রাজপাট – ১০৫

তিলোত্তমা মজুমদার

১০৫ 

হয়তো চেঙ্গিস আজো বাহিরে ঘুরিতে আছে করুণ রক্তের অভিযানে। 
বহু উপদেশ দিয়ে চলে গেল কনফুশিয়াস— 
লবেজান হাওয়া এসে গাঁথুনির ইট সব ক’রে ফেলে ফাঁস। 
বাতাসে ধর্মের কল ন’ড়ে ওঠে—নড়ে চলে ধীরে। 

.

সিদ্ধার্থর ঘরে আজ বসে আছে তারা। তৌফিক, বসির খান, মির্জা এবং সিদ্ধার্থ স্বয়ং। আষাঢ়ের এই ঘোর রাত্তিরে, বাহিরে তুমুল বর্ষণ, বসে আছে তারা। আলোচনা সমাপ্ত তাদের। 

আলোচনা, সিদ্ধার্থর নিরাপত্তা বিষয়ে। একা একা রাত্রে কোথাও যাবে না সিদ্ধার্থ। একা দূরে যাবে না কখনও। তার প্রাণসংশয়। প্রাণ যদি না-ও যায়, বীভৎস প্রহারে করে দেবেই এমন, যাতে সিদ্ধার্থর দেহযন্ত্র সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়। আর প্রাণ নেবে না, এমন বিশ্বাসই বা কীসের? যারা আসন দখলের জন্য মরিয়া, পরমেশ্বর সাধুখাঁর মতো বর্ষীয়ান সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতাকে হত্যার চক্রান্ত যারা করতে পারে, তাদের সিদ্ধার্থর মতো এক তরুণ নেতৃত্বের মোকাবিলা করতে প্রাণ কেঁপে উঠবে, এ ভাবনা অবান্তর। 

কিন্তু একা একা যাবে না কোথাও, এ কি মানা যায়? সিদ্ধার্থ সে, তার বৃহৎ পরিকল্পনার প্রাথমিক এই পর্বে সর্বত্র যেতে হবে তাকে। একা অথবা কয়েকজন। 

তাকে কেউ প্রহার দিতে পারে, এই সম্ভাবনা অবান্তর নয়। সে জানে। মেরে হাড়-গোড় ভেঙে দিতে পারে ঠিক। তবে প্রাণে মেরে দেবে একেবারে, সেরকম সম্ভাবনা সহজে সে ভাবে না। সে ঘোর তর্ক করে। তার সুহৃদ, হৃদয়ের নিকটজন, বন্ধুদের সঙ্গে ঘোর তর্ক করে। অসম্ভব বুদ্ধিধর, দুঃসাহসী ছেলেটি যেন-বা নির্বুদ্ধির মতোই জেদ ও গোঁয়ারতুমির খপ্পরে পড়ে যায়। আর, সবচেয়ে বড় কথা, নিজেরই শহরে সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বাঁচতেও চায় না। সাহস হারাতে তার অভিমানে লাগে। 

মির্জা বোঝায় তাকে, যেন অভিভাবকই সে একজন, বলে—একে সাহস হারানো বলে না। নিরাপত্তার অভাব ঘটলে তার প্রতিকার নেওয়া বুদ্ধির পরিচয়। অপ্রয়োজনীয় দুঃসাহসিকতায় যে নির্বুদ্ধিতা তুমি তাকে প্রশ্রয় দেবে বলে তো মনে হয় না আমার। 

সকলেরই সমর্থন তার প্রতি। মির্জা সফল এই সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে। সে বলে – সফি থাকবে সিদ্ধার্থর সঙ্গে সারাক্ষণ। সফি ঠান্ডা মাথার ছেলে। ক্ষিপ্র। এবং হৃদয়বান। এ কাজ হতে পারত বীরাকে দিয়েও। তবে বীরা সংসারী পুরুষ। সংসারের জন্য, বিবি-বাচ্চার জন্য তার লাগে কিছুটা সময়। সেদিক দিয়ে সফি নির্ঝঞ্ঝাট। চব্বিশ ঘণ্টাই সে থাকতে পারবে সিধুভাইয়ের সঙ্গে। সফির ব্যয়ভারের জন্যও এমনকী তাকে ভাবতে হবে না। সে দায়িত্ব নেবে মির্জা। 

সিদ্ধার্থ শুনছিল। মৃদু হাসি মাখা ছিল তার মুখে। মির্জার মনে হল, সিদ্ধার্থর মুখে ধীরে ধীরে এসে যাচ্ছে পরিণতমনস্কের ছাপ। বুদ্ধির দীপ্তির সঙ্গে গভীরতার স্বাক্ষর। প্রসারিত হৃদয়ের আলোয়, সিদ্ধার্থ সে, হয়ে উঠছে সুন্দরতর। মির্জার হৃদয় সস্নেহ হয়ে ওঠে। চোরাব্যবসার যাবতীয় সংকট সত্ত্বেও হৃদয়ে সে জারি রাখে প্রেম ও স্নেহের সম্ভার। আপনার জন নিয়ে রয়েছে তার আপনার জগৎ। সে জগতে সিদ্ধার্থ পরমাত্মীয়। সে কি কৃতজ্ঞতা শুধু? নাকি তারও চেয়ে বড় কিছু! 

না। শুধু কৃতজ্ঞতা নয়। শুধু কৃতজ্ঞতা দ্বারা জন্মে না ভালবাসা। জন্মে না স্নেহ, প্রেম, প্রীতি। কবেকার কবেকার বন্ধু মির্জা সিদ্ধার্থর। দীর্ঘদিনের চেনা পথ, জানা সরণির ধর্মে সে জানে সিদ্ধার্থর হৃদয়সন্ধান। তার কষ্টকে জানে। স্বপ্ন জানে। জানে তার সমুন্নত মানবতা। 

আলাদা করে কৃতজ্ঞতা নেই আর। থাকা বাঞ্ছনীয়ও নয়। কৃতজ্ঞতা এক হিসেবের অন্তর্ভুক্ত করে। তার সঙ্গে সিদ্ধার্থর দেওয়া-নেওয়ার কোনও হিসেব নেই। 

তবু মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে। সিদ্ধার্থ বাঁচিয়েছে কতবার তাকে। যখন সে হয়নি এতখানি শক্তিমান। বসির খানের বোনের জন্য, বাবার জন্য যা সে করেছে, তেমনই, বা ততোধিক উপকৃত মির্জা সিদ্ধার্থর দ্বারা। 

সে হাততালি মারল দু’বার। নড়েচড়ে বসল। সিদ্ধার্থর ঘাড়ে হাত রেখে ঝুঁকে পড়ল তার মুখের কাছে। বলল—এ দেশের সমস্ত মানুষের হয়ে ভাববার ভার তুমি নাও। তোমার ভার নেব আমরা! ব্যস! আর কোনও কথা নেই। 

তৌফিক ও বসির খান সরব সমর্থন জানাল। তারা সকলেই সিদ্ধার্থর মধ্যে দেখতে পায় এক ভবিষ্য ব্যক্তিত্বকে, যে হতে পারে নেতা, হতে পারে জননায়ক, এই নায়ক তাদের হৃদয়ে প্রীতি উৎসারিত করে। এবং এভাবেই এক দল গড়ে উঠতে পারে। এক এবং এক দুই। দুইয়ের সঙ্গে দুই চার। চারটে মানুষের দল প্রেরণার উদ্যমের পথ পেরিয়ে লক্ষজনের হয়ে ওঠে একদিন। 

এমন এক প্রাণ, তাকে আগলে রাখা দরকার। সকল সংহার থেকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। প্রদীপশিখা আলো দেয়। কিন্তু হাওয়ায় যাতে নিভে না যায়, তার দায়িত্ব নিতে হয় দু’টি হাতকে অতএব সিদ্ধার্থ নিরাপত্তা মেনে নিতে বাধ্য হল একপ্রকার। বসির খানের মনে হল, এ কাজ সে-ই করতে পারত সবচেয়ে ভাল। কিন্তু সে নিরুপায়। তার পেশা তাকে সারাক্ষণ সিদ্ধার্থর অনুগামী হতে দেবে না। 

তারই ভাবনার প্রতিধ্বনি উঠল তৌফিকের কথায়। সে বলল—মির্জাভাই, আমাকে একটু শিখিয়ে নিতে পারো না? সিধুদার সঙ্গে আমিই থাকি সবচেয়ে বেশি। 

সিদ্ধার্থ গম্ভীর তাকাল তার দিকে। বলল—ছেলেমানুষি করিস না তৌফিক। আমার বডিগার্ড হওয়ার জন্য তুই বাড়ি ছেড়েছিস নাকি? তোর আরও অনেক কাজ আছে। 

মির্জা বলল— ঠিক। তৌফিক, সফিই ঠিক আছে আপাতত। সফিকে জানো না তুমি। ও একা দশজনকে সামলাতে পারে। 

জোর বৃষ্টি নামল বাইরে। জলের ছাঁট আসছিল। জানালা বন্ধ করে দিল সিদ্ধার্থ। এখন, এই একান্তে তারা চারজন, দুলু বাউলের কথা মনে পড়ল তার। মোহনলালের কথা মনে পড়ল। হারাধনের কথা। মোহনলাল বহরমপুরে এসেছে কয়েকবারই এর মধ্যে। সে দল ছাড়ার পর এসেছে। তার সঙ্গে দেখা করেনি। অথচ, সে, হারাধন, মোহনলাল কত কত কাটিয়েছে এমন বর্ষণমুখর রাত্রি, একত্রে। অধিক কেটেছে তার ও মোহনলালের। আজ তারা ভিন্ন চারজন। সারা জীবনে এমন সঙ্গ পালটাবে কতবার! এমন দৃশ্য পালটাবে কতবার! 

এখন দুলু বাউলের কথা তার সমধিক মনে পড়ছে। বৈরাগীঠাকুর এক অসমবয়সি বন্ধু তাদের। কিন্তু বড় কাছের। মানুষটাকে তার আপন লাগে, অন্তরঙ্গ লাগে, কিন্তু মানুষটাকে ঘিরে থাকে অস্পষ্টতা। রহস্যের হালকা আবরণ। সে স্বীকার করে, ওই রহস্যের জন্যই দুলু বাউল অনেক বেশি করে আকর্ষণ হানে। 

আজ বৈরাগী ঠাকুর এখানে থাকলে শোনাত গান। এই বর্ষণের রাতে, এমন অন্তরঙ্গ গাঢ় পরিবেশে তার গান শোনার আকুলতা দারুণভাবে বোধ করল সে। তার কানে বাজল বাউলের সুর—এমনকী হাপুগানও সে গুনগুনায় ইচ্ছে হলে 

বাচ্চা থেকে জোয়ান বুড়ি 
আজ ধর্ষিত সবখানে।
বিবেক বুদ্ধি সব হারালছে 
এমনি মানুষ খুনে ।।
উরররর…উরররর ঘ্যাঁচাক দুম
ঘ্যাঁচাক দুম ঘ্যাঁচাক দুম। 
দ্যাশে ঘুষটো আছে হুঁষটো নাই 
তাই হচ্ছে সব খুন ।।

সে প্রকাশ করে তার আকুলতার কথা। দুলু বাউলের অভাব এমনকী পীড়িত করছে তৌফিক এবং বসির খানকে। তৌফিক বলছে—গান হবে না। কিন্তু গল্প হোক। বসিরভাই? 

বসির খান বলে—ঠিক আছে। আজ রাজা উদয়নারায়ণের গল্প। সিধুদা! চা হবে? 

মির্জা বলে—সাবিত্রীদিকে ডাকার দরকার নেই। আমি বানিয়ে আনছি। তবে কী, আমি না আসা পর্যন্ত গল্প চালু হবে না। 

—না না না। 

একযোগে কথা দেয় প্রত্যেকেই। 

সকল অধ্যায়

১. রাজপাট – ১
২. রাজপাট – ২
৩. রাজপাট – ৩
৪. রাজপাট – ৪
৫. রাজপাট – ৫
৬. রাজপাট – ৬
৭. রাজপাট – ৭
৮. রাজপাট – ৮
৯. রাজপাট – ৯
১০. রাজপাট – ১০
১১. রাজপাট – ১১
১২. রাজপাট – ১২
১৩. রাজপাট – ১৩
১৪. রাজপাট – ১৪
১৫. রাজপাট – ১৫
১৬. রাজপাট – ১৬
১৭. রাজপাট – ১৭
১৮. রাজপাট – ১৮
১৯. রাজপাট – ১৯
২০. রাজপাট – ২০
২১. রাজপাট – ২১
২২. রাজপাট – ২২
২৩. রাজপাট – ২৩
২৪. রাজপাট – ২৪
২৫. রাজপাট – ২৫
২৬. রাজপাট – ২৬
২৭. রাজপাট – ২৭
২৮. রাজপাট – ২৮
২৯. রাজপাট – ২৯
৩০. রাজপাট – ৩০
৩১. রাজপাট – ৩১
৩২. রাজপাট – ৩২
৩৩. রাজপাট – ৩৩
৩৪. রাজপাট – ৩৪
৩৫. রাজপাট – ৩৫
৩৬. রাজপাট – ৩৬
৩৭. রাজপাট – ৩৭
৩৮. রাজপাট – ৩৮
৩৯. রাজপাট – ৩৯
৪০. রাজপাট – ৪০
৪১. রাজপাট – ৪১
৪২. রাজপাট – ৪২
৪৩. রাজপাট – ৪৩
৪৪. রাজপাট – ৪৪
৪৫. রাজপাট – ৪৫
৪৬. রাজপাট – ৪৬
৪৭. রাজপাট – ৪৭
৪৮. রাজপাট – ৪৮
৪৯. রাজপাট – ৪৯
৫০. রাজপাট – ৫০
৫১. রাজপাট – ৫১
৫২. রাজপাট – ৫২
৫৩. রাজপাট – ৫৩
৫৪. রাজপাট – ৫৪
৫৫. রাজপাট – ৫৫
৫৬. রাজপাট – ৫৬
৫৭. রাজপাট – ৫৭
৫৮. রাজপাট – ৫৮
৫৯. রাজপাট – ৫৯
৬০. রাজপাট – ৬০
৬১. রাজপাট – ৬১
৬২. রাজপাট – ৬২
৬৩. রাজপাট – ৬৩
৬৪. রাজপাট – ৬৪
৬৫. রাজপাট – ৬৫
৬৬. রাজপাট – ৬৬
৬৭. রাজপাট – ৬৭
৬৮. রাজপাট – ৬৮
৬৯. রাজপাট – ৬৯
৭০. রাজপাট – ৭০
৭১. রাজপাট – ৭১
৭২. রাজপাট – ৭২
৭৩. রাজপাট – ৭৩
৭৪. রাজপাট – ৭৪
৭৫. রাজপাট – ৭৫
৭৬. রাজপাট – ৭৬
৭৭. রাজপাট – ৭৭
৭৮. রাজপাট – ৭৮
৭৯. রাজপাট – ৭৯
৮০. রাজপাট – ৮০
৮১. রাজপাট – ৮১
৮২. রাজপাট – ৮২
৮৩. রাজপাট – ৮৩
৮৪. রাজপাট – ৮৪
৮৫. রাজপাট – ৮৫
৮৬. রাজপাট – ৮৬
৮৭. রাজপাট – ৮৭
৮৮. রাজপাট – ৮৮
৮৯. রাজপাট – ৮৯
৯০. রাজপাট – ৯০
৯১. রাজপাট – ৯১
৯২. রাজপাট – ৯২
৯৩. রাজপাট – ৯৩
৯৪. রাজপাট – ৯৪
৯৫. রাজপাট – ৯৫
৯৬. রাজপাট – ৯৬
৯৭. রাজপাট – ৯৭
৯৮. রাজপাট – ৯৮
৯৯. রাজপাট – ৯৯
১০০. রাজপাট – ১০০
১০১. রাজপাট – ১০১
১০২. রাজপাট – ১০২
১০৩. রাজপাট – ১০৩
১০৪. রাজপাট – ১০৪
১০৫. রাজপাট – ১০৫
১০৬. রাজপাট – ১০৬
১০৭. রাজপাট – ১০৭
১০৮. রাজপাট – ১০৮
১০৯. রাজপাট – ১০৯
১১০. রাজপাট – ১১০
১১১. রাজপাট – ১১১
১১২. রাজপাট – ১১২
১১৩. রাজপাট – ১১৩
১১৪. রাজপাট – ১১৪
১১৫. রাজপাট – ১১৫
১১৬. রাজপাট – ১১৬
১১৭. রাজপাট – ১১৭
১১৮. রাজপাট – ১১৮ (শেষ)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন