দীনেশচন্দ্র সেন
নুরন্নেহা ও কবরের কথা
নূরুন্নেহা ও কবরের কথা পালাটি শ্রীযুক্ত আশুতোষ চৌধুরী ১৯২৮ সনে সংগ্রহ করেন। গানটি ৬৩২ পঙ্ক্তিতে সম্পূর্ণ। আশুবাবু সের আলি খাঁ নামক বড় উঠান গ্রামের জমিদারের নিকট প্রথম পালা গানটির সংবাদ পান। ‘বড় উঠান’ গ্রামটি দেওয়াং পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। সের আলি খাঁ হয়বৎ আলি নামক এক গায়কের কথা আশুবাবুকে বলেন। হয়বৎ আলির ডাক নাম ‘কাদিরের বাপ’ কিন্তু ইহাকে কোথায় পাওয়া যাইবে? এই গায়ক একটি আশ্চর্য্য লোক। নদী এবং সমুদ্রই তাহার বাড়ী। সে প্রায়ই চালা ঘরে থাকে না—জলেই আহার, জলেই শয়ন। বহু কষ্টে পেস্কারের হাট নামক গ্রামে আশুবাবু ইহার সাক্ষাৎ লাভ করেন। হয়বৎ আলির একখানি সাম্পান আছে। সে এখন বৃদ্ধ। আশুবাবু তাহার সাম্পান ভাড়া করেন। একটি ক্ষুদ্র নদীর পথে আট ঘণ্টা কাল হয়বৎ আলি এই পালা গানটি গাহিয়া গিয়াছিল। তাহার মাথায় একটা বেতের টুপি এবং সে দাঁড়ের দ্বারা তরঙ্গ অভিঘাত করিয়া গাহিবার সময় তাল ঠুকিতেছিল। বৃদ্ধ হইলেও তাহার কণ্ঠ কোকিলের ন্যায় মিষ্ট। নদীর দুই দিক্ হইতে কৃষকেরা সেই গান শুনিতে নৌকার কাছে আসিয়া জড় হইয়াছিল। হয়বৎ বলিয়াছে, “বাবু, এই নদী আমার বড় প্রিয়। ইহাই আমার এই গানের প্রধান রঙ্গশালা। এই গান গাহিয়া এই নদীর উপরে আমি যে কত কাঁদিয়াছি ও লোককে কাঁদাইয়াছি তাহার অবধি নাই। নূরুন্নেহা একটি পরীর ন্যায় আমার মন আকর্ষণ করে। জীবনের শেষদিন পর্য্যন্ত যেন এই গান করিতে করিতে আমি প্রাণত্যাগ করিতে পারি।”
সেই দেশের লোকেরা বলিয়াছে, “হয়বতের সুরলহরীর সহিত তাহারা আশৈশব পরিচিত। হয়বতের গান তাহদের জীবনের একটি প্রধান আনন্দোৎসব।”
শুধু হয়বৎ আলি নহে, আশুবাবু আরও কয়েকজন গায়কের নিকট হইতে এই গানটি শুনিয়া পালাটি সম্পূর্ণ করিয়াছেন। সেই সব গায়কের নাম নিম্নে দেওয়া গেলঃ—
১। কোতোয়ালী থানার অন্তর্গত চর-চাকতাই গ্রাম নিবাসী হাকীম খাঁ।
২। বোয়ালখালী থানার অধীন পূবদিয়া গ্রাম নিবাসী গুণা মিঞা।
৩। রাউজান থানার অধীন লোয়াপাড়া গ্রামের পৈথান চন্দ্র দে নামক এক কৃষক।
এই পালা গানটিতে নিম্নলিখিত স্থানগুলির উল্লেখ আছেঃ—
১। রঙ্গদিয়ার চর।—এই গ্রামটি দেওয়াং পাহাড়ের নীচে সুপ্রসিদ্ধ আনোয়ার গ্রামের নিকটবর্ত্তী। সম্ভবতঃ যখন গানটি বিরচিত হইয়াছিল, তখন রঙদিয়া সমুদ্রের একটা চর ছিল, এখন উহা নিকটবর্ত্তী উপকূলের সহিত মিশিয়া গিয়াছে।
২। দেওগাঁও।—দেওয়াং পাহাড়ের নিকট অবস্থিত। ১৭৬৪ সালে যখন চট্টগ্রামের জরীপ হয় তখন দেওগাঁও নয়টি প্রধান চাকলার মধ্যে অন্যতম ছিল। ইহা পূর্ব্বকালে একটি অতি প্রসিদ্ধ গ্রাম ছিল। এখনও এটি একটি বড় গ্রাম।
৩। পাঁচ গৈরা (পাঁচটি ঢেউ)—চট্টগ্রাম কক্সবাজারের উত্তর-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে একটি স্থান আছে, সেখানে একটি একটি করিয়া পাঁচটি প্রবল তরঙ্গ তটভূমিকে অভিঘাত করে। এই সফেন তরঙ্গগুলি পাঁচ সঙ্খ্যায় উপনীত হওয়ার পরে একটা বিরাম হয়। কয়েক মিনিট নিস্তব্ধ থাকিয়া পুনরায় একটি একটি করিয়া পাঁচটি ঢেউ পূর্ব্ববৎ সমুদ্র-উপকূলে পৌঁছায়। এইরূপ স্বাভাবিক ঘটনার কারণ কেহ খুজিয়া পান নাই।
৪। কালাপানি—চট্টগ্রামের দক্ষিণে অনেকটা পর্যটন করিলে সমুদ্রের মধ্যে একটা স্থান পরিদৃষ্ট হয় তাহ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। বস্তুতঃ নীলসমুদ্রের জল হঠাৎ কালীর বর্ণ ধারণ করিয়া সেই স্থানটিকে অতি ভীষণ করিয়া রাখিয়াছে। বহু জাহাজ ও নৌকা এই কালাপানির গর্ভে নিমজ্জিত হইয়াছে তাহার সংবাদ আমরা জানি।
৫। উজানটেক—চট্টগ্রাম কক্সবাজারের নিকট উজানটেক নামক একটি রেলষ্টেশন এখনও আছে। পূর্ব্বকালে পর্ত্তুগীজ ও ব্রহ্মদেশীয় জলদস্যুদের ইহা একটি প্রধান আড্ডা ছিল।
৬। লালদিয়া এবং সোণাদিয়া—এখনও এই দুইটি ক্ষুদ্র দ্বীপ মৎস্যব্যবসায়ের জন্য প্রসিদ্ধ। সম্প্রতি এই দুইটি দ্বীপকে চট্টগ্রাম জেলার অন্তৰ্গত করা হইয়াছে।
৭। ধান-চিবান্যা ও আণ্ডার চর—এই দুইটি স্থান এখন পর্যন্ত মৎস্যব্যবসায়ের জন্য প্রসিদ্ধ। ইহারা এখন বাখরগঞ্জ জেলার অন্তৰ্গত।
এই পালাগানটিতে হার্ম্মাদদের অত্যাচার সম্বন্ধে অনেক কথা পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের নিকটবর্ত্তী বঙ্গোপসাগরে এবং তাহার উপকূলে বহু পর্তুগীজ দস্যু ছিল তাঁহাদের সঙ্গে দেশীয় স্ত্রীলোকদের পরিণয়াদিও হইত। অনেক সময়েই ঐ দস্যুর দল বলপূর্ব্বক সুন্দরী দেশীয় রমণীদিগকে গ্রহণ করিত। ফলে তথায় একটি মিশ্র জাতির উৎপত্তি হয়। ইহারাই ফিরিঙ্গী। চট্টগ্রামের মাদারবাড়ী, ব্যাণ্ডেল, জামাল খাঁ, দেওয়াং, সাহামীরপুর, অলকারণ, গোমদণ্ডী, বজরা, বচিলিয়া, চাঙ্গাও প্রভৃতি স্থানে এখনও বহু ফিরিঙ্গী বাস করিয়া থাকে। ১৫৭৭ খৃষ্টাব্দে লিখিত কবিকঙ্কণ চণ্ডীতেই সম্ভবতঃ আমরা হার্ম্মাদ দিগের প্রথম উল্লেখ পাই। ইহাদের উৎপাতের কথা মুকুন্দরাম এই দুই ছত্রে লিপিবদ্ধ করিয়াছেনঃ—
“ফিরিঙ্গির দেশখান বাহি কর্ণধারে।
রাত্রি দিন বহি যায় হার্ম্মাদের ডরে॥”
আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে লিখিত আলোয়ালকৃত ‘পদ্মাবৎ’ কাব্যে এই হার্ম্মাদদের উৎপাতের অনেক কথা আছে। আলোয়ালের পিতা সম্সের জলপথে হার্ম্মাদগণ কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করেন। চট্টগ্রামের বহু প্রবাদে এমন কি বংশাবলীতেও এই জলদস্যুদের অত্যাচারের কথা পাওয়া যায়। আশুবাবু প্রাচীন এক বংশলতিকা হইতে এই দুইটি ছত্র প্রমাণ স্বরূপ উদ্ধৃত করিয়াছেন—
“ডাকু হার্ম্মাদের ডরে হেনকালে দেশে।
গোলাম, ধোপা, নাই বসাইল আশে পাশে॥”
ইহার অর্থ, ভদ্র লোকেরা জলদস্যু হার্ম্মাদগণের ভয়ে বাড়ীর আশে পাশে গোলাম, ধোপা, এবং নাপিত (নাই) দের বসাইয়া ছিলেন। শেষোক্ত বলশালী লোকেরা পল্লীর রক্ষক স্বরূপ উপনিবিষ্ট হইয়া ছিল।
সুজাবিলাপ পালাতেও আমরা এই হার্ম্মাদদের উল্লেখ পাইয়াছি। কিন্তু বোধ হয় এই পালাগানটিতেই হার্ম্মাদদের সম্বন্ধে কিছু বেশী বৃত্তান্ত পাওয়া যাইতেছে। হার্ম্মাদদের ভয় এত বেশী হইয়াছিল যে বাণিজ্যনৌকাগুলি অনেক সময়ে সমুদ্রপথে এক যাইতে সাহসী হইত না। বহু ডিঙ্গা একত্র হইয়া সমুদ্রে রওনা হইত। এই ডিঙ্গাগুলির মিছিল ‘বহর’ নামে পরিচিত। ডিঙ্গাস্বামীদের সর্ব্বাপেক্ষা সাহসী ও কর্ম্মঠ ব্যক্তির উপাধি ছিল ‘বহরদার’। তাহারই নির্দেশমতে সকলে পরিচালিত হইত।
এই নূরন্নেহা এবং কবরের কথা পল্লীসাহিত্যের একটি উজ্জ্বল রত্ন। ইহাতে একনিষ্ঠ প্রেমের যে নিদর্শন আছে তাহার তুলনা নাই। নূরন্নেহাকে আমরা মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ নায়িকাদের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে স্থান নাও দিতে পারি। যেহেতু সেই সকল চরিত্রে প্রেমের সঙ্গে উদ্ভাবনীশক্তি এবং নানা বুদ্ধির চাতুর্য্যের মিশ্রণ আছে। উক্ত চরিত্রগুলি কতকটা জটিল এবং খরপ্রতিভাশালী। কিন্তু নূরন্নেহা স্বভাবের শিশু। প্রেমই তাহার জীবন এবং তাহার বঁচিবার উপাদান ও অবলম্বন। শেষকালে কবর হইতে যখন অশরীরী দেহে সে জানাইল যে প্রকৃত প্রেমের ধ্বংস নাই, বিদেহ হইলেও প্রেম যায় না, তখন সেই সুরের অপার্থিব রেশ আমাদের কানে চিরদিনের জন্য লাগিয়া রহিল। শেষ অধ্যায়ে যেন স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীর মিলন হইল। একদিকে আজীবন নিষ্ঠার জীবন্ত মূর্ত্তি নূরুন্নেহা, আর এক দিকে শোকোন্মত্ত মালেক। ইহাকে দেখি, কি উহাকে দেখি তাহা ঠিক করা যায় না, উভয়েই এরূপ অতুল সুন্দর। এই পালাগানটিতে নানা প্রকার অমার্জ্জিত প্রাকৃত কথার বাহুল্য থাকা সত্ত্বেও আমরা বঙ্গদেশের যে পল্লীচিত্রটি পাইতেছি তাহা বাঙ্গলা মাটির খাটি জিনিষ। এখন আমাদের সাহিত্যে যে কৃত্রিমতা আসিয়া ঢুকিয়ছে, তাহার পার্শ্বে এই অকৃত্রিম চিত্রগুলি রাখিলে ইহাদের দর বোঝা যাইবে। মাঝিরা দাঁড় বাহিতে বাহিতে যে আকুল আবেগে সারি গান গাহিয়া যাইতেছে, তাহার প্রত্যেকটি পঙ্ক্তিতে উত্তেজনা বহিয়া আনে, এবং সমুদ্রগামী ডিঙ্গার চিত্র চোখের সামনে উপস্থিত করে।
মুসলমান-বিরচিত হইলেও পালাটি হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই প্রিয়। কবি বন্দনার সময়ে যে উদারতা দেখাইয়াছেন তাহা খুব বড় দার্শনিকের মত। তাঁহার এই উক্তিটি সুবর্ণ অক্ষরে লিখিত হইবার যোগ্য:―
“হিন্দু আর মুসলমান একই পিণ্ডের দড়ি।
কেহ বলে আল্লা রসুল কেহ বলে হরি॥
বিশমল্লা আর শ্রীবিষ্ণু একই গেয়ান।
দোফাঁক করি দিয়ে প্রভু রাম রহিমান॥”
কবি একদিকে পীর পয়গম্বরদিগের স্তুতি করিয়াছেন, অপরদিকে হিন্দুর দেবতা, বুড়া শ্রীমাই এবং ইছামতী নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবীকেও বন্দনা করিয়াছেন। এখনকার এই বিষপূর্ণ বিদ্বেষের হাওয়ার মধ্যে এই কথাগুলি অমৃতের প্রলেপের ন্যায়।
শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন
.
নুরন্নেহা ও কবরের কথা
(১)
বন্দনা[১]
চাইর দিক্ মানি আমি মন কৈল্লাম স্থির।
মাথার উপরে মানম্ আশী হাজার পীর॥১
আশী হাজার পীর মানম্ ন’লাখ পেকাম্বর।
শিরের উপরে মানম্ চাঁডিগার বদর[২]॥২
নাছিরাবাদেতে[৩] মানি সাহারে সোলতান[৪]।
দেশ বৈদেশ হৈতে আইসে মোমিন্[৫] মোছলমান॥৩
তার পরে মানি আমি ফকির সেখ ফরিদ।
নেজাম আউলিয়া মানম্ তান[৬] সাহারিদ[৭]॥৪
কাঁইচার[৮] মুখেতে মানি গেরাম বন্দর[৯]।
বটতলী মৌজায় মানম্ মোছনের[১০] কয়বর॥৫
ছড়াছড়ি[১১] মানি কহি ডলু[১২] সেতানলী[১৩]।
হাইত্যার[১৪] থম্থমি[১৫] মানম্ চুনতি[১৬] পাকলী[১৭]॥৬
চাষখোলা[১৮] গেরামে মানি মা বুড়া ছিরমাই[১৯]।
রাগন্যায়[২০] ইছামতী শিলক[২১] ঠাকুর ভাই।৭
হেঁদু আর মোছলমান একই পিণ্ডর[২২] দড়ি।
কেহ বলে আল্লা রছুল কেহ বলে হরি।৮
বিছমিল্লা আর ছিরিবিষ্টু[২৩] একই গোয়ান[২৪]
দোফাক্[২৫] করি দিয়ে পরভু রাম রহিমান॥৯
(২)
নাগরের উক্তি
“চৈতের চৈতালী[২৬] মিষ্টা কোয়িলার রাও।
এমনি কালে কেন তুমি এই পন্থে যাও?১
কার আশাতে একলা যাও নাকে দোলাই নথ।
আমার কথা কিছু তোমার উডেনি[২৭] মনত[২৮]?২
ধুয়া—ওরে পাক্লা মন রে।
বাঁধিলে বাঁধন না যায় মন এমন বৈরী
রাইত নিশিতে বিছানাতে ভাবি ভাবি মরি রে—
আমি ভাবি ভাবি মরি॥৩
বুগত[২৯] নাই রে পানির তিষ্ঠা পেডত[৩০] নাই রে ক্ষুধা
দিনে রাইতে তোমার কথা ভাবি আমি হুদা[৩১] রে—
হায়রে, ভাবি আমি হুদা॥৪
খানা পিনায় সুখ ন পাই রে চৌক্ষে নাই রে ঘুম।
রজাই[৩২] কেথা[৩৩] গায়ত দিয়া ন পাই রে উম[৩৪]॥৫
নছিব[৩৫] আমার ভালা রে আইজ নছিব আমার ভালা।
এম্নি কালে পন্থে তোমায় পাইলাম রে একেলা॥৬
লড়ে[৩৬] ভালা আঁচলখানি দক্ষিণালী বায়।
তোমার মিক্যা[৩৭] চাইতে আমার কৈল্লা[৩৮] ফাডি যায় রে—
আমার, কৈল্লা ফাডি যায়॥৭
ছিবাতলে[৩৯] টিবাটিবি[৪০] ছোডকালের[৪১] খেলা।
অখন[৪২] তুমি পাত্থর হৈয়া ভুলি কে’নে[৪৩] গেলা রে—
হায়, ভুলি কে’নে গেলা॥”৮
ফিরিয়া চাইলো কৈন্যা চাইলো ফিরিয়া
ধীরে ধীরে কয়রে কথা ঘোমটা টানি দিয়া।৯
(৩)
কন্যার উক্তি
“তোমার কথা মনে আমার উডে[৪৪] পৈত্য[৪৫] দিন।
তোমার মনর মাঝে পাইবা আমার মনর চিন[৪৬]॥১
ছাড়ি দেয়[৪৭] পন্থ এখন দেয় রে পন্থ ছাড়ি।
কেলা গাছর[৪৮] হেরত[৪৯] ওই আমার বাপর বাড়ী॥
যাইয়ো আমার বাপর বাড়ীত হৈয়ো মোছাফির[৫০]
মোরগের ছালন[৫১] খাইবা খাইবা দুধর ক্ষীর॥৩
খাইবা তুমি ভালামতে দিব আমি রাঁধি।
মায় বাপে রাজী হৈলে হৈব তখন সাদি॥”৪
কন গিরস্থর কৈন্যা রে এই কন বা দেশে ঘর।
পন্থের মাঝে দেখা হৈল কন বা এ নাগর॥৫
পরিচয় কথা কহি শুন বিবরণ।
সোর-গোল না করিয়ো যত সভাজন॥৬
(৪)
নুরন্নেহা
ওরে দেয়াঙের পাহাড়ের বিছে[৫২] বাহার দরিয়া[৫৩]।
নয়াচর পড়িল এক নাম রঙ্গদিয়া॥১
নয়াচরে নয়া বস্তি চারা চারা গাছ।
পেরাবনে[৫৪] জাগ্দি[৫৫] থাকে লৈট্যা[৫৬] রিশ্যা[৫৭] মাছ॥২
নয়াচরে বলা জবিন্[৫৮] দুনা[৫৯] হয় রে ধান।
নুনা মারার[৬০] ডরে মাইন্সে দিয়ে মাডির বান[৬১]॥৩
বলী[৬২] বলী গরু মৈষর গায়ত ভাসে তেল।
গড়্কি[৬৩] আর মড়্কি[৬৪] আইলে এক্কিবারে গেল॥৪
রংদিয়া চরেতে ভাইরে মাছে মানুষ খায়।
হাঙর কুমীর দৌঁড়ে বাহার দরিয়ায়॥৫
লৈট্যা রিশ্যা তাইল্যা[৬৫] ফাইস্যা[৬৬] কোড়াল[৬৭] বোয়াল।
চাঁদা[৬৮] ছুরি[৬৯] ইচা[৭০] বাইলা[৭১] মাছর টালাটাল[৭২]॥৬
ওরে কত জাইল্যা ঘর বাঁধিল রঙ্গদিয়ার চরে।
রোসাঙ্গ্যা[৭৩] খেত্যাল[৭৪] আসি বলা[৭৫] জবিন[৭৬] ধরে॥৭
রংদিয়ার চরেতে ভাইরে এম্নি মাডির বল।
কানি[৭৭] ভূঁইয়ে শতর উপর ধানের ফসল॥৮
পুগ কূলর থুন আসিয়ারে খেত্যাল আজগর[৭৮]।
রংদিয়ার চরেতে ভাইরে বাইন্ধে নয়া ঘর॥৯
নয়াঘর বাইন্ধ্যে খেত্যাল-উলু ছনর ছানি[৭৯]।
ছোড করি কাইট্যে পহির[৮০] ডাবর[৮১] মতন পানি॥১০
ক্ষেতি করে ক্ষেতিয়াল জবিন আউয়াল[৮২]।
‘হে-রা’ ‘তি’ ‘থি’[৮৩] ডাক দিয়া মৈষে জোড়ে হাল॥১১
এক কৈন্যা আছেরে তার নুরন্নেহা নাম।
দেখিতে সোন্দর যেন চান্নির সমান॥১২
হাতর মাঝে শির খারু[৮৪] আর কুলুপ দেওয়া তার।
পাড়াল্যা[৮৫] মা ভৈনে তারে বাহারি চাহার[৮৬]॥১৩
কৈন্যার ছুরত[৮৭] দেখি করে কাণাকাণি।
পরাণ কাড়িয়া লয়রে নথের ঢুলানী॥১৪
বুড়া ক্ষেতিয়ালের কৈন্যা উডন্ত[৮৮] যৌবন।
ক্ষেতে কাম করে দিলে[৮৯] খুশী হামিষ্কন[৯০]॥১৫
পর্ছিমে[৯১] সাইগরের ডাকে চৈতালীর বায়।
আপন যৌবন কৈন্যা ফিরি ফিরি চায় রে—
ফিরি ফিরি চায়॥১৬
এমনি কালে কি হইল শুন বিবরণ।
পুরানা বন্ধের[৯২] সনে হৈল দরশন॥১৭
ছোড কাইল্যা[৯৩] পিরীতি রে কাট্টলের[৯৪] আটা।
ছাড়াইলে ছাড়ন ন যায় এম্নি বিষম লেঠা রে—
হায়, এম্নি বিষম লেঠা॥১৮
ছোড কালের পিরীতি রে কোয়িলার রাও।
উতরি উতরি[৯৫] উডি[৯৬] কৈল্লাত[৯৭] মারে ঘাও॥১৯
ছোড কাইল্যা পিরীতি রে নারিকেলের তেল।
জমি আছিল শীতর রাইতে রৈদে উনাই[৯৮] গেল রে
রৈদে উনাই গেল॥২০
ছোড কালর পিরীতি রে গাঁজা ভাঙর নিশা[৯৯]।
যদি কখ্খন লাগত পাইলো ন থাকে রে দিশা॥২১
ছোড় কাইল্যা পিরীতির কহি বিবরণ।
কেমনে ভিজিয়া গেল দোন জনর মন॥২২
(৫)
মালেকের পূর্ব্বকথা
মালেক বঁধুর নাম দেওগাঁয় বাড়ী।
কচরগ্যা[১০০] জোয়ান মর্দ্দর মুখে চাপ দাড়ি॥১
বাঁইয়রাতে[১০১] রূপার তাবিজ বাঁধা রেশম দিয়া।
ওরে বয়স উতরি[১০২] গেইয়ে[১০৩] ন হৈল রে বিয়া॥২
মালেকের বাপ ছিল পাড়ার মাদবর[১০৪]।
দেওগাঁয় জাগা জবিন[১০৫] আছিল বহুতর॥৩
নাম তান[১০৬] নজু মিঞা মানুষ আছিল সোজা।
সরামতে[১০৭] নমাজ পৈত্ত[১০৮] পাইল্ত তিরিশ রোজা॥৪
হেপজ[১০৯] আছিল দিলে তান কোরাণ হদিজ।
ভালামতে কৈত্ত তিনি এন্ছাপ তরবিজ[১১০]॥৫
গোলা ভরা ধান আর পহির ভরা মাছ।
বাড়ীর পিছে বাগ বারিচা নানান পদর[১১১] গাছ॥৬
বালাম নুকা ভরিয়ারে শতে শতে ধান।
বেয়ার[১১২] করিত নজু কাঁইচার উজান॥৭
নছিব মন্দ হৈলরে ভাই নছিব হৈল মন্দ।
সোণামুখর হাসি খোদা কৈরা দিল বন্ধ॥৮
ফাউনে[১১৩] দরিয়া আউন[১১৪] উতলা বয়ার[১১৫]।
ধানর বোঝাই লৈয়া নজু কাঁইচা হয়রে পার॥৯
টেকে বাকে[১১৬] যায় রে নুকা বড় বিষম পারি[১১৭]।
উল্টা বয়ারে পড়ি পানির বাইরগ্যাবারি[১১৮]॥১০
বাইছা দিল নজুর বালাম ধানেতে বোঝাই।
ঘুরিতে লাগিল নুকা মাঝ দরিয়ায় যাই॥১১
পাছিলে[১১৯] বৈসাছে নজু নাই মানে হাল।
বাতাসের জোরে নুকার ফাডি গেলগই পাল॥১২
দড়ি কাঁছি ছিড়ি গেল রে নুকা টলমল।
গলই[১২০] উডিল উয়র মিক্যা[১২১] পাছিল পৈল তল[১২২]॥১৩
কন্তে[১২৩] গেলগই সেই না বালাম হাজার আড়ি[১২৪] ধান।
কাঁইচাতে ডুপিয়া নজু হারাইলা জান॥১৪
মাও নাই বাপও নাই, নাইরে সোদ্দর ভাই।
দাদী[১২৫] বিনে মালেকের ঘরে কেহ নাই॥১৫
আশী বছরের বুড়ী দুই আক্ত[১২৬] রাঁঁধে।
সাইগরে জোয়ার আইলে বুগ কুডি কাঁদে॥১৬
কাঁদে বুড়ী রাও ধরি শুনিতে অদ্ভুত।
হারি কুমরীর[১২৭] মত করে “হুত” “হুত”॥১৭
“জোয়ারে ন আইলি রে পুত ভাডায় ন আইলি।
কন হাঙরে কন কুমীরে মোর পুতরে খাইলি॥”১৮
নাতিরে লইয়া বুকে কাঁদিল রে দাদী।
“ছেমরা[১২৮] নাতিরে মোর ন করালি সাদি রে—
পুত ন করালি সাদি॥”১৯
আড়া পহল[১২৯] বুড়ীরে সেই পাড়া আউল[১৩০] করে।
পুতর শোকে কাঁদি কাঁদি গেল রে হায় মরে॥২০
(৬)
নুরন্নেহা ও মালেক
তারপরে কি হইল শুন রে খবর।
দেওগাঁয় বস্তি তখন কৈত্তরে আজগর॥১
নজুর সহিত তার ছিল আড়াআড়ি[১৩১]।
মধ্যে একখান ধানর কোডা[১৩২] ছাম্না ছাম্নি বাড়ী রে—
তারার ছাম্না ছাম্নি বাড়ী॥২
ওরে নজুর সহিত তার ন বনিত হায়।
সবুর করন সভাজন কৈব সমুদায়॥৩
ক্রেমে ক্রেমে কইব আমি কিস্তা[১৩৩] মজাদার।
পিরিত আছল[১৩৪] চিজ[১৩৫] দুনিয়ার মাঝার॥৪
একলা ঘরে থাকে মালেক আর কেহ নাই।
ভাত রাঁধি দিত নুর মাঝে মাঝে আই[১৩৬]॥৫
ছেমর[১৩৭] মালেকের লাগি ফাডি যায়রে বুক।
খেত্যাল[১৩৮] আজগর দিলে[১৩৯] পাইল বড় দুঃখ॥৬
ভুলিল আগের কথা ভুলিল সক্কল
মালেক করিল তার সাদা দিল দখল॥৭
মালেকের দুঃখে নুরের পুড়িত পরাণ।
লিপি মুছি দিত সদাই ঘর বাড়ী খান॥৮
মাডির কলসী ভরি আনি দিত পানি।
মালেকরে দেখিয়ারে ঘোমটা দিত টানি॥৯
আইজ যে দেখি ফুটা ফুল কাইল দেইখাছি কলি।
ওরে ভন ভনাইয়া উড়ের[১৪০] ভোমরা মধু খাইত বলি॥১০
কিসের ঘর কিসের বাড়ী কিসের রাঁধা বাড়া।
রশির টানে কশি’ কশি’[১৪১] পড়ি গেইয়ে[১৪২] গিরা[১৪৩]॥১১
আড় নয়ানে চাইল কৈন্যা আড় নয়ানে চাইল।
বিজলী চমকি যেন মেঘের কোলে ধাইল॥১২
পড়িল ঠাডার মাথায় পড়িল ঠাডার।
সোন্দরীর মিক্যা মালেক চাইলো বারে বার॥১৩
ওরে, পিরীতি এমন ধন গলিল মন
হৈল বিষম জ্বালা।
দিনে দিনে মালেকের শরীল হইল কালা॥১৪
চলে কৈন্যা সিনা[১৪৪] খুলি বুকে চুলি[১৪৫]
নয়ানে কাজল।
মাসুকে[১৪৬] করিল হায়রে আসকে[১৪৭] পাকল[১৪৮]॥১৫
পিরীতির এমন টান ওরে পরাণ নান[১৪৯]
করের ধড়ফড়।
লাজ সরম ন থাকেরে ন থাকেরে ডর॥১৬
পিরীতির সমান ধন তির্ভুবনে নাই।
মাইয়া মাইন্সর[১৫০] দিলে পিরীত খোদার পয়দাই[১৫১]॥১৭
ওরে বাড়ীর শোভা বাগ-বারিচা[১৫২]
ঘরর শোভা নারী।
কচরগ্যা[১৫৩] জোয়ানের শোভা
মুখে চাপ দাড়ী॥১৮
গাছর শোভা পাতা রে ভাই
পাতার শোভা ফুল।
মাথার শোভা সিঁথার সিঁদূর
কাণর শোভা দুল॥১৯
নাগর[১৫৪] শোভা সোণার নথ
দোলে ঘন ঘন।
সকল শোভার আছল[১৫৫] জাইন্য[১৫৬]
পিরীতে মিলন॥২০
পরথম পিরীত যেমন
তিয়াসীর[১৫৭] পানি।
শয়নে স্বপ্পনর মাঝে
পড়ে টানাটানি॥২১
চৌখে করে ঝিলিমিলি
পরাণে আন্ছান্।
হোতর[১৫৮] টানে কতই ক্ষণ আর
থাকে বালুর বান[১৫৯]॥২২
নুরন্নেহার মাও তারে নিত ঘরে ডাকি।
আদর করি খাবাই দিত তরমুজ খিরা বাঁকি[১৬০]॥২৩
মৈষর দই দিত আর কুশ্যালের[১৬১] মিডা[১৬২]।
দুধর সঙ্গে মিহাই[১৬৩] দিত পাক্কনের পিডা[১৬৪]॥২৪
থিল দুপরে[১৬৫] ক্ষেতিয়াল ক্ষেতে দিত মই।
মালেক যাইত পিছে হোঁক্কা বেনা[১৬৬] লই॥২৫
চিংড়ি মাছর ছালন[১৬৭] আর গিরিং চৈলর[১৬৮] ভাত।
মোচা[১৬৯] বাঁধি নিত খেত্যাল দিয়া কলার পাত।২৬
আইলর[১৭০] পাড়ত বসিয়ারে তারা দোন জন।
খুশী হৈয়া খাইতরে ভাত বাপ পুতর মতন॥২৭
যৌবন উট্টে বসন ফাডি[১৭১] ওরে কলসী কাঁকে লই।
চোগে চোগে চাহি নুর চলি যাইত গই॥২৮
ঘাঁডার আগাত[১৭২] তেতই[১৭৩] গাছটা তেতই বেকা বেকা।
হাঁজর[১৭৪] বেলায় যাইত মালেক পন্থে হৈত দেখা॥২৯
উডানেতে মৈয়া[১৭৫] গাড়ি গরু বৈলায়[১৭৬] নুর।
পহির[১৭৭] পাড়ত বসি মালেক বাঁশীত দিত সুর॥৩০
দিনেতে ঘুমায় মালেক নাইরে কেহ ঘরে।
হিতানে[১৭৮] বসিয়া নুর পাঙ্কা[১৭৯] করে রে॥৩১
লঙ্ এলাচি দিয়া পানর গোলাপী খিলি।
রৈস্যা ভৈনে[১৮০] খাবাই দিত ঘুমর থুন তুলি॥৩২
পরথম যৌবনের রূপ বাতাসে খেলায়।
ভাসিয়া চলিল মালেক প্রেম দরিয়ায়॥
৩৩
(৭)
তুফান
তুয়ান[১৮১] হৈল সেই না বছর খোদার গজব।
গড়কিতে[১৮২] ভাসাইয়া নিল ঘর বাড়ী সব॥৩৩
হাইল্যা[১৮৩] চাষার মারে জালা[১৮৪] পানির ঠেলা[১৮৫]
ধানের ঝারে ফুল।
ঢলের[১৮৬] পানিত মরে মানুষ হাঁচুরী[১৮৭] নাই কূল॥২
ভাসি গেলগই যত ক্ষেতি[১৮৮] —ফেন্যা, বেতি,
বীজমালি, বালাম।
চিন্নাল, গিরিং, বিনি[১৮৯] কত কৈব নাম॥৩
দেশের মাঝে হৈল কহর[১৯০] জীবন রাখা ভার।
দারুণ তুয়ান[১৯১] হায় কৈল্ল রে উজার॥৪
জলস্থল একাকার কৈল্ল মাওলাজি[১৯২]।
ঢলর পানিত ডুপি মৈল যত নায়র মাঝি॥৫
দেবায়[১৯৩] ডাকে হুরুম ধুরুম বিজলীর ছডক[১৯৪]।
দেশের মধ্যে কাণ্ড এক হৈল আচানক॥৬
হাড ঘাড[১৯৫] ভাসাই নিল ভাসাইল দোকান।
আলীমের[১৯৬] কোরাণ আর বারইর[১৯৭] নিল পাণ॥৭
তোয়াঙ্গরের[১৯৮] ধন নিল আর মাল মাত্তা।
জাইল্যার জাল জোলার তাঁত ধুপীর[১৯৯] নিল তক্তা॥৮
নাপিতের হঁজ[২০০] নিল কামারের ভাতি[২০১]।
উড়াই নিল গাছ গাছড়া তাল খেজুরের মাথি॥৯
শতে শতে মৈল মানুষ কারে কনে চায়।
ঘরর ঢালত ভাসি কেহ পৈল দরিয়ায়॥১০
গরু মৈল মৈষ মৈল তুয়ান হৈল ভারী।
ধানের দয় চড়িয়া হৈল টাকায় পাঁচ আড়ি[২০২]॥১১
কেহ বেচে স্তিরি পুত্র কেহ বেচে মাইয়া।
পেড ফুলিয়া মরে কেহ পাতা সিদ্ধ খাইয়া॥১২
আজগরের দুঃখের কথা কি বলিব আর।
ঘরে নাই রে খুদর কণা উয়াসে[২০৩] দিন যার॥১৩
ভিডাঁত নাই রে ঘরের ঠুনি[২০৪] আর নাই চাল।
গড়কিতে[২০৫] ভাসিয়া গেছে যত মালামাল॥১৪
মালেক কোথায় গেল নাইরে খবর।
তার লাগি বহুত দুঃখ পাইলরে অজগর॥১৫
জাগা জবিন পড়ি রইল ন হৈল রে চাষ।
গাঙে ভাসে বিলে ভাসে শতে শতে লাস॥১৬
হালর বিরিষ[২০৬] মৈরা গেছে—মৈরা গেছে গাই।
নাকল জুয়াল[২০৭] বীজর ধান ঘরে কিছুই নাই॥১৭
ভাবিয়া চিন্তিয়া আজগর কি কাম করিল।
রংদিয়া চরেতে যাইয়া উপনীত হইল॥১৮
নয়া চরে পানির মূলে জাগা জমির দাম।
এক দোণ[২০৮] পেরা[২০৯] আজগর পাইল ইনাম॥১৯
নজর ছাড়া জবিন পাইল আর পাইল গরু।
বীজর লাগি পাইল ধান দশ আড়ি লম্বরু[২১০]॥২০
রংদিয়া চরের মাঝে এমনি মাডির বল।
ছিঁডি[২১১] দিলে ফলে সেথায় ধানের ফসল॥২১
স্তিরি কৈন্যা লৈয়া আজগর থাকে রংদিয়ায়।
সুখে দুঃখে এক মতন দিন কাডি যায়॥২২
(৮)
পুনর্মিলন
বহুত জাগা ঘুরি মালেক আইলো তারপর।
নুরন্নেহার লাগিরে মন করে ধড় ফড়॥১
ছাড়া ভিঁডাত[২১২] নাইরে ঘর নাই জ্বলে বাতি।
আগের কথা ভাবিরে তার ফাডে বুগর[২১৩] ছাতি॥২
ঘুরিতে ঘুরিতে মালেক কি না কাম করে।
মোছাফির[২১৪] হৈয়া আইলে রংদিয়ার চরে॥৩
শুন শুন সভাজন কহিয়া জানাই।
আগের কথা কৈলাম কিছু ঘুরাই ফিরাই॥৪
এখন শুন আছল[২১৫] কথা নাল[২১৬] করিয়া কহি।
পিরীতে সাইগরে মালেক হাঁচুরি[২১৭] যারগই[২১৮]॥৫
ওরে তার লাগি নুরন্নেহার মনে আছে দাগ।
এক বছর পরে আইছ পাইয়ে বঁধের[২১৯] লাগ॥৬
পরছিমে সাইগরের মাঝে ঢেউয়ে খেলায় পানি।
ঘরে আর বাহিরে সুর করে আনি গুনি॥৭
হাঁজর[২২০] বাত্তি জ্বালাই দিল থির নহে মন।
মায়ে দিছে রাঁধিবারে নানান ছালন॥৮
মালেকের সঙ্গে কথা কহে বাপ মায়।
বেড়ার হেরেদি[২২১] নুর ফুইক্যা[২২২] মারি চায়॥৯
ন উডিল বিয়ার কথা ন উডিল কিছু।
মালেক ভাবিতে লাগিল মাথা করি নীচু॥১০
জিরবার[২২৩] আগাত আনিয়ারে ন কহিল আর।
ভিতরের আগুনে হায়রে কৈল্লা[২২৪] পুড়ি যার।১১
কৈল্লা পুড়ি যার রে তার কৈল্লা যার পুড়ি।
ভাবিতে ভাবিতে মালেক পড়ে ঝুরি ঝুরি[২২৫]॥১২
অজগর বলে “ওরে মালেক বাব্জান।
খাইয়া দাইয়া অখন চল লইরে বিছান[২২৬]॥১৩
হারা[২২৭] দিন ত খাও নাই, পেডত লাইগ্যে[২২৮] ভোগ[২২৯]।
ঠাণ্ডা পানি দিয়া আগে ধুইয়া ফেল চোখ॥”১৪
খাইতে বইলো[২৩০] দোন জনে ছাম্না ছাম্নি হই।
নুরন্নেহা আইলো তখন ভাতের বাছন[২৩১] লই॥১৫
বেতি[২৩২] চৈলর[২৩৩] চিয়ন[২৩৪] ভাত ধূমা[২৩৫] উড়ি যার।
নুরন্নেহার মিক্যা মালেক ঠাহারি[২৩৬] চাহার[২৩৭]॥১৬
পেডত ডিম্যা[২৩৮] তাজা রিশ্যা গায়ে গায়ে তেল।
গণ্ডা পাঁচেক মালেকের পাত্ত দিয়া গেল॥১৭
হাঁসর আণ্ডা রাইন্ধে ভালা নুন মরিচে কড়া।
পরুন[২৩৯] দিয়া তেলত্ ভুনি[২৪০] বানাই লৈছে বড়া॥১৮
লৈট্যা মাছর ঝোল আর মোরগের গোছ[২৪১]।
খাইয়া দাইয়া মালেকের মনে হৈল খোস॥১৯
নানান পদর[২৪২] নাস্তা[২৪৩] রাইন্ধে খানা হইল ভারী।
ছেমাই পিডা[২৪৪] খাইয়া মালেক বাছন দিল ছাড়ি॥২০
হোঁক্কা[২৪৫] আনি দিল রে নুর মালেক দিল টান।
বহুত দিনর পরে পাইল সেই না হাতের পাণ॥২১
শুইতে দিল ডেহেরিতে[২৪৬] শীতল পাডি পাতি।
কি ভাবে পোষাইয়া[২৪৭] যাইব এই না দীঘল রাতি॥২২
আধা রাইতে আওলাতে[২৪৮] শুইয়া পড়িল নুর।
চৌখে ঘুম ন আসিল বুগে দুরু দুর॥২৩
মনের মাঝে নানান কথা নানান ভাবে উঠে।
হরা[২৪৯] চাপা দিলে রে ভাত যেমন করি ফুটে॥২৪
“দহিনালী বয়ার[২৫০] ভালা কোয়িলার রাও।
নাইরকল তেল দি বাইন্লাম ঝোঁডা[২৫১] আইসা দেখি যাও॥২৫
ঘাঁডার আগাত ডালিম গাছটা লট্কি পড়ের আগা।
ছোডকালে পিরীতি করি ন দিও রে দাগ।॥২৬
লাউপাতা খস্খস্যা জাইন্য, পুঁই পাতা নরম।
বুগর আউন চাবা[২৫২] দিলা কন মত সরম॥”২৭
ভাবিতে ভাবিতে কৈন্যা হৈয়া গেল ফানা[২৫৩]।
অবুঝ মন কন মতে ন মানিল মানা রে—
ওরে ন মানিল মানা॥২৮
মাও ঘুমায় বাপও ঘুমায় ডাকে তারার নাক।
ঘরর বাহির হৈল কৈন্যা দুয়ার করি ফাঁক॥২৯
এক পাও চলে আগে আর এক পাও পিছে।
উতলা হৈয়াছে কৈন্যা দারুণ মাথার বিষে॥৩০
রাইতর নিশি হৈয়ে তখন ঘর বাড়ী নিঝুম।
চমকি উডিল মালেকের বুগ, চোখে নাইরে ঘুম॥৩১
বাহিরে আসিয়া দেখে নুরন্নেহা খাড়া।
দহিনালী[২৫৪] বাও আর আচমানে[২৫৫] জ্বলে তারা॥৩২
(৯)
জলদস্যু বা হার্ম্মাদগণ
রংদিয়ার পচ্ছিমেতে বেমান[২৫৬] সাইগর।
লাম্ছি[২৫৭] দিয়া বাড়ে সদাই নয়াবাদী চর॥১
ঢেউ করে বাইরগ্যাবারি[২৫৮] আসিলে জোয়ার।
কত গধু বালাম চলে নাইরে শুমার[২৫৯]॥২
সেই না সাইগরের মাঝে হার্ম্মাদ্যার[২৬০] দল।
বাঁকে বাঁকে ঘুরে সদাই বড় বেয়াকল[২৬১]॥৩
লুড্তরাছ[২৬২] করে তারা আর দাগাবাজি।
সাইগরে হার্ম্মাদ্যার ডরে কাঁপে নায়র[২৬৩] মাঝি॥৪
পাঁচগৈরা[২৬৪] ছাড়িয়া গেলে ওরে পাঁচগৈরা ছাড়ি।
বেমান সাইগরের মাঝে কালা পাইন্যার পারি॥৫
মুড়ার[২৬৫] সমান ঢেউ বাতাসে খেলায়।
ওরে উপরে তুলিয়া নুকা নীচেতে ফেলায়॥৬
দম্কা হাওয়া ছুটে যখন দম্কা হাওয়া ছুটে।
পাঁচগৈরার বিষম ঢেউ আচমান ছুইয়া উঠে॥৭
বেমান সাইগর সেই যে কালা কালা পানি।
শরর[২৬৬] বালাম[২৬৭] চলি যাইতে পরাণ টানাটানি॥৮
কালা পাইন্যা পার হৈতে বড় বিষম ঢেউ।
পীরের নামে হাজার টাকা ছিন্নি[২৬৮] মানে কেউ॥৯
হেঁদু[২৬৯] ডাকে ‘জয়কালী’ মঘে ডাকে ‘ফরা’[২৭০]।
এইবার পর্ভু নিরাঞ্জন সঙ্কটেতে তরা॥১০
এই না পারি পার হৈলে ঠাণ্ডা যে সাইগর।
পূগর কূলে দেখা যায়রে নয়া নয়া চর॥১১
ওরে নয়াচরে ধূ ধূ বালু গাছ বিরিক্ষ নাই।
হার্ম্মাদ্যার কথা এখন শুন কিছু ভাই॥১২
উজান টেকের[২৭১] বাঁকে রে সেই উজান টেকের বাঁকে।
দলে দলে যত ডাকু খাপ্দি বসি থাকে॥১৩
বৈদেশে কামাইয়া আসে যত সদাইগর।
বাওটা[২৭২] তুলিয়া দেরে ডিঙ্গার উপর॥১৪
দুরন্ত হার্ম্মাদ্যার ডাকু কিনা কাম করে।
তেলেছ মাতি[২৭৩] নাওরে তারার পঙ্কীর মতন উড়ে॥১৫
পরাণের লালছ[২৭৪] নাইরে বড়ই জাহিল[২৭৫]।
সাইগরে লড়িতে[২৭৬] তারা না হয় কাহিল[২৭৭]॥১৬
লুড্তরাছ করিয়া রে ডিঙ্গা যে ডুপাইত।
মাঝি মাল্লায় বাঁধিয়ারে সঙ্গে করি নিত॥১৭
এই না সময় হায় রে শুন সভাজন।
মালেক নুরের কিছু কহি বিবরণ॥১৮
পিরীতির রসেতে তারা ভাসে দিন রাইত।
রংদিয়া আইল একদিন হার্ম্মাদ্যার ডাকাইত॥১৯
কাঁদিতে কাঁদিতে আজগর ভাঙি ফেলায় বুক।
ঘরেতে পর্বেশিল ডাকু খুলিল সিন্দুক॥২০
টাকা কড়ি ছিল যত সব লৈল লুডি[২৭৮]।
নুরন্নেহা কাইন্ত লাগিল মাথা কুডি কুডি॥২১
দুরন্ত হার্ম্মাদ্যার ডাকু কিনা কাম করে।
কৈন্যারে বাঁধিয়া লৈল কাঁধের উপরে॥২২
মালেকরে লৈল তারা হাতে পায়ে বাঁধি।
দুলা[২৭৯] কৈন্যা লৈল সঙ্গে করাইব কি সাদি?২৩
কাঁদিতে লাগিল হায়রে বুড়া ক্ষেতিয়াল।
সুখের সংসার তার হইল বেনাল[২৮০]॥২৪
আওরাত কাঁদে তার বুগ্ত[২৮১] কিল দিয়া।
“কন্তে[২৮২] আমার কৈন্যা নুর, ওরে কনে[২৮৩] দিব বিয়া॥”২৫
(১০)
চড়াভূমিতে হাঙ্গামা
হার্ম্মাদ্যার নুকারে সেই ঢেউয়ের তালে তালে।
চিল-উড়ানি[২৮৪] উড়ের নুকা বাতাস লাইগ্যে পালে॥১
বেহোঁস[২৮৫] হৈয়াছে কৈন্যা কাঁদিয়া কাঁঁদিয়া।
নুকার ডেরায়[২৮৬] তারে রাইখাছে বাঁধিয়া॥২
বেপরদা রৈয়ে কৈন্যা অঙ্গে নাইরে বাস।
মাথার চুল কৈল্ল আউল[২৮৭] দারুণ বাতাস॥৩
মালেকরে দিয়া তারা পিছমোরা বান[২৮৮]।
হাতের দরদে তার নিকলি[২৮৯] যার জান[২৯০]॥৪
ওরে কৈন্যার ছুরত[২৯১] দেখি ডাকুর ছরদার[২৯২]।
মালেকের কাছে যাইয়া পুছে সমাচার॥৫
“ছুরতের বাহার কৈন্যা তোর হয় রে কি।
কন্[২৯৩] দেশে শ্বশুরের ঘর কন বা বাপর ঝি॥”৬
চাহিয়া রহিল মালেক মুখে নাইরে রাও।
ডাকুর ছরদার তখন হাতে লৈল দাও[২৯৪]॥৭
আতাইক্যা[২৯৫] মা বুলি নুর উঠিল জিঙ্কারি[২৯৬]।
ঝাপ্টাইন্যা[২৯৭] বয়ারে[২৯৮] গেল পালর দড়ি ছিড়ি॥৮
বেমান সাইগরে নুকা দিতে লাগিল পাক।
যুরিতে ঘুরিতে পাইল বালুচরের লাক[২৯৯]॥৯
গাছ গাছড়া নাইরে সেই ধূ ধূ বালুর চরে।
কয়েকজন জাইল্যা তথায় সাইগরে মাছ ধরে॥১০
রাঙা সুরুজ[৩০০] ডুপে[৩০১] তখন কালাপানির তলে।
জাইল্যার নুকায় ডাকুরা সব উডিল দলে বলে॥১১
কেহ জ্বাইল্যে ভাতর আউন[৩০২] কেহ কুডের[৩০৩] মাছ।
এমন সময় তারার মাথাত পৈল বাজ॥১২
কেহ লৈল পালর বাঁশ, কেহ লৈল পঁই[৩০৪]।
কেহ কেহ উজাইল[৩০৫] ধামা দাও[৩০৬] লই॥১৩
ডাঙ্গার[৩০৭] শুরু হৈলরে সেই ধূ ধূ বালুর চরে।
কারো মাথা ফাড়ি গেলগৈ, কেহ গেল মরে॥১৪
জাইল্যার মধ্যে একজন বয়সে সেই বুড়া।
তড়াতড়ি আইন্লগই মরিচের গুঁড়া॥১৫
মরিচের গুঁড়া আনি কি কাম করিল।
মুট করি ডাকাইতের চোগে মেলা দিল॥১৬
ভোম খাইয়া[৩০৮] পড়ে ডাকাইত বালুর উপর।
জাইল্যারা সব কি না কাম করে তার পর॥১৭
একে একে বাইন্ল ডাকু পালর রশি দিয়া।
কেহ মারে থাবা[৩০৯] চোয়ার[৩১০] কেহ মারে ডিয়া[৩১১]॥১৮
হার্ম্মাদ্যার ডাকাইত বাঁধি যত জাইল্যাগণ।
তর্বিজ[৩১২] করিতে তারা ভাবে মনে মন॥১৯
কয়জন মিলি তারা করিলরে ছল্লা[৩১৩]।
দাও দিয়া কাটি লৈতে যত ডাকুর কল্লা[৩১৪]॥২০
কেহ বলে তারার গলায় পাথর বাঁধিয়া।
বেমান দরিয়ার মাঝে দাও ডুপাইয়া॥২১
এইরূপে নানান জনে নানান কথা কয়।
ডাকুর নুকাত[৩১৫] থাকি মালেক শুনিল সমুদয়॥২২
রাও ধরি[৩১৬] কাঁদে মালেক কাঁদেরে রাও ধরি।
জাইল্যা ক’ জন উজাল[৩১৭] লৈয়া আইলো তড়াতড়ি॥২৩
মালেকের আবস্থা দেখি খুলি দিল বান।
আদিগুরি[৩১৮] যত কথার লইল সন্ধান॥২৪
লড় চড় নাইরে কৈন্যার ঢলি পৈড়্গ্যে মাথা।
খুলিয়া দেখিল মালেক দুই নয়ানের পাতা॥২৫
উলটি রৈয়াছে তারা ন পড়ের পলক।
বুগেতে পরাণ নাই করের ধক্ ধক্॥২৬
দুই পাও ঠাণ্ডা হায় রে ঠাণ্ডা দুই হাত।
পড়িয়া রৈয়াছে কৈন্যা ভিড়ি[৩১৯] দাঁতে দাঁত॥২৭
সকলে মিলিয়া তারা কি কাম করিল।
জাইল্যার নুকার[৩২০] মধ্যে কৈন্যারে আনিল॥২৮
কেহ দে মাথায় পানি কেহ বিচে[৩২১] গাও।
মালেক বলিল—“ভৈন রে আমার মিক্যা চাও॥২৯
গা তোল[৩২২] গা তোল ভৈন উড[৩২৩] একবার।
রংদিয়ার চরেতে চল যাই এইবার॥৩০
উডরে উডরে আমার পুন্নমাসীর[৩২৪] চান[৩২৫]।
কনে[৩২৬] খাবাই[৩২৭] দিব[৩২৮] মোরে খিলি খিলি পান॥৩১
হোঁক্কাতে[৩২৯] সাজাইয়া থামু[৩৩০] কনে দিব আনি।
গরমিকালে কনে দিব সরবতের পানি॥৩২
গা তোল গা তোল আমার আঁধার ঘরর বাতি।
কনে মোরে দিব আর শীতল পাডি[৩৩১] পাতি॥৩৩
রংদিয়াতে যাইব রে ভৈন তোরে সঙ্গে লই।
নয়া হাড়িত বোসাইয়ে মা খামা খামা[৩৩২] দই॥৩৪
কুড়ার[৩৩৩] ঘরত আণ্ডার উয়র[৩৩৪] রাতায়[৩৩৫] দেরে উম[৩৩৬]।
রংদিয়ায় চলরে নুর ভাঙি ফেল ঘুম॥”৩৫
এই না মতে কাঁদে মালেক চোগে পানি ঝরে।
কৈন্যারে লইয়া তারা পৈড়গ্যে[৩৩৭] বিষম ফেরে॥৩৬
বুড়া জাইল্যা কিনা কাম করে তড়াতড়ি।
বাট্টা[৩৩৮] খুলি বাহির কৈল্ল বায়ু রোগর বড়ি॥৩৭
চৈলর[৩৩৯] পানির সঙ্গে মিশাই কৈন্যারে খাবায়।
ঠাণ্ডা পানির ছিট্কা[৩৪০] দিল চোগের পাতায়॥৩৮
এই দিকে ডাকাইত্যার দল করে হুড়াহুড়ি।
বাঁধন ছিঁড়িল তারা দাঁতেতে কামড়ি॥৩৯
একজন মুক্ত হইয়া করে কিনা কাম।
ধীরে ধীরে খুলি দিল সকলের বান॥৪০
ভূতা গোঁয়ার[৩৪১] জাইল্যারে সেই ন জানে হের ফের[৩৪২]
বাঁধন ছিঁড়ি ডাকাইত ধাইল ন পাইল রে টের॥৪১
আধা রাইতে চান্নি উডিল আচমানের উপর।
নুরের লাগিয়া মালেক করে ধড় ফড়॥৪২
কোলেতে লইয়া মাথা করিছে বীজন।
নাগেতে শোয়াস যেন পড়ে ঘন ঘন॥৪৩
জোন পহর পৈল মুখে দহিনালী বায়।
গা মোচরা দিয়া কৈন্যা চোগ মেলি চায়॥৪৪
উডিয়া বসিল নুর মুখে ফুডিল মাত[৩৪৩]।
পানি দি কচালি[৩৪৪] তারে খাইতে দিল ভাত॥৪৫
মা বাপর কথা কৈন্যা করিল রে পুছ[৩৪৫]।
একে একে কহি মালেক দিতে লাগিল বুঝ[৩৪৬]॥৪৬
বেমান দরিয়ার মাঝে ধূ ধূ বালুর চর।
পাতার ছানি পাতার বেড়া সেই না জাইল্যার ঘর॥৪৭
রৈল তারা দোনজনে চৌখে নাইরে ঘুম।
সাইগরে খেলায় ঢেউ রাইত হৈল নিঝুম॥৪৮
মাছে যেন পাইলো পানি পানিয়ে পাইলো গাঙ[৩৪৭]।
লাউ ঝিঙার লতা যেন পাইলো বাঁশের চাঙ[৩৪৮]॥৪৯
ভিখারীয়ে পাইলো যেন সোনা ভরি ভরি।
ইছপ রে[৩৪৯] পাইলো যেন জেলেখা[৩৫০] সোন্দরী॥৫০
(১১)
রংদিয়ায় প্রত্যাবর্ত্তন
পরের দিন জাইল্যাগণ যুক্তি করি সার।
সাজাইয়া নুকা তারা হয় রে সাইগর পার॥১
বড় বড় গধু নুকার বড় বড় পাল।
শুক্না মাছর বোঝাই লৈল আর যত মাল॥২
কেউ বাজায় বাঁশর বাঁশী কেউ ফুকে শিঙা।
নাচিতে নাচিতে আসে বোঝাই গধু ডিঙা॥৩
বেমান দরিয়া সেই যে বড় বিষম পারি।
কেহ ধরে ঘোসা[৩৫১] আর কেহ গায় সারি॥৪
সারিগান
ওরে— পুষ মাস্যা শীতর কাল,
আঁচুরি[৩৫২] বাইলাম টেঁইয়া জাল[৩৫৩],
করণখালির দক্ষিণ দি[৩৫৪]
বোসাই আইলাম বিহন-দি[৩৫৫]
জালত বাজিল ইচা বাইলা কোড়াল বোয়াল।
(ধুয়া)— পুষ মাস্যা শীতর কাল॥৫
ওরে— বেইন জাল[৩৫৬] বেসাইলাম রাইতে
দেরী হইল খাইতে চাইতে
ধানচি বন্যা[৩৫৭] আণ্ডার চর[৩৫৮]
হেই জাগাত[৩৫৯] মাছর ঘর
কত রৈল কত ধাইল কত দিল ফাল[৩৬০]।
(ধুয়া)— পুষ মাস্যা শীতর কাল॥৬
ওরে— উজান ভাঙি নুকা বাইয়া
আইলুম রে বিদেশী নাইয়া
লালদিয়ার[৩৬১] নয়া চর
ঢেউ উডিলে বড় ডর
হেই চরেতে জাইন্য ভাইরে মাছর টালা টাল।
(ধুয়া)— পুষ মাস্যা শীতর কাল॥৭
ওরে— সোনাদিয়ার[৩৬২] উত্তর বাঁকে
তাইল্যা[৩৬৩] ফাইস্যা[৩৬৪] জাগ্দি থাকে
আর থাকে বড় বড় ছুরি[৩৬৫]
ওরে ভাই মছির হুড়াহুড়ি
মাছে করে টানাটানি ফাড়ি ফেলায় জাল।
(ধুয়া)— পুষ মাস্যা শীতর কাল॥৮
এইরূপে তিন দিন গোজারিয়া[৩৬৬] যায়।
জাইল্যার যত গধু নুকা আইলো রংদিয়ার॥৯
কৈন্যারে লইয়া সঙ্গে মালেক সুজন।
আজগরের ছাম্নে যাইয়া দিল দরশন॥১০
কাঁদি বুড়া মালেক রে ধরিল বেড়াই।
দোন চোগর পানি পড়ে গড়াই গড়াই॥১১
নুররে লইয়া বুকে মা জননী তার।
সোণামুখে মুখ দিয়া চুম্পে বারে বার॥১২
গাঙ না হাঁছুরি[৩৬৭] তারা পাইলো কুলর মাডি।
আঁধায় পাইলো যেন হাজাইয়া[৩৬৮] লাডি[৩৬৯]॥১৩
(১২)
রহস্য ভেদ
আউনে[৩৭০] উনায়[৩৭১] ঘিও[৩৭২] যদি কাছে থাকে।
ছাড়াই দিতে ন পারেরে যদি পিরীত পাকে॥১
নুনা পানি ছাকি লৈলে ন যায় রে নুন।
দিনে দিনে বাড়ে পিরীত এম্নি তার গুণ॥২
পাষাণের দাগ পিরীত মনে পৈলে আঁকা।
যত না গোপনে হৌক রে ন থাকিব ঢাকা॥৩
আজগর বুঝিল সেই মালেকের গতি।
মায় বাপে বুঝিল রে নুরন্নেহার মতি॥৪
একদিন হাঁজর বেলা[৩৭৩] সুরুজ পাটে যার[৩৭৪]।
মালেক রে লৈয়া বুড়া আইলো সাইগর পার॥৫
আদর করি কৈল[৩৭৫] তারে “শুন রে বাবজান।
তোমারে জাইনাছি আমি পুতের সমান॥৬
এক কথা কহি এখন শুনরে মন দিয়া।
নুরন্নেহা কৈন্যারে মোর ন করিয়ো বিয়া॥৭
নাইরে জান আগের কথা রৈয়াছে গোপন।
তোমার বাপ নজু মোরে ভাইবত রে দুষমন॥৮
তোমার বাপের সাদি হৈল কত রে ধূমধাম।
বজ্জাতি করিয়া কনে[৩৭৬] রটাইল বদনাম॥৯
লাহানতি[৩৭৭] হৈল কত তুমি হৈলা ঘরে।
তোমার মারে তোমার বাপ তেলাক দিলা পরে॥১০
বহুত কাঁদিল আওরাত কপাল তার ভাঙা।
আমার ঘরে আইল যখন আমি কৈল্লাম হাঙা[৩৭৮]॥১১
দেওগাঁ মুল্লুকে তখন ন পাইলাম আছান[৩৭৯]।
সেই কথা মনত পৈলে ফাডি যায়রে জান॥১২
মাহালতের[৩৮০] যত মানুষ হৈল আমার বৈরী।
গোলাত নাই রে ধান আমার গিরাত[৩৮১] নাই রে কড়ি॥১৩
যত দুঃখ পাইলাম আমি কি না কইব আর।
আউনের মাঝে পানি, তোমার মা, আমার[৩৮২]॥১৪
দুনিয়া ঠগের জাগা কেবল মিছা ফাঁকি।
তোমার বাবজান চলি গেলা, আমি রৈলাম বাকী॥১৫
মাড়ির তলের বিছান লাগি ভাবি রে দিন রাইত[৩৮৩]।
কখ্খন খাইট্যম[৩৮৪] দোন চোগ আর কখন হৈয়ম কাইত॥১৬
এই যে নুরন্নেহা আমার পরাণের পোতলা[৩৮৫]।
তোমার ভৈন হয় রে সেই আমার বুগর নলা[৩৮৬]॥১৭
তুমি রে পুত ন ভাবিও আমারে বেগানা[৩৮৭]।
মার পেডের ভৈন রে বিয়া সরামতে[৩৮৮] মানা॥”১৮
বসিয়া পড়িল মালেক এই কথা শুনিয়া।
আচমান ভাঙি পৈল যেন কাঁপিল দুনিয়া॥১৯
দুই চোগ হৈল থির কালা হৈল মুখ।
পাত্থরর চাবত যেন ভাঙি যারগই বুক॥২০
আঁধার ঘনাইয়া আইলো সাইগর ডাক ছাড়ে।
পাল তুলি আইসের নুকা দক্ষিণা বয়ারে[৩৮৯]॥২১
বুড়া বলে “চল মালেক এখন ঘরে যাই।”
মালেক বলিল “আমি ক্ষাণেক বাদে আই॥”২২
ঘরে গেল বুড়া খেত্যাল ন বুঝিল ফের[৩৯০]।
ফিরি যাইতে কৈল আবার “ন করিও দের॥”২৩
রাঁধিয়া বাড়িয়া নুর হৈল রে অবসর।
আতাইক্যা[৩৯১] তাহার বুক করের ধড়ফড়॥২৪
বাপে খাইলো মায় খাইলো মালেক ন আইলো।
সাইগরের কিনারে হায় কনরে ভূতে পাইলো॥২৫
ঠাণ্ডা হৈল হাইলের[৩৯২] ভাত আর ফাণ্ডা[৩৯৩] মাছার ঝোল।
ভাবিতে ভাবিতে নুরর মাথা হৈল গোল[৩৯৪]॥২৬
একবার উডে কৈন্যা আরবার বসে।
ঝুরিয়া ঝুরিয়া[৩৯৫] পড়ে ঘুমের আলসে॥২৭
আধা রাইতে চেতন পাইয়া খেত্যাল আজগর।
কৈন্যারে ফুইদ[৩৯৬] কার জানিল খবর॥২৮
ঘরে ন আইল মালেক রাইতে গেল কোথা
পোলাইল কি পরর পোলা আড়াকাড়া[৩৯৭] তোতা॥২৯
উজাল[৩৯৮] লইয়া বুড়া পন্থের বাঁকে বাঁকে।
মালেকের নাম ধরি চিক্কির[৩৯৯] ছাড়ি ডাকে॥৩০
হারা[৪০০] রাইত ঘুরিল রে পাড়ায় পাড়ায়।
রংদিয়ার পত্তি[৪০১] ঘরে তোয়াই তোয়াই[৪০২] চায়॥৩১
সেই না নিশিতে মালেক কি কাম করিল।
ঘাটের কিনারে আসি বসিয়া পড়িল॥৩২
ধীরে ধীরে আইলো তখন বালাম নুকা এক।
ভাবিয়া চিন্তিয়া তথায় উডিল মালেক॥৩৩
মাল্লাগিরী কাম লৈল মালিকরে কৈয়া।
ঘরেতে কাঁদিছে নুর ভাতর বাছন[৪০৩] লৈয়া॥৩৪
সাইগরে জোয়ার হৈল পানি উডিল ফুলি।
উত্তর মিক্যা ছুডিল নুকা জুইতর পাল তুলি॥৩৫
(১৩)
শেষ দৃশ্য
কৈন্যারে সিরজিলা পর্ভু ন সির্জিলা জোরা[৪০৪]।
শুকানা হইল ফুল ন আইল ভর্মরা।১
দুনিয়া সিরজিল পর্ভু কেবল আঙ্খির পল[৪০৫]।
পদ্দ পাতাত[৪০৬] পানি যেমন করে রে টলমল॥২
নুরন্নেহা কৈন্যা রে সেই পৈড়াছে বিমারে।
কনে[৪০৭] বুলায় মাথাত হাত কনে ডাকে তারে॥৩
কনে দে বিছান পাতি কনে দে দাবাই[৪০৮]।
এক ফোডা পানি দিত[৪০৯] ঘরে কেহ নাই॥৪
গুটি উডি[৪১০] মৈল[৪১১] মা বাপ দুই দিন আগে।
মাইনসর কি ক্ষেমতা যদি খোদা পিছে লাগে॥৫
কৈন্যারও হৈয়াছে গুটি মত্ত ত[৪১২] হাজির।
মালেকের কথা ভাবি হৈল রে অস্থির॥৬
দেখা ন হৈল রে আর ন পূরিল আশা।
মন মনুরা[৪১৩] দিল উড়া ছাড়ি আপন বাস৷॥৭
পাঁচ না বছর পরে মালেক সদাইগর।
রংদিয়া চরেতে আইলো মস্ত তোয়াঙ্গর[৪১৪]॥৮
বাহার করি আইস্যে মিঞা লৈয়া নানান মাল।
ষোল দাড়ের চলতি নুকা (তার) নয়া রঙীন পাল॥৯
রংদিয়াতে আসি মালেক কি কাম করিল।
আজগরের বাড়ীতে যাইয়া উপনীত হৈল॥১০
নাইরে সেই ঘর বাড়ী নাইরে বুড়া আর।
নাইরে সেই নুরন্নেহা নাইরে মাও তার॥১১
পাড়াল্যারে[৪১৫] পুছ ক’র্যা[৪১৬] জানি লৈল[৪১৭] সব।
গুটি উডি মৈল সবাই খোদার গজব[৪১৮]॥১২
আগে মৈল মা-জননী পিছে মৈল বাপ।
তার পরে মৈল কন্যা বাড়ী হুদ্দা[৪১৯] ছাপ[৪২০]॥১৩
মালেকের চোগর পানি ন মানিল বান।
বুগর মধ্যে আনছান[৪২১] পুড়িল পরাণ॥১৪
তদান্ত করিয়া বহুত পাইলো খবর।
সাইগরের পারত হৈয়ে তিনটা কয়বর॥১৫
তড়াতড়ি যাইয়া মালেক কি না কাম করে।
শুইয়া পড়িল এক কয়বরের উপরে॥১৬
দিন গেল আইলো রাইত হোঁস[৪২২] নাই তার।
রাইতর শেষে কাণ্ড এক হৈল চমৎকার॥১৭
কাঁপিল কাঁপিল মাডি থর থর থর।
নুরন্নেহা কয় কথা কয়বরের ভিতর॥১৮
“শুনরে পরাণের ভাই ন করিও দুঃখ।
হিতানেতে[৪২৩] একবার আনো তোমার মুখ॥১৯
গায়ে নাইরে গোস্ত আমার লৌ আর শিরা।
ভুলি নাইরে তোমার কথা খুলি নাইরে গিরা[৪২৪]॥২০
খুলিত নাই গিরারে ভাই রইয়ে মনর বান[৪২৫]।
মত্ততেও[৪২৬] হামিষ্খন কাঁদে পরাণ নান॥২১
শুনিয়া কয়বরের কথা মালেক দেওয়ানা।
এন্তেকালের[৪২৭] পিরীতেও মন মানে না মানা॥২২
এক দুই তিন করি চাইর দিন যায়।
চোগের পানিতে মালেক কয়বর ভিজায়॥২৩
ক্ষুধা তিষ্টা কিছুরে তার নাইরে মালুম।
অলড়[৪২৮] পড়িয়া রৈছে কণ্ডে[৪২৯] চোগত ঘুম॥২৪
দাঁড়ি মাঝি আসি সবে কৈল্ল টানাটানি।
ন খাইলরে দানা আর ন খাইলরে পানি॥২৫
ষোল দাঁড়ের বালাম নুকা নয়া রঙীন পাল।
নানান দেশী বেসাইত আর নানান পদর[৪৩০] মাল॥২৬
ফিরিয়া ন চাইল মালেক ন চাইল রে ফিরি।
কণ্ডে গেল গই ধন দৌলত কণ্ডে মিঞাগিরী॥২৭
পরছিম সাইগরের মাঝে উজান ভাডি[৪৩১] বাহি।
মাঝি মাল্লা যায় রে সদাই বাইছার[৪৩২] সারি গাহি॥২৮
চাইয়। দেখে পাগ্লা মালেক চাইয়া দেখে দূরে।
আর কখ্খনো কয়বরের চাইর[৪৩৩] দিকেতে ঘুরে॥২৯
কি এক ভাবনা ভাবে মুখে নাইরে বাত।
ছিড়া কাপড় ছিড়া কোর্ত্তা[৪৩৪] টুবি[৪৩৫] নাই মাথাত॥৩০
.
টীকা
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন