মহাশ্বেতা দেবী
সকালে শ্লোগান ছিল সোনাবাঁধ চলো।
দেবরূপ ও অমিতের পিছন পিছনই পুলিসের জীপ ও বড় গাড়ি।
ফরেস্টের অনেকটা ঘিরে দড়ির বাঁধ, পুলিস পাহারা। ফরেস্ট গার্ডরা নিরুপায়। জনগণকে রোখা আজকাল খুব মুশকিল। সবাই শুটিং দেখবে।
রূপক আজ সিনেমার শহর থেকে সিনেমার গ্রামে আসা প্রেমিক যুবক।
সিনেমায়, অতীব বাণিজ্যিক সিনেমায় শহর ও গ্রামের বিষয় একটা অঙ্ক আছে।
শহর থেকে যে যুবক আসবে, তার কাছে গ্রাম মানে আজও—
”ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।”
সে গ্রামের লোকেরা শহরের ছেলেটিকে দেখলেই হেদিয়ে মরে যায়। আর গ্রামে থাকতেই হবে এক যুবতী সুন্দরী মেয়ে, যার মা নেই, আছে এক স্নেহান্ধ বা সিনেমায় অন্ধ পিতা। সাধারণত এই পিতারা গায়ক বা বেয়ালাবাদক বা স্কুল—মাস্টার হয়ে থাকে, ভগবৎভক্ত তো হতেই হয়।
সিনেমার গ্রামে যুবক ও যুবতী গান গেয়ে দৌড়ায়, জড়াজড়ি করে, প্রেম করে।
সুদেবকে স্বপন বলল, এ গ্রাম কোথাকার?
—সিনেমার। পশ্চিমবঙ্গের নয়।
—তাই হবে। ঢুকুক কোনো শালা হাতিপোতা, বিটিছানা নিয়ে ছেনাল করুক, পঞ্চায়েত বেঁধে নিয়ে যাবে আর দে ধোলাই, দে বাঁধে ফেলে।
মালা রায় একটি ছাপা শাড়ি ও সবুজ জামা পরে আলুলায়িত চুলে রূপকের হাত ধরে, বনপথে দৌড়ে, গাছ ঘিরে ঘিরে ঘুরে, রূপকের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে, তারপর ওর হাত ধরে দুলে দুলে, যে গানটি আশা ভোঁসলের গলায় সুপারহিট হতে চলেছে তাতে লিপ দেয়।
দেবরূপ ফিসফিসিয়ে বলে, গান নেই শুধু লিপ, কিন্তু কি সুপার্ব।
রূপকও অনুরূপ ঠোঁট নাড়ে।
—কাট!
ইন্দ্র রূপককে একপাশে টেনে বলে, গানের কথাগুলো মনে আছে?
—নিশ্চয়।
—প্রেমের কথা। প্রতিশ্রুতির কথা।
মালার চোখ মুখ, প্রতিটি চাহনি কথা বলছে। রাইজ আপ টু হার।
—হ্যাঁ।
—মালা একটু কথা বলে নে।
মালা এখন প্রফেশনাল। সে মধুর হেসে বলে, যেহেতু আমরা এখানে অনাদি অনন্তকাল বসে থাকতে চাই না, সেহেতু ব্যাপারটা পরস্পর সহযোগিতা করে যত তাড়াতাড়ি মিটে যায় ততই ভালো, বুঝলে? কাম। ইন ক্যান ডু ইট!
—হ্যাঁ ম্যাডাম!
—মালা বলে। নো ম্যাডাম।
—থ্যাংকিউ।
—দেখ ভাই, নায়িকাপ্রধান ছবি। কিন্তু এ গানটাতে তোমার ম্যাক্সিমাম আন্তরিকতা থাকতে হবে। অর্থাৎ এ গানটা যে গাইছে, সে পার্বতীকে ঠকাতে পারে না। স্টোরিও তো বলছে, সন্দীপের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল বলেই সন্দীপ আসতে পারেনি।
—এবার … ভুল হবে না।
—ইন্দ্র!
আবার শুরু হয় গান, ছোটাছুটি মালার আঁচল ওড়ে, চুল ওড়ে। দেখতে দেখতে সুদেব বোঝে, অভিনয় ব্যাপারটা আসলে যথেষ্ট পরিশ্রমের।
একটি দৃশ্যেই দুটো বাজে।
ইন্দ্র বলে, মালা! আজ কি আর?
—হবে কি? পার্বতী দাঁড়িয়ে আছে জলের ধারে, ভাবছে, ভাবছে। এই গানের কথা মনে পড়ল। ঘুরে ঘুরে দেখল। তারপর দৌড়তে দৌড়তে জলের ধারে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার মনে হয় না আজ হবে।
—ঠিক আছে।
—শোন, কুইক লাঞ্চ হয়ে যাক। আজ বরং মন্দিরটা দেখে আসা যাক। কাল সকালে শুটিং সেরে দুপুরের মধ্যে রওনা।
লজে ফেরার সময়ে পুলিসকে ভিড় ঠেলতে হয়। অবশেষে সুদেব মালাকে প্রায় আগলে ধরে দৌড়ে বের করে আনে।
গাড়িতে তুলেই বলে, চালান।
মালাকে বলে, কি কাণ্ড? এরকম হরদম হয়?
—তা হয়।
—আপনার … লাগেনি তো?
—না না।
লজে ঢুকে যায় গাড়ি।
মালা অভিজ্ঞ চোখে আকাশ দেখে বলে, আকাশটা ঘোলাটে লাগছে। বৃষ্টি হলেই চিত্তির।
—না না, এখানে এখন বৃষ্টির সময় নয়।
ঝড় হতে পারে। জল হলেও সামান্য।
এটা খরাপ্রবণ এলাকা বলেই তো ওই বাঁধ।
—কাল দেখব।
মালা ঘরে চলে যায়।
আমিত সত্যিই প্রচুর ফল এনেছে।
এগুলো ফ্রিজে তোলাতে হবে। মোহর এসে বলে, বড়বাবু এসেছেন।
—কোথায়?
—শুটিং দেখছেন।
অপরূপবাবু আর সুবর্ণও আসেন।
—সুদেব! যত্নআত্তি কোর। কি করে কি করছ, তা তো জানি না। ইন্দ্রবাবু!
—আমাকে ইন্দ্র বলবেন।
—বিলক্ষণ! আমাদের অপুবাবুর ছেলে!
তা, তোমার বাবা মা সবাই কলকাতায়?
—হ্যাঁ, সল্টলেকে বাড়ি করল বড়দা।
—বেশ বেশ। তোমাদের অসুবিধে হচ্ছে….
—সুদেববাবু থাকতে?
—আমার গিন্নি একটু ওনার সঙ্গে আলাপ করবেন।
—স্নান করতে গেছে বোধহয়।
সুদেব আস্তে বলে, আপনারাও খেয়ে যান না কেন বড়বাবু? মাছ ভাত তো রান্না।
সুবর্ণ বলে, না ছেলে? আমার সোমবার। আর উনি মন্ত্র নেবার পর বাইরে ভাত খান না।
অপরূপবাবু সুদেবকে ওর ঘরে ডাকেন।
—সব এই দেবার কীর্তি! টাউনে সবাই বলছে সিনেমা পার্টি টাকা মেরে পালায়।
তুমি কিন্তু….
—দেবুবাবু কিছু বললে আমি কি করে….
—সে জন্যেই এসেছি। দেবার হাতে থেকে তো লজ লাটে উঠেছিল। তুমি এসে থেকে রিটার্ন পাচ্ছি। তুমি এলে কেন?
সুবর্ণ বলল, ও তো বলবে না। আমিই মনে করাতে এলাম। যেমন দেখে রাখছে, কাজের লোকজন যেমন সন্তুষ্ট আছে, এবারে ওর মাইনে দু’শো বাড়াও।
কথাই ছিল।
নিশ্চয় নিশ্চয়। তুমি যখন বলছ…
সুদেব বলে, পুজোর সময়ে স্টাফকে যদি একশোটা টাকা দেন, দেখেশুনে ওরাই রাখে।
—সে দেখব। তুমি কিন্তু হিসেবটা দেখে নিও।
—দেব।
—ক্লাব বলছিল, সংবর্ধনা দেবে। আমি বললাম, সেসব টাইম ওদের হবে না।
রানীপুরে যে কি গুলতানি হচ্ছে।
—এঁরা বেশ ভদ্র, ভালো।
—হতেই হবে। সবাই ভালো। শুধু দেবাটা….
অপরূপবাবুর এটা দুর্ভাগ্য। মেয়েগুলি সৎ পাত্রে বিয়ে দিয়েছেন। একতম পুত্রটি মানুষ হয়নি। তার একুশ বছর বয়সে যে সতেরো বছরের মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন, রানীপুর—চমকানো বৌভাত করেছিলেন, সে মেয়েটি দেবরূপের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে বাপের বাড়ি বসে আছে।
বসে থাকার জোর তার আছে। সেও বাপের একমাত্র সন্তান। দুর্ব্যবহার বা অবহেলা উপেক্ষা সইতে রাজী নয়। তার বাবা বলেছেন, দেবযানী বণিকের কেস হতে দেখেছি। রানীপুরে বছরে কয়েকটা কেস হয়। মেয়েকে আমি পাঠাব না।
জামাই শোধরাক, তারপর ভাবব। নইলে ডাইভোর্স করাব।
ভদ্রলোক মানবেন না ডাইভোর্স খুব বড় কলঙ্কজনক। তাঁর কথা, মেয়ে মরে যাবে তার চেয়ে ডাইভোর্স শ্রেয়।
সুবর্ণ খুব অবিচলিত। দেবরূপের তিরিশ বছর বয়স অবধি কুসময় যাবে।
সে কথা না মেনে বিয়ে দেবার অপরাধ ছেলের বাবার। ছেলের বয়স তিরিশ হোক, সব ঠিক হয়ে যাবে।
সুবর্ণ বলে, চলো গো, ঝড় উঠবে।
খাওয়াদাওয়া মিটতে চারটে হয়।
মালা বলে, রাতে মাছ খাব।
তার লাঞ্চ কমলালেবু, আপেল, শসা, ঘোল।
অন্যরা মাছ খেয়ে ধন্য ধন্য করে।
দেবরূপ ইন্দ্রকে বলে, রাতে আসবেন?
—ওখানেই ”নো গুড’ হয়ে গেছি। মদ খাই না, বউয়ের বারণ।
—মদ খান না, সিনেমা করেন?
—বলেন কেন। ওরা খায়, খাওয়াবেন।
রবীনবাবুকে সামলে রাখবেন।
রবীনবাবুকে খাওয়ার পর ডাকে ইন্দ্র।
রবীনবাবু সুদেবকে টাকা দেয়। বলে, রসিদ কাল দেবেন। ফাইনাল পেমেন্ট, পাকা রসিদ। ইন্দ্র! ওখানে ওরা গেলাস—টেলাস ভেঙে কাল….
—বিল নেবেন, হিসেব দেবেন।
না, আজও নমিতাকে তেমন দেখে না সুদেব। কিছুক্ষর বাদে ঝড় ওঠে।
ধুলোর ঝড় থামতে না থামতে কয়েক পশলা বৃষ্টি।
সনাতন বলে, ভালো, ভালো। এখন ঝড় জল হলে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠেও হবে। একটা বর্ষা ভালো পাই তো ধান তুলে নিব।
সনাতন জল—ভেজা মাটির গন্ধ শোঁকে।
বলে, না, মেঘ দৌড়ায়। ওই যা ধুলাটা মরবে।
পরদিন সকাল ছিল ঝকঝকে। গাছপালা বৃষ্টি ধোয়া। কে জানত এমন বিপদ ঘটে যাবে।
মালা আর নমিতার পরনে একই রকম ডুরে শাড়ি, একরকম জামা। সন্দীপের জন্যে অপেক্ষা করে করে হতাশ, ভগ্নহৃদয় পার্বতী ”মা গো”! বলে দৌড়ে গিয়ে জলে ঝাঁপ দেবে।
মালা দৌড়চ্ছে, দৌড়চ্ছে, দেখা যাচ্ছে ওকে।
নমিতা দৌড়চ্ছে, দৌড়চ্ছে, নমিতার পেছনটা দেখা যাচ্ছে, নমিতার ওপর ক্যামেরা।
নমিতা ঝাঁপ দিল।
জলে তলিয়ে যাবার শট খুব ফেথফুল।
কিন্তু তারপর?
নমিতা তো ওঠে না। ওর হাতটা উঠল একবার।
ঝপাঝপ জলে ঝাঁপ মারছে লোক।
সুদেব ঝাঁপ দিল। ডুবসাঁতারে ধরল মেয়েটাকে।
এক হাতে ঠেলে ঠেলে ওপরে তোলো, সুদেব বিপন্ন। নমিতার হাত ওর গলা জড়াচ্ছে।
সাঁতার কেটে কাছে এল কয়েকজন। তারপর পাড়ে তুলতে বোঝা গেল কাপড়ের আঁচল খুলে দু’পায়ে জড়িয়ে গিয়েছিল। তারপর অচৈতন্য নমিতাকে কাঁধে ফেলে পাক খাইয়ে জল বের করা। পেটে চাপ দাও, উপুড় করো।
—হাসপাতাল! হাসপাতাল!
—লাগবে না। জল বেরিয়ে গেছে।
—কিসের লাগবে না?
মারুতি ভ্যানে বটেশ্বর স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ততক্ষণে নমিতা চোখ খুলেছে। ডাক্তার বললেন, সরে যান আপনারা। ইন্দ্র, মালা, রূপক, সবাই তটস্থ। কিছুক্ষণ বাদে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন।
—ঘণ্টাখানেক বাদে নিয়ে যান!
—বাঁচবে?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভয় পেয়েছিলেন খুব।
শকেই তো…. বাঁধে আনাড়ি লোক নামে?
—সাঁতার জানে বলল!
—সামান্য সাঁতার জ্ঞান নিয়ে ও বাঁধে কেউ নামে না।
—সিনেমার শুটিং হচ্ছিল…
—খুব বিপজ্জনক কাজ করেছেন।
ইন্দ্র বলে, সুদেববাবু! আপনাকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা আমি জানি না। মালা, নমিতার কাছে যা। বেণু! মালা আর নমিতার একটা স্টীল!
দেবরূপ মরিয়া হয়ে বলে, আমিও দাঁড়াব?
—দাঁড়ান।
সুদেব স্তম্ভিত। এমন ঘটনা নিয়েও বিজ্ঞাপন?
ইন্দ্র বলে, যাক! শটটা উৎরে গেছে। নাহলে যে কি হোত! নমিতাকে দিয়ে তো আর হোত না।
সুদেব বলে, উনি বেঁচেছেন এটাই বড় কথা।
—হ্যাঁ হ্যাঁ… ওর কিছু হলে… ও বাবা, সে খুব অপয়া হোত। আর না, কালই প্যাক আপ।
মালা বলে, আজই নয় কেন?
—নমিতা আছে না?
—রবীনবাবু ওকে নিয়ে কাল আসুন। আমি চলে যাব ইন্দ্র। খুব বিশ্রী লাগছে। কেমন যেন…
নমিতাকে নিয়েই ওরা ফেরে।
তারপর, এখন রওনা হয়ে রাত করে পৌঁছনোর চেয়ে কাল ভোরে যাওয়াই সাব্যস্ত হয়।
আজকের ঘটনায় একেকজন একেকভাবে নাড়া খেয়েছে।
লজে পৌঁছবার পর সনাতনের বউ গৌরী ও বিবি নমিতাকে ধরাধরি করে নিয়ে যায় ঘরে। হাসপাতালের সাদা চাদর জড়ানো, তা খুলে কাপড় পরায় চুল মোছায়।
ভেজা জামাকাপড় ধুয়ে মেলে দেয়।
সুদেব বলে, ওনাকে আগে আদা—চা করে দাও। তারপর গরম দুধ খেতে দাও।
—তুমি জামাকাপড় ছাড়ো।
—হ্যাঁ, আমিও একটু চা খাব।
ইন্দ্র বলে, আমরাও।
ইন্দ্র যে বলেছে, ”যাক, শটটা উৎরে গেছে।’ এ কথাটাই সুদেবের কানে লেগে থাকে।
নমিতা মরে গেলেও শট উৎরে যেত। ওর কাজ তো ছিল ঝাঁপ দেওয়া, ও দিয়েছিল।
রবীনবাবু ওর ঘরে ঢোকে।
—আপনাকে আমার বিশেষ ধন্যবাদ।
—থাক ওসব কথা।
—আমিই ওকে জোগাড় করি।
—সাঁতার জানেন না জেনেও?
—বলেছিল, জানে। এই হলো এসব মেয়েদের বোকামি। বলে দে, জানি না। টাকার নাম শুনলে…
—টাকা ছাড়া কে কাজ করে? যাক গে। আজ দুবেলা ফুড, ব্রেকফার্স্ট, একদিনের অনসূয়াদেবীর লন্ড্রী চার্জ, সার্ভিস চার্জ, সব আমি বিল করে ফেলছি। কাল সকালে আপনারা কি খেয়ে যাবেন, জানাবেন, তার চার্জও বিল করব।
—করবেন, করবেন… সার্ভিস চার্জ?
—আপনাদের জন্যে তো স্পেশাল কুক আনা হোল।
—নেবেন। শুনুন, বিলটা বাড়িয়ে ধরবেন, যেন খরচে আর বিলে হাজার টাকা ফারাক থাকে। ডিফারেন্সটা আমার আপনার।
—বিল তো একটাই হবে।
—দুটো করবেন, কি আছে?
—আপনার কত, আর আমার কত?
ধরুন পাঁচশো—পাঁচশো।
—বলছেন ভালো।
—এসব করতেই হয়। আপনার—আমার সামান্য থাকল। আমি অন্যদেরও এজায়গা রেকমেন্ড করব।
—আমাকে দিয়ে তো তা হবে না।
—কার জন্যে সততা দেখাচ্ছেন? ওই দেবুবাবুর জন্যে?
—নিজের জন্যে, নিজের জন্যে। আপনি যান রবীনবাবু। আমার ঘরে ভিড় বাড়াবেন না।
অতঃপর দেবরূপ।
—লাঞ্চে ওদের কি দেবেন?
—কালই তো ঠিক ছিল মাটন হবে।
—রাতে চিকেন?
—হ্যাঁ। পরোটা—কারি। দেবুবাবু।
—বলুন, বলুন।
—রসুলের টাকাটা সার্ভিস চার্জে ধরে নেব?
—না। ওটা আমিই দিয়ে দেব। ভেরি ব্যাড, আজ এরকম একটা কাণ্ড হোল। এটা যদি মালা রায়ের হোত?
উনি তো ঝাঁপ দিতেন না। দুর্ঘটনা হলে ওঁর ডবলেরই হোত। তাতে সন্দেহ নেই।
—আপনি খুব সার্ভিস দিয়েছেন।
—এ জায়গায় জলে ঝাঁপ না দেওয়াই ভালো। বাঁধ কোথায় যে কত গভীর কেউ জানে না।
—হ্যাঁ, সব যেন সেঁতিয়ে গেল। আচ্ছা, নমিতা নর্মাল ডায়েট খাবে তো?
—ডাক্তার তো তাই বললেন।
দেবরূপ চলে গেল।
গৌরী এসে বলল, তোমায় ডাকছে।
—কে?
—মেয়েটা।
সুদেব নমিতার ঘরে ঢুকল।
—কিছু বলছিলেন?
—হ্যাঁ, ওরা তো আসছে না। শুটিংটা হয়েছে?
—শুনলাম তো হয়েছে।
—যাক। ওরা কি চলে গেছে?
—না, আপনারা কাল যাছেন।
—ভালো।
—এখন কেমন লাগছে?
—ভালো।
—সাঁতার জানেন কি?
—সামান্য।
—ওই বাঁধে ঝাঁপ দিলেন?
—হ্যাঁ সুদেববাবু।… সাঁতার কম জানলেও টাকার জন্য… ইন্দ্রবাবু বলেছিল রেসকিউ পার্টি থাকবে…
—ছিল তো। নইলে তুলল কারা?
—আপনি আগে ধরেন। শুনেছি।
—বহুকাল অপরের জীবন ও সম্পত্তি বাঁচাবার ভূমিকায় অভিনয় করছি তো। ঘুমোন। খাবেন পেট ভরে। কাল চাঙ্গা হয়ে চলে যাবেন।
—হ্যাঁ… গৌরীদি আমার কাছে একটু থাকবে আজ রাতটা? অসুবিধে হবে?
—না, ওকে বলব। ও তো কাজ করে, আসতে দেরি হবে ওর, আসবে। ভাববেন না। ঠিক হয়ে গেছেন, ঠিক হয়ে যাবেন।
—হ্যাঁ, ঠিক তো হতেই হবে। আচ্ছা… নমিতা চোখ বোজে। ওর লম্বা চুল মেঝে অবধি। কপালটি সুন্দর। চেহারায় কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। নেহাত অভাবী না হলে কেউ এ কাজে আসে? দিন কেটে যায়। রাত কেটে যায়। সকালে ওরা রওনা হয়ে যায়। ইন্দ্র ভূয়সী প্রশংসা করে যায় সুদেবের। বলে যায়, এবারে হরদম শুটিং হবে, দেখবেন।
—জলে ঝাঁপটা বাদ দিয়ে।
যাবার সময়ে নমিতা সুদেবকে বলে, গৌরীদি বলল, আপনার গ্রাম বাঁধবেড়া আর ওদের গ্রাম হাতিপোতা।
—তাই তো।
—কিছুই দেখা হোল না। নমস্কার।
—নমস্কার।
সবাই চলে গেলে মোহর বলে, আজ কি ছুটি?
—এখন তো সব ঝটাপট সাফসুতরো করতে হবে। কে কখন এসে পড়ে কে জানে।
—কালকের মাংস বেঁচেছে অনেক।
—মেশিনে থাকুক। বিকেল অবধি গেস্ট না এলে আমরাই খেয়ে নেব। স্বপন একটা প্লাস্টিকের বালতি এনে হাজির করে।
—মালা রায়ের সাবান, রুমাল, কাপড়ের চটি, ওর মায়ের আয়না, ডিরেক্টরের মোজা, সব ফেলে গেছে দাদা।
—নিয়ে যা।
—কি সাবান!
গৌরী একটি নাইলেন শাড়ি আনে।
—মেয়েটা আমাকে দিল। জলধর, স্বপন, অমরু ও মোহর আর বিবিকে পাঁচটা করে টাকা দিয়ে গেল আমার কাছে। মনটা খুব ভালো গো।
বিবি বলে, জীবনটা চলে যেত।
সুদেব বলে, আর না। ঝটপট কাজে লাগো।
অমরু খুব অসন্তুষ্ট। ওরা অমরুর সযত্নে সংগৃহীত, সযত্নে লালিত ভুঁইচাঁপার গাছগুলি মাড়িয়ে দিয়েছে। ”দুবার বিয়ে” ছবি কেন যেন লেগে যায়, কৃতজ্ঞতা স্বীকারে সুবর্ণ লজ ও দেবরূপ বটব্যালের নাম থাকে। সুবর্ণ লজের সবাই ছবিটি দেখে আসে। রানীপুরের দর্শক ছবিটি নেয়। সোনা বাঁধ ও সুবর্ণ লজ খ্যাতি পায়। টাইটেলে নমিতার নাম থাকে না। মালার স্বাক্ষরিত একটি ছবি সুবর্ণ লজে বসার ঘরে দেয়ালে ঝোলে।
অমরু খড়গপুর ওয়ার্কশপে ডি—গ্রুপে কাজ পেয়ে চলে যায়। তার জায়গায় তার সুপারিশে গোপাল চলে আসে। ফরেস্টে ক্যাজুয়াল কাজ করছিল, এটা বাঁধা মাইনের কাজ।
অমরুর দৃষ্টান্তে জলধর পড়তে শুরু করে নিজে থেকেই। সুদেবও বলে, পড় আমার কাছে। নয় বাঁধবেড়া স্কুলে ভর্তি হবি। চাকরি যদি পাস বেঁচে যাবি। সুবর্ণ লজে কেয়ারটেকারের জীবন চলে, চলতে থাকে।
ইতিমধ্যে সোনা বাঁধ থানার কাজ শুরু হয়, এবং বটেশ্বরে উদ্বোধিত হয় এক গ্রন্থাগার। বাঁধে নমিতার আরেকবার পড়ে যাবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কেন না জায়গাটির পর্যটক আকর্ষণ যেমন বাড়ে, পর্যটন বিভাগ বাঁধের গা দিয়ে রেলিং লাগায়, বেঞ্চ বসায় এবং নোটিস টাঙায় ”বাঁধে নামা বিপজ্জনক”।
এর মধ্যে কত পর্যটক আসেন ও যান তার ঠিক নেই। সুবর্ণ থাকার জন্যে যে কটেজটি, সেটি এখন হাওয়াবদলেচ্ছুক পারিবারিক কটেজ হয়ে যায়। সঙ্গে রান্নাঘর আছে। বাঁধ ও অরণ্যের বাতাস খাও, বেড়াও, থাকো।
অপরূপবাবু বলে যায়, মিডিল ক্লাস মানুষ মোটামুটি খরচায় থাকবে এমন জায়গা কোথায় পাচ্ছে? আমাদের বাবারা দেওঘর, কার্মাটার, মধুপুর, শিমুলতলা যেত। তা এখানে লালমাটি, ছোট পাহাড়, শালগাছ, সাঁওতাল গ্রাম, কি নেই?
প্রখ্যাত লেখক নীলেন্দু সেনরায় ওই কটেজে থেকে তাঁর পূজার উপন্যাস লিখে ফেলেন। বাঁধের ধারে বেড়িয়ে অসীম আনন্দ পান ও জলধর মহোৎসাহে ওঁকে ”করম পূজা” দেখিয়ে মুগ্ধ করে দেয়। ভিজিটরের খাতায় উনি লিখে দেন—
”বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি, সোনা বাঁধ ও সুবর্ণ লজ সেই কথাটাই জানিয়ে দিল। এ পৃথিবী জানি নাই আগে।”
রানীপুরে সুবর্ণ লজ বুকিং আপিস খোলা হয় অপরূপ বটব্যালের বাড়িতে। সেখান থেকে মিনি বাসে যাত্রী চলে আসে এখন। বাঁধবেড়ার উত্তরে কয়লার খনি আবিষ্কার একটা নতুন খবর হয়। যদিও পঞ্চাশ সালে ভারুচা কোম্পানী ওখানে কয়লা তোলার চেষ্টা করেছিল, রেল যোগাযোগ না থাকায় তারা কাজ ছেড়ে দিয়েছিল।
অপরূপবাবুর ভাই স্বরূপ বলে, রেল তো এখনো নেই। স্যাংশান লাইন, জয়পুর থেকে মালঞ্চ করে দাও, জেলার ম্যাপ পালটে যাবে। রেল হচ্ছে না, সেটা কেন্দ্র বিরূপ বলেই তো। এরই মধ্যে সুবর্ণ লজে কলকাতার বড় ব্যবসায়ী আয়রন অ্যানড স্টীল এজেন্ট মণিময় রায়ের চিঠি নিয়ে অপরূপবাবু স্বয়ং আসেন।
—কাণ্ড দেখ। লোকটার শরীর খারাপ। ডাক্তার বলেছে বিশ্রাম নিতে। নার্স নিয়ে, ডাক্তার নিয়ে, অ্যাটেনডেন্ট নিয়ে এখানে আসছেন। ড্রাইভারকে নিয়ে পাঁচজন।
—লজে, না কটেজে?
—ডাক্তার, ড্রাইভার, লজ দিয়ে দাও। ওনারা, কটেজে থাকবেন। কে যেন বলেছে, সোনা বাঁধ শান্তির জায়গা। লোকটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ছেলেরা সব দেখছে। শরীর খারাপ, মানে বড়লোকের শরীর খারাপ….
—ডাক্তারতো আনছেন।
—হ্যাঁ, চলাফেরা রাজার মতো বলতে হবে। ব্যবসা আমিও করি। দেহগতি খারাপও হয়। তা বলে নার্স রে, ডাক্তার রে….. কটেজটা সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে হয়।
—সবই তো আছে।
নীলেন্দু সেন রায়ের প্রস্তাব মতো কলকাতা থেকে কিছু যামিনী রায়ের প্রিন্ট এনে টাঙানো হয়েছে। অপরূপবাবু প্রথমে ছবি পছন্দ করেনি। কিন্তু শিল্পী বাঁকুড়ারই লোক, এ কথা জেনে মেনে নিয়েছে।
—ওঁরা আসবেন কবে?
—ওনারা জানাবেন, আমিও জানাব।
—লজ তো ভালো চলছে।
—তোমার হাত যশ!
—তা নয়। আপনি এভাবে টাকা না খাটালে…. আসলে বাগান বেড়ে গেছে। গোপালের আইডিয়াও যথেষ্ট। একজন দারোয়ান এবার দরকার। একেক সময়ে গোপাল দুটো সামলাতে পারে না।
—দেখি, ভেবে দেখি।
—লজের সম্পত্তিও তো বাড়ছে। এত পাখা, আলো, ভি. সি. আর., টি. ভি., বাসনকোসন, ফ্রিজ দুটো এখন। কটেজটা একপাশে। সেটারও সেফটি দরকার। সোনা বাঁধে লোকজন যাতায়াত বাড়ছে। চুরি, ডাকাতি রাহাজানি, সবই বাড়ছে। সেদিন বটেশ্বর গ্রামীণ ব্যাঙ্কে ডাকাতি হয়ে গেল। আমার কাছে ক্যাশও থাকে।
—দেখ, গিন্নিকে সব না বলে কাজ করব না। ওনাকে না বলে ছেলের বিয়ে দিলাম, সেই আমার সর্বনাশ হোল। তোর বউ বি. এ. পাশ করে ফেলল, তুই সেই…. এখন তো কলকাতায় ঘন ঘন যাচ্ছে। কার হাতে এসব রেখে যাব বল তো?
সুদেব হাসে।
—ভাববেন না।
—সুবর্ণও তাই বলে। বেটা কলকাতা যায়, একবার বোনগুলোর বাড়ি যায় না। তোমাকে সব বলে ফেলি। যাহোক, কাল সকালে আমি আসব, জনা চারেক বিজনেসের লোক। ওরা বিয়ার খাবে, দুপুরে মাংস ভাত, বিকেলে যাবে।
—আপনি কি খাবেন?
—ফল, ছানা, মিষ্টি, সে নিয়ে আসবে।
অপরূপবাবুর ব্যবসায়িক কথাবার্তা সুবর্ণ লজেই হয়ে থাকে। দেবরূপের বন্ধু—বান্ধবদের আড্ডাও।
—দেবা সেবারে কি বিল দেয়নি?
—ওঁর তিনবারের বিল হয়ে গেল।
অপুরূপবাবুর গলা পাল্টে যায়।
—এবারে আমি দিয়ে দিচ্ছি, পরে তুমিই বলবে। ওর দোকানে পাঠাওনি কেন?
—অন্যকে দিয়ে পাঠালে ওঁকে অসম্মান করা হয়। আমি নিজে বার কয়েক গেছি…
—বলতে পারো, আমার নিষেধ বাকি রাখা।
—আমি বললে উনি অসন্তুষ্ট হন।
—না, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সব ও উড়িয়ে দেবে। বউমাকে বুঝিয়ে পটিয়ে নিয়ে আসত যদি! ঘরে মন টেকে না। বয়স তো হোল। আর এগারোটা মাস কাটলে স্বস্তেন করে বউ আনাব। এতদিন ছাড়াছাড়ি, তারা অবশ্য আদালতে যায়নি। যদি সব ভালো হয়, শ্বশুর যদি ওকে জব্দ করতে পারে, স্বরূপ, মদন, আমার ভাইগুলোর ছেলেরা দেখ কেমন সুপথে চলছে।
সুদেব কিছু বলল না।
স্বরূপ আর মদনমোহন তো গ্রাম ছাড়েনি। সম্পন্ন চাষী, জোতদারই বলা চলে। মদনবাবুর আবার তেজারতি কারবার। ওদের ছেলেরা বাঁকুড়া কলেজে পড়েই দুজন ব্যাঙ্কে ঢুকেছে, একজন কলকাতায় ইনকামট্যাক্স প্র্যাকটিস করছে, এক ছেলের সারের ব্যবসা।
অপরূপবাবু গ্রামেও থাকেনি। ছেলেকে অত্যধিক প্রশ্রয় দিয়েছে। রাত—দিন শুনিয়েছে, মেয়েরা পরের ঘরে যাবে, এ সব তোমার।
দেবরূপের বিয়েও হল কলকাতায়। রানীপুরে তার মন বসে না। বাঁধবেড়ায় যায় না কত বছর। অপরূপবাবু তবু বাড়ির পুজোয় যায়। একেক বার একেক ভাইয়ের পালা পড়ে।
পরদিন অপরূপবাবুর বিশেষ অতিথিরা ঘুরে গেল। কটেজে এক অধ্যাপক সস্ত্রীক ছিলেন, তিনিও চলে গেলেন। বুকিং এখন রানীপুর থেকেই হয়। আজ কোনো বুকিং নেই। তবে সেচবাংলোয় সরকারী মিটিং চলছে, খাবারের অর্ডার আছে। এখন সেচ—ফরেস্ট বাংলোর খাবারের অর্ডার সুবর্ণ লজে খুব আসে।
সন্ধ্যায় ভূদেব এসে হাজির।
—সুদেব! তোকে খবর নিতে হবে।
—কি হোল? সেদিনই দিনে দিনে ঘুরে এলাম…
—আজই তো শুনলাম। স্বরূপবাবু বলল…
—কি বলল?
ভূদেবের চোখে জল।
—মাদুলির বর পরিমল নাকি বিয়ে করছে আবার। বটেশ্বরের যতীন সিংগির মেয়েকে। পাঁচ হাজার টাকা নগদ, ঘড়ি—আংটি সাইকেল—রেডিও মেয়েকে তিন ভরি সোনা…
—বটে!
সুদেবের মাথায় আগুন জ্বলে গেল।
—তুমি যাও বাড়ি। আমি দেখছি। কবে বিয়ে?
—সামনের মাসে…
—করাচ্ছি বিয়ে। মাদুলি কি কাঁদছে খুব?
—না। ভোমা মেরে বসে আছে।
—ওর ওপর নজর রাখো। বলো গে, ছোড়দা আছে, ভরসা রাখে যেন। ওঃ, এমন কাজের সময়টা এখন…যাক গে, কাজ তো বারমাসের দেখছি, দেখছি আমি। বটেশ্বরে বাড়ি তোর, চাকরি করে দিই আমরা ধরে করে…খুব বেড়েছে!
—কি হবে?
—পরিমল শিক্ষা পাবে। মাদুলিকে দিয়ে মামলা করাব। পঞ্চায়েত ডাকা করাব। আজ বিয়ে কাল ছাড়লাম, সুদেবের বোনকে নিয়ে সে করতে দেব না।
—মারদাঙ্গা করিস না।
—না না, তুমিও যাও। অন্ধকারে যাবে। জলধরকে নিয়ে যাও। ও সকালে চলে আসবে।
ভূদেব চলে যায়।
সুদেব বলে, স্বপ্ন! জেনে আয় তো, ইরিগেশন বাংলো থেকে কোন গাড়ি রানীপুরে যাবে কি না কাল ভোরে। বটেশ্বর যাব।
—বটেশ্বর যাবে দাদা, সাইকেলে যাও।
—ইরিগেশনে বি. ডি. ও এসেছে?
—না না, দেখলাম না তো।
রাত কাটে অস্বস্তিতে। পরিমলের সঙ্গে কাটান ছেঁড়ান করানো যায়, বোনের আরেকটা বিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু মাদুলির মনে কোনো জোর নেই। সুদেব অনেক বলে দেখেছে।
ভোরবেলা সুদেবকে দেখবে বলে পরিমল ভাবেনি। সুদেবকে দেখেই ঘরে ঢুকে পড়ে। সুদেবও ঢোকে।
পরিমলকে ঝুলিয়ে তুলে আনে বাইরে। পরিমল যদিও নিজেই বিয়ে ঠিক করেছে, এ সময়ে মাতৃভক্ত ছেলের মতো মাকে ডাকতে থাকে।
পরিমলের মা হামলে আছড়ে পড়ে।
—মেরো না, মেরো না সুদেব, পায়ে ধরি…
—বিয়ে দিচ্ছ ছেলের?
—সবে কথা হচ্ছে গো…ঠিক হয়নি।
পরিমলকে মারতে থাকে সুদেব।
—ভেবেছিস সুদেব রায় মরে গেছে? ভেবেছিস সুদেব রায় বাবু হয়ে গেছে? চাকরির পরোয়া করে? তোকে মেরে ফেলে ফাঁসি যেতে হয় যেতে পারি, জানিস?
ছেড়ে দিতে পরিমল ঘুরে পড়ে।
—এ যে রক্ত গো!
—জল ঢালো, আবার মারব।
পরিমল হাতজোড় করে।
—চল যতীন সিংগির বাড়ি।
—না দাদা! না!
—তোকে খুন করাই উচিত। পরশু এই বউকেও ছাড়বি, আবার বিয়ে করবি। ব্লকে পিওনের কাজ করে দিয়ে এই পরিণাম হোল? চল ওঠ। দরজার ভিড় সরে যায়। সুদেবের চণ্ডাল মূর্তি দেখে পরিমলের জ্ঞাতিরাও এগোয় না। ব্লকে চাকরি পেয়েছে বলে ওদের হিংসেও আছে।
যতীন সিংগি বটেশ্বরের সার—বীজ দোকানী।
সুদেব ওকে ডাকতে থাকে।
—আমাকে চেনো? দেখেছ?
—এ কি কথা সুদেব, কতবার দেখছি…
—এর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ? দেখ সিংগি, এ আমার নির্দোষী বোনকে নেয় না, চাকরি আমরা করে দিয়েছি, তারপর সাইকেল চাই বলে…সাইকেল চাই!
পরিমলকে ঝাঁকায় ও।
—হাতে আমার অনেক পথ আছে। পঞ্চায়েতে তুলব ওকে, কোর্টে যাব, পথ আছে। কিন্তু আমি তো সুদেব রায়। আমি ওকে কেটে ফেলব, তোমারও দোকানদারী ঘুচিয়ে দেব। পাপ নিকেশ করে ফাঁসি যেতে হলে যাব, জানলে?
যতীন সিংগি বলে, তবে যে শুনলাম কাটাছেঁড়া হয়ে গেছে? বিয়ে হতে পারে?
—কে বলল?
—পরিমল বলল।
—আমি বলি নি…
—তবে আমি জানলাম কোত্থেকে?
চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে সুদেব বলে, আমার বোনকে লাথ মেরে যে টোপর পরে, তার মাথা আমি ফেলে দেই। আজ এটা প্রথম দিন। এবার ওর অপিসে যাব, পঞ্চায়েতে তুলব ওকে, তারপর আদালতে তুলব, সাসপেন্ড করাব, মনে থাকে। তবে হ্যাঁ, যদি মিউচুয়াল করতে চায় সে অন্য কথা। সাতদিন সময় দিলাম, পরিমল ভেবে দেখুক। তিন দিনের পর, আমার যা মেজাজের হাল, ওকে আদালতেই তুলি, না ওর নামটাই তুলে দিই, সে আমার বিবেচনা।
পরিমল বসে থাকে। কান ছিঁড়েছে, গাল ফেটেছে, কাঁধের হাড়েও চোট।
—দেহেতো এতগুলো ঘা! যা! সাহস থাকে থানায় যা! নালিশ কর আমার নামে। কুত্তা কোথাকার। সিংগি বা বিয়ে দিচ্ছ, এ বিয়ে আইনী নয়। বউ থাকতে আবার বিয়ে! পরের বউটা রক্ষিতা! বুঝেছ? আইনে তাই বলে। দাও বিয়ে, কেমন সাহস দেখি!
পরিমলের মা বলে, তোমরা সব বোবা মেরে রইলে?
বটেশ্বরের প্রধান পূজারী বলে, ফ্যামিলি ব্যাপারে আমরা কি বলব? ছেলে সরকারী চাকরি করে, আদালতে মেয়ে কাটাছেঁড়া করো, সে বউকে খোরপোষ দাও, বিয়ে করো।
—আর বিয়ে! ছেলের যে দুর্গতি হোল…
সুদেব বলে, হয়নি হবে। আবার ডেকে হেঁকে বলে যাচ্ছি, দরকারে বোনকে বিধবা করব, ফাঁসি যাব।
সুদেবের মনে ভয় নেই।
সুদেব চলে আসে। আসার সময় আউটপোস্টে বলে আসে, আমার বোনকে ত্যাগ দেয়নি, আরেকটা বিয়ে করছে, শিক্ষা কিছু দিয়ে গেলাম।
বাঁধবেড়াতে গিয়েও ও সব বলে আসে।
ভবনীবাবুকে বলে, আপনি অঞ্চলপ্রধান। ওকে ডাকা করান। ও বলুক আমার বোনের কি দোষ। বোনকে ত্যাগ দিক, খোরপোষ দিক, তবে আবার বিয়ে করুক।
—দেখছি, দেখছি। তবে মারধোরটা না করলেই…
—করতে হয় দাদা। সেদিনে এই সুদেব মেরেছিল। মার খেয়েছিল বলেই আপনি বউ—বেটা নিয়ে বেঁচে ফিরলেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, সে কথা ভুলিনি।
—বলে গেলাম। বিচার চেয়ে বিচার না পেলে তবে মানুষ নিজে বিচারে নামে? আমি তো আপনাকেই বললাম।
—এখনো তুমি…?
—মাদুলি আমার একমাত্র বোন দাদা!
মাদুলিকে বলে, তুই মনে সাহস আন। সোজা কথা, ওরা এসে ভালো ভাবে কথা বলবে, সাইকেল দেব, ঘড়ি দেব, তোকে পৌঁছে দিয়ে আসব।
—যদি এরপর মারধোর করে?
—সাহস হবে না। তবে ”যদি” বলে কথা! তুই মন ঠিক কর। ”যদি” মনে হলে বিয়ে কাটাব। আবার বিয়ে দেব। এখন তো হচ্ছে। ভাল হচ্ছে।
মীনা বলে, গ্রামে কি তা চলবে?
—অবনীবাবুর ভাগ্নী করেনি?
বেলডাংরা কি শহর? ওসব ভুলে যাও বউদি?
—বোসো, খেয়ে যাবে তো?
—না, জল দাও শুধু। ভি. আই. পি. গেস্ট আসছে, তার বাহানা কত! না গেলে হয়?
গলা নামিয়ে বলে, মাদুলির ওপর নজর রেখো।
মীনা নিশ্বাস ফেলে বলে, পরিমল মাদুলিকে নেবে না। তাহলে বিয়ে ঠিক করত না। এখন বলার সুযোগ পাবে, ওকে মেরেছ। আরো কি! তোমার ভয়ভীতে নিল ওকে, তারপর মেরে দিলে?
—মাদুলি ভাবুক। পঞ্চায়েতে কথাটা উঠলে তবে খানিক পথ মেলে। পঞ্চায়েতকে সবাই ডরায়।
সুদেব মীনাকে বলল, ফ্যামিলি কোয়ার্টার পেলে ওকে নিয়ে যেতাম, কোয়ার্টার তো নেই।
—বিয়ে করো, কোয়ার্টার পাবে।
—ব্যবস্থাই নেই।
—করে দেবে। সবাই বলছে, তোমার জন্যে ওর রোজগার অনেক হচ্ছে লজ থেকে।
—মাদুলি! সাবধানে থাকবে। কেউ এসে বলল পরিমল ডাকছে, দৌড় লাগাবে না।
—না, তা যাব কেন?
—দেখ মাদুলি, দুঃখের দিন চিরকাল থাকে না, কেটে যায়। আমি কোথায় ভেসে যেতাম, তোরাই ফিরিয়ে আনলি।
—ছোড়দা, তুই বিয়ে করবি না?
—তোকে হাসি মুখ না দেখলে তো নয়। শোন, তুই কার মেয়ে, কাদের বোন মনে রাখিস। পরিমল একবার বলুক তোকে সম্মান করে রাখবে, আমি ওর পা ধরব। কিন্তু ওকে বলতে হবে। তোকে শক্ত হতে হবে। মেয়েদের নিয়ে এত হেলা অছেদ্দা। যত চুপ করে সইবে তত বাড়বে।
মা সব শুনছিল। এখন বলল, মার খেয়েছে, সে আসবে?
—মার খায়নি যখন, আসছিল?
মাদুলি বলল, সকলকে অবাক করেই বলল, মার খাবার কাজ করেছে, মার খেয়েছে।
নিশ্বাস টেনে এতদিনের চেপে রাখা কথা প্রকাশ করল মাদুলি। বলল, আমাকে হপ্তায় পাঁচদিন ঠেঙিয়েছে, নিজে একদিন খাক। চাকরি পেয়ে নিজের মাকেও মেরেছিল!
কয়েকটা নিশ্বাস টেনে বলল, তোমরা ভাবতে আমি ওখানে ফেরবার জন্যে গুসসে আছি। আমি ভয়ে মরে থাকতাম। যদি সাইকেল নিয়ে তোমরা বেচে দিয়ে আস।
মীনা বলল, বলবে তো?
—কাকে বলব? কে জিগ্যেস করেছে?
মা বলল, তুই হোথা যাবি না?
—ছোড়দা যেমন বুঝবে তেমন করব।
আগে এমন ছিল না। চাকরি পেল, যতীন সিংগি পেছনে লাগল… শাশুড়ি কিছু বলেনি, মনে যা থাক। ছোড়দাকে ডরায়…
সুদেব অবাক, অবাক। মীনাকে বলল, দাদাকে বোলো সব কথা। আমি চললাম। দাদাকে ভাবতে ধারণ করো।
যাক! মাদুলি কুয়োতে কাঁপায়, না পুকুরে…দাদা পাগল হয়ে আছে।
ফেরো, ফেরো সোনা বাঁধ। সকাল থেকে অনেক হয়েছে, আর নয়। ডাকসাইটে অতিথি এসে পড়লে আবার কতদিন আটকে যাবে কে জানে। যিনি যেমন ডাকসাইটে, তাঁর আবদার তেমনি নানা খানা। সবাই কি নীলেন্দুবাবুর মতো সাদা মানুষ হবে? যা দাও তাই বলে, অপূর্ব রান্না। কত কুণ্ঠাভরে সকালে বলত, সকালে উঠতে পারি না, রাত জেগে লিখি। তোমাদের কত অসুবিধেয় ফেলেছি!
ওঁকে লিখতে হবে। বটেশ্বর গ্রন্থাগারে ওঁর লেখা কয়েকটা বই যদি দেন। সুদেব নিজে পড়ে নেবে, তারপর লাইব্রেরিতে দেবে।
সোনা বাঁধ, সুবর্ণ লজ।
আশ্চর্য ব্যাপার বটে!
অপূর্ববাবুর গাড়ি, একটি বড় বিদেশী গাড়ি, সঙ্গে একটি মারুতি।
অপরূপবাবু প্রায় খেঁকিয়ে ওঠেন।
—এটা বাড়ি যাবার সময় হোল?
—বড় বিপদ বাড়িতে…
—ওনারা এসে গেছেন।
—সে কি!
—কাল রওনা হয়েছেন, রাতে শালবনী ডাকবাংলোয় ছিলেন, আজ ভোরে শালবনী ছেড়েছেন।
—ছি ছি ছি! ওঁরা কোথায়?
—কটেজে। শোনো!
গলা নামিয়ে অপরূপবাবু বলে, এখানে সই করলেন ডাক্তারের নামে। ওনার নাম বলা চলবে না। ওনাকে সর্বদা ”স্যার” বলবে।
ফিসফিস করে বলে, ডাক্তার বলল, এটা একটা রোগে দাঁড়িয়েছে! সদাই ভাবেন চারিদিকে শত্রু আমি তো বুঝিয়ে পাটিয়ে বললাম, কোনো অসুবিধে নেই। ওনার খাদ্য এবেলা ওবেলা সুপ, টোস্ট, কি কি, সব লেখা আছে। উনি অ্যাটেনডেন্ট আর নার্স নিয়ে কটেজে থাকবেন! ড্রাইভার আর ডাক্তার লজে। জলের ফিলটার এনেছে, ওনার খাবার জল ফোটাবে—জুড়োবে—ফিলটারে ঢালবে। ছি ছি! এখানকার জল বলে কত হজমী!
আর রান্না হবে…উনি এসেছেন…
সূর্যমুখীর তেলে!
—সব হয়ে যাবে, ভাববেন না।
—আমাকে এমন খেঁকাচ্ছে, আমি যেন ওর চাকর। আমি ”স্যার” বলছি, উপায় কি?
—আর দুটো ঘরে গেস্ট এলে?
—তা আসুক না। উনি তো কটেজে।
—আমি একবার যাই।
—যাও, তাই যাও। তুমি না থাকায় আমি…কি বিপদ হয়েছে যেন বললে?
—ঝটপট তো বলা চলে না, পরে বলব।
—ওনারা যে ক’দিন থাকে, ঘরে যেও না।
এখানে কাজটা কম দায়িত্বের নয়। যাও, যাও…
—না, দায়িত্ব ফেলে যাব না।
সুদেব বলতে পারত, রক্ত যখন ক্ষেপে, আমাকে নোটিস দেয় না বড়বাবু রক্ত ক্ষেপলে আমি চাকরির পরোয়া করব না।
মনেই থাকবে না।
বলল না।
সুদেবকে যেতে হোল না।
চুল উঁচু করে বাঁধা, সুসজ্জিত একটি মেয়ে পারফিউমে বাতাস ভারি করে ঢুকল।
—আপনাদের কেয়ারটেকার এসেছেন?
—নমিতা, তুমি নমিতা!
—হ্যাঁ, ইনিই…নমস্কার করো সুদেব।
—ন…ন…নমস্কার। আমি সুদেব রায়।
—নমস্কার। শম্পা ঘোষাল। শুনুন, মিস্টার রায়ের জন্য স্নানের জল চাই, একটা পনেরোয় ওঁর লাঞ্চ যাবে। চিকেন সুপ, বিনসেদ্ধ, টোস্ট, একশো গ্রাম দই। খাবার ড্রাইভার নিয়ে যাবে। উনি সকালে সাতটা থেকে আটটা গাড়িতে বেড়াবেন। তার মধ্যে কটেজ পরিষ্কার করে দিতে হবে। কটেজে আপনারা কেউ যাবেন না। ড্রাইভার একটার মধ্যে খেয়ে নেবে। উনি লাঞ্চ খেলে আমি, ডাক্তার আর সিস্টার এসে খেয়ে যাব।
বিকেল চারটে পনেরোয় ওঁকে লেবু চা দেবেন, এই যে গ্রীন টী’র প্যাকেট।
রাত আটটা পনেরোয় উনি সব্জীর সুপ, একটা রুটি কাস্টার্ড খাবেন।
—লিখে নিতে হবে।
—নিন। ওঁর ব্যাপারে সময়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
অপরূপবাবু বলে, খুব রাগী?
—সময়টা রেখে চলবেন। আপনি তাড়াতাড়ি সময়গুলো লিখে নিন। আমি গেলে ড্রাইভার আসবে জল নিতে।
—চলুন।
সুদেব যন্ত্রচালিত। সুদেব, শেখো, গতকালকে ভুলে যাওয়া দরকার।
সেদিন তুমি নমিতা নামে একটি মেয়েকে দেখেছিলে। সে রাতের নীরব সঙ্গীত ভালোবাসত। সামান্য সাঁতার জেনেই তাকে জলে ঝাঁপ দিতে হয়েছিল। নিশ্চয় সামান্য টাকার জন্যে, যা তার কাছে সামান্য ছিল না। ছোট একটা সস্তা ব্যাগে দুটো তিনটে কাপড় নিয়ে সে এসেছিল। তাকে তুমি জল থেকে তুলেছিলে।
ভুলে যাও। ও সে পরিচয় মুছে ফেলেছে। এখন ওর পরণে দামী শিফন, গায়ে খাটো জামা এঁটে আছে। ঠোঁটে লিপস্টিক, হাতে ঘড়ি। কাঁধের ব্যাগটি দামী।
অফিসঘরে ও এমনভাবে বসে, যেন নবাগতা। ব্যাগ থেকে নোটবই খুলে বলে, লিখুন।
—লিখছি।
—সকাল আটটা পনেরোয় ওঁর ব্রেকফাস্ট যাবে। শুকনো টোস্ট, দুধ, কালো কফি। দুপুর একটা পনেরোয় লাঞ্চ।
চিকেন সুপ, বিনসেদ্ধ, দুটো টোস্ট, একশো গ্রাম দই। বিকেল চারটে পনেরোয় লেবু চা, এই চা দেবেন। রাত আটটা পনেরোয় সব্জীর সুপ, একটা পাতলা আটার রুটি—পোড়া দাগ থাকবে না—কাস্টার্ড দেবেন। ওঁর কাস্টার্ড প্যাকেট, খাবার দেবার প্লেট, বোল, কাপ, চামচ, ন্যাপকিন আনোয়ার দিয়ে যাবে, ড্রাইভার।
—আপনাদের?
—আমি, আনোয়ার, সিস্টার সবই খাব।
ডক্টর মোদী নিরামিষ খাবেন, যা হয় দেবেন, টক দই আর রুটি দু’বেলা।
—আর কিছু?
—সকালে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে ঘর পরিষ্কার করবে। মোট কথা উনি এখানকার কোনো লোককে ওঁর কটেজে দেখতে চান না।
—ঘর সাফ করার সময়ে ঘরে থাকবে কে?
—সিস্টার অথবা ডাক্তার মোদী!
—লিখে নিয়েছি।
—আচ্ছা।
—নমিতা দেবী!
—শম্পা ঘোষাল। কিছু বলবেন?
—কিছু না।
—ও, রোজ স্টেটসম্যান তো পাব না, তাই না?
—বড়বাবুকে বলুন, যদি কিছু করতে পারেন।
—কটেজে ভি. সি. পি. চলে তো?
—চলে।
—ইলেকট্রিক?
—সমস্যা নেই। ভালো ইনভার্টার, জেনারেটর…
—ধন্যবাদ।
শম্পা ঘোষাল বেরিয়ে যায়।
অপরূপবাবু বলেন, আমি চলি।
স্টেটসম্যান পাব বা কোথায়, পেতেও বিকেল হবে।
সুদেব বলে, মোহরদা, চা খাওয়াও।
গৌরী বলে, তোমায় চেনেনি, আমাদের ঠিক চিনেছে। বুড়াটার দেখা—ভালা করে, টাকা পায়।
—কিছু বলল?
—কি বলবে?
মোহর চা আনে। বলে, সায়েবের মেজাজ যত, ড্রাইভারের মেজাজ তত। হবে না।
ড্রাইভার ডান হাত। সায়েব ওকে অ্যাম্বাসাডর গাড়ি দিয়েছে, লাকসারি ট্যাক্সি খাটায়। হাজার টাকা মাইনে দেয়, খাওয়া পরা।
—দেখ! আমার চেয়ে কত বড়লোক ওই ড্রাইভার।
—ছোটবেলা থেকে আছে। আর দাদা! এটা হোল কপালের ব্যাপার। যে যেমন কপাল করে আসে।
—সেই তো কথা। এখন গুনে নাও…
—পথে হাট পেয়েছে। জলধরের বাপ উপেনের কাছে এক ঝাঁকা মুরগী কিনেছে।
—থাকবে?
—মর্জি! ড্রাইভার বলল, সাতদিন থাকবে বলে হাজারীবাগ গিয়ে দু’দিন বাদে চলে এসেছে। এখন প্রচণ্ড বাই রোগ। পেলেনে চাপে না, ট্রেনে যায় না, নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হবে। গাড়িতে ঘোরে। ড্রাইভার বডিগার্ড গো!
পিস্তল রাখে।
—এত খবর জোগাড়ের সময় কখন পেলে?
—অনেকক্ষণ এসছে।
—আমার বড্ড ঘোরাঘুরি গেছে আজ।
স্নান করব, কিছু খাই।
—বটেশ্বর জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছ।
—কে বলল?
জলধর বলে, খবর চাপা থাকে? বাবা বলে গেল। বাবা চোদ্দোটা ছোটবড় মুরগী তিনশো টাকায় বেচেছে।
—সর্বনাশ। মদ খাবে।
জলধর ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসে।
—সি হবে লাই। মা সাথকে আছে। গৌরীর চুল চুড়োতে বাঁধা, বড়—সড় কাপড় খাটো করে পরা। দেখলেই বোঝা যায় গৌরী ‘কথা কম কাজ বেশি’ পার্টি। গৌরী বলে, সবার জন্যে সুদেবের মতো কেউ ভাববে না। জলধর কাজে যাক এখন। বাসন মাজার পাউডার লাগবে, ঘর মোছার ঝাড়ন, এবং সন্ধ্যায় সুদেব যেন অবশ্য হাতিপোতা যায়। আজ শুয়োর খাওয়া হবে।
—এনে দিস মাসি। এখন গেলে চাকরি চলে যাবে।
স্নান করে সুদেব। স্নান করলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কিন্তু মনের ভেতরটা জুড়োয় না। নমিতা…শম্পা…ওর আসল নাম কি? নমিতাকে ও যেন মুছে ফেলেছে। কিন্তু চোখের অতলে কি ছিল? সুদেব কোনোদিন বলতে পারবে না, নমিতাকে জল থেকে তোলার পর সুদেবের মনে কি মমতা হয়েছিল। ইন্দ্ররা ওর কথা ভাবছিল না।
মালা রায়ের ওই দুর্ঘটনা হলে ছবিটাতো পাল্টে যেত। ইন্দ্ররা অত নির্লিপ্ত থাকতে পারত না। সেদিন নমিতা মারা গেলেও সেটা হোত একটা অপ্রীতিকর দুর্ঘটনামাত্র। নমিতাদের জীবনের খুব একটা দাম নেই।
স্নান করে সুদেব একটু দই চিড়ে খায়।
যাক, শত অশান্তিতে একটা শান্তি, মাদুলি মনে মনে ভেঙে পড়েনি।
বিয়ে কাটাছেঁড়া করিয়ে মেয়েটাকে আবার বিয়ে দিলে ঠিক হয়। তবে পাড়াগাঁয়ে কাজটি সহজ নয়।
বিকেলে সুদেব দেখতে পায় মহামান্য অতিথিকে।
বয়স বছর সত্তর তো হবে। পাকানো চেহারা, কালো রঙ, ধপধপে পাঞ্জাবী পায়জামা পরে কোনোদিকে না চেয়ে হেঁটে এসে গাড়িতে ওঠে। একদিকে শম্পা, নতুন পোশাকে। অন্যদিকে সিস্টার। আনোয়ার গাড়ির দরজা খুলে ধরে। দুপুরে সুদেব শুনেছে ওটা জাপানী গাড়ি, কলকাতায় কমই আছে।
ভদ্রলোকের চোখে কালো চশমা।
ডাক্তার মোদী বলেন, এক ঘণ্টার জন্যে নিশ্চিন্ত। যাক, মনে হচ্ছে জায়গাটা ওঁর ভালো লেগেছে।
—কি করে বুঝলেন?
—এ অবধি একবারও চেঁচান নি।
—উনি অসুস্থ হলে এমন জায়গায়…
—অসুখ আছে, মনে। ওঁর ধারণা উনি অসুস্থ। যাক গে। আমার ঘরে পাখাটার স্পীড নেই।
—দিনে একটু কম থাকবে, রাতে বাড়বে।
—মশারি টাঙাতে হবে কেন?
—সাপ—টাপ আছে…সাবধানে থাকা।
তবে সাপ এ লজে কোনোদিন ঢোকেনি।
—চমৎকার বাগানটি। জায়গাটা সুন্দর।
কলকাতা থেকে এমন দূরে নয়, কিন্তু মনে হয় কোথায় চলে এসেছি। আচ্ছা, ওই মন্দিরের ঠাকুর খুব জাগ্রত?
—সবাই তাই বলে।
—যেতে হবে, যেতে হবে। আপনি তাস খেলেন?
—না।
—কি যে করি!
—হেঁটে আসুন না।
—না না। বস জানতে পারলে…
বাগানেই হাঁটি!
এক সময়ে ওঁরা ফিরে আসেন।
তারপর সিস্টার, আনোয়ার আর ডাক্তার তাস বের করেন লাউঞ্জে।
সিস্টার তাস ভাঁজতে ভাঁজতে বলে, এখন শম্পা দেখবে। ওঃ, বস পারে বটে…
আনোয়ার বলে, কথা নয় ম্যাডাম।
কি পারে শম্পা? কেন কটেজে ও এবং মনিব রইল, সিস্টার বেরিয়ে এল?
সুদেবের সব গোলমাল হয়ে যায়।
আটটার সময়ে আনোয়ার উঠে পড়ে।
বসের ডিনার নিয়ে আনোয়ার এবং তার সঙ্গে সিস্টার যায় কটেজে। ডাক্তার মোদী বলে, আমার ডিনারটা দিন!
—এখনি খাবেন?
—হ্যাঁ। আমি গেলে ওরা খেতে আসবে।
ওঁকে একলা রাখা বারণ। কাছে লোক থাকতে হবে।
—দিয়ে দিচ্ছে।
সুদেব ঠিক করেছে নিজের মধ্যে নিজেকে শাসন করে থামিয়ে রাখবে। সে সুবর্ণ লজের কেয়ারটেকার সে পরিচয়টাই প্রথম সত্য। অপরূপবাবু কয়েক ঘণ্টার অনুপস্থিতিও সহ্য করবে না। অতিথিদের বেলাও সজাগ থাকতে হবে। কেননা সকলে একরকম নন। কে কবে নালিশ করবেন, চটে যাবেন কে জানে।
ডাক্তার মোদী খেতে বসে। বলে, আমাদের বস অত্যন্ত সাহেবী মেজাজের লোক।
—রান্না বিষয়ে, খাবার বিষয়ে বলবেন দয়া করে।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চই।
ন’টা নাগাদ শম্পা, আনোয়ার ও সিস্টার খেতে আসে। সিস্টার ও আনোয়ার কথা বলে। শম্পা নীরবে খেয়ে যায়।
সুদেব একটু তফাতে দাঁড়িয়ে থাকে।
সিস্টার বলে, কাল কি খাওয়াবেন?
—মাছ, মাংস, ডিম, বা বলবেন।
আনোয়ার বলে, জংলী জায়গা, যা পাবেন খেয়ে নেবেন। এ কি শহর যে চয়েস পাবেন?
তারপর বলে, রাস্তা খুব রাফ। কিন্তু বসের পছন্দ হয়েছে জায়গাটা।
খাওয়ার পর ওদের যান্ত্রিক প্রস্থান।
শম্পা আর সিস্টার চলে যায়, ডাক্তার মোদী চলে আসে।
রাতে টর্চ ফেলে বাগান, আশপাশ দেখা সুদেবের কাজ। বাগানে দাঁড়িয়ে আছে শম্পা।
—সুদেববাবু।
সুদেব দাঁড়িয়ে পড়ে।
—আমাকে বলছেন?
—হ্যাঁ।
—কি বলবেন, বলুন।
—আপনি তো আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না?
—আপনারা গেস্ট, আমি কেয়ারটেকার। সুবিধে—অসুবিধে জানাবেন, আমি সাধ্যমতো দেখতে চেষ্টা করব। কিছু মনে করবেন না, রাতে এ ভাবে বেরিয়ে এসে ঠিক করেননি।
সেবারও বলেছিলেন। সাপ আমাকে কামড়াবে না সুদেববাবু। সেবার আপনি আমার প্রাণ বাঁচালেন, তারপর আপনাকে ধন্যবাদও জানাইনি। জানালে আপনাকে অবশ্য ছোট করা হোত।
—আপনি শুতে যান।
শম্পা ঈষৎ হাসে।
—কত দূরে চলে গেছেন আপনি। যাব, পরে যাব। বস এখন ক্যাসেট দেখছেন। বারোটা অবধি সিস্টার ওঁর কাছে থাকলেই হয়। আমার ডিউটি তারপর।
—এটাও কি…সাঁতার কম জেনেই জলে নামতে বাধ্য হয়েছেন?
—অপমানকর কথা, কিন্তু সত্যি।
—আপনার কি কেউ নেই?
…সেদিন তো আপনি ছিলেন।
…এটা কি জবাব হোল?
—আপনার বাড়ি কাছেই, তাই না?
—হ্যাঁ।
—সেবার গৌরীদিদি অনেক কথা বলেছিল।
একটু হেসে শম্পা বলে, আপনি না কি ভীষণ ডাকাত। ক্ষেপে গেলে অন্য মানুষ।
—আর কি বলেছে?
—মা, দাদা, বউদি, ভাইঝি সবাই আছেন আপনার। কি কপাল আপনার। কত আপনজন।
—গৌরীদি। এত কথা বলল কেন?
—আমি জিজ্ঞেস করতাম। ওদের সঙ্গে গল্প করতাম তো। বলেছে আপনি ওদের জন্যে খুব করেন।
—আমি আর ওরাই থাকি। সনাতনদা, গৌরীদি ওদের কিছু জমিতে ভাগ আছে। ছেলে চাষ করে। গোপাল, অমরুর দাদা। গোপালের সঙ্গে ক্লাবে দৌড়েছি। জলধরের বাবা আমার উপেন কাকা।
—শুনতে কি ভালো লাগে।
—গ্রামে বলুন, এখানে বলুন, একটা সম্পর্ক গড়ে না দিলে আমরা বসবাস করতে পারিনা। অবস্থাতেও খুব তফাত ছিল না। মা পরের ধান এনে সেদ্ধ করতেন। দাদা অঘ্রাণে ধান কিনে ভাদ্রে বেচত। ক্রমে দাদা গ্রামে কাজ পেল…
আমি কাজ পেলাম এখানে…
—অমরু চাকরি পেয়েছে?
—পেয়ে গেছে।
—ওদের তো সুবিধে।
—লেখাপড়া কোথায়, যে সে সুবিধে কাজে লাগাবে। আর, খবরাখবরও তো রাখে না, জানতেই পারে না।
অসুবিধে ওদের অনেক।
—দেখাই হোল না ওদের গ্রাম।
—আপনি এবার যান।
—যাব। নিশ্বাস ফেলে শম্পা।
—মাপ করবেন, কেন আপনি…
—টাকার জন্যে।
—বিয়ে থা করে ঘরসংসার করতেন…
—সুদেববাবু, আপনাকে যদি কেউ বলে আমাকে বিয়ে করতে, আপনি কি সিনেমায় এক মিনিট চেহারা দেখায় এক নামে, এ রকম লোকের অ্যাটেনডেন্ট হয়ে আসে আরেক নামে, তেমন মেয়েকে বিয়ে করবেন? করবেন না। অন্য কেউ বা করবে কেন?
শম্পা চলে যায়।
সুদেবের মনে হয় ওর ভেতরটা কাঁপিয়ে দিয়ে গেল শম্পা! জানা হোল না ওর নাম কি।
চলে এল ও।
লাউঞ্চে বসে দামী সিগারেট টানছে আনোয়ার।
—কি বলছিল ম্যাডাম?
সুদেব জবাব দেয় না।
—শুনলেন কথাটা?
—আমাকে বলছেন?
—আর কাকে?
সুদেবের রক্ত ক্ষেপতে থাকে।
—আপনাকে জবাব দিতে হবে?
—আমি ছাড়া বসের ভালোমন্দ দেখার কেউ নেই, আমিই ওনাকে দেখি। এ ম্যাডাম, ভালো…নানারকম ম্যাডাম আসে…ফালতু কথা বলে কাজ খোয়ায়…লোকটা কি জানে, সুদেবের হাতের কবজি ও চেটোতে কি অসীম, বন্য শক্তি? কিন্তু হঠাৎ মনে হয়, শম্পা নমিতার বিপদ হতে পারে।
—সায়েবের টাইমগুলো আবার জেনে নিচ্ছিলাম। এখানে পাওয়া যায় না সব…লোকজনও তেমন তৈরি নয়…এই সব।
আনোয়ার ঈষৎ হাসে।
—তবে তাই। বস ইদানীং গাড়িতেই ঘুরছেন। এসব জায়গায় উনি আসবেন…দরজায় তালা দিচ্ছেন? রাতে কটেজে যেতে হলে কি করব?
—আমার ঘর দেখেছেন, ডাকবেন।
আমাদের যেমন নিয়ম তেমন কাজ করতে হবে। রাতে মশারি টানাবেন, গুঁজবেন। কোনো দরকারে বেল বাজাবেন। ডাক্তার মোদীকে কথাটা বলা হোল না, তবে ঘরে লেখা আছে।
—মোদী উঠবে না। লোহার পাত বালিশের নিচে রেখে ঘুমোবে সকাল অবধি। বেজায় ভূতের ভয়।
আনোয়ার হাসতে থাকে।
সকলের বিষয়ে এমন তাচ্ছিল্য ভরে কথা বলতে পারে যখন, এ আস্পর্ধাটা ওকে ওর মনিব দিয়েছে নিশ্চয়। এই অসভ্যতা এখন তো হরদম দেখা যায়।
—আমার কথায় রাগ করবেন না কেয়ারটেকারবাবু। ওনারা সবাই টেম্পোরারি। আমি পার্মানেন্ট।
সুদেব জবাব দেয় না। ঘরে চলে যায়।
শম্পা—নমিতা ওকে ভয়ানক ঘা দিয়েছে। কথাটা তো সত্যি। সুদেব ওর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারে, ওকে মমতা দেখাতে পারে। কিন্তু বিয়ে করতে হলে সুদেব নিশ্চয়ই কোনো দাগী মেয়েকে নির্বাচন করবে না। অথচ সুদেবের নিজের জীবনেও অনেক দাগ।
এরকমই হয়ে থাকে, সে জন্যেই বলেছে সুদেবের হঠাৎ ওর দাদার কথা মনে হোল।
মাসখানেক আগেই মীনাকে বলেছিল, কতরকম অবস্থায় পড়ি, কত অপমান হই, সুদেব হলে সহ্য করত না। সুদেব ”সুদেব”ই থেকে গেল। মা দাদাকে ”বড় খোকা” বলে, সুদেবকে ”ছোট খোকা” কখনো বলেনি। দাদা বলেছিল, ক্ষেপে গেলে ও অন্য মানুষ। হবেই তো। পিছটান তো নেই। আমি ভাবি আমার মা—বোন আছে, বউ মেয়ে আছে।
মীনা আস্তে বলেছিল, ওরও মা—বোন আছে।
—আছে, আছে, সব আছে। কিন্তু বিয়ে করলে, ছেলেমেয়ে হলে, তবে সবটার ওপর পিছটান আসে।
—বিয়ে করে ছেলে মা—বাপকে ভোলে এও তো দেখছ।
…ও তো সে ছেলে নয়।
—মাদুলিকে দেখে জ্বলে আছে, তাতেই…আমারও খুব ইচ্ছে করে ও বিয়ে করুক ওর সংসার হোক। এখন দেখ, সংসারে মানুষজন দরকার। গ্রামদেশে বাস করতে লোকবল চাই। এখানে লোক ছাড়া চলে না।
—তুমি যেমন একটা ”লোক” হয়েছ সংসারে।
—সে কথা ছেড়ে দাও। তোমার—আমার বিয়ে হতেই হোত। এটা হোল জন্ম—জন্মের লেখা।
সুদেব কি সে জন্যেই দাদার মতো বুঝদার, শান্ত, নিজেকে মানিয়ে চলা মানুষ হতে পারল না?
পরদিন সুদেব রাতে শম্পা—নমিতাকে বাগানে দেখে না। ও খেতে আসে, চলে যায়। সকালে ও বিকেলে বেরোয় গাড়িতে। সুদেবের দিকে তাকায় না। তার পরদিন কি হয় তা বোঝা যায় না।
রাতে খেতে এসে শম্পা—নমিতা বলে, বিলটা রেডি রাখবেন সুদেববাবু। কাল সাড়ে আটটা থেকে ন’টার মধ্যে বেরিয়ে যাব আমরা।
—কোথায়?
—কলকাতা।
—বিল রেডিই আছে।
সিস্টার, আনোয়ার, মোদী, সবাই নির্বাক।
শম্পা ঘোষাল বিল চুকিয়ে দেয়, রসিদ নেয়। সনাতন, গৌরী, জলধর, স্বপন, গোপাল, মোহর, বিবি, প্রত্যেকের সার্ভিসের জন্যে একশো টাকা করে দেয়।
—ওরা খুশি হবে।
—উনি খুশি হননি। খুশি হলে দুশো দিতেন। আর শুনুন আমি আপনাকে চিঠি লিখে জানাব আমার কথা। এদিকে কোথাও যেমন তেমন কাজ হলে আমাকে একটু খবর দেবেন? আমি থার্ড ডিভিশনে উচ্চমাধ্যমিক পাশ। বুড়ো লোকদের মাসাজ, সেবা করতে পারি। ভদ্র পরিবারে রান্নাবান্না করতে রাজী আছি, দেখবেন তো?
—দেখব।
—এ কাজ তো কলকাতায় ফিরলেই যাবে। দেখবেন।
সেদিন রাতে কথা বললেন বলেই কি…
—ও একা পার্মানেন্ট। ইনি কোনো লোককেই বেশিদিন সহ্য করতে পারেন না। আনোয়ারের সঙ্গে অন্য সম্পর্ক। চলি।
—আবার আসবেন?
—সে কি আমিই জানি?
এবার গৌরী আর বিবিকে নিজের কাপড় দুটো দেয়। জলধরকে বলে, লেখাপড়া কোর।
সুদেবকে বলে, গভীর মমতায় বলে, অমন হটচটকা ক্ষেপে যাবেন না। এবারে একটি লক্ষ্মী মেয়েকে বিয়ে করুন, ঘর সংসার করুন।
—ডাকাতকে মেয়ে দেবে কে?
—বেটাছেলের বিয়ের অভাব কি হয়?
হয় না। বিয়ে করবেন, কেমন?
মলিন হেসে বলে, এবারে যেতে ইচ্ছে করছে না একেবারে। কেন জানি না।
পরদিন ওরা চলে গেলে গৌরী বলে, বুড়াটা পিচাশ বটে। দিদিটাকে রোজ মার খেতে হবে এমন চাকরি, তাতেই অত মাইনা দেয়! তা দিদিটা ভালো তুই ওকে বিয়া কর কেনে?
—কি বলিস?
—উদামাদা থাকবি?
খুব উদ্বেগ না হলে গৌরী ওকে ”তুই” বলে না।
—তুদের জাতে বিয়া করি যদি?
—মেরে বানধে ফেলে দিবে।
—আমি…আমি…সন্ন্যাসী হব।
—মিছা কথা। বাবুটো পিচাশ বটে। বড়লোকের কত খেলা, সাতবুড়ার এক বুড়ো! ছিঃ।
দেবরূপ সহসা দর্শন দিতে আসে।
—ম্যারেজ প্রবলেম সলভ হয়ে যাচ্ছে এবার।
—খুব ভালো কথা।
—শ্বশুর বলছে কলকাতায় এসে বিজনেস করো। বউ বলেছে, এখানে থাকবে, ঠিক ভাবে চলবে।
—তাই করুন।
—করতেই হবে। আগে শ্বশুর কিছু খসাক, এখানে ধার কর্জ মেটাই। জানেন তো এগারো মাসের আগে আমার রাহু কাটছে না। বরেন ব্রহ্মচারীর নাম শুনেছেন? ইন্টারন্যাশনাল জ্যোতিষী মশাই। ইন্দিরা গান্ধী খুন হবে, বলেছিল। রাজীব পি. এম. হবে, বলেছিল। খোমিনি মরবে, বলেছিল। মিডিল ইস্টে খুব পশার। তাকে দিয়ে শ্বশুর যজ্ঞ করাল।
বাঁ ও ডান, দু’হাতে নানাবিধ পাথর।
—খারাপ সময়টা কাটুক, অন্য দেবরূপ। অপরূপ বটব্যাল বনগাঁয়ে শেয়াল রাজা হয়ে থাকুক।
দুঃসময় অন্যভাবে কেটেছিল।
মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে দেবরূপ হাসপাতালে পড়ে থাকল। অতঃপর নার্সিংহোম। তারপর স্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ। স্ত্রীও হিন্দি ছবির হিন্দু স্ত্রীর মতো দেবরূপকে নিয়ে গেল। সল্টলেকে ”উদয়াচল” ভবনে। অপরূপবাবু বলল, সুবর্ণও ক’দিন ওখানে থাকবে। এ যাক, মন্দের ভালো হোল। প্রাণে বাঁচল, মতি যদি ফেরে।
অপরূপবাবুও বটেশ্বরে বিশাল আয়োজনে পুজো দিল। শিবকে সোনার বেলপাতা দিল। সুদেবকে বলল, ডাইভোর্স হলে নাক কাটা যেত সুদেব। বড় কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচিয়েছে থেকে ভগবান।
অ্যাক্সিডেন্টের ফলে দেবরূপ ভগবৎভক্ত হয়ে গেছে। মদ, সিগারেট খায় না। বরেন ব্রহ্মচারীর ছবি পুজো করে। আর সুদেবকে চমকিত করে পরিমলের মা পরিমলকে নিয়ে বাঁধবেড়া গেল। পঞ্চায়েত মাদুলির সপক্ষে যেত। উত্তেজিত ভূদেব সুদেবকে সব বলে গেল।
চার
সে এক বলার মতোই ঘটনা। বটেশ্বর অঞ্চলে কোনো পঞ্চায়েতে এমন ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য কোন পঞ্চায়েতে অবনী, স্বরূপ, মদন, হোপন মান্ডি, বীরু পাত্র পাঁচ মাথা এক হয়! পরিমলের মা পরিমলকে নিয়ে এসেছিল। পরিমল বাড়িতে ঢোকেনি। ঘরের বাইরে পথের দিকে যে সজনে গাছটি অনেককাল মানুষকে চচ্চড়ি খেতে ফুল ও ডাঁটা দিচ্ছে, তার নিচে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাড়িতে সুদেবের বেয়ানকে দেখেই কাঁদতে শুরু করে।
—কোথা থেকে কি হয়ে গেল বেয়ান, আগে কত ভালোবাসা ছিল, মাদুলিকে দেখে তুমি বলেছিলে, বউ নয়, মেয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তারপর কোথায় কি দোষ হয়ে গেল, কে দোষী…
মীনা এসে পরিমলের মায়ের পা ধুয়ে দিল, গামছা দিয়ে মুছে দিল। ভূদেব এসে প্রণাম করে জোড় হাতে দাঁড়াল। তখন পরিমলের মা নিশ্বাস ফেলে বলল, ছেলেকে এনেছি। দোষ তো আমাদের। মিটমাট না করলে পঞ্চায়েত লোক ডাকবে, মারা করাবে, তা তোমরাই তাকে মারো। সুদেব তো বউনি করে এসেছে। শেষটাও এখানে হোক।
ভূদেব বলল, পঞ্চায়েত অতটা ঘামত না। কিন্তু বিচারটা ঠিকমতো করলে মানুষের মনে পঞ্চায়েতের ওপর একটু ভরসা ফেরে, সে কথা ভাবল। পঞ্চায়েতে সুবিচার অনেককাল হয় না। আর বউ ছেড়ে বিয়ে এখন ঘরে ঘরে।
ভূদেব গিয়ে স্বামী—স্ত্রীতে পরিমলকে যথেষ্ট খাতির করেও ভেতরে আনতে পারেনি।
মাদুলি বলেছে, পঞ্চায়েত বিচার করেছে, পঞ্চায়েতকে লিখে দিক।
পরিমলের মা বলেছে, ছোট ছেলে যখন সব করল, তাকে বোল আমি আর আমার বেটা এসেছিলাম।
সুদেব বলল, কি করবি?
সুদেব বলল, একবার ওরা ঘুরে গেল। কিন্তু মাদুলি যদি ভরসা পায় তবেই তো। আমিও যাব। এত কচাকচির পর মিলমিশ হয় কিনা দেখতে হয়।
—যাহোক ওরা ঘুরে গেল, অবনীবাবু বলছিল এবারে তোমরা যা হয় ঠিক করো। আমার কাছে নিয়ে এসো দুজনকে। পরিমল যদি কথা দেয়…
—দাদা! কথা দিলেও পরে হেনস্তা করতে পারে।
নিশ্বাস ফেলে সুদেব বলল, আমাদের দক্ষিণের জমিটা মাদুলিকে লিখে দেয়া যায়, দেড় কাঠা হবে, দামও আছে। ঘর তুলে দিতে পারি, সাইকেলও ধার করেই দেব। চোখের ওপর থাকলে অনেক নিশ্চিন্ত।
—সে আসবে?
—বলা যায়। কথাটা অবনীবাবু বললে ভালো হয়, যেন সেই বিচার করল।
—দেখি মাদুলি কি বলে।
মাদুলি বলল, বটেশ্বরে সে নিজেকে রাজাগজা মনে করে। এখানে সে জব্দ থাকবে এ এক কথা। আর কাটান—ছেঁড়ান, আবার বিয়ে, সেও গুচ্ছের খরচ তোমাদের। কিন্তু আর কি সম্পর্ক থাকবে ভালো মতো?
পরিমল প্রথমে রাজী হয়নি। কিন্তু এর পরে, যেন ওদের সম্পর্ক আবার বাঁচিয়ে তোলার জন্যেই পরিমল যেদিন মাইনে তুলে ফিরছে, মাথায় ডাং মেরে ওর টাকা নিয়ে ঘড়ি নিয়ে পালাল রজত ও সুবল। পরিমল ব্লকে কাজ পাওয়ার পর থেকে, সরকারী লোন পাইয়ে দেবে বলে ছ’সাতজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল। রজত ও সুবল তারই দু’জন।
এখন পরিমলের মার সন্দেহ রইল না তার ছেলের সময় খারাপ পড়েছে।
সুদেব মাদুলিকে নিয়ে ওকে দেখতে গেল হাসপাতালে। বলল, আটটা সেলাই পড়েছে, রক্ত পড়েছে খুব। এখন দেখতে যাওয়াটা কর্তব্য হয়।
মাদুলিকে দেখে পরিমল চেয়ে রইল। মাদুলিও ওকে দেখে নির্বাক।
সুদেবই বলল, অবনীবাবুর কথা শুনলে না। স্বগ্রামেই শত্রু তোমার। বাঁধবেড়ায় আমাদের পেতে।
পরিমলের মা বলল, তাই যাব। বাঁধবেড়া থেকে ওর পিতামো’ বটেশ্বরে এসেছিল, ও আবার যাবে। ওর বাপ ছোট বউয়ের ছেলে বলে বড় তরফের সঙ্গে ঝগড়া—বিবাদ, মামলা কি হয়নি? জমি শেষে তিন বিঘায় ঠেকেছিল। আমিও বললাম, সুদেব ডাকাত বটে, কিন্তু বোনকে তো বিধবা করবে না। সবই কেমন হয়ে গেল আমার কপালে।
মাদুলি শাশুড়িকে প্রণাম করে বসে থাকল।
জমি লিখে দেয়া, ঘর তোলা এখনো হয়নি। হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। তবে পরিমল অবনীবাবুকে বলে গেছে, সে তাঁর শর্তে রাজী আছে।
ভূদেববাবুকে বলেছে, আমি ঘরের টিন, দোর জানালা, জমি সব বেচে আসব যেমন, তেমন আপনাদের ওদিকে ভালো জমি খানিক কিনে দেবেন। আমরা চাল কিনে খাইনি কখনো।
—বাস্তু কি করবে?
—শৎপথীকে বেচে। সেও চায়, আমিও দেব। শরিকরা এখন বুঝুক।
ভূদেব বলল, কথাবার্তা কাঠ কাঠ, তবে ক্রমে ক্রমে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সুদেব মাদুলিকে আড়ালে নিয়ে গেল।
—তুই মন থেকে ”হ্যাঁ” বললে তবে। দাদা বা আমি তোর ওপর জোর করিনি করব না।
মাদুলি যেন অনেক শান্ত, বিবেচক হয়ে গেছে।
—তোমার বয়স কত হোল ছোড়দা?
—আটাশ তো হোল।
—আমার তবে পঁচিশ।
—তোর বয়সের হিসেব সোজা। মেয়ে ইস্কুল যে বছর, সে বছর তুই হলি।
—ছোড়দা! আমাকে নিয়ে আর ভাবিস না। ও দাদার মতো মানুষ নয়। বউদির মতো সুখ আমার হবে না। তোদের চোখের সামনে থাকব। মানিয়ে গুছিয়ে চলব। ওরও শিক্ষে হয়েছে, বার বার নাক কাটা গেছে। ওকেও বুঝে চলতে হবে। আমি তো বলেছি, এদিক সেদিক করলে আমি সইব না।
—পারবি?
—একবার চেষ্টা করে দেখি। এবারে তো ওর ভরসা থাকবে না। নিজের ঘরে থাকব, পঞ্চায়েতে বলে ব্যাঙ্ক লোন নেব, ধান ভানারি করব।
—তবে সে কাজ এখনই শুরু কর।
—সে ভুল আর করছি না।
—শাশুড়ি কেমন?
—শাশুড়ি যেমন হয়। তবে এবারে ওরা আমার ঘরে থাকবে, আমি ওদের ঘরে থাকছি না।
—অর্থাৎ এমন—তেমন হলে গেট আউট?
—যা বলিস।
মাদুলি হাসল।
সুদেবের মনে হোল, নিজের জমি, নিজের ঘর হবে জেনেই মাদুলি যেন একটা জোর পেয়েছে।
—হাতে টাকা হলে ধান কিনব, চাল বেচব।
মাদুলি স্বাবলম্বী হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
—পারবি?
—কেন পারব না? মা পারেনি? তারপর মাদুলি বলল, তুইও বিয়ে কর এবারে। তুইও তো কম কষ্ট পেলি না, কম কষ্ট করছিস না।
একটু থেমে বলল, একদিন তোর ওখানে নিয়ে যাবি ছোড়দা? একদিন থাকতাম, বেড়ানো হোত।
সুদেব মাদুলিকে নিয়ে এসেছিল। মাদুলি বাঁধের ধারে বেড়িয়ে বাগান দেখে বিবিদের সঙ্গে গল্প করে কি খুশি, কি খুশি।
গেস্টদের মধ্যে সে অধ্যাপক সস্ত্রীক আবার এসেছেন। অধ্যাপকের স্ত্রী বললেন, সুদেববাবু! মাদুলি দেখতে কি সুন্দর! কে বলবে আপনার বোন! মাদুলি সুন্দরী? সুদেব সগর্বে হাসল।
মাদুলি কতটা সপ্রতিভ, তা সুদেব জানেনি কখনো। গৌরীদির সঙ্গে চলে চলে গেল হাতিপোতা। জলধর খুব গর্বিত। মাদুলি তারও দিদি হয় গ্রাম সম্পর্কে।
গৌরী বলল, বিকেলে কাজ করতে আসব। তখন নিয়ে আসব। রাতটা থাকুক কেন, মুরগী খাইয়ে দেব। মাদুলি বলল, পরের বার থাকব গো দিদি।
তারপর বলল, বেড়াবার জায়গা বটে।
বিকেলের ডাকে সুদেব চিঠিটা পেয়েছিল।
ছয়
”শ্রীচরণেষু সুদেববাবু,
দশবার লিখেছি আর ছিঁড়েছি। লিখব লিখব নিত্য ভাবি, আজ লিখছি। সব সময় সুযোগ পাই না। জীবনটা এরকম, আজ এখানে কাল ওখানে। আপনার কথা আমার প্রথম দিনের দেখা থেকে মনে হয়। জীবনে সদয় ব্যবহার তো পাইনি। দু’বার দেখা হোল দু’বার মনে হোল মানুষের মতো একটা মানুষ দেখলাম বটে। সেই কবে থেকে অমানুষই দেখছি।
আপনাকে আমার কথা জানানো দরকার মনে করি। আপনি আমার সঙ্গে যেমন ব্যবহার করেছেন, তাতে সে অধিকার আপনার কাছে। আমি সেই মানুষই আছি, যে সাঁতার একটু জানে কিন্তু যাকে গভীর জলে ঝাঁপ দিতে হয়। এইরকম ঝাঁপ দিতে দিতেই একদিন মরে যাব। সব জায়গায় তো আপনি থাকবেন না।
কেমন গুছিয়ে বাংলা লিখছি দেখুন। লেখারই কথা। মাধ্যমিক দিতে পারিনি। কিন্তু দিলে পাশ করতাম। বাংলা আর ইতিহাসে ভালো ছিলাম। অঙ্কে কাঁচা ছিলাম। কেমন করে বাঁচতে হয়, সে অঙ্কটা আর শেখা হোল না।
আমার নাম কিন্তু নমিতা। নমিতা মল্লিক। বনগাঁ লাইনে অশোকনগরে আমাদের বাড়ি। বাবা মঙ্গলা হাটে সায়া—জামা কিনে বাজারে বেচত। মা থাকতেই বাবা আবার বিয়ে করে। তিন বোন আর মাকে ভাত দিত না। মা মেয়ে স্কুলে আয়া ছিল। দিদি হাসপাতালে আয়ার কাজ করতে করতে এক রিকশাঅলাকে বিয়ে করে। ইস্কুলে পড়ছিলাম। মায়ের দিদিমণিরা জামা কাপড়—বই সাহায্য করত। কিন্তু মা পেটে পাথর অপারেশন করতে গিয়ে মরে গেল। তখন বাবা আমাদের নিয়ে গেল। আমি ইস্কুলে আয়া—কাজ পাব পাব করে পেলাম না। বাবার একটা ছেলে হয়েছে। পাঁচটা মুখে ভাত জোগানো বড় কষ্ট। এর মধ্যে ছোট বোনটা বিয়ে করে বসল লন্ড্রীর দোকানের মালিককে। বোনেদের মধ্যে ও দেখতে সবচেয়ে ভাল। আমাকে বলল, যাকে হোক, হাত ধরে চলে যা।
বাবা খুব চেঁচিয়েছিল। বলেছিল, নমিতাকে আমি বিয়ে দেব, তোদের মতো বিয়ে হবে না ওর।
কলকাতার লোক, সে হবে বর। বাবা আর বিমাতা কি সব পরামর্শ করল। তারপর একদিন বাবা হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি এল। আমাকে কলকাতায় নিয়ে বিয়ে দেবে।
কলকাতায় আনল আমাকে। একজায়গায়, পরে জেনেছি সেটা খিদিরপুর, আমাকে তুলে দিয়ে ”ঘুরে আসছি” বলে চলে গেল। বুঝতেই পারছেন, বাবা আমাকে বিক্রী করে চলে গেল। বাড়ির মালিকও এক মেয়েছেলে। সে আমার মতো আরো মেয়ে কিনেছিল। মেয়েদের প্রথমবার কিনতে বেশি লাগে না সুদেববাবু। তিনশো, পাঁচশো, সাতশো, আমার ফটো দেখিয়ে বাবা হাজার নিয়েছিল। দ্বিতীয়বার বিক্রী হবার সময়ে বেশি দাম ওঠে। তারপর দাম পড়তে থাকে। এটাও বোধহয় বুঝেছেন, আট—দশ বছর সম্পর্ক না রাখুক, লোকটা আমার বাবা। আর বাবা মেয়েকে বেচে দিলে সে মেয়ের পালাবার জায়গা থাকে না। পালাবার চেষ্টা একবারই করি। কিন্তু মালকিনের হাতেই আবার ঘুরে ফিরে আসতে হোল। এরপরে আর পালাবার চেষ্টা করিনি। আমাকে এক বিপত্নীক প্রৌঢ়ের বাড়ি সেবিকা করে রেখে দিল। কিছুকাল ছিলাম।
আমাদের কামাইটা মালকিনই খায়। এরপর আমাকে এরকম ভাড়া ও আরো খাটিয়েছে। রবীনবাবু ওর পুরনো বন্ধু। রবীনবাবুই নাকি ওকে বের করেছিল অনেক আগে। তারপর ও এক বড়লোকের রক্ষিতা হয়ে যায়। তিনিই ওকে ”বুলবুল” নাম দেন, বাড়ি লিখে দিয়ে এই ব্যবসায়ে বসিয়ে দেন। বুলবুল বাড়িতে বাবু আনে না। ও দু’জন ধর্ম ছেলে পোষে। তারা আমাদের ওপর নজর রাখে।
বুলবুল আমাদের ট্রেনিং দেয়, বিউটি পার্লারে নিয়ে যায়। নামে ক্লাব, কাজে মধুচক্র, সেখানে পাঠায়। কারো কম্প্যানিয়ান করে টুরে পাঠিয়ে দিল। শীলা ভেগে গেছে, তাই আমরা কড়া পাহারায় থাকি। বুলবুলের বাড়ির বাইরে ”ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেল” লেখা আছে। রবীনবাবু কিছু বললে আজও বুলবুল শোনে। মদ খেয়ে বলে, রবীনবাবুর সঙ্গে নাকি ওর ভালোবাসা আজও আছে।
হয়তো আছে। রবীনবাবুকে টাকা তো দেয়।
রবীনবাবুই আমাকে সোনাবাঁধের কাজটা পাইয়ে দেয়। আর এবারে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে দেখলেন, টেম্পোরারি কম্প্যানিয়ন হিসেবে প্রৌঢ়। আধবুড়ো, বুড়োরা আমাকে খুব পছন্দ করে। আমি নাকি মাদারলি স্বভাবের বাঙালী মেয়ে; এখনো তো আরেক প্রৌঢ়ের কম্প্যানিয়ন হিসেবে একটা পাহাড়ী শহরে এসেছি। চারদিনে তিন হাজার, আড়াই বুলবুলের, পাঁচশো আমার।
এটাও আমি জানি, আমি আর পারছি না।
বুলবুলও বলছে, তুমি আর চার্মিং থাকছ না। তোমাকে কতদিন রাখা যাবে তা বুঝছি না।
আর না পারলে কি করব? নমিতা—আলো—শম্পা—শ্রাবণী—বিদিশা—রূপালি, কত নামে কত জায়গায় তো ঘুরলাম। বুলবুল জামাকাপড় দেয়, ভালো খেতে দেয়, ডাক্তার দেখায়, মেকাপের জিনিস দেয়। বলছে, তোমার দাম ঝপ করে পড়ে যাবে। তখন আমার ইনভেস্টমেন্ট জলে যাবে।
মেয়েদের দাম ফুরোলে তখন ও কোনো সস্তার মেয়ে খোঁজা খন্দেররা যেমন ব্রথেলে যায়, সেখানে বেচে দেয়। তারপর কি হয় ধরে নিন। ঠিকানাটা দিলাম না।
আমাকে তো বাঁচাতে পারবেন না।
পুলিসকে জানাব অত সাহস আমার সেই।
সব কথাই লিখে ফেললাম। প্রণাম জানবেন। খুব অন্ধকার লাগলে সুবর্ণ লজ, বাগানটা, বাঁধ ফরেস্ট, এ সব কথা মনে করি। আপনাদের মনে করি।” —নমিতা।
সুদেব চিঠিটা হাতে করে বসে রইল। ঠিকানা নেই। খামের ওপরে ডাক ঘরের ছাপ অস্পষ্ট। চিঠি লিখেছে খাতার পাতা ছিঁড়ে। কালো রিফিল, সবুজ রিফিল, একদিনে লেখেনি।
সুদেব টেবিলে মাথা নামাল, দু’হাতের মুঠোর ওপর কপাল। নমিতা, নমিতা, মনে খুব তোলপাড় হচ্ছে। পাহাড়ী শহর তো কতই আছে। সুদেব অতীত জীবনে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং গিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার জন্যে। সেখানে নিশ্চয় ও আর নেই।
কোথায় সেই মেয়েদের হস্টেল, কোথায় সেই বাড়ি, এ সব খোঁজা তো অবাস্তব। নমিতা যদি চাইত ও সাহায্য করে তবে সে কথা লিখত। নমিতাকে ও সামান্য দেখেছে, যা দেখেছে তাতে মনে হয়েছে সব অবস্থাতেই ও নিজেকে সঁপে দিয়ে বসে থাকে। যেন জলে পড়ে মাথা তুলে দেখেছে স্রোত ভয়ানক প্রতিকূল। ওর পক্ষে স্রোতের বিপরীতে যাওয়া অসাধ্য। তাই ও স্রোতেই নিজেকে সমর্পণ করেছে। ভাসতে ভাসতে তলিয়ে যাবে বলে ধরে নিয়েছে। নমিতার অবস্থায় একজন মেয়ে কতটা অসহায়।
মাদুলির অবস্থায় একজন মেয়েও নিদারুণ অসহায়। কিন্তু ভাইরা হাত ধরলে, সাহায্য করলে, পৈতৃক সামান্য জমিতে নায্য অধিকার দিলে মাদুলিও বুকে জোর পায়।
মাদুলি জানে, সে একলা নয়।
নমিতা জানে, সে একান্ত একলা।
বাপ মেয়েকে বেচে দেয়, এও তো এখন সত্যি।
—ছোড়দা।
সুদেব মুখ তোলে।
—কার চিঠি, কি ভাবছিস?
—না, কিছু না।
—অনেকদিন ধরে তুই অন্যরকম হয়ে গেছিস। আমাকে বল, আমি হাজার হলেও তোর বোন।
—জেনে কিছু করতে পারবি না।
—ছোড়দা, কে কার জন্যে কতটা করতে পারে? তবু মানুষ মানুষকে বলে, খানিক হাল্কা হয়। আমি যেমন তোকে এখন সবই বলি।
—আগে বললে কাজ হোত।
—ও যেমন সেদিন বলল, আমার সঙ্গে আগে অমনটা করেছে, মতিচ্ছন্ন হয়েছিল। আমি বললাম, একদিনের কথা তো নয়। সারা জীবনটা সে—কথা খেয়াল রেখে চলতে পারো, দুজনেই ভালো থাকব। আসলে ও এখন আমাকে খানিক সমীহ করছে।
—ও এর—তার কাছে টাকা নিয়েছে?
—নিশ্চয়। তাতে রাগ করতাম বলেই তো…
—তখন টাকাপয়সা ছিল না। তেমন দেখতে পারেনি দাদা। নইলে তোকে অমন বিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি।
…ঠিকভাবে চললে চলেই যেত। আর মা তখন পাগল হয়ে উঠেছিল, সে কথাও ভুলো না। মা এমন করতো যেন আমার বয়স তিরিশ, আর বিয়ে হবে না।
ওই যে সুপ্রিয়া অবনীবাবুর ছেলের সঙ্গে প্রেম করল, সূর্যবাবু ওকে বিয়ে করল না, সুপ্রিয়া ফলিডল খেল? সেই আমাদের বয়সী মেয়েদের যেন—তেন প্রকারে বিয়ে দেবার তাড়া লাগল।
—দিনে দিনে দিন বদলায়। বাঁধবেড়া থেকে মেয়েরা মাধ্যমিক পাশ করছে, কলেজে যাচ্ছে, চাকরিও করছে।
—এখন বল দেখি।
—বলব, পরে বলব। বলার কিছু নেই, বলব।
—হাতিপোতা বেশ দেখলাম গো।
পরিষ্কার তো হয়ই ঘরদোর, পাড়া, দেখার মতো। দীঘিটা দেখার মতো। গৌরীদি চালে খড় দিয়েছে, চৌকি কিনেছে।
—অমরুদের বাড়ি দেখলি?
—না, ওখানেই।
…তুই এখন শুয়ে থাক খানিক।
—আমি তোর ঘরে শোব, তুই?
—লাউঞ্জে। জায়গার কি অভাব?
স্বপন এসে বলে, এমেলের গেস্টরা ফরেস্ট বাংলোয় এসেছেন। বাবুদা বলতে এসেছে, আমরা ছ’টা চিকেন ডিনার, কাল ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ দিতে পারব কি না।
—বাবুদা কোথায়?
—এই যে!
—বাবু, দাম কে দেবে?
—ওঁরাই।
—সেবার এমেলের গেস্ট নিয়ে যা হোল…
এখন আমাদের ক্যাশ সিস্টেম।
দাম দিয়ে যাও, খাবার নিয়ে যাও তোমাদের বাসনে।
বুঝতেই পারছ, এদিক—ওদিক হলে আমি বিপদে পড়ি।
—ছ্যাঁচোড় পার্টি। যাক গে, তাই বলি।
—আমি নিরুপায়। নইলে পারব না।
ঝটপট নিয়ে যেও, আজকের ডিনার পঁচিশ টাকা মাথাপিছু। বোলো বিরিয়ানি, চিকেন মশলা, জিনজার পুডিং।
—ব্রেকফাস্ট?
—স্ট্যান্ডার্ড। পনেরো টাকা। লাঞ্চে মাছ, ভাত, দই। লাঞ্চ কুড়ি টাকা।
—ব্যাপার কি?
—সে সব বলা যাবে না।
মাদুলিও বলে তোরা কি এসব তৈরি রাখিস?
—কেউ তা রাখে এমন জায়গায়?
স্বপন বলে, মাঝে মাঝে ঘটে যায়।
আমিত কাপুর দশজনকে আনল, দিনে খেল, রাতের খাবার তৈরি, পার্টি তো চলে গেল। দাম দিয়ে গেছে। আমিত কাপুরের সব সময়ে আগাম পেমেন্ট। মক্কেল গাঁথে, তারাই দেয়।
খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে মাদুলি বলে, চল বাগানে বেড়াই। আমার দিনটা খুব ভালো কাটল।
ওরা লিলিপনডের ধারে বসে।
সুদেব ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, বলার মতো কি যে আছে।
—বললে তুই শান্তি পাবি।
—কাউকে বলিস না।
—তাই বলি?
সুদেব ওকে নমিতার কথা বলে। নমিতার চিঠির কথাও বলে। মাদুলি মন দিয়ে শোনে।
সব শুনে বলে, আহা।
—কি বুঝলি?
—কি বলব?
—কিছু করা যাবে না। ঠিকানাই তো দেয়নি।
—ঠিকানা পেলে যেতিস?
—হয়তো যেতাম।
—ধর গেলি, তাকে উদ্ধার করলি, তারপর?
—তা তো ভাবিনি।
মাদুলি গম্ভীর, বিবেকের গলায় বলে, তাহলে উদ্ধার বা করবে কেন? সেখান থেকে এনে আবার কোথায় ফেলবে?
তার কি হবে?
—সেও বলেছিল, আমার মতো মেয়েকে কে বিয়ে করবে, আপনিও অন্যরকম মেয়ে খুঁজবেন।
—হ্যাঁ, মেয়েদেরই তো দোষ হয়।
—সেই তো।
—সাহস থাকলে বিয়ে করতিস।
—কি বলছিস?
মাদুলি বলে, কাগজ পড়িস না? এমন মেয়েদেরও বিয়ে করেছে কেউ কেউ। কাগজে তাদের ছবি দিয়েছিল। পড়িসনি তুই।
না, অনেক কিছুই পড়া হয়নি সুদেবের বটেশ্বর লাইব্রেরি থেকে এনে ”পথের পাঁচালী” যেমন সেদিনই পড়ল।
নীলেন্দুবাবুর বইগুলো পড়া হয়নি। বাংলা কাগজ লজে আসে একটি সেটি নিয়ে গেস্ট, স্টাফ, সকলে টানাটানি করে।
—চল শুতে যাই।
—চল। তবে বিয়ে করতেই হবে ছোড়দা। কাজ করছিস, বাড়ির প্রতি ডিউটি করছিস, কিন্তু এটা তো সব হতে পারে না। ভেবে দেখ, আমাকে নিয়ে ভাবনা ছিল। আমার জীবনে যা হয় ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। দাদা বউদির নিজের জীবন আছে। এবার সন্তানটি হলে তো আরোই জড়িয়ে পড়বে। মা আর কতদিন। নিজের কথা নিজে ভাব ছোড়দা।
—মীনার কি আবার…
—হ্যাঁ। ওকে খুশি খুশি দেখছিস না কিছুদিন?
—এটা একটা সুখবর।
—আমিও খুব খুশি।
—বিয়ে করব, অজানা অচেনা কোনো মেয়ে… আমার একটা ক্রিমিনাল পাস্ট আছে, সেটা না জানিয়ে আমি এগোব না। সেটা জানলে কোন মেয়ের অভিভাবক রাজী হবে?
—সত্যিই কি আছে?
—নিশ্চয়।
মাদুলি ঈষৎ হেসে বলে, দাগী একটা মেয়ে খোঁজ।
—যথেষ্ট হয়েছে, শুতে যা। কাল জলধরের সঙ্গে চলে যাবি। বাস তো এখন বকুলতলা অবধি যাচ্ছে।
—তোর সাইকেলে চেপে এলাম, যাবও তোর সাইকেলে। জলধর পৌঁছে দেবে।
মাদুলি হাই তোলে।
—তোর জন্য চিন্তা হয় ছোড়দা।
—অনেককাল বাদে দু’জনে এত কথা বললাম। চিন্তাটা এখন নিজের জন্যে কর। তুই যা। আমি সব ঘুরে—ঘেরে দেখে যাই। ডিউটি।
—যা। আমার ঘুম পাচ্ছে।
মাদুলি ঘরে চলে যায়।
ক্রমে পুজো এগিয়ে আসে।
পুজোর সময় থেকে এপ্রিল অবধি সোনা বাঁধে টুরিস্ট বোঝাই থাকে। সাতদিন লজ বন্ধ রেখে লজ রং করানো হয়। সুবর্ণ লজ ঝক ঝকে হয়ে যায়।
বাগানের শিউলিগাছ দুটোতে এবার প্রথম ফুল ফোটে। স্থলপদ্ম ফুলগাছ আলো করে রাখে। বাঁধের গা দিয়ে কাশফুলের ঝাড়। আকাশটা খুব নীল হয়ে যায়।
একদা বাঁধবেড়াতে স্বরূপবাবুদের বাড়িতে একটি পুজো হোত। এখন দুর্গাপুজো দুটি হয়। স্বরূপবাবুর বাড়ির পুজোটাকে তার মধ্যে ধরা হয় না। উত্তর বাঁধবেড়া ও দক্ষিণ বাঁধবেড়ায় দুটি বারোয়ারি পুজো। অবনীবাবুরা আছেন, উত্তর বাঁধবেড়ায় দুর্গাপুজোয় যাত্রা উৎসবও হয়।
সোনা বাঁধে পূজা হয় না, তবে পিকনিক স্পট, বাঁধের ধার, সর্বত্র আলোকসজ্জা হয়। বটেশ্বরে তিনটি বারোয়ারি পুজো, তার জাঁকজমক বেশি, উৎসবের আনন্দের গান—নাচের ঋতু এটা।
আশপাশের গ্রামে চলে বাঁধনা। দাঁসায় নাচের প্রতিযোগিতা সাঁওতালী যাত্রা হয়, ওদের একাঙ্ক প্রতিযোগিতা হয়। বাঁধনা যাদের যেমন সুবিধে, আগে পরে করে চলে। ওদের নাচ, যাত্রা, থিয়েটারে হাজার হাজার লোক চলে আসে।
এভাবেই বাতাসে বাজে বাজনা, বাতাসে লাগে হিম। রাতে বাগানে টর্চ ফেলে ঘুরতে ঘুরতে সুদেবের মাঝে মাঝে মনে হয়, নমিতা বেঁচে থাকলে ওকে হয়তো লিখত আরেকটা চিঠি। নমিতা যদি মরেও যায় সে কথা কাগজে বেরোবে না। এ রাজ্যে এখন কত মেয়ে প্রত্যহ বিক্রি হচ্ছে, স্বেচ্ছায় অন্নের জন্য লাইনে আসছে কে খবর রাখে। উচ্চকোটির সমাজের মেয়ে—বউরা বাঁচার মতো টাকা নয়, ভোগবিলাসের অনেক টাকার জন্য, অথবা বিকৃত রুচির তাড়নায় বিলাস—বহুল ফ্ল্যাটে নিজেদের বিক্রি করেছে।
গ্রাম—সমাজে ছেলেরা বহুবিবাহকে পেশা করে ফেলেছে। বধূ হত্যা এখন ভারতীয় ঐতিহ্য হয়ে গেছে।
সুদেব এখন কাগজ পড়ে, খুঁটিয়ে পড়ে। সেদিনই পড়ল, নারী ধর্ষণ ক্ষেত্রে পুলিসের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হোল, মেয়েটি চরিত্রহীনা। আর পুলিস নিজেও নারী ধর্ষণে অন্যতম প্রধান এই যখন বাস্তব, সেখানে নমিতার কথা কে ভাবে? সুদেব মেয়েদের এমন অবস্থার কথা এমন করে কখনো ভাবেনি আগে। এখন মনে হয়, খুব মনে হয়। পুজোর বোনাস চাই বলে গেল মোহর, অপরূপবাবু বলল, এ বছরটা তেমন…
সুবর্ণ বলল, তোমার সুবচ্ছর কোনোদিন আসবে না। দেবুর জীবন থিতু হয়েছে, ও বৌমাকে নিয়ে কাশ্মীর বেড়াতে যাচ্ছে। বড় খুকির মেয়ে ”বসে আঁকো”তে প্রাইজ পেল, ছোট খুকির মেয়ের পর খোকা হোল, আর কি চাও?
অপরূপবাবু ওদের এক মাসের টাকা দিতে রাজী হোল কিন্তু এমন হাহাকার করতে লাগল যেন ওর সর্বস্ব চুরি গেছে।
—এরপর ইউথ হস্টেল করবেন।
—হয় ইউথ হস্টেল, নয় চীনাবাদাম চাষ।
সুবর্ণ বলল, ঢং! দুটো যেন এক হোল।
অপরূপবাবু বলল, সবই হোল কত খাটাচ্ছ কত রিটার্ন পাচ্ছ। বাদাম বলো, স্কুল কলেজের ছেলে বলো…
সুবর্ণ গভীর বিশ্বাসে বলল, সময় দেবুর ফিরেছে। তোমারও এখন আট বছর সাত মাস সুসময় থাকবে।
—তোমার?
আমারও ভালো যাবে। অ ছেলে, এবারে আমাদের পুজোর পালা পড়েছে।
এবারে বড় ইচ্ছে ধুমধাম করি।
অপরূপবাবু বলল, চলো চলো তো।
খরচার এত পথ ভেবে বের করতে জানো?
—কেন করব না? বাবা আমাকে ভিখিরি দেখে বিয়ে দেয়নি। তোমার যা হয়েছে সব আমার পয়ে।
সুবর্ণ সুদেবকে শার্ট ও প্যান্টের কাপড় দিল। প্রথম বছর থেকে দিচ্ছ।
সুবর্ণ মনে রেখেছে সুদেব ওকে সেদিন বাঁচিয়েছিল।
এটাও অদ্ভুত লাগে সুদেবের। আজকাল এসব মনে রাখারাখি তো উঠেই গেছে। অপরূপবাবু ভুলে যেতে চায় সুদেবের চেষ্টা ও শ্রম না থাকলে সুবর্ণ লজ এত নাম করত না। সম্ভবত সুবর্ণ ভুলতে দেয় না। তাছাড়া, অপরূপ কন্ট্রাক্টর, ঝানু ব্যবসাদার।
কিন্তু বৈদ্যনাথ দত্ত মঞ্জন দিয়ে দাঁত মাজে, জিভ ছোলা দিয়ে জিভ চাঁছে।
মাটিতে বসে ভাত খায় বাড়িতে। মদ, মেয়েছেলে, হিন্দী ফিল্ম, পর্ণো ভি.ডি.ও. পরিহার করে চলে।
ওর মধ্যে প্রাচীন বাঁধবেড়ার জমিভূমিবান বটব্যাল ঐতিহ্য রয়ে গেছে। অব্রাহ্মণের হাতে অন্ন খায় না। বাড়ি থেকে রান্নার বামুন সহ ভারতভ্রমণ করে। বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে।
অপরূপ বটব্যাল, আমিত কাপুরের মতো স্মার্ট ও চলতাপুরজা নয়, হতে পারেনি।
তবে ব্যবসা বোঝে। কাজ পেতে হবে, ”মিষ্ট কথায় কষ্ট নেই” নীতিতে বাবা—বাছা বলে কাজ তুলে নেয়।
সুদেব শেষ আঘাতটি হানে।
—স্টাফের মাইনে কিছু বাড়ালে ভালো হোত। ওদের মতো বিশ্বাসী কর্মঠ লোক তো পাবেন না।
—হবে, হবে সুদেব। সব হবে।
অপরূপবাবু চলে যায়। সুবর্ণ বলে যায়, তুমিও বিয়ে করো, অ ছেলে বয়স তো হোল।
—চলো চলো। আজকালকার ছেলে কি ধপ বলতে ঝপ করে বিয়ে করে? এটাও বলতে হবে, অপরূপবাবু বউগত প্রাণ। বটেশ্বর, রাণীপুর, বাঁধবেড়াতেও দর্জিরা পুজোর বরাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মাদুলির ঘরটি তোলা হয়ে গেছে। শেষ অবধি ঘরখানা মন্দ হোল না। দাওয়াটি চওড়া। এক পাশে রান্না, অন্য পাশে শাশুড়ির খুপরি ঘর। মাদুলিদের বড় ঘরের একদিকে বেড়ার দেওয়াল পড়ল।
ধান—চাল—ছাগল সব ওদিকেই থাকবে।
ভূদেব বলল, খড়ের চাল হোল, খরচ কম হোল না। তুই টিনের চাল করে নিস। দরজা—জানলা মীনার মার কাছে কেনা গেল। পুজোর পরে মাদুলি নিজের ঘরে উঠে যাবে।
পরিমল অনেক নতিস্বীকার করে আসছে। এবারে সাইকেল ওকে দিতেই হবে।
পুজো বোনাস থেকেই সাইকেল হবে।
এসব ভাবনায় সুদেব যখন খুব ব্যস্ত, তখন একদিন ওকে অবাক, অবাক করে নমিতা এল।
প্রথম দিনের মতো পরনে ছাপা কাপড়, চুলে বেণী, কাঁধে ব্যাগ। ব্যাগটা বেশ বড়সড়।
—আপনি!
—আসতে নেই?
খানিকটা শীর্ণ, চোখ একটু বসে গেছে। হাতে একটি সস্তা কোয়ার্টজ ঘড়ি।
—একা এসেছেন মনে হচ্ছে।
—হ্যাঁ, একাই এসেছি। শুনুন, আমি তিন—চারদিন থাকব। আপনাদের লজের ভাড়া তো অনেক। থাকার কি ব্যবস্থা হবে কোনো?
—না হলে কোথায় যাবেন?
—বটেশ্বরে তো হোটেল আছে।
—সেখানে থাকতে পারবেন না। না, লজেও হয় না। কিন্তু একটা ব্যবস্থা আছে।
—ঘর পাব?
—পাবেন। পাখা পাবেন না। ক্যাম্প—খাটে শোবেন।
—নিয়ে চলুন না আমাকে।
নমিতার আসাটা আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত। সুদেব ওর কথা শুধু ভেবেছে আর ভেবেছে এতদিন ধরে।
সে কথা বলা গেল না।
নমিতাকে ও উদ্ধার করতে রাজী ছিল।
সে কথা বলা গেল না।
মোহর ও বিবির ঘর সব চেয়ে শেষে।
মাঝের ঘরে স্বরূপ ও জলধর থাকে। এ পাশের ঘর দুটি তেমন দরকারে গেস্টকে দেওয়া হয়।
সুদেব তালা খুলল, জানলা খুলে দিল।
—পাখার সীজন নয়…
—কিচ্ছু লাগবে না…ভাড়া কত হবে?
—যা হয় হবে। ভয় নেই, দিতে পারবেন।
দুজনে দুজনের দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে এখন!
—ক্যাম্পখাটটা পেতে দেবে? আমি একটু ঘুমোতাম।
—দেবে। আমার বাথরুমে স্নান করুন কিছু খান। তারপর ঘুমাবেন। আপত্তি আছে?
টিনের চেয়ারে বসে পড়ে নমিতা।
—খেতেও তো পয়সা লাগবে।
—কত আছে আপনার কাছে?
—শ’ দুই হবে।
—আমাকে দিন।
—তারপরে?
—ঠিক ঠিক পেমেন্ট হয়ে যাবে।
—সব যে ফুরিয়ে যাবে।
—আবার চলে যাবেন, এই তো?
নমিতা চোখ তোলে।
—হ্যাঁ যাব…
—তখন টাকা দেব। শুনুন, আপনি তো এখানে এসেছেন। অত ভাববেন না।
—না, ভেবে করব বা কি! ভেবে লাভ নেই, তাই না। ভেবে কিছু হয় না।
—উঠুন।
—আমি…গামছা সাবান কিছু আনিনি।
—সব বাথরুমে আছে। দাঁড়ান।
বেরিয়ে আসে সুদেব। বিবিকে ডাকে।
—বিবি—দি! এনাকে আগেও দেখেছ।
—দেখেছি। এ কি চেহারা করেছ দিদি?
—অসুখ হয়েছিল বিবি—দি।
—বি—বি—দি জলধরকে বলো ঘরটা পরিষ্কার করে দিক। বিছানা দেবে, খাবার জল..বিবিদি উনি চান করবেন।
একটু চা রুটি দাও। ঘরেই খাবারটা দিও।
—দিচ্ছি। তুমি যাও।
—দাঁড়ান।
নমিতা জামার ভেতর থেকে রুমালে মোড়ানো টাকা দেয় সুদেবকে। তারপর ব্যাগটি খোলে। জামাকাপড় নেয়। বিবি বলে, কোথা চান করবে গো দিদি?
সুদেব বলে, আমার বাথরুমে যান এখন।
—ওখানে কাপড় কাচার সাবান আছে। তাড়াতাড়িতে…যা পেলাম তাই নিয়ে… হঠাৎ সুদেব বোঝে, নমিতা এখনো স্বাভাবিক হতে পারছে না! বিশ্বাস করতে পারছে না ও এখানে এসেছে। বিবির চোখে কৌতূহল।
—তুমি খাবারটা দেখ বিবিদি। জলধরকে…আপনি আসুন, স্নান করুন।
বেরিয়ে এসে সুদেব নিচু গলায় বলে, হঠাৎ এসেছেন, কিছুই জানি না। তবে বিবিদি বা কারো সামনে এমন কোনো কথা বলবেন না, যাতে ওদের কৌতূহল হয়।
—আমি…আমি…
—পরে হবে। শুনুন, আমি আছি, আপনার কোনো ভয় নেই। বুঝেছেন?
—কিন্তু…
—ভয় নেই।
নমিতা বাথরুমে ঢুকে যায়।
জলধর মন না করলে কিচ্ছু পারে না, মন করলে সব পারে। ”নমিতাদিদি” এসেছে শুনে, সুদেবের চোখমুখ থমথমে দেখে জলধর ঝাঁটা নিয়ে দৌড়ায়।
স্নান করে, জামাকাপড় কেচে নমিতা বেরিয়ে আসে। তারপর কাপড় মেলতে চলে যায়।
বিবি চা, রুটি তরকারি নিয়ে আসে।
—খান।
নমিতা খেতে থাকে।
—কাল খাননি বোধহয়?
নমিতা শিউরে ওঠে।
—খেয়ে দরজা ভেজিয়ে শুয়ে থাকুন।
বিবিদি খাবার দিয়ে যাবে। খেয়ে আবার ঘুমোবেন।
—আপনি…?
—আমি আমার ঘরে আছি।
—ঘরটাও চেয়ে দেখলাম না। ঘরটা তেমনি আছে, না?
—বিকেলে দেখবেন।
কিচ্ছু দেখে না নমিতা। সকালে ঘুমোয়, দুপুরে ঘুমোয়, সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে ওকে তুলে দেয় গৌরী।
—ওঠো চুলটা বেঁধে দিয়ে যাই।
—দাও গৌরীদি।
—এমন চেহারা করেছ কেন?
—অসুখ করেছিল দিদি।
—থাকো, খাও, শরীর সারো। পুজোতে কত ধুমধাম হবে, কত গেস আসবে, ঘরে সিনেমা চলবে।
—আবার ঘুম পাচ্ছে।
আবার ঘুমোয় নমিতা। বিবি ডাকতে উঠে ভাত খায়। ও বাথরুমে গেলে সুদেব বলে, বিবিদি ওর দেহটা তো ভালো নেই। আজ রাতটা যদি এ ঘরে শোও।
—তা শোবো। তুমি বলছ আমি শোবো।
সুদেবের প্রতি স্টাফের এই আনুগত্যটা অপরূপবাবুর তেমন পছন্দ নয়। সুদেব মাঝে মাঝে ওঁর আহত অহংবোধে মলম মাখায়।
আমি আপনার কর্মচারী। ওরা আপনার সঙ্গে বলবে, সে সাহস তো নেই! আমি ওদের নিয়ে পড়ে আছি, ওরা আমাকেই সব বলে টলে। আপনি শুধু দেখবেন আমরা সার্ভিস দিচ্ছি কিনা। আপনি তো যখন—তখন চলে আসেন। ওদের কোনো গাফিলতি দেখেছেন কাজে?
—না, তা মানতেই হবে।
নমিতা ফিরে আসে।
সুদেব বলে, ঘুমোন। রাতে বিবিদি থাকবে। নো—পাওয়ার বালব জ্বলবে নিশ্চিন্তে ঘুমোন।
—হ্যাঁ, ঘুমোই।
নমিতা ঘুমিয়ে পড়ে। সুদেব বেরিয়ে আসে। কতদিনের অপূর্ণ ঘুম জমা হয়েছিল কে জানে।
জলধরকে বলে, তোরা বাবা আজ রাতটা, এই দিদি যে ক’দিন থাকবে, রাতে রেডিও জোরে বাজাস না।
—রেডিও তো বাজাই না, বাঁশি বাজাই।
—বাবার মতো পারিস।
—শিখছি।
জলধরের বাঁধবেড়া আদিবাসী ক্লাব দাঁসার নাচের প্রতিযোগিতায় তিন বছর প্রথম হয়েছে।
সুদেব ঘরে বসে ঠিক করে, কালই বড়বাবুকে জানাতে হবে যে তার একজন আত্মীয়া এখানে আছেন, কম ভাড়ার ঘরে আছেন। ভাড়া, খাবারের দাম, সার্ভিস চার্জ সুদেব বিল করে নিজে দিয়ে দেবে। নমিতাকে নিয়ে কোনো কথা হতে দেবে না ও।
পরদিনও ঘুমে ঘুমে যায়। সেদিনই আমিত বলছিল, ওর দাদা কাজের খাতিরে প্লেনে পৃথিবী ঘোরেন ও বাড়ি ফিরে কয়েকদিন ঘুমোন। তার নাম জেট ল্যাগ।
নমিতা নিশ্চয়ই ভীষণ ঘুরেছে, নিজেকে অতিরিক্ত খরচ করেছে, তাতেই এত ক্লান্ত। তার পরদিনও নমিতা সন্ধ্যায়, নতুন গেস্ট এক নব দম্পতি, দুই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা এবং দুটি রামভক্ত স্ক্রীপ্ট লেখক তরুণ (যারা বোতল বোতল রাম খেয়ে গেল সমানে), এদের চোখের সামনে বেরিয়ে বাগানে বসল।
সুদেব বলল, চলুন বাঁধের ধারে যাই।
—চলুন।
—হাঁটতে পারবেন?
—দেখি। না পারলে বসে পড়ব।
—থাক, এখানেই বসুন।
লাউঞ্জে ওরা ”ত্রিদেব” বা ”ত্রিদেবা” দেখছে। ছবির কোলাহলে সব গমগম করছে। স্বপনা, জলধর, সবাই সেঁটে বসে আছে। সেটাই স্বাভাবিক।
—এখানেও ক্যাসেট ফিল্ম?
—গেস্ট হাউস বলে কথা। এখনকার গেস্টদের রকম রকম রুচি। ক্যাসেট যে—যার মতো এনে দেখতে পারে। রাত বারোটা অবধি। দেখলে কমার্শিয়াল ছবি। অন্যরকম নোংরা ছবি আমরা অ্যালাও করি না।
—কটেজে তো দেখে।
—সেই বৃদ্ধ দেখত?
—অবশ্যই।
—কটেজে দরজা বন্ধ করে নিজে দেখলে আমরা কি করব। জানতে পারলে নিশ্চয়ই কিছু বলা যেত। সুবর্ণ লজটাকে লোকে মনে করে পরিবারবর্গ নিয়ে থাকার মতো জায়গা। সুবর্ণ লজের বাড়বাড়ন্ত লোকের ঈর্ষাও আছে। তাহলে এ জায়গার বদনাম করতে পারলে তাদের লাভ। যতটা সম্ভব দেখে চলি।
—বদনাম তো আমার জন্যেও হতে পারে।
—কি করে হবে? মনিবকে জানিয়েছি আপনি আমার আত্মীয়া। আপনার খরচপত্রের দায়িত্ব আমার।
—তা কেন, আমি তো টাকা…অবশ্য সামান্য দিয়েছি….
—বিল হবে, রসিদ পাবেন। দুশো টাকাকে অত কম মনে করছেন কেন?
দুশো পাব জানলে আমি রড নিয়ে গ্যাং ফাইটে নেমে গেছি এক সময়ে।
—মনে হয় না।
—সত্যি। কিন্তু…বলুন তো…চিঠি লিখলেন যদি ঠিকানা দিলেন না কেন? কেন আমাকে মানসিক যন্ত্রণায় রাখলেন। আর এলেন যদি, এমন দেরি করে এলেন কেন?
নমিতা আস্তে বলে, ঠিকানা দিলে বা কি করতেন?
—উদ্ধার করতাম, নিয়ে আসতাম।
—আমি তা আশা করিনি।
—তবে লিখেছিলেন কেন?
—দেখুন…মানুষ মরতে মরতেও ভাবে, তার কথা কাউকে বললে শান্তি পাবে।
আপনি ছাড়া কাকে লিখতাম? আমার আগেকার জীবনটা তো চলে গেছে।
ওখানে যাবার জায়গাই নেই। দিদি, রুনকি, যে—যার জীবনে যেমন হোক আছে। কোথায় যাব? বাবা…বাবার কাছে?
—ঠিকানাটা দেবেন তো।
—আপনি বলছেন, এত দেরি করি কেন এলাম। আগেই ঠিক করেছিলাম, ধরেই নিয়েছিলাম, এ ভাবেই আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে। মরেই যেতাম।
বাঁচার ইচ্ছেটা ফিরল যখন, তখন মনে হোল, একবার যাই। মনে খানিক জোর পাব, হয়তো চোখেও দেখতে পাব কোনো পথ। না—এসে পারব ভেবেছিলাম, পারলাম না।
—কিছুই বলেননি কিন্তু।
—বলার খুব নতুন কিছুতো নেই।
দার্জিলিং থেকে লিখেছিলাম। তারপর বুলবুল তো খুশি ছিল না। রবীনবাবুকে বললাম, আপনি যেমন হোক একটা কাজ জোগাড় করে দিন আমাকে।
ওখানে মিতালি আমাকে বলেছিল, এরা যেখানে পাঠাক, নিজেদের চক্রের মধ্যে রাখবে। বাইরে বেরিয়ে গিয়ে আমরা এদের কথা পাঁচজনকে জানিয়ে দেব, সে সহ্য করবে না।
—ঠিকই বলেছিল মেয়েটি?
—আমাকে বাঁচাবে কে! রবীনবাবুকে আমি আবার বিশ্বাস করলাম।
রবীনবাবু বলল, যে ডাক্তারবাবু তোমাদের দেখে শোনে, বুলবুলের ডাক্তার! ওনার নার্সিংহোমে দিতে পারি। কাজ শিখবে, রোগীর সেবা করবে, খাবে থাকবে, কাজ শিখলে মাইনে।
—আপনি বিশ্বাস করলেন?
—করলাম। শরীরে বয়না, মন ভেঙে গেছে। ভাবলাম এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে কাজ করলে হয়তো পথ পাব।
বুলবুল আপত্তি করল না। তবে বলল, কাপড় সব নিও না। যেমন যেমন দরকার নিয়ে যেও। আমি তখন আর ভাবতে পারি না। যা বলে তাই বলুক, বেরিয়ে তো যাই।
—রবীনবাবুই নিয়ে গেল?
—হ্যাঁ। মেটেবুরুজ জানেন?
—জানি।
—সেখানে নার্সিংহোম। আছি, আছি।
ডাক্তার বলল, দু’একদিন যাক, সব বুঝিয়ে দেব। নিচে দু’ঘরে কেবিন কয়েকটা। ওপরে দুটো ঘরে নার্সরা থাকে। আমাকেও সেখানে রাখল। তিনদিন বাদেই জানলায় বসে আছি, দেখলাম বুলবুল ডাক্তারকে নামিয়ে দিয়ে গেল।
—যোগাযোগটা ওরা ছাড়েনি।
—তারপরেই জানেন, কি করে সাহস পেলাম, ব্যাগে যা হয় ভরে নিয়ে নেমে এলাম। ডাক্তারের কাছে রোগীও ছিল।
বললাম, আমি এখানে থাকব না।—
ডাক্তার কি বলবে সে জন্যে দাঁড়াইনি।
নেমে এসেই যে মিনিবাসটা পেলাম চেপে বসলাম। বাস পৌঁছল ডালহৌসি। সেখান থেকে হাওড়া। তারপর কোনো দিকে তাকাইনি।
—ওরা খুঁজবে না?
—সেইতো আমার ভয়, ভীষণ ভয় ছিল সুদেববাবু। কিন্তু ভয় করতে করতে ভয়ের বোধ হারিয়ে যায়।
—হয়তো।
—আপনি কখনো ভয় পান নি?
—নিশ্চয় পেয়েছি, এখনো পাই। কিন্তু শুনুন, এখানে তো বাইরে থেকে লোক আসেই। কে দেখবে, কে চিনবে…
আপনি যতটা সম্ভব ঘরেই থাকুন। অত ভয়ের কিছু নেই। আপনি পুলিসে যেতেন, ওরা ঘাবড়াত।
—এই যে বললাম, এও তো অনেকদিন ধরে হোল। একদিনে তো হয়নি। ঘুম আমার হোত না, মনে হোত হবে না।
কিন্তু দেখুন এখানে এসে থেকে কি ঘুম ঘুমোচ্ছি।
—ঘুমোন। ঘুমিয়ে সুস্থ হওয়াই দরকার।
—তারপর? তারপর কি করব?
—ভাবা যাবে। চলুন।
—গৌরীদির জীবন বেশ সহজ, তাই না?
—আজকাল কারো জীবনই সহজ নেই।
দেখতে সহজ লাগে। চলুন, ঘরে চলুন। এখানে হিমটা আগেই পড়ে। ঠাণ্ডা লেগে যায়।
নমিতা নরম গলায় বলে, সেবারে এখানকার কোন এক আশ্রমের লোকরা এসেছিলেন। জলধর বলেছে সেখানে মেয়েরা থাকে, তাঁত বোনে, পুজো করে, তেমন জায়গায় আমার ঠাঁই করে দিন না। এখানে ক’দিন থাকা যাবে?
—দেখা যাবে। ঘরে চলুন।
—ভাবতে ইচ্ছে করে, যে কাজ দিল করলাম। তারপর একটা নিজের ঘরে থাকলাম।
—আপনাকে জলধর রামাশ্রয় আশ্রমের কথা বলেছে। ওখানে খোঁজ নিয়ে দেখব।
—হ্যাঁ…ঘরে যাই এবার। এই জায়গাটাই আমার পছন্দ খুব। এই আশ্রম তো কাছেই।
—হ্যাঁ।
—গ্রামই তো ভালো লাগত। এখনো লাগে।
আসলে মানুষ আজকাল ঝামেলা বাঁচিয়ে থাকতে পারবে না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন