৮. মোক্তারদের কারনামা

মোক্তারদের কারনামা

আদালতে দেখবেন ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল খাবিশ। আলবাত আমি সেই মোক্তার আর উকিলদের কথা বলছি যাদের না আছে তালিম না আছে কানুনি এলেম। এরা স্রেফ টিকে আছে লোকেদের মধ্যে ঝগড়া আর ফইজত বাধিয়ে। কানুন-ই-সরকারের গলত নজির আওড়ানো বা নিজামত আদালতের সার্কুলার, চিঠি বা বয়ানের কনট্রাকশন (contraction)-র কথা জাহির করে মক্কেলদের ভড়কানোটাই হল এদের কাজ। আওয়াজ উঁচু রেখে ঝুঠ বলে যাওয়াটাই এদের কেরামতি। কখনও দাবড়ানি, কখনও জরিমানা কখনও আবার ঘাড়ধাক্কা কিছুতেই তাদের হুঁশ হয় না। হুকুমতের কোনও রদবদল হলেই দেখবেন এরা ঠিক ফিরে এসেছে। আমি যেমন অনেক মজাদার ঘটনা দেখেছি তেমন আবার হুজুরের গুস্‌সার কারণ হয়ে বেইজ্জতও হয়েছি।

লুটিশপ্রসাদ ছিল এক রংদার আদমি। হুরমত (hurmat) ডডসন আর ফগের মতো সেও মামলা লড়ত ঝুঁকি নিয়ে। মক্কেল মজুরি দিতে না পারলেও কুছ পরোয়া নেই। সরকারের সিলমোহর দেওয়া কাগজে মক্কেল দস্তখত করলেই চলত। কিছু মাস পরে সে দেখত, তার জমি জিরেত সব ক্রোক করা হয়েছে আর সে সবের দখল নিয়েছে লুটিশপ্রসাদ।

ফরফন্দি বেগম পরদানশিনের তরফে সে একদিন একটা পিটিশন দাখিল করল। তারা চায় কোনও এক সৈয়দ মুফাক্কর-উদ-দৌলাকে ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর যেন শাস্তি দেন। সৈয়দ মুফাক্করও পালটা একটা পিটিশন দিল। সেই সঙ্গে জানাল, ফরিয়াদি আসলে একজন তবায়েফ। নবাব—এর রাখেল। এখন তার নখরায় নবাবজাদা আর খুশ হতে পারছেন না তাই দূর করে দিয়েছেন। তার আরও বলার ছিল যে ওই ঔরত কোনও কালেই পরদানশিন নয়।

লুটিশপ্রসাদ এখানেও ডডসন আর ফগের রাস্তা ধরেছিল। হুজুর মোক্তারনামা খারিজ করে দিয়ে হুকুম দিলেন, ফরফন্দি বেগমকে আদালতে হাজিরা দিতে হবে। শপথ নিয়ে বলতে হবে মুফাক্কর-উদ-দৌলার খিলাফ সে মামলা রুজু করতে চায়।

পরের দিনই লুটিশপ্রসাদ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির হয়ে জানাল, তার মক্কেল ডুলি চেপে কাছারিতে এসেছে। হুজুর যদি এখন দয়া করে ডুলি সমেত কামরায় আসার হুকুম করেন। হুজুর রাজি হলে মুহুরিও তৈরি হল তার বয়ান লিখবে বলে। মোক্তার সওয়াল করল, তুমিই ফরফন্দি বেগম? জবাব মিলল, হ্যাঁ, মুফাক্কর তখন বলে বসল, কী করে জানা গেল ডুলির ভেতর যে বসে আছে সেই ফরফন্দি? পরদার পিছনে যে ঔরত বসে আছে সে অন্য কোনও বুড্ডি, বদ সুরত জানানা যে কেউ হতে পারে। এই কথা শোনার পর সবাইকে তাজ্জব করে, ডুলির পরদা সরিয়ে, গালিগালাজের বান ছুটিয়ে বেরিয়ে এল এক ঔরত। মুফাক্করের দিকে ফিরে সাফ জানতে চাইল, তার মতো একজন মামুলি ইনসানের এত হিম্মত যে বলে কি না সে বুড্ডি, বদসুরত। বোঝাই যাচ্ছিল আগের সেই ঠমক আর তার নেই কিন্তু মেজাজটা একই রকম আছে। এইসব তামাশায় ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের কোনও উৎসাহ ছিল না। তিনি সাফ হুকুম দিলেন, শপথ নিতে বল ফরফন্দিকে। কিছুটা জেরা করার পরেই জানা গেল পুরো শিকায়তটাই ঝুঠ। সে আসলে এক মামুলি গস্তানি। আগে নবাব-এর রাখেল ছিল। মুফাক্কর ছিল তার আশিক এখন আর কোনও যোগ নেই। লুটিশপ্রসাদই তাকে উসকে ছিল পরদানশিন হয়ে পুরনো আশিকের খিলাফ জালসাজির মামলা দায়ের করতে। তার এই করর্‌বাইয়ের ওয়াস্তে তাকে জরিমানা করা হল। ছাড় মিলল না লুটিশপ্রসাদেরও।

এক সাদাসিধা জয়েন্ট সাহেবকে বড় প্যাঁচে ফেলেছিল সেয়ানা মোক্তার দুরান্দেশ লালা। এক গ্রামে খুব বড় দাঙ্গা হয়। দাঙ্গার সময় লাঠির চোট লেগে মৌত হয় দু’জনের। থানেদারকে হুকুম দেওয়া হয় তল্লাশি চালানোর। সে গ্রামে হাজির হয়ে সলা দেয় মুর্দাগুলোকে পুড়িয়ে নদীতে ভাসিয়ে দাও। তারপর হুজুরকে খবর করে, একটা ছোট হাঙ্গামা হয়েছিল ঠিকই তবে ফিদবি (fidwee) সেখানে খোদ হাজির হয়ে দেখে সব মিটমাট হয়ে গেছে। আলবাত ঝুঠভর (Jhoot Bhur) গোরায়েত তাকে এত্তেলা করেছিল যে দাঙ্গায় দু’জনের মৌত হয়। তবে তল্লাশি চালানোর পর তাঁর এই ফিদবি জানতে পেরেছে যাদের মৌত হয়েছে তারা আসলে তিন মাস ধরে বিমার ছিল। থানেদারের আক্কেল নাকিশ (ukkil-nakis) বলে এরপর আর কোনও তহকিকাতের জরুরত নেই। তার আরও মনে হয় যে ঝুঠভরকে বরখাস্ত করাই ভাল। জয়েন্ট সাহেব তো বুঝতে পারছেন না কী করবেন। এই সময় সেখানে হাজির হল দুরান্দেশ লালা। সেলাম ঠুকে দাখিল করল একটা পিটিশন। ওই আর্জিতে বলা ছিল, যে দু’জনের মৌত হয়েছে তাদেরই একজনের রিস্তেদার হল তার মক্কেল। সে চায় তার রাজিনামা হুজুর-কবুল করুন। মনে হল হুজুর এবার যেন একটু আরাম পেলেন। এই জবরদস্ত প্যাঁচ এবার খোলা যাবে। দুরান্দেশ লালার কাছে জানতে চাওয়া হল, দরখাস্তকারী হাজির কি না। জরুর, বলে যাকে হাজির করা হল সে এক বছর বারোর ছোকরা। হুজুর এবার মোক্তারের কাছে জানতে চাইলেন, সত্যিই ছোকরা রিস্তেদার তো? জবাবটা এল দুরান্দেশের কাছ থেকে। “হুজুরকে কী কেউ বুদ্ধু বানাতে পারে! জনাব-ই-আলি জানবেন সেই চেষ্টা নামুমকিন। দৌলত-ই-খোয়া (doulut-i-khawh) সে সবের অনেক উপরে।” হুজুর এই কথায় খুশ হয়ে একবার টুপিটা ঠিক করে নিলেন। তারপর মুনশিকে হাঁক পেড়ে বললেন, “বহুত খুব, রাজিনামা মঞ্জুর মিছিল দাখিল দফতর।” বেচারা মুনশি! সে বারে বারে হুজুরকে সাবধান করে দিতে চাইল, শক একটা থেকেই যাচ্ছে মামলাটা খুনের কি না— আর যে ছোকরা রাজিনামা দাখিল করেছে সে যে ভাঁওতা দিচ্ছে না তাই বা কে বলবে। এবার দুরান্দেশ ঢুকে পড়ল তাদের বাতচিতের ভিতর। “হুজুর দেখুন, দেখুন এই হল আমলাদের কারসাজি। কেমন করে ওরা আপনার বিচারকে নাপাক করে ছাড়ে দেখুন! আপনার বিচার মানে তো সলোমানের আদেশ। আপনি বলেছেন তাও এরা মানতে রাজি নয়।” মুনশির কিসমত খারাপ। সাহেব তাকে আচ্ছা করে ধমক দিলেন আর যারা পিটিশন করেছিল তারা ঝন্ডা উঁচিয়ে কাছারি থেকে বেরিয়ে পড়ল।

দুরান্দেশ লালা যে শুধু থানেদার আর দাঙ্গাবাজদের কাছ থেকে ইনাম পেল তাই নয়, সাবিত হল তার এলেম আছে আদালতের রায় ঘুরিয়ে দেওয়ার। ঢল নামল মক্কেলের। কাছারি থেকে এক্কা চড়ে ফেরার পথে সে জরুর একবার মুনশিকে দর্শন দিত। মুনশিকে তার বলার কথা ছিল একটাই, সবই কুদরতের মেহেরবানি।

১. নখরা: হাবভাব, ছলকলা

২. শিকায়ত: অভিযোগ, নালিশ, দোষারোপ

১. নামুমকিন: অসম্ভব

২. নাপাক: অপবিত্র, অশুচি

সকল অধ্যায়

১. ১. শুনতা ক্যা সিং-এর আমদানি
২. ২. মুনশিজির-তালিম
৩. ৩. নাজিরের দপ্তর আর পাঁচকড়ির আমদানি
৪. ৪. পাঁচকড়ি ঢুকে পড়ে বাবুর খয়রাতি ফর্দে
৫. ৫. জবরদস্ত মিশ্র আর লালা রামবালক
৬. ৬. সাচ্চা রিপোর্ট দাখিল করায় থানেদারের সাজা
৭. ৭. এক দৌলতমন্দ পুলিশের তসবির
৮. ৮. মোক্তারদের কারনামা
৯. ৯. দালালদের বজ্জাতি
১০. ১০. বামুনের বাড়া পান্ডা
১১. ১১. ঘাটিয়া, গঙ্গাপুত্র আর অঘোরপন্থী
১২. ১২. রিশবতখোর কর্মচারী
১৩. ১৩. রাজার ভেক
১৪. ১৪. গ্রহণের দিনে বেনারসের ঘাট
১৫. ১৫. সরকারি হুকুম বনাম ফেরি
১৬. ১৬. আদালতের গড়িমসি চাল
১৭. ১৭. পুলিশের কার্‌রবাই
১৮. ১৮. ইংরেজ হুকুমত খতম করার সাজিশ
১৯. ১৯. সাজিশকারদের খিলাফ কার্‌রবাই
২০. ২০. মাশুল বন্দোবস্ত আর টাকা আমদানির হরেক ফিকির
২১. ২১. নাচার রায়তের মামলা
২২. ২২. জমিদার আর কালেক্টর
২৩. ২৩. রায়তের উপর জবরদস্তি
২৪. ২৪. বিচারের নামে মশকরা
২৫. ২৫. না কাবেল ফিরিঙ্গি কারপরদাজি
২৬. ২৬. ক্রোক করার কমিশনার
২৭. ২৭. কালেক্টর, সিভিল সার্জেন আর এলাকার মোর্চা
২৮. ২৮. সুবা উত্তর-পশ্চিমে জরিপ
২৯. ২৯. জরিপকারদের কার্‌রবাই
৩০. ৩০. সেটেলমেন্ট অফিসারদের জিম্মাদারি
৩১. ৩১. ডেপুটিদের জিম্মাদারি
৩২. ৩২. মাশুল কর্তাদের জিম্মাদারি
৩৩. ৩৩. মুনসেফ, সদর আমিন, প্রিন্সিপাল সদর আমিন, জেলার জজ আর সদর দেওয়ানি আদালত
৩৪. ৩৪. কানুনের রখওয়ালা
৩৫. শব্দার্থ ও পরিশিষ্ট

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন