দুষ্টুবুদ্ধি বুদ্ধিজীবী – ১

সাদাকে সাদা অথবা কালোকে যথার্থই কালো আখ্যাত করে সত্যভাষণে খ্যাতিমান হবার পথ সকলের জন্য প্রশস্ত নয়। সে ক্ষেত্রে খ্যাতকীর্তি না হয়েও খ্যাতিমান হবার জন্য সাদাকে কালো অথবা কালোকে সাদা বলে আসর জমিয়ে তোলার চেষ্টা সাম্প্রতিক কালের একটি জনপ্রিয় পন্থা। ঔচিত্যবোধের নিরিখে প্রকৃষ্ট পন্থা কিনা সে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক। অধিকন্তু বিষয়টি যদি হিন্দু-মুসলমান—এই দুই সম্প্রদায়ের পাস্পরিক সম্পর্কবিষয়ক হয় তাহলে তো ‘সোনায় সোহাগা’। যে কোন আলোচনার শেষে যদি ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু হিন্দু-সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করে কাঠগড়ায় টেনে আনা যায়; তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মেরে প্রগতিশীল হিসেবে জাতে ওঠা তো যায়ই, নানা মহলের দাক্ষিণ্যের কলাটা-মুলোটা নগদ লাভের সম্ভাবনাও প্রবলতর করে তোলার সুযোগ তৈরী হয়।

সাম্প্রতিককালে উপরোক্ত প্রবণতা এত বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে যে নিতান্ত অপ্রয়োজনেও ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গেয়ে যে কোন বিষয়ে হিন্দুকে শুধুমাত্র হিন্দু হবার কারণে গালমন্দ করা যেন প্রায় ছোঁয়াচে রোগের আকার ধারণ করেছে। নিন্দিত হিন্দুত্ববাদীরা নন, অন্যরাও এই দুষ্টুবুদ্ধি ধরতে পারছেন, কেউ কেউ চিহ্নিতও করছেন তাকে। কপটাচার ও অপরিণামদর্শীতার মাঝে তা অবশ্যই কিছু পরিমানে স্বস্তির মুক্ত বাতাস বহন করে আনছে

জনৈক বিকাশ চক্রবর্তী বাংলার বাউলদের নিয়ে ‘বাউলজীবনের সমাজতত্ব’ নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেছেন সম্প্রতি। লেখকের বাউলচর্চা কতখানি মৌলিক সে প্রশ্নে না গিয়েও গ্রন্থটির ৬নং পৃষ্ঠায় প্রকাশিত মন্তব্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। লেখক মন্তব্য করেছেনঃ-“অতি সাম্প্রতিকালের ঘটনাবলী থেকে জানা যায় যে বাউল-ফকিররা হিন্দু অথবা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের দ্বারা এখনও অত্যাচারিত হয়ে থাকেন।”

গ্রন্থটির সমালোচনা করেছেন অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী, ১৭ই অক্টোবর ২০০৪-এর ‘দেশ’ পত্রিকায়।

সুধীর চক্রবর্তী বাংলার বাউল সম্প্রদায়কে নিয়ে রচিত বেশ কয়েকটি গ্রন্থের লেখক. বাংলার গৌনধর্মসম্প্রদায়ের বিষয়ে একজন স্বীকৃত ও খ্যাতকীর্তি গবেষক এবং অবশ্যই হিন্দুত্ববাদী নন। (কবি-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বিষয়ে সুধীরবাবুর গবেষণা অবশ্য বহু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে হিন্দুত্ববাদী দ্বিজেন্দ্রলালকে মহৎ বানানোর এক প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত।)

সুধীরবাবু বিকাশ চক্রবর্তীর উপরোক্ত মন্তব্যের প্রসঙ্গে এনে লিখেছেন :-“সর্বশেষে একটি তথ্যভ্রান্তির ব্যাপারে লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার। যতদূর জানা যায়, বাউল-ফকিরদের ওপর গত কয়েক দশকের অত্যাচার সংঘটিত হচ্ছে মৌলবাদী মুসলমানদের দ্বারাই—হিন্দুরা কেন তাঁদের ওপর অত্যাচার করবে।”

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বাউলজীবনের সমাজতত্ব রচনায় লেখক যে তথ্যভ্রান্তি ঘটালেন তার পেছনে লেখকের কোন মনস্তত্ব কাজ করছে?

সুধীরবাবু, বিকাশ চক্রবর্তীর লেখায় যে তথ্যভ্রান্তি সকলের নজরে আনলেন, সে ধরনের তথ্যপ্রমাদ আজকাল বহু গ্রন্থেই প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবে ‘ধ্রুব’ স্থান দখল করে নিচ্ছে।

মুসলমানসমাজের এমনকী মৌলবাদী অংশকেও তাদের কোন কাজের জন্য সত্যের খাতিরে নিন্দিত করতে হলেও নিতান্তই অকারণে তার সাথে হিন্দুদেরকে জুড়ে দিয়ে স্বকপোলকল্পিত ভারসাম্য ঘটানোর প্রচেষ্টা যে বিশেষ উদ্দেশ্য-প্রণোদিত তাতে আর সন্দেহ কি?

অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর পর্যবেক্ষণ যে কতটা বাস্তবসম্মত তা বোঝা যায় অতি সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনার মাধ্যমে।

ঘটনাটি এই পশ্চিমবঙ্গেরই বীরভূম জেলায় অবস্থিত কোটা গ্রামের। যে সুফী-দরবেশদের মাধ্যমে আমরা ইসলামের মুক্তমনের সন্ধান করি, সেই সুফি-ফকিরি গান গাইতে গিয়ে মুসলমানপ্রধান গ্রামে গ্রামবাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন ১৭ বছরের সানোয়ার।

সানোয়ারের দাদা, এই অজুহাতে হত্যা করা হয়েছে নূর হোসেন (৩০), নূর আলি (২৬), আবুল হোসেন (২৪), জিয়ার হোসেন (২১), আনোয়ার হোসেন (১৯)-কে। হত্যা করা হয়েছে তাঁদের মাসির ছেলে জাফর শেখ (২৫), পিয়ার শেখ (২৪) এবং ভুনু শেখকেও (২১)।

মাড়গ্রামের সানোয়ার কোটায় তাঁর বোন নাইমার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন।

গত ৬ই আগষ্ট, ২০০৫-এর আনন্দবাজার পত্রিকায় নাইমা বিবির জবানিতে ঘটনাটি এ রকম :-“ছোটদাদা সানোয়ার মাড়গ্রাম থেকে আমার বাড়িতে এসে ফকিরি গান গাইছিল। পড়শিরা শুনতে জড়ো হয়েছিলেন। গানে ‘প্রভু’ উচ্চারণ করায় গ্রামের দুই যুবক দাদাকে চড় কষায়। বলে, এখানে ‘প্রভু’ উচ্চারণ করতে পারবি না।”

সানোয়ার পরের দিন ফকিরি গানের উদার ধর্মভাব বোঝানোর জন্য তাঁর দাদাদের নিয়ে গ্রামে একটি গানের আসর বসানোর ব্যবস্থা করেন। বোন নাইমার বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার পরে বিশ্রাম করার সময় শ’চারেক মুসলমান গ্রামবাসী বল্লম, টাঙ্গি, তলেয়ার নিয়ে আক্রমণ চালায়। খড়ের চালে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বাধ্য করে সানোয়ার ও তাঁর ভাইদের বাইরে বেরিয়ে আসতে। উন্মত্ত জনতা তাঁদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নয়জনকেই কুপিয়ে হত্যা কবে পাশের মাঠে ছড়িয়ে দেয়।

সানোয়ারের মা আনোয়ারা বিবিও সেদিন মেয়ের বাড়িতে ছিলেন। চোখের সামনে ছেলেদের খুন হতে দেখেছেন তিনি। লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও বিচার মেলেনি। ‘কেস ডাইরী’ হারিয়ে গিয়েছে বলে হাইকোর্টে জানিয়েছেন সরকারী কৌসুলি।

সুফিবাদে বিশ্বাসী আইনজীবী সৈয়দ মুন্না, আনোয়ারা বিবির হয়ে মামলা লড়ছেন।

মামলার ফল কি হবে তা অজানা। কিন্তু যে উদার-মুক্ত পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আমাদের গর্ব তার ভিতরের চিত্রটি কি বিকাশ চক্রবর্তীর মতো লেখকদের মনগড়া ব্যাখ্যার অসারতা প্রমাণ করে না? সেই সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের তথাকথিত নিরপেক্ষতার স্বরূপ সম্বন্ধেও প্রশ্ন চিহ্ন আঁকা হয়ে যায় না কি?

ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান সংঘাত কোন নতুন কথা নয়। কিন্তু এই সংঘাতের বিচারকালে কোনো একটি সম্প্রদায়কে কেবলমাত্র কনিষ্ঠ পক্ষ হবার জন্য বিশেষ প্রীতি প্রদর্শনে যদি সততই তার অপরাধমাত্রাকে খাটো করে জ্যেষ্ঠকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে জ্যেষ্ঠ বহুদিন সেই শাসন শিরোধার্য করে চলবে এমন ভাবনা সমীচীন হতে পারেনা। কনিষ্ঠের অপরাধে জ্যেষ্ঠকেও জেলের ঘানি টানতে হবে এ আবদার কতদিন সহ্য করা যাবে?

তথাকথিত নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীরা একথা বোঝেন না এমন নয়, কিন্তু এ বিষয়ে হক কথায় পাছে নানা রঙিন সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে যায়, সেই কারণে বিপরীতমুখী হাঁটতেও দ্বিধা করেন না। এ ধরনের বুদ্ধিজীবীরা যে তাদের সামনে ধরা দর্পণে বৃহন্নলার রূপেই উদ্ভাসিত হবেন বিশিষ্ট পণ্ডিত তথা গবেষক ডঃ অরবিন্দ পোদ্দার তা যথার্থই উপলব্ধি করেছেন।

গোধরাতে করসেবকদেরকে পুড়িয়ে মারার ঘটনার পর মুসলমানদের তরফে ঘটনার নিন্দা করা হলে গোধরা পরবর্তী গুজরাট দাঙ্গা সম্ভবত ততটা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে না।

গত ২২শে মার্চ, ২০০৬ এ আনন্দবাজার পত্রিকায় গৌতম রায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বারানসীর সংকটমোচন মন্দিরে সন্ত্রাসবাদী হামলায় বেশ কিছু হিন্দুর মৃত্যু সত্বেও হিন্দুদের সহনশীলতার যে দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন তা উপরোক্ত ধারণারই সত্যতা প্রমাণ করে।

সঙ্কটমোচন মন্দিরের হত্যাকাণ্ডের পর মুসলমান ইমাম, উলেমারা যেভাবে তার নিন্দা করেছেন তা প্রশংসনীয়। যদিও একথা না বললে সত্যের অপলাপ করা হবে যে মুসলমানদের কিন্তু অতীতে কখনো এধরনের কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করতে দেখা যায় নি-–না কাশ্মীরে, না দেশের অন্য কোনো স্থানে।

গোধরাকাণ্ডের পরবর্তী দাঙ্গা নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তত্ব’ ব্যঙ্গ বিদ্রুপের খোরাক হয়ে উঠেছে। গুজরাটের দাঙ্গাকে মহান করে তোলার কোনো প্রশ্নই আসেনা, কিন্তু একথা ভেবে দেখা প্রয়োজন যে সংকটমোচন মন্দিরের ঘটনায় মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া গোধরাপরবর্তী গুরজরাট দাঙ্গায় হিন্দুদের সহিষ্ণুতার বাধ ভেঙ্গে যাবার ঘটনারই প্রতিফলন কি না? অবশ্য যদি একান্তই তা হয় তাহলে এটি একটি শুভলক্ষণ। যে কোনো হঠকারী কাজের যে এখটি সামাজিক প্রতিক্রিয়া হবে এই বাস্তব বোধ থাকাটাও তো একটি সদর্থক ভাবনা।

গুজরাটের গোধরাতে করসেবকদের পুড়িয়ে মারা হলো। তর্কের খাতিরে যদি মেনে নেওয়া হয় যে বিভিন্ন স্টেশনে করসেবকদের দুর্ব্যবহার এবং মুসলমান মহিলাদের প্রতি কটূক্তিবর্ষণে ক্ষিপ্ত মানুষ করসেবকদের আক্রমণ করেছে, তাহলেও নারী-শিশু নির্বিশেষে এতগুলি মানুষকে জীবন্ত দগ্ধ করা একান্তই নিন্দাৰ্থ নয়?

(এখানে লালন ফকিরের সেই বিখ্যাত গান ‘বামন চিনি পৈতাতে, বামনি চিনি ক্যামনে’র অনুকরণে ‘মুসলমান চিনি দাড়ির নূরে, মুসলমানী চিনি ক্যামনে’ বলা যায় কি!)

কিমাশ্চর্যম, এদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা গোধরা হত্যাকাণ্ডকে লঘু করতে প্রথমে উপরোক্ত যুক্তি খাঁড়া করেছিলেন। কিন্তু ধোপে না টেকায় বললেন নরেন্দ্র মোদীর সরকার ষড়যন্ত্র করে করসেবকদের পুড়িয়ে মেরেছেন এবং তারই অজুহাতে দাঙ্গা বাঁধিয়ে নির্বাচনে জয়লাভের পথ পাকা করেছেন।

কি ভয়ানক অভিযোগ! সামান্যতম দায়িত্ববোধ থাকলে এমন কথা বলার আগে নিশ্চিত প্রমাণ হাতে আসা প্রয়োজন ছিল না কি? এদেশে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা যেন নতুন এবং করসেবকদের হত্যার প্ররোচনা থাকা সত্বেও গোধরাতে দাঙ্গা লাগা যেন একান্তই এক অসম্ভব ব্যাপার!

ইতিহাস সচেতনতার দাবি যারা করেন, তারা পুরানো নথিপত্র এবং তথ্য একেবারেই ঘেঁটে দেখবেন না এ কেমন কথা? গোধরা বরাবরই একটি সংবেদনশীল স্থান। অতীতে বহুবার সেখানে দাঙ্গা হয়েছে। এবিষয়ে বহু তথ্য দিয়ে লেখাকে ভারাক্রান্ত করার বদলে উদাহরণ হিসেবে মনস্বী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যার একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ করা যেতে পারে। অর্থাৎ আজ থেকে ৭৫বছর আগে, যখন নরেন্দ্র মোদীদের নির্বাচনে জয়লাভের জন্য কোন ষড়যন্ত্র ছিল না; বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রামজনমভূমি আন্দোলন ছিলনা, তখনও গোধরায় দাঙ্গা হয়েছে।

প্রবাসী ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ এই শিরোনামে লিখছে (পৃ ১৭৪) :- “……গোধরায় জৈনদের এক শোভাযাত্রা মসজিদের সম্মুখ অতিক্রম করার সময় মুসলমানগণ তাহাদিগকে আক্রমণ করে। তার ফলে একজন নারী আহত হয়। উক্ত শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ হইলে মসজিদের নিকটবর্তী স্থানে আরও একটি হাঙ্গামা হয় তাহাতেও ১২জন লোক আহত হইয়াছে।  

বোম্বাই ব্যবস্থাপক সভার সদস্য মিঃ ডাব্লিউ.এস.মুকাদাম, মস্তকে এবং বাহুতে গুরতর আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছেন বলিয়া সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। ১৩জন আহত ব্যক্তির মধ্যে ১২জনই হিন্দু। যে মুসলমানটি আহত হইয়াছে তিনি একজন পুলিশ পেট্রল। গোধরা হিন্দু মহাসভার স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রেসিডেন্ট এবং প্রসিদ্ধ উকিল মিঃ পুরুষোত্তম একজন মুসলমান তৈল ব্যবসায়ীর দ্বারা গুরুতর রূপে আহত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন।”

করসেবকদের জীবন্ত দগ্ধ করার প্ররোচনায় গোধরায় দাঙ্গা বেঁধে ওঠাকে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করবার সময় ভাবলেন না এদের মন্তব্যের পরিণাম কি হতে পারে!

গুজরাটের দাঙ্গা নিয়ে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হলো। নানা রোমহর্ষক কাহিনী সংযোজিত হলো তাতে। দু-চারটি তেমন ঘটনা সত্য নয় এমন কথা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু অধিকাংশই যে নেহাত বানানো গল্প সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। গত ২৬শে এপ্রিল, ২০০৩-এর আনন্দবাজার পত্রিকায় অলোককুমার ঘোষ বেশ কয়েকটি ঐ জাতীয় গ্রন্থের পর্যালোচনা (সমালোচনা, ইংরেজী Review-এর সার্থক প্রতিশব্দ নয়।) করেছেন। ঐ তালিকায় অনেকগুলি গ্রন্থের মধ্যে মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় ও সোমা মারিক সম্পদিত ‘গর্ভঘাতী গুজরাট’(তৃতীয়-শ্রেণীর যাত্রাপালার নামকরণও হার মেনে যায়!) গ্রন্থটি ছিল। পর্যালোচক এই বই-এ বর্ণিত ঘটনা প্রসঙ্গে যা লিখেছেন তা তুলে দেওয়া যাক :-“……কী করে বিশ্বাসযোগ্য হবে সেই বর্ণনা যেখানে ধর্ষণের শেষে সুলতানি পিরোজের পা কেটে রেখে যায় দুষ্কৃতীরা, অথচ একটু পরেই পিরোজা বাচ্চা কোলে নিয়ে নদী বরাবর দৌড়ে পালিয়ে যায়!” (গর্ভঘাতী গুজরাট, পৃ-৯৮)

‘গল্পের গরু গাছে চড়ে’ একথা সমালোচক জানেন না এমন নয়, কিন্তু পাখা মেলে উড়তেও পারে তা জানা সম্ভব কজনার

গুজরাট নিয়ে লেখা সমস্ত লেখায় প্রশাসন ও পুলিশকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। দাঙ্গাকারীরা নাকি পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে অবাধে লুঠ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি সংঘটিত করেছে।

গত ২১শে অক্টোবর, ২০০৩-এর আনন্দবাজার পত্রিকায় পি.টি.আই-এর সরবরাহ করা একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘গুজরাট পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা’ শিরোনামের সেই সংবাদটি এই রকম :-“গুজরাটের দাঙ্গায় আক্রান্ত ও প্রত্যক্ষদর্শীরা ওই রাজ্যের পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করলেন। নানাবতী কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে এসে তাঁরা জানিয়েছেন, পুলিশের জন্যই তাঁরা বেঁচে গিয়েছেন।

সাক্ষ্যে বেরামপুরের বাসিন্দা মুমতাজ পাঠান জানিয়েছেন, দাঙ্গাবাজরা তাঁদের মেরেই ফেলত, কিন্তু পুলিশ ঠিক সময়ে আসায় তাঁরা প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। ………..দাঙ্গায় আক্রান্ত হাজি মহম্মদ পটেলও পুলিশের প্রশংসা করে বলেন, দাঙ্গাবাজরা ইব্রাহিম সৈয়দ দরগা আক্রমণ করলে পুলিশ দাঙ্গাকারীদের হটিয়ে দেয়।”

তাহলে প্রশাসন ও পুলিশ সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের মনে সন্দেহ ও আস্থাহীনতার বীজ বপন করছে কারা?

২৭শে ফেব্রুয়ারী, ২০০২, ডাউন সবরমতী এক্সপ্রেস ট্রেনটি আক্রান্ত হয় গোধরা রেলস্টেশন থেকে ৫০০ মিটার দূরে, ২৫জন মহিলা ও ১৪জন শিশু সহ মোট ৫৭জন মানুষকে জীবন্ত দগ্ধ করা হলো। পরিণামে সমগ্র গুজরাট জুড়ে দাঙ্গা বেঁধে যায়।

‘গুজরাট নরমেধ যজ্ঞ’ নামে গ্রন্থটির সম্পাদক রুদ্রদেব মিত্র জানিয়েছেন ২০০১সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নাকি গুজরাট দাঙ্গার ছক সাজানো হয়েছিল এবং তিনি তখনই তা জানতে পেরেছিলেন। (পৃ-১০)

পাঁচ মাসেরও বেশী সময় পেয়েছিলেন রুদ্রদেব দাঙ্গার ষড়যন্ত্র জানার পর না, কোথাও ঘুণাক্ষরেও তিনি তা প্রকাশ করেননি!

রুদ্রদেবের মতো সম্প্রীতিবাদী মানুষ গুজরাট দাঙ্গার আগাম সংবাদ জেনেও সেটি প্রকাশ করবেন না, তা বিশ্বাস করতে, কষ্ট হয়! অবশ্য ষড়যন্ত্রের কথা বলতে রুদ্রদেব যদি করসেবকদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনার কথা বলতে চান, তাহলে রুদ্রদেবের পক্ষে সেটি প্রকাশ না করাটাই স্বাভাবিক এবং তা বরং অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য। বিশেষত, কাক পাখী স্বজাতির মাংস না খেলেও, হিন্দু তা খায় না এমন কথা যখন অন্তত জানা নেই।

রুদ্রদেব অবশ্য অন্তত একটি বিষয়ে গঠনমূলক প্রস্তাব রেখেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মরণে একটি জাতীয় মনুমেন্ট গড়ার কথা বলার মধ্যে দিয়ে। (গুজরাট নরমেধ যজ্ঞ, পৃ-১২)

বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখিকা অরুন্ধতি রায় ইদানিং গল্প-উপন্যাস লেখার চাইতেও সংবাদপত্রে প্রতিবেদন লেখাতেই বেশী উৎসাহী। গুজরাট দাঙ্গা তাঁকে এবিষয়ে বিশেষ সুযোগ এনে দিয়েছে। কাহিনী উপস্থাপনায় যে কল্পনাশক্তির প্রয়োজন শ্রীমতী রায়ের তা একান্তই সহজাত বলে গুজরাট নিয়ে প্রতিবেদন রচনায় তিনি তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে যথার্থই উদ্ভাবনীশক্তিসম্পন্না লেখিকা হিসেবে নিজের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। তবে গল্প হিসেবে অরুন্ধতী রায়ের লেখা আকর্ষণীয় হলেও শেষরক্ষা হয়নি।

২০০২-এর ৫ই এপ্রিল ‘Out Look’ পত্রিকায় অরুন্ধতী গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে যে নিবন্ধ রচনা (যথার্থই রচনা) করেন তার সূচনা এই রকম :-“বরোদা থেকে এক বান্ধবীর ফোন এলো। ফোনে সে অঝোরে কাঁদছে। ওর এক বান্ধবী সঈদা উন্মত্ত জনতার হাতে পড়ে গিয়েছিল। সঈদার পেটটা চিরে দাঙ্গাকারীরা জ্বলন্ত কাপড়ের ফালি ঢুকিয়ে দেয়। সঈদা মরে যাবার পর তার কপালে লিখে দেয় ওম।”

দাঙ্গায় সঈদা কিংবা সীতা নামের কোন যুবতীর নিহত হবার ঘটনা মোটেও অসম্ভব নয়। দাঙ্গাকারীরা তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে —— এমন ঘটনাও সত্য হতেই পারে। কিন্তু ভাবুন দেখি কপালে ‘ওম’ লিখে দেবার বিষয়টি। দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে তাহলে এক শিল্পীও ছিলেন যিনি দাঙ্গার উন্মত্ততা ও গণ্ডগোলের মাঝেও নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে তার শিল্পকর্ম সম্পূর্ণ করেছেন।

প্রশ্ন উঠবে না কে দেখেছেন সঈদার কপালে আঁকা সেই অভূতপূর্ব শিল্পকর্ম? যদি দেখে থাকেন তাহলে ছবি তুলে রেখেছিলেন কি শিল্পকর্মের?

প্রশ্ন উঠতে পারে অরুন্ধতী রায়ের মত সম্মনীয়া লেখিকা মিথ্যে লিখবেন একথা বিশ্বাসযোগ্য?

হ্যাঁ অরুন্ধতী রায় অনেক স্থানেই সত্য বলেননি। ঐ নিবন্ধেরই আর একটি বর্ণনা :-“হিংস্র জনতা তাঁর বাড়িতে ঢুকে পড়ে তাঁর কন্যাদের নগ্ন করে পুড়িয়ে মারে। তারপর জাফরীর মাথা কাটে এবং টুকরো টুকরো করে তাঁকে “

এহসান জাফরীর পুত্র টি.এ.জাফরী ২রা মে’র ‘ASIAN AGE’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন :-“আমার ভাই-বোনদের মধ্যে আমি একাই ভারতে বাস করি। ভাই-বোনদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বড় এবং আমার ভাই ও বোন আমেরিকায় বাস করেন।”

জাফরী একথাও জনিয়েছেন যে তাঁর বোন সুস্থ আছেন।

তাহলে অরুন্ধতী রায় জাফরীর কন্যাদের (বহুবচন করে ভারী করা হয়েছে। নগ্ন করে পুড়িয়ে মারার গল্প ফাঁদলেন কি উদ্দেশ্যে?

সঙ্গীত সাধক ফৈয়াজ খাঁর সমাধি নষ্ট করার প্রসঙ্গও উত্থাপন করেছেন অরুন্ধতী রায় তাঁর লেখায়। কলকাতায় এই সংবাদ শুনে প্রকৃত ঘটনা কি তা বিচার না করেই বিবৃতি দিলেন কিছু শিল্পী। সরকারী প্রসাদপ্রার্থী বুদ্ধিজীবীরা তো আছেনই, এমনকী সংযতবাক এবং প্রচারে বিখ্যাত হতে হয়নি এমন কিছু যথার্থ গুণী শিল্পীও প্রতিবাদ করলেন তথাকথিত গৈরিকবাহিনীকে দোষারোপ করে।

ফৈয়াজ খাঁর সমাধি বরোদার দর্শনীয় স্থান ছিল কি?

বিশিষ্ট লেখক নিত্যপ্রিয় ঘোষ লিখেছেন :-“সমাধিটি কি অবস্থায় ছিল? ১৯৫৮-তে মৃত ওস্তাদ, তাঁর কবর দেখতে গিয়েছিলেন কুমারপ্রসাদ মুখ্যোপাধায়, মৃত্যুর চোদ্দ-পনের পছর পরে। বরোদায় গিয়ে তিনি দেখলেন, ওস্তাদের মজ্হর কোথায় সেটা জানা দূরের কথা, ওস্তাদ কে তাই কেউ জানেনা। খুঁজতে খুঁজতে তিনি শহরের অনেক গলি খুঁজি পেরিয়ে, একটি ছোট মোটর গ্যারাজের পিছনের দরজা দিয়ে, একটা কাঠা দশেক খোলা জায়গা, একাধিক নাম না জানা কবরের মধ্যে দেখতে পান, কোণে ছতরীওয়ালা কবর ওস্তাদের। প্রশ্ন জাগে, এমন একটি চুড়ান্ত অবহেলায় পড়ে থাকা কবরের উপর আক্রোশ হবে কার? যেখানে ওস্তাদকেই লোকে ভুলে গেছে। মহাশ্বেতা দেবী যখন কবর ধ্বংশের খবর পেয়ে ধিক্কার জানান, তখন নিশ্চয়ই কবর ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু সেটা কি ওস্তাদকেই অসম্মান করার জন্য? যাঁর গানে রাধাকৃষ্ণের ছড়াছড়ি, যিনি সঙ্গীত শুনে ‘রাধে রাধে’ বলে তারিফ জানাতেন, যিনি ধ্রুপদ গাইতেন ‘ওম অনন্ত নারায়ণ হরি’ দিয়ে, যাঁর ‘বন্দে নন্দকুমারম’ ঠুংরি বিখ্যাত, তাঁর উপর গৈরিকবাহিনীর আক্রোশ কেন? কবরখানায় আক্রমণ বিশেষ করে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁকেই অসম্মান, না অন্ধভাবে কবর ধ্বংস, না জমির ধান্দায় এই আক্ৰমণ?…………….ফৈয়াজ খাঁকেই অপমান করা হয়েছে, এমন নিশ্চিত প্রমাণ কি পাওয়া গেছে?”

শ্রীযুক্ত নিত্যপ্রিয় ঘোষ আরও বেশ কয়েকটি বিষয় তাঁর লেখাতে এনেছেন। কোনো কোনো স্থানে মিথ্যা এবং ভুল সংবাদের উপর ভিত্তি করে কি ভাবে ‘হিন্দু সম্প্রদায়িকতা’–র কথা বলে মুসলমানদের উত্তেজিত করে চলেছেন এদেশের তথাকথিত সমাজমনস্ক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকরা, শ্রী ঘোষের লেখা সে বিষয়েও আলোকপাত।

শ্রী ঘোষ লিখছেন :-“২৩শে এপ্রিল লোকসভায় তুমুল আলোড়ন, গুজরাট শিক্ষা ব্যবস্থায় গৈরিকীকরণ। উপলক্ষ গুজরাট রাজ্য বোর্ডের পরীক্ষায় ইংরেজি প্রশ্নপত্রে কয়েকটি বাক্য, যার উদ্দেশ্য নাৎসীদের জয়গান করা, নাৎসি আদর্শ প্রচার করা। পরের দিন যথারীতি সম্পাদকীয় লেখা হয় বড় বড় সংবাদপত্রে গৈরিক শিক্ষার বিরুদ্ধে। অথচ লোকসভাতেই জানানো হয়েছিল, বাক্যগুলি নেওয়া হয়েছে অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তক থেকেই। বাক্যগুলোর রচয়িতা ই.এম.ফস্টার যাঁর উদ্দেশ্য ছিল নাৎসিদের ব্যঙ্গ করা। যাঁরা Irony বুঝতে পারেন না, তাঁদের আলোকিত করা কোন ব্যবস্থায় সম্ভব? সাংসদরা হয়তো না জেনেই সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু জানার পরও সম্পাদকীয় লেখার কারণ।……..আরও পরিহাসের বিষয়,প্রশ্নটা যিনি করেছিলেন, তিনি করেছিলেন গুজরাটের দাঙ্গার বছর খানেক আগে এবং তিনি একজন মুসলমান শিক্ষয়িত্রী।”

সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের মিথ্যাচারও ধরা পড়েছে গুজরাটের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। ১৮ই এপ্রিল, ২০০২-এ যে পরীক্ষা নেওয়া হলো, আইনশৃঙ্খলার কথা ভেবেই সেই পরীক্ষাকেন্দ্রগুলির কিছু কিছু শান্তিপূর্ণ এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হয়।

শ্রীযুক্ত নিত্যপ্রিয় ঘোষ লিখেছেন :-“পরীক্ষাকেন্দ্রের স্থানান্তরের বিরুদ্ধে সভা করে অ্যাফেক্টেড সিটিজেন্স অফ আহমেদাবাদের নেতারা পরীক্ষা বয়কটের ডাক দিলেন। পরের দিন বোর্ড জানাল প্রথম দিন ৯২-৯৫শতাংশ পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু বহু কাগজে লেখা হলো ৯০শতাংশ মুসলমান ছাত্ররা বয়কট করেছে। ……… ঐ অ্যাফেক্টেড সিটিজেন্স অফ আহমেদাবাদের মুখপাত্র বলেছেন, আহমেদাবাদের আটহাজার মুসলমান ছাত্রছাত্রীর ৩,৬০০ অনুপস্থিত। অর্থাৎ অনুপস্থিতির সংখ্যা ৪৫শতাংশ।”

স্বভাবতই দায়িত্বজ্ঞানহীন ঐ সব সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সংখ্যালঘু দরদী সাজবার জন্য একের পর এক মিথ্যা সংবাদ দিয়ে যান, সম্পাদকীয় লেখেন এদের নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই।

সংবাদপত্রে কিভাবে মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বাস নষ্ট করা হয় তার দৃষ্টান্ত সর্বত্র রয়েছে। বহুপূর্বে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নিয়ে মিথ্যাচারের এক উদাহরণ রয়েছে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘যাত্ৰী’ গ্রন্থে

“ত্রিশ-চল্লিশজন মুসলমান হিন্দুদের তাড়া খেয়ে পাঁচিল টপ্‌কে লাফিয়ে পড়েছে আমাদের ভিতর বাড়ির বাগানে। দারোয়ানরা লাঠি হাতে দৌড়লো তাদের মারবার জন্যে। দারওয়ানদের ধমকে সরিয়ে দিয়ে আমি তাদের সকলকে ডেকে নিয়ে বসালুম আমাদের একতলার বারাণ্ডায়। বাগানের পাঁচিলের ওদিকে তখন ভীষণ হল্লা শুরু হয়েছে। গিয়ে দেখি প্রায় দু’ তিনশো লোক জড়ো হয়েছে। আমাকে দেখে চিৎকার শুরু হোলো মুসলমানদের বের করে দাও নইলে আমরা জোর করে বাড়িতে ঢুকব। হাতের বন্দুকটা দেখিয়ে তাদের বুঝিয়ে দিলুম যে পাঁচিল টপকে ঢুকলে তাদের কি অবস্থা হবে। কিছুক্ষণ হট্টগোল করে তারা সব চলে গেল। আঞ্জুমানকে টেলিফোন করে গাড়ি আানিয়ে তাদের পাঠিয়ে দিলুম। তার দুদিন বাদে ‘হানিফী’তে বের হোলো যে ঠাকুরবাড়ির সৌম্যেন্দ্রনাথ অনেক মুসলমানকে বাড়িতে আটক করে ফেলেছিল, নেহাৎ খোদাতাল্লার কৃপা ছিল বলে এই মুসলমানেরা অনেক কৌশল করে তার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে। ‘হানিফী’র সম্পাদক আমাদের শ্রমিক-কৃষক দলের আফিসে মাঝে মাঝে আসতেন। পরে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলুম তাঁকে যে আমার সম্বন্ধে যা লিখেছেন তাঁর কাগজে সেই খবরটি কোথা থেকে জোগাড় হোলো! তিনি হেসে বললেন আঞ্জুমান খবর দিল আপনি অনেক ক’টি মুসলমানকে বাঁচিয়েছেন। অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গে বলেও দিল যে খবরটিকে বিকৃত করে কাগজে বের করতে, তাই করেছি ব্যবসার খাতিরে।”

মহাশ্বেতা দেবী, অরুন্ধতী রায় থেকে আরম্ভ করে সকলেই গুজরাট দাঙ্গায় পুলিশের নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ করেছেন। যে কোন দাঙ্গাতেই এই অভিযোগ ওঠে। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদগুলি যাচাই না করেই সিদ্ধান্ত দেবেন!

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এদেশের বাবু সম্প্রদায়কে ব্যঙ্গ করে যথার্থই লিখেছিলেন যে এদের :-“বেদ, দেশী সম্বাদপত্র”।

এখনও তার কোন পরিবর্তন হয়নি। যে দাঙ্গায় মোট মৃত্যুর সংখ্য প্রায় ৭০০, সেখানে পুলিশের গুলিতেই মৃতের সংখ্যা ১৭০ এবং এরা অধিকাংশই দাঙ্গায় যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ। গুজরাট দাঙ্গায় স্বাভাবিক কারণেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বেশী নিহত হয়েছেন কিন্তু হিন্দুরাও নিহত হয়েছেন অনেকে এবং বালবাহুল্য মুসলমান দাঙ্গাকারীদের আক্রমণে। দাঙ্গা একতরফা হয়নি।

নিত্যপ্রিয় ঘোষ এবিষয়ে লিখেছেন :-“খবরের কাগজ পড়ে সেখানে যে হিন্দুরাও আছে দাঙ্গায় আক্রান্ত হয়ে, সেটা বোঝা দুস্কর। মুসলমান শিবিরের আশ্রয়প্রার্থীদের অভিযোগ হিন্দুরা পাচ্ছে পনেরো হাজার টাকা আর মুসলমানরা পাচ্ছে এক থেকে দুইহাজার। একহাজার বা পনেরো হাজার কোনওটাই যথেষ্ট নয়। তবে এই কথাতেই বোঝা যায়, দাঙ্গা কবলিত হয়েছে দুই সম্প্রদায়ই।”

এখানে বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক সালাম আজাদের একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

সালাম আজাদ লিখেছেন :-“বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত একটিও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। ………….. দাঙ্গা হয় দুই পক্ষে। কিন্তু এখানে একপক্ষনীরব থেকেছে। মার খেয়েছে, পালিয়ে বেড়িয়েছে, অপর পক্ষ মেরেছে। ………বাংলাদেশে এই সাম্প্রদায়িক নির্যাতন প্রতিদিন ঘটছে।”

ভারতবর্ষে যেখানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশী, সেখানে দাঙ্গা হয়। যেমন বিহারে, গুজরাটে। মুসলমানপ্রধান স্থানে দাঙ্গা হয় না, নির্যাতন চলে, হত্যা চলে। কাশ্মীর তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

গুজরাট থেকে এক কুতুবুদ্দিন আনসারী অন্যত্র গিয়েছেন;কাশ্মীরের লক্ষাধিক মানুষ দিল্লীর সন্নিহিত অঞ্চলে উদ্বাস্তুর জীবন অতিবাহিত করছেন স্বাধীন ভারতে। কুতুবুদ্দিনের দুঃখে কাতর বুদ্ধিজীবীরা কেউই কোনদিন কাশ্মীরীদের জন্য সামান্যতম সমবেদনাও জানাননি।

কাজেই এইসব বুদ্ধিজীবীদের, রাখি বাঁধতে তৎপর নায়িকাদের দরদ যে সকল মানুষের জন্য নয়, মুসলমানদের জন্য এবং তা প্রগতিশীলতা জাহির করে সরকারী কৃপা লাভ নিশ্চিত করার জন্যই, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে কি?

ইদানিং অবশ্য কিছু সাংবাদিক এবং লেখক হর্ষ দত্ত’র মতো কেউ কেউ ভণ্ডামীকে চিহ্নিত করবার জন্য কলম ধরেছেন। (‘দেশ’-২রা সেপ্টেম্বর, ২০০৩)

গুজরাট দাঙ্গা বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করবার জন্য মহাশ্বেতা দেবী, অভিনেতা দিলীপ রায়, আজকাল পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত প্রমুখ ঐ প্রদেশ থেকে ঘুরে এসে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন লিখেছেন। দিলীপ রায় ‘আজকাল’ পত্রিকায় গত 23.5.200২ তারিখে ‘জবাব কি হবে মহাত্মাজী’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লেখেন। এই লেখায় আহমেদাবাদ থেকে বরোদা যাত্রাপথের একটি বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যে গাড়িতে করে লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা যচ্ছিলেন তার চালক ছিলেন জনৈক হিন্দু। পথে একস্থানে ধূমপানের প্রয়োজনে দেশলাই কিনবার জন্য গাড়ি থামাতে বললে চালক সেই স্থানে গাড়ি থামাতে অস্বীকার করেন কারণ চালক দলপতের ভাষায়, “উন সবকো মহল্লা হ্যায় ইয়ে” অর্থাৎ মুসলমানদের এলাকা।

শেষপর্যন্ত অবশ্য লেখক ও তাঁর সঙ্গীদের কথায় গাড়ি থামাতে বাধ্য হন দলপত। দিলীপবাবু লিখেছেন :-“……..বেচারি দলপতের হাড়ে কাঁপুনি ধরে যাওয়ার অবস্থা।”

গাড়ি ঐ স্থান থেকে রওনা হবার পর দিলীপবাবুর ভাষায় :-“………..দলপত যেন যমের দুয়ার থেকে ফেরে।”

মনে প্রশ্ন জাগছে না কি যে প্রায় সব তথাকথিত নিরপেক্ষ লেখকেরা যখন গুজরাটের দাঙ্গাকে ‘দাঙ্গা’ না বলে ‘হিন্দুদের দ্বারা সংঘটিত মুসলমান হত্যা বলে চালাতে চাইছেন তখন মুসলমান মহল্লায় হিন্দু ‘দলপতের হাড়ে কাঁপুনি’ ধরে কেন?

উপরোক্ত প্রতিনিধি দলের অপর সদস্য অশোক দাশগুপ্ত ‘গুজরাট-যতটুকু বুঝেছি’ শীর্ষক একটি রচনা লিখেছেন ‘অনীক’ পত্রিকায়।

দিলীপ রায় বর্ণিত ঘটনাটি অশোকবাবুর লেখাতেও স্থান পেয়েছে। অশোকবাবু লিখছেন :-“দেশলাই কেনার ছুতোয় নামলাম, ……… দেশলাইয়ের দাম নিতেও হাত কাঁপছে দোকানির। গাড়ির চালক দলপত সিং বললেন, এরকম গাড়ি তো এখানে গত কয়েকদিনে অনেকবার থেমেছে এবং গাড়ি থেকে নেমেছে গুণ্ডারা আগুন, হত্যা। তাই চোখেমুখে আতঙ্ক।”

বলাবাহুল্য,অশোবাবুর বর্ণিত দোকানি এবং আতঙ্কিত মানুষ মুসলমান মহল্লায় বসবাসকারী মুসলমান জনসাধারণ।

দুজন লেখকের রচনার কোনটি অবস্থার সঠিক চিত্র?

দিলীপ রায়ের বর্ণনায় গাড়ির চালক হিন্দু দলপতের কাঁপুনি, না অশোক দাশগুপ্তের লেখায় যেমন বলা হয়েছে মুসলমান দোকানির কাঁপুনি?

দুজনের মধ্যে একজন নিশ্চিতভাবে যথার্থ ছবি তুলে ধরেননি। মুসলমান মহল্লা এবং মুসলমান দোকানি দোকান খোলা রাখতে সাহস করেছেন, কাজেই দিলীপবাবুর বর্ণনাই সত্য বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। অশোকবাবুর বর্ণনায় সত্যের প্রতিফলন ঘটেনি এবং দিলীপবাবুর বর্ণনাতেই প্রমাণ হচ্ছে যেখানে যে সম্প্রদায় শক্তিশালী সেখানে সেই সম্প্রদায়ের মানুষকে ভয় পাচ্ছেন সেই নির্দিষ্ট স্থানের সংখ্যালঘু মানুষ–এমনকি হিন্দু হলেও।

রফিক য্যাক্যরিয়্যা নিঃসন্দেহে একজন ভারতীয় মুসলমান। ভারতবর্ষকে নিজের দেশ বলে মেনে নেবার ক্ষেত্রে তাঁর ধর্মবিশ্বাস কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু ‘Hindustan Times’ পত্রিকায় ২০০২-এর ২৭শে মার্চ তারিখে তিনি কিভাবে লিখলেন :-“আনুমানিক চল্লিশটি শহর এবং দু’শ গ্রাম থেকে মুসলমানদের সাফাই করা হয়েছে।”

যাকারিয়্যা সাহেব সম্প্রতি পরলোকগমন করেছেন। যতদূর জানি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি অন্তত একটি শহর অথবা গ্রামের নাম করতে পারেননি যেখান থেকে মুসলমানদের সাফাই করা হয়েছে।

শর্মিলা বসু ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় গত ১৮.৩.২০০২ এ লিখেছেন “হিন্দুত্বের নামে সংগঠিত হত্যা’। একস্থানে শর্মিলা লিখেছেন :-“হিন্দুধর্মের নামে অসংখ্য মুসলমান নারীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে পৈশাচিকভাবে। তবে মানবাধিকার কর্মীরা ধর্ষিতাদের পক্ষে জবানবন্দী নিতে পারছেন না, কারণ ধর্ষণের পরে তাদের জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব অধিকাংশ মৃত।”

তবু রক্ষা, শর্মিলা লেখেননি সবাই মৃত, লিখেছেন ‘অধিকাংশ মৃত।’

তাহলে শর্মিলা দেবীর কাছে এবং শর্মিলা দেবীর মতো গল্প লেখক হর্ষ মানদার-এর কাছে কেন জানতে চাওয়া হবে না অন্তত সামান্য কিছু অত্যাচারিতা মহিলাদের সাকিন-ঠিকানা,?

একটি নাম অবশ্য সংবাদপত্রে উঠে এসেছে বিলকিস বেগম। তার প্রসঙ্গ পরে আলোচিত হবে।

সমস্ত দাঙ্গায় মহিলাদের প্রতি অত্যাচারের কিছু ঘটনা ঘটে। কিন্তু কিভাবে বিশ্বাস করব হর্ষ মানদার-এর সেই বর্ণনা যেখানে অত্যাচারের ঘটনাকে আতঙ্ককর চলচ্চিত্র (Horror Film)-এর কায়দায় তুলে ধরে লেখা হয়েছে:-“গর্ভবতী জননীর পেট চিরে বার করে এনেছিল গর্ভস্থ সন্তান। পরিপূর্ণ অবয়বের মানব শিশুকে। …………..সেই ভূলুণ্ঠিতা জননীর ভাগ্য অবশ্যই সুপ্রসন্ন ছিল কেননা চোখ বোজার পরেই ধারালো ত্রিশূলে বিদ্ধ হয়েছিল সেই শিশুর কচি হৃদপিণ্ড। তাতেও শান্তি নেই, তলোয়ারের এক কোপে সেই শিশুকে দ্বিখণ্ডিত করতে ভোলেনি সশস্ত্র যুববাহিনী।”

কে সেই প্রত্যক্ষদর্শী? কে সেই ছবির মতো বর্ণনা ধরে রেখেছেন তার ক্যামেরায়? হর্ষ মানদারের মনের ক্যামেরা কি না, সেই কূট প্রশ্নে না গিয়ে আবারও ফিরে যাওয়া যাক হর্ষ মানদার-এর বর্ণনায়। তিনি লিখছেন :-“দলবদ্ধভাবে এসে দাঁড়িয়েছে ক্লীবত্ব আর অপরিমেয় বিকৃতির সমস্ত জানোয়ারেরা। নিজেরাই উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই জীবস্মৃত মেয়েদের সামনে। তারপর মাতৃসমাকে ধর্ষণ করতে নির্দেশ দিয়েছে পুত্রের বয়েসী ত্রিশূলধারীকে, বাপের বয়েসী সংঘী কুকুরের মতো রমন করেছে কন্যাসমা কিশোরীকে। মধ্যবয়সিনীকে কিশোর, ফুটফুটে বালিকাকে প্রৌঢ় –পর্যায়ক্রমে চলেছে অবর্ণনীয় যৌন সন্ত্রাস।”

না, হর্ষ মানদার তার ইমানদারী প্রমাণ করবার জন্য ধর্ষিতা ও অত্যাচারিতারা কোন শহরের, কোন গ্রামের, সে তথ্য দেবার কথা ভাবলেন না। কিন্তু বর্ণনা দিতে গিয়ে যেভাবে হিসেব কষে প্রৌঢ়কে কন্যাসমা বালিকার ধর্ষণকারী, বালককে মাতৃসমা মধ্যবয়সিনীর ধর্ষক হিসেবে সাজিয়েছেন তাতে মনে হয় এ বর্ণনা হর্ষ মানদার-এর মনের কোণে লুকিয়ে থাকা কোন মনস্তাত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারই বহিঃপ্রকাশ।

তাছাড়াও হর্ষ মানদারের লেখায় রয়েছে অনেকগুলি শূন্যস্থান। মহিলারা সবাই কিভাবে একই স্থানে জমায়েত হলেন, পুরুষরা সবাই মহিলাদের ফেলে রেখে কোথায় নিরুদ্দেশ হলেন, হর্ষ মানদার তার লেখার দ্বিতীয় পর্বে তা পূরণ করলেন না।

দু-চারজন অত্যাচারিতার নাম-ঠিকানা চাওয়ায় বলা হয়েছে সাক্ষীদের নাম প্রকাশ করলে হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডারা তাদের গুজরাটে থাকতে দিত না; তাদের জীবন বিপন্ন হতো।

উত্তরে একথা কেন বলা যাবেনা যে, কুতুবুদ্দিন আনসারী—যিনি শুধুমাত্র করজোরে প্রাণভিক্ষা করে ভারত বিখ্যাত হয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় আশ্রয় পেয়েছেন, ধর্ষকদের নাম-ধাম বলে তার চাইতে অনেক মহৎ কাজ করে আরও কিছু মুসলনমান প্রয়োজনে পশ্চিমবঙ্গ অথবা ত্রিপুরার মতো নিরাপদ স্থানে আশ্রয় পেতে পারতেন না কি?

বিলকিস বানু সাক্ষী দিয়েছেন। আদালতে মামলা চলছে। বিচারে নিশ্চিতভাবে দুস্কৃতিদের শাস্তি হবে। বিলকিসের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বারোজনকে। অন্তঃসত্তা ছিলেন একথা জানিয়ে ধর্ষণকারীদের কাছে আবেদন করায় নিজে রক্ষা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিলকিস।

বিলকিসের এই বক্তব্যই কি সমস্ত গুলিয়ে দিচ্ছে না? ধর্ষণকারীরা যখন এতই বিবেচক ছিলেন তখন বিলকিসের পদ্ধতি গ্রহণ করে ধর্ষিতারা সকলেই রেহাই পাবার চেষ্টা করলেন না কেন?

বিলকিসের বক্তব্য কুতুবুদ্দিন আনসারীর কথাও মনে পড়িয়ে দিচ্ছে।

গুজরাট দাঙ্গার সময় কুতুবুদ্দিন আনসারী করজোড়ে দাঙ্গাকারীদের কাছে প্রাণভিক্ষা করেছিলেন। তার সেই বিশেষ মুহূর্তের ছবি দেশ-বিদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। ইদানিং সে ছবি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের প্রচারের অবশ্য সামগ্রি হয়ে উঠেছে।

শুধুমাত্র হাতজোড় করে যদি দাঙ্গাকারীদের কাছে প্রাণভিক্ষা পাওয়া যায় তাহলে যাদের কাছে এই প্রাণভিক্ষার প্রার্থনা তারা সত্যিই দাঙ্গাকারী কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ দেখা দেওয়াটি কি একেবারেই অযৌক্তিক?

কুতুবুদ্দিনের নিষ্কৃতি কি প্রমাণ করে না যে দাঙ্গাকারীরা পেশাদার খুনী নয়, কোন সুতীব্র ক্ষোভের কারণে দাঙ্গায় যুক্ত হয়ে পড়লেও করজোড়ে প্রাণভিক্ষার প্রার্থনায় সাড়া না দেবার মতো হিংস্রতা তাদের স্পর্শ করেনি। সেক্ষেত্রে করজোড়ে প্রার্থনা করায় যারা কুতুবুদ্দিনের প্রাণভিক্ষা দিলেন, শুধুমাত্র সংবাদপত্রে ছবি প্রকাশিত হয়েছে বলে তারা কুতুবুদ্দিনকে ভয় দেখাচ্ছিল এবং সেই কারণেই কুতুবুদ্দিনকে গুজরাট ছাড়তে হলো—এসমস্তই নানা সন্দেহ জাগিয়ে তোলে।

কুতুবুদ্দিনের ছবির সাংস্থানিক বিন্যাস কিংবা ইংরেজীতে যাকে Visuali-sation বলা হয়, তা বিশ্লেষণ করলেও কেমন যেন সন্দেহ জেগে ওঠে।

ছবিটি যেভাবে সামনাসামনি তোলা হয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে কুতুবুদ্দিনের বর্ণিত দাঙ্গাকারীরা যেন তার ছবি তুলতে দেবার জন্যই স্বেচ্ছায় দু-পাশে সরে দাঁড়িয়েছে এবং সেই কারণেই সামান্যতম বাধাও (obstruction) নেই ক্যামেরাম্যানের।

সব মিলিয়ে কুতুবুদ্দিনের ছবিও তাই যেন ‘মোনালিসা’র হাসির মতই রহস্যময়।

গুজরাটের দাঙ্গা নিয়ে যে সমস্ত প্রচার ও গল্প সেগুলির সংযোজনে আর এক ‘আবোল তাবোল’ তৈরী হওয়া সম্ভব।

মহাশ্বেতা দেবীও গুজরাট নিয়ে বিস্তর লিখেছেন। নানা শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে লেখা সেই সব নিবন্ধ। মহাশ্বেতা দেবী নিজেই বলেছেন :-“আমি দেখেছি যত, শুনেছি তার চেয়ে বেশী।” কাজেই মহাশ্বেতা দেবী যা নিজে দেখেননি তার উপর ভিত্তি করেই লিখেছেন :-“গোটা গুজরাট যেন একটা বাড়ি। তার প্রতি দরজা-জানালা বন্ধ। ভিতরে চলেছে একতরফা নৃশংস হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি।”

বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ হলে মহাশ্বেতা দেবী সব দেখলেন কি করে?

থুড়ি, মহাশ্বেতা দেবী তো বলেইছেন, উনি দেখেছেন যত শুনেছেন তার বেশী!

মহাশ্বেতা দেবীর মনে হয়েছে অনশন আর পিকেটিং গুজরাটে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধের পথ। তিনি লিখেছেন :-”আমি ডায়াবিটিসের কারণে পারি না, পারলে আমেদাবাদের রাস্তায় আমৃত্যু অনশন করতাম।”

হাসব, না কাঁদব?

আমৃত্যু অনশন করবার কথা যিনি ভাবছেন তাঁর ডায়াবিটিসের ভয়!

বিশিষ্ট গবেষক রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায় এবিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সঙ্গত কারণেই জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে উদ্যত জনৈক ভদ্রলোকের গল্পের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন।

গল্পটি এই রকম :-

“এক ভদ্রলোক জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন অন্ধকার রাস্তা ধরে টর্চ জ্বেলে। রাস্তায় এক পরিচিত জনের সঙ্গে দেখা হলে পরিচিত ব্যক্তিটি জানতে চাইলেন-মশাই হন্ হন্ করে চলেছেন কোথায়?

আত্মহত্যা করতে উদ্যত ভদ্রলোকের জবাব—নদীতে, এ জীবন রেখে আর লাভ নেই। জলে ডুবে আত্মহত্যা করবো।

— তা হাতে টর্চ কেন?

— রাস্তায় বড় সাপের উপদ্রব।”

এবিষয়ে আর কথা না বাড়িয়েও সহজেই বলা চলে যে এদেশের তথাকথিত মুসলমান দরদী বুদ্ধিজীবীরা যে মানসিক ডায়াবিটিস-এ আক্রান্ত শিক্ষিত মুসলমানরাও তা ধরতে পারছেন না।

শিবসেনার নেতা বাল ঠাকরের যতই দোষ থাকুক না কেন সম্ভবত তিনিই বুঝেছিলেন যে মুসলমানদের ভোটাধিকার না থাকলে মুসলমান দরদ বলে কিছুই থাকবে না এদেশে।

ভাবুন দেখি অম্লান দত্তের মতো মুক্তমনা স্পষ্টবাদী মানুষ প্রবন্ধ লিখে (আনন্দবাজার) প্রশ্ন তুলছেন যে মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনে হিন্দুদের মাথাব্যথার কারণ কি? অম্লান দত্তের মতে এতে তো মুসলমানদেরই ক্ষতি হচ্ছে।

অধ্যায় ১ / ৫

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন