পার্থিব সকল পদার্থই পরিবর্ত্তনশীল। আমরা যে দিকে জ্ঞাননেত্রোন্মীলন করিয়া দেখি, সেই দিকেই দেখিতে পাই যে, কোন বস্তু নূতন উৎপন্ন হইতেছে, কোন বস্তু বা ধ্বংস হইয়া ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুতে লীন হইতেছে। অদ্য যে বস্তু একরূপ দেখা যায়, কল্য তাহার ভিন্ন ভাব দৃষ্ট হয়; বৰ্ত্তমান নিমেষ মধ্যে আমরা যাহা দেখি, আবার তৎপরক্ষণেই তাহার আর একটী ভিন্ন ভাব লক্ষিত হয়; অদ্য ঘোর ঘনাবৃত হইয়া গগনমণ্ডল হইতে অনবরত বারিধারা বর্ষিত হইতেছে, কল্য ঠিক বিপরীত ভাব; অদ্য খণ্ডপ্রলয়ের উৎপাতে অধিষ্ঠানভূত ধরণীমণ্ডল কম্পমান হইতেছে, জীবগণ ওষ্ঠাগত-প্রাণ হইয়া নিজ নিজ রক্ষা হেতু উপায় চিন্তা করিতেছে, কল্য আবার সমুদায়ই স্থিরভাব, প্রাণিগণ নির্ভয়-চিত্তে মহোল্লাসে বিচরণ করিতেছে। এ সমস্ত বস্তুর কথা দূরে থাকুক, অতি দৃঢ়তর পর্ব্বত সমূহ যাহা কখন ভিন্ন ভাব ধারণ করিবে এরূপ ভাব আমাদিগের অন্তরাকাশে উদিত হয় নাই, তাহাও কালক্রমে অনন্তনিয়মাধীন হইয়া ভগ্নচূড় হইতেছে। এমন কি, কোনটীর বা একেবারে চিহ্ণ পৰ্য্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া দীর্ঘ দীর্ঘ হ্রদরূপে পরিবর্ত্তিত হইতেছে; সুবিস্তৃত দ্বীপ সমূহ যাহা অসংখ্য অসংখ্য জীবের অধিষ্ঠান ভূমি-সমূহ হইতে শত শত হস্ত উচ্চ, সেই দ্বীপপুঞ্জও সাগরে নিমগ্ন হইয়া, জলাকীর্ণ স্থানে পরিণত হইতেছে; কোথাও বা সাগর-গর্ভ হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্ব্বত বাহির হইয়া একটী জনাকীর্ণ দ্বীপ সমুৎপন্ন হইতেছে। পৃথিবীমণ্ডলে এমন কোন বস্তুই দৃষ্ট হয় না, যাহা পরিবর্ত্তনের অধীন নহে। সুতরাং মনুষ্যের আন্তরিক ভাবও যে এই নিয়মের অনুবর্ত্তী, তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যে হেতু আমরা সাধারণত দেখিতে পাই যে, শৈশবাবস্থায় মনুষ্যের একরূপ আন্তরিক ভাব থাকে, যৌবন কাল উপস্থিত হইলে তাহা পরিবর্ত্তিত হয়, আবার যৌবন কাল উত্তীর্ণ হইয়া গেলে, প্রৌঢ়ে পদার্পণ সময়ে মনোবৃত্তি সকল অন্যভাব ধারণ করে, এবং বৃদ্ধাবস্থায়ও সেইরূপ পরিবর্ত্তনের নিয়ম আছে। মনুষ্যের মনোবৃত্তি সকল পরিবর্ত্তনের সহিত অবস্থা, রীতি, নীতি, আচার, ব্যবহার সমুদায় পরিবর্ত্তিত হইতে থাকে। প্রাচীন কালের ইতিবৃত্তগ্রন্থ সকল পর্য্যালোচনা দ্বারা জ্ঞাত হওয়া যায় যে, যখন একটী জাতির রীতি নীত্যাদি সংস্কৃত হইতে আরম্ভ হয়, তখন তাহার সঙ্গে সঙ্গে ভাষাও পরিবর্ত্তিত ও পরিমার্জ্জিত হইতে থাকে, ইহার উদাহরণ স্বরূপ ইংরাজজাতি ও তাঁহাদিগের ভাষার প্রতি মনোনিবেশ করিলে অনায়াসেই উপলব্ধি হইতে পারিবে। এতদ্দ্বারা স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, আমাদিগের ভাষা অন্য কোন একটী প্রাচীন ভাষার অপভ্রংশেই উৎপন্ন হইয়াছে। অস্মদ্দেশীয় ইতিবৃত্তগ্রন্থ অতি দুষ্প্রাপ্য। কেবল মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত ভিন্ন আর যাহা কিছু ছিল, অধিকাংশই উপর্য্যুপরি রাষ্ট্রবিপ্লবে বিধ্বংস হইয়া গিয়াছে। এতদ্ভিন্ন আর যে সমস্ত ইতিহাস সম্বন্ধীয় পুস্তক দৃষ্ট হয়, তাহার অধিকাংশই অসম্পূর্ণ অথবা আশ্চৰ্য্য উপাখ্যান সমূহে পরিপূরিত, বিশ্বাসযোগ্য সার বিষয় অতি অল্পই আছে। কিন্তু যাহা হউক, পূর্ব্বোক্ত বিশ্বাস্য প্রাচীন গ্রন্থদ্বয়ে ভাষা সম্বন্ধে কোন প্রসঙ্গই দৃষ্ট হয় না। এই নিমিত্ত কোন্ সময়ে এই ভাষার উৎপত্তি হইয়াছে, তাহার সুনিশ্চয়রূপে স্থির করা যায় না। কিন্তু আমরা বিবেচনা দ্বারা স্পষ্টাক্ষরে বলিতে পারি যে, এই ভাষা-রত্ন, সংস্কৃত-ভাষা-রত্নাকর হইতেই উত্তোলিত হইয়াছে। বোধ হয়, সংস্কৃত ভাষাজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রেই এ বিষয়ে দ্বিরুক্তি করিবেন না। অতএব এই খনি অন্বেষণ করিলে অবশ্যই ইতিলব্ধ রত্ন সমূহের উৎপত্তি বিবরণ কিছু না কিছু অবগতি হইতে পারিবেই পারিবে। অতএব তদন্বেষণে প্রবৃত্ত হওয়া গেল।
ইউরোপীয় ভাষাবিৎ পণ্ডিতেরা লিখিয়াছেন যে, অতি পূর্ব্বকালে পুরাতন গোলকার্দ্ধে কেবল তিনটী প্রাচীন ভাষা মাত্র প্রচলিত ছিল। তন্মধ্যে এসিয়া খণ্ডের অন্তঃপাতি ইরান্ প্রদেশীয় একটী ভাষা হইতে লাটিন, জর্ম্মন্, গ্রীক, নর্স, প্রভৃতি ভাষার উৎপত্তি হয়; এসিয়া খণ্ডের জেন্দ ভাষা হইতে উর্দ্দূ ইত্যাদি এবং সংস্কৃতের অপভ্রংশে ভারতবর্ষীয় বর্ত্তমান প্রচলিত ভাষার প্রায় অধিকাংশই উৎপত্তি হইয়াছে। তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এস্থলে প্রকটিত হইল। যথা,—বৰ্ত্তমান যে কোন ভাষা যতই সম্পূর্ণাবস্থা প্রাপ্ত হউক না কেন, প্রথমতঃ একেবারে কখনই সেরূপ হইতে পারে না, অপরিণতাবস্থা হইতেই ক্রমে পরিবর্ত্তিত হইয়া একটী উৎকৃষ্ট ভাষা মধ্যে পরিগণিত হয়। সংস্কৃত যে এত উৎকৃষ্ট ও সুললিত ভাষা, তাহাও বহুবার পরিবর্ত্তিত না হইয়া কখন এরূপ পূর্ণাবস্থা ধারণে সমর্থ হয় নাই। কারণ সংস্কৃতভাষাবিৎ পণ্ডিত মহাশয়েরা বিশেষ সমালোচনা দ্বারা অবগত হইয়াছেন যে, ঋগ্বেদ সংহিতার ভাষাই অতীব প্রাচীন। কিন্তু তাহার সহিত মনুসংহিতা ও বাল্মীকি রামায়ণের ভাষার তুলনা করিয়া দেখিলে অনেক পরিবর্ত্তন দৃষ্ট হয়। পরন্তু আবার ঐ সংহিতার ও রামায়ণের ভাষার সহিত মহাভারতের অনেক বৈলক্ষণ্য প্রতীতি হইয়া থাকে। মহাভারত রচনার কয়েক শত বৎসর পরে, ভারতকবি কুলশেখর কালিদাস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার দ্বারা ভাষার অনেক পরিবর্ত্তন হইয়াছে। বোধ হয় কালিদাসের সংস্কৃত, তান্ত্রিক সংস্কৃতে পরিণত হইয়া থাকিবে। এস্থলে অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, এরূপ পরিবর্ত্তনের কারণ কি? কিন্তু স্থিরচিত্তে বিভাবনা করিয়া দেখিলে স্পষ্টই জ্ঞাত হইতে পারা যায় যে, উচ্চারণসৌকর্য্য ও অধিক ভাব অল্প সময় মধ্যে প্রকাশার্থই ভাষা এইরূপ সংস্কৃত হইয়া থাকে। বৈদিক-সংস্কৃত অতীব দুরূহ ও দুরুচ্চাৰ্য্য, সংস্কৃত ভাষা-বিশারদ পণ্ডিত মহাশয়েরাও সময়ে সময়ে উক্ত গ্রন্থরচিত শব্দাবলী উচ্চারণ করিতে সঙ্কুচিত হন। বোধ হয়, তজ্জন্যই মনুসংহিতা, রামায়ণ, মহাভারত ও কালিদাসের সংস্কৃত অপেক্ষাকৃত সরল ও ঐ সকল রচনায় অধিক বিকর্ষণ কাৰ্য্য ব্যবহৃত হইয়াছে। খৃষ্টীয় শতাব্দীর ৫ শত বৎসর পূর্ব্বে বুদ্ধদেবের সমকালে সংস্কৃত ভাষার অপভ্রংশে “গাথা” নাম্নী একটী পৃথক ভাষা সমুৎপন্ন হইয়াছিল। সংস্কৃতজ্ঞ মহোদয়গণ বলেন যে, গাথা প্রাচীন সংস্কৃতের সহিত প্রায় সৰ্ব্বাংশেই সমান, কেবল বিকর্ষণ কার্য্যের নিমিত্ত বিভক্ত্যাদির কিছু বৈলক্ষণ্য দৃষ্ট হয়। এই অপভ্রংশিত ভাষা সমুৎপন্নের প্রায় ২৫০ বৎসর পরে অশোক রাজার আধিপত্য সময়ে উহাই পরিবর্ত্তিত হইয়া “পালী” আখ্যায়িকা ধারণ করে। এই ভাষা এ পর্য্যন্ত সিংহল দ্বীপে প্রচলিত আছে। অশোক রাজার প্রায় এক শত বৎসর পরে প্রাকৃত ভাষা সমুৎপন্ন হইয়াছে। তৎপূর্ব্বে যে প্রাকৃত ভাষার সৃষ্টি হয় নাই, তদ্বিষয়ে অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়, অনাবশ্যক বোধে এস্থলে লিখিত হইল না। প্রবল প্রতাপান্বিত উজ্জয়িনী স্বামী বিক্রমাদিত্যের শাসন কালে সংস্কৃতভাষা অপভ্রংশিত হইয়া প্রাকৃত, মহারাষ্ট্রীয়, মাগধী, শৌরসেনী, পৈশাচী, ও পাশ্চাত্য প্রভৃতি অন্যূন দশ বা দ্বাদশটী ভাষার সৃষ্টি হয়। প্রাচীন আর্য্যগণ সেই সমূহকেই প্রাকৃত নামে আখ্যাত করিয়াছেন। এবং বোধ হয় সেই সমুদায় ভাষার পরিবর্তনেই বাঙ্গালা, তৈলঙ্গী, গুজরাটী, হিন্দী প্রভৃতি ভারতবর্ষের অধুনা প্রচলিত ভাষা সমূহের উৎপত্তি হইয়া থাকিবে। কিন্তু কোন্ প্রাকৃত হইতে কোন্টার সৃষ্টি হইয়াছে, তাহার কোন বিশেষ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। বিশেষত, বঙ্গ ভাষায় লিখিত কোন প্রাচীন রচনা না থাকার এই ভাষার আদিম বিবরণ সংগ্রহ করা অতীব কঠিন। বহু অনুসন্ধান দ্বারা অবগতি হয় চৈতন্য দেবের আবির্ভূত হইবার এক শত বৎসর পূর্ব্বে রাজা শিবসিংহ লক্ষ্মী-নারায়ণের আধিপত্য সময়ে, বঙ্গদেশে বিদ্যাপতি নামক এক ব্যক্তি বঙ্গভাষায় অনেকগুলি পদ রচনা করিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে কয়েকটা এখনও বঙ্গদেশে বর্তমান আছে। সেই সকল পদাবলীর রচনা প্রণালী দৃষ্টে অতি প্রাক্তন বলিয়া অনুমান হয়, এবং তাহাতে হিন্দী শব্দের আধিক্য প্রযুক্ত বোধ হয় যে, পূর্ব্বে অস্মদ্দেশে হিন্দীভাষা প্রচলিত ছিল। এবং এই হিন্দীভাষা যে মগধের অপভ্রংশে উৎপত্তি হইয়াছে, তাহার প্রমাণ চীনদেশীয় ভ্রমণকারী ফাহিয়ানের গ্রন্থে পাওয়া যায়। তিনি লিখিয়াছেন ষোড়শ শত বৎসর পূর্ব্বে এদেশে কেবল সংস্কৃত ও মাগধীভাষা প্রচলিত ছিল। পূৰ্ব্বেই উক্ত হইয়াছে মাগধী সংস্কৃতের অপভ্রংশিত ভাষা। হিন্দী ইহা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে তাহাও প্রতিপন্ন করাগেল। এবং বিদ্যাপতি ও চণ্ডিদাস প্রভৃতি প্রাচীন লেখকদিগের রচনা পাঠে অবগত হওয়া যায় যে হিন্দীরই অপভ্রংশে বাঙ্গালা ভাষার উৎপত্তি হইয়াছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন