দীনেশচন্দ্র সেন
রাজা রঘুর পালা
এই পালা-গানটি মৈমনসিংহের আইথর গ্রামনিবাসী আমাদের অন্যতম পালা-সংগ্রাহক শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রচন্দ্র দে কর্ত্তৃক সংগৃহীত।
দ্বিতীয় খণ্ডে আমরা রাণী কমলার গানটি প্রকাশিত করিয়াছি। এই পালাটিও সেই গানেরই শেষাংশ। প্রথমটিতে রাণী কমলার স্বামিকুলের ইষ্টার্থ প্রাণ-বিসৰ্জ্জন এবং রাজা জানকীনাথের শোকোম্মত্ততা বর্ণিত আছে। ইহার ঐতিহাসিক বিবরণ আমি রাণী কমলার ভূমিকায় দিয়াছি, সুতরাং তাহার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। যে দীঘিতে কমলা প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন তাহার একাংশ এখন সোমেশ্বর নদের গর্ভস্থ। এই দীঘির নাম ‘কমলা সায়র’। রাণী কমলার পালাটিতে ঐতিহাসিক ঘটনা কবি-কল্পনায় জড়িত হইয়া বড়ই চিত্তাকর্ষক হইয়াছে। অধরচন্দ্র নামক জনৈক কবি ঐ গানটি লিখিয়াছিলেন। তাঁহার ঊষার বর্ণনার সারল্য আমাদিগকে ঋগ্বেদের সূক্তগুলি স্মরণ করাইয়া দেয়। রাজার মৃত্যু-কথা টেনিসনের Mort d’Arthur এর মত এক লোকাতীত অপ্রাকৃত রাজ্যে লইয়া যায়। বস্তুতঃ নিম্নশ্রেণীর লোকেরা যে ঐতিহাসিক কাহিনীকে কিরূপ আশ্চর্য্য কবিত্বের আবরণ দিয়া সাজাইতে পারে, সেই পালাটি তাহার নিদর্শন। রাণী কমলার গাম্ভীর্য্য, অটুট সঙ্কল্প এবং বাৎসল্য অতি অপূর্ব্ব। যদিও তিনি একটি প্রাচীন কুসংস্কারের বশবর্ত্তী হইয়া প্রাণদান করিয়াছিলেন, তথাপি কবি তাঁহার যে মূর্ত্তি আঁকিয়াছেন তাহা সম্রাজ্ঞীরই মত; তন্মধ্যে হীনতার দৈন্য কিংবা অজ্ঞতার লেশ নাই। পাঠকের মনে রাণী কমলার মূর্ত্তি চিরতরে অঙ্কিত হইয়া থাকিবে। বিদেহী রাজ্ঞী শিশু রঘুনাথকে স্তন্য দান করিয়া স্বৰ্গপথে যাইতেছিলেন, তখন শোকোন্মত্ত রাজা জানকীনাথ সজোরে তঁহার অঞ্চল ধরিয়া টানিতেছিলেন, কিন্তু তাঁহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিলেন না। স্বর্ণবিন্দুযুক্ত চেলাঞ্চলের অংশ তাহার মুষ্টিতে রহিয়া গেল। রাজা উন্মত্তের ন্যায় সেই অমূল্য স্মৃতিচিহ্ন হাতে লইয়া স্বৰ্গগামিনীর পথের দিকে চাহিয়া রহিলেন। এই চিত্রের উপরে কবি পটক্ষেপ করিয়া পাঠকের মনে জানকীনাথের যে মূর্ত্তি আঁকিয়াছেন তাহা কখনই মুছিয়া যাইবার সম্ভাবনা নাই।
বর্ত্তমান পালাটি সেই পালারই উপসংহার এ কথা আমরা বলিয়াছি। ইহা অধরচন্দ্রের লেখা নহে। অজ্ঞাতনামা কবি এই পালাটিতেও তাঁহার বিলক্ষণ শক্তির প্রমাণ দিয়াছেন। চিরশত্রু জানকীনাথের মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া ভুঁইয়াদের নায়ক জঙ্গলবাড়ীর ইশা খাঁ তখনই দুর্গাপুর অধিকার করিতে সসৈন্যে রওনা হইলেন। তখন রঘুনাথ পঞ্চ বৎসর বয়স্ক মাত্র। তঁহার পিতার চিরবিশ্বস্ত মন্ত্রীরা তঁহাকে সিংহাসনে বসাইয়া রাজ্য পরিচালনা করিতেছিলেন। ইশা খাঁর সৈন্যেরা ঐ সময়ে পুরী অবরোধ করিল। বহুদিনের চেষ্টায় ছলে বলে শত্রুরা পুরীতে ঢুকিয়া শিশুরাজাকে বন্দী করিয়া লইয়া গেল।
এই সংবাদ প্রজাদের মধ্যে রাষ্ট্র হওয়ায় পরে যে শোকোন্মত্ততা দেখা দিল, তাহা করুণ রসের বন্যা; বিশেষতঃ যখন সহস্ৰ সহস্র গারোসৈন্য ভীষণ জলপ্রপাতের ন্যায় পাহাড় হইতে নামিয়া তাহদের শিশু রাজার জন্য উন্মত্তভাবে শোকপ্রকাশ করিয়া প্রতিশোধ লইবার সঙ্কল্প জানাইল তখনকার সে দৃশ্য উত্তেজনাপূর্ণ। হিন্দুরাজ্যে প্রজারা যে কিরূপ রাজভক্ত ছিল, এই পালা-গানটি পড়িলে তাহা বুঝা যায়। গারোরা দোর্দণ্ড প্রতাপে বর্শা ও খড়্গ লইয়া জঙ্গলবাড়ীর দিকে ছুটিল। তাহারা হয় শিশু-রাজাকে উদ্ধার করিয়া আনিবে, নয়। প্রাণ দিবে—এই তাহাদের সঙ্কল্প।
তখন দুৰ্গাপুরে রাজকুমারকে বন্দী করার আনন্দে ইশা খাঁর প্রজামণ্ডলী নানা প্রকার আমোদ-প্রমোদে ব্যস্ত। জঙ্গলবাড়ীর নিকটে এক দুর্ভেদ্য অরণ্য ছিল। ত্রিশ হাজার গারো তথায় জড় হইয়া একটা খাল কাটিয়া ফেলিল। এই খাল দ্বারা তাহারা রাতারাতি ধনেখালি নদীর সহিত জঙ্গলবাড়ীর পরিখার সংযোগ সাধন করিল। ইশা খাঁর নিযুক্ত রক্ষীদের অজ্ঞাতসারে তাহারা শিশু-রঘুনাথকে উদ্ধার করিয়া ইশা খাঁরই বড় পিনিসে বহু লোকে দাঁড় টানিয়া তাঁহাকে দুৰ্গাপুরে লইয়া আসিল। বহুহস্তচালিত পিনিস নৌকা তীরবৎ বেগে যখন দুর্গাপুর পৌঁছিল, তখন তথাকার প্রজারা যেরূপ আনন্দে তাঁহাকে অভিনন্দন করিয়াছিল তাহা আমরা কল্পনা করিতে পারি।
পালাটি ক্ষুদ্র হইলেও কবি যুদ্ধকাহিনীর দ্রুত ছন্দে যে বর্ণনা দিয়াছেন তাহা একখানি ছবির ন্যায়। এই পালা বাঙ্গালার ইতিহাসের একটি ক্ষুদ্র পৃষ্ঠা কিন্তু ইহা ক্ষুদ্র হইলেও মূল্যবান্। বাঙ্গালা দেশের প্রাচীন প্রত্যেক রাজা সম্বন্ধেই যে এইরূপ পালা-গান প্রচলিত ছিল তৎসম্বন্ধে আমার সন্দেহ নাই। তাহার অনেকগুলি নষ্ট হইয়া গিয়াছে। চেষ্টা করিলে এখনও কতক কতক উদ্ধার করা যাইতে পারে। কালে হয়ত কোন ঐতিহাসিক এই মুষ্টি মুষ্টি রত্নকণা সংগ্রহ করিয়া আমাদের ইতিহাস-ভাণ্ডারে উপঢৌকন দিবেন, আমরা তাঁহারই প্রতীক্ষায় আছি।
এই পালা-গানটিতে দুই একটা অসঙ্গতি আছি। সেগুলি প্রাচীন সংস্কারগত। গেঁয়ো কবিরা যদি শিক্ষার ত্রুটির জন্য তদ্রূপ দু’একটা ভুল করেন তবে তাহা মাৰ্জ্জনীয়।শিশু-রঘুনাথকে বন্দী অবস্থায় বাইশ মণ পাথর চাপা দিয়া রাখা হইয়াছিল। বাইশ মণ পাথরের চাপ দেওয়াটা পল্লী-গাথার একটা চিরাগত রীতি। ইশা খাঁ দিল্লীর সম্রাট্কে কীটের তুল্যও গণ্য করিতেন না প্রভৃতি কথাও পাড়াগাঁয়ের। এত বড় শক্তিশালী কবিও এই সকল পল্লী-সংস্কারের হাত এড়াইতে পারেন নাই।
রাজা রঘুনাথ জাহাঙ্গীরের সমকালবর্ত্তী এবং পালা-গানটিও সম্ভবতঃ তাঁহার সময়ে কিংবা অব্যবহিত পরে বিরচিত হইয়া থাকিবে। তবে যে সব কাহিনী গানের আকারে দেশে দেশে প্রচারিত হয় তাহার ভাষা মধ্যে মধ্যে পরিবর্ত্তিত হওয়া অপরিহার্য্য। সুতরাং ঠিক যে আকারে প্রথম ইহা রচিত হইয়াছিল, ঠিক সেই ভাবে যে আমরা ইহা পাই নাই,—একথা বলা বাহুল্য মাত্র।
শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন
.
রাজা রঘুর পালা
(১)
শুত্যা আছিল ধার্ম্মিক রাজা রে
আরে রাজা, বা’র-বাংলার[১] ঘরে।
রাণীর লাগিল্ রাজা রে
আরে রাজা, উফর ফাফর[২] করে॥২
“কই গেলা গো কমলা রাণী
এগো রাণী, ফালাইয়া আমারে।
আন্ধুয়া তুকি বাইয়া[৩] মরি গো
এগো রাণী বিছড়াইয়া[৪] তোমারে॥”৪
সোণার অঙ্গ পুড়্যা যেমুন রে
আরে রাজার অঙ্গ ছালি[৫] অইছে॥৬
রাণীর লাগিয়া রাজার রে
আরে রাজার আধা হাল অইছে॥
“কাজি-মরা[৬] কর্যা মোরে গো রাণী
আরে রাণী থইয়া গেছে মোরে।
দুধের বাচ্ছা থইয়া[৭] গেছে গো রাণী
কি স্তা[৮] পালি তারে॥”৮
কান্দিতে কান্দিতে রাজারে আরে ভালা,
উঙ্গাইয়া[৯] পড়ে।
উঙ্গাইতে উঙ্গাইতে রাজা রে
আরে রাজা কিবা দেখিল স্বপনে॥১০
সায়র থাক্যা উঠ্যা রাণীরে
আরে রাণী কয় রাজার গোচারে।
মূর্ত্তিমান অইয়া রাণীরে
আরে রাণী রাজার না ধারে॥১২
বা’র-বাংলার ঘরের মধ্যে রে
আরে রাজার শইল্য[১০] হাত বুলাইয়া।
আস্তে আস্তে কয় কথারে
আরে রাণী রাজারে বুঝাইয়া॥১৪
“শুন শুন ধার্মিক রাজা গো
এগো রাজা, শুন্যা লও কাণে।
পূব-দুয়ারী ঘর বান্ধ্যা
দেউখাইন[১১] গো এগো রাজা সায়রের পাড়ে॥১৬
নিশির কালে দুধের শিশুরে
আরে রাজা, শুতাইয়া রাখ্য সেই ঘরে।
একলা ঘর রাখ্য রাজারে
আরে রাজা, শুতাইয়া কুমারে॥১৮
রাইতের নিশি উঠা আমি গো
এগো রাজা, বুনি[১২] দিবাম তারে।
মায়ের দুগ্ধু খাইয়া কুমার গো
আরে কুমার বলিব[১৩] দুই গুণি॥”২০
(২)
এই কথা বলিয়া রাণী গো
এগো রাণী, উঠা দিলাইন মেলা।
ধচ্ মচ্ কইরা উঠে গো রাজা
আরে রাজা, স্বপনে কি দেখিলা।২
“স্বপন যে না লয় মনে গো
আরে রাণী সাচারীর[১৪] যেমুন।
আমার পাশ বইয়া রাণী গো
আরে রাণী কর্ছে আলাপন॥৪
দারুণিয়া কাল ঘুম রে
আরে ঘুম আছিল চউখ্যের আগে।
সেই কারণ না পাইলাম রে
আরে রাণী আপন কর্ম্মদোষে॥৬
শইল্যের মধ্যে পাইতে আছি রে
আরে রাণীর অঙ্গের পরশন।
আলা-ঝালা[১৫] দেখলাম যে রে
আরে ঘুমে হইয়া অছেতন॥৮
কইছে কথা কাণে কাণে রে
আরে আমার পষ্ট আছে মনে।
আপনে রাণী আইছিল যে রে
আরে সুনাধরি পুতের[১৬] কারণে॥”১০
স্বপনের কথা রাজারে
আরে রাজা রাখ্ছে গির দিয়া।
রাণীর আরদাশ[১৭] মতন রে
আরে রাজা দিল ঘর বান্ধিয়া॥১২
ঘর না বান্ধিয়া দিল রে
আরে ঘর সায়ারের কিনারে।
তার মধ্যে ছাওয়াল পুতের[১৮] রে
আরে ভালা বিছানা যে করে॥১৪
সাঞ্জা[১৯] বেলা কুমার না রে
আরে ভালা ঘুরিয়া ঘাটিয়া[২০]।
পালঙ্গের উপুরে কুমার রে
আরে ভালা রাখে শুতাইয়া॥১৬
পরতি দিন উঠ্যা রাণীরে
আরে রাণী যায় বুনি দিয়া[২১]।
নিশি রাইতের মাধ্যে সগল রে
আরে ভালা নিভুতি[২২] হইলে॥১৮
কমলা সায়র তনে[২৩] রে
আরে রাণী আইয়ে ঘরের মাধ্যে।
ঘরের মাধ্যে আইয়া রাণী রে
আরে রাণী দুগ্ধ দেয় কুমার রে॥২০
সেই দুগ্ধু খাইয়া কুমার রে
আরে কুমার দেবংশী বাড় বাড়ে[২৪]।
ছয় মাসের বাইর[২৫] কুমার রে
আরে কুমার এক দিনে বাড়ে॥২২
এই কারণ সন্দে আইল রে
আরে ভালা রাজার যে মনে।
বাডা[২৬] ভইরা রাখে পান রে
আরে ভালা সেই না ঘরের মাইঝে॥২৪
আমলধারী[২৭] রাণী নি মোর গো
আরে রাণী, একটি পান দেয় মুখে।২৬
না ছয়[২৮] পান না ছয় গুয়া রে
আরে রাণী, যায় বুনি দিয়া।
“মঞ্চের[২৯] মাটি ছাড়্যা আইছিরে
আরে ভালা, তার লাগি কেনে মায়া॥২৮
বুনি দিতাম আয়ি[৩০] কেবুল[৩১] রে
আরে ভালা বংশের কারণ।
এই পুত্র মর্যা গেলে রে
আরে ভালা হয় বংশ-নিবারণ[৩২]॥৩০
সেই সে কারণে দুগ্ধু রে
আরে ভালা দিতাছি কুমার রে।
সগল ত্যজিয়া আইছি রে
আরে ভালা আর পান খাওন কে রে[৩৩]॥৩২
পরতি নিশি উঠ্যা রাণীরে
আরে রাণী বুনি দিয়া যায়।
নিশি রাইতের কালে আইয়ে রে
আরে ভালা কেউ না দেখ্তে পায়॥৩৪
পুত্ত্রের না বাইর দেখ্যা রে
আরে ভালা রাজার হইছে সন্দে’।
তাকে তাকে থাক্যা[৩৪] দেখবাম রে
আরে রাণী আইয়ে কোন্ ছন্দে[৩৫]॥৩৬
বাইর আগেতে[৩৬] বান্ধা আছে রে
আরে ভালা বারামখানা[৩৭] ঘর।
সেই ঘরের মাধ্যে বস্যারে
আরে রাজা ভাবে নিরান্তর॥৩৮
সারা নিশি পোষাইবাম রে[৩৮]
আরে ভালা রাণীর লাগিয়া।
দেখবাম কেমনে রাণী আইয়া রে
আরে ভালা যায় দুগ্ধু দিয়া॥৪০
(৩)
নিরাবিলা বইয়া[৩৯] আছে রে
আরে রাজা রাণীর বার চাইয়া[৪০]।
আজুকা নিশি দেখবাম রাণীরে
আরে ভালা থাক্যা পলাইয়া॥২
শুত্যা আছুইন ধার্ম্মিক রাজারে
আরে ভাল্যা ফির্যা ফির্যা চায়।
কমলা সায়রের মাধ্যে রে
আরে ভালা কেউরে নি দেখা যায়[৪১]॥৪
এক প’র[৪২] রাইত দুই প’র রাইত রে
আরে ভালা কলরবে গেল।
আড়াই প’র্যা রাইতের নিশি রে
আরে সকল নিশুতি হইল[৪৩]॥৬
অন্ধকার্যা-জলক্যারা রে[৪৪]
আরে ভালা নিশি যায় বইয়া।
এমুন সম[৪৫] ধার্ম্মিক রাজা রে
আরে রাজা কি দেখুইন চাইয়া॥৮
কমলা সায়রের মাধ্যেরে
আরে ভালা জ্বল্যা উঠ্ছে আলা।
সেই আলাতে দেখা যায় রে
আরে ভালা সায়রের তলা॥১০
গয়িন[৪৬] সাররের মাধ্যে রে
আরে ভালা কি দেখুইন রাজা।
লক্ষ্মীঠাকুরাইণ উঠলাইন যেমুন রে
আরে ভালা উঠলাইন করি সাজা[৪৭]॥১২
চৌদিগ বান্ধ্যা[৪৮] আলাও[৪৯] অইল রে[৫০]
সেই রূপের পশরে[৫১]।
নিউলিয়া[৫২] দেখুইন রাজা রে
আরে ভালা অপরূপ কমলা সায়রে॥১৪
সায়র থাক্যা উঠ্ছুইন যেমুন রে
আরে ভালা লক্ষ্মীঠাকুরাণী।
ধার্ম্মিক রাজা চিনছুইন বুলে[৫৩] রে
এই সে তাঁর সাধের কমলা রাণী॥১৬
রাণীরে দেখিয়া রাজার রে
জিউ নাই সে ঠারে[৫৪]।
আইজ রাণীরে ধইরা রাখবাম রে
যেমনে আর না যাইতে পারে॥১৮
এই সে না চিন্তিয়া রাজা রে
আরে ভালা কোন্ কাম করে।
আস্তে আস্তে যায় রাজা রে
আরে ভালা কমলা সায়রে॥২০
সায়র তনে[৫৫] উঠ্যা রাণী রে
আরে রাণী গেলাইন[৫৬] ঘরের ভিতরে।
অমির্ত্তির[৫৭] রস খাওয়াইল রে
আরে ভালা পরাণের কুমারে॥২২
খাওয়াইয়া লওয়াইয়া পুত্ত্রেরে
আরে রাণী ঘুম পাতাইয়া।
পন্থে মেলা দিলাইন রাণী গো
এগো রাণী সায়র পানে চাইয়া॥২৪
ঘরের বাইরি না অইতে রে
আরে রাজা থাক্যা গুপ্তাইয়া[৫৮]।
যাইবার কালে রাণীর আঞ্চল রে
আরে রাজা ধরলাইন হাত বাড়াইয়া॥২৬
জোয়াপ[৫৯] না দিয়া রাণী গো
আরে রাণী চল্লাইন হেছ্ড়াইয়া[৬০]॥২৮
“হাত ধরি পাও ধরি গো
এগো রাণী চাও আমার পানে।
আর নাইসে ছাড়্যা যাও গো
এগো রাণী বাঁচাও পরাণে॥৩০.
না যাইও না যাইও রাণী গো
এগো রাণী আমারে ফালাইয়া।
আর নাই সে বাচবাম রাণী গো
এগো রাণী তোমারে ছাড়িয়া॥৩২
তোমার লাগিয়া রাণী গো
এগো রাণী ছাড়ছি দানা পানি।
পরাণে মরিয়া রইছি গো
এগো রাণী কেবুল আছে ধুক্ ধুকানি॥৩২
কির্পা কর পরাণের রাণী গো
এগো রাণী কির্পা কর মোরে।
আর নাই সে যাও রাণী গো
এগো রাণী কমলা সায়রে॥৩৬
এই যে ধইরাছি রাণী গো
এগো রাণী আর নাই সে ছাড়িবাম তোমারে।
তুমি যথায় যাও রাণী গো
এগো রাণী সঙ্গে নেও আমারে॥”৩৮
আঞ্চলে না ধরিয়া রাণী রে
আরে রাণী হেছ্ড়াইয়া চলে।
এক চোটে নামিল গিয়ারে
আরে রাণী সায়রের জলে॥৪০
আঞ্চলে ধরিয়া রাজা রে
আরে রাজা গইড়াইয়া পড়ে।
জোড়াবলি[৬১] করতে করতে রে
আরে তা’রা দইড় ভাঙ্গ্যা[৬২] জলে পড়ে॥৪২
পানিতে পড়িয়া রাণী
আরে রাণী গেল পানিতে মিশাইয়া।
সাঁতার পাড়িয়া রাজা রে
আরে রাজা ফিরে হাতড়াইয়া॥৪৪
সায়র পড়িয়া রাজা রে
আরে রাজা সাত ঢুক[৬৩] পানি খায়।
রাণীরে হারাইয়া কেবুল রে
আরে ভালা কান্দিয়া বিছড়ায়[৬৪]॥৪৬
বিছড়াইতে বিছড়াইতে রাজা রে
আরে রাজা হয়রান হইয়া।
কান্দিতে কান্দিতে রাজা রে
আরে রাজা পাড় উঠ্ল আইয়া॥৪৮
এই সে দুঃখে ধার্ম্মিক রাজা গো
আরে রাজা ছাড়ে দানাপানি।
রাণীর লাগিল্ রাজা রে
আরে রাজা ছাড়িল পরাণি॥৫০
(8)
দুধের চাওয়াল শিশু রঘুনাথ নাম।
বাড়া বয়স[৬৫] ছেউরা[৬৬] কর্যা বিধি হইল বাম॥২
এক না বচ্ছরের শিশু দুই বচ্ছর যায়।
পাঞ্চ না বচ্ছরের কাল গদিত বুয়ায়॥[৬৭]৪
পালা-পইরদা[৬৮] করে যত উজির নাজিরগনে।
রাজ্যতি করে তারা জানিয়া আপনে[৬৯]॥৬
দুধের ছাওয়াল রঘুনাথ নামে কেবুল রাজা।
উজির নাজির তারা দেখে শুনে পরজা॥৮
এই সে না আবেস্থায়[৭০] তারার[৭১] দিন যায়।
ধার্ম্মিক রাজা মর্ছে ইছা খাঁয়ে খবর পায়॥১০
ইছা খাঁ আর ধার্ম্মিক রাজা কত কর্ছে লড়ালড়ি।
কে লা বড় কে লা ছুডু[৭২] বুঝিবার না পারি॥১২
গায়-গণ্ডায়[৭৩] ইছা খাঁ পিরবীণ[৭৪] জোয়ান।
জঙ্গল বাড়ির সরের[৭৫] মধ্যে তার মোকাম॥১৪
তার সমান্যা জুড়ি নাই পিরথিমিতে[৭৬]।
চর্কির[৭৭] মতন ঘুড়ায়[৭৮] আথি[৭৯] ধরিয়া শুরেতে[৮০]॥১৬
মিয়ার দাপটে কাপে আসমান জমিন।
পা’ড়ের[৮১] মতন জোয়ান এমুন পিরবীণ॥১৮
রাও করিলে মিয়া, দেওয়ায় যেমুন ডাকে[৮২]।
দইরা[৮৩] পা’ড় ডংশ্যা[৮৪] যায় যখন পন্থে চলে॥২০
রণেতে তেজ্যুয়ান মিয়া ডাকে ঘন ঘন।
তার মতন পলুয়ান নাই তিরভুবন॥২২
এইসা মর্দ্দ ইছা খাঁ, দিল্লীর বাদশারে।
গণ্য নাই সে করে, যেমুন পিপড়ার মতন টেরে[৮৫]॥২৪
এই সে মিয়া ইছা খাঁ জঙ্গল বাড়ীর দেওয়ান।
ধার্ম্মিক রাজা আছিল তার জন্নমের দুষ্মান॥২৬
ধার্ম্মিক রাজা মইরা গেছে এই না খবর পাইয়া।
সুসুঙ্গের মোকামে[৮৬] মিয়া যায় কেবুল ধাইয়া॥২৮
(৫)
সুসুঙ্গের মোকাম মিয়ারে আরে মিয়া
জুড়্যা বের[৮৭] দিল।
সিঙ্গির গাথার[৮৮] মাধ্যে যেমুন রে আরে ভালা
শিরকাল[৮৯] পরবেশিল॥২
এই মতে তিন মাস রে আরে মিয়া
বের কইর্যা রাখে।
তিন মাসের বাদে মিয়ারে আরে মিয়া
দুধের বালক রঘুনাথরে ধরে॥
রঘুনাথরে ধর্যা মিয়ারে আরে মিয়া
আনে জঙ্গল বাড়ীর সরে।
হুলুচ্ তুলুচ্[৯০] লাগ্যা গেছে রে আরে ভালা
সুসুঙ্গের মোকামে॥৬
মরিয়া গেছে ধার্ম্মিক রাজা রে আরে রাজা
এক পুত্ত্র থইয়া।
বংশের ডেডা[৯১] রঘুনাথরে আরে
ইছা খাঁয়ে নিছে ধইরা॥৮
রাজারে বান্ধিয়া নিছে রে আরে যত
পরজা লুডায়[৯২] কাঁদিয়া।
সুসুঙ্গের যত পরজারে আরে সবে
পাগল হইয়া ফিরে।
রাজার রাজ্যি অয়রান পরছে রে
আরে নছিবের ফেরে॥১২
(৬)
থমরম লাগ্যা গেছে সুসুঙ্গ মুলুক জুড়িয়া।
গারুলীর[৯৩] যত গাড়[৯৪] আইল নামিয়া॥২
মুল্লুক ভাঙ্গিয়া তারা পাগল হইয়া ফিরে।
কেমুন হিম্মতি[৯৫] বেটায় রাজারে নিছে ধইরে॥৪
তার মুণ্ডু কাট্যা ফালা সায়রের মাইঝে।
আ নইলে[৯৬] পারাপার নাই এই লাজে॥৬
জঙ্গল বাড়ী স’র ভাঙ্গা কর গুড়া গুড়া।
এর নাল্লতি[৯৭] দেও আচ্ছা করিয়া॥৮
সিঙ্গাসন খালি কইরা রাজারে ধইরা নিছে।
রাজা না হইলে রাজ্যের কি শোভা আছে॥১০
রাজার লাগিয়া তারা পাগল হইয়া ফিরে।
কতকে[৯৮] গিয়া দাখিল হইব জঙ্গল বাড়ীর সরে॥১২
কুচ[৯৯] লইল বল্লম লইল
আর রাম কাডারি[১০০]।
মার মার কর্যা চলে
জঙ্গল বাড়ীর স’রে॥১৪
বাইশ কাহন[১০১] বাছ গাড়
চলে উফে লাফে[১০২]
তারার দাপটে ভূমি
তরাতরি[১০৩] কাঁপে॥১৬
রাতারাতি বাইশ কাহন
গাড় চলে ধাইয়া।
জঙ্গল বাড়ীর সর চল্ছে
পুরী পিরথিমি খাইয়া[১০৪]॥১৮
(৭)
জঙ্গল বাড়ী সর নারে ইছা খাঁ দেওয়ান।
তার মতন ফিকিরি[১০৫] নাই সংসার ভুবন॥২
চাইর দিকে গাঙ্গনা[১০৬] কাটছে গইন[১০৭] করিয়া।
জঙ্গল বাড়ী সহর রাখছে তার মাধ্যে বান্ধিয়া॥৪
দুই পর রাইতের সম[১০৮] তারা করিল গমন।
গাঙ্গনার পাড় গিয়া হইল উচাটন।৬
কেমন করিয়া দিব গাঙ্গিনা পাড়ি।
ঠাওর না করত পারে বহুত চিন্তা করি॥৮
সেই না রাইত রইল তারা জঙ্গলাত ছাপিয়া[১০৯]।
যত ইতি[১১০] সা করে পরধানীরা[১১১] মিলিয়া॥১০
কত সল্লা পরামিশ যাচ্কিয়া[১১২] যায়।
বুড়্যা গাড় তবে মনেতে ঠাউরায়[১১৩]॥১২
তিন কোশ দূরাত আছে ধনাইয়ের ঢালা[১১৪]।
গাঙ্গিনাও তার মাধ্যে কাট্যা আন নালা॥১৪
৮
এই সল্লা সকল গাড় মনেতে ধরিয়া।
সারা দিন জঙ্গলার মাধ্যে রইল ছাপিয়া॥২
আন্ধাইর হইলে তারা বাহির অইয়া আইলা।
বাইশ কাহন গাড় মিল্যা কাডে সেই নালা॥৪
পরেকের[১১৫] মাধ্যে নালা কাট্যা শেষ করিল।
কুদাল ধুইতে কাডে এত্তক্[১১৬] কুদাল মাটি।
তাতে সিরজন হইল ‘কুদাল-ধওয়া’ দীঘি॥৮
রাজার পুতরে ধইরা আন্ছে জঙ্গল বাড়ীর সরে।
আমোদে মাতুয়াল হইছে তিন দিন ধইরে॥১০
বাইশ কাহন গাড় এই না ছুতা পাইয়া।
ইছা খাঁর ভাওয়াল্যা[১১৭] যত লইল সাজাইয়া॥১১
কুঞ্জত খানা[১১৮] ঘর গিয়া দেখিল রাজারে।
বাইশ-মণী লোয়ার পাত্থর[১১৯] বুকের উপরে॥১৩
যতেকে ধরিয়া তবে পাত্থর লামাইল।
রাজারে ঘিরিয়া সবে পন্থে মেলা দিল॥১৫
ভাওয়াল্যায় উঠিয়া তবে দাড়[১২০] মাইল[১২১] টান।
শূন্যে উড়া[১২২] করে যেমুন পবন সমান॥১৭
তিন দিনের পথ যায় পরকেতে[১২৩] বাইয়া।
ইছা খাঁ লাগাল পায় আর কেমুন[১২৪] করিয়া॥১৯
.
টীকা
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন