সোঞাই – ৫

নারায়ণ সান্যাল

মুক্তকেশী এসে খবর দিয়ে গেল কর্তা আসছেন।

এটাই প্রথা। মানে, এটাও প্রথা নয়, তবে বিকল্পে এটাই চলছে। কোন বনেদী পরিবারে কর্তা-গিন্নিতে দিবাভাগে সাক্ষাৎ হওয়ার কানুন নেই। এটা যে কোন্ সংহিতায় কোন পুরাণকার লিখে গেছেন তা জানা নেই, তবে বনেদী বাড়িতে—যেখানে বার-মহল আর অন্দর-মহল আছে—হাড়-হাবাতে দুঃস্থর এক কামরার পর্ণকুটির নয়, সেখানে ঐ অনাচারটা সহ্য করা হয় না। কর্তারা দিবা-নিদ্রা দেন বার-মহলে, গিন্নিরা পান-দোক্তার আসর বসান, ঘুটি, বাঘবন্দী, ষোলঘর, দশ-পঁচিশ খেলেন অন্দর মহলে। কখনও বা ‘অড়ঢ’ বা ‘আঢ’ অর্থাৎ বাজি রেখে খেলা। ‘চোরে কামারে’ দেখা হয় প্রথম প্রহরে শেয়াল ডাকার পর—তাও যদি পঞ্জিকায় শুভরাত্রির নির্দেশ থাকে। নচেৎ কর্তারা যান উপপত্নীর শয্যাকক্ষে, গিন্নিরা তাঁদের নিজ নিজ একক শয্যায়।

ব্রজেন্দ্রনারায়ণ এক ব্যতিক্রম। তিনি মধ্যাহ্নে প্রত্যহ অন্দর-মহলে আগমন করে থাকেন। তবে আসার পূর্বে যথারীতি দূতীর মুখে সংবাদ পাঠান। যাতে গা খুলে যেসব পুরললনা বিশ্রম্ভালাপ করছে বা নিদ্রা যাচ্ছে তারা বিড়ম্বিত না হয়।

ব্রজেন্দ্রনারায়ণ অনেক কারণেই ব্যতিক্রম। শুধু সোঞাই গ্রামেই নয়, বোধকরি এই রাঢ়খণ্ডে তাঁর কীর্তির নাগাল আর কেউ পায়নি।

ব্রজেন্দ্রনারায়ণ কুলীন ব্রাহ্মণ, বারেন্দ্রশ্রেণীর—কাশ্যপ গোত্র, নিরাবিল পটি। বয়স তিনকুড়ি পার হয়েছে, প্রচুর ধনসম্পদ—অথচ তাঁর ধর্মপত্নী—একমেবাদ্বিতীয়ম ব্রজসুন্দরী।

সেটা ওঁর পিতৃদত্ত নাম নয়। তিন-চার দশক পূর্বে নাকে নোলক, গলায় শতনরী, হাতে রতনচূড় পরে যে বালিকাটি নববধূরূপে এই জমিদারবাড়ি শুভাগমন করেছিলেন তখনই তাঁর নতুন নামকরণ হয়েছিল ব্রজেন্দ্রনারায়ণের ধর্মপত্নী : ব্রজসুন্দরী!

তারপর কেটে গেছে বহু বৎসর। দুটিমাত্র সন্তানের জননী—তারাপ্রসন্ন আর পুটুরাণী, অর্থাৎ পটেশ্বরী। উত্তরবঙ্গ থেকে একাধিকবার লোভনীয় প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু কর্তা-মশা‍ই দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহে স্বীকৃত হননি। গ্রামে তাই ব্রজসুন্দরীর এক বিশেষ মর্যাদা। এমন সতী- লক্ষ্মী সুদুর্লভ—যিনি পাকা চুলে সিন্দুর পরেন অসপত্ন-অধিকারে।

লোকে তাই আড়ালে ব্রজেন্দ্রনারায়ণকে বলে: নবাব সাহেব।

অর্থাৎ নবাব আলিবর্দী খাঁ সাহেব।

শোনা যায়, সেই আহাম্মক নবাবও একটি স্ত্রী নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে গেছেন—উপপত্নী পর্যন্ত ছিল না তাঁর। নবাবের এক বেগম! বিশ্বাস হতে চায় না। খোদাতালা কত বিচিত্র চিড়িয়াই না পয়দা করেন!

স্বভাবতই গ্রামের লোক মেনে নিয়েছিল জমিদার-মশাই কিঞ্চিৎ স্ত্রৈণ! তাই বনেদী প্ৰথা নস্যাৎ করে দ্বিপ্রহরে স্ত্রীর কক্ষে দিবানিদ্রা দিতে আসেন। রুদ্ধ কক্ষে নয়। কবাট খোলাই থাকে। না থাকলেও ক্ষতি ছিল না—জানতে কারও বাকি নেই।

সে ক্ষমতাই নেই যৌবনোত্তীর্ণার। না, শুধু যৌবন গেছে বলেই নয়—এক কালরোগে আজ দু বছর ধরে তিনি তিলতিল করে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে চলেছেন।

ঘরে ঘরে এ নিয়ে দাম্পত্য রসালাপ চলে, তাহলে বুড়ো কেন এমন আঁচলধরা? যে বউ ‘“ইয়েই” করতে পারে না তার কাছে ঘুরঘুর করা কেন বাওয়া? তোর তক্কায় তো ছাতা পড়ছে। নতুন বউ পোষার হিম্মৎ না থাকে তো দু-চারটে বাইজীই পোষ

সেই মর্মন্তুদ `হেতুতেই ব্রজেন্দ্র নিত্য আবির্ভূত হন সহমধর্মিণীর শয্যাকক্ষে। দুজনেই জানে—খোলাখুলি কথা হয় না—আর বড় জোর দুটি বছর। মানে প্রায় সাতশোটি দিন! দুপুরগুলো নষ্ট করার মানে হয়? কত কথা বলা হয়নি! কত কথা আছে, যা বারে বারে লও তৃপ্তি হয় না।

ব্রজেন্দ্রনারায়ণ কক্ষের বাহিরে পাদুকা ত্যাগ করে ভিতরে এলেন। ঘরে বিরাট বড় একটা পালঙ্ক—দ্বৈত শয্যা। কিন্তু এখন, এই দিবাভাগে কর্তা-মশাই অর্ধশয়ান থাকেন একটি আরাম-কেদারায়। উরুনিটা মুক্তোকেশীর হাতে দিয়ে উনি বসলেন নির্দিষ্ট আসনে। ব্রজসুন্দরী আধশোয়া হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর পিঠের দিকে দু তিনটি কামদার উপাধান। তার পাশে শুভ ঘুমাচ্ছে। শুভপ্রসন্ন ওঁর নাতি—তারাপ্রসন্নের একমাত্র সন্তান। বছর চারেক বয়স।

কর্তা ঊর্ধ্বমুখ হয়ে কী-যেন দেখে নিয়ে বলেন, আবার জ্বর এল নাকি? শীত শীত করছে?

ব্রজ বলেন, না তো। শীত করবে কেন?

—তাহলে টানা-পাখা বন্ধ যে?

—এক নাগাড়ে টানতে টানতে ওরাও তো ক্লান্ত হয়ে পড়ে।—বলেন, কিন্তু শয্যাপার্শ্বে বিলম্বিত একটি রেশমী রজ্জুতে আকর্ষণও করেন। সেটি ‘কল-বেল’। তৎক্ষণাৎ টানা-পাখা চালু হল। যে চালায় সে কক্ষান্তরে।

ব্রজ বলেন, নন্দ ঠাকুরপোর বাড়িতে মহাপ্রসাদ খেতে গেলে না কেন কাল?

—তাতে ক্ষতি হয়নি। লৌকিকতাই শুধু নয়, মায়ের পূজায় যাওয়াটা কর্তব্য। তারাপ্রসন্ন গিয়েছিল।

—জানি। -ফিরে এসে বলেছে সে কথা। কিন্তু সে আরও একটা অদ্ভুত কথা বলল, শুনেছ? -শুনেছি। এতবড় কথাটা সে তোমাকে বলবে আর আমাকে বলবে না? কিন্তু হেতুটা কী, সেটা সে আন্দাজ করতে পারেনি।

—তোমার কী মনে হয়?

—জানি না, গিন্নি। গাঁয়ে তার বদনাম—‘একবগ্গা’! আমার যদিও তা মনে হয়নি কখনো।

—রুপো বাঁড়ুজ্জে ‘একবগ্গা” নয়? আপন খেয়ালে থাকে না?

—কী ‘একবগ্গামি’ দেখলে তার?

—বামুনের ছেলে, একটা ও বিয়ে করল না?

ব্রজেন্দ্র হেসে ফেলেন। বলেন, তাহলে তো আদি শঙ্করাচার্যও ‘একবগ্গা’। আর তোমার ঐ সংজ্ঞাটা সম্প্রসারিত করলে ‘আলিবর্দী’ও তো ‘একবগ্গা’! নয়? নবাব হয়ে একটিমাত্র বেগম? ব্রজসুন্দরীও মৃদু হেসে বলেন,’পরস্মৈপদী’ ধাতু কেন গো কুলীনকুলতিলক? ‘আত্মনেপদী ‘ ধাতু কী দোষ করল।

ব্রজসুন্দরী শিক্ষিতা! এও এক ব্যতিক্রম! ব্রজেন্দ্রনারায়ণ অত্যন্ত সুগোপনে তাঁকে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন। সুগোপনে—কারণ সমাজ সেটা সে কালে মেনে নিত না!

কথা ঘোরাতে কর্তা-মশাই বলেন, তোমার প্রথম যুক্তিটা খাটল না। বিবাহ না-করাটা একবগ্গামি নয়। আর কিছু?

—রূপেন্দ্র তার বাপের চতুষ্পাঠীটা তুলে দিল—

—এটা ভুল বললে, গিন্নি। বাবা চেয়েছিল সে ছয় নম্বর কবিরাজ হক। তাই সে হয়েছে।

—’ছয় নম্বর কবিরাজ’ মানে?

—’মালাকারশ্চর্মকারঃ নাপিতো রজকস্তথা। বৃদ্ধারণ্ডা বিশেষেণ কলৌ পঞ্চ চিকিৎসকাঃ।।[১] এরাই এতদিন আয়ুর্বেদশাস্ত্রের চর্চা করত। সৌরীন বাঁডুজ্জের তা পছন্দ হয়নি। তাই ছেলেকে কবিরাজ করে তুলেছে, টোল খুলতে দেয়নি।

[১. “বাগানের মালী, কর্মকার, নাপিত, ধোপা আর পাড়ার বৃদ্ধা বেশ্যা—কলিযুগে এই পাঁচজনই হচ্ছে চিকিৎসক।”]

—কিন্তু এখানে কে তার চিকিৎসা করাবে?

—দোষটা রূপেন্দ্রের নয়। তোমার-আমার। তুমিও তো রাজি হওনি। বল, ঠিক কি না?

—আমার এ রোগ সারবার নয় গো! আর কী জন্য বেঁচে থাকব, বলো? সবাইকে রেখে ড্যাংডেঙিয়ে স্বর্গে যেতে পারলে আর কী চাই?

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। তবু হেসেই বললেন—সেটাই তো মুশকিল গিন্নি! এ পোড়া দেশে স্ত্রীলোকের চিকিৎসা হতে পারে না। কুমারী অবস্থায় সে চায় বাপ-মায়ের গলগ্রহ হয়ে না থাকতে। বিধবার তো কথাই নেই, মায় সধবার দলও ড্যাংডেঙিয়ে স্বর্গে যেতে চায়!

সকল অধ্যায়

১. কাশীধাম – ১
২. কাশীধাম – ২
৩. কাশীধাম – ৩
৪. কাশীধাম – ৪
৫. কাশীধাম – ৫
৬. কাশীধাম – ৬
৭. কাশীধাম – ৭
৮. কাশীধাম – ৮
৯. কাশীধাম – ৯
১০. সোঞাই – ১
১১. সোঞাই – ২
১২. সোঞাই – ৩
১৩. সোঞাই – ৪
১৪. সোঞাই – ৫
১৫. সোঞাই – ৬
১৬. সোঞাই – ৭
১৭. সোঞাই – ৮
১৮. সোঞাই – ৯
১৯. সোঞাই – ১০
২০. সোঞাই – ১১
২১. সোঞাই – ১২
২২. সোঞাই – ১৩
২৩. সোঞাই – ১৪
২৪. সোঞাই – ১৫
২৫. সোঞাই – ১৬
২৬. সোঞাই – ১৭
২৭. সোঞাই – ১৮
২৮. সোঞাই – ১৯
২৯. সোঞাই – ২০
৩০. সোঞাই – ২১
৩১. সোঞাই – ২২
৩২. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১
৩৩. তীর্থের পথে – ১
৩৪. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ২
৩৫. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৩
৩৬. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৪
৩৭. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৫
৩৮. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৬
৩৯. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৭
৪০. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৮
৪১. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ৯
৪২. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১০
৪৩. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১১
৪৪. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১২
৪৫. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৩
৪৬. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৪
৪৭. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৫
৪৮. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৬
৪৯. নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৭
৫০. তীর্থের পথে – ২
৫১. তীর্থের পথে – ৩
৫২. তীর্থের পথে – ৪
৫৩. তীর্থের পথে – ৫
৫৪. তীর্থের পথে – ৬
৫৫. তীর্থের পথে – ৭
৫৬. তীর্থের পথে – ৮
৫৭. তীর্থের পথে – ৯
৫৮. তীর্থের পথে – ১০
৫৯. তীর্থের পথে – ১১
৬০. তীর্থের পথে – ১২
৬১. তীর্থের পথে – ১৩
৬২. তীর্থের পথে – ১৪
৬৩. তীর্থের পথে – ১৫
৬৪. তীর্থের পথে – ১৬
৬৫. তীর্থের পথে – ১৭
৬৬. তীর্থের পথে – ১৮
৬৭. ১. ভাগীরথী
৬৮. ২. শান্তিপুর
৬৯. ৩. ফুলিয়া
৭০. ৪. রণারঘাট
৭১. ৫. চক্ৰদহ – প্রদ্যুম্ননগর
৭২. ৬. যশোড়া – কাঞ্চনপল্লী
৭৩. ৭ বংশবাটি
৭৪. ৮. ত্রিবেণী
৭৫. ৯. কুমারহট্ট
৭৬. ১০. নৈহাটি
৭৭. ১১. ভাটপাড়া
৭৮. ১২. মূলাজোড়
৭৯. ১৩. ডিহি-কলিকাতা
৮০. ১৪. পাথুরিয়াঘাটা
৮১. ১৫. মাহেশ
৮২. ১. বঙ্গদেশ
৮৩. ২. সপ্তগ্রাম
৮৪. ৩. হুগলী
৮৫. সতী – 1742-57 – ষষ্ঠ পর্ব

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন