১৪. গ্রহণের দিনে বেনারসের ঘাট

গ্রহণের দিনে বেনারসের ঘাট

পাঠক আপনারা কি কখনও সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সময় গঙ্গার ঘাটে গেছেন? না যদি গিয়ে থাকেন তা হলে অন্তত একবার দেখে আসুন। শহরের রাস্তায় তখন যে মানুষের ঢল নামে সেটা দেখার মতো। প্রত্যেক গলি, প্রত্যেক মহল্লা থেকে মানুষ এসে আছড়ে পড়ছে স়ড়কে আর সেই ভিড়টাই গিয়ে ঠেলে উঠছে ঘাটে। ভয়ানক ভিড়ের চাপ, ধাক্কা-ধাক্কি, চিৎকার-আওয়াজ, দুবলা-পাতলাদের হঠিয়ে হাট্টা-কাট্টাদের জায়গা করে নেওয়া— একটা দেখার আর ভাবার মতো কথা। আদমি হরেক কিসমের লিবাস পরে হাজির; কেউ যদি লিবাসের ইতিহাস নিয়ে ভাবতে চান তা হলে এর থেকে ভাল মওকা আর কিছু হয় না। তবে সত্যি সত্যি যা দেখে তাজ্জব হতে হয় সেটা হচ্ছে জমায়েত। এই ছোট জায়গার ভিতর কী করে এত মানুষ ঢুকে পড়ছে! ভাবতে বসলে দেখবেন মনে পড়ে যাচ্ছে মানুষ জাতের জন্ম পদ্ধতি। এইসব তো হল বড় বড় জ্ঞানের কথা, এবার আসল কথায় ফেরা যাক।

ভিড়ের ভিতর নজরে পড়বে কোনও মালদার বাবু। সে চেষ্টা করছে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। কেউ বসে আছে তাঞ্জামে কেউ আবার ঘোড়ার পিঠে সওয়ার। একদল লোক ছুটছে চাবুক হাতে। সপাং, সপাং করে চাবুক চলছে মুতফরক্কাদের (mutfarakka) পায়ে। মুখে তাদের আওয়াজ ফারাক! ফারাক! এত করেও ঢোকা যাচ্ছে না ভিড়ের মধ্যে। সওয়ার বাধ্য হচ্ছে রাশ টানতে আর বাবুকে চুপচাপ বসে থাকতে হচ্ছে বেহারাদের কাঁধে তাঞ্জামের উপর।

ধরা যাক কোনও এক মওকায় আপনি পৌঁছে গেলেন মণিকর্ণিকা ঘাটে। সেখানে একটা নাও আপনার খিদমতে হাজির। আপনি তাতে চড়ে দেখতে শুরু করলেন ঘাটগুলোর কী হচ্ছে। গঙ্গায় আপনি কখন ডুবকি দেবেন সেটা তো আপনার মর্জি। আপনি তা হলে কী দেখলেন? দেখলেন যে আপনার চারদিকে কেবল মানুষের মাথা আর মাথা। একবার ডুবছে, একবার উঠছে। আরে বাপু! শুধু মাথা নয়, বেশ কয়েকটা লাশও ভাসছে। এত মানুষ ডোবা-ওঠায় তৈরি হচ্ছে ঘূর্ণি, আর তাতেই পাক খাচ্ছে লাশগুলো। মানুষ সেগুলো এড়িয়ে যেতে পারছে এমনটা নয়। লাশের এত কড়া বদবু যে ঘোড়ারও মৌত হবে। দেখুন, দেখুন ওই ছুকরি কেমন ডুব দিয়ে উঠল। তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে একটা লাশ। ছুকরির তাতে কোনও হেলদোল হল না। সহজেই লাশটাকে ঠেলে দিল পাশের বুড়ির দিকে। বুড়ির তো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, ঝুলে পড়েছে গায়ের চামড়া, আর কিছু দিনের ভিতর তার যা হাল হবে সেটাই সে দেখতে পেল। কোনও রকমফের হল না তার সেই লাশটা দেখে; চুপচাপ ঠেলে সরিয়ে দিল আর এক দিকে। দেখুন ওই তাগড়া জোয়ানকে, জরুর সিপাহি হবে। সঙ্গে তার ছানা, বয়স খুব বেশি হলে দুই। বসে আছে বাপের গর্দানে। ভয়ের চোটে আঁকড়ে ধরেছে তার চুল। খুশির সঙ্গে বাপ তাকে ডোবাচ্ছে আর ওঠাচ্ছে। ঘাটের তসবির যে পুরোটাই খুশালির তা বলা যায় না। নজরে পড়বে মুহব্বতের ছোঁয়াও। ধাঁচটা একটু আজব আর পুরনো কিসমের। এক ঝাঁক খুবসুরত জলপরিকে দূরে দেখা যাচ্ছে। ঘোলা জলে তাদের জলকেলি দেখে বলতে ইচ্ছে করছে যেন ফুটে আছে পদ্ম। এবার নজর ফেরান ওই তনদুরুস্ত (tandurust) ছোকরার দিকে। সেও দেখে যাচ্ছে জলপরিদের। নিজেকে আর সামলাতে পারল না, ঝাঁপ দিল পানিতে। সটান ভেসে উঠল জলপরিদের মাঝে। লাজুক মুখে হয়তো বলল, গোস্তাখি মাফ! তারপর বলতে বসল, স্নান ক্যা, পুসস্নান ক্যা তু নাম লে পরমেশ্বর কা, ব্যোম, ব্যোম, ব্যোম। হয়তো কোনও ছুকরির নজর পড়ল তার উপর, মনে হল তার ছোকরা ইশক লায়েক, পানিতে ছুড়ে দিল হাতে ধরা ফুল। ছোকরা সেটাই উঠিয়ে নিল মহব্বতের নিশান বলে। এবার দেখুন আর এক মজা। হিকমতি কারবারিরা কিন্তু সুযোগ খুঁজে চলেছে। একদল ঔরত দামি দামি জেবরাত পরে গঙ্গায় ডুব দিতে এসেছে। ভাবখানা এমন যেন গঙ্গা তাদের খাস মহল। ওই যে ডুব দিল ছুকরি আর একই সঙ্গে ঝাঁপ মারল ছোকরাও। জল থেকে মাথা তুলেই ডুকরে উঠল ছুকরি, মাইয়া রে মাইয়া! মেরি নথ গয়ি! সবার নজর যখন তার দিকে সেই ফুরসতে বদমাশ গায়েব। আবার একটু পরেই শুনতে পাবেন চিৎকার, দয়া রে দয়া! মেরি বালি গয়ি! আলবাত ছিনতাই হয়েছে দুল। একজনের ছিঁড়েছে নাক আর একজনের কান। এসব তো মামুলি; কখনও কখনও শোনা যায় জলের মধ্যে জেবরাত পরা ঔরতই গায়েব। এতে কেরামতি বাড়ে ছিনতাইবাজদের। এরা এতই ধড়িবাজ আর সাঁতারে ওস্তাদ যে ঠিক যারা ব্যোম ব্যোম মহাদেব বলে ডুব দিচ্ছে তাদের মাঝখান দিয়ে গলে বেরিয়ে যায় আর মহাদেবের নামই তখন তাদের কামইয়াবির নিশান।

নাও-এ চড়ে ভাসতে ভাসতে আপনার নজরে পড়বে দারুণ সব তসবির। পাথরে বাঁধানো ঘাট আর হাবেলি, মন্দির আর মিনার, মসজিদ, মানমন্দির যেগুলো সব মিলে মিশে বেনারসকে করে তুলেছে এত রংদার। আপনি হয়তো ভেসে যাবেন বরুণার দিকে। দেখতে পাবেন যত ভিড় এদিকটাতেই। পুজো-পাঠের নামে চলছে সেই এক তামাশা আর তারই সঙ্গে চুরি ছিনতাইয়ের নতুন নতুন ফন্দি। কয়েক মাস আগে এখানে যে হাদসা হয় তার জন্যই সবার মনে থাকবে এই ঘাট। কিনারার জমিতে ধীরে ধীরে নামছিল ধস। লোকেদের এই দিকে কোনও নজরই ছিল না। একদিন পুরোটাই ধসে পড়ল। ভেসে গেল হাজার হাজার আদমি। মাহোল আরো বিগড়ে গেল লোকেরা ভয় পেয়ে ধাক্কা ধাক্কি শুরু করায়। পায়ের চাপেই যে কত আদমির মৌত হল তার কোনও হিসাব নেই। পুলিশের রিপোর্ট মোতাবেক মৌত হয়েছিল এক হাজার। তবে বড় বড় অফিসারেরা চেয়েছিলেন গুনতি কম করে দেখানো হোক যাতে এই হাদসার অসলিয়ত ধামা চাপা দেওয়া যায়।

এই রকম কোনও হাদসা মানেই কিছু লোকের মওকা, বিশেষ করে যারা ফেরেব্বাজি করে বেঁচে থাকে। চুড়ি-বালা-নথ-দুল-হার সুযোগ মিলতেই হাপিস হয়ে গেল। আদমি হোক বা ঔরত, জিন্দা কি মুর্দা। তবে শিকার জেনানাই বেশি। কারা এই কারবারটা সেদিন চালিয়েছিল তার হদিশ করা এক মস্ত ছুপা হুয়া রাজ।

এক মজবুত আদমি নজরে পড়ল যে এক ছুকরির কাপড়ে মোড়া লাশ নিয়ে চলেছে। কেউ সওয়াল করলেই সে বলছিল, “বেচারি আমার বহন, অচানক দম তোড়া।” ভিড় সঙ্গে সঙ্গে সরে গিয়ে ফাঁকা করে দিচ্ছিল পথ। একটা শুনশান জায়গা দেখে সে ফেলে দিল ওই লাশ। তার দেহে তখন আর পাওয়া যাবে না কোনও দুল-চুড়ি-নথ বা মল— সবকিছু বিলকুল সাফ আর কিছু মিলবে না বলেই লাশটা ফেলে দেওয়া হল। সেই সঙ্গে ওই মুস্কো বেরিয়ে পড়ল নতুন শিকারের তল্লাশে। হতেই পারে সেই ছুকরি ছিল কারও বিবি কারও বা রিস্তেদার, কী হাল হল বেচারির! আবারও কাউকে উঠিয়ে আনবে বদমাশরা মিলবে না তার কোনও খোঁজ। শুধু ছাতি চাপড়ে মরবে তার আজিজরা। আমি বলব, “বেচারা হিন্দু! তোমাদের ঘরের আশপাশে কী কোনও ইঁদারাও নেই যেখান থেকে মিলবে সাফ পানি? কেন তা হলে সেই পানি দিয়ে তুমি আর তোমার গেরস্তি পাক হও না!”

এক ডোমকে নিয়ে শোনা যায় তাজ্জব কাহানি। ব্যাটার এক সময় খুব রবরবা হয়েছিল। জনাব উইলিয়াম ওয়েলবারফার্স বার্ড সাহেবের আমলে তার সেই জারিজুরি খতম হয়। ডোম ছিল সাঁতারে ওস্তাদ। একদিন মণিকর্ণিকা ঘাটে সে ঘুরপাক খাচ্ছে শিকারের তল্লাশে। নজরে পড়ল স্নান করতে এসেছে এক মহাজনের পরিবার। তাদের ভিতর সে বেছে নিল প্রচুর সোনার জেবরাত পরা এক ঔরতকে। ঝাঁপ দিল পানিতে, আর সেই সঙ্গে তলিয়ে গেল সেই ঔরতও। কেউ তাদের আর ভেসে উঠতে দেখেনি। নিজের লোকেরা রটিয়ে দিল তাকে মগর (mugger) মাছে উঠিয়ে নিয়ে গেছে যাতে আর কেউ কিছু বলতে না পারে। কয়েক দিন পর ঘাটে এসেছে সাধু মহারাজ, পাপ ধোলাই করতে। স্নান সেরে ঘাটে উঠবে, আচমকাই তার পা পড়ল পাথরের সিঁড়ির বদলে নরম কিছুর উপর, মামলা তার ঠিক মনে হল না। কথাটা সে জানাল অন্যদের। তলব করা হল কয়েকজন ডোমকে। তারা পাথরের খাঁজ থেকে বের করে আনল একটা লাশ। এই সেই গায়েব হয়ে যাওয়া ঔরত। তখন তার গায়ে কোনও জেবরাত নেই। শুরু হল খোঁজ, কে করতে পারে এই ভয়ানক কাজ। কিছু মাস পরে সেই জেবরাত বেচতে গিয়ে বমাল গ্রেফতার হল ডোম। শনাক্ত হল জেবরাত। গুনাহ কবুল করল সে। শোনানো হল তাকে ফাঁসির হুকুম।

১. আজিজ: আত্মীয়, ঘনিষ্ঠজন

সকল অধ্যায়

১. ১. শুনতা ক্যা সিং-এর আমদানি
২. ২. মুনশিজির-তালিম
৩. ৩. নাজিরের দপ্তর আর পাঁচকড়ির আমদানি
৪. ৪. পাঁচকড়ি ঢুকে পড়ে বাবুর খয়রাতি ফর্দে
৫. ৫. জবরদস্ত মিশ্র আর লালা রামবালক
৬. ৬. সাচ্চা রিপোর্ট দাখিল করায় থানেদারের সাজা
৭. ৭. এক দৌলতমন্দ পুলিশের তসবির
৮. ৮. মোক্তারদের কারনামা
৯. ৯. দালালদের বজ্জাতি
১০. ১০. বামুনের বাড়া পান্ডা
১১. ১১. ঘাটিয়া, গঙ্গাপুত্র আর অঘোরপন্থী
১২. ১২. রিশবতখোর কর্মচারী
১৩. ১৩. রাজার ভেক
১৪. ১৪. গ্রহণের দিনে বেনারসের ঘাট
১৫. ১৫. সরকারি হুকুম বনাম ফেরি
১৬. ১৬. আদালতের গড়িমসি চাল
১৭. ১৭. পুলিশের কার্‌রবাই
১৮. ১৮. ইংরেজ হুকুমত খতম করার সাজিশ
১৯. ১৯. সাজিশকারদের খিলাফ কার্‌রবাই
২০. ২০. মাশুল বন্দোবস্ত আর টাকা আমদানির হরেক ফিকির
২১. ২১. নাচার রায়তের মামলা
২২. ২২. জমিদার আর কালেক্টর
২৩. ২৩. রায়তের উপর জবরদস্তি
২৪. ২৪. বিচারের নামে মশকরা
২৫. ২৫. না কাবেল ফিরিঙ্গি কারপরদাজি
২৬. ২৬. ক্রোক করার কমিশনার
২৭. ২৭. কালেক্টর, সিভিল সার্জেন আর এলাকার মোর্চা
২৮. ২৮. সুবা উত্তর-পশ্চিমে জরিপ
২৯. ২৯. জরিপকারদের কার্‌রবাই
৩০. ৩০. সেটেলমেন্ট অফিসারদের জিম্মাদারি
৩১. ৩১. ডেপুটিদের জিম্মাদারি
৩২. ৩২. মাশুল কর্তাদের জিম্মাদারি
৩৩. ৩৩. মুনসেফ, সদর আমিন, প্রিন্সিপাল সদর আমিন, জেলার জজ আর সদর দেওয়ানি আদালত
৩৪. ৩৪. কানুনের রখওয়ালা
৩৫. শব্দার্থ ও পরিশিষ্ট

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন