পারিবারিক : স্ত্রী

মহাশ্বেতা দেবী

সকাল থেকেই জয়ার কোনো অবসর ছিল না। রাজনীতিক নেতার একদা রাজনীতিক এবং পাঁচ বছর রাজনীতিবিমুখ স্ত্রীদের থাকে না।

শহরের দামী নেতা পলটুদার জন্মদিন।

এমন দিনে জয়া সহযোগিতা করবেই এটা পলটু জানে। বরাবর করেছে। স্ত্রী অরাজনীতিক, ঘর সংসার নিয়ে থাকে। এমন দিনে সে শতশত পেয়ালা চা করবে, বাইরের ঘরে পাঠাবে, শত শত সন্দেশ।

সন্দেশ বা চা পাতা জয়াকে দীর্ঘ পাঁচ বছর কিনতে হয় না।

কারা যেন সব উপহার দিয়ে যায়। দার্জিলিঙের চায়ের পেটি, কমলালেবুর ঝুড়ি, শাড়ি ও ধুতি, পাঞ্জাবীর কাপড়। অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার সন্দেশ পাঠিয়েছিল।

সকাল থেকে কত যে উপহার এল। জয়া দেখে ক্লান্ত, ক্লান্ত। রাজনীতিক নেতার বউ হিসেবে তার জন্যেও শাড়ি।

এ সব শাড়ি জয়া পরবে না, বিলিয়ে দেবে, সবাই জানে, তবু দেয়।

সকাল থেকেই ও ক্লান্ত, ক্লান্ত, লিলির পাশে বসা হয়নি, যাওয়া হয় নি ও ঘরে। ভাগ্যে দিনটা রবিবার আর তনিমাও এসেছিল।

তনিমা লিলির ঘরে বসে আছে। আজ বাড়ির কাজের লোকেরাও ব্যস্ত এবং লিলির জন্য অন্য কাউকে করতে দেয় না জয়া।

এ নিয়ে পলটু ওকে অনেক বার বলেছে।

—এটা তোমার ম্যানিয়া হয়ে যাচ্ছে।

—হয়তো।

জয়া দীর্ঘকাল স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে হলে প্রতিরক্ষা পাঁচিলের ভেতর থেকে কথা বলে।

পুরনো জয়াকে পলটু আঘাত করতো হরদম। জয়া ছিল পলটুর বক্সিং—এর ঘুষি অভ্যাসের বালির ব্যাগ।

নিরন্তর জখম হতে হতে পুরনো জয়া আর অটুটু নেই। না, চল্লিশ বছর বয়সে এখনো ওর বাইরের চেহারা তেমন জখম নয়।

কপাল থেকে ডান কানের সামনে দিয়ে কাঁধ অবধি কাটা দাগটা বাদ দিলে জয়া এখনো চলে যাবার মতো চেহারা। চুল ওর আজও অন্ধকার বিদিশার নিশা। বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করার মতো চুল।

ভেতরে তো জয়া অক্ষত নেই। পলটু রাজনীতির কেরিয়ারে ওপরে উঠতে উঠতে পুরনো, আদর্শবাদী, রাজনীতিক আনুগত্যে অটল জয়াকে বড্ড জখম করছে।

যে টুকু ওর বাকি আছে, সেটুকুর চারদিকে জয়া সে জন্যেই পাঁচিল তুলেছে। স্বামীর সঙ্গে কথা বলে ও সেই আড়াল থেকে।

মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা ওর ম্যানিয়া, এ কথার জবাবে জয়া যখন বলে, ”হয়তো’,—পলটু ক্ষেপে যায়।

—তোমার ভাবখানা দেখলে মনে হয় এখনো আমরা সেই…

—না, আমি জানি আমরা সেখানে নেই।

—স্বচ্ছন্দে তুমি ওর জন্যে নার্স রাখতে পারো।

—না। কেন না শহরে একটা নাসিংহোম থেকেই নার্স—এর খবর মেলে।

—হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বললে…

—তারা মিনিমাগনা সার্ভিস দিতে বাধ্য।

—তার মানে?

—মানে পরিষ্কার। তুমি এ শহরে সম্রাট। তোমার মেয়েকে যে দেখবে সে পয়সা চাইলে শহর থেকে তার বাস উঠে যাবে।

—তুমি আমায় কি ভাব?

—কিছুই ভাবি না।

—কেন, নার্স আনি নি?

—সে বেচারা ডবল কেন তিনটে ডিউটি করতে পারছিল না। আমিই তাকে চলে যেতে বলি। অবশ্য সে শহর ছেড়েই পালিয়েছে।

—তিনটে ডিউটি?

—নিশ্চয়।

জয়া বেণী বাঁধতে বাঁধতে বলে, লিলিকে দেখা, মাঝে মধ্যে তোমার সঙ্গে শোয়া, সে কথা আমার কাছে চেপে রাখা…ক’টা হল?

—জয়া!

—বেচারা তুমি! অন্য কেউ এ কথা বললে তাকে তুমি ”নিখোঁজ” করে দিতে। আমার বেলা একটু অসুবিধে আছে বই কি! আমি তোমার স্ত্রী! অবশ্য দুর্ঘটনার চেষ্টা করতে পারো। তবে আমার দাদারা আবার তোমার বিরোধী, আমার খবর রাখে, দু’জন নামকরা ক্রিমিনাল ও সিভিল ব্যারিষ্টারের বোনকে দুর্ঘটনায়…বললে তারা ছেড়ে দেবে না।

—জয়া! তুমি ম্যানিক হয়ে যাচ্ছ।

—ম্যানিক, ম্যানিয়া, এ সব শব্দ বোধহয় সম্প্রতি শিখেছ কোনো বই থেকে।

—অসুস্থ মেয়ের কাছে থেকে থেকে…

—অসুস্থ নয়।

—ওটা কি আমার ইচ্ছাকৃত!

—কি করে জানব? শিলিগুড়ি থেকে এতটা পথ…ড্রাইভার চালাচ্ছিল…তুমি প্রথমত ভালো চালাও না। দ্বিতীয়ত মদ খেয়েছিলে। অবশ্য ওর হাত থেকে হুইল নেবার আগে থেকেই তুমি ক্ষেপে ছিলে!

—সেই কথা, আবার!

—আঃ, কেউ না জানলেও, অবশ্য সবাই জানে, কিন্তু আমিও তো জানি।

জয়া মধুর হাসে। বলে সব জানি। বনমহোৎসব করছ, শহরে গাছ লাগাচ্ছ, সাতটা জেলার কাগজের লোক ছবি তুলছে, ভ্যান্টার স্টুডিও ছবি তুলছে, কলকাতায় যাবে। এরই মধ্যে তোমারই লোকের চোরাই কাঠের লরি আটকাল, তোমাকে দৌড়তে হল।

—লাডিয়া আমার লোক নয়।

—নিশ্চয় তোমার লোক। কার মদতে ও জঙ্গল কাটায়, পঞ্চাশটা ট্রাক খাটায়, শহরে বেআইনী স—মিল খুলে যায়, তোমাকে মারুতি উপহার দেয়?

—চুপ করবে?

—না, চুপ করব না। কার গাড়িতে তুমি দৌড়েছিলে? কার কৌশলে থানা অফিসার, বিট অফিসার সাসপেনড হল? লাডিয়া তোমার লোক নয়! লাডিয়া তোমার লোক, কলকাতার লোক, লালবাড়ির লোক, বেশ! তাই হোক!

—ছি ছি ছি, জয়া!

—ছি ছি ছি পলটু। তোমার চক্রান্তে সবই উলটে যায় পরে। কিন্তু সেদিন তুমি ভয় পেয়েছিলে, ক্ষেপেছিলে ভীষণ। ভালো। কিন্তু আমি, লিলি, আমরা শিলিগুড়িতে আমার বন্ধুর বাড়িতে কয়েকদিন ধরে, আমাদের ডাকতে গেলে কেন?

—খালি বাড়িতে ফিরব…

—চালাতে গেলে কেন? কেন ওখানে জঘন্য একটা সীন করলে? কেন আমাদের বাধ্য করলে লাডিয়ার গাড়িতে উঠতে? আমি উঠি না, তুমি জানো না?

পলটু নিরুত্তর, হতাশ।

—কেন চালালে গাড়ি? কেন দুর্ঘটনা হল? কেন লিলি পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে? কেন ড্রাইভার মরল আর তুমি রইলে প্রায় অক্ষত? বুঝতে পারো না?

—কি বুঝব?

—সবটা তোমার পরিকল্পনা মতো হল না। লিলি যখন পঙ্গু, কোমর থেকে ওর সবটা অসাড়, চোখ যখন অন্ধ, তখন আমাকেই ওর সেবা করতে হবে।

—পরিকল্পনা!

—নিশ্চয়। লিলিকে আমি মনে করে ধাক্কা দিয়েছিলে, জয়া! বলে চেঁচিয়েছিলে, কি ভেবেছিলে?

—তুমি পাগল হয়ে গেছ জয়া। তোমাদের বাঁচাবার জন্যেই আমি…

—তোমাকে তো তাই বলতে হবে।

—লিলির কাছে থেকে থেকে…

—নিশ্চয় থাকব। তুমি ক’বার মেয়েকে দেখতে আস? অবশ্য ও তো মেয়ে। তার ওপর আমার মতো বলে তোমার রাগ ছিল…যে তোমার মতো সেই ছেলেকে তো মস্কো পাঠিয়েছ…যে নড়তে পারে না, দেখতে পায় না, তার দায়িত্ব অন্য লোকের ওপর ফেলে রেখে আমি তোমার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনব করব না।

সে জন্যেই জয়া পলটুর জন্মদিনে যায়নি বাইরের ঘরে। পলটুর একার ছবিই তুলতে হয়। পলটু বলল, মেয়ের জন্যে ও…

লাডিয়া বললো, পুজা উজা দিলে কাজ হয়। সে তো আপনি দিবেন না।

—পলটু দা পূজো দেবেন।

—না না, তবে ওঁর পরিবার দিতে পারেন।

—দেবেন না।

 পলটু ওদের বলতে পারে না। জয়া আগে পূজাবিরোধী ছিল কি না কে জানে। বর্তমানে ও সব কিছুরই বিরোধী।

মেয়ের জন্যে ফিজিওথেরাপি, মেয়ের জন্যে ডাক্তার, মেয়ের জন্যে বই পড়ে শোনাবার লোক, খরচের কথা জয়া ভাবে না।

—তোমার টাকার অভাব?

জয়া জানে পলটু কোথায় টাকা রাখে। না, জয়াকে নিয়ে পলটুর সব চেয়ে বেশি…

লাডিয়া বলে, ঠিক আছে। আপনি দাদা। দাদার মেয়ের জন্যেই আমিই পূজা দিয়ে দেব। জয়া এ পাশ থেকে শোনে।

হঠাৎ তীক্ষ্ন গলা শোনা যায়, লালু! বাইরের ঘরে বলে দে, লিলির জন্যে কোনো প্রসাদ, ফুল, এ সব যেন বাড়িতে না ঢোকে।

পলটুর মুখ লাল হয়ে যায়।

ওর চামচা এবং যুবক নেতা (সরকারী ঘর বাড়ির ঠিকাদার এবং পার্টি ফান্ডে টাকা দেয়) চেহারায় না হোক, কেশ সজ্জা ও গলার স্বরে অমিতাভ বচ্চন। অমিতাভ বচ্চন বিরোধী দলের এম পি. হতে পারে, কিন্তু অনুকরণ করতে হলে ওই একটা লোকই আছে।

যুবক নেতা বলে, বউদি আমাদের পোকিত মার্কোসবাদী। পুজো আচ্ছায় বিশ্বাস করে না।

শিক্ষক সমিতির নেতা বলে, আদর্শ যারে কয়! কুনোদিন দামী কাপড় পরল না।

যুবক নেতা বলে, চলুন পলটু দা। লাঞ্চে আজকে আপনার অনারে…

লাডিয়া বলে, নিজে না খেলাম। খাওয়াতে কি দোষ?

—কোথায়?

—সে আমার দুসরা বাড়িতে। এ বাড়িতে তো কিছু ঢুকবে না।

পলটু বলে, বলে আসি ভেতরে।

জয়া ওপরে উঠে যাচ্ছে। হাতে খাবার সাজানো ট্রে।

—ওগো! আজ আমি দুপুরে…

জয়া উঠে যায়।

লিলি নিথর নিস্পন্দ কোমর থেকে। ওপরটি সজীব। দেখতেও ভালো ছিল না। কিন্তু বাস্কেটবলে, ব্যাডমিন্টনে, সাঁতারে…লিলি আর কোনোদিন খেলতে যাবে না। কলেজে যাবার জন্যে দৌড়বে না সাইকেলে। চোখ চাইলেও দেখতে পাবে না, ওর ঘর মা কেমন করে সাজিয়েছে।

—লিলি!

—মা!

—এবার তো খাওয়াব।

—ব্যাকরেস্টটা দাও।

ব্যাকরেস্টে বসে লিলি। তারপর বলে, কোলে ট্রে দাও। আমি নিজে খাব।

—মাছে কাঁটা আছে।

—বেছে নেব। আমি মেছো না?

—তনিমা, একটু দেখবে?

—দেখব মাসিমা।

—তনিমাদি আজ থাকবে?

—ওর অসুবিধে হবে না?

—কি অসুবিধে? জানো মা! ওখানে থাকতে ওর একটুও ভালো লাগে না, গাদাগুচ্ছের খরচও হয়, বাড়িতেও টাকা পাঠাতে পারে না।

—আমাকে তো এত কথা বলেনি।

—আমি ওর বন্ধু, তুমি তো মাসিমা।

—তাও সত্যি।

—ও আমাদের বাড়িতেই তো থাকতে পারে। আমার ঘরে থাকবে?

তনিমা বলে, সে হবে এখন লিলি!

—মা!

—বলো।

—আজ তো বাবার জন্মদিন।

—হ্যাঁ।

—নিচে অনেক লোক এসেছিল?

—অনেক।

—চলে গেছে?

—হ্যাঁ। তোমার বাবাকে ওরা…

—লাঞ্চ খাওয়াবে।

—হ্যাঁ।

—যাকগে, আমি তো খাই।

—হাতটা ধুয়ে দিই।

—আমি নিজে ধোব।

হাত ধোয় লিলি, হাতড়ে হাতড়ে খেতে থাকে। তারপর খেতে খেতে বলে, তুমি সব করে দিতে চাও। তনিমাদি সব নিজে করতে বলে। কেন বলে জানো? নিজে যতটুকু পারি তা আমাকেই করতে হবে। নইলে আমি পরনির্ভরশীল হয়ে যাব ভীষণ রকম। সেটা মোটেই ঠিক নয়।

পারে, একা তনিমা পারে লিলিকে দিয়ে আগেকার লিলির মতো যুক্তিবাদী কথা বলাতে। সাধে কি তনিমা জয়ার এত প্রিয়?

—মাছটা বেশ ভালো।

—আরেকটা খাবে?

—না, আর না। শুয়ে শুয়ে খেয়ে খেয়ে যদি মোটা হয়ে যাই?

—সেটাও সত্যি।

—তনিমাদি আরো বলেছে…

—কি?

—সিলেবাস ধরে কেউ যদি পড়ে শোনায় বারবার, আমি পড়া তৈরি করে নিই। আমি পরীক্ষাও দিতে পারব।

তনিমা বলে, মাসিমা আর তুমি আলোচনা করে নাও। তারপর এটা খুব পারা যাবে। ব্যাপারটা তেমন কঠিন নয় মাসিমা, লিলির পক্ষে তো নয়ই। ব্যাপার কি জানেন? পুরো সিলেবাসটা ক্যাসেটে ধরে নিতে হবে।

লিলি বলে, এটা কার আইডিয়া সেটা বলো?

—তোমার।

—নিশ্চয়। আমি শুনে শুনে ঠিক শিখে নেব।

—ও পরীক্ষা দিতে পারবে তনিমা?

অ্যাকসিডেন্টের সময়ে লিলির বয়স পনেরো। এখন ওর উনিশ। বয়স আন্দাজ ও তখনো ছেলেমানুষ ছিল, এখনো। ছেলেমানুষ বয়সে মানুষ সোজা হিসেবে কথা বলে।

লিলি বলে, কেন পারব না? হলে আমায় নিয়ে যাবে। আলাদা ঘরে আমি হেলপার নিয়ে পরীক্ষা দেব। অন্ধরা তো তাই করে।

লিলি নিজের অন্ধত্বের কথা এমন সহজে বলে, যে জয়ার বুক ছিঁড়ে যায়। কিন্তু জয়া তো তা বুঝতে দেবে না লিলিকে!

—এটা খুব ভালো হবে।

খেয়ে, হাত ধুয়ে লিলি বলে, এবারে মাকে চাই।

ব্যাকরেস্ট সরাও। লিলিকে ইউরিনাল দাও। পরিষ্কার করো। লালুর মাকে ডাকো, এঁটো বাসন সরাবে। ঘর মুছে নেবে। বড্ড পিঁপড়ের উৎপাত এ সময়টা।

—মা! তোমরা খেয়ে এসো। আমি ঠিক ঘুমিয়ে পড়ব। তিনটে না বাজতেই তো তোমার ভানুবাবু আসবে।

ভানু ছেলে নয়, মেয়ে। ফিজিওথেরাপির ট্রেনিং নিয়ে ও নিজেই সেন্টার খুলেছে। ও মেয়েদের, ছেলেদের ট্রেনিং দেয়। ভানুর সেন্টার খোলার সময়ে জয়াও খুব সাহায্য করে। ভানু ওটা ভোলে নি।

ওর চেহারা পুরুষালি, গলাও বাজখাঁই। লিলি ওকে ”ভানু বাবু” বলে।

জয়ার মেয়ের মাসাজের ব্যাপারও অন্যকে দেয় নি, নিজেই আসে। ওই বলেছে, হুইল চেয়ারে ও বসতে পারবে। নিজে ঘুরতে পারবে এ ঘর, ও ঘর।

নিচে এসে ওরা খেতে বসে। সব বেড়ে নিয়ে খেতে বা। এতকাল লালু আর লালুর মা ছিল ভরসা। লিলি আর জয়া দুজনের দুর্ঘটনার পর রান্নার জন্যে একটি মেয়েকে রাখতেই হয়েছে।

আজ ও বাড়ি গেছে। আসবে কাল।

খেতে বসে তনিমা চোখ কুঁচকে দেখে। লাডিয়ার আনুকূল্যে শালের জন্য একদা বিখ্যাত কুকমারি জঙ্গলের শাল কাঠে তৈরি টেবিল, চেয়ার, কাবার্ড, বিশাল মীটসেফ। শহরের একমাত্র মেহগনি গাছটিও লাডিয়ার কবলিত।

বাইরের ঘরে মেহগনির আসবাব।

—চেয়ারের ডিজাইনটা নতুন।

—তাই কি?

—চমৎকার দেখতেও।

—সব কৃতিত্বই গৃহস্বামীর।

—মাসিমা।

—বলো তনিমা।

—কি করি, বলুন তো?

—আমি একটা কথাই বলতে পারি।

—জানি।

—এটা আমার বাড়ি হলে তোমাকে এখনি চলে আসতে বলতাম, বাড়ি তো আমার নয়।

—আপনার বাড়ি না হোক…

—দেখছি তনিমা।

—সুনীলাদি পারেন…

—ভয় পাচ্ছেন।

—ভীষণ ভয়।

—দাঁড়াও, কথা বলে দেখি।

—ওঁকে বলবেন?

—বলতাম না। পারত পক্ষে বলি না। বলব।

—চাকরিটা যদি এত দরকারী না হত…

—চলে যেতে?

—তাও ভেবেছি। তারপর মনে হয়েছে যাব কেন? আমি তো কাজ করতে এসেছি।

—না, কেন যাবে? শহরের মানুষকেও বলিহারি ভাই। কেউ একটা কথা বলে না।

—কেন বলে না আপনি তো জানেন।

—জানি। রাজনীতিক গুণ্ডামির ভয়ে।

—ভানুদির মতো মেয়ে, ওই সাহস পায় না।

—জানি।

—আমার শুধু মনে হয় কি জানেন?

—কি?

—আপনাকে আমি যেমন দেখেছি…আপনি যেমন মানুষ…আপনি যার স্ত্রী…আপনি যদি এগিয়ে এসে একটা স্ট্যান্ড নিতেন, তাহলে খুব ভাল হত।

—তনিমা! তুমি যা যা বলছ সবই ঠিক। আমার ভূমিকা ইতিবাচক হওয়া উচিত ছিল।

—ছিল না?

—ছিল।

—কিন্তু…আমি কার স্ত্রী তনিমা? তোমার জীবন যে দুর্বিষহ করেছে, শুধু কি তোমার! আগে আরো কত মেয়ে… সেই তো আজ এসে শহরের নেতাকে ওই প্যাকেটটা দিয়ে গেল। কি আছে তা জানো? বিদেশী রুমহীটার। এখানে তো খুব শীত পড়ে।

—ও!

—তনিমা! আমার সব কথা আমি বলতে পারব না, বোঝাতে পারব না। এই রাজনীতি, যে রাজনীতির জন্যে ও লাডিয়ার বাড়ি লাঞ্চে যায়, বাচ্চু ওকে রুমহীটার দেয়, সে রাজনীতি থেকে আমি নিজেকে অনেকদিন হল সরিয়ে নিয়েছি।

—সরিয়ে নিলেও…

—ওই লাডিয়া! যার কারণে লিলি আজ অন্ধ আর পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে…জানি, সরিয়ে নিলেও মানুষ আমাকে বিশ্বাস পায় না। কাপড় কিনতে গিয়ে দেখেছি…দোকান করতে গিয়ে…

—হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।

—আমার ক্ষমতা সত্যিই খুব কম।

—তবু তো আমার বাড়ি গিয়েছিলেন।

—ইচ্ছে করে। আমি গেলাম, তোমাকে ডেকে আনলাম…সবাই জানুক যে আমি তোমায় পৌঁছে দিই…তুমি এখানে আস…তাতে যদি তুমি কোনো নিরাপত্তা পাও।

তনিমা চোখ নামিয়ে বলে, ওখানে থাকা যাবে না।

—তোমার বয়স…তোমার চেহারা…

—নানা কারণেই।

—তোমার সঙ্গে যার বিয়ে হবার কথা…

—সুবীর তো এখনি রাজী মাসীমা। কিন্তু ভাইটা পাশ না করলে কাজ না পেলে আমি বিয়ে করি কি করে? বড়দি তো আমাদের মানুষ করতে গিয়ে বিয়েই করল না। মেজদির বিয়ে দিল…আমি কাজ পেতে না পেতে বেচারা আপিসের কাজেই ট্যুরে গিয়ে কি না কি ভাইরাসে মরেই গেল। কথা আছে…ভাইটা পাশ করলে বড়দির আপিসে কাজ পাবে।

—কথা ওর রাখবে?

—হ্যাঁ, বড়দি তো ইউনিয়নও করত। ওর সুনাম ছিল খুব। মনে হয় কথা রাখবে।

—তোমার মেজদি?

—সে খুবই আলগা আলগা বরাবর। ওদের বাড়িও এক অদ্ভুত বাড়ি। আমি গেলেও ওর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে পারি না। শাশুড়ি সামনে থাকবেই।

—আশ্চর্য তো!

—তার চেয়েও আশ্চর্য, মেজদি তাতেই সুখী।

—কেনো ব্যক্তিত্ব নেই।

—সে তো আমিও রামভিতু। বড়দি অন্যরকম ছিল। দেখতে সেও ভালো ছিল, কিন্তু তেজ কি!

—রায়গঞ্জেত তোমাদের নিজেদের বাড়ি?

—বাবাই করেছিলেন। টিনের চাল, পাকা ভিত, পাকা দেয়াল।

—মার বয়স হয়েছে?

—ষাট বছর হবে।

—এখানে ওঁরা তোমার কে হন?

—খুবই দূর সম্পর্কের বোন। তবে আমার মা মানুষ করেছিলেন দশ বছর অব্দি।

—নিশীথবাবু তোমার ভগ্নীপতি?

—হ্যাঁ। ওই বোনের কথায় ওদের ওখানে উঠেই ভুল করেছি। নইলে অন্য টীচাররা মেস করে আছে, থাকতে পারতাম।

তনিমা ভুরু কুঁচকে কি ভাবে। খুব সুন্দর দেখায় ওকে। যার জীবনে অনেক সংগ্রাম, তার চেহারা এমন নরম কেন?

—তোমার বয়স কত, তনিমা?

—তেইশ।

—আমার বিয়ে আঠারো বছর বয়সে। উনিশ বছরে রণি। একুশ বছরে লিলি। তোমার বয়সে আমি দুজনের মা।

—এখানে ছিলেন?

—না, এখানে তো পরে আসা হয়।

—কোনোদিন কাজ করেছেন?

—পার্টি করতাম।

—কলকাতায়?

—হ্যাঁ।

—ওখানেই পরিচয়?

—হ্যাঁ।

—আপনার সঙ্গে ওঁর…

—অত্যধিক আদরে মানুষ, অত্যাধিক জেদ ছিল…চলো উঠি। লালুরা খাবে।

—তনিমা ঘড়ি দেখে।

—ফেরার কথা ভাবছ?

—হ্যাঁ।

—আজ থেকে যাও।

তাহলে আমি লিলির ঘরে গিয়ে একটু ঘুমোই। আপনিও শোবেন তো?

—তোমার পাশেই।

—লিলি যে একলা শোয়…

—এখন বলে নয়। ছোটবেলা থেকেই ওর ভয় কম, একলা শুত। ওর দাদার চেয়ে খেলাধূলায় অনেক ভাল ছিল। লেখাপড়ায় মন দিত না। সেই মেয়ে…

—সত্যিই ভাবতে পারি না।

—ওর জন্যেই তো আমায় বাঁচতে হবে তনিমা। ওর জীবনটা তো নষ্ট হয়ে গেল।

—আপনি না কি চাকরি পেয়েছিলেন, করেন নি? সত্যি, আপনাকে নিয়ে কত কথাই যে শুনি।

—করি নি, তার আদর্শ আছে বলে।

খট খট করে ভানু ঢুকে পড়ে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, সব সময়ে ধপধপে সাদা কাপড়। সাদা জামা। চুল নেই বললে হয়, শূন্যে তুলে বড়ি খোঁপা বাঁধা।

—বউদি ইচ্ছে করলে আজ…

—তিনটে বাজে?

—সময় কারো জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে না তনিমা। চারটেয় উঠব, যোগব্যায়াম করব, ছোলা আর মুড়ি খাব, স্নান করব, ছ’টার মধ্যে তৈরি। দুপুরে খাব বারোটায়।

—চলো ভানু।

—লিলি কি বলছে?

—তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

—কলকাতায় যান বউদি। ডাক্তার আশীষ লাহিড়ী আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। ওঁকে একবার দেখান।

—যাব।

—আপনার দাদাদের লিখুন।

—লিখব। কিন্তু লিলির কি…?

—পারলে উনিই পারবেন।

—চোখ তো পাবে না আর…যদি হাঁটতে পারত!

—আশা কি ছাড়তে আছে?

—ভানু খট খট করে উপরে উঠে যায়।

তনিমা বলে, সত্যি! পারেন বটে।

—হ্যাঁ সাংঘাতিক জেদী মেয়ে। ওর কথা তো তুমি জানো না। লিখতে পারলে লিখতাম।

—চাকরির ব্যাপারটা বলুন না।

—আগো বলো, শহরে আমাকে নিয়ে কি বলে।

—কেন চাকরি নিলেন না, কেন আপনি সাদাসিধা কাপড় কিনে পরেন। কেন পারতপক্ষে গাড়ি চড়েন না। কেন রিকশায় চলাফেরা করেন। কেন দীপালিদি আপনার কাছে আসেন, কেন আপনি আদিমহিলা সেবাসমাজে যান…

—পাবলিক এ থেকে দুয়ে দুয়ে চার করে না?

—ওরা মনে করে আপনি এ সব করেছেন, যাতে পলটু দত্তের সুবিধে হয়।

—ওর সুবিধে!

—হ্যাঁ। আপনার এ সব ব্যবহারই প্রমাণ করে, আসলে পলটু দত্ত বড় দলের নেতা হলেও সে খুব উদার, সে কারণেই আপনাকে এ ভাবে জনসংযোগ করতে দেয়।

জয়া বিচিত্র ও বিষণ্ণ হাসে। বলে, আমি মনে করি আমার নিজস্ব জীবনে স্বাধীন ভাবে চলব। অথচ দেখ, সব রাস্তাই গিয়ে রোমে পৌঁছয়।

—চলুন, ওপরে চলুন।

—চলো।

লালুর মা বলে, রাতে রান্না হবে কিছু?

—কিছু না, রুটি।

এ বাড়ির একতলাটি গৃহকর্তার। দোতলা জয়ার। দোতলা বাড়ির সামনে বাগান ছিল। বাগানের আধখানা ঘিরে পল্টু দত্তের গুদামঘর। সে তো ঠিকাদারও বটে। শহরে সিমেন্ট যোগানদার।

আদি বাড়িটা কেমন ছিল তা জয়া মনে করতে পারে না। উত্তরবঙ্গের এ শহরও ছিল এক দেশীয় নৃপতির সীমানায়। তখন চারিদিকে জঙ্গল। মাঝে ছোট শহর।

এখন এটা জেলার দ্বিতীয় শহর।

এ শহরে জয়ার শ্বশুর হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করেই ছোট একটা বাড়ি করেন। আশেপাশের জমি কেনেন। কুকমারির জঙ্গল সেদিন শহরের সীমানায়।

এ বাড়িকে তিলে তিলে নয়, তালে তালে বাড়ানো, জমিগুলি প্লট করে বিক্রি করা, সবই পল্টুর কৃতিত্বে হয়েছে। সাত আট বছরে ও জয়াকে শহরের অন্যতম দর্শনধারী বাড়ির গৃহিণী করে দিয়েছে।

সবচেয়ে দর্শনধারী বাড়ি অবশ্যই লাডিয়ার। কয়েক পুরুষে উত্তরবঙ্গে বাস কিন্তু বিকানীরে ও প্রতি বছর যায়। আগে কথা ছিল নির্ভেজাল বাংলা। এখন একটু অন্য টান আসছে।

সম্ভবত স্ত্রীর কারণে। স্ত্রী বিকানীর দুহিতা, অত্যন্ত পর্দানশীন, অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা। তাঁর কথাতেই লাডিয়া প্রাচীন শিবমন্দিরটিকে আমূল সংস্কার করে একটা জগঝম্প বানিয়ে শহরবাসীকে উপহার দিয়েছে। প্রাচীন শিবলিঙ্গটি যথাস্থানে আছেন। পাশে মহাবীর। রঘুপতি রাঘব রাজা রাম ও সন্তোষী মার তিনটি মন্দির হয়েছে।

এজন্যে জায়গা দরকার হয়েছে। পলটু দত্তকে লাডিয়া ভুলবে না, ভুলবে না। কেন না তার মদতেই ওই জমি থেকে কিছু কোমরভাঙা লোককে উচ্ছেদ করা গেছে এবং সরকারী খাস জমি ভূমিরাজস্ব দপ্তরকে কলা দেখিয়ে সৎ কাজে লেগেছে।

এ নিয়ে পিছনে লেগেও শহরের একমাত্র প্রতিবাদী কাগজ (বিরোধী পক্ষের) ”কৃপাণ” কোনো সুবিধে করতে পারে নি। স্বপক্ষের মেজ শরিকের কাগজ ”সত্যবার্তা”ও পারে নি।

”কৃপাণ” জয়াকে নিয়েও লেখে। ওর শস্তার কাপড় কেনা, পলটুর বৃত্তের বাইরে জনসংযোগ রেখে চলা, সবই ওই কাগজের ”বাঁকা চোখে” কলমে বেরোয়।

পলটু বলে, বেরোক না। যারা বুঝবার তারা ঠিকই বুঝবে।

বাচ্চু পলটুর অনুগত যুবনেতা।

বাচ্চুর বাবা ”কৃপাণ” কাগজ, প্রেস, পাটের আড়ত ও কাপড়ের মালিক।

মেজ শরিকের কর্মীদের বড় শরিকের কর্মীরা কাটে, মারে।

”সত্যবার্তা” সে খবর ছাপে।

মেজ শরিকের পার্টি সম্পাদক ও পলটু সমঝোতা রেখে চলে। যে তারা থাকুক ধরাছোঁয়ার বাইরে, ক্যাডার বা কর্মী দলীয় সংঘর্ষে মরতে পারে।

মাঝে মাঝে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশকে মঞ্চে ঢুকতে হয়। তখন হত্যা, গৃহদাহ, শস্য লুণ্ঠন, এ সব ঘটনা আসলে দলীয় সংঘাতের ফলে ঘটলেও সবগুলি কাগজেই ”উগ্রপন্থী বনাম পুলিশ” সংবাদ হয়ে যায়।

এরকমই চলে এ শহরে, নিরন্তর চলে। বুঝতে জয়ার সময় লেগেছে। তাড়াতাড়ি অসম বিয়ে করলেও, দুটি ছেলে মেয়ের মা হলেও, বড়দা জোর করে ওকে কাছে রেখে বিএ—টা পাস করান, এমএ.।

বলেন, পার্টি করো, যা করো, নিজের পায়ে দাঁড়াবার মতো যোগ্যতা অর্জন করে নাও।

পলটু তাতে বাধা দেয় নি। কেন দেবে? রাজনীতিক আদর্শের মিল থেকে প্রেমজ বিবাহ। সই করা বিয়ে হোক। মেয়ের বড়দা যদি যৌতুক, গহনা, আসবাব দেন, সে কি করতে পারে?

ওঁদের বাড়িতেই সে সময়টা থাকা? জয়ার বাবার উইল মতো ওর তো বসবাসের অধিকার আছেই। জয়ার মা যদি একমাত্র মেয়ের ছেলেমেয়ে বিষয়ে অত্যন্ত দুর্বল হন, পলটু কি করতে পারে?

১৯৬৩—তে ওদের বিয়ে। পলটু লাইফ ইনসিওরেন্স ইউনিয়নের জঙ্গী কর্মী। রায় স্ট্রিটের অভিজাত বাড়িটিতে সে শুধু নিশিযাপন করে এবং জয়াকে বলে, একদিন এসব শ্রেণী মালিকানা ঘুচে যাবে।

জয়ার বড়দা প্রাজ্ঞ চোখে পলটুকে দেখে যান, দেখে যান। ১৯৭০—৭১ সালে পলটুকে দেখে উনি এখানে এসেছিলেন। উনি রায় দিয়ে যান, জয়া! তোর বিয়ে নিয়ে মনে দুঃখ একটা ছিল। কিন্তু এখন দেখছি ভালোই করেছিস। রাজনীতি হল আসলে কেরিয়ার, ওদের রাজনীতি। পলটু অনেক ওপরে যাবে।

সেদিন জয়া যথেষ্ট প্রতিবাদ করেছিল।

—ওর রাজনীতি কেরিয়ার করার জন্যে নয় বড়দা। দেখছ না, এ রকম একটা সময়ে ও কি ভাবে পার্টির কর্মীদের বাঁচাবার জন্যে দৌড়চ্ছে।

ব্যস্ত ব্যারিস্টার, যিনি দার্জিলিং থেকে ফেরার সময়ে অনেক পথ ঘুরে ঘুরে বোনকে দেখে যেতে এসেছেন, তিনি বোনের কথা সস্নেহে শুনেছিলেন।

 নিজের ছেলেমেয়ে যখন ছোট ছিল, তাদের কথা যেমন শুনতেন, তেমনি সস্নেহ প্রশয়ে।

—এ সব জায়গাও বেড়ে উঠছে…হ্যাঁ…পলটু পারবে। এখনি তো কথাবার্তায় অনেক যুক্তি এসেছে।

—তোমাদের আর ক্যাপিটালিস্ট বলে না।

—ব্যারিস্টারকে পুঁজিবাদী বলা রাজনীতিক অজ্ঞতা জয়া। আর…এমন টালমাটালের সময়েও তোরা তো ঠিক দরিদ্রদের মতো থাকছিস না।

—জমিগুলো বিক্রি করল…

—ভালো। বুদ্ধিমান ছেলে!

—ছোড়দা না কি নতুন বাড়ি করছে?

—করছে, থাকবে এখানেই।

—রায় স্ট্রিটের বাড়ি তো যথেষ্ট বড়।

—হ্যাঁ হ্যাঁ, দু’ভাগে ভাগ করা …মায়ের অংশটা তোর…এ বাড়িটা তো লাকি, তাই না?

—আমি আর অংশ দিয়ে কি করব!

—কলকাতায় একটা থাকার জায়গা!

লিলির জন্যে পরে তো কাজেই লাগছে বাড়ির ওই অংশ। যেতে হয়, থাকতে হয়। রণিও ওখানে থেকেই পড়ল। লিলিও মামাবাড়ি যেতে ভালবাসত।

 সে সময়টা, যখন জয়ার বড়দা আসেন, সত্যিই বড় উত্তাল সময়। উত্তরবঙ্গ তখন তোলপাড়। পলটু দত্ত তখনই বেশ কেউকেটা। বোঝাই যাচ্ছে যুক্তফ্রন্ট থাকবে না, থাকবে না। তারপর কি হবে, তা ভাবা যায়নি তখনো।

উগ্রপন্থীদের ঠেঙিয়ে নিঃশেষ করার কাজেই সবাই ব্যস্ত ছিল এবং সে সময়ে এই ছোট শহরেও যে কত চেনা মুখ সারি সারি লাশ চালান যায়, ভাবলে আজও জয়ার আশ্চর্য লাগে।

সেই সময়ে জয়ার বাড়িতে শরদিন্দু রায়বর্মা ঘনঘন আসতেন। জেলার প্রবীণ পার্টি কর্মী, দীর্ঘকাল কৃষকদের মধ্যে কাজ করেছেন, তেভাগার সময়ে চা—বাগান এলাকায় ছিলেন। সে সময়ে ওঁর বয়স বছর বাষট্টি হবে। বারবার আলসার হবার কারণে পার্টি—সেক্রেটারি হয়ে শহরেই ছিলেন। রায়বর্মা শহর কেন, মহকুমা কেন, জেলার মধ্যেই বেশ শ্রদ্ধেয়, সম্মানিত মানুষ। ওঁর সত্যপ্রিয়তা ও সত্যবাদিতা এ শহরে গল্প কথা। যে পুলিশ ওঁকে তেভাগার পর ধরে, তাকে উনিই সময় সংশোধন করে বলেছিলেন, দশটা থেকে এগারোটা কি করেছিলেন মানে কি? ন’টা আটান্ন থেকে দশটা এগারোটা অবধি পায়খানায় ছিলাম, দশটা বারো থেকে দশটা বেয়াল্লিশ স্নান করেছি, মশারি কেচেছি। এখন বাজে দশটা বাহান্ন, এগারোটা বাজে নি, এগারোটা অবধি কি করেছিলেন মানে? ঠিক ভাবে প্রশ্ন না করলে রায়বর্মা জবাব দেয় না।

এমন অনেক কথা।

‘পণ দিব না’ জেদের ফলে তিনটি মেয়েই অবিবাহিত থেকে যায় এবং ছেলের বিয়েতে পণ নেন স্ত্রী (রায়বর্মা তখন জেলে) সেজন্যে ছেলের কাছে স্ত্রীকেও পাঠিয়ে দেন।

রায়বর্মা পলটুকে বলেছিলেন, তোমরা বললে, আমিও মানছি, উগ্রপন্থীরা খতমের রাজনীতি করেছে। কিন্তু তোমরা তাদের খতমের যে রাজনীতি করছ, সেটা বন্ধ করো।

—রায়বর্মাদা, এটা আপনি কি বলছেন?

—আমাদের ছেলেদের ওপর ঠ্যাঙা আসছে।

এসেছিল। বাহাত্তর থেকে কর্মীদের পালাতে হয়, মরতে হয়, নেতারা থাকে চুপচাপ। সে সময়ে রায়বর্মা বহুজনকে পালাবার ব্যবস্থাও করে দেন।

এবং একদিন একরাত বেপাত্তা থেকে তিনি যখন ফেরেন, তখন শহর ফেটে পড়ে উত্তেজনায়, গুজবে। বাড়িতে পুলিশ। ওঁর তিন চাকুরে ও অনূঢ়া, প্রায় প্রৌঢ়া মেয়ে নিশ্চুপ (নার্স, শিক্ষিকা, স্বাস্থ্যবিভাগের কেরাণী) বসে আছে।

রায়বর্মা থানায় যান।

কারা ওঁর বাড়িতে সেলটারে ছিল, কাদের উনি কুকমার্রি জঙ্গলে পার করে দিয়ে এলেন, তা ওঁর মুখ থেকে বের করা যায় নি।

—সত্যি কথা বলা যাবে না, মিথ্যে বলতে পারব না। অতএব কিছুই বলব না আমি। আমার মনে হয়, আমার জীবনের বিগত ত্রিশ ঘণ্টা তেরো মিনিট সতেরো সেকেন্ড কোথায় ছিলাম, কি করছিলাম, সেটা আপনারাই লিখে নিতে পারবেন। যা ঘটে তা না লিখে যা ঘটেনি লেখায় আপনাদের ক্ষমতা তো সবাই মানে।

সেই সময় থেকে রায়বর্মা একাধারে পুলিশের ও পলটুদের সন্দেহভাজন হয়ে যান। ওঁর মেয়েরা ওঁরই মতো। বাপের বিরুদ্ধে ওরা মুখও খোলে না। এবং রোগাটে, কালো মানুষটিকে সকলে নতুন চোখে দেখতে থাকে। সন্দেহ, সন্দেহ!

পলাতক মাত্রেই আশ্রয় দেবেন, প্রাণ বাঁচাবেন, এ কেমন কথা?

পলটু ক্ষেপে গিয়ে বলে, যদি পুলিশ পলাতক হয়ে আসে, তাকেও বাঁচাবেন?

—পলটু? জ্ঞানকাণ্ড রেখে কথা বলো। তুমিও কি খোয়াব দেখছ? বিপ্লব এসে গেছে এবং প্রাণভয়ে পুলিশ এসে শেলটার চাইছে?

—তবু…

—বিপ্লব আমরা দেখি নি, তোমরা দেখবে না, ঝুড়িতে টাটকা ডিম আর নেই হে আমাদের, এখন থেকে পচা ডিমই বেরোবে।

এ সব বলে রায়বর্মা নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মায়ের ভোগে দেন এবং জরুরি অবস্থায় এ শহরে একা তিনিই গ্রেপ্তার হন।

অবস্থা অবসানে মুক্তিপ্রাপ্ত রায়বর্মা নিজের বাড়িতে নিজেকে বন্দী রেখেছেন। শরীর তাঁর বড়ই ভাঙা। পলটুরা ওঁকে গ্রহণ করে নি, ত্যাগও করে নি। কোনো বৃদ্ধ মন্ত্রী শহরে এলে দেখাও করে যান। ওঁকে সাহায্য করাও মুশকিল। জীর্ণ বাড়িতে বসে নিজের আমাশা ও আলসার জীর্ণ পেটে উনি হাত বোলান ও প্রাচীন কমরেডদের লজ্জা দিয়ে বলেন, আমার কি চাই! আমার তো কিছু চাই না। ঠিকাদারী, কোনো পরামর্শদাতা কমিটির চেয়ারম্যানসিপ, নাঃ, কিছু চাই না।

—তুমি বুনো রামনাথ হয়ে গেলে?

—তাই বা পারলাম কই। মেয়েদের রোজগারে খাই, স্বর্গত দেবনাথ রায়বর্মার তৈরি বাড়িতে বাস করি, শেলটার দিয়ে চলি…

—শেলটার? কাকে? এখন তো…

রায়বর্মা অত্যন্ত কুচুটে হাসি হেসেছিলেন, শেলটার বলতেই ভূত দেখলে মনে হচ্ছে?

মন্ত্রী বড় বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বয়সও অনেক, মনে তাঁরও শান্তি নেই, মানুষ তিনিও সৎ। ঔচিত্য বোধে প্রাচীন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে আসার জন্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বোধনী সভার জন্য অন্যের লিখিত ভাষণ ছাঁটাই করে সময় চুরি করতে হয়েছে, শরীর তাঁরও ভালো যায় না। রায়বর্মা তাকে ভয় দেখাচ্ছে কেন? জীর্ণ ও সংস্কারহীন ভূতুড়ে বাড়িতে বসে?

—শেলটার! এই দেহে। লাগাবাঁধা আমাশা, লাগাবাঁধা আলসার, এক চোখে ছানি, পিতৃদত্ত বাত, মাতৃদত্ত অর্শ, কত কিছুকে পুষে চলেছি বলো তো?

—একবার কলকাতায় এলে…

—কি, মস্কো পাঠাতে?

—ঠাট্টাই করো।

—না রে ভাই, মহানগরী যাব ভাবলেও ভয় করে। আমার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসালয়ই ভালো।

—পলটুর তো উচিত…

—ও বাবা! সে এখন মস্ত মানুষ। সেদিন যেয়ে লাডিয়ার সার্কাস উদ্বোধন করল।

—সার্কাস?

—আহা? লাডিয়ার মন্দির মালা!

এই রায়বর্মার কাছেই জয়া যেত। দু’দণ্ড শান্তি পেত। না, সবাই কেনাবেচা হয়ে যায় না। অন্যরকম মানুষ বিরল হলেও এখনো আছে।

রায়বর্মাই ওকে ভানুর কথা বলেন।

—বড় তেজী মেয়ে বউমা! স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে চলে এসেছে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে বলে ফিজিওথেরাপি শিখে এসেছে।

—ওর বিয়ে হয়েছিল?

—হ্যাঁ। দেখতে ভালো নয়, বাপ টাকা দিয়ে…যা হয়…মেয়েকে পেল না…নিজে চলে এল…মেয়েও অদেখা অযত্নে মরে গেল…যাক, অতীত, অতীতই। বর্তমানে সমস্যা, শহরে ও একটা সেন্টার খুলতে চায়, বাড়িও দেখেছে, টাকা দরকার।

—কত?

—বলছিল চার—পাঁচ হাজার…

—দেখি!

জয়া নিজে কিছু দেয়, কিছু চেয়ে নেয় স্বামীর কাছে। ওর নিজের টাকা মানে মায়ের দেয়া হাজার তিন।

ভানু অসীম জেদে, ব্যাপারটিকে সফল করে তুলেছে। কয়েকটি বিপন্ন মেয়ে, মহিলাশ্রম বা পতিতালয় ছাড়া যাদের জায়গা ছিল না, তাদের এনে প্রশিক্ষণ দিয়ে উপার্জনক্ষম ওই করে দেয়। সে সময়ে এ শহরে ”মেয়েছেলে মালিশ করবে, ব্যায়াম করাবে আবার কি? ওই ভানুমতী নিজেও দুশ্চরিত্র, শহরের বুকে পাপের ব্যবসা খুলছে” বলে খুব হইচই হয়।

জয়া একদিকে, অন্যদিকে রায়বর্মা ভানুর পেছনে থাকেন। আজ ভানু স্বপ্রতিষ্ঠিত। জয়ার টাকা ও কবেই শোধ করে দিয়েছে।

উত্তরবঙ্গের এ জায়গায় বর্ষা, বাত ও হঠাৎ ধনীর সংক্রমণ খুবই বেশি। লাডিয়ার মতো মাড়োয়ারি পরিবারও অনেক। ডাক্তাররা এখন ফিজিওথেরাপি ও মালিশ করাতে বলেন। ভানুর আজ নিজের বাড়ি, সে বাড়িতে সেন্টার, সেন্টারের নাম অসীমা (ওর মৃতা কন্যার নাম) ফিজিওথেরাপি কেন্দ্র। ছয়টি মেয়ে ওর স্টাফ। অনেক মেয়েই ওর কাছে শিখে মাসাজ করছে।

জয়া সব কথা তনিমাকে বলে না। ভানুর কথা বলে। আরো বলে, তোমার ব্যাপারটা দেখছি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন