। দ্বিতীয়ত জলপথ। সময় হয়তো কিছুটা বেশি লাগবে। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রীর পক্ষে সেটা আরামদায়ক। নৌকায় ঝাঁকি কম। সে পথ প্রথমে সিধা উত্তরমুখো। দামোদর পার হয়ে উত্তর-মুখো চলতে থাকলে পৌঁছাবে অজয়ের তীরে। নৌকা পাবে সেখানে। চলতে থাক পূর্বাভিমুখে। পথে পড়বে ইলামবাজার। জয়দেব-কেন্দুবিশ্বের কাছাকাছি। তারপর মঙ্গলকোট, কাটোয়া। এই কাটোয়াতে অজয় বিলীন হয়েছে গঙ্গায়। রোগীর অবস্থা যদি ইতিমধ্যে সঙ্গীন হয়ে উঠে থাকে, তাহলে নবদ্বীপে যাওয়ার চেষ্টা কর না। কাটোয়ার গঙ্গাতীরেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সব কিছু পাবে সেখানে—হরিসংকীর্তনের দল থেকে চন্দন কাঠ। আর তখনো যদি রোগীর পার্থিব বন্ধন ছিন্ন হবার মুহূর্তটি আসন্ন না হয়ে থাকে, তবে এবার গঙ্গা বেয়ে দক্ষিণাভিমুখে চলতে পার। অচিরেই উপনীত হবে শ্রীচৈতন্য-পদরজধন্য নবদ্বীপধামে। স্থির হয়েছে ওঁরা নদীপথেই যাবেন। কাটোয়া অথবা নবদ্বীপ? সেটা—‘ক্ষেত্রে কর্ম বিধিয়তে’। রোগীর অবস্থা বুঝে

সেই মতো যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাড়ম্বরে শেষযাত্রার আয়োজনে সবাই ব্যস্ত। শুধুমাত্র রোগিণী একা গেলেই তো চলবে না—যেতে হবে বৃদ্ধার একমাত্র পুত্র তারাপ্রসন্নকে না হলে, মুখাগ্নি করবে কে? এমনকি যেতে হবে স্বয়ং জমিদার-মশাইকেও। না হলে, অন্তিম মুহূর্তে সতীসাবিত্রীর ওষ্ঠাধরে পতিদেবতার পাদোদকটুকু দেওয়া যাবে কী ভাবে?

এল ডুলি, পালকি, সারি সারি গোযান। গো-গাড়িতে যাবে মালপত্র। অনেক আগেই রওনা হবে তারা স্থলপথে। পথে চোর-ডাকাতের ভয় নাই। নবাব আলিবর্দীর সুবন্দোবস্তে সমগ্ৰ রাজ্যে শান্তি বিরাজিত। তবু আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে সঙ্গে যাবে পাইক বরকন্দাজ। যাত্রা-মুহূর্তটি সুচিহ্নিত। রওনা হতে হবে কৃষ্ণা তৃতীয়ার সূর্যোদয়-মূহূর্তে। পঞ্জিকা দেখে যাত্রা-মুহূর্তটি নির্ধারণ করে দিয়েছেন স্বয়ং বাচস্পতি। কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি ভাদুড়ী মশায়ের কুলগুরু। প্রতিটি মোচ্ছবেই তাঁর শুভাগমন ঘটে। দোল, দুর্গোৎসব, পুণ্যাহে। এবারও সংবাদ পেয়ে এসেছেন। বিধানটা তাঁরই—ঐ অন্তর্জলিযাত্রা। গ্রহ সংস্থান ও কোষ্ঠি বিচার করে উনি সিদ্ধান্তে এসেছেন তিন-চার সপ্তাহ পরে—ঐ পূর্ণিমার কাছাকাছি পঢ়াকাশ ঘটাকাশে আর ফারাক থাকবে না। পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্তি পাবেন ব্রজসুন্দরী। গুরুদেব অন্তর্জলিযাত্রার দলে যাচ্ছেন না। গৃহলক্ষ্মীকে রওনা করে দিয়ে তিনি যজ্ঞ করতে বসবেন। অনির্বাণ শিখায় জ্বলতে থাকবে হোমাগ্নি। যতদিন না সংবাদ আসে গঙ্গাতীরে জীবাত্মা বিলীন হয়ে গেছে পরমাত্মায়। এ জন্য গুরুদেব দ্বাদশটি ব্রাহ্মণ শিষ্য সমভিব্যাহারে এসেছেন। যাতে অহোরাত্র যজ্ঞে কোনও ব্যত্যয় না হয়। অপরিসীম দার্ঢ্যে বাচস্পতি ঘোষণা করেছেন—এ মহাযজ্ঞ অমোঘ! অব্যর্থ! কোন যমদূতের পিতৃদেবেরও দুঃসাহস হবে না সতীলক্ষ্মীর পুষ্পকরথের সম্মুখে এসে পথ রুখতে। গঙ্গাতীর থেকে পুষ্পকরথ না থেমে সোজা চলে যাবে খাশ বৈকুণ্ঠলোক—

গোঘ্নাবাপি চ চণ্ডালো দুষ্টো দুষ্টচেতনঃ।
বালঘাতী তথাহবিদ্বান্ ম্রিয়তে তত্র বৈ যদা।।

গো-হত্যার পাপ, শিশু হত্যার পাপও এই হোমাগ্নিশিখায় পুড়ে খাক হয়ে যায় যে! চণ্ডাল, শঠ, দুষ্টচেতা, বিদ্বান, মূর্খ কোন বাছবিচার নেই—যজ্ঞান্তে পূর্ণাহুতির অবসানে যজমান লাভ করে বৈকুণ্ঠধামের অধিকার। ব্রজসুন্দরী এমনিতেই পুণ্যাত্মা, সতীলক্ষ্মী—তাঁর অক্ষয় বৈকুণ্ঠবাস ঠেকায় কোন ‘ইয়ে’। জমিদার বাড়ির ‘মাচিঘর’ অর্থাৎ ভাণ্ডার থেকে আড়াই মণ গব্যঘৃত বার করে দিয়েছে গোমস্তা। সোজা কথা! যমদূত তো ছাড়, তার চৌদ্দপুরুষ এ দিগড়ে ভিড়বে না! আড়াই মণ গব্য ঘৃত! সোজা ‘কতা’?

শুধু সোঞাই বা পঞ্চগ্রামেই নয়, পুণ্যাত্মা মহিলা হিসাবে—দেবীর অংশ হিসাবে, ব্রজসুন্দরীর খ্যাতি দূর-দূরান্তে প্রসারিত। পাকা চুলে কুলীনের ঘরে অসপত্ন অধিকারে সংসার করে গেলেন দেড়কুড়ি বছর! সেটাই একটা দুর্লভ ব্যতিক্রম। তাছাড়া, তাঁর স্বামীর ঐশ্বর্য কুবেরীর্ষিত, প্রতাপ ইন্দ্রের মতো আর দাম্পত্য জীবনের একমুখিনতা শ্রীরামচন্দ্রের মতো। এমন সৌভাগ্যশীলা, ভাগ্যবতী কে কোথায় দেখেছে?

কিন্তু সেজন্যই শুধু নয়, ব্রজসুন্দরীর উপর দেবীত্ব আরোপিত হয়েছিল আর একটি অলৌকিক ঘটনায়। অবিশ্বাসীরা তার লৌকিক ব্যাখ্যা দেবার অপচেষ্টা যে না করে তা নয়—বলে, এ নিতান্তই কাকতালীয়। কিন্তু যারা ভগবৎ-বিশ্বাসী তারা বুঝতে পারে ‘এহ বাহ্য, আগে কহ আর।’

সে অনেক-অনেক দিন আগেকার কথা। ব্রজসুন্দরী তখন পঞ্চবিংশতিবর্ষীয়া। একটি মাত্র সন্তানের জননী—তারাপ্রসন্ন।

কৃষিনির্ভর অঞ্চল। আর কৃষকের ভাগ্য বৃষ্টির সময় ও পরিমাণের সঙ্গে অচ্ছেদ্যবন্ধনে আবদ্ধ। দু-পাঁচ-দশ বছর পর পর আসে ‘আকাল’—অনাবৃষ্টি। অনাবৃষ্টি মানে অনাসৃষ্টি। মা ধরিত্রীর বুক চৌচির হয়ে যায়। দিগন্তজোড়া মাঠ খাঁ-খাঁ করতে থাকে। তৃণগুল্ম পর্যন্ত নিঃশেষিত। গোচারণ ভূমি সব ব্রহ্মডাঙার মাঠ। শুরু হয় প্রথমে গো-মড়ক! তাতে লাভবান হওয়ার কথা বায়েন পরিবারের; কিন্তু তারাও যুক্তকরে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানায়—এমন সৌভাগ্য যেন না আসে। সে দৃশ্য চোখ চেয়ে দেখা যায় না। আকাশের কোণে কোণে কালো মেঘের বদলে সঞ্চরমাণ শকুন! মাথায় হাত দিয়ে বসে চাষীভাই। ইলামবাজার, বর্ধমান, খাশ মুর্শিদাবাদে ক্রীতদাসের দাম হু-হু করে পড়তে থাকে। দলে দলে গ্রামের মানুষ চলতে থাকে শহর গঞ্জের দিকে। এক ধামা মুড়ির বিনিময়ে তাদের পরিবার থেকে নির্বাচন করে নিতে পার যে কোন যৌবনবতীকে। যাকে মনে ধরে! ক্রীতদাসী! আমৃত্যু না হলেও, আযৌবন তারা নিত্য-সেবায় খাড়া থাকবে।

সেই আকালের বৎসরে গ্রামের মানুষ শিবের দোরে ‘হত্যা’ দেয়। মানত করে। মায়ের থানে জোড়া পাঁঠা বলি দেয়। শেষমেশ ব্যাঙের বিয়ে। তাতেও বৃষ্টি না নামলে অন্তিম প্রচেষ্টা—সার্বজনীন ‘পর্যন্তদেবের’ পূজা।

‘পর্যন্তদেব’ এক লৌকিক দেবতা। হিন্দুর তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে তাঁর নামটা যে কোন পুরাণে লেখা আছে তা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি বটে, তবে শিরোমণি-মশাই বলেন আছে, নিশ্চয় আছে। না হলে আবহমানকাল ধরে আকালের বছর তাঁরে স্মরণ করা হয় কেন? আর মনে করে দেখ; বাবা-সকল—তাঁর কৃপাতেই শেষমেশ বর্ষা নামে।

ব্যুৎপত্তিগত অর্থটাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন শিরোমণি মশাই, নামটির অর্থ বুঝলি তো? ওনার বাস মানুষের শেষ সহ্য সীমান্তে। ‘আকাল’ মানে দেবতার রোষ। কোন কিছু অন্যায় হয়েছে—অজান্তে—মানে সবাই তা টের পায়নি। তাই এই অনাবৃষ্টির অনাসৃষ্টি। সহ্য কর তোমরা। তারপর শেষ সীমান্তে পৌঁছে দেবতাকে বল : আর পারবনি বাবা! আমাদের সইবার ক্ষ্যামতা এই পর্যন্ত! তখনই ‘পর্যন্ত’ দেবের পূজা করতে হয়। বৃষ্টি নামে। পর্যন্তদেবের গায়ের রঙটি নিকষ কালো—নীলের আভা। চতুর্ভুজ—বরাভয়, লক্ষ্মীর ঝাঁপি আর বজ্র।

দু-দশ বছর বাদে—আকালের বছরে—এ অঞ্চলে পর্যন্তদেবের সার্বজনীন পূজা হয়। রূপেন্দ্রনাথ তর্কপঞ্চাননকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন : ‘পর্যন্তদেব’-এর বর্ণনা কোন পুরাণে আছে। আদ্যোপান্ত শুনে সেই মহাপণ্ডিত বলেছিলেন, আমার মনে হয়, এই লৌকিক দেবতাটি

অর্বাচীন নয়। সম্ভবত পুরাকালে তাঁর নাম ছিল : পর্জন্যদেব! শব্দটা. লোক মুখে ‘পর্যন্তদেব’ হয়ে গেছে; পর্জন্য একজন বৈদিক দেবতা। তাঁর গাত্রবর্ণ ঘন নীল, হাতে বজ্ৰ মেঘ দিয়ে তিনি অন্তরীক্ষব্যাপ্ত করেন। ঋগ্বেদে তাঁর নামে তিনটি সূক্ত আছে।

পঞ্চম মণ্ডলের ত্র্যশীতিতম সূক্তের দ্রষ্টা অত্রিপুত্র ভৌম ঋষি, ছন্দ : ত্রিষ্টুপ এবং দেবতা : পর্জন্যদেব। গীতাতেও আছে: ‘পর্জন্যাৎ অন্নসম্ভবঃ’!

সকল অধ্যায়

১. কাশীধাম – ১
২. কাশীধাম – ২
৩. কাশীধাম – ৩
৪. কাশীধাম – ৪
৫. কাশীধাম – ৫
৬. কাশীধাম – ৬
৭. কাশীধাম – ৭
৮. কাশীধাম – ৮
৯. কাশীধাম – ৯
১০. সোঞাই – ১
১১. সোঞাই – ২
১২. সোঞাই – ৩
১৩. সোঞাই – ৪
১৪. সোঞাই – ৫
১৫. সোঞাই – ৬
১৬. সোঞাই – ৭
১৭. সোঞাই – ৮
১৮. সোঞাই – ৯
১৯. সোঞাই – ১০
২০. সোঞাই – ১১
২১. সোঞাই – ১২
২২. সোঞাই – ১৩
২৩. সোঞাই – ১৪
২৪. সোঞাই – ১৫
২৫. সোঞাই – ১৬
২৬. সোঞাই – ১৭
২৭. সোঞাই – ১৮
২৮. সোঞাই – ১৯
২৯. সোঞাই – ২০
৩০. সোঞাই – ২১
৩১. সোঞাই – ২২
৩২. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১
৩৩. তীর্থের পথে – ১
৩৪. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ২
৩৫. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৩
৩৬. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৪
৩৭. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৫
৩৮. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৬
৩৯. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৭
৪০. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৮
৪১. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৯
৪২. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১০
৪৩. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১১
৪৪. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১২
৪৫. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৩
৪৬. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৪
৪৭. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৫
৪৮. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৬
৪৯. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৭
৫০. তীর্থের পথে – ২
৫১. তীর্থের পথে – ৩
৫২. তীর্থের পথে – ৪
৫৩. তীর্থের পথে – ৫
৫৪. তীর্থের পথে – ৬
৫৫. তীর্থের পথে – ৭
৫৬. তীর্থের পথে – ৮
৫৭. তীর্থের পথে – ৯
৫৮. তীর্থের পথে – ১০
৫৯. তীর্থের পথে – ১১
৬০. তীর্থের পথে – ১২
৬১. তীর্থের পথে – ১৩
৬২. তীর্থের পথে – ১৪
৬৩. তীর্থের পথে – ১৫
৬৪. তীর্থের পথে – ১৬
৬৫. তীর্থের পথে – ১৭
৬৬. তীর্থের পথে – ১৮
৬৭. ১. ভাগীরথী
৬৮. ২. শান্তিপুর
৬৯. ৩. ফুলিয়া
৭০. ৪. রণারঘাট
৭১. ৫. চক্ৰদহ – প্রদ্যুম্ননগর
৭২. ৬. যশোড়া – কাঞ্চনপল্লী
৭৩. ৭ বংশবাটি
৭৪. ৮. ত্রিবেণী
৭৫. ৯. কুমারহট্ট
৭৬. ১০. নৈহাটি
৭৭. ১১. ভাটপাড়া
৭৮. ১২. মূলাজোড়
৭৯. ১৩. ডিহি-কলিকাতা
৮০. ১৪. পাথুরিয়াঘাটা
৮১. ১৫. মাহেশ
৮২. ১. বঙ্গদেশ
৮৩. ২. সপ্তগ্রাম
৮৪. ৩. হুগলী
৮৫. সতী – 1742-57 – ষষ্ঠ পর্ব

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন