১৮. রাজপ্রাসাদে ভিক্ষুক

পার্থ সারথী দাস

অষ্টাদশ পর্ব
রাজপ্রাসাদে ভিক্ষুক

আইরাস নামে একটি ভিক্ষুক বহুদিন থেকে ইথাকার রাজপথে ভিক্ষে করে বেড়াত। সে অনেকের ফাই-ফারমাস খেটেও বেড়াত। ছেলেরা তাকে সংক্ষেপে আইরাস বলে ডাকত। সে সেদিন রাজপ্রাসাদে ভিক্ষা করতে এসে একজন বিদেশী ভিক্ষুককে দেখে রেগে গেল। তার ভিক্ষার ভাগ কমে যাবার ভয়ে সে ওডিসিয়াসকে তার অবাঞ্ছিত প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বলল, যাও যাও, এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেল। দেখছ না রাজবাড়ির বাবুরা আমাকে ইশারা করেছে তাড়াবার জন্য। তুমি নিজে থেকে না গেলে মেরে তাড়াব।

ওডিসিয়াস শান্তভাবে বললেন, আমি তোমাকে আমার কোন কথা বা কাজের দ্বারা আঘাত করি নি। তুমিও আমার মতই ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করো। আর একবার ভেবে দেখো। আমি বৃদ্ধ হলেও আমি তোমার দেহকে আঘাত দ্বারা রক্তরঞ্জিত করে তুলতে পারি। তোমাকে তাহলে এ প্রাসাদের মুখ আর কোনদিন দেখতে হবে না।

ভিক্ষুক আইরাস তখন রাগের মাথায় বলল, তোমার শূয়োরের মত দাঁতগুলো ঘুষি মেরে সব ভেঙ্গে দেব। আ বুড়ো রাঁধুনি এর থেকে আর কি ভাল কথা বলবে। যদি আমার সঙ্গে লড়তে চাও তাহলে বাবুরা দেখুন তোমার কি করি।

তাদের ঝগড়া প্রথমে অ্যান্টিবোয়াসের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সে তখন হেসে অন্য সব পাণিপ্রার্থীদের বলল, দেখ বন্ধুরা, আইরাস আর বিদেশী ভবঘুরের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ হবে। চল আমরা গিয়ে দেখি।

অ্যান্টিনোয়াসের কথায় সকলে এসে চারদিকে ঘিরে দাঁড়াল। অ্যান্টিনোয়াস তখন বলল, ভদ্রমহোদয়গণ, আমার কিছু বক্তব্য আছে। আমাদের নৈশভোজনের জন্য কিছু মাংস আছে। এদের মধ্যে যে জয়লাভ করবে সে সেই মাংস পাবে এবং আমাদের সঙ্গে নিয়মিত ভোজসভায় যোগদান করবে। সে ছাড়া আমাদের কাছে অন্য কেউ আর ভিক্ষা করতে পারবে না।

সকলেই সমর্থন করল অ্যান্টিনোয়াসকে। ওডিসিয়াস তখন বললেন, বন্ধুগণ, আমার মত একজন বৃদ্ধ কখনো একজন যুবকের সঙ্গে লড়াই করতে পারে না। তথপি উদরপূর্তির জন্য আমাকে একাজ করতেই হবে। তবে আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। উপস্থিত কেউ যেন আইরাসকে সাহায্য না করেন।

সকলেই আশ্বাস দিল ওডিসিয়াসকে এবিষয়ে। টেলিমেকাস তখন বলল, বন্ধুগণ, হে বিদেশী, তুমি যদি এর সঙ্গে লড়াই করতে চাও তাহলে অন্য কেউ তোমায় আঘাত করবে না। আমি এ বাড়ির মালিক এবং রাজকুমার অ্যান্টিনোয়াস ও ইউরিমেকাস এ দ্বন্দ্বের বিচার করবেন।

মল্লযুদ্ধ শুরু হলো। ওডিসিয়াস প্রথমে তার দেহগাত্র হতে কম্বলটি খুলে ফেললেন। তার বিস্তৃত বক্ষপট ও পেশীবহুল বলিষ্ঠ বাহু দেখে পাণিপ্রার্থীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তারা দৃষ্টি বিনিময় করতে লাগল পরস্পরের মধ্যে। তাদের মধ্যে একজন বলল, ছিন্নমলিন কম্বলের তলায় কত ভাল এক চেহারা লুকিয়ে ছিল। আইরাসের আর পরিত্রাণ নেই।

আইরাস ওডিসিয়াসের চেহারা দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগল। কিন্তু অ্যান্টিনোয়াস তাকে বলল, একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত বৃদ্ধের সঙ্গে লড়তে গিয়ে যদি ভয়ে কাঁপতে থাক তাহলে তোমার কিন্তু রক্ষা নেই। আবার যদি এই বিদেশী তোমায় হারিয়ে দেয় তাহলে আমি একটি কালো জাহাজে করে তোমায় নরখাদকদের রাজ্যে পাঠিয়ে দেব।

আইরাস ভয়ে কাঁপতে থাকলেও তাকে জোর করে মল্লযুদ্ধে নামানো হলো। ওডিসিয়াস প্রথমে তাকে বধ করবেন না আঘাত দিয়ে ছেড়ে দেবেন তা ভাবতে লাগলেন। পরে ঠিক করলেন কিছু আঘাত দিয়ে লোকটাকে ছেড়ে দেবেন। বেশি শক্তির পরিচয় দিয়ে পাণিপ্রার্থীদের অহেতুক দৃষ্টি আকর্ষণ করে লাভ নেই। যুদ্ধ শুরু হতেই ওডিসিয়াস আইরাসের ঘাড়ে এমনভাবে এক আঘাত করলেন যাতে সে মাটিতে পড়ে গেল। তার দাঁত দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। ওডিসিয়াস তখন আইরাসের পা ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে দরজার পাশে রেখে বললেন, এই নাও তোমার লাঠি, কুকুর আর শিয়াল তাড়াও। ভিখারি হয় রাজার মত কথা বলো না।

এই বলে ওডিসিয়াস তার গায়ে কম্বলটি আবার চাপিয়ে দিয়ে সেই তক্তার উপর বসলেন। পাণিপ্রার্থীরা তখন বললেন, হে বিদেশী, জিয়াস ও অন্যান্য দেবতারা তোমার মনোবাসনা পূর্ণ করুন। এবার ঐ লোকটিকে আমরা নরখাদকের দেশে পাঠাব।

তাদের কথায় খুশি হলেন ওডিসিয়াস। অ্যান্টিনোয়াস তার কথামত চর্বিমেশানো মাংস আর অ্যাম্ফিনোয়াস রুটি এনে খেতে দিল। অ্যাম্ফিনোয়াস বলল, তুমি অনেক কষ্ট সহ্য করেছ, আশা করি ভবিষ্যতে সুখী হবে।

ওডিসিয়াস বললেন, যেহেতু আমাকে দেখে খুব ভদ্র মনে হচ্ছে এবং তোমার পিতা দুলিসিয়ামের রাজা রিসাসের সদাশয় ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতি ছিল, আমার কিছু কথা তোমাকে বলব। পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তার মধ্যে মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে অসহায়। মানুষের যতদিন শক্তি ও সম্পদ থাকে ততদিন সে ভবিষ্যতের কথা ভাবে না। দেবতাদের কথা চিন্তা করে না। আমিও একদিন তাই করতাম। কিন্তু আজ আমি সব শক্তি ও সম্পদ হারিয়ে সেকথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। সুতরাং এটা প্রতিটি মানুষের কাছে শিক্ষার বস্তু যে বিধির বিধান বা ঐশ্বরিক নিয়ম কখনও লঙ্ঘন করতে নেই। ঈশ্বর মানুষকে যা দেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বিধির বিধান লঙ্ঘনের এক দৃষ্টান্ত আমি এখানেও দেখছি। এইসব পাণিপ্রার্থীরা এখানে এমন একজন ব্যক্তির স্ত্রীকে অপমান করছে যিনি খুব বেশি দিন আর দূরে থাকবেন না এবং যিনি এখানে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে রক্তপাত ঘটাবে এ প্রাসাদে।

এই কথা বলার পর ওডিসিয়াস মদের অঞ্জলি দেবতাদের নিবেদন করে সেই পানপাত্রটি অ্যাফিনোয়াসের হাতে দিতে গেলেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ বিপদের আশঙ্কায় পিছিয়ে গেল অ্যাফিনোয়াস। এথেন আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন টেলিমেকাসের বর্শার আঘাতে প্রাণ হারাবে অ্যাফিনোয়াস। তাই সে ভয়ে ভয়ে তার চেয়ারে গিয়ে বসল।

এমন সময় অন্দরমহলে তার ঘরে বসে থাকা পেনিলোপের মাথায় এক বুদ্ধি গজিয়ে দিলেন এথেন। পেনিলোপ স্থির করলেন তিনি এই সময় পাণিপ্রার্থীদের সামনে গিয়ে তাদের তীব্র উৎসর্গ দ্বারা তিরস্কৃত করে তাদের উত্তপ্ত করে তুলবেন এবং তার ফলে পন্ত্রিতা সতী নারী হিসেবে তাঁর গুরুত্ব বেড়ে যাবে তাঁর সন্তানের চোখে। তিনি তাঁর ইউরিনোম নামে এক দাসীকে ডেকে বললেন, যেসব দুবৃত্ত মুখে ভাল কথা বলে ভিতরে ভিতরে চক্রান্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আমার পুত্রকে সতর্ক করে দিতে চাই।

ইউরিনোম বলল, হ্যাঁ মা, আপনার পুত্রকে গিয়ে সব কথা খুলে বলুন। কিন্তু তার আগে ভাল করে মুখ ধুয়ে গণ্ডদ্বয়ে তৈলমর্দন করে প্রসাধনকার্য সম্পন্ন করে যান।

পেনিলোপ বললেন, ইউরিনোম, যেদিন আমার স্বামী চলে গেছেন বিদেশে সেদিনই আমার সব দেহসৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেছে। যাই হোক, এখন অ্যান্টনি হিপ্লোডেমিয়াকে ডেকে আন। তারা আমার সঙ্গে যাবে। আমি একা নারী হয়ে সেইসব বীরপুরুষদের সঙ্গে ঝগড়া করতে যাব না।

ইউরিনোম দাসীদের ডাকতে গেলে এথেন সহসা নিদ্রাভিভূত করে তুললেন পেনিলোপকে। সঙ্গে সঙ্গে এক ঐশ্বরিক প্রসাধন দ্রব্যের দ্বারা তার গাত্রত্বক ও গণ্ডদ্বয়ের সৌন্দর্য ও কর্মনীয়তা বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর দেহলাবণ্য আরো বেড়ে গেল আগের থেকে। দাসীরা কাছে এলে পেনিলোপের নিদ্রাভঙ্গ হলে তিনি তাঁর দুদিকে দুজন বিশ্বস্ত দাসী নিয়ে পাণিপ্রার্থীদের সামনে মুখের উপর অবগুণ্ঠন টেনে একটি স্তম্ভের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। পেনিলোপের দেহসৌন্দর্য দেখে পাণিপ্রার্থীদের লালসা আরো বেড়ে গেল। তাদের প্রত্যেকেই তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠল।

কিন্তু পেনিলোপ কোনদিকে না তাকিয়ে টেলিমেকাসকে লক্ষ্য করে বললেন, টেলিমেকাস, তুমি যখন বালক ছিলে, তোমার যে বুদ্ধি বিবেচনা ছিল আজ তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তা আজ তোমার নেই। আমি ভাবছি একটু আগে এ বাড়িতে যা ঘটে গেছে তার কথা। তোমার সামনে একজন অতিথির সঙ্গে লজ্জাজনক দুর্ব্যবহার করা হয়েছে আর তা তুমি নীরবে দেখেছ, এ বাড়ির কোন অতিথি যদি পুনরায় এরূপ ব্যবহার পান তাহলে তার কি করবে?

টেলিমেকাস গুরুত্বসহকারে বলল, তোমার ক্রোধ যথার্থ মা, আমার অন্তরে ন্যায় অন্যায় বোধ যথেষ্ট আছে। কিন্তু এইসব দুষ্কৃতকারীদের প্রতিকূলতার ফলে আমি ন্যায়সঙ্গত পথ জেনেও তা অবলম্বন করতে পারছি না। ওরা আমাকে সমর্থন করে না। হায়, যদি জিয়াস, এথেন ও অ্যাপোলোর কৃপায় এইসব পাণিপ্রার্থীরা আইরাসের মতই ভগ্নদেহ ও উত্থানশক্তিরহিত অবস্থায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকত।

ইউরিমেকাস এবার এ প্রসঙ্গের অবসান ঘটিয়ে পেনিলোপকে সম্বোধন করে বলল, হে আইকারিয়াসকন্যা বুদ্ধিমতী পেনিলোপ, আজ গ্রীসের সব লোক যদি তোমায় দেখত তাহলে তারা তোমার রূপসৌন্দর্য ও বাকভঙ্গিমা দেখে সকলেই তোমার পাণিপ্রার্থীতে পরিণত হত।

পেনিলোপ উত্তর করল, হায় ইউরিমেকাস, যেদিন গ্রীকদের সঙ্গে আমার স্বামী ইলিয়ামনগরীর পথে যাত্রা করেন সেইদিনই আমার সকল রূপলাবণ্য আমার দেহ ত্যাগ করে চলে গেছে। আর যদি ওডিসিয়াস ফিরে আসতেন তাহলে আবার আমার রূপসৌন্দর্য ফিরে আসত আমার দেহে। আমার সুনাম যেত বেড়ে। যেদিন তিনি এ প্রাসাদ ছেড়ে চলে যান সেদিনকার কথাটি আজও মনে আছে আমার। তিনি আমার ডানহাতের কব্জি ধরে বললেন, এ বাড়ির সমস্ত ভার তোমার উপর দিয়ে গেলাম। আমার অবর্তমানে আমার বৃদ্ধ পিতামাতাকে দেখো। আমার পুত্রকে মানুষ করে তুলল। তার মুখে দাড়ি গজানোর পর আবার তুমি কাউকে বিয়ে করে এ বাড়ি ত্যাগ করতে পার। কারণ ট্রয়যুদ্ধ শেষে আমি নাও ফিরতে পারি। তাঁর কথাই আজ সত্যে পরিণত হতে চলেছে। এমন একদিন হয়ত আসবে যেদিন অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্বামী হিসেবে কাউকে গ্রহণ করতে হবে আমায়। কিন্তু তোমাদের যে ব্যবহারটা আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছে তা হচ্ছে এই যে সাধারণত প্রেমনিবেদনকারীরা সঙ্গে খাদ্য, রসদ ও উপহার নিয়ে আসে মেয়ের বাড়িতে। কিন্তু তোমাদের মত কেউ মেয়ের বাড়িতে বসে অন্ন ধ্বংস করে না।

পেনিলোপের কথা শুনে প্রীত হলেন অতিথিবেশী ওডিসিয়াস। পতিব্রতা পেনিলোপ প্রতিপ্রেমে সমস্ত প্রাণ মনকে সংহত ও দৃঢ়সংবদ্ধ করে রেখে কিভাবে কৌশলে বাকচাতুর্যের দ্বারা এক শ্রদ্ধাসিক্ত আসক্তি আকর্ষণ করেছেন পাণিপ্রার্থীদের কাছ থেকে তা স্বচক্ষে দেখে আনন্দিত হলেন তিনি।

এবার অ্যান্টিনোয়াস বলল, আইকারিয়াসকন্যা হে বুদ্ধিমতী পেনিলোপ, যদি তুমি উপহার চাও তাহলে আমাদের প্রত্যেকেই তোমাকে বহু মূল্যবান উপহার পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু তুমি যতদিন আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত কোন ব্যক্তিকে স্বামীরূপে গ্রহণ না করবে ততদিন আমরা প্রাসাদ ত্যাগ করে কোথাও যাব না।

সকলেই একথা মেনে নিল এবং আপন আপন সহচরকে উপহার আনতে পাঠাল আপন আপন বাড়িতে। অ্যান্টিনোয়াসের লোক নিয়ে এল একটি কারুকার্যখচিত মূল্যবান পোশাক। ইউরিমেকাসের লোক নিয়ে এল জপের মালার মত একটি সোনার শিকল ও দুটি সোনার কর্ণকুন্তল। পিসান্ডারের লোক নিয়ে এল মূল্যবান কণ্ঠহার। এইভাবে সব উপহারগুলো এসে পড়লে পেনিলোপ কোন কথা না বলে উপরতলায় চলে গেলেন আর তাঁর পরিচারিকারা সমস্ত উপহারগুলো তুলে নিয়ে গেল।

সন্ধ্যা পর্যন্ত পাণিপ্রার্থীরা পান ভোজন ও নৃত্যগীতাদির দ্বারা আমোদ প্রমোদ করতে লাগল। সন্ধ্যা হতেই নৃত্যগীত বন্ধ করে সেই বিরাট সুপ্রশস্ত হলঘরটিকে আলোকিত রাখার জন্য তিন জায়গায় আগুন জ্বালাল তারা। অনেক কাঠ জমা করা হলো। প্রাসাদের অন্তঃপুর হতে দাসীরা প্রায়ই এসে আগুনে কাঠ ফেলে দিয়ে যেতে লাগল। একসময় ওডিসিয়াস তাদের বললেন, তোমরা রাণীর কাছে গিয়ে তার কি দরকার দেখগে। তাকে সাহচর্য দান করগে অথবা সুতো কাটগে। এখানে আগুনে কাঠ আমি ফেলে দেব।

অন্য দাসীরা অতিথিবেশী ওডিসিয়াসের কথা শুনে হাসতে লাগল। কিন্তু মেলানথো রেগে গেল। মেলানথোর সঙ্গে ইউরিমেকাসের গোপন প্রণয় ছিল। রাণীর প্রতি মোটেই বিশ্বস্ত ছিল না মেলানথো, যদিও তাকে ছোট থেকে রানী পেনিলোপই মানুষ করে তোলেন প্রচুর দয়া দাক্ষিণ্যের দ্বারা। মেলানথো ওডিসিয়াসকে বলল, রাত্রিবেলায় তুমি এখানে কি করছ, অন্য কোন স্থানে যাও না কেন? একটা বাজে ভবঘুরে কোথাকার। বেশি বড় বড় কথা বলতে তো আইরাসের থেকে অন্য কোন শক্তিমান লোক তোমার মাথাটা ভেঙ্গে দেবে।

ওডিসিয়াস গর্জন করে উঠলেন, আমি এখনি টেলিমেকাসকে গিয়ে বলে দেব তোমার কথা। সে তাহলে তোমার ব্যবস্থা করবে।

এ কথায় ভয় পেয়ে দাসীরা ছুটে পালিয়ে গেল। ওডিসিয়াস মাঝে মাঝে আগুনে কাঠ ফেলে আলোটা রাখছিলেন আর আড়চোখে পাণিপ্রার্থীদের দিকে তাকাচ্ছিলেন।

এত শীঘ্র পানিপ্রার্থীদের মতের কোন পরিবর্তন সাধন না করে ওডিসিয়াসের অন্তর্বেদনাকে আরো গভীর করে যেতে চাইলেন দেবী এথেন। সহসা ইউরিমেকাস একটা টিপ্পনি কেটে বলল, শোন সব হে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীগণ, আমার মনে হয় নিশ্চয় কোন দেবতা এই লোকটিকে ওডিসিয়াসের রাজপ্রাসাদের পথ দেখিয়ে এনেছেন। মনে হচ্ছে ওর গা থেকে একটা জ্যোতি বেরিয়ে আসছে।

এবার ইউরিমেকাস ওডিসিয়াসের দিকে ঘুরে বলল, আচ্ছা বিদেশী, আমি ভাবছি যদি আমি তোমাকে আমার খামার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উপযুক্ত বেতনে পাথর দিয়ে বাঁধ বাঁধার ও গাছ লাগানোর কাজে লাগাই তাহলে কি কাজ করবে? খাওয়া পরার কোন অসুবিধা হবে না। তবে তুমি কাজ না করে শহরের পথে পথে ভিক্ষা করার লোভ ছাড়তে পারবে না।

ওডিসিয়াস বললেন, ইউরিমেকাস, গ্রীষ্মকালে সারাদিন ধরে না খেয়ে তুমি আর আমি দুজনে যদি মাঠে ঘাস কাটা অথবা লাঙ্গল চালানোর কাজ করি তাহলে দেখবে আমি তোমার থেকে কত এগিয়ে যাই কাজে। অথবা যদি যুদ্ধ লাগে আর আমার হাতে ঢাল শিরস্ত্রাণ ও বর্শা থাকে তাহলে আমি সম্মুখ সারিতে এমনভাবে যুদ্ধ করব যাতে কেউ কোন কথা বলার সাহস পাবে না। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার মুখেই যত বড়াই, আসলে কোন ক্ষমতা নেই। আজ যদি হঠাৎ ওডিসিয়াস আসে তাহলে তোমরা সকলে পালাবার পথ পাবে না। দরজাগুলো ছোট মনে হবে।

ইউরিমেকাস একথা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। বলল, পাজী কোথাকার, মনের ঝোঁকে তুমি একথা বললে অথবা আইরাসকে মেরে খুব অহঙ্কার হয়েছে। এই বলে কাঠের টুলটা ওডিসিয়াসের দিকে ছুঁড়ে দিতে মদ পরিবেশনকারী ভৃত্যের হাতে তা লাগল এবং তার হাত থেকে মদের পাত্রটি পড়ে গেল। তখন সেই প্রায়ান্ধকার প্রশস্ত কক্ষটিতে হৈ চৈ পড়ে গেল। পাণিপ্রার্থীদের অনেকে বলতে লাগল, সামান্য একটা ভিক্ষুককে নিয়ে আমরা কেন এত নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে আমাদের সব ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছি?

টেলিমেকাস বলল, আমার মনে হয় মদের নেশায় আপনাদের কারো মাথার ঠিক নেই। আমার অনুরোধ, এবার আপনারা আপন আপন ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন, আপনারা যথেষ্ট তুপ্তি সহকারে ভোজন করেছেন।

অনেকে টেলিমেকোসের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথায় ক্ষুণ্ণ হলো মনে মনে। অ্যাম্ফিনোয়াস বলল, ঠিক কথা বলেছে টেলিমেকাস। আমাদের পক্ষে কোন বিদেশী অথবা ভূত্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা উচিত নয়। এবার দেবতাদের মদ নিবেদন করে চল শুতে যাই। অ্যাম্ফিনোয়াসের কথা সকলেই মেনে নিয়ে মদের অঞ্জলি দান করে আপন আপন ঘরে রাত্রির মত চলে গেল পাণিপ্রার্থীরা।

সকল অধ্যায়

১. ০১. প্রথম পর্ব
২. ০২. ইথাকায় তর্কযুদ্ধ
৩. ০৩. নেস্টর সকাশে টেলিমেকাস
৪. ০৪. মেনেলাস ও হেলেন
৫. ০৫. কালিপসো
৬. ০৬. নৌসিকা
৭. ০৭. অ্যালসিনোয়াসের প্রাসাদ
৮. ০৮. ফেসীয়দের ক্রীড়ানুষ্ঠান
৯. ০৯. সাইক্লোপ জাতি
১০. ১০. জাদুকরী
১১. ১১. মৃতদের কাহিনী
১২. ১২. সিল্লা ও চ্যারিবডিস
১৩. ১৩. ওডিসিয়াসের ইথাকায় পদার্পণ
১৪. ১৪. ইউমেয়াসের কুটির
১৫. ১৫. টেলিমেকাসের প্রত্যাবর্তন
১৬. ১৬. পুত্রের সাথে ওডিসিয়াসের সাক্ষাৎ
১৭. ১৭. ওডিসিয়াসের নগরযাত্রা
১৮. ১৮. রাজপ্রাসাদে ভিক্ষুক
১৯. ১৯. ইউরিক্লীয়া ওডিসিয়াসকে দেখে চিনতে পারল
২০. ২১. বিশাল ধনুক
২১. ২২. প্রাসাদে খণ্ডযুদ্ধ
২২. ২৩. ওডিসিয়াস ও পেনিলোপ
২৩. ২০. সঙ্কটের পূর্বাভাষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন