০৬. নৌসিকা

পার্থ সারথী দাস

ষষ্ঠ পর্ব
নৌসিকা

ক্লান্ত অবসন্ন নিদ্রাভিভূত ওডিসিয়াস যখন সেই অলিভকুঞ্জের স্বরচিত পত্রশয্যায় বিশ্রাম করছিলেন, দেবী এথেন তখন ফ্যাকেসিয়াবাসীদের দেশে গিয়ে তাদের নগরে প্রবেশ করলেন, ফ্যাকেসিয়াবাসীরা আগে বাস করত সাইক্লোপ জাতীয় লোকদের কাছে। কিন্তু সাইক্লোপ জাতির লোকেরা ছিল বড় বিবাদপ্রবণ। ফ্যাকেসিয়ার লোকদের থেকে তারা বেশি শক্তিশালী ছিল বলে সেই শক্তি প্রয়োগ করত তারা তাদের দুর্বল প্রতিপক্ষের উপর। অবশেষে ফ্যাকেসিয়াবাসীদের রাজা নৌসিমাস তাঁর প্রজাপুঞ্জ নিয়ে দূরে নির্জন স্কেরী দ্বীপে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। সেখানে বহু ঘর, বাড়ি, প্রাসাদ, অট্টালিকা ও দেবালয় সহ এক নতুন নগরী নির্মাণ করেন এবং এক বিরাট প্রাচীর দিয়ে নগরের চারদিকে ঘিরে দেন। তিনি কৃষিকার্যের জন্য অনেক জমিও দান করেন কৃষকদের। দীর্ঘদিন হলো তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর থেকে অ্যালসিনোয়াস ছিলেন দেবতাদের প্রিয় এবং সুশাসক। অ্যালসিনোয়াসের প্রাসাদেই দেবী এথেন গেলেন ওডিসিয়াসকে কিভাবে উদ্ধার করা যায় তার পরিকল্পনা নিয়ে।

রাজা অ্যালসিনোয়াসের নৌসিকা নামে পরমাসুন্দরী এক কন্যা ছিল। রূপে গুণে সে ছিল দেবীর মত। তখন রাত্রিকাল। রত্নজালমণ্ডিত একটি শয়নকক্ষে স্বর্ণপর্যঙ্কের উপর সে তখন নিদ্রা যাচ্ছিল গভীরভাবে। তার দুজন সহচরী সেই রুদ্ধদ্ধার কক্ষের দ্বারপথের দুই পাশে শুয়ে ছিল। কিন্তু এথেন বাতাসের মত সূক্ষ্ম শরীরে সে কক্ষে প্রবেশ করলেন। তার অন্তরঙ্গ বান্ধবী ডাইমাসের রূপ ধারণ করে নৌসিকার বিছানায় গিয়ে তাকে ডাকতে লাগলেন।

ডাইমাসের কণ্ঠস্বর নকল করে এথেন বললেন নৌসিকা, তোমার মত অলস মেয়ের জন্ম তোমার মা কেন দিলেন? এত সুন্দর সুন্দর পোশাক তুমি ময়লা করে অবহেলাভরে ঘরে ছড়িয়ে রেখে দিয়েছ? অথচ শীঘ্রই তোমার যখন বিয়ে হবে তখন তোমার ও তোমার বরযাত্রীদের জন্য অনেক পোশাক দরকার হবে। যেসব মেয়ে তাদের পোশাকপরিচ্ছদ গুছিয়ে রাখে তাদের বাপ মা ছাড়াও সকলে তাদের প্রশংসা করে। এখন চল সকলে মুখ হাত ধুয়ে আসিগে একসঙ্গে। আমিও যাব তোমার সঙ্গে তোমার সাহায্য করতে, কারণ, তোমার বিবাহ হতে আর দেরি নাই। তুমি একজন সুন্দরী রাজকন্যা এবং অনেকেই তোমার পাণিপ্রার্থী। সকাল হলেই তোমার পিতাকে একটি ঘোড়ার গাড়ির জন্য বলবে। এই সব ময়লা পোশাক সেই গাড়িতে নেবে। আর সেই গাড়ি তুমি নিজেই চালাবে। স্নানের ঘাট অনেকটা দূরে বলে পদব্রজে যাওয়া ঠিক হবে না। নদীর জলে ওসব পোশাক ধুতে হয়।

কথা শেষ করে এথেন চলে গেলেন দেবতাদের নিবাসভূমি অলিম্পাসের পর্বত শিখরে। সে স্বর্ণশিখরদেশ কোন প্রবল বায়ুপ্রবাহের দ্বারা কখনো বিকম্পিত হয় না, বৃষ্টিজলধারায় কখনো সিক্ত হয় না, যেখানে মেঘদূত নির্মল বাতাস এক সততশুভ্র উজ্জ্বলতায় খেলে বেড়ায় প্রতিনিয়ত, দেবতারা কালযাপন করেন সেখানে চিরসুখে। নৌসিকাকে তার মনের কথা বলে সেই স্বর্ণশিখরদেশে চলে গেলেন দেবী এথেন।

প্রত্যূষের সূর্য পূর্ব আকাশে সগৌরবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল নৌসিকা। ঘুমন্ত অবস্থায় যে স্বপ্ন সে দেখেছে তার কথা মনে করে আশ্চর্য হয়ে গেল সে এবং তার কথা সে তার পিতামাতাকে বলতে গেল। তার মা তখন একটি ঘরে গরম চুল্লীর পাশে অন্যান্য সহচরীদের সঙ্গে চরকা কাটছিল। আর তার পিতা তখন দরবার কক্ষে এক সভায় যোগদানের জন্য যাচ্ছিলেন। তার পিতার কাছে গিয়ে নৌসিকা বলল, পিতা, তুমি তোমার লোকদের একটা ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে বলবে কি? নদীতে গিয়ে কিছু ময়লা পোশাক ধুয়ে আনব। তুমি শুধু রাজকার্য। নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাক। কিন্তু তোমার খেয়াল নেই তোমার প্রাসাদে পাঁচটি পুত্রের মধ্যে মাত্র দুজনের বিবাহ হয়েছে আর তিনজন এখনো অবিবাহিত আর সেইজন্য তারা নাচের জন্য রোজ পরিষ্কার পোশাক চায়। আমাকে এসব কথা ভাবতে হয়।

লজ্জায় নিজের বিয়ের কথা পিতাকে বলতে পারছিল না বলেই এমনি করে পরোক্ষভাবে কথাগুলো বলল নৌসিকা। কিন্তু একথার অর্থ ঠিক বুঝে নিলেন তার পিতা। তিনি বললেন, গাড়ি ঘোড়া কোন কিছুই আমি তোমাকে দিতে অসম্মত হব না মা। আমার ভৃত্যেরা তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছুরই ব্যবস্থা করে দেবে।

ভৃত্যদের ডেকে আদেশ দিয়ে দিলেন রাজা অ্যালসিনোয়াস। গাড়ির সঙ্গে অশ্বগুলোকে সংযুক্ত করা হলে পোশাকের ঘর থেকে ময়লা পোশাকগুলো সব আনয়ন করালেন। তার মা তাকে অনেক কিছু খাবার ও বোতলে করে কিছু ভাল মদ দিলেন। তারপর একটি বাটিতে করে কিছু অলিভ তেল দিলেন। নৌসিকা স্নান করে তা গায়ে মাখবে বলে। হাতে চাবুক আর বন্ধু নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল নৌসিকা। তার কয়েকজন দাসীও সঙ্গে ছিল।

অবশেষে সেই বিরাট নদীর ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হলো তারা। স্বচ্ছ কালো জলের কত ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল সেই নদীর বুকে। সেই নদীর তীরে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে গোড়াগুলোকে খুলে তীরসংলগ্ন তৃণাচ্ছন্ন ভূমিতে চরতে দিল। তারপর নৌসিকার দাসীরা গাড়ি থেকে ময়লা কাপড়গুলো এনে ধুতে লাগল। ভাল করে দেয়ার পর সেই তৃণভূমির উপর মেলে শুকোতে দিল। তারপর তারা স্নান করে গায়ে অলিভ তেল মেখে খাওয়া শুরু করল। ইতিমধ্যে সূর্যকিরণে পোশাকগুলো শুকোতে লাগল। খাওয়ার পর দাসীরা বল খেলতে লাগল আর গান গাইতে শুরু করল নৌসিকা। লিটোর কন্যা তীরন্দাজদেবী আর্তেমিস সুদূর স্বর্গলোক থেকে মাঝে মাঝে মর্ত্যের কোন অরণ্যভূমিতে নেমে জলপরীদের সঙ্গে শিকার শিকার খেলতে থাকলে তাঁকে যেমন চেনা যায় না, জলপরীদের প্রত্যেককেই আর্তেমিস বলে ভ্রম হয়, ঠিক তেমনি তার দাসীদের মধ্যে নৌসিকাকে চেনাই যাচ্ছিল না।

এবার বাড়ি ফিরে যাবার সময় হলো। শুকিয়ে যাওয়া পোশাকগুলো গুটিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে গাড়ি ছাড়ার উদ্যোগ করছিল যখন নৌসিকা তখন দেবী এথেন ওডিসিয়াসের ঘুম ভাঙ্গানোর ও নৌসিকার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার ব্যবস্থা করলেন। বল খেলার শেষের দিকে বলটি কোন এক দাসীকে দেবার সময় সেটি নদীর জলে পড়ে যেতেই সকলে মিলে একসঙ্গে জোর চিৎকার করে উঠল তারা। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গেল ওডিসিয়াসের। উঠে বসে আপন মনে বলতে লাগলেন, হায় কোন দেশে আমি এসেছি? এখানে কারা বাস করে? তারা কি বন্য বর্বর কোন অসভ্য উপজাতি না ধর্মভীরু দয়ালু প্রকৃতির মানুষ? তীক্ষ্ণ কণ্ঠের কেমন এক চিৎকার শুনছিলাম আমি। মনে হলো কতকগুলো বালিকা ভয়ে চিৎকার করছে। মনে হয় জলপরী, যারা কোন সুউচ্চ পর্বত শিখরে ঝর্ণার ধারে অথবা কোন তৃণাচ্ছন্ন প্রান্তরে শিকার করতে আসে অথবা আমাদের মতই কোন মানব সমাজে এসে পড়েছি। যাই হোক, বাইরে গিয়ে আমি স্বচক্ষে দেখব।

অলিভকুঞ্জের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন বীর ওডিসিয়াস। পত্রাচ্ছন্ন এক বৃক্ষশাখা ভেঙ্গে তাই দিয়ে কোনরকমে নিজের নগ্ন পুরুষাঙ্গটিকে ঢাকলেন। কোন পার্বত্য সিংহ যেমন ক্ষুধার তাড়নায় ঝড়বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সদর্পে এগিয়ে যায় শিকার সন্ধানে, ঠিক তেমনি একাকীত্ব সত্ত্বেও এক দৃঢ় পদক্ষেপে সেই বালিকাদের সামনে এগিয়ে যেতে লাগলেন ওডিসিয়াস। ক্রমাগত কয়েকদিন ধরে সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল ওডিসিয়াসের চেহারাটা। তার পানে একবার তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে যে যেখানে পারল ছুটে পালিয়ে গেল নৌসিকার দাসী ও সহচরীরা। কিন্তু একা নৌসিকা দাঁড়িয়ে রইল নির্ভীকভাবে। দেবী এথেন স্বয়ং সাহস সঞ্চার করলেন তার মধ্যে। তার ফলে কিছুমাত্র ভীত না হয়ে অকম্পিত হৃদয়ে সম্মুখীন হলো সে ওডিসিয়াসের।

এদিকে নৌসিকাকে দেখে কি করবেন তা ভেবে পেলেন না ওডিসিয়াস। নৌসিকার পা দুটোকে জড়িয়ে ধরে তার কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা জানাবেন না দূর থেকেই তার কাছে কিছু কাপড় চাইবেন ও নগরের মধ্যে গিয়ে নিয়ে যেতে বলবেন তা ঠিক করে উঠতে পারলেন না। বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর তিনি বুঝতে পারলেন বালিকার পা ধরলে সে রেগে যেতে পারে। সুতরাং দূর থেকে তার কাছে আবেদন জানানোই সমীচীন হবে তাঁর পক্ষে। অবশেষে তিনি দ্র ও শান্তভাবে বললেন, হে মহাশয়া, হে ভদ্রে, আমি আপনার দয়ার উপর নিজেকে সঁপে দিচ্ছি। আপনি কি কোন দেবী না মানবী? যদি আপনি স্বর্গবাসিনী কোন দেবী হন তাহলে আপনি অবশ্যই হবেন জিয়াসকন্যা আর্তেমিস। আপনার রূপ গুণ ও গরিমা আমাকে সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আর যদি আপনি মানবী হন তাহলে আপনার পিতা মাতা ও ভ্রাতারা সত্যিই বড় ভাগ্যবান। কারণ আপনাকে যখনই তারা দেখেন বিশেষ করে নৃত্যের সময় যখন আপনি অংশগ্রহণ করেন তখন আপনি তাদের আনন্দ বর্ধন করেন। কিন্তু যে ব্যক্তি আপনাকে বিবাহ করে তার ঘরে নিয়ে যেতে পারবে বধূরূপে তিনিই সর্বাপেক্ষা ভাগ্যবান। কোন নরনারীর মধ্যে জীবনে আমি এমন পরিপূর্ণ সৌন্দর্য মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি নি। আপনাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে দেবীর মত পূজা করতে ইচ্ছা করছে আমার। বহুদিন আগে আপনার সঙ্গে তুলনীয় এক বস্তু দেখেছিলাম ভেলসে। সেটি ছিল এক সবুজ সতেজ তালগাছের চারা, অ্যাপোলোর মন্দিরের ধার ঘেঁষে বেড়ে উঠছিল। তখন যাচ্ছিলাম এক সামরিক অভিযানে। আমার পিছনে ছিল এক বিরাট সৈন্যদল, অবশ্য আমার সে অভিযান সফল হয় নি, তবু তখন আমি সেই সুন্দর চারাগাছটির পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম স্তব্ধ বিস্ময়ে। অনেক আনন্দ আমি লাভ করেছিলাম। ঠিক তেমনি আজও এক শ্রদ্ধানিবিড় বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে আছি আপনার পানে। সঙ্গে সঙ্গে ভয় জাগছে, মনে মনে ভাবছি হয়ত আপনি কোন দেবী, তাই আপনার কাছে আমার আবেদন জানাতে পারছি না।

মাত্র গতকাল সন্ধ্যায় আমি সুদূর অজিগিয়া দ্বীপ হতে ঊনিশ দিন ধরে ঝড় ও সমুদ্রের ঢেউ-এর সঙ্গে ক্রমাগত সংগ্রাম করতে করতে এই উপকূলে এসে উঠি। হয়ত কোন দেবতা আরো দুঃখভোগের জন্য এখানে আমাকে এনে ফেলেছেন। কারণ আপাতত আমার সুখের কোন আশা দেখি না। আমার ভাগ্যে এখনো অনেক দুঃখ মজুত আছে। হে আমার রাণী, আমার উপর দয়া করুন, এই নির্জন দ্বীপে আপনাকেই আমি প্রথম দেখলাম এবং এখানে আমার পরিচিত কোন মানুষ নেই। আমার প্রার্থনা, আমাকে আপনি নগরমধ্যে নিয়ে চলুন এবং আমাকে একটি কম্বল বা চাদর দিন। তাহলে দেবতারা আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন। আপনি তাহলে আপনার মনোমত স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি পাবেন। পৃথিবীতে মনের মানুষের সঙ্গে ঘর করার মত সুখ আর নেই আর আপনার সেই সুখ দেখে আপনার শত্রুরা অখুশি আর বন্ধুরা খুশি হবে।

সুন্দর নৌসিকা বলল, মহাশয়, আপনার আচরণ দেখে ও কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে আপনি কোন দুবৃত্ত বা নির্বোধ নন। আর আপনি যেসব দুঃখকষ্টের কথা বললেন তা মনে হয় দেবরাজ জিয়াসের বিধান অনুসারেই ভোগ করতে হয়েছে আপনাকে। মানুষের গুণগত যোগ্যতার কথা বিবেচনা না করেই সুখ-দুঃখের বিধান করে জিয়াস। কিন্তু আপনি যখন আমাদের দেশে ও নগর উপান্তে এসে পড়েছেন তখন বস্ত্র বা প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিলাভে বিমুখ হবেন না আপনি। আমি আমাদের নগরমধ্যে আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব এবং আমাদের পরিচয় দান করব। আমাদের এই দেশ হচ্ছে ফ্যাকেসিয়া জাতির অধিকারে এবং আমি হচ্ছি এ রাজ্যের রাজা অ্যালসিলোয়াসের কন্যা।

এবার নৌসিকা তার দাসীদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, থাম, এদিকে এস, একজন মানুষকে দেখে তোমরা ভয়ে কোথায় পালাচ্ছ? ওঁকে তোমরা শত্রু ভেবো না। কোন মানুষ কোনদিন শত্রুতা করার সাহস পাবে না আমাদের দেশের সঙ্গে। দেবতাদের আশীর্বাদ আছে আমাদের উপরে। সমুদ্রতরঙ্গলাঞ্ছিত আমাদের এই দেশ পৃথিবীর এমন এক প্রান্তসীমায় অবস্থিত যেখানে অন্য কোন মানবজাতির সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। যে মানুষটিকে তোমরা দেখছ উনি একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত ভ্রমণকারী, ঘটনাক্রমে এখানে এসে পড়েছেন। এখন আমাদের ওঁর সেবাযত্ন করা উচিত। মনে রাখবে সকল ভিক্ষুক ও অতিথিকেই জিয়াস রক্ষা করেন। সুতরাং তাদের অবহেলা করতে নেই। তোমরা আমাদের এই অতিথিকে প্রথমে খাদ্য ও পানীয় দাও, তারপর নদীতে নিয়ে গিয়ে স্নান করাও।

নৌসিকার এই ভর্ৎসনাবাক্যে পলায়নরতা দাসীদের চৈতন্য হলো। তারা নিজেরা পরস্পরকে ডেকে শান্ত হতে বলল। তারপর ওডিসিয়াসকে নদীর ঘাটে নিয়ে গিয়ে অন্তরালবর্তী এক জায়গায় বসাল। তারপর তার পাশে কিছু অলিভ তেল আর স্নানান্তের পরিধান করার জন্য উপযুক্ত পোশাক নামিয়ে রেখে নদীর জলে স্নান করতে বলল ওডিসিয়াসকে। ওডিসিয়াস তখন বললেন, হে ললনাগণ, দয়া করে আমার কাছ থেকে সরে যাও। আমার দেহগাত্রে যে লবণকণাগুলো লিপ্ত হয়ে আছে সেগুলো আমি নিজে ঘসে উঠিয়ে দিয়ে অলিভ তেল মাখব। কিন্তু আমি যখন নগ্ন হয়ে স্নান করব তখন তোমরা দাঁড়িয়ে তা দেখলে আমি লজ্জা পাব।

একথা শুনে দাসীরা সরে গিয়ে নৌসিকাকে সব কথা জানাল। নদীর নির্মল জলধারা দিয়ে ওডিসিয়াস তাঁর দেহগাত্রের উপর অবলিপ্ত লবণাবশিষ্টগুলো ধুয়ে ফেলে সারা গায়ে তৈল মর্দন করলেন ভালভাবে। তারপর নৌসিকা প্রদত্ত পোশাক পরিধান করে উঠে এলেন জল থেকে। ঝোঁপের মত জটপাকানো মাথার চুলগুলো উপযুক্ত তৈল ও জলমিশিত সিক্ততায় নরম হয়ে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর ঘাড়ের উপর। তাতে তার দেহসৌন্দর্য আরো বেড়ে গেল। তার উপর দেবী এথেনের কৃপায় আরো বলিষ্ঠ ও দীর্ঘকায় দেখাতে লাগল। স্নানান্তিক সৌন্দর্যে উজ্জ্বল ওডিসিয়াসকে নদীতীরে বসে থাকতে দেখে এক মধুর বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে উঠল নৌসিকা। শ্রদ্ধাবনতচিত্তে সে তার দাসীদের লক্ষ্য করে বলতে লাগল, শোন তোমরা, আমার মনের কথা বলি তোমাদের। দেবতাদের প্রিয় ফ্যাকেসিয়া জাতির মাঝে এই বিশিষ্ট ব্যক্তিটির আবির্ভাব নিশ্চয়ই দেবতাদের পূর্বকল্পিত। যখন আমি ওঁকে প্রথম দেখি তখন ওকে তুচ্ছ ভাবি, কিন্তু এখন ওঁর দেবোপম স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি আমি। উনি যদি আমাদের দেশে বসবাস করতেন তাহলে আমি ওঁকে পতিত্বে বরণ করতেও পারতাম। আমি আশা করি উনি এখানে থেকে যাবেন। কিন্তু সেকথা থাক, এখন ওঁকে খাদ্য ও পানীয় দাও।

নৌসিকার আদেশে দাসীরা প্রচুর খাদ্য ও পানীয় ওডিসিয়াসের সামনে রাখল। দীর্ঘদিন অভুক্ত ওডিসিয়াস তা বুভুক্ষুর মত গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করতে লাগলেন। ইত্যবসরে মনস্থির করে ফেলল নৌসিকা। সে শুকনো কাপড়গুলো গাড়িতে ভরে অশ্ব সংযোজিত করে গাড়িতে উঠে বসল। তারপর ওডিসিয়াসকে ডেকে বলল, শুনুন মহাশয়, এবার আপনাকে পায়ে হেঁটে নগরমধ্যে যেতে হবে। অবশ্য পথের নির্দেশ আমি দেব। আমাদের প্রাসাদে গিয়ে আমার পিতা ও রাজ্যের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের এক সভায় দেখতে পাবেন। সেখানে অবশ্য আপনাকে নিজের পরিচয় নিজেকেই দিতে হবে। তবে আপনি তা পারবেন, কারণ আপনাকে দেখে বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি বলেই মনে হচ্ছে। যতক্ষণ গ্রামাঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাবেন ততক্ষণ আমার এই গাড়ির পশ্চাতে আমার দাসীদের সঙ্গে দ্রুত পথ চলবেন। কিন্তু শহরাঞ্চলের মধ্য দিয়ে এভাবে যেতে পারবেন না।

আমাদের নগরটি চারদিকে এক বিরাট দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তার চারদিকে চারটি বন্দর ও প্রবেশপথ আছে। সেই পথেই বার হয়ে নগরবাসীরা সমুদ্রপথে যাতায়াত করে। এই সব প্রবেশদ্বারের কাছে পাথর দিয়ে গড়া পসেডনের মন্দির আছে এবং সেখানে নগরবাসীরা মিলিত হয়। এই সব জায়গায় নাবিকরা জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ করে। ফ্যাকেসিয়া জাতির লোকেরা তীর ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করে না, তারা শুধু সুন্দর সুন্দর জাহাজ ভাসিয়ে সমুদ্রে পাড়ি দিতে ভালবাসে। এই সব নাবিকদের সঙ্গে দেখা হলে আপনাদের সঙ্গে তাদের যে অপ্রীতিকর বাকবিতণ্ডা হবে তা আমি পরিহার করতে চাই। এইসব নাবিকদের মধ্যে অনেক নীচ প্রকৃতির লোক আছে যারা আমার নামে কলঙ্ক লেপন করবে। তাদের মধ্যে কেউ বলবে, এই দীর্ঘকায় সুপুরুষটি কে? নৌসিকা কোথা হতে ধরে আনল তাঁকে? নিশ্চয় ইনি ওর স্বামী হবেন। সে নিশ্চয় এই জাহাজডুবি বিদেশীকে উদ্ধার করেছে, কারণ আমাদের তো কোন প্রতিবেশী দেশ নেই যার লোক এখানে আসতে পারে। অথবা কোন দেবতা হয়ত তার কাতর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে তার প্রণয়ী ও পরিণেয় পুরুষ হিসেবে স্বর্গ হতে নেমে এসেছেন। ভালই হয়েছে। বাইরে থেকে নিজের মনোমত স্বামী সংগ্রহ করে এনে ভাল করেছে নৌসিকা। দেশের কত ভাল ভাল লোক ওকে বিয়ে করতে চাইলে ও তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। এইভাবে তারা কথা বলাবলি করবে নিজেদের মধ্যে আর তাতে আমার নাম কলঙ্কিত হবে। অবশ্য এটা নিন্দারই কথা। বিবাহের আগে কোন অনূঢ়া কন্যার পক্ষে কোন পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করা উচিত নয় এবং আমি নিজেও তা দোষের বলে মনে করি। সুতরাং আপনি যদি আমাদের প্রাসাদে গিয়ে আমার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান তাহলে আমার কথা শুনুন। আমাদের শহরের সীমানার মধ্যে পথের ধারে পপলার গাছের বন ও প্রস্রবণসমন্বিত এক উদ্যান দেখতে পাবেন। নানারকমের শাকসজীতে পূর্ণ ঐটি হলো আমার পিতার প্রিয় রাজ্যোদ্যানবাটিকা। আপনি ওখানে বসবেন। আমরা বাড়ি পৌঁছে আমার পিতাকে খবর না দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন আপনি সেখানে।

আর আপনি যদি মনে করেন বাড়ি থেকে ফিরতে বিলম্ব হচ্ছে আমাদের, তাহলে আপনি নিজেই এগিয়ে গিয়ে আমার পিতা রাজা অ্যালসিনোয়াসের প্রাসাদ কোথায় তা নগরবাসীদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন। এটা খুবই সহজ ব্যাপার। কোন শিশুও তা দেখিয়ে দিতে পারবে। কারণ সারা নগরের মধ্যে রাজা অ্যালসিনোয়াসের প্রাসাদের মত ওকরম সুদৃশ্য ও সমুন্নত অট্টালিকা একটিও নেই। সেখানে উপনীত হয়ে প্রাসাদ প্রাঙ্গণ ও দরবার কক্ষ অতিক্রম করে দেখতে পাবেন এক জায়গায় একটি চুল্লীর ধারে বসে আমার মাতা ইন্দ্রনীল সমুদ্রে রঙের সুতো দিয়ে বয়ন করে একটি ছবিকে চিত্রিত করে তুলছেন তাঁর সুচীকার্যের মধ্যে। আর তাঁরই পাশে সিংহাসনে এক দেবোপম গাম্ভীর্য সহকারে বসে মদ্যপান করছেন আমার পিতা। আমার পিতার পাশ কাটিয়ে গিয়ে আমার মাতার পা দুটো জড়িয়ে ধরবেন, তাহলে আপনার শীঘ্র বাড়ি ফেরার বাসনা পূর্ণ হবে। তাঁর সহানুভূতি একবার আকর্ষণ করতে পারলেই আপনি আপনার জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে আপনার আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে আবার মিলিত হতে পারবেন।

কথা শেষ করে অশ্ব তাড়না করে গাড়ি ছেড়ে দিল নৌসিকা। নদীটিকে পিছনে ফেলে ছুটে চলল গাড়ি। কিছুক্ষণ যাবার পরে দেবী এথেনের নামাঙ্কিত সেই উদ্যানবাটিকায় উপনীত হল তারা। এতক্ষণ ধীরে ধীরে অশ্বচালনা করে এসেছে নৌসিকা যাতে করে ওডিসিয়াস ও তার দাসীরা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। সেই উদ্যানে উপস্থিত হয়েই দেবী এথেনের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন ওডিসিয়াস। নৌসিকা ও তার দাসীরা চলে গেল। ওডিসিয়াস বললেন, হে জিয়াসকন্যা, আজ আমার প্রার্থনার কথা শোন দেবী। আর তোমার শুনতেই হবে আমার কথা। যেদিন ভূকম্পনদেবতা পসেডনের রোষে আমার নৌকো ভেঙ্গে যায় সেদিন আমার প্রার্থনায় কান দাও নি। ফ্যাকেসিয়াবাসীরা আজ যাতে আমার প্রতি সদয় হয় আজ তার ব্যবস্থা তোমায় করতেই হবে।

দেবী এথেন তাঁর প্রার্থনা স্বকর্ণে শুনেও সশরীরে আবির্ভূত হলেন না তাঁর সামনে। কারণ তাঁর খুল্লতাত পসেডন চাইছিলেন তাঁর স্বদেশ পদার্পণ না করা পর্যন্ত ক্রমাগত কষ্ট পেয়ে যান ওডিসিয়াস আর তাঁর পিতার ভ্রাতার প্রতি শ্রদ্ধাবশতই তার সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করতে পারছিলেন না দেবী এথেন।

সকল অধ্যায়

১. ০১. প্রথম পর্ব
২. ০২. ইথাকায় তর্কযুদ্ধ
৩. ০৩. নেস্টর সকাশে টেলিমেকাস
৪. ০৪. মেনেলাস ও হেলেন
৫. ০৫. কালিপসো
৬. ০৬. নৌসিকা
৭. ০৭. অ্যালসিনোয়াসের প্রাসাদ
৮. ০৮. ফেসীয়দের ক্রীড়ানুষ্ঠান
৯. ০৯. সাইক্লোপ জাতি
১০. ১০. জাদুকরী
১১. ১১. মৃতদের কাহিনী
১২. ১২. সিল্লা ও চ্যারিবডিস
১৩. ১৩. ওডিসিয়াসের ইথাকায় পদার্পণ
১৪. ১৪. ইউমেয়াসের কুটির
১৫. ১৫. টেলিমেকাসের প্রত্যাবর্তন
১৬. ১৬. পুত্রের সাথে ওডিসিয়াসের সাক্ষাৎ
১৭. ১৭. ওডিসিয়াসের নগরযাত্রা
১৮. ১৮. রাজপ্রাসাদে ভিক্ষুক
১৯. ১৯. ইউরিক্লীয়া ওডিসিয়াসকে দেখে চিনতে পারল
২০. ২১. বিশাল ধনুক
২১. ২২. প্রাসাদে খণ্ডযুদ্ধ
২২. ২৩. ওডিসিয়াস ও পেনিলোপ
২৩. ২০. সঙ্কটের পূর্বাভাষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন