হুমায়ূন আহমেদ
কম্পিউটারে কমলের
গোপনীয় ডায়েরি
আমার নাম কমল।
এটা একটা ফুলের নাম। ফুলটির ইংরেজি নাম Lotus. বাংলায় কমলের আরেক নাম পদ্ম। পদ্ম আবার দুরকম–
জলপদ্ম
স্থলপদ্ম
জলপদ্মের বোটানিক্যাল নাম Hibiscus mutabilis, স্থলপদ্মের বোটানিক্যাল নাম Nelumbo nucifera Gaertn. জলপদ্মের আবার অনেক ভাগ আছে। যেমন–
শ্বেতপদ্ম
রক্তপদ্ম
নীলপদ্ম
ফুলের রঙে নাম। যেমন লালপদ্ম হলো রক্তপদ্ম। রক্তলাল বলেই রক্তপদ্ম হলো লালপদ্ম।
এদের আলাদা কোনো বোটানিক্যাল নাম নেই। আমাকে এইসব তথ্য দিয়েছেন ফারুক। আগে আমি তাঁকে ডাকতাম আঙ্কেল ফারুক। এখন ডাকি ফারুক। কারণ তিনি আমার আঙ্কেল না। আঙ্কেল হলো বাবার ভাই কিংবা মায়ের ভাই। ফারুক বাবার ভাই না, আবার মায়েরও ভাই না।
আমার কাছে মনে হয় সম্পর্ক খুব জরুরি। সম্পর্ক দিয়ে ফ্যামিলি ট্রি তৈরি হয়। আমি একটি ফ্যামিলি ট্রি তৈরি করেছি।
আবদুল করিম
↓
সালাউদ্দিন জলিল
↓
সালেহ ইমরান
↓
কমল
ফ্যামিলি ট্রি তৈরি করতে মায়ের ফ্যামিলি ও প্রয়োজন হয়। আমার মায়ের নাম মুনা। তার মায়ের নাম আকিলা বেগম। আকিলা বেগমের মায়ের নাম আমি জানি না। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা বলল, এখন মনে নাই, পরে জেনে দেব। মা পরে আর দেয় নি। এটা হচ্ছে মার স্বভাব।
ফারুক এরকম না। তাকে যা বলা হয় তিনি সঙ্গে সঙ্গে করে দেন। তিনি একজন অ্যামেচার ম্যাজিসিয়ান। Ameteur শব্দের অর্থ হচ্ছে–
A person who takes part in a sport or other
activity for enjoyment, not as a job.
এই শব্দের আরেকটি অর্থ আছে–
A person who is not skilled.
ফারুক Skilled ম্যাজিশিয়ান। কাজেই তাঁর জন্যে প্রথম অর্থটা ঠিক। দ্বিতীয়টা না। অর্থাৎ সে হচ্ছে–A person who takes part in a sport or other activity for enjoyment, not as a job.
আমি অর্থ দুটা পেয়েছি Oxford Advanced Learners Dictionary থেকে। ডিকশনারিটা আমাকে ফারুক উপহার দিয়েছেন। তিনি আমাকে অনেক বই উপহার দিয়েছেন। একটি বইয়ের নাম Easy Coin Tricks. এটা একটা ম্যাজিকের বই। এই বইটা আমি পড়ি নি। কারণ আমার ম্যাজিক ভালো লাগে না।
ম্যাজিকে মিথ্যাকে সত্য করে দেখানো হয়। মিথ্যা কখনো সত্য হয় না। মিথ্যা সবসময় মিথ্যাই থাকে।
মিথ্যা আমার পছন্দ না। কেউ মিথ্যা বললে আমার রাগ লাগে। যখন আমার রাগ লাগে, তখন আমার মাথা ভার ভার লাগে। তখন আমি পরিষ্কার কিছু দেখতে পাই না। মাথা যখন খুব বেশি ভার ভার লাগে তখন আমার Epileptic Seizure হয়।
Epileptic Seizure শব্দটির অর্থ হলো–A Sudden attack of an illness, especially one that affects the brain.
আমার এই সমস্যার কথা সবাই জানে বলেই কেউ আমার সঙ্গে মিথ্যা বলে না।
কয়েকদিন আগে আমি একটা বই পড়ে শেষ করেছি। বইটিতে একটা আমার মতো ছেলের কথা লেখা। তার নাম ক্রিস্টোফার। মিথ্যা কথা সেই ছেলেটিও সহ্য করতে পারে না। তবে ছেলেটির বাবা তাকে মিথ্যা কথা বলেছিলেন। ছেলেটি ডিটেকটিভের মতো মিথ্যাটা ধরে ফেলে। তখন তার খুব কষ্ট হয়। ক্রিস্টোফারের বাবা একটা কুকুরকে বর্শা দিয়ে মারেন। খুব অন্যায়।
আমিও ক্রিস্টোফারের মতো ডিটেকটিভের কাজ করছি। কারণ আমার ধারণা ফারুক আমার বাবা। আমার পিঠে যেমন লাল দাগ আছে, ফারুকের পিঠেও আছে। আমি আয়নায় দেখেছি। একে বলে Heredity.
এই শব্দটার অর্থ হলো–
The process by which mental and physical characteristics are passed by parents to their children.
বিষয়টা নিয়ে আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করি নি। শুধু মতিনকে বলেছি। মতিন আমার বন্ধু। সে এই বিষয়ে আমাকে সাহায্য করবে।
ফারুক যদি আমার বাবা হয়, তাহলে তাকে আমার বাবা ডাকতে হবে এবং সালেহ ইমরানকে তার নাম ধরে ডাকতে হবে। এটা সহজ কাজ। যে-কেউকে যে-কোনো কিছু ডাকা যায়। তবে ফারুক যদি আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে চান, তাহলে সমস্যা হবে। কারণ তখন আমাকে আমার ঘর ছেড়ে যেতে হবে। আমি পরিচিত জায়গা ছাড়া থাকতে পারি না। পরিচিত জায়গার সব গন্ধ আমার চেনা। অপরিচিত জায়গার সব গন্ধ চেনা না।
টেলিফোনে কাল রাতে আমি মার সঙ্গে কথা বলেছি। মা টেলিফোন করেছিলেন, আমি টেলিফোন ধরেছি। মার সঙ্গে আমার কী কী কথা হলো আমি এখন তা লিখব। আমার সবকিছু মনে থাকে। আজ থেকে একমাস পরেও যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আমি বলতে পারব। একমাস পার হয়ে গেলে বলতে পারব। কি-না জানি না। পরীক্ষা করে দেখি নি। মা বলল, হ্যালো।
আমি বললাম, হ্যালো।
মা বলল, কী করছ?
আমি বললাম, কিছু করছি না।
মা বলল, আমি যে এতদিন বাইরে থাকছি তোমার খারাপ লাগছে না?
আমি বললাম, না।
মা বলল, তুমি কি আমাকে মিস করো না?
আমি বললাম, না।
মা বলল, আমি কিন্তু তোমাকে মিস করি।
আমি বললাম, তুমি কি বাবাকেও মিস করো?
মা বলল, হ্যাঁ।
আমি বললাম, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। বাবাকে মিস করলে তুমি বাবাকে ছেড়ে যেতে না।
মা বলল, তোমার বয়স কম, তুমি অনেক কিছু বুঝবে না।
আমি বললাম, বুঝিয়ে দাও। Be my teacher.
মা টেলিফোন রেখে দিল। আমি রুবিক কিউব নিয়ে খেলতে বসলাম। রুবিক কিউব হলো–
A puzzle consisting of a plastic cube covered with coloured squares that you turn to make each side of the cube a different colour.
রুবিক কিউবটি আমাকে দিয়েছেন ফারুক। তিনি বলেছেন, এই পাজল। সমাধানের সর্বনিম্ন সময় তিন মিনিট। ভিয়েতনামের একটি ছেলে এই রেকর্ড করেছে। তার নাম গিনিজ বুক অফ রেকর্ডসে উঠেছে।
আমি বললাম, ছেলেটার নাম কী?
উনি নাম বলতে পারলেন না।
আমার রেকর্ড পাঁচ মিনিট তিন সেকেন্ড। আমি প্রতিদিনই পাঁচবার এই পাজলের সমাধান করি। মার সঙ্গে কথা বলে টেলিফোন রাখার পর আমি যে পাঁচবার সমাধান করেছি তার সময় হলো–
৬ মিনিট ১০ সেকেন্ড
৬ মিনিট ০ সেকেন্ড
৫ মিনিট ৪০ সেকেন্ড
৫ মিনিট ৩০ সেকেন্ড
৫ মিনিট ৫০ সেকেন্ড
আমার বাবা (কিংবা বাবা না) সালেহ ইমরান একজন ব্যারিস্টার। তিনি যতক্ষণ বাসায় থাকেন ততক্ষণ বই পড়েন। আগে তাঁর সঙ্গে সপ্তাহে দুইদিন আমি মুভি দেখতাম। এখন একদিন দেখি। গত সপ্তাহে যে মুভি দেখেছি তার নাম–
A sound of Thunder.
টাইম ট্রাভেলের গল্প। লেখকের নাম Ray Bradbury.
বাবা (কিংবা বাবা না) বলেছেন ইনি খুব বড় একজন সায়েন্সফিকশান লেখক। আমার কাছে তাকে বড় সায়েন্সফিকশান লেখক মনে হয় নি। কারণ বড় লেখকরা ভুল করেন না। তিনি ভুল করেছেন, টাইম ট্রাভেল করতে হলে আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে যেতে হবে। সেটা সম্ভব না। আলোর গতি ধ্রুব। সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল।
আমি বাবাকে (কিংবা বাবা নাকে) বললাম, লেখক ভুল করেছেন।
বাবা বললেন, বিজ্ঞানের সত্যের চেয়ে চিন্তার শুদ্ধতাটা দেখতে হবে। তাঁর চিন্তা শুদ্ধ।
বিজ্ঞানের সত্য আবার ভুল। বিজ্ঞানের মিথ্যা কিছু নেই। বিজ্ঞানের সবই সত্য। আমি বললাম, তুমি ভুল কথা বলেছ।
তিনি বললেন, হতে পারে আমি ভুল বলেছি।
আমি বললাম, কেউ ভুল বললে আমার খারাপ লাগে।
তিনি বললেন, খারাপ লাগাটা কমাতে হবে। মানুষ ভুল করবেই।
আমি বললাম, কেন?
তিনি বললেন, কারণ মানুষ কম্পিউটার না।
আমি বললাম, মানুষ অবশ্যই কম্পিউটার। কম্পিউটার ইনফরমেশন প্রসেস করে, মানুষও করে। মানুষের ব্রেইন হলো হার্ডডিস্ক। মানুষের চিন্তা হলো কমান্ড।
তিনি বললেন, আমি এই নিয়ে তোমার সঙ্গে তর্কে যাব না। কারণ এই বিষয় আমি জানি না।
আমি বললাম, কে জানেন?
তিনি বললেন, আলোচনা এখানেই বন্ধ। প্লিজ স্টপ।
আমার বন্ধু মতিন একজন লেখক। তিনি Ray Bradburyর চেয়ে বড় লেখক। কারণ তিনি ছোট ছোট ভুল করেছেন, বড় ভুল করেন নি। তিনি বইতে লিখেছেন পিপড়াগুলি পেছন দিকে হাঁটা শুরু করল। পিপড়া পেছন দিকে হাঁটে না। প্রাণী জগতের কেউই পেছনে হাঁটতে পছন্দ করে না। কারণ তাদের পেছনে কোনো চোখ নেই। মানুষও পেছন দিকে হাঁটতে চায় না। মোটরগাড়ি পেছনে যায়। ব্যাক গিয়ার দিলেই মোটর পেছনে যায়। Gear হলো–
Machinery in a vehicle that turns engine power into movement forwards or backwards.
উনার বইতে আরেকটা ভুল হলো, তিনি লিখেছেন—–অন্ধকার দেখতে হলে আলো লাগে। আলো ছাড়া অন্ধকার দেখা যায় না।
আলোর অভাবই অন্ধকার। তাহলে আলো দিয়ে আমরা কীভাবে অন্ধকার দেখব? উনি যে সব ভুল করেছেন, আমি সবই হলুদ মার্কার দিয়ে দাগ দিয়েছি। যেদিন তার সঙ্গে দেখা হবে সেদিন তাঁকে ভুলগুলি দেখাব। তার সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে।
আমি বললাম, হ্যালো।
তিনি বললেন, হ্যালো কমল।
আমি বললাম, হ্যালো নতিম।
তিনি বললেন, হ্যালো লমক।
আমি বললাম, যে হারিয়ে গেছে তাকে কি পাওয়া গেছে? আপনার পরিচিত যে মেয়ে!
তিনি বললেন, তোমাকে কে বলেছে?
আমি বললাম, বাবা বলেছেন। (আমার বলা উচিত ছিল বাবা হতে পারেন আবার নাও হতে পারেন বলেছেন। সেটা না বলে আমি বলেছি, বাবা বলেছেন। এটা ভুল।)
তিনি বললেন, তাকে পাওয়া যায় নি।
আমি বললাম, পুলিশের উচিত কুকুর দিয়ে খোঁজা। কারণ কুকুর হাফ কিলোমিটার দূরের গন্ধও পায়।
তিনি চুপ করে রইলেন।
আমি বললাম, তাকে যদি কোনোদিন খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে কি আপনার খারাপ লাগবে?
তিনি বললেন, তোমার যদি প্রিয় কেউ হারিয়ে যায়, তোমার কি খারাপ লাগবে?
আমি বললাম, মানুষের কেন খারাপ লাগে, কেন ভালো লাগে এটা আমি জানি না। আমি চিন্তা করছি। চিন্তা করে যেদিন বের করব তখন আপনার প্রশ্নের জবাব দেব!
আমি চিন্তা করার জন্যে খুব ভালো একটা জায়গা পেয়েছি। সিঁড়িঘরের ছাদ। ছাদ থেকে সিঁড়িঘরের ছাদে উঠার জন্যে লোহার একটা সিঁড়ি আছে। সিঁড়িঘরের ছাদে উঠে রাস্তার দিকে মুখ করে ছাদে বসা। পা ঝুলিয়ে বসতে হবে। উপর থেকে রাস্তার মানুষদের দেখা যাবে। কিন্তু রাস্তার লোকজন আমাকে দেখতে পাবে না। যাদের Batophobia আছে, তারা কখনো এই কাজটা পারবে না।
Batophobia হলো–Fear of heights.
এরকম আরো অনেক Phobia আছে।
যেমন—
আরো অনেক আছে। সব এখনো যোগাড় করতে পারি নি। আমি তালিকা তৈরি করেছি আমার কী কী Phobia আছে তা জানার জন্যে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন