কেয়ারটেকার – ৪

মহাশ্বেতা দেবী

রামাশ্রয় স্বামীর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত চালকুড়া গ্রামে প্রাক্তন জমিদারদের দানে ধ্যানে আশ্রমের সূচনা। বর্তমান অধ্যক্ষ ধর্মাশ্রয় স্বামী। তিনি ছেলেদের এক আবাসিক স্কুলও চালান। সেবাপ্রাণা নারীআশ্রম চালান। নারীআশ্রমে বয়স্কা মেয়েরা আজীবন আশ্রম সেবাকার্য করবে বলে কথা দেয়। নিরাশ্রয়, স্বামী—পরিত্যক্তা, বিধবা, পুলিস রেইডে পতিতালয় থেকে উদ্ধারপ্রাপ্তা ষাটজন বিভিন্ন বয়সী স্ত্রীলোক তাঁত বোনে, আচার বানায়, হজমি বানায়। সে সব বিক্রি হয়।

আছে ছোটছেলে ও মেয়েদের আলাদা অনাথাশ্রম। আছে মেয়েদের আবাসিক স্কুল। এ ছাড়া ডেয়ারি, সবজির বাগান, ধানক্ষেত আছে। স্কুল দুটি থেকে প্রতিবার ছেলে মেয়েরা ভালো রেজাল্ট করে। বিশাল গেটের ওপর সিমেন্টের হরফ বসানো, ”কর্মেই জীবনের আশ্রয়”।

—স্বামী রামাশ্রয়।

ধর্মাশ্রয় বলেন, আমাদের মূল আশ্রম হিমাচল প্রদেশে। রাঁচিতেও আশ্রম আছে। আপনার আত্মীয়া এখানে থাকলে থাকবেন। আশ্রয় প্রার্থীকে আমরা ফেরাই না। তবে কাজ করে থাকতে হবে।

—যাঁরা কাজ করতে করতে বুড়ো হয়ে যান?

—তাঁদেরও ব্যবস্থা আছে।

ধর্মাশ্রয় বলেন, আশ্রম দেখলেন, ব্যবস্থা জানলেন। দেশ ও বিদেশ থেকে ভক্তরা ডোনেশান দেন! কয়েকটা ব্যাপারে ভারত সরকারের সাহায্য পাচ্ছি। গ্রামোন্নয়ন কাজও হচ্ছে। ডেয়ারিতে, বাগানে, ক্ষেতে গ্রামবাসী কাজ পাচ্ছে। এ সব উন্নয়ন গত দশ বছরের মধ্যে হয়েছে।

—কি করতে হবে? ওঁকে নিয়ে এলেই হবে?

ধর্মাশ্রয় ঈষৎ হাসেন, বুঝিয়ে দেন সুদেব কত অজ্ঞ!

ওঁর নাম, বর্তমান ঠিকানা, এখানে আসার কারণ, সব লিখে আনবেন। ফর্ম দিয়ে দিচ্ছি, তাতে এখানে থাকার নিয়মাবলী আছে, সেগুলো পূরণ করবেন। আজীবন কুমারী থাকতে হবে, তাও জানালাম, লেখাও আছে। আশ্রমের নিয়মভঙ্গ করলে আমরা আশ্রমে রাখি না। আহার নিরামিষ, থাকবেন ডর্মেটরিতে, পরবেন সকলের মতো গেরুয়া লাল পাড় কাপড়। আর কাজ করবেন।

নামিতা ঘাড় কাত করে।

—ভিজিটর আসতে পায় না।

—বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না?

—না। আশ্রমের জীবন, আশ্রমেরই জীবন। এতজন স্ত্রীলোকের ব্যাপার, এসব কড়াকড়ি আমাদের রাখতেই হয়। সুদেব ও নমিতা বাসে ওঠে। রামাশ্রয় আশ্রমের কারণে এই অবহেলিত আদিবাসী অঞ্চলে পাকা রাস্তা হয়েছে, ডাকঘর বসেছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, সবই হয়েছে। সমবায় মৎস্যচাষ অফিসও দেখা যায়। বাসে একজন বলে, চালকুড়া বললে কেউ বোঝে না। সব ”আশ্রম” বললে বোঝে। ওদের গেস্ট হাউস, নিজেদের হাসপাতাল কি নেই?

এবারে কুষ্ঠ হাসপাতালও করবে।

স্থানীয় লোকের মনে সভয় সমীহ।

—শিবচতুর্দশী, রামনবমী, মিছিল যা করে তা দেখার মতো। খুব প্রতিপত্তি ওদের।

সোনাবাঁধে ফিরে নমিতা ঘরে চলে যায়। সুদেবও খুব নির্বাক হয়ে যায়। যেখানে ছিল সেখানকার মতো পণ্য হবে না। কিন্তু নিজস্ব জীবন বলে তো কিছুই থাকবে না।

আশ্রমে ঢুকে যাবে, বাইরের জগতকে চিরতরে ত্যাগ করে? আশ্রমের নিরমাবলীতে লেখা আছে সব। ভোর পাঁচটায় ওঠো, স্নান ও প্রাতঃকৃত্য, ধর্মোপাসনা জলযোগ, কর্মশালায় আটটা থেকে বারোটা। দুটো থেকে পাঁচটা। তারপর জলযোগ, উপাসনা গান। সাতটা থেকে ন’টা রামাশ্রয়ী গীতা অনুশীলনী। দশটার মধ্যে আহার ও শয়ন। জাগ্রত প্রহরগুলি নিয়মের ছকে বাঁধা।

রাতে নমিতা খেতে চায় না।

—খেলেন না কেন?

—ইচ্ছে করছে না।

—চলুন, বাইরে বসবেন?

—কি লাভ? চলেই তো যাব।

—ইচ্ছে না হলে যাবেন কেন?

—এখানে কত দিন থাকব বলুন?

আপনিও তো চাকরি করেন, আপনার লজ তো নয়।

—অন্য কোনো ব্যবস্থা দেখতে হবে।

নমিতা গভীর স্নেহে, যেন সান্ত্বনা দিয়ে বলে, আমার মতো মেয়েদের জন্যে খুব অনেক দরজা খোলা নেই সুদেববাবু। আর…আপনি তো আমার কথাতেই নিয়ে গেলেন ওখানে। আমি…পারব…এই যে এখানে এ ক’দিন থেকে গেলাম…পারব।

—আপনার পরিণামের জন্যে আপনি তো দায়ী নন।

—সে কথা কি কেউ বিবেচনা করে? ওই সাধুর চোখ দেখছিলেন? আপনি বলে যাচ্ছেন, আপনার জানাচেনা, ভদ্রঘরের মেয়ে, দুরবস্থায় পড়েছে…উনি কেমন শুনে যাচ্ছিলেন?

—ওঁকে বলছি, শুনবেন না?

—আমি তো বুঝতে পারছিলাম, উনি একটা কথাও বিশ্বাস করেননি। উনি মনে করছিলেন দাগী মেয়ে, সাতঘাট ঘুরে এসেছে, আশ্রমে আসবে কেন, কলঙ্ক যদি না থাকে?

—ভাববেন না।

—ভাবা আর না ভাবা! পরশু থেকে তো সব ভাবনাই শেষ। নামটা আবার বদলে দেবে…তাই তো নিয়ম।

—যাবেন না তাহলে।

—কি যে বলেন! আপনি ভাললোক, দয়ার প্রাণ, তা বলে থেকেই যাব, তা কি হয়? আমি বা তা থাকব কেন? এসব ঘরও আপনারা পুজোয় ভাড়া দেন, আমি একটা ঘর আটকে বসে থাকতে পারি?

—ওখানে যে কোনো স্বাধীনতা থাকবে না।

—হাসাবেন না তো! স্বাধীনতা থাকবে না, সেটাই আপনার বড় মনে হচ্ছে? স্বাধীনতা আমার কবে ছিল? পেছনে তাকাই, পাঁচ বছরে কোন স্বাধীনতাটা পেয়েছি?

—আপনার বয়স…

—চবিবশ। উনিশ বছরে বাবা বেচে দেয়। আর না, যান তো। হাত মুখ ধুয়ে একটু ঘুমোই। আজ বড় নিশ্চিন্ত লাগছে! বাকি জীবনটার হিল্লে হয়ে গেল। আপনার কাছে এলাম, আপনি নিয়ে গেলেন…

সুদেব বেরিয়ে আসে। বলে, বিবি খাবার আনবে, আপনি যা হয় খাবেন।

—আপনি যান। আমার ঘুম পাচ্ছে! নমিতা তীব্র গলায় বলে, ”খাবেন খাবেন” বললেন না। ইচ্ছে হলে খাব না, ঘুম পেলে ঘুমোব, এটুকু স্বাধীনতা তো দেবেন!

সুদেব চলে আসে।

বুকের ভেতর তোলপাড় করছে। ”স্বাধীনতা থাকবে না সেটাই আপনার বড় মনে হচ্ছে?”

নমিতা কি বলতে চাইছিল? ”পেছনে তাকাই, পাঁচ বছরে কোন স্বাধীনতাটা পেয়েছি?”

পাওনি, পাওনি নমিতা। আমি যা বলতে পারিনি, তুমি সে কথা বলার সুযোগ করে দিলে, আমি বলতে পারিনি।

আমার নিজের সম্পর্কে অবিশ্বাস আছে। বন্য, বর্বর, নিমেষে রক্ত জ্বলে যায় যার, সে সুদেবকে তো দেখনি। বিয়ের কথা সবাই বলে, আমি কোনো স্থায়ী মানবিক সম্পর্কের কথা ভাবতে ভয় পাই। কিন্তু তোমাকে আমি ভুলতে পারিনি। নমিতা কাল তোমাকে সব কথা বলব, সব। তোমার সেই অসহায় ডুবে যাওয়া, সব বলব তোমাকে। তোমারও জানার অধিকার আছে। সব শুনে যদি তবু যেতে চাও, যেও।

যাবার ব্যাপারটা তোমার সিদ্ধান্ত বলেই আমি কিছু বলিনি। কিন্তু মনে হচ্ছে, তোমার ওপরে এতটা না ছাড়লেও পারতাম। কি জীবন কাটিয়েছ, অথচ এখনো তুমি কত নরম, কত নির্ভরশীল, কত সহজে খুশি।

সব বলব তোমায়।

ঘুম আজ সুদেবকে ধরা দেয় না।

পাঁচটা না বাজতে ও উঠে পড়ে, দরজা খোলে। গেট খুলে দেয় গোপাল। সুদেব চোখ মুখ ধোয়। নমিতার ঘরে যায়।

দরজা খোল।

নমিতা ঘরে নেই।

ঘরে নেই বাগানে নেই, নমিতা কোথায়?

গোপাল বলে, হাঁটতে গেল।

—কোথায়?

—ফরেস্ট।

ফরেস্টের পরেই তো বাঁধ। এ বনপথ ফুলে ফুলে ঢাকা নয়। ইউক্যালিপটাসের শুকনো পাতা বিছানো।

সুদেব ভীষণ উদ্বেগে ছুটতে থাকে। নমিতা তুমি বাঁধের ওপর উঠছ কেন? পাঁচিল দিয়ে হাঁটছ কেন?

—নমিতা!

সুদেব প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওর কোমর জাপটে টেনে নেয়। দু’জনেই গড়িয়ে পড়ে।

—নমিতা, কি করছিলে?

দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে থাকে। অন্তহীন, অন্তহীন সময়।

নমিতা দু’হাতে মুখ ঢাকে।

সুদেব চেয়ে থাকে বাঁধের দিকে। এখানে জল গভীর। জলে আকাশের ছায়া। তারপর নিশ্বাস ফেলে বলে, ওঠো। আঁচল গোছাও। শোনো, কোথাও যাবে না তুমি। আমার কাছে থাকবে।

—কি করে?

—বিয়ে করে। এই কথাটাই আজ বলতাম, ভোরেই বলা হয়ে গেল। শোনো, আমার জীবনটাও দাগী। আর তোমাকে আমার খুব দরকার। আজই রেজেস্ট্রি করে ফেলব রানীপুর গিয়ে, ঘুস দিলে সব হয়। এখন ওঠো, ফিরে চলো। মুখ চোখ মুছে ফেলো।

—সবাই নানা কথা বলবে।

সুদেব হাসে।

—সুদেব রায়কে? তার বউকে? এ তল্লাটে তো নয়। ওসব আমি ভাবব। তুমি আর ভেব না।

—আপনার বাড়ি…

—সবাই জানবে। আগে বিয়েটা করে ফেলি। তোমাকে বিশ্বাস কি, আবার হারিয়ে যাবে। ব্যবস্থা তো করে এনেছিলে, ছি ছি ছি! আবার আমাকে জলে নামাতে?

নমিতা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে স্থির হয়। বলে, চলুন, কোথায় নিয়ে যাবেন।

—চলো।

ওরা ধীরে ধীরে হাঁটে। এখন আর তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।

সুদেব বলে, সবাই খুব খুশি হবে।

—আমাকে দেখলে…

—বা, আমি ছাড়া তোমাকে তো কেউ ধরে রাখতেই পারবে না, তাই না?

—আমার এখনো…

—বিশ্বাস হচ্ছে না তো? হয়ে যাবে, সব হয়ে যাবে। শুধু অতীতটাকে ভুলে যেতে হবে।

নমিতা বলে, হয়ে যাবে।

বনপথে ভোরের আলো। সোনা বাঁধ জেগে উঠছে।

__

অধ্যায় ৪ / ৪

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন