দীনেশচন্দ্র সেন
নসর মালুম
নসর মালুমের পালাটি শ্রীযুক্ত আশুতোষ চৌধুরী মহাশয় প্রধানতঃ কাঁঠালভাঙ্গার নূরহোসেন ভাহৈয়ার নিকট হইতে সংগ্রহ করেন। এই নূরহোসেন ও তাহার জ্ঞাতিরা বংশানুক্রমে পালাগান গাহিয়া আসিতেছে। নূরহোসেনের পিতার নাম কোর্ব্বান আলী। ইনিও নসর মালুমের পালা গাহিতেন। কোর্ব্বান আলীর পিতা হায়দর আলীই এই পালা-গায়কদের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। এখনও এই অঞ্চলে পরিণত বয়স্ক অল্পসংখ্যক শ্রোতারা আছেন যাঁহারা হায়দরের করুণরসউদ্দীপনার প্রশংসা করিয়া থাকেন। এই পালা-গানের সময়ে হায়দর সমুদ্রে বাণিজ্য-দস্যুদের আক্রমণ এবং নায়কনায়িকার প্রেমের যেন জীবন্ত ছবি আঁকিয়া যাইত। চাটগাঁয়ের লোকেরা এখনও তাহার গানের কথা ভুলিতে পারে নাই। ইহাদের কৌলিক উপাধি ভাহৈয়া। এই শব্দটা ভাবুক শব্দের অপভ্রংশ বলিয়া মনে হয়। ভাবুক শব্দের লৌকিক অর্থ চিন্তাশীল নয়, যাহারা ভাব (feeling) উদ্রেক করিতে পারে তাহাদেরই লৌকিক কথায় ভাবুক বলে; কিন্তু ভাহৈয়া শব্দ ভ্রাতৃ শব্দেরও অপভ্রংশ হইতে পারে। যে নূরহোসেন গায়েনের নিকট হইতে আশুবাবু পালাটি সংগ্রহ করিয়াছেন সে এই গান গাহিয়া উপজীবিকা অর্জ্জন করে বটে, কিন্তু সমস্ত পালাটি তাহার মুখস্থ নাই। এখন পালা-গানের দিকে লোকের সেরূপ উৎসাহ নাই এবং পালা-গায়কেরাও আর তাদৃশ মনোযোগের সহিত গানগুলি শেখে না। নূরহোসেন ভাহৈয়া যে সকল অংশ ভুলিয়া গিয়াছে তাহা সে নিজে গদ্যভাষায় জোড়াতালি দিয়া বর্ণনা করে। সুতরাং ইহার প্রদত্ত সংগ্রহের উপর আশুবাবু ততটা নির্ভর করিতে পারেন নাই। কাঁঠালভাঙ্গার নিকটবর্ত্তী মহিষমারা গ্রামে গুরুমিঞা নামক জনৈক “হারিগায়েন”এর (সারিগান-গায়ক) নিকট হইতে আশুবাবু আরও কয়েকটি পদ সংগ্রহ করিতে পারিয়াছেন। কিন্তু তখনও পালাটি পূর্ণতা লাভ করে নাই। চট্টগ্রামের সমুদ্রকূলে মাতৃভাষার এই অক্লান্ত সেবক ও পালাগানভক্ত যুবক বহু পর্য্যটন করিয়া কর্ণফুলির মোহানার নিকট রহমন নামক সাম্পানের একজন মাঝির নিকট সম্পূর্ণ পালাটি প্রাপ্ত হন।
পালা-গানটি নানাদিক দিয়াই কৌতুকাবহ এবং চিত্তগ্রাহী। ইহার নায়িকা আমিনা খাতুন পাতিব্রত্যে সীতা-সাবিত্রীর পাশে দাঁড়াইতে পারেন; সীতা অশোক বনে রাবণ কর্ত্তৃক যে ভাবে প্রলুব্ধ হইয়াছিলেন, আমিনা খাতুন এসাকের হস্তে তাহা হইতে কম লাঞ্ছিত হন নাই। তাঁহার পিতামাতা তাঁহার বৈরী হইয়াছিলেন। স্বামী তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। সীতা জানিতেন, রাম তাঁহাকে ভিন্ন কাহাকেও জানেন না, সুতরাং তাঁহার নির্ভর এবং একনিষ্ঠ প্রেম গৌরবান্বিত। কিন্তু বিনা দোষে স্বামি-পরিত্যক্তা আমিনা যে ভাবে একনিষ্ঠ প্রেমের মাহাত্ম্য রক্ষা করিয়াছিলেন, তাহা পাঠক সাশ্রুনেত্রে পড়িবেন। এই নিষ্ঠা, এই চরিত্রগৌরব―এই একব্রত সঙ্কল্প বাঙ্গালী রমণীর। তিনি মুসলমানই হউন, কি হিন্দুই হউন, তাহাতে কিছু আসে যায় না। ইঁহারা সকলেই বঙ্গজননীর স্তন্যপালিতা। নসর মালুম বহুগুণশালী হইয়াও ঈদৃশ রমণীরত্ন লাভের প্রকৃত যোগ্য নহেন। পালা-গানের অধিকাংশ নায়কের মতই এই নায়কটিও মেরুদণ্ডহীন। কিন্তু একদিকে কতকটা ছায়া ঘনীভূত না করিলে নায়িকার চরিত্র হয়ত তাদৃশ গৌরবে উজ্জ্বল হইয়া উঠিত না। আমিনা খাতুন রৌদ্র ও ছায়ার অন্তরালে বিচিত্র চালচিত্রের মধ্যে যেন ভগবতী-প্রতিমার ন্যায় ঝলমল করিতেছেন।
কিন্তু নায়কনায়িকার কথাতো আমরা অনেক পালাগানেই পাইতেছি। আমিনা খাতুন উৎকৃষ্ট আট দশটি নায়িকার মধ্যে না হয় আর একটি হইলেন। এই পালা-গানটির বিশেষ প্রণিধানযোগ্য বিষয় বাঙ্গালার প্রাচীন ঐতিহাসিক কথা। ঘন উত্তাল তরঙ্গসঙ্কুল সমুদ্রের রূপ কবি যেন চক্ষের সম্মুখে আঁকিয়া দেখাইয়াছেন। বাণিজ্য-যাত্রীর নানা বিপদের কথা ইনি বিচিত্র রং ফলাইয়া চিত্রকরের তুলিতে আঁকিয়াছেন। পর্ত্তুগীজ দস্যু হার্ম্মাদের অবিকল প্রতিমূর্ত্তি আমরা এই পালাটিতে পাইতেছি। ইহার কালো পাগড়ী ও রাঙ্গা কোর্ত্তাপরা দুর্ব্বিনহস্তে শ্যেন পক্ষীর ন্যায় বাণিজ্যযাত্রীদের উপর আসিয়া পড়িত। তাহাদের হস্তে বন্দুক ও কোমরে শাণিত ছোরা। যেরূপ নির্দ্দয় ভাবে ইহারা বন্দীদিগের প্রতি ব্যবহার করিত তাহা রোমাঞ্চকর। ১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে নূরজাহানের নিকট আত্মীয় সায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রাম অধিকার করেন। আরাকানের অধিপতি পর্ত্তুগীজদের সহযোগে সায়েস্তা খাঁর গতি প্রতিরোধ করিতে চেষ্টা করেন। আরাকানাধীপের দুই শত বড় ডিঙা এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র নৌকা ছিল। সুপ্রসিদ্ধ পর্য্যটক ট্যাভার্নিয়ার এই ডিঙাগুলির একটি কৌতুকাবহ বর্ণনা দিয়াছেন। “এই ডিঙাগুলি যেরূপ দ্রুতগতিতে সমুদ্রে চলিয়া যায় তাহা অসামান্য। কোন কোন ডিঙা এত দীর্ঘ যে তাহাতে এক এক দিকে পঞ্চাশটি করিয়া দাঁড় থাকে, প্রত্যেকটি দাঁড় দুইটি করিয়া মাঝি টানে। এই ডিঙাগুলি স্বর্ণ, রৌপ্য এবং জহরেতে মণ্ডিত। ইহাদের সুদর্শন নীল ও পীত বর্ণের আকৃতি সমুদ্রের তরঙ্গকে ঝলসিত করিয়া চলিয়া যায়।” সায়েস্তা খাঁ একজন পাকা রাজনৈতিক ওস্তাদ ছিলেন। তিনি কলে-কৌশলে অনেক পর্ত্তুগীজকে হস্তগত করেন এবং মগদিগকে এরূপ সাঙ্ঘাতিক ভাবে পরাস্ত করেন যে তাহারা তীরবেগে চট্টগ্রামের পার্ব্বত্য প্রদেশে পলাইয়া যাইয়া প্রাণরক্ষা করে। তাহারা যে ভাবে ছুটিয়া পলাইয়াছিল তাহা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হইয়াছে। ইতিহাসে তাহা Xerxesএর Retreat of the Ten Thousandএর সঙ্গে তুলনা করা যাইতে পারে। এই পলায়ন-বৃত্তান্তটিকে চট্টগ্রামবাসীরা ‘মগ-ধাওনি’ নামে অভিহিত করিয়াছে। মগেরা পলাইয়া যাইবার সময়ে তাহাদের ধনরত্ন এবং তদপেক্ষা মুল্যবান্ বুদ্ধ-বিগ্রহগুলি দেয়াঙ্গের পাহাড়ের নীচে পুতিয়া রাখিয়া চলিয়া গিয়াছিল। যখন দেশে শান্তি ফিরিয়া আসিল, তখন ইহারা দলে দলে আসিয়া সেই সব মূর্ত্তি ও ধনরত্ন উত্তোলন করিয়া লইয়া গিয়াছিল। যখন তাহারা পলাইয়া ব্রহ্মদেশে যায় তখন তাহারা ওইসব গচ্ছিত সামগ্রীর স্থান নির্দ্দেশ করিয়া মানচিত্র অঙ্কনপূর্ব্বক সঙ্গে লইয়া গিয়াছিল। এখন এই ঘটনার পরে প্রায় দুই শত বৎসর অতীত হইয়াছে। শুনিতে পাই এখনও মাঝে মাঝে মগ পুরোহিতেরা সেই চার্ট (মানচিত্র) সঙ্গে করিয়া লুক্কাইত ধনরত্ন খুঁজিতে আসে। অন্ততঃ সেগুলি যে তাহারা এখনও নিঃশেষ করিয়া লইয়া যাইতে পারে নাই, তাহার প্রমাণ এই যে দেয়াঙ্গের পাহাড়ের নিম্নে মাঝে মাঝে দেব-বিগ্রহ ও অর্থাদি এখনও পাওয়া যায়। এই সকল বিগ্রহের নাক-কাণ ভাঙ্গা নয়। তাহারা সম্পূর্ণ অক্ষত এবং এক স্থানে অনেকগুলি জড়ীভূত। সুতরাং ইহারা যে সে “মগধাওনি”র নিদর্শন তৎসম্বন্ধে সন্দেহ করিবার বিশেষ কারণ নাই। বিগ্রহগুলির মধ্যে অনেকগুলি নবম এবং দশম শতাব্দীর। এই পুস্তকে আমরা “মগ-ধাওনি”র নিদর্শন কতকগুলি বিগ্রহের ছবি দিলাম। বলা বাহুল্য এই পালাগানটিতে ‘মগ-ধাওনি’র উল্লেখ আছে এবং মগেরা শেষ কালে কি ভাবে ধনরত্ন উত্তোলন করিয়া লইয়া যাইত তাহার বর্ণনা আছে। ১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে সায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রাম অধিকার করিয়া ছিলেন। এই সময়ের কিছু পরে এই পালা-গানটি বিরচিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। সুতরাং সম্ভবতঃ ইহা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগের রচনা।
আরাকানের রাজারা পর্ত্তুগীজদের প্রতি অনুগ্রহশীল ছিলেন। তাঁহারা অনেক সময়ে খৃষ্টধর্ম্মের প্রতি অনুগ্রহ দেখাইয়া ভূমি দান করিতেন। চাটগাঁয়ের সেণ্ট সিলাষ্টিকার কনভেণ্ট স্কুল এই প্রকার ভূমির উপরে প্রতিষ্ঠিত। তৎসম্বন্ধে কনভেণ্টের “প্রভিন্সিয়াল” মাদার অ্যাম্ব্রোজি ১৯২৯ সালের ১৬ই আগষ্ট যে চিঠি লিখিয়াছিলেন তাহার প্রতিলিপি আমরা পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকার চতুর্থ খণ্ডের প্রথম সংখ্যার ভূমিকায় দিয়াছি। ১৬৩৮ খৃষ্টাব্দে আরাকান রাজার অধীন মুকুট রায় নামক জনৈক ক্ষুদ্র মগ-রাজা পর্ত্তুগীজদের সঙ্গে একত্র হইয়া জলদস্যুদের প্রভাব বিস্তার করিবার সহায়তা করিয়াছিলেন।
এই পালা-গানটিতে ‘দিয়াঙ্গের পাড়ি’ নামক স্থানের উল্লেখ আছে। উহা আধুনিক সময়ের দেয়াঙ্গের বন্দর। পর্ত্তুগীজেরা এই বন্দরটিকে ডায়াঙ্গ বলিত। পালা-গানটির উল্লিখিত “গোবধ্যার চর” নামক স্থান কর্ণফুলির মোহানার নিকট। ইহা বর্ষাকালে সমুদ্রগর্ভস্থ হয় এবং তারপর জাগিয়া উঠে। এজন্য ইহা বাসযোগ্য নহে। তবে এই চর বহুদিন পর্য্যন্ত পর্ত্তুগীজ এবং মগ জলদস্যুদের আড্ডাস্বরূপ ছিল। ‘পরীদিয়া’ অথবা ‘সাহ পরীদিয়া’ চট্টগ্রামের দক্ষিণে প্রায় দেড়শত মাইল দূরে সমুদ্রের একটি দ্বীপ। ইহা পূর্বের মৎস্য ব্যবসায়ের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। পালা-বর্ণিত ‘অঙ্গী’ নগর ব্রহ্মদেশের কোন নগর বলিয়া মনে হয়।
শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন
.
নছর মালুম
আরম্ভন
পহেলা আল্লার নাম করিয়া স্মরণ।
মাথা নোয়াইয়া বন্দম নবিজির চরণ॥
তালমান নাহি জানি না চিনি আখর।
মুল্লুকে মুল্লুকে ঘুরি নাইরে বাড়ি ঘর॥
ওস্তাদে গাহিত গান আছিলাম দোহারী।
মুখেমুখে শিখিয়াছি পদ দুই চারি॥
ভাগ্যবানের বাড়িৎ গিয়া পালা গান গাহি।
সক্কলর দোয়ার[১] বলে নূনে ভাতে খাই॥
(১)
বর্ষার বিরহ
ধুয়া— ঘরের মধু পরে খার
ওরে লঙ্কাপোড়া বৈদেশে বেড়ার॥
ঝড় পড়েরলে[২] লোছালোছা[৩] উজানি উডের[৪] কই[৫]
ওরে উজানি উডের কই॥
এমন বরিষার কালে থাক্যম কারে লইরে॥
কুহুম কুহুম[৬] শীতরে পড়ের গায়ত দিলাম কেথা[৭]
ওরে গায়ত দিলাম কেথা।
কন দাবাইয়ে[৮] যাইব আমার বুকের হাড্ডির[৯] বেথারে॥
দেবায়[১০] ডাকে হারুম ধূরুম আছমান ভাঙ্গি পড়ে
ওরে আছমান ভাঙ্গি পড়ে।
এম্নিকালে একলা আমি কেমনে থাকি ঘরেরে॥
টোবার[১১] পানি বাড়ি উট্টে বাড়ি উট্টে ফেনা,
ওরে বাড়ি উট্টে ফেনা।
দুখ্খর কথা কারে কইয়ম কেহত বুঝেনারে॥
বীজানায়[১২] বাড়ে রোয়া[১৩] আগা লক্ লক্
ওরে আগা লক্ লক্।
পানির হোতৎ[১৪] ভাসি গেইরে আমার বসর কাল্যা সখরে
আউল হইয়ে যতরে মাছ মেঘর পানি খাই
ওরে মেঘর পানি খাই।
খাইল্যা[১৫] ঘরৎ কেমতে আমি মনরে বুঝাইরে॥
বাড়ীর পিছে ঝিঞা খেতি টুনি পঙ্কীর বাসা।
দিনৎ খায়রে চড়িবড়ি রাইতৎ তারার আশা॥
দুমাসের লাগি গেলা দুবছর যায়।
বনর বাঘে না খাই মোরে মনর বাঘে খায়॥
নারীর যৈবন জাইন্য জোয়ারের পানি।
কুলে কুলে ভরে আবার ভাডাৎ[১৬] টানাটানি॥
দা কিনিয়া ন ধারাইলে জামার[১৭] ধরি যায়।
খাইল্যা ভুঁইয়ে[১৮] দুন্যাইর[১৯] যত আগাছা গাছায়॥
পাতিলার ভাত ঠাণ্ডা হৈলে খাইতে মজা নাই।
হেলি পৈলে সোণার যৈবন কি করিবা আ-ই॥[২০]
ছাট্টিনের[২১] চুলি[২২] ছিল বুকে আঁটা আঁটি।
সোণার অঙ্গ মৈলান হৈয়ে যৌবন হৈয়ে ভাটি॥
হাতর বেকি[২৩] হলস[২৪] হইয়ে পড়ি পড়ি যার।
ভাবনা চিন্তনা মোরে চুষি চুষি খার॥
পাড়ার লোক নানান কথা দিতেছে লাগাই।
মা বাপেতে নিত চায় তোমার থুন[২৫] ছাড়াই॥
কন সাইগরের কুলে তুমি কন সাইগরের কুলে।
কত কত ভরমরা যে বসিতে চায় ফুলে॥
কার লাগিয়া কর তুমি এইনা কামাই রুজি[২৬]।
সিঙাল চোরে[২৭] হাতাই লই যার ঘরর আছল[২৮] পুঁজি॥
কার লাগি বৈদেশী হৈলা হৈলারে কার লাগি।
আমি যদি মরি তুমি হৈবা বধর ভাগী॥
হাঙার বৌ[২৯] ন হইয়মরে ন পুইয়মরে[৩০] হাঙা।
হদ[৩১] বাজাইয়া চাইয়ম আমার কোপাল কন্নৎ[৩২] ভাঙা॥
(১—88)
(২)
আমিনা খাতুন কইন্যা বাপের এক ঝি।
ছবছর খসম[৩৩] ছাড়া উপায় হৈব কি॥
হায়দর বাপের নাম মাঝির গাঁও বাড়ি।
অতি কষ্টে দিন কাটে ঘরজার[৩৪] কাম করি॥
জাগাজমি নাইরে তার নাইরে হাল চাষ।
দিনের রুজি দিনে খায় কন দিন উয়াস[৩৫]॥
কৈন্যারে দিছিলা বিয়া ভালা ঘর চাহি।
ছবছর গত হইল কন পুশ্যিস[৩৬] নাই॥
কন পু্শ্যিস নাইরে তার গেল ছবছর।
ভৈনর পুত ভাগিনা দুলা[৩৭] নাম যে নছর॥
ভৈনর পুত ভাগিনা নছর তার কথা শুন।
আমিনার কোপালে সেই লাগাইছে আগুন॥
আদিগুরি কথা এখন কহিয়া জানাই।
ভাগিনা কেমনে হৈল ঝিয়ের জামাই॥
মার পেডে[৩৮] থাকিতে নছর বাপের এন্তেকাল[৩৯]।
বড় দুঃখে তার মায় কাটাইত কাল॥
পাঁচ না বছরের বসে[৪০] মাও গেল ছাড়ি।
সে হইতে নছর আলি থাকে মামুর বাড়ী॥
আমিনা হইতে নছর দুই বছরের বড়॥
বড় মহব্বত[৪১] তারে করিত হায়দর॥
দুঃখ মিন্নত[৪২] করি আনে দুই আক্ত খায়।
আমিনা নছর সদাই খেলিয়া বেড়ায়॥
সোয়ারীর[৪৩] খোলে[৪৪] নছর নুকা বানাইয়া।
পহিরর[৪৫] পানির মাঝে দিত ভাসাইয়া॥
এক সঙ্গে খেলা তারার এক সঙ্গে খাওন।
কৈতর কৈতরীর মত তারা দোন জন॥
এক দুই তিন করি ষোল বছর যায়।
যৌবন জোয়ারের জল আইল দরিয়ায়॥
গোলাপ ফুলের পরে ভরমরার মন।
গোপনে বসিয়া তারা করে আলাপন॥
জবিনে রুইলে চারা বাড়ে দিনে দিনে।
মাডির ভিতরের রস হিঁয়ড়েতে[৪৬] চিনে।
হাপে[৪৭] চিনে মনি আর বেঙে বাইরার[৪৮] পানি।
আসকে মাসুক[৪৯] চিনে যখন টানাটানি॥
অল্পবয়সের যুবা ভেরল ভেরল[৫০] গা।
নছররে জামাই কৈল্ল আমিনার মা॥
পুত নাই ক্ষেত নাই ঝিয়র উয়র আশা।
দুদিন্যা দুনিয়ার মাঝে সকলি যে লাসা[৫১]॥
কাউয়ার[৫২] বাসাৎ কোকিলার ছা ন মানিল পোষ
ঘরবাড়ী ছাড়িল নছর নছিবের দোষ॥
বাপে ভাবে মায়ে ভাবে উপায় হৈব কি।
শেষ কাডালে[৫৩] কারবা হাতে সঁপি যাইয়ম ঝি॥
এক দুই তিন করি গেল ছবছর।
কন্তে গেল গই[৫৪] অভাগ্যার পুত ন পাইলাম খবর॥
ন পাইলাম খবররে তার কি হৈব উপায়।
মোরা মৈলে আমিনারে কনে চাইব হায়॥ (১—৪৬)
(৩)
খুঁডি খুঁডি ধান খায় মনা[৫৫] আর চনা[৫৬]।
গহিন[৫৭] পানির তলে মাছে খোঁড়ে খনা[৫৮]॥
চতুর সন্ধানী বঁধু হাঁডে[৫৯] মূরে মুরে[৬০]।
গাছের গোডা[৬১] পাক্ ধরিলে পাইক পহল উড়ে[৬২]॥
ফুলেতে থাকিলে মধু জানে সে ভ্রমর।
মধু খাইতে চাহি বঁধূ করেরে ধড়ফড়॥
এছাক মিঞা আইসে সদাই হায়দরের বাড়ী।
আমিনার প্রেম সাইগরে দিতে চায় পাড়ি॥
বাপ গেইয়া কামে কাজে মায়ে বাঁধের বাড়া।
এই সময়ে এছাক মিঞা দুয়ারেতে খাড়া॥
পানর বিড়া আইন্যে ভালা নারিকেলের তেল।
আমিনারে ডাকি কয় “ঘরর দুয়ার মেল্”॥
ইসারায় কয় কথা দুই চোগ লড়ে।
ন মানে পরাণ তার মুখর লেউস্যা[৬৩] ঝরে॥
হোক্কাতে[৬৪] তামুক আর পানর খিলি দিয়া।
আমিনা বাহিরে আসে কথা না বলিয়া॥
জাইল্যা যেমন ঘোলায় পানি জাল ফেলাইয়া দুরে।
সেইনা মতে মন চোরা আশে পাশে ঘুরে॥
পানির সঙ্গে তেল মিশেনা চিনির সাথে নূন।
এছাকের সঙ্গে তেমনি আমিনা খাতুন॥ (১—২০)
(8)
গেরামের মাঝখানে এছাকের ঘর।
নাম ডাগর[৬৫] মানুষ তারা মস্ত তোয়াঙ্গর[৬৬]॥
চৌচালা ডেহেরিখানা উড়ান জুড়িয়া।
চাইর দিকে গড় খন্দক[৬৭] গিরিডি[৬৮] ঘিরিয়া॥
ভিতরে আটচালা ঘর উলুছনর ছানি।
বড় পুকুর ছামনে তার দশ হাত গহিন পানি॥
এছাকের ঘরে বিবি নাম ‘মেমাজান’।
ছুরতে জিনিয়া লয় পুন্নমাসীর চান॥
বড় ঘরর মাইয়া[৬৯] ‘মেমা’ বড় ঘরর মাইয়া।
সুখ ন পাইল ভমরা বঁধূ ফুলর মধু খাইয়া॥
যার সঙ্গে যার মজে মন বাদ বিচার নাই।
কোন জনে সুখ পায় মদ বেচি দুধ খাই॥
আমিনারে নারাজ দেখি এছাকের মন।
প্রেমের আগুনে আরও জ্বলে হামিস্কন[৭০]॥
এইত আগুনের জ্বালা ছেলর মতন ফুডে[৭১]।
ফুদিয়া নিবাইতে গেলে বেশী জ্বলি উডে॥
একদিন এছাক মিঞা করিল কি কাম।
হায়দারের নিকটে গিয়া কহিল তামাম[৭২]॥
কহিল মনের কথা যত আছে মনে।
দিল যে ফাডিয়া[৭৩] যায় আমিনার কারণে॥
সাদি যদি করে মোরে আমিনা সোন্দরী।
তোমরারে পালিবাম সারা জীবন ভরি॥
আষ্টকানি জমি দিব শঙ্খনদীর কুলে।
ভরি ভরি সোণা দিব হাত কাণ চুলে॥
দুঃখ মিন্নত ন করিবা বুড়া কালে আর।
আমিনার কারণে তোমরা ন হৈবা লাচার[৭৪]॥
এছাকের এই সব কথা শুনিয়া হায়দর ৷
মাথার মাঝে হাত দিয়া ভাবিল বিস্তর॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া হায়দর জিজ্ঞাসে তখন।
আমিনারে রাখিবা কি বান্দীর মতন॥
এছাক বলিল—ইহা নয়া কথা নয়।
নহিলে কুলের মান কেমন কৈরে রয়॥
আষ্টকানি জমি দিব শঙ্খ নদীর কুলে।
ভরি ভরি সোনা দিব হাত কাণ চুলে॥
হায়দর বলিল আমি পুছার[৭৫] করিয়া।
তোমারে আমার কইন্যা দিবাম তবে বিয়া॥
মায় আসি কৈল কথা আমিনার গোচরে।
নীচের মিক্যা[৭৬] চাইল কন্যা বুগে[৭৭] ধড়ফড় করে॥
ন চাহিল মার মিক্যা ন ফুডিল[৭৮] মাত[৭৯]।
পেরেসানে[৮০] তিন দিন ন খাইলরে ভাত॥ (১—৪০)
(৫)
সেইত গেরামের গুণীন্ বুধা তার নাম॥
ঝারা ফুয়া[৮১] আদি জানে বিতকিছ্য[৮২] কাম॥
গর্ভিতা খালাস হয় পানি পড়া খাই।
বুধাগুণীর দোয়া তাবিজ আচানক দাবাই॥
পুরুষ দেবানা[৮৩] হয় নারী ছাড়ে ঘর।
পররে আপন করে আপনারে পর॥
শনি মঙ্গল বারে যদি অমাবস্যা পায়।
গাছের হিঁয়র[৮৪] তুলি আনি অসুদ[৮৫] বানায়॥
যুবতী নারীর লাগে ঝোঁডার[৮৬] আগার চুল।
আর লাগে বাসি বিয়ার মুকুটের ফুল॥
আঙ্গুলের নোক[৮৭] আর আঞ্চলের কোনা।
এসব জিনিষ দিয়া করে দারুটোনা[৮৮]॥
যত বদমাস আছে যত লুচ্চা আর।
দিনে রাইতে ঘুরে তারা দুয়ারে বুধার॥
কেহ পড়ায় হৈরর[৮৯] তেল কেহ পড়ায় পান।
কেহ দে বাইয়ন[৯০] মূলা কেহ দেরে ধান॥
কেহ দেয় আনাজি কেলা[৯১] কেহ কচুর মাথি।
ভেট বেয়ার[৯২] লয় বুধা দোন[৯৩] হাত পাতি॥
ওঝাগিরি ব্যবসা ভালা মাছে ভাতে খানা।
দিনে জোটে মৈষর দই রাইতে দুধর ছানা॥
সিন্দুক ভরা টাকা বুধার গোলায় আটকাট[৯৪] ধান
ওঝাগিরি করি বেটা হৈছে জাণ্টুমান[৯৫]॥
দেশ বৈদেশে হৈছেরে তার বড় নাম ডাক।
বুধার কাছে একদিন আসিল এছাক॥
মুখেতে সরম তার বুকে বেথা ভারি।
আরে ঠারে কয়রে কথা মাথা লাড়ি চারি॥
বুধা বলে শুনরে বাপ আইস্য কিয়র লাই[৯৬]।
কোন নারী দিয়াছে দিলে[৯৭] আগুন লাগাই॥
এছাক বলিল আমার পাড়াল্যা হায়দর।
হাটের উত্তরে যাইতে পথর মোড়ৎ ঘর॥
তার কইন্যা আমিনারে খামখা[৯৮] যে চাই।
বাঁচাও আমারে গুণী আগুন নিবাই॥
পেডৎ ন যায় ভাত আমার মরির সদাই ভোগে[৯৯]।
শুতি[১০০] পৈলে তারে ভাবি ঘুম ন আইয়ে চোগে॥
বিষগোটা মৈষর হাল দশ দোন[১০১] ভুঁই।
টেঁয়া পৈছার[১০২] লাগিয়ারে ন ভাবিও তুঁই[১০৩]॥
গোলার ধান ইন্দুরে খায় নাইরে পুশ্যিস[১০৪]।
আমিনার লাগি আমার মাথায় উট্টে বিষ॥
বুধা বলে শুনরে বাপ কালুকা ফজরে[১০৫]।
আমার পরিচয়ে যাইবা নজু তেল্যার ঘরে॥
হৈর[১০৬] দিয়া যখন নজু ঘুরাইব ঘানি।
পরথমের সাত ফোডা[১০৭] তেল দিবা তুমি আনি॥
শনিবারে সেই তেল আমি দিব পড়ি।
দেখিব কেমন কইন্যা আমিনা সোন্দরী॥(১—88)
(৬)
ছবুর[১০৮] মানেনা এছাক মানেনা ছবুর।
সদাই পঙ্কীর মতন করে উড় উড়॥
ডল্যুয়া খালর[১০৯] হোঁত[১১০] হৈয়ে মন ডল্যুয়া খালের হোঁত।
কন দিকদি কন্তে যাইব খুঁজি ন পায় পোঁথ[১১১]॥
দিলে নাই খোসালী[১১২] তার মুয়ৎ নাইরে মাত[১১৩]
বিলাইর মতন চুপ্পে চুপ্পে তোয়ায়[১১৪] ইন্দুর গাথ[১১৫]॥
হায়দরের কাছে যাইয়া কৈল সমুদায়।
আমিনারে হাত করিতে চিন্তিল উপায়॥
মায় বাপে ছল্লা[১১৬] করি কি কাম করিল।
খেসীর[১১৭] বাড়ীৎ যাইব বলি ঘরর বাহির হৈল॥
আমিনারে কৈল তারা কিছু নাহি ডর।
ফিরিয়া আসিব মোরা হাজন্যার[১১৮] ভিতর॥
পৈরনেতে[১১৯] তহমান[১২০] কালা কোর্ত্তা গায়।
মাথার উয়র টুবি দিয়া আনা[১২১] ধরি চায়॥
মুখেত মাখিয়া দিল বুধার তেল পড়া।
সাজিয়া মাজিয়া এছাক বাহির হৈল ত্বরা॥
গা আঁধারি[১২২] হৈয়ে তখন সুরুজ লৈয়ে ঘর।
দুতিয়ার[১২৩] চান দেখা যায়রে আচমানের উয়র॥
ধীরে ধীরে আসে এছাক চায় ফিরি ফিরি।
এক্কই বারে চলি আইল হায়দরের বাড়ী॥
দুয়ার রৈয়ে বাঁধারে তার ঘরে নাইরে বাতি।
আমিনা খাতুন কন্তে[১২৪] গেইয়ে এই রাতি॥
ন আইল ন আইল কইন্যা ন আইলরে ঘরে।
তেল পড়া মুয়ত দিয়া এছাক ভাবি মরে॥
চাডার[১২৫] মাঝে ন-আইল মাছ ন খাইল আধার।
বনর হাতী ন পড়িল খেদার মাঝে তার॥
জাঁহির[১২৬] মাঝে ঝাড়র ডাহুক ন বাড়াইল গলা।
মুড়ার বাঁদর ফাঁদৎ পড়ি ন খাইলরে কলা॥
সারা রাইত মোশার[১২৭] কামড় সহিয়া সহিয়া।
ফজরে আপনার বাড়ীৎ গেল এছাক মিঞা॥
খাইবার বেলা আসি মা বাপ ঘর দেখে খালি।
আমিনা রাখিয়া গেছে দোন কানর বালি॥
রঙ্গিনা ছাট্টিনের চুলি আর নাগর নথ।
ফেলিয়া গিয়াছে কইন্যা ঘরর দুয়ারত॥
আড়াকাড়া[১২৮] তোতারে সেই আড়াকাড়া তোতা।
হাঁজর[১২৯] বেলা কনবা দুঃখে উড়ি গেল গই কোথা॥
এখানে আমিনার কথা করিলাম বারণ।
নছরের কথা কিছু শুন দিয়া মন॥ (১-৩৮)
(৭)
চাঁডিগা বন্দরের ছুলুপ নাম তার ‘রুম’।
নছর আলী সেই জাহাজের হুঁস্যারি[১৩০] মালুম॥
দরেয়া জরিপ করি বাদসা ‘সেকান্দার’।
জাহাজ চালাইবার লাগি বানাইলা ‘চাডর’[১৩১]॥
‘হিরামন’ নামে এক তোতা ছিল তান্।
সেই তোতা সাইগরের জানিত সন্ধান॥
কনখানেতে ডুবাচর কন্তে গহিন পানি।
হিরামন নানান খবর দিত তানে আনি॥
জাহাজী ছুলুপী যত আছে দুনিয়ায়।
সেকেন্দরের ‘চাড়র’ চাহি বাইছা[১৩২] বাহি যায়॥
নছর পরথমে ছিল জাহাজের লস্কর।
ভালামতে হেপঝ[১৩৩] পরে করিল ‘চাড়র’॥
আচমানের তারা চাহি চিনি লয় পথ।
ভালামতে বুঝে নছর হাবার আলামত[১৩৪]॥
লস্কর হইতে নছর হইতে হইল মালুম।
টেঁয়া পৈছা জমাইয়ারে হাতত কৈল্ল কুম[১৩৫]॥
মালুম হইয়া নছর করিল কি কাম।
দক্ষিণ মুল্লুকে এক স্থাপিল মোকাম॥
অঙ্গী নামে সহর সে সাইগরের কূলে।
সে সহরে নছর মালুম নানান কারবার খোলে॥
আচানক দেশ সেই শুন কহি যাই।
বেপরদা মাইয়া মাইন্সর লাজ সরম নাই॥
মরদেরা রাঁধে ভাত নারী হাটে যায়
ভালা মাছ ছাড়ি তারা নাপ্ফি পোঁচা[১৩৬] খায়॥
ওক[১৩৭] আসে এই না দেশের খানার কথা শুনি।
আঁজিলা কেঁয়াল্লিশ (?) খায় তেলর মাঝে ভুনি[১৩৮]॥
মাইয়া মাইন্সর জেয়র জাতি বহুত বহুত দামি।
এক পেঁচে কাপড় পিন্ধে আড়াই হাতর খামি[১৩৯]॥
মাথার চুল বাবরি ছাঁটা এঙ্গি[১৪০] থাকে বুকে।
ঝোঁডার ভিতর পানর খিলি ইসারাতে ডাকে॥
রূপের ছটা বুকের গোটা নারাঙ্গির তুল।
মাথার উয়র খুচি ধরে বেল কদম্বের ফুল॥
কানর মাঝে সোনার নাধং[১৪১] রাস্তা দিয়া যায়।
মুচকি মুচকি হাসি তারা পুরুষ ভুলায়॥
নারীর রাজ্যে আইল যখন মালুম নছর।
পিরিতির আগুনে দিল করে ধড়ফড়॥
‘মাফো’ নামে ‘পোয়াজা’[১৪২] এক অঙ্গী সহর বাড়ী।
‘এখিন’ তাহার কইন্যা পরমা সোন্দরী॥
ষোল বছর বয়স তার চাম্বা ফুলর রং।
ঠমকে ঠমকে চলে কত রকম ঢং॥
শুকনা মাছ বেচে ‘মাফো’ বড় সদাইগর।
তার বাড়ীতে একদিন আইল নছর।
পানর খিলি বানায় ‘এখিন’ বাপর ঘরে বসি।
চৈক্ষে করে ঝিলি মিলি মুখে প্রেম হাসি॥
এদিক ঐদিক চাইতে কৈন্যার দুই চোগ লড়ে।
আঙ্গির উয়র[১৪৩] ভেল্কি দিয়া রসিক পাগল করে॥
চাম্বার বরণ কইন্যার সোন্দর বদন।
তার উপরে আসক হইল নছরের মন॥
পিরিতির তিনটি আখর মর্ম্মে লাগে যার।
কিবা সরম কিবা ভরম কিবা লাজ তার॥[১৪৪]॥
দিনে রাইতে যায় নছর পোয়াজার বাড়ী।
আমিনারে ভুলি গেইয়ে বাড়ী ঘর ছাড়ি॥
ভুলি গেইয়ে ছোডকালের যত সুখ দুঃখ।
ভুলি গেইয়ে আমিনার হাসিভরা মুখ॥
ভুলি গেছে ভাই বেরাদর[১৪৫] ভুলিছে সকল।
‘এখিনের’ রূপ তারে কৈরাছে পাকল॥
একদিন হাঁজর বেলা কি কাম হইল।
মাফো সদাইগরের বাড়ীৎ নছর আসিল॥
কেহ নাই ঘরে আর এখিন একেলা।
মস্কারি[১৪৬] করিয়া দিল পানর বঁডু মেলা[১৪৭]॥
এখিনের হাত তখন ধরিল নছর।
পরবোধ ন মানে মন করেরে ধরফড়॥
জহরিয়ে জহর চিনে বাইন্যা চিনে সোণা।
পিরিতিয়ে মন চিনে মন চিনে আপনা॥
ক্ষেতিয়াল চিনে ভুঁই মাঝি চিনে খাল।
ওস্তাদ গাইনে চিনে কন্টা ভাল তাল॥
কারবারিয়ে ব্যবসা চিনে ধনী চিনে ধন।
রসিক নাগর চিনে রমনী রতন॥
মালুম ছুয়ানী[১৪৮] চিনে সাইগরের চর।
এখিনরে চিনিলরে বিদেশী নছর॥
দেখিয়া শুনিয়া মাফো কি কাম করিল।
সেই দেশের সরামতে তারার বিয়া দিল॥
মুড়ার কুল্যা গরু[১৪৯] আর গাঙর কুল্যা বাড়ী।
মুছুলমানের বিবি আর হেঁদুর গালর দাড়ি॥
এ সক্কলের কোন দিন ন থাকে ঠিকানা।
পত্য[১৫০] ন করিও কেহ করি আমি মানা॥
ফুলর মধু খায় নছর মুখে টাগা মারে।
ভুলি গেইয়ে জানের জান সেই আমিনারে॥ (১—৮০)
(৮)
কন দেশেতে যাওরে মাঝি ভাডি গাঙ বাইয়া।
মা বাপেরে কইও আমার নাইয়রের লাগিয়া॥
আম ধরের থোবা থোবা কাট্টলে ধরে মুচি[১৫১]।
রাখি আইস্যি কধু লাউ[১৫২] গেইয়ে বুলি পুঁচি॥
বাপের বাড়ীৎ যোড় কলসী উপরে ঢাকনি।
আমার পরাণে খোজের সেই কলসীর পানি॥
বাপর বাড়ীর করই গাছটা পাতা ঝুম ঝুম করে।
মাবাপেরে কইও মাঝি নাইয়র নিত মোরে॥
দুষমনের লাগি আমি ছাইড়লাম বাপর বাড়ী।
নছিবের দোষে আমার খসম্ থাকতে রাঁড়ি॥
ছোড কালে পালি মা বাপ দিলা বড় দাগা।
কি করিব শঙ্খর কুলর আষ্ট কানি জাগা॥
কি করিব সোনার জেয়র[১৫৩] বুকে আমার ঘাও।
মনের দুঃখ ন বুঝিলা আমার বাপ আর মাও॥
কি করিব মৈষর হাল আর দোনাদোনি ভুঁই[১৫৪]।
বাড়াবাঁধি তোমরারে খাবাইতাম মুই[১৫৫]॥
বুগর ছেল[১৫৬] হাড়ি তোলতে দিলা আরো গাড়ি।
বেচা পরাণ কেম্নে আবার লইয়ম আমি কাড়ি॥
অল্প বয়সের কালে পাইলাম বড় দাগা।
এ কাল যৈবন আমার রাইখতে ন পাইর জাগা॥
খাওনের চিজ্ নহে কাটিয়া খাইব।
বেচিবার মাল নহে বাজারে বেচির॥
বাটিবার ধন নহে দিব ঘরে ঘরে।
ন বুঝিলা মাও বাপ ন বুঝিলা মোরে[১৫৭]॥
গাঙর কুলৎ বসিয়ারে আমিনা সোন্দরী।
মা বাপরে ভাবিয়ারে কাঁদে রাও ধরি॥
দুই মাস গত হৈল ছাড়ি বাপর ঘর।
বহু দুঃখ পাইল কইন্যা ঘুরিল বিস্তর॥
কত গেরাম ছাড়ি আইস্যে কত নন্দি[১৫৮] নালা।
কত গণ্ডা লুচ্চা ছাণ্ডা দিয়ে কত জ্বালা॥
খোদায় ছুরত দিয়ে ছুরত হৈয়ে বৈরি।
সন্তিপনা[১৫৯] রাখি আইস্যে আমিনা সোন্দরী॥
সাইগরেতে ধায় নন্দি কনে দিব বান।
হাত বাড়াইলে পায়ন ন যায় আচমানের চান॥
নারীর দৌলত সন্তিপনা রাইখতে যদি চায়।
এমন পুরুষ কেহ নাই কাড়ি লৈয়া যায়॥ (১—৩৬)
(৯)
ইলসা খালির কুলে আছে গফুরের বাড়ী।
তার ঘরে আশ্রা[১৬০] পাইয়ে আমিনা সোন্দরী॥
আশীবছর উমর[১৬১] তার বুড়া ক্ষেতিয়াল।
হাঁজর বেলা ঘরে আসে কাঁধে লৈয়া হাল॥
চোগর ভুরু পাইক্যে[১৬২] বুড়ার আরো বুগর কেশ।
দেড় হাত লম্বা পাক্না দাড়ি দেখতে লাগে বেশ॥
ঘরে আছে গুজা বুড়ি নাই দেখে চোগে।
কনে রাঁধের ভাত ছালন[১৬৩] মরে পেডর ভোগে[১৬৪]॥
গরু আছে মৈষ আছে গোলা ভরা ধান।
দুনিয়ায় কিরপণ নাই বুড়ার সমান॥
নছিবের দোষে গফুর হৈয়ে আটকুড়া।
চরফু দিন[১৬৫] ক্ষেতে তবু খাটে এই বুড়া॥
পোষ্যিন[১৬৬] আনিয়া এক পালাইলা তারে।
খোদায় নারাজ হৈলে কে রাখিতে পারে॥
মরিল পোষ্যিন পোয়া[১৬৭] ভাঙিলরে বুক।
গুজা বুড়ি লৈয়া গফুর পায় বড় দুঃখ॥
এম্নিকালে ঘরে আসি আমিনা সোন্দরী।
ধর্ম্মের বাপ ডাকে তারে দোন পায়ত ধরি॥
নিজের অবস্থার কথা একে একে কৈল।
আমিনার উপরে তার মহব্বত[১৬৮] হৈল॥
অকুলে ভাসিয়া কইন্যা পাইল কুলর লাগ।
আঁধার ঘর রোশনাই করি জ্বলিল চেরাগ॥
রাঁধি বাড়ি ভালা মতে তারারে খাবায়।
বুড়া বলে পাইলাম কইন্যা আল্লার দোয়ায়[১৬৯]॥
হাঁজর বেলা গরু বাঁধে কুড়া খল্লি দিয়া ৷
হোক্কাতে তামুক ভরে বাপের লাগিয়া॥
দুই আক্ত নাস্তা[১৭০] বানায় সকাল বিকালে।
ছেঁইচ্যা পান[১৭১] পাইয়া বুড়ি চুম্প[১৭২] দিল গালে॥
আমিনা পরম সুখে আছে তারার ঘরে।
মা বাপর লাগি তবু চোখর পানি ঝরে॥ (১—৩০)
(১০)
দক্ষিণ সাইগরে চর ‘পরীদিয়া’ নাম।
সেই জাগাতে ছিল আগে পরীর মোকাম॥
আচ্মান হইতে পরী আসিত উড়িয়া।
মানুষের সঙ্গে হৈত কত পরীর বিয়া॥
ক্রেমে ক্রেমে হৈল কিবা শুন বিবরণ।
নানান দেশের মানুষ চরে কৈল্ল আগমন॥
ধাইয়া গেল যত পরী ন রহিল আর।
মানুষের বস্তি হৈল বসিল বাজার॥
যত জাইল্যা ধরে মাছ বেমান সাইগরে।
শুকাইয়া লয় তাহা পরীদিয়ার চরে॥
শুকটী মাছের আড়াং[১৭৩] হৈল বেব্সা হৈল ভারি।
পরীদিয়ার চরে আসে যতেক কারবারি॥
অঙ্গী হৈতে মাফো পাইল এই জাগার খবর।
শুকটী মাছ বেচা যায়রে আধা আধি দর॥
‘পরীদিয়া’র ‘লাউখ্যা’[১৭৪] শুকটীর বড় নাম ডাক।
মাফো ভাবে কেমন করে পাইবে তার লাগ॥
নছররে ডাকি মাফো কহিল। জামাই।
কেমন কৈরে পরীদিয়ার ভালা লাউখ্যা পাই॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া নছর কহিল তখন।
সেইচরে আমি তবে করিব গমন॥
দহিনালী[১৭৫] বয়ার পাইলে বার দিনের পাড়ি।
মাসেকের মধ্যে আমি ফিরি আইস্যম[১৭৬] বাড়ী॥
‘এখিনের’ কাছে যাইয়া কহিল নছর।
মাসেকের লাগি যাইয়ম পরীদিয়ার চর॥
কন দুঃখ ন করিও আসিব ফিরিয়া।
হাসিয়া কহিল এখিন—“ন করিও বিয়া॥” (১—২৬)
(১১)
দহিনালী হাবা বয় মাঘমাসের শেষ।
অঙ্গী সহর হৈতে নছর আসে উত্তর দেশ॥
বাইশ পালের ছুলুপ সে হাঙ্কারিয়া যায়।
ছুয়ানী লস্কর যত বাইছার সারিগায়॥
উত্তর মিক্যা আইয়ের[১৭৭] জাহাজ ডানদিকেতে কুল।
রঙ বেরঙের পাইখ[১৭৮] দেখা যায় রঙ বেরঙের ফুল॥
বেমান দরিয়ার বামে মাঝে মাঝে চর।
সেই চরেত নাইরকলের[১৭৯] বন দেখইতে মনোহর॥
ঝরি ঝরি পড়ে নাইরকল মাইন্সে নাহি খায়।
লাখে লাখে ফেনার মতন ভাসে দরিয়ায়॥
কন চরে ধূধূ বালু নাইরে কন গাছ।
হাজারে বিজারে তায় কুমীরের বাস॥
মস্ত মস্ত আণ্ডা[১৮০] পাড়ি বালু ঝাপাই দিয়া ৷
চাহিরৈয়ে মেদী[১৮১] কুমীর উপরে বসিয়া॥
আরো কিছু পছিমেতে[১৮২] আছে এক চর।
বেশুমার[১৮৩] হাপ[১৮৪] থাকে নাম কালন্দর॥
পেরাবনে[১৮৫] বাঘ ভাল্লুক কত জানোয়ার।
এক চরর থুন আর এক চরৎ হাঁছুরি[১৮৬] হয় পার॥
কত চর কত বস্তি দেখিয়া দেখিয়া।
নছরের ছুলুপ আইসের পঙ্কী উড়া দিয়া॥
বার দিনের পন্থ তারা আইল ছয় দিনে।
পরীদিয়া আসি নছর ভালা ‘লাউখ্যা’ কিনে॥
বোঝাই করিয়া জাহাজ ভাবিল নছর।
উল্টা বয়ারে চলা হবে যে দুষ্কর॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া মালুম কিনা কাম করে।
ছুয়ানীরে[১৮৭] কইল “বাইছা দিবা যে উতরে॥”
তিনদিনের পন্থ আসি করিল লঙ্গর।
মাঝির গাঁও গেরামের মাঝে গেল যে নছর॥ (১—২৮)
(১২)
নছর চলিয়া আইল হায়দরের বাড়ি।
শ্বশুর মরিয়া গেছে, আছে শ্বাশুড়ি॥
পাড়ায় পাড়ায় বুড়ী ভিক্ষা মাঙ্গি খায়।
বেগর খাওনে রৈলে কেহ ন জিগ্যায়[১৮৮]॥
ছানি নাই বেড়া নাই ভাঙা সেই ঘর।
আমিনা যে কন্তে গেইয়ে ভাবিল নছর॥
বারমাস্যা বাইয়ন[১৮৯] গাছে ফুইটে বাইয়ন ফুল।
ভাঙ্গা ঘরৎ বসি নছর ভাবিয়া আকুল॥
বেলর মতন বেল চলি যায় কেহত ন আইল।
নছর ভাবের—কেন আইলাম কন ভূতে যে পাইল॥
পরদেশে পরবাসে আমি না করিলাম মনে।
লানছনে[১৯০] হৈল যে তারা আমার কারণে॥
আমিনার কত কথা মনৎ উডিল তার।
চোগর পানি বুগৎ পড়ি গড়াই গড়াই যার॥
ন আইল ন আইল কেহ আঁধার হইয়া গেল।
বাহির হইল নছর বুগৎ লৈয়া ছেল[১৯১]॥
হাটে আসি এক ঘরে হৈল মোছাফির[১৯২]।
একে একে যত কথা হইল বাহির॥
দুনিয়ার মাঝারে জাইন্য বিচার আচার নাই।
নানান কথা কৈল মাইন্সে জোড়াই তাড়াই॥
কৈল তারা—আমিনার ছিল বেশ্যামতি।
তাইরে[১৯৩] লৈয়া মাবাপের যতেক দুর্গতি॥
তারারে ফেলাইয়া শেষে বজ্জাত সে মাইয়া।
লোভৎ পড়ি কন দেশেতে গেইয়ে যে ধাইয়া॥
কাঁদিয়া মরিল সেই বুড়া হায়দর।
মাডিতে পড়িয়া বুড়ী কৈল্ল ধড়ফড়॥
শুনিয়া এসব কথা নছর মালুম।
দানাপানি ন খাইলরেন গেলরে ঘুম॥ (১—২৮)
(১৩)
বাড়িল হাবার[১৯৪] জোর ফাউন মাস্যাদিন।
মোকামে ফিরিতে নছর করিল একিন[১৯৫]॥
দাড়ি মাল্লা কৈল্ল মানা ন শুনিল কাণে।
আউনে[১৯৬] পড়ে যে ফেরুঙ[১৯৭] নছিবের টানে॥
বাহির দরেয়ায় যখন আসিল ছুলুপ।
ঝাপটাইন্যা বয়ারে পড়ি হৈল ডুপ ডুপ॥
একেত জোয়ারের ঠেলা জোরে বয় হাওয়া।
হইল বিষম দায় দহিন মিক্যা যাওয়া॥
আচমানে ডাকিল ডেয়া[১৯৮] চমকে বিজলি।
আইয়ের কালা কালা মেঘ দেওর[১৯৯] মত চলি॥
দাড়ি মাল্লা কাঁদি উডিল ছুয়ানী টেণ্ডল।
ক্রেমে ক্রেমে বাড়ি যার গই হাবার বলাবল॥
আচমানের অবস্থা দেখি মাথা নাহি থির।
কেরামত করে বুঝি খোয়াজ খিজির[২০০]॥
নছর মালুম যাইয়া ধরিল ছুয়ান।
সাইগরে উঠিছে ঢেউ মুড়ার সমান॥
দুই দিকে জুড়ি ঢেউ আসে লহরিয়া।
দাড়ি মাল্লা কাঁদি উডিল বেনালে পড়িয়া॥
বদরের নামে কেহ ছিন্নি মানস করে।
গুড়াগাড়ার[২০১] লাগি কেহ মাথা থাবাই মরে॥
সোর[২০২] চিক্কির[২০৩] মারি কেহ করে ধড়ফড়।
ন দেখিলাম মাও বাপ ভাই বেরাদর॥
জানের পেয়ারা বিবির[২০৪] ন পাইলামরে দেখা।
দরেয়ায় মউত[২০৫] ছিল নছিবেতে লেখা॥
গাঁজাখোরর সঙ্গে পড়ি খাইলাম বুঝি গাঁজা।
ন পাইলাম গোর কাফন ন পাইলাম জানাজা॥
ছিড়িল পালের রশি ভাঙ্গিল মাস্তুল।
জাহাজের মাঝে তখন পড়ে হুলুস্থুল॥
ছুডিল ছুডিল জাহাজ বাতাসের জোরে।
এক্কই বারে লাগিল্ গিয়া ‘গোবধ্যার’ চরে॥
পরছিম সাইগরে তখন কি কাম হইত।
হার্ম্মাদ্যারা নুকানারা[২০৬] লুডিয়া লইত॥
চৈঁয়া পৈছা[২০৭] ধন দৌলত নিত সব কাড়ি।
তেরিমেরি[২০৮] করিলেরে মাথাৎ দিত বাড়ি॥
বেনাম দরিয়ার মাঝে হার্ম্মাদ্যার ডর।
চলিত ছলুপ তাই করিয়া বহর॥
লাডি সোডা ছেল বল্লম কত কইব আর।
বারুদ বন্দুক লৈত যত হাতিয়ার॥
কাঁইচার দক্ষিণ মুখে দিয়াঙ্গার[২০৯] পারি।
সেইখান হইতে বাইছা দিত বদর শুমারি॥
এ হেন সময়ে হায়রে কি কাম হইল।
নছরের ছুলুপ আসি চরেতে ঠেকিল॥
‘গোবধ্যার’ চর সেই বড় বিষম জাগা।
কত শত মাঝি মালুম পাইয়ে কত দাগা॥
ঝড় তুফান থামি গেইয়ে ভাট্যাল বয়ার।
ভাডার পানি গেইয়ে লামি রাইতর অন্ধকার॥
ধূ ধূ বালুর চর সেই নাইরে এক গাছ খের[২১০]।
কনদিকদি[২১১] যাইব নছর ন পার যে টের॥
বালুর উয়র উইট্টে ছুলুপ ন লড়ে ন চড়ে।
পানি ন বাড়িলে হায় লামায় কেমন কৈরে॥
ফজরে জোয়ার হৈব সেই আশাতে তারা।
দুরফু[২১২] রাইত বসি রৈল দিয়া যে পাহারা॥
পাহারায় রৈল তারা খানাপিনা ছাড়ি।
ভাইব্ত লায়িল[২১৩] কনমিক্যাদি কন্তে[২১৪] দিব পাড়ি॥
রাইত আর নাইরে বাকী আচ্মান হৈয়ে ছাপ।
পছিম দিক্দি হার্ম্মাদ্যারা দিয়া বইস্যে খাপ॥
গাঙর চিলে ডাক মারিল সুরুজ উডের পূবে।
ধীরে ধীরে আসি জোয়ার বালুচর ডুবে॥
দূরে থাকি ডাকুর দল দুর্মি[২১৫] ধরি চায়।
দেখিয়া নছর মালুম করে হায়রে হায়॥
দশবারজন আইলো তারা কালা জঙ্গি পরি।
কারো গায় লালকোর্ত্তা মাথাতে পাগড়ি॥
কোমরেতে তলোয়ার হাতেতে বন্দুক।
ছরদ[২১৬] হইয়া গেল নছরের বুক॥
দাড়ি মাল্লা ছিল যত ছুয়ানি টেণ্ডল।
হাত পা লাড়িতে তারার গায়ৎ নাইরে বল॥
ছুলুপে উডিয়া ডাকু কিনা কাম করে।
নছর মালুমের পরথম গলা চাবি[২১৭] ধরে॥
গলা চাবি ধরি পরে মারিল চোয়ার।
ডেরার[২১৮] মুখে পড়ি নছর করে হাহাকার॥
ছুয়ানী টেণ্ডল আদি ছিল যতজন।
হেরে হেরে[২১৯] পেলাই রৈয়ে দেখে ডাকুগণ॥
একে একে সক্কলের বাঁধি হাত পাও।
হার্ম্মাদ্যার নুকার মাঝে করিলা চড়াও॥
সিন্দুক খুলিয়া তারা পাইল বহুধন।
বর্ম্মাদেশের সোণা পাইয়া খুসী হইল মন॥
পুড়ান্যা[২২০] হইল জোয়ার ফুলি উডিল পানি।
চরর থুণ[২২১] নামাইল ছুলুপ ডাকাইতেরা টানি॥
ভিজা ‘লাউখ্যা’[২২২] পাইয়ে রৈদ[২২৩] বদ্বু[২২৪] উডের ভারি।
শত শত গাঙ কৈতরে লই যার ঝাপ্টা মারি॥
আঁয়াসের[২২৫] হক্কুন[২২৬] আইস্যে আরো গাঙর চিল।
লাউখ্যা শুকটীর বেসাদ[২২৭] লইয়া ফেসাদ বাজিল॥
নছরের ছুলুপ আর যত মাল ছিল।
সক্কলি লইয়া ডাকু মোকামে চলিল॥ (১—৮২)
(১৪)
আমিনার কথা এখন শুন কিছু কহি।
খায় সুখে গফুরের মহব্বত লই॥
মরি গেইয়ে গুজাবুড়ী[২২৮] আর কেহ নাই ঘরে।
ধর্ম্মের কইন্যার লাগি গফুর ভাবি ভাবি মরে॥
আমি যদি নাই থাকি কি হৈব উপায়।
ধন দৌলত জাগা জমিন কনে[২২৯] চাইব হায়॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া বুড়া স্থির কৈল্ল মন।
আমিনারে ডাকি আনি কহিল তখন॥
তুমিত ধর্ম্মের কন্যা আমি ধর্ম্মের বাপ।
এককথার লাগিয়ারে মনে বড় তাপ॥
জাগা-জমিন ধনদৌলত খাইবরে কনে।
তোমাকে মা সাদি দিতে করিয়াছি মনে॥
এই যে দুনিয়া জাইন্য বড় ঠগের মেলা।
ধনদৌলত লৈয়া কেমনে থাকিবা একেলা॥
শুনগো ধর্ম্মের কইন্যা মোর কথা ধর।
ভালা দুলা[২৩০] দিব আনি ফিরতুন[২৩১] সাদি কর॥
সাতবছর যার কোন ওয়াকিব[২৩২] নাই।
আর কদিন বসিয়া তুমি থাকিবা তার লাই[২৩৩]॥
কামিনের সরামতে হৈয়াছে তেলাক[২৩৪]।
শুনগো ধর্ম্মের কন্যা মোর কথা রাখ॥
কয়বরে ডাকিছে মোরে শুন আমার মাও।
কবুল জোয়াব দিয়া একিন পুরাও।
গফুরের কথা শুনি আমিনা সোন্দরী।
বলিতে লাগিল কথা দোন পায়ত ধরি॥
শুনগো ধর্ম্মের বাপ শুন আমার বাণী।
তিয়াস[২৩৫] নাই যে বুকে আর ন পিয়ম পানি॥
মাবাপরে ছাড়ি আইলাম ছাইড়লাম বাড়ীঘর।
সাদি দিতে চাইল বলি মাবাপ হৈল পর॥
শুনগো ধর্ম্মের বাপ ধরি তোমার পাও।
অভাগিনীর ভাঙাবুকে আর না দিয়ো ঘাও॥
কইন্যার মন বুঝি গফুর আর কিছু না কৈল।
লাঙল জুয়াল কাঁধৎ লৈয়া ঘরর বাহির হৈল॥
বুড়া ক্ষেতিয়াল গফুর করে হাল চাষ।
নানান জাতর নানান ক্ষেতি পায় বার মাস॥ (১—৩৪)
(১৫)
গোপ্ত কথা কহি শুন একে একে সব।
বানাউটি[২৩৬] নহে ইহা—নহে মিছা গব[২৩৭]॥
অরাজক হৈল দেশে জঙ্গ[২৩৮] হৈল ভারি।
দহিন মিক্যা ধাইয়ে মগ বাড়ীঘর ছাড়ি॥
সোণারূপা ধনদৌলত মাডিতে গাড়িয়া।
দহিন মিক্যা ধাইয়ে মগ চাঁডিগা ছাড়িয়া॥
এক রাত্রি কি হইল শুন বিবরণ।
গফুরের বাড়ীতে মগ দিলা দরশন॥
এক ছাড়া ভিঁডা[২৩৯] আছে বাড়ীর উতরে।
মগেরা আসিয়া সেই ছাড়া ভিঁডা কোড়ে॥
দেখিয়া গফুর ক্ষেত্যাল কি কাম করিল ৷
লাড়ি ছোড়া হাতত লৈয়া ঘরর বাহির হৈল॥
আমিনারে ডাকিয়ারে করে সাবধান।
আজুয়া[২৪০] মগের হাতে হারাইলাম জান॥
পোলাইয়া[২৪১] থাকরে মা মোচার[২৪২] উয়র উডি।
মগে যদি জাইন্তে পারে নিব তোমায় লুডি[২৪৩]॥
আশীবছরের বুড়া পাক্কাই পাক্কাই পড়ে[২৪৪]।
আমিনা উডিল গিয়া মোচার উয়রে॥
ধীরে ধীরে আইলো বুড়া লাড়িৎ দিয়া ভর।
মগে বলে—কেন বুড়া মিছা কর ডর॥
বাপদাদার ভিঁডা ইহ। এইখানে আমি।
ছোডকালে খেইল্লাম কত মার কোলর থুন নামি॥
বার ঘড়া সোণার মোহর ভিঁডার মাঝে রাখি।
গেরাম ছাড়িয়া এখন নানার বাড়ীৎ থাকি॥
বলিতে বলিতে মাডি কুড়িতে লাগিল।
বার ঘড়া সোণার মোহর তুলিয়া আনিল॥
বুড়ারে কহিল তারা লও দুই ঘড়া।
এতদিন এই ধন দিয়াছ পাহারা॥
পাইল বুড়া দুই ঘড়া সোণার মোহর।
রাইতে রাইতে ধাইল রে মগ না হৈতে ফজর[২৪৫]॥
আমিনার কাছে আনি পিতলের ঘড়া।
ঢালিয়া দেখিল গফুর মোহরেতে ভরা॥
হাপুতায়[২৪৬] পাইলে পুত বুগত বাজায়।
নিধনীরে পাইলে ধন টিবিটিবি চায়॥
বাপে ঝিয়ে যুক্তি করি কি কাম করিল।
দোন ঘড়া সোণার মোহর মাডিতে গাড়িল।
এইরূপে কিছুদিন হৈল গোজারণ[২৪৭]।
গফুরের উপরে দিল মউতে[২৪৮] ছমন[২৪৯]॥
সময় ফুরাইয়া গেছে নাই বেশী দিন।
আমিনারে ডাকি গফুর জানাইল একিন॥
শুনগো ধর্ম্মের কইন্যা শুন আমার বাত।
আমার মিক্যা একবার বাড়াওরে হাত॥
হাতে হাত দিল কইন্যা দোন চোগৎ পানি।
বুড়া গফুর আমিনারে কাছে লৈল টানি।
শুনগো ধর্ম্মের কইন্যা শুন আমার মাও।
কাঁদিয়া কেনরে তুমি আমারে কাঁদাও॥
ন কাইন্দ ন কাইন্দ কইন্যা ন কান্দিয়ো আর।
আমার যত ধনদৌলত সক্কলি তোমার॥
আমাত[২৫০] হইল গফুর হৈল চোগ খাড়ি।
পাড়াল্যা মানুষে মিলি দিল তারে মাডি[২৫১]॥
ধর্ম্মের বাপের লাগি কাঁদে আমিনা সোন্দরী।
কন্তে তুমি যাওরে বাপ আমারে পাসরি॥
এতদিন ভুলিছিলাম আছল[২৫২] বাপ মাও।
একেলা ফেলিয়া মোরে এখন কন্তে[২৫৩] যাও॥
যেই গাছ ধরি আমি অভাগিনী নারী।
দারুণ তুফানে সেই গাছ ফেলে যে উফারি॥[২৫৪]
বাপর ঘরৎ জন্ম লৈয়া ন পাইলাম রে সুখ।
তুমি আরো ভাঙি দিলা আমার ভাঙা বুক॥
এইরূপে কাঁদি কাডি দুই মাস যায়।
আমিনার উপরে কুদিন ফেলাইল আল্লায়॥ (১—৬০)
(১৬)
মাঝির গাঁও গেরাম হৈতে এছাক দুষমন।
ভালামতে জানিলরে সব বিবরণ॥
জানিয়া শুনিয়া এছাক কিনা কাম করে।
একইবারে চলি আইল বুড়ীর গোচরে॥
বুড়ী সেই আমিনার মা ভিক্ষা মাঙ্গি খায়।
হাবিজাবি[২৫৫] কথা তারে এছাক বুঝায়॥
বুড়ীরে দায়দ[২৫৬] করি সঙ্গেতে আনিল।
আপনার বাড়ীৎ গিয়া খানাপিনা দিল॥
ভালাভালা ছালন[২৫৭] দিল দুধ আর দই।
দুই আক্ত খাইয়া বুড়ী দড় হই যারগই[২৫৮]॥
এইরূপ থোরা[২৫৯] দিন গেল গোজারিয়া।
বুড়ীরে রাখিল এছাক তাজিম[২৬০] করিয়া॥
আমিনা সোন্দরীর কথা তুলি একদিন।
কত গব[২৬১] মারে এছাক রঙিন রঙিন॥
বুড়ী বলে—শুনরে বাপ তাইরে দেইখতে চাই।
লৈয়া আস আমিনারে তুমি একবার যাই॥
এছাক বলিল—বুড়ী কেন কর ভুল।
দরেয়া হাঁছুরি[২৬২] আমি ন পাইলামরে কুল॥
আমি গেলে আমিনার হবে বড় রোষ।
তাহার বেগানা[২৬৩] হৈলাম নছিবের দোষ॥”
এইরূপে নানা কথা কহিয়া এছাক।
ফন্দিমতে বুড়ীরে করিল ঠিক ঠাক॥
হাঁজর[২৬৪] বাত্তি ঘরে দিল আমিনা সোন্দরী।
এ সমে[২৬৫] নাইয়রী আইল মাহাফায়[২৬৬] চড়ি॥
কন আইল কন আইল বলি ভাবি মনে মনে।
ধীরে ধীরে আইল কইন্যা বাহিরের উডানে[২৬৭]॥
মা বলিয়া বুড়ি তারে যখন ডাক দিল।
আমিনা আসিয়া মারে বেড়াই ধরিল॥
অঝোরে ঝরিল তার দুই নয়ানের পানি।
চিয়নির[২৬৮] উপরে মারে বসাইল আনি॥
বাপের মউতের কথা আরো মায়ের দুঃখ।
শুনি অভাগিনী কইন্যার ফাডি গেল্গই বুক॥
একে একে শুনি আরো যতেক খবর।
আমিনা যে সারা রাইত কৈল্ল ধড়ফড়॥
ফজরে উডিয়া বুড়ী খাইল খানাপিনা।
বড় তরাজন[২৬৯] তারে করিলা আমিনা॥
বুড়ী বলে,—শুন কইন্যা আমার কথা ধর।
মাঝির গাঁও গেরামে যাইয়া ফিরি বস্তি[২৭০] কর॥
একলা ঘরে থাক তুমি ভালা নহে কাম।
ফিরি চল যাই আবার আপনার মোকাম॥
আমিন। কহিল—মাগো ধরি তোমার পাও।
কি খাইব যাইয়া মোরা সেই মাঝির গাঁও॥
খাইয়া দাইয়া বেচি ধান টাকা হয়রে জমা।
মাঝির গাঁও গেরামে যাইয়া কি খাইব ওমা॥
আম পাই কাট্টাল[২৭১] পাই বারমাস্যা ফল।
কনে চাইব[২৭২] আমার এই গরু আর ছায়ল[২৭৩]॥
চাষকোরের[২৭৪] কাম আছে গোলায় আছে ধান।
চলি গেলে এই সব হৈবরে লানছান[২৭৫]॥
আমার সঙ্গে থাক তুমি ন যাইও আর।
তোমার হাতে দিলাম তুলি সক্কল সংসার॥
খাওনের পরণের নাই টানখিজ[২৭৬]।
পরাণে যাহা খোজে তুমি খাইও সেই চিজ[২৭৭]॥”
বুড়ী রৈল কইন্যার ঘরে মন করি থির[২৭৮]।
মাঝির গাঁও হৈতে একদিন আইলো মোছাফির[২৭৯]॥
ফিস্ফিস্ কথা কহে বুড়ীরে গোপনে।
কি যুক্তি করিছে তারা আমিনা ন জানে॥
খাইয়া দাইয়া মোছাফির হইল বিদায়।
রাতুয়ার[২৮০] কথা কহি শুন সমুদায়॥
আমিনা সোন্দরী যখন ঘুমে অচেতন।
দুয়ার খুলিয়া বুড়ী দিলরে তখন॥
তিনজন আসি তারা সামাইল[২৮১] ঘরে।
পরথমে বাঁধিল মুখ হাত তার পরে॥
তার পরে পা বাঁধিয়া কি কাম করিল।
আমিনারে কাঁদৎ লৈয়া ঘরের বাহির হৈল॥
কাঁদিতে ন পারে কইন্যা লড়িতে ন পারে।
যাইবার কালে একবার চাইল গুণর[২৮২] মারে॥
হায়রে দুনিয়াদারী কন্তে পাইবা সুখ।
পাথরের মত দড় হৈয়ে মায়ের বুক॥
ন বুঝিলা আমিনার মা কি করিলা কাম।
কাঞ্চাসোণা বেচিয়ারে পাইলা কাঁচর দাম॥
সরেঙ্গা নুকা[২৮৩] যে এক ঘাটে বাঁধা ছিল।
আমিনারে আনি তারা নুকাতে তুলিল॥
তুলিয়া নুকার মাঝে খুলি দিলা বান[২৮৪]।
বুক কুডি কুডি কইন্যা করে আনছান[২৮৫]॥
ছোড ছোড খাল বাইয়া একদিনের পর।
মাঝির গাঁও গেরাম তারা আইল বরাবর॥
কইন্যারে লইয়া তারা কিনা কাম করে।
দাখিল করিল নিয়া এছাকের গোচরে॥ (১—৭৮)
(১৭)
এদিকে হইল কিবা শুন বিবরণ।
নছররে কি করিল যত ডাকুগণ॥
সেইনা ছুলুপ আর ছিল যত মাল।
বেচিয়া পাইল ডাকু টাকা টালে টাল[২৮৬]॥
পচ্ছিম দিগেতে রাজ্য দরেয়ার শেষ।
মাইন্সে মানুষ বেচি খায় আচানক দেশ॥
দাড়ি মাল্লা ছিল যত ছুয়ানী টেণ্ডল।
সেই দেশেতে সক্কলরে বেচে ডাকুর দল॥
নছররে বেচিয়ারে পাইল বহু দাম।
হার্ম্মাদ্যারা চলি আইলো যে যার মোকাম॥
গোলাম হইয়া নছর যার বাড়ীতে ছিল।
ছোড একখান নুকা তারা নছররে দিল॥
হাট করে বাজার করে বোঝা রইয়া আনে।
ছোড নুকা লৈয়া নছর যায়রে স্থানে স্থানে॥
সুবুদ্ধি আছিল তার কুবুদ্ধি হইল।
সেই নুকা লৈয়া নছর দেশে বাইছ। দিল॥
ছোড গাঙ ছাড়ি পাইল বেমান দরিয়া।
ভাইবত লাগিল কনমিক্যাদি[২৮৭] যাইব পাড়ি দিয়া॥
জানের লালছ[২৮৮] তার নাহি ছিল হায়।
বেমান সাইগরে নুকা ভাসি ভাসি যায়॥
এক দুই তিন করি গেল চাইর দিন।
উয়াসে[২৮৯] কায়াসে নছর হৈল বলহীন॥
দোন হাত ফুলি গেইয়ে নাই চলে আর।
কনমিক্যা[২৯০] ন দেখে যে কূল আর কিনার॥
ঢেউয়ের উপরে নুকা ভাসি ভাসি যায়।
ন ডুবিয়া রইয়ে কেম্তে জানে যে আল্লায়॥
সাইগরের জানোয়ার পাহাড়ের সমান।
‘হুমাহুমি’ শব্দ করে যেনরে তুয়ান[২৯১]॥
চোখে নাই দেখে নছর মাথা নাই থির।
নুকাতে পড়িয়া জপে আল্লার জিকির॥
জপিতে জপিতে নাম হইল বেহোঁস।
এত কষ্ট পায় নছর নছিবের দোষ।
দরেয়ার পীর সেই খোয়াজ খিজির[২৯২]।
শুনিল শুনিল যেন তাহার জিকির[২৯৩]॥
বড় বড় নুকা লৈয়া খাটাইয়া পাল।
সারি গাইয়া যায়রে জাইল্যা বোসাইতে[২৯৪] জাল॥
মাঝ দরিয়ায় ছোড নুকা ঢেউয়ের মাথাৎ খেলে।
দেখি তারা ধীরে ধীরে নুকা ধরি ফেলে॥
নছররে পাইয়া তারা তুলিয়া আনিল।
পরাণ আছে কি নাই বুঝা নাই গেল॥
মাথাৎ দিল ঠাণ্ডা পানি খাইতে দিল ডাব।
খানিক বাদে ভাল হৈল নছরের ভাব॥
কেহ কারো কথা নাই বুঝে কোন মতে।
নছর দুঃখের কথা জানাইল ইঙ্গিতে॥
পুগ্দেশী[২৯৫] ছুলুপ এক ধান বেচিয়া যায়।
নছররে দিল জাইল্যা তারার জিম্যায়॥
(১৮)
অঙ্গী সহরেতে মাফো ভাবিতে লাগিল।
‘বছরের মধ্যে নছর ঘরে ন ফিরিল॥
পরীদিয়া পাঠাইলাম লাউখ্যার[২৯৬] কারণে।
ফাকি দিয়া ধাইল বুঝি নিজের মোকামে॥
উতরের কালা তারা বড় দাগাবাজ।
এত টাকা দিলাম তারে না বুঝি আন্তাজ[২৯৭]॥
এই না ভাবিয়া মাফো কি কাম করিল।
নছরের কারবারেতে যত মাল ছিল॥
সব মালমাত্তা[২৯৮] বেচি ভাঙ্গিল কারবার।
‘এখিন’ কৈন্যারে সাদি দিলারে আবার॥
নছর ফিরিয়া আইল বছরের পরে।
দূরে থাকি শুনি সব নাহি গেল ঘরে॥
ভিংছা জাতি[২৯৯] হয় তারা গলাৎ দিব ছুরি।
অঙ্গী সহর হৈতে নছর ধাইল তাড়াতাড়ি॥
“এখিন” কইন্যার আর ন চাহিল মুখ।
খসম্ লইয়ে শুনিয়ারে ভাঙি গেল্গই বুক॥
আবরু ইজ্জত নাই দিলেতে দরদ।
ভিন্ন নাই ভাবে তারা বেগানা মরদ॥
পিরিতির মর্ম্ম নাহি জানে এই জাত।
চৈঁয়া পৈছা পাইলে পিরিত ন পাইলে ফজ্জাত[৩০০]॥
দিলরে করিয়া ছাপ মালুম নছর।
একইবারে ছাড়ি আইল ভিংছার সহর॥
নছিবেতে দুঃখ তার খেলিছে আল্লায়।
পাগলের মত হৈল নানান চিন্তায়॥
টেঁয়া নাই পৈছাঁ[৩০১] নাই পন্থের ভিখারী।
দুনিয়াতে কেহ নাই নাইরে ঘরবাড়ি॥
উত্তর দেশে আসে নছর ঘুরিয়া ফিরিয়া।
কন দিন থাকে হায় গাছতলে পড়িয়া॥
এক নিশাকালে নছর খোয়াব[৩০২] দেখিল।
আমিন। আসিয়া যেন ছাম্নে খাড়া হৈল॥
আমিনা আসিয়া যেন ছাম্নে হৈল খাড়া।
দুইচোগে জ্বলে তার আসমানের তারা॥
অঙ্গের বরণ তার যেন চাম্পা ফুল।
সন্তিপনা[৩০৩] রাইখ্যে কন্যা রাইখ্যে জাত কুল॥
যৌবন কলসী সেই কিছু নহে উনা।
কন দোষ নাই তার নাই কন ওনা[৩০৪]॥
বুকেতে দরদ তার মুখে মৃদু হাসি।
এই ফুল ঝরা নহে, নহে ইহা বাসী॥
থোয়াব দেখিয়া নছর খানিক ভাবিল।
দেখিতে আমিনার মুখ একিন করিল॥ (১—৪০)
(১৯)
আমিনারে লুডি আইন্যে এছাক দুষমন।
নানারকম লোভ দেখায় কাড়ি নিত মন॥
ন মানিল পোষ কইন্যা ন মানিল পোষ।
জাঁহুরা[৩০৫] হাপের মত করে ফোঁস ফোস॥
বুধা ওঝার গুণ গেয়ান ফুসা[৩০৬] হৈয়া গেল।
বরবাদ[৩০৭] হইল কত মন্তর্ পড়া তেল॥
দোয়া তাবিজ কৈল্ল কত কৈল্ল দারু টোনা[৩০৮]।
আগুনে পুড়িলে ভাই চিনা যায় সোণা॥
ছয়মাস গেল কইন্যার ন ভিজিল মন।
শুন শুন কি করিল এছাক তখন॥
দিন আর বাকী নাই পড়ি গেইয়ে বেল্।
আমিনার কাছে এছাক ধীরে ধীরে গেল্॥
ধীরে ধীরে যাইয়া বলে—“শুনরে আমিনা
ছোড লোকের মাইয়া তুই বড়ই কমিনা[৩০৯]॥
আমার ঘরেতে তোর নাই আর জাগা।
বড় পেরেসান[৩১০] দিলি পাইলাম বড় দাগা॥
জল্দি করি যারে চলি ন থাকিস্ আর।
বড় গোস্বা[৩১১] হৈয়ে ‘মেমা’ বিবিজান আমার॥
বাহির করিয়া দিব চুলৎ ধরি টানি।
আমার ঘরে ন পাইবি ভাত আর পানি॥”
শুনি এছাকের কথা আমিনার দিল্।
ধুমাইয়া ধুমাইয়া জ্বলিতে লাগিল্॥
বাহির হইল কইন্যা চোগৎ লৈয়া পানি।
বাপের বাড়ি আসি দেখে ঘরৎ নাহি ছানি॥
ঘরৎ নাহি ছানি আর ভাঙা ভাঙা বেড়া।
রাতুয়া[৩১২] হিয়াল[৩১৩] থাকে, আবর্জ্জনা ভরা॥
কেমনে ঘুমায় কইন্যা নাইরে দুয়ার।
সারা রাইত বসি রইল এক কোণে তার॥
আধা রাইতে আচমানেতে উইট্টে সোণার চান।
এছাকের মাথায় বিষ আনছান পরাণ॥
একলা ঘরে আছে কইন্যা জানেরে দুষমন।
আরজু[৩১৪] পুরাইতে আইলো পশুর মতন॥
গুমরি বসিয়া কইন্যা ঘরের কোণায়।
দেখিল এছাক আসে হৈল বিষম দায়॥
হরিণীরে পাইয়ে বাঘ ধরিবে কামড়ি।
এমনি কালে ভাঙা ঘর কাঁপে থরথরি॥
নছর লইয়া এক বাঁশর ঠুনিহারি[৩১৫]।
এছাকের মাথাৎ দিল মস্ত বড় বাড়ি॥
জোন পহর[৩১৬] উইট্যে ভালা দক্ষিণালী বায়।
আমিনা বেড়াই ধৈল্ল নছরের গলায়॥
কথাবার্ত্তা নাই তারার চোগৎ বহে পানি।
নছরের পিন্ধনেতে ছিড়া একখান কানি॥
বেগর খাওনে[৩১৭] তার শুকায় গেইয়ে মুখ।
দেখিয়া আমিনা কইন্যার ফাডি যার গই বুক॥
মাথার চুল দিয়া কইন্যা লইল নিছনি।
“কেমনে ছিলা ভুলি মোরে আমার নয়ন-মণি॥”
কিছু ন কহিল নছর ন কহিল কিছু।
ঘরর বাহির হৈয়া গেল কইন্যার পিছু পিছু॥ (১-৪৮)
.
টীকা
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন