২৫. খুঁটি পোঁতা হচ্ছে

হুমায়ূন আহমেদ

নীলগঞ্জ রেলস্টেশনের উত্তরের ফাঁকা জায়গাটায় চার-পাঁচ জন লোক কী যেন করছে। খুঁটি পোঁতা হচ্ছে। এক জনের হাতে কাগজ-পেন্সিল। সে গরমের মধ্যেও একটা হলদে রঙের কোট পরে আছে। চৌধুরী সাহেব রেলস্টেশন থেকে ব্যাপারটা দেখতে পেলেন। হচ্ছেটা কি? কোনো সরকারী অফিস-টফিস নাকি? তাঁর তো তাহলে জানার কথা। অবশ্যি আজকাল আর আগের মত খোঁজখবর রাখতে পারেন না। কিছুদিন আগেই হঠাৎ শুনলেন নীলগঞ্জে একটা অয়েল মিল বসান হয়েছে। বিদেশী লোকজন হুট-হাট করে কাজ করে। আগেভাগে কাউকে কিছু বলে না। চৌধুরী সাহেব খবর নিয়ে জানলেন, জন খাঁ অয়েল মিল দিয়েছে। ভাটি অঞ্চলের নতুন ধনী। জলমহালে পয়সা করে এখানে পয়সার গরম দেখাতে এসেছে। চৌধুরী সাহেব এক দিন গেলেন অয়েল মিল দেখতে। মিলের কাজকর্ম এখনন শুরু হয় নি, ভিত পাকা করা হচ্ছে। জনু খাঁ খুবই খাতির করল। দাঁত বের করে বলল, গরিবের ঘরে থতির পা।

আসলাম আপনার মিল দেখতে।

দেখবার কিছু নেই জনাব। গরিবী হালতে শুরু করলাম।

গরিবী হালত বলে অবশ্যি মনে হল না। নানান কিসিমের লোকজন দেখা গেল। জনু খাঁ পানির দেশ থেকে দলবল নিয়ে এসেছে। চৌধুরী সাহেব বললেন, শুকনার দেশে বসত করবেন মনে হয়।

তা ঠিক, চৌধুরী সাব। পানির দেশে ডাকাইতের ভয়টা বেশি।

চোর-ডাকাত তো সবখানেই আছে।

শুকনা দেশের ডাকাইত আর পানির দেশের ডাকাইত–কী যে আপনি কন চৌধুরী সাব! হেঁ-হেঁ-হেঁ।

বিদেশী লোকজন ঢুকে পড়ছে নীলগঞ্জে। লক্ষণ ভালো নয়। কিছু করা দরকার। সেই বছর চৌধুরী সাহেব সরিষার ব্যবসা করবেন ঠিক করলেন। পিডিপির ইঞ্জিনীয়ারদের কি-না-কি বললেন, যার ফলে একটা ট্রান্সমিটার নষ্ট হয়ে গেল। গোটা মাসে বাতি জ্বলল মিটমিট করে। জনু খাঁ ছ মাসের মাথায় অয়েল মিল বিক্রি করে ফেলল।

চৌধুরী সাহেব স্টেশনের উত্তরের ফাঁকা জায়গায় এসে হাজির হলেন। কড়া বোদ উঠেছে। ছাতা না আনায় তাঁর মাথা ঝাঁ-ব্য করতে লাগল। এই বছর বৃষ্টিবাদলা হচ্ছে না। খুব খারাপ লক্ষণ। চৌধুরী সাহেব গলা উচিয়ে ডাকলেন, এই যে, এই।

হলুদ কোট পরা লেকটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। গায়ে কোট থাকলেও লোকটার চেহারা চাষাড়ে। সে উদ্ধত স্বরে বলল, কী চান?

নাম কি তোমার?

উদ্ধত ধরনের লোকদের আচমকা তুমি করে বললে তাদের প্রতিরোধ ভেঙে যায় এটি একটি বহু পরীক্ষিত তথ্য। চৌধুরী সাহেব আবার বললেন, নাম কি তোমার?

নাম দিয়ে কী করবেন?

এইখানে হচ্ছেটা কি?

সিনেমা হল হবে। বিউটি ছায়াঘর।

করছেটা কে?

নেসারউদ্দিন সাহেব।

নেসারউদ্দিন সাহেবটা কে?

ময়মনসিংহের। উনার আরো দুইটা সিনেমা হল আছে। নেত্রকোণায় একটা, ময়মনসিংহে একটা।

লোকটি চৌধুরী সাহেবের প্রশ্নে নার্ভাস বোধ করছিল। তা কাটাবার জন্যেই সে সিগারেট ধরাল।

বিদেশী লোজন আসতে শুরু করেছে। ছোট নীলগঞ্জ এখন আর ঘোট নয়। আর কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো যে-কেউ ফস করে তার সামনে সিগারেট ধরাবে। চৌধুরী সাহেব ক্লান্ত পায়ে হাটতে শুরু করলেন। রোদ বড় কড়া। এই বয়সে এত রোদে হাঁটাচলা করা মুশকিল।

নীলগঞ্জ হাইস্কুলের কাছে আসতেই তার মনে হল আজ সকালে স্কুল কমিটির মিটিং ছিল, তিনি আসতে পারেন নি। এরকম ভুল তাঁর হয় না। হওয়াটা ঠিক নয়। বয়সের লক্ষণ। চৌধুরী সাহেব নীলগঞ্জ স্কুলে ঢুকে পড়লেন। হেডমাষ্টার সাহেবের ঘরে ফ্যান আছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা হওয়া ভালো। মিটিংয়ে কিছু হয়েছে। নাকি তাও জানা দরকার। নীলগঞ্জ স্কুলের হেডমাষ্টার সাহেব লোকটি মহা চালবাজ এবং মহা ধূর্ত। ধূর্ত লোকজন সময়ে অত্যন্ত বিনয়ী হতে পারে। এইটি চৌধুরী সাহেবের ভালো লাগে। হেডমাষ্টার সাহেব খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, শরীরটা খারাপ নাকি চৌধুরী সাহেব?

নাহ্‌।

হেডমাষ্টার সাহেব স্কুলের দপ্তরীকে পাঠালেন ডাব আনতে।

চৌধুরী সাহেব বললেন, কাজে আটকা পড়েছিলাম। মিটিং হয়েছে?

জ্বিনা, আপনি ছাড়া মিটিং হবে কি? বুধবারে ডেট দিয়েছি। বুধবারে কোনো অসুবিধা নাই তো?

নাহ্‌।

হেডমাষ্টার সাহেব গলার স্বর দু ধাপ নিচে নামিয়ে বললেন, সোবাহান মোল্লা স্কুল ফাণ্ডে দশ হাজার টাকা দিয়েছে। নতুন পয়সা হয়েছে আর কি। হা-হা-হা।

চৌধুরী সাহেব ভ্রূ কুঁচকে বললেন, কবে দিল?

মিটিংয়ের সময় এসে বলে গেছে।

ও।

চৌধুরী সাহেব নড়েচড়ে বসলেন; লক্ষণ মোটই ভালো নয়। এই সব নতুন পয়সাওয়ালা লোকজন ভেসে উঠতে চেষ্টা করছে। চৌধুরী সাহেব মৃদুস্বরে বললেন, নীলগঞ্জে সিনেমা হল হচ্ছে।

আর বলেন কেন, দেশটা অধঃপাতে যাচ্ছে।

চৌধুরী সাহেব উঠে পড়লেন।

ডাব আনতে গেছে, একটু বসেন চৌধুরী সাহেব।

নাহ।

একটু বসেন। এসে পড়বে।

চৌধুরী সাহেব বসলেন না।

একটা রিকশা ডেকে দিই চৌধুরী সাহেব?

রিকশা লাগবে না।

নীলগঞ্জ বদলে যাচ্ছে। রিকশা পাওয়া যায় এখন। রাস্তাঘাটে অচেনা লোকজন দেখা যায়। বড়ো বড়ো অফিসাররা এখন আর চৌধুরী সাহেবের বাড়ি এসে ওঠেন না। তাদের জন্যে সরকারী ডাকবাংলা হয়েছে।

প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে চৌধুরী সাহেব হাঁটতে লাগলেন। তৃষ্ণা পেয়েছে। ডাবটা খেয়ে এলে হত। পাশ ঘেঁষে খালি রিকশা যাচ্ছে একটিা চৌধুরী সাহেব ভারি গলায় বললেন, এই থাম।

রিকশা থামল না। রিকশাওয়ালা সরু গলায় বলল, ভাড়া যাইতাম না।

নীলগঞ্জে এখন অনেকেই তাঁকে চেনে না। তিনি প্রচণ্ড একটা ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না।

মসজিদের কাছাকাছি এসে শুনলেন ওয়াজ হচ্ছে। মসজিদের ইমাম সাহেব নতুন এসেছেন। আগের ইমাম সাহেবের ঘর-সংসার ছিল। ইনি এখনো বিয়েটিয়ে করেন নি। হাতে সম্ভবত কাজকর্ম কিছু নেই। সময়ে-অসময়ে মাইক ভাড়া করে নিয়ে আসেন। চৌধুরী সাহেব শুনলেন, ভাইসব, হাদিস-কোরানের কথা আজকাল কেউ শুনে না। মেয়েরা পর্দাপুশিদা করেন। হাটে-ঘাটে গজে-গ্ৰামে যুবতী মেয়েরা নাভির নিচে কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়–

ইমাম সাহেব অল্পবয়স্ক বলেই যুবতী মেয়েদের কথা তার ওয়াজে বারবার আসে। ওয়াজের ফাঁকে-ফাঁকে কোরান শরীফের আয়াত পড়া হয়। তাঁর কণ্ঠ অসম্ভব মধুর বলেই শুনতে বড়ো ভালো লাগে। কিন্তু আজ লাগছে না। চৌধুরী সাহেবের ইচ্ছা হল ইমাম সাহেবকে ডেকে একটা ধমক দেন। কিন্তু তা দেওয়া সম্ভব নয়। লোকটি আল্লাহ-খোদার নাম নিচ্ছে।

সকল অধ্যায়

১. ০১. সে ছাড়া পেল বসন্তকালে
২. ০২. দবির মিয়া নীলগঞ্জের বাজারে
৩. ০৩. রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ
৪. ০৪. দেশের উন্নতি হচ্ছে না
৫. ০৫. অঞ্জু খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে
৬. ০৬. অমাবস্যার রাতে নীলগঞ্জ বাজারে
৭. ০৭. সন্ধ্যার আগেই বাঁয়া-তবলা নিয়ে
৮. ০৮. সাইফুল ইসলাম খানার পাশ দিয়ে
৯. ০৯. জহুরের বিছানা আজ বারান্দায়
১০. ১০. থানাওয়ালাদের বিরুদ্ধে কেইস
১১. ১১. জায়গাটা অন্ধকার
১২. ১২. চৌধুরী সাহেবের বাড়ি
১৩. ১৩. রাতে ভালো ঘুম হয় না
১৪. ১৪. হঠাৎ বৃষ্টি
১৫. ১৫. এশার নামাজের পর
১৬. ১৬. নবীনগর থেকে মনসুরের বাবা
১৭. ১৭. দবির মিয়া বিছানায় শোওয়ামাত্র
১৮. ১৮. সাইফুল ইসলাম ভোরবেলা গলা সাধে
১৯. ১৯. জহুরের শার্টের পকেটে
২০. ২০. খয়েরী রঙের একটা শাড়ি
২১. ২১. সাইফুল ইসলাম রাত এগারটার সময়
২২. ২২. নীলগঞ্জ স্টেশনের ওয়েটিং রুমে
২৩. ২৩. অঞ্জু স্কুলে গিয়েছে
২৪. ২৪. সন্ধ্যাবেলা মেয়ে দেখতে আসবার কথা
২৫. ২৫. খুঁটি পোঁতা হচ্ছে
২৬. ২৬. কাঁঠাল গাছের নিচে
২৭. ২৭. নাশতা নিয়ে এল অঞ্জু
২৮. ২৮. ট্রেন থেকে নেমে
২৯. ২৯. রাজকন্যার মতো দেখাচ্ছে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন