মহাশ্বেতা দেবী
হলঘরে অনেক আলো। টেবিলে যদিও ব্যুফে ডিনার সজ্জিত আমন্ত্রিতরা ও গৃহকর্তা কারোই খাবার অবস্থা তেমন নেই। রাত একটা।
মালিনী অসম্ভব দামী শাড়ি (সমুদ্র নীল রঙের), ম্যাচ করা গয়না, মেকাপ সহ অনেকক্ষণ এক গেলাস কাম্পাকোলা নিয়ে বসে আছে।
মেজ খোকা বলে, তুমি না হস্টেস?
—কি করতে হবে?
—অন্তত…কথা বলো।
—কেউ শোনার জন্যে বসে নেই।
—আজ যে দেখছি…
—তোমায় বারবার বলেছিলাম, বাবা থাকার সময়টা এসব তুমি বাইরে কোর।
—কেন? ওঁকে বেরোতে বারণ করনি?
—করেছি।
—তবে আর কি! ওঁর জন্যে তো আমি কাজকর্ম বন্ধ রেখে বসে থাকতে পারি না।
—আমি একটা ফোন করব।
—কোথায়?
—ছ’ তলায়।
—কেন?
—বাবি এখনো আসেনি।
—বা! চমৎকার মা।
—না, আমি চমৎকার মা নই, চমৎকার স্ত্রী নই, আমি কিছু হতে পারিনি।
—কোথায় যাচ্ছি?
—ছ’ তলায়।
—হয়তো মিসেস কেডিয়া ওকে থেকে যেতে বলেছেন। আর…আর…কি যেন? মুন তো ওর বন্ধু…বান্ধবী।
—সে জন্যেই যাব। কেডিয়ারা স্বামী—স্ত্রী ব্যাঙ্গালোরে। মুন আর জিন এখানে। রাত একটা…
মালিনী বেরিয়ে আসে। লিফটে ছ’ তলা। ও তো মদ খায় না, ও কেন, ভেতর থেকে টলে যাচ্ছে? ও বেল টেপে। রাত ন’টায় ”ক্যাসেট বদলে আনছি” বলে নাকি বাবি চলে এসেছে, গোপাল বলল।
দরজা খুলে যায়।
ঘর কটুগন্ধী ধোঁয়ায় অন্ধকার। লালচে আলো জ্বলছে। দরজা খুলতেই কোন বাজনা কানে আসে।
মুন। চোখ অদ্ভুত। অল্প টলছে। এখন সব কথাবার্তা ইংরিজিতে।
—বাবি কোথায়?
বাবির গলা, কে?
—তোমার মা।
বাবির জড়ানো গলা, চলে যেতে বলো।
—বাবি। চলে এসো।
বাবি টলতে টলতে এসে দাঁড়ায়। ওর মুখে খুব ধূর্ত হাসি।
মা’র দিকে তাকায়।
—তোমরা…
—নিশ্চয়।
কি খাচ্ছ?
—মারিহুয়ানা। খাবে?
মালিনী ওর হাত ধরে। বাবি হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে নেয়।
—ছোঁবে না, ছোঁবে না। ছুঁলেই আমরা রেমবো। ‘ফার্স্ট ব্লাড,” পড়েছ? দেখেছ?
বাবি দরজা বন্ধ করতে যায়। মালিনী ওর হাতের কবজি ধরে টানে।
বাবির পিছনে অনেকগুলি মুখ। একটি ছেলে এগোয়। মুন ওকে পিছনে ঠেলে দেয়।
—জিন ভায়োলেন্ট হোয়ো না। আপনি চলে যান।
—বাবি!
—মা’দের দিন আর নেই। আমি পরে যাব।
দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
মালিনী দরজায় মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। উল্টো দিকের দরজা খুলে যায়।
—মিসেস চৌধুরী।
—আপনি।
সুপ্রভাত দত্ত আস্তে বলেন, আপনি আমার মেয়ের মতো। শুনুন, চলে যান।
—চলে যাব? আমার ছেলে…
—ওদের ড্রাগ সেসান চলছে। ওরা কেউ প্রকৃতিস্থ নেই। আপনি ডাকলে ওরা যাচ্ছেতাই করতে পারে! কাল ছেলেকে শাসন করবেন।
—আমার…ছেলে…
—আপনার বাড়িতেও তো পার্টি আছে, তাই না?
—হ্যাঁ। আছে।
—চলে যান। রাত দেড়টা বাজে।
—যাচ্ছি… যাব…
মালিনী পুতুলের মতো হাঁটে। বাবি এখানে আসে, রাত এগারোটায় ফেরে। কিন্তু আজ?
আবার লিফট আবার চোদ্দতলা। রান্নাঘর দিয়ে ঢোকে মালিনী। গোপালকে বলে, বাবি তোকে বলে বেরিয়ে গেল, তুই আমায় বললি না?
জবাবের জন্যে দাঁড়ায় না ও। আবার হলঘর। মেজ খোকা সকলকে খেয়ে নিতে চেষ্টা করছে।
—সরো, আমি দিচ্ছি।
—কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
—সরো, সরে যাও।
মালিনী স্বামীর হাত ধরে সরিয়ে দেয়, বসায় ডিভানে।
তারপর প্লেটে তুলতে থাকে খাবার। কাপুর সেন, কুট্টি, বসুরায়, দেশাই, আসলাম,…না, খাবার আবার গরম করা হয়েছে। ওরাও শিখেছে। মাথা নাড়ে মালিনী। মালিনী স্বামীর প্রয়োজনে লোক রেখে ইংরিজি বলতে শিখেছে, বাবির কাছে শিখেছে কায়দাকানুন, চুল ছেঁটেছে, সাজতে শিখেছে। কিন্তু মেজ খোকার প্রয়োজন যে অনেক। তাই তো বড় পার্টিতে বাইরে থেকে হস্টেস আনতে হয়। সব যে পারে না মালিনী।
স্বামীর বিয়াল্লিশ, ওর সাঁইত্রিশ, ছেলের ষোল।
বাবি!
—সর্বনাশ! কাপুর গেস্টরুমে যাচ্ছে।
প্রায় ছুটে যায় মালিনী। ওদিকে নয়, এদিকে, এই বাথরুমে, ওদিকে নয়।
—কেন?
মেজ খোকা বলে, (এখানেও সব কথাবার্তা ইংরিজিতে) আমার বুড়ো বাবা ও ঘরে আছেন।
—তোমার বাবা।
—হ্যাঁ কাপুর। মা মারা গেলেন। আমি…আমি ওঁকে নিয়ে এসেছি।
—ভালো, খুব ভালো। কর্তব্যপরায়ণ পুত্র। আমি…আমি কি করব মিসেস চৌধুরী।
—কেন, কি হলো?
—আমার বাবা যে নেই!
—কাঁদবেন না। গোপাল, কাপুর—সাহেবকে বাথরুমে নিয়ে যা তো!
মেজ খোকা বুকে হাত রেখে বলে, আমি বাবাকে এনেছি।
—আমি।
বাথরুম থেকে এসে কাপুর বলে, যথেষ্ট হয়েছে। এখন যাওয়া যাক।
যেতে যেতে তিনটেই বাজে।
মালিনী বাবির ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে মোড়ায় বসে।
বিশ্বনাথ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শোনেন, ওঁর ছেলে অতিথিদের এগিয়ে দিচ্ছে।
বাথরুমে যাবার জন্যে না উঠলে ব্যালকনিতে দাঁড়াতেন না। ব্যালকনিতে না দাঁড়ালে শুনতে পেতেন না মেজ খোকা এককথাই বলে যাচ্ছে ইংরিজিতে।
—আমি কর্তব্যপরায়ণ ছেলে। আমি বাবাকে এনেছি। বেজন্মা দীপকটা আমার কর্তব্য শেখায়।
দরজা বন্ধ করেন বিশ্বনাথ। শুয়ে পড়েন। অন্ধকারে সনকার ছবির দিকে তাকান। তারপর মনে মনে কথা বলেন সনকার সঙ্গে।
—তুমি জানতে না সনকা, আমিও জানতাম না। আমাদের কাছে ওরা অন্যরকম মুখ দেখাত। বছরে কয়েকবারই তো! অন্যরকম মুখ দেখাত। আমাদের যখন নন্দীবাবু বলত, ব্যবসা করতে গেলে আজকাল এসব করতে হয় আমি শুনতাম, বুঝতাম না। এসব না করলে আজকাল সাফল্য আসে না সনকা। তুমি জানতে না। আমিও জানতাম না।
বাইরে সব নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। আস্তে আলো জ্বালেন বিশ্বনাথ। পড়ার আলো। টেপরেকর্ডটি বালিশের পাশে রাখেন। যে কোনো ক্যাসেট। আজকে বিশ্বনাথ হারিয়ে যাচ্ছেন, ভেসে যাচ্ছেন, ঘুমোতে পারছেন না, সনকার গলা খুব আস্তে শুনলে তবে উনি ঘুমোতে পারবেন।
—তোমার শুধু এক কথা। বলো, বলো আর বলো। কেবল শুনতে চাও, কেন আমি ভাবছি। আজ ষষ্ঠী। জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠীতে ছেলেদের কথা, মেয়েদের কথা মনে করে মনটা খারাপ হচ্ছে না?
—দূর থেকে আশীর্বাদ করো।
—তা তো সর্বদা করছি। আসলে ওদের ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ে। সেই যে ওরা পাঁচজনে আসনে বসত আমি নতুন পাখার ওপর পাকা আম, দুর্বো সব রেখে ওদের মাথায় ঠেকাতাম, তারপর নতুন পাখায় জল দিয়ে বাতাস দিতাম…সেবারে তুমি দূরে বেগুসরাই গেছ। ফেরার কথাই নয়, পাশে গোবিন্দও আছে, বেশ মনে পড়ছে, তুমি হঠাৎ এলে জোড়া ইলিশ নিয়ে। কি আনন্দ! জোড়া ইলিশ! আজ সে কথা ভাবা যায়?
—গঙ্গার ইলিশ! দুটো বুঝি দু’টাকা।
—তাই তো ছিল…মেজ খোকা বলছে আমি একটা পুরো খেয়ে নেব। কি ভালবাসত ইলিশ। ষষ্ঠীর দিনটা। তাই ওদেরকে মনে মনে আশীর্বাদ করলাম। মীরাদের আম—কাঁঠাল—মিষ্টি দিলাম। আর তোমাকে একটা প্রণাম করলাম। আবার হাসছ, থামতে বলছ কেন? ও…টেপ শেষ হয়ে গেছে বুঝি?
রেকর্ডার বন্ধ করেন বিশ্বনাথ। রেকর্ডারে হাত রেখে ঘুমোন।
৩
ছোট খোকা, শিপ্রা, ওদের ছেলে বুবাই। বেবি, ওর ছেলে ও মেয়ে সোনা আর রূপা।
মেজ খোকা নেই। দিল্লীতে। মালিনীকে যথেষ্ট হালকা মনে হচ্ছে আজ।
—বাবা! ওদের সকলকে আসতে বললাম। আজ রবিবার। এখানে খাবে। বিকেলে যাবে। বিকেলে আমি আর আপনি কোথায় যাব বলুন তো?
—কোথায় মা?
—মাসিমার বাড়ি।
—মাসিমা?
—আপনার বড় শালী। অসুস্থ হয়ে কতদিন পড়ে আছেন। আপনি তো এসেই যেতে চেয়েছিলেন।
—বাড়ি চিনতে পারব?
—আমি পারব। আগে আগে তো গেছি। আর কোথায় কোথায় যেতে ইচ্ছে হয় বলবেন। ও যখন থাকবে না, আমি আপনাকে নিয়ে যাব।
সেই ডিনারের দিন থেকে কি হয়েছে বাড়িতে বিশ্বনাথ জানেন না। কিন্তু বাবি রাত ন’টার সময়ে ওঁকে ”হাই”! বলে যাচ্ছে। গোপাল বলছে ও বাড়ি ফিরছে ন’টার মধ্যে, তাই হবে। কেন না ওর ঘর থেকে বাজনা, গান, এ সবের সুর বিশ্বনাথ শুনতে পান!
মালিনীই ওঁর সঙ্গে কথাটথা বলে। পরদিন সন্ধ্যেয় মেজ খোকাও ঘরে এল। একটু বসল, কথা বলল।
বিশ্বনাথ আঁচ করতে পারছেন, কিছু হয়েছে একটা। কি, তা উনি জানেন না।
বেবির ছেলে মেয়ে ওঁকে ”হাই দাদু!” বলে বাবির ঘরে ঢুকে যায়। বেবি বলে, আর যা করো, তোমাদের গানবাজনাগুলো আস্তে বাজিও। মাথা ধরে যায় একেবারে গোলমালে।
ছোট খোকা বলে, হঠাৎ তলব কেন?
মালিনী বলে, বাবা আছেন, সবাই এলে বেশ ভাল লাগে না?
—মেজদা নেই, তাই বলো।
—সে যাই বলো।
বেবি বলে, কেন, মেজদা থাকলে কি অসুবিধে?
মালিনী আস্তে বলে, ও থাকলেই বিয়ার—টিয়ার আনত, কোনো কথা শুনত না। বাবা আছেন না?
বেবি বলে, সে তো বাপু আমিও খাই, শিপ্রাও খায় কখনো—সখনো। তোমার কথা অবশ্য আলাদা।
ছোট খোকা বলে, না না, থাক।
শিপ্রা বলে, বাবা যখন এখানেই থাকবেন, উনি তো বুঝেই যাবেন সব…
মালিনী বলে, তোমরা তো কেউ এমন নও যে, চাই—ই চাই। সে জন্যেই…
শিপ্রা বলে, বাবা থাকলে তোমাকেও…
মালিনী বলে, ওসব কথা থাক এখন। চলো না, বাবার ঘরে চলো।
সবাই এসে বসে বিশ্বনাথের ঘরে।
—কেমন আছ বাবা?
—ভালো, খুব ভালো। বউমা খুব যত্ন করে।
—আমি আর কি করি!
—গোপাল বলেছে, আমার রান্নাবান্না করেও দাও, দেখিয়েও দাও।
মালিনী অপ্রতিভ হয়ে বলে, করতে কি আর পারি? সব সময়ে করি না, ভুলেও গেছি।
—আমি তোমার জন্যে মাছ রেঁধে আনব।
—আমি তোমার জন্যে মাছ রেঁধে আনব বাবা একদিন। মা’র মতো হবে না…
শিপ্রা সহাস্যে বলে, আমার দৌড় চা—কফি—ভাত—ডাল—ডিম সেদ্ধ—আলু সেদ্ধ, ব্যাস। ওর ছেলে বুবাই বলে, তোমার চেয়ে ননী অনেক ভালো রাঁধে।
—তোর ভালো লাগলেই ভালো।
বেবি বলে, তোমার রান্না করার দরকার কি শিপ্রা? তোমার ননী যা ভালো রাঁধে।
ছোট খোকা বলে, বাবা যেন কি বলবে বলবে মনে হচ্ছে?
—হ্যাঁ…কথাটা…দরকারী।
—কী বলো? মেজবৌদি চলে যাচ্ছ?
—একটু শরবত দিতে বলি। আর, বাবার কথা আমি শুনেছি। তোমরা শোনো, আমি আসছি।
—বলো বাবা।
—ছোট খোকাকে বলছিলাম…তুমি মায়ের মুখাগ্নি করলে…শ্রাদ্ধও করলে…এক বছরের কাজটা তো করতে হবে। তার আগে, প্রতি মাসে একটা করে কাজ থাকে। সে কথাই বলছিলাম।
সবাই চুপ। মালিনী শরবৎ নিয়ে ঢোকে।
ছোট খোকা একটু ভাবে, তারপর বলে, বাবা! এসব যা বলছ, তাকি করতেই হয়?
বিশ্বনাথ ঈষৎ হাসেন।
—তাই তো নিয়ম।
—আমার পক্ষে…মাসে মাসে…
বেবি বলে, ও যদি করতে পারে, তুমি পারবে না কেন? শিপ্রার কি আপত্তি আছে?
শিপ্রা যথেষ্ট আত্মস্থ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়ে। তাকে মালিনীর মতো বা বেবির মতো চেষ্টা করে সামাজিক রীতিনীতি শিখতে হয় নি। মালিনীর মতো ও বিশ্বসংসারকে ভয়ও পায় না।
ও ঈষৎ হেসে বলে, আমার আপত্তি থাকবে কেন? তখন কি আপত্তি করেছিলাম? আমার মা—বাবা মারা গেলে আমি যদি কোনো রাইটস করি, ও আপত্তি করবেও না, করলেও আমি মানব না।
ছোটখোকা বলে, মাসে মাসে…
বিশ্বনাথ বলেন, কৃত্য তো অনেক থাকে বাবা। মাসেরটা মাসে না করলে বাৎসরিকের সময়ে বড় কষ্ট পেতে হয়।
ছোট খোকা বলে, বাবা! আমার পক্ষে মাসে মাসে…বা এক বছর হলে…ও সবে আমার তেমন বিশ্বাস নেই। তাই…
—তখন করেছিলে কেন?
—সবাই বলল বলে।
—ছোট খোকা! অন্তর থেকে বলছি, নেভার ডু দিস। যে জিনিসে বিশ্বাস নেই, তা কোর না।
—বাঃ, তোমার একটা সেন্টিমেন্ট নেই।
বেবি বলে, ছোড়দা! মায়ের শেষ কাজ করেছিলে শুধু বাবার সেন্টিমেন্টের জন্যে?
—বেবি! তুমি কথা বোল না। তুমি বড্ড খোঁচা মেরে বলো, আমার সব গুলিয়ে যায়।
—ও, আমার কথায় খোঁচা থাকে?
বিশ্বনাথ বলেন, এসব কথা থাক এখন। তবে আমার কি মনে হয় জানো? তোমরাও সব বিশ্বাস সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পার নি। সেদিন ওসব কাজ করার সময়ে একবারও মনে হয়নি, কোনো ঘোর নাস্তিক এ কাজ করছে।
শিপ্রা বলে, বাবা ঠিক বলেছেন, যুক্তি আছে কেমন, জবাব দাও? আমাকে তো খুব তর্কে হারাও।
—তোমরা খুব তর্ক করো বুঝি?
—হ্যাঁ বাবা। রাজনীতি থেকে মাছের ঝোল, সব বিষয়ে আমাদের দারুণ মতের অমিল।
ছোট খোকা বলে, বাবা ঠিকই বলেছ।…আমার কি মনে হয় জানো? মাসে মাসে ওসব করা—টরা হবে না। বরঞ্চ সেই এক বছর হলে…
বেবি বলে, তখন বারোটা না তেরোটা…শ্রাদ্ধের ম্যারাথন ছোড়দা…
—কিন্তু আমাদের বাড়ি, এ বাড়ি, কোথায় মাসে মাসে এসব করার মতো পরিবেশ বলো?
শিপ্রা বলে, এর মানে কি? করতে চাও, করতেই পারো। বাড়িতে না করো, হিন্দু মিশনের…বাড়িতেও করতে পারো…
—তুমি জানো না, সে কি ঝুটঝামেলা…
—কিসের ঝামেলা? আমাদের বিল্ডিং—এই হালদার করছেন তো! পুরুত আসে, ফর্দ করে জিনিস আসে, উনি করেন দেখলাম তো।
—তুমি আবার কখন গেলে?
—যখনই হোক গেছি।
মালিনী শরবৎ নিয়ে ঢোকে, প্রত্যেককে দেয়। বেবি তির্যক হাসে।
—এ বাড়িতে সকালে শরবত!
মালিনী সমিনতি চোখে তাকায়। ছোট খোকা বলে, দাও তো মেজ বউদি।
—বাবা আপনি?
—না মা, নিয়মের বাইরে কিছু খেলে—
—শিপ্রা! বেবি! বাবার চেহারাটা বেশ ভালো হয়েছে, তাই তা? বেশ ভালো।
—ভালোই তো!
—একটু রান্নাঘরটা দেখে আসি।
—কি খাওয়াবে, মালিনী?
—শিপ্রা! খুব সাধারণ রান্না। বাবা যেমন খান।
বেবি বলে, আমাকে তা’হলে একমুঠো কাঁচালঙ্কা দিও। সত্যি ভাবি খাব না, আলসার হবেই হবে, তবু…
বিশ্বনাথ বলেন, আগে তো খেতে না?
—বাবা! মানুষ বদলায় না?
—নিশ্চয়। পরিবর্তন তো স্বাভাবিক।
ছোট খোকা বলে, পরিবর্তন মানে সময়ের সঙ্গে মানিয়ে চলা। তাই বাবা! ওসব মাসে মাসে কাজটাজ…
শিপ্রা নিচু গলায় বলে, আমি কিন্তু কোনো আপত্তি করছি না। এটা তোমার যা মনে হয় তাই বলছ…
—তোমার এসব হিঁদুয়ানি তো দেখি নি?
—হিঁদুয়ানি আমার থাকতে পারে না, কেন না আমি সেভাবে বড় হই নি। কিন্তু আমি এও মনে করি যে, যদি কেউ করে তাহলে সেটাকে অশ্রদ্ধা করার অধিকারও আমার নেই। সে সময়ে তুমি যদি বাবার কথা ভেবেই সব করে থাকো, এখনো তাই করা উচিত।
—তোমার শুধু উচিত, উচিত আর উচিত।
বেবি বলে, বেশ! এখানে না করো সোদপুরে গিয়ে করো। সেটাই ভালো।
—দীপক যা করে, আমাকেও তাই করতে হবে?
—কেন নয়? ও কর্তব্যগুলোও করে, আবার নিজের যা কিছু নিজেই করেছে। তোমার মতো শ্বশুরের দেয়া বাড়ি গাড়ি তো ওর ছিল না!
শিপ্রা বলে, এ কিরকম কথা বেবি?
ছোট খোকা বলে, দীপকের ব্যবসার কথা আমাকে বোল না। কিভাবে যে টেন্ডার ধরায়…
বিশ্বনাথ অবাক হয়ে ছেলে—মেয়েকে দেখেন, দেখতে থাকেন।
শিপ্রা দুবার ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলায়। তারপর বলে, দোহাই তোমাদের! তোমরা একসঙ্গে হলেই এমন করো যে, আমার…বাবা আছেন সে কথাটাও ভাবো।
ছোট খোকা ও বেবি চুপ করে যায়। বেবি উঠে যায় ঘর থেকে। ছোট খোকা বলে সরি!
শিপ্রার চোখ থেকে হঠাৎ একটু জল গড়ায়। মুছে নিয়ে ও বলে, একসঙ্গে হলেই বেবি…
বিশ্বনাথ মনে মনে দুটি ছবি মেলাতে চেষ্টা করেন। তাঁর মেয়ে বেবি যাকে আঠারো বছর আগে বিয়ে দিয়েছিলেন, যার স্বভাব ছিল নরম, যে কীর্তন শিখেছিল, ছোটবোনের চেয়ে একটু বোকাই ছিল, লম্বা চুলে যে বেণী বাঁধত, রোজ সোৎসাহে মাকে পুজোর ফুল তুলে দিত, সে বেবি একটা চেনা ছবি।
এখন উগ্র মেকাপ, চুল ছাঁটা সদাই অসুখী, বিশ্বসংসারের ওপর কোনো আক্রোশে তিক্ত, ঝাঁঝালো এই বেবির সঙ্গে সে বেবির কোনো মিল নেই।
হঠাৎ ওঁর মনে হয়, হয়তো বেবির ভেতরে আত্মবিশ্বাস নেই, নিরাপত্তাবোধ নেই। হয়তো ও অসুখী। সে জন্যেই এত ছোবল মেরে কথা বলে।
আর ছোট খোকা? এই ছেলেকেই কি তিনি চেনেন?
প্রিয়ার সঙ্গে বিয়ে, সে বিয়ে ভাঙল। তারপর শিপ্রাকে বিয়ে…কোনো বিয়েটাই তিনি দেননি। প্রিয়া ছিল অন্য রকম। শিপ্রা অন্যরকম।
ছোট খোকাও কি সুখী নয়?
বিশ্বনাথ আস্তে বলেন, ছোট খোকা। শ্রাদ্ধটা তো কিছুই নয়। পরলোকে যে গেছে, তাকে শ্রদ্ধা জানানো। আমার যা মনে হয়েছে আমি বলেছি। তোমাদের যা মনে হয় তোমরা কোর।
—পরেও তো ভাবা যাবে বাবা।
শিপ্রা হঠাৎ বলে, বাবা, মা’র নামে কোথাও কোনো ভালো ভালো কাজে দান করলেও তো হয়।
—বেশ তো! সেরকম আগেও করত মানুষ…তবে শ্রাদ্ধশান্তি বাদ দিত না।
ছোট খোকা বলে ওঃ আগে!
বিশ্বনাথ ঈষৎ হেসে বলেন, হ্যাঁ ছোট খোকা। আগেকার লোকদের বুদ্ধি কম হ’ত। খোকা। আগেকার লোকদের বুদ্ধি কম হ’ত।
ছোট খোকা বলে, তা বলছি না। কিন্তু এটা ঠিক যে, দিনে দিনে মানুষের আয় কিন্তু বাড়ছে।
—অর্থাৎ আমার চেয়ে তুমি বুদ্ধিমান, তোমার চেয়ে তোমার ছেলে বুদ্ধিমান, তাই তো? জানি, তুহিন আর বিদিশা দুই ডাক্তার তো! ওরা আমাকে কতরকম লেখা পড়ে শোনাত, কত কথা বলত…
শিপ্রা বলে, সোদপুরের কথা খুব মনে হয়, তাই না বাবা? ওদের কথা?
—তা তো হবেই।
মালিনী এ সময়ে ঢুকে পড়ে। বলে, ছেলে—মেয়েদের খেতে দিয়ে দিচ্ছি শিপ্রা।
—আমার পুত্র?
—বুবাই তো আজ আমার হাতেই খাবে।
—আহ্লাদ দিও না তো। নিজে দিব্যি খায়।
—তাহলেও আজ আমি খাইয়ে দেব।
—তুমি পারও, মালিনী।
মালিনী আজ খুব খুশি, খুব স্বাভাবিক। ও বলে, খুব পারি ভাই। এসব আমার ভালও লাগে। আমার বাপের বাড়ি তো দেখনি। রবিবারে ছুটির দিনে, যত আত্মীয়—স্বজন সবাই আসবেন, সব একসঙ্গে খাওয়া—দাওয়া হয়…
—সত্যি!
—তোমাকে ত কত বলেছি চলো একবার!
—যাব, ঠিক যাব!
—আর গিয়েছ!
—মাংস মাংস গন্ধ পাচ্ছি?
—হ্যাঁ ছোট খোকা। ছেলেমেয়েদের জন্যে মাংস তো করতেই হবে। জানেন বাবা, ছেলেমেয়েরা কেউ মাছ খেতে চায় না।
—বুবাই খায় কিন্তু। আমার অবাক লাগে। ওর বাবা, আমি, কেউ অত তৃপ্তি করে মাছ খাই না।
বিশ্বনাথ হেসে বলেন, ঠাকুমার মতো হয়েছে।
—মা খুব মাছ ভালবাসতেন?
—মাছ তার চাই রোজ। তবে খেত বড়জোর দু’খানা। তবু রোজ চাই।
ছোট খোকা বলে, তুমি আমাদের রোজ ছোট মাছ খেতে বলতে। তাতে নাকি বুদ্ধি বাড়ে।
—যা শুনতাম তাই বলতাম। তবে নুটু যখন বিধবা হল, তোমার মা কতদিন মাছ খায় নি।
শিপ্রা ছোটদের খাওয়া দেখতে উঠে যায়। ছোট খোকা বলে, কাগজটা দেখি বাবা।
—এ ঘরে তো বাংলা কাগজ।
—তুমি ইংরিজি কাগজ পড়ো না?
—তোমার মায়ের জন্য…আর বাংলা কাগজই বা কি পড়ব? শুধু বধূহত্যা…দাঙ্গা—হাঙ্গামা…
—দেখি, ও ঘরে কাগজ আছে বোধহয়…
—হ্যাঁ, পাবে।
পড়ুক না পড়ুক, মেজ খোকা দুটি ইংরিজী কাগজ, অনেক ইংরিজী সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, রীডার্স ডাইজেস্ট সবই রাখে। মাসে মাসে কাগজের বিল দেয় কয়েকশো টাকা।
সব কাগজের ভাঁজও খোলা হয় না। মাসে মাসে সেসব কাগজ বেচে দেয় মালিনী। বিশ্বনাথের জন্যে বাংলা কাগজের ব্যবস্থাও মালিনীর এবং সে খুব মন দিয়ে কাগজে খুন—জখম—ধর্ষণ—রাহাজানির খবর পড়ে।
অর্থাৎ মেজ খোকা যতই দাবড়াক, মালিনী এখনো মনে মনে বাঙালিনী রয়ে গেছে।
বিশ্বনাথ মনে মনে বলেন, সনকা এদের তুমি চেনো না। এক শহরেই থাকে, কিন্তু শিপ্রা কখনো মালিনীর বাপের বাড়ি যায় না। আমি যে দীর্ঘকাল বাংলা কাগজই পড়ি, তা ছোট খোকা জানে না। একসঙ্গে হলে তোমার ছেলে—মেয়ে এ—ওকে আক্রমণ করে। আর মালিনী! সে তার স্বামীর সামনে অন্যরকম, স্বামী না থাকলে খুব সহজে স্বাভাবিক।
ছোট খোকা তোমার বাৎসরিক কাজ করতে চায় না। মাসে মাসে কাজ করার কথা তুললে…
—চলুন বাবা।
শিপ্রা এসে দাঁড়ায়।
—চলো মা।
—বুবাই এখনি আপনার ঘরে আসছে। ওর খুব পছন্দ ঘরটা। ও ওখানেই ঘুমোবে।
—সে তো আমার সৌভাগ্য।
—মালিনী ওকে যা খাওয়া খাইয়েছে।
বুবাই ঢোকে, বলে, তুমি তো কখনো খাওয়াও না। জেজেম্মা খাইয়ে দিলে আমি এত এত খেতে পারি।
—খুব হয়েছে, শুয়ে পড়ো।
—তুমি আমার কাছেও শোও না। শুধু…বাবার সঙ্গে ঝগড়া হলে…বলে দেব?
—বুবাই!
বিশ্বনাথ শুনেও শোনেন না। বলেন, চলো চলো। ছোট ছেলের কথা কি ধরতে আছে?
—বড্ড পাকা হয়ে যাচ্ছে। সে জন্যেই ওকে হস্টেলে পাঠাব ভাবছি।
—ওইটুকু ছেলেকে?
—দার্জিলিঙে বাবা! আসলে আমরা দুজন এত ব্যস্ত থাকি…
—যে ওকে সঙ্গ দিতে পারি না।
—তাই!
—হস্টেলে!
—আমি তো মুসৌরিতে হস্টেলেই মানুষ।
—তুমি কি কোন কাজটাজ করো?
শিপ্রা অপ্রতিভ হেসে বলে, ওর সেক্রেটারি।
—আপিসে যাও?
—হ্যাঁ বাবা।
বেবি এ ঘর থেকে উঠে গিয়ে দুটি নীল বড়ি খেয়ে নিজেকে বশে এনেছে। মিসেস ভরদ্বাজ না বললে ও জানতেই পারত না এমন কোনো বড়ি আছে।
চায় না, বেবি রাগতে চায় না। দীপকের অনুগত স্ত্রী হয়েই থাকতে চায়। কিন্তু দীপকের শাসন অত্যন্ত কড়া। দীপকের স্ত্রী হিসেবে বেবিকে সমাজে চলবার মতো সবই নিখুঁতভাবে জানতে হবে। নইলে আর ইউরোপে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া কেন, স্টেটাসের জন্যেই তো! স্টেটাস অনুযায়ী চলতে গেলে…
হ্যাঁ, দীপকের দরকারে তুমি কখনো স্কচ, কখনো বিয়ার খাবে, দীপক যখন বলবে।
একই সঙ্গে তুমি ছেলে—মেয়েকে এই সব পার্টি—হুল্লোড়—ব্যবসার জন্য মদের আসর, সব কিছু থেকে বাঁচিয়ে চলবে, চলতে বাধ্য।
শ্বশুরবাড়িতে মাসে একবার তাঁতের শাড়ি পরে মাথায় কাপড় দিয়ে যাবে, যেতে বাধ্য।
তুমি মনে রেখে চলবে যে, তোমার ভাইদের মতো দীপক টপকা বড়লোক নয়, সে বনেদী ঘরের ছেলে। ছোট খোকা এবং তার বউ, নো মাখামাখি। ডিভোর্স, আবার বিয়ে, এগুলো দীপকের পছন্দ নয়।
মেজ খোকা ও মালিনীর সঙ্গেও নো মাখামাখি। মালিনীর ছেলেটি বখাটে এবং মেজ খোকা ব্যবসার খাতিরে বাড়িকে বাজারে তুলে দিয়েছে।
এ সবই তুমি করবে এবং মিসেস দেশাই, মিসেস ভরদ্বাজ, মিসেস মুখার্জী, এঁদের সঙ্গে সমাজসেবা করবে। তাতে তোমার আরেক রকম আভিজাত্য বাড়ে।
হ্যাঁ, আমি অনিতাকে মধ্যমগ্রাম থেকে তুলে এনে পার্কস্ট্রীটে রাখব। নিজের দিকে চেয়ে দেখো আয়নায়। আমার সব দরকার তুমি মেটাতে পারবে না। আমি মেজ খোকা নই যে, পার্টি দেবার জন্যে হোটেল ভাড়া করব এবং কখনো হোটেল কখনো কলগার্লের সঙ্গে একই বাড়িতে স্বতন্ত্র ফ্ল্যাটে রাত কাটাব।
আমি যা করব, বুক বাজিয়ে। নৈতিকতা দেখিও না বেবি। আমার ঠাকুর্দা থিয়েটারের অ্যাকট্রেস রাখতেন। আমার জ্যাঠামশাই তাঁর সিন্ধুবালাকে বৌবাজারে বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন।
তোমার জীবনটা আমি কয়েকটা কামরায় ভাগ করে দিয়েছি বেবি। এ ঘরে তার সোনা—রূপায় মনোযোগী মা, আবার তুমি বাড়িতে ব্যবসার লোকজন এলে কেতাদুরস্ত গৃহিণী, চোস্ত ইংরিজি বলো, একটু মদ খাও, মদ দাও। এ ঘরে তুমি বনেদী ঘরের বউ, মাথার কাপড় সরে না। ও ঘরে তুমি সমাজ সেবিকা, রবীন্দ্রসদন ও কলামন্দিরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করিয়ে মিসেস দেশাই—এর ”আশ্রয়” হোমের জন্যে টাকা তোলো।
এভাবে নিজেকে ভাগ করতে করতে, বিভিন্ন ভূমিকায় ঠিক মতো অভিনয় করতে করতে বেবির স্নায়ুগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়, যেত। সর্বদা আক্রোশে চলে বেবি, সকলের ওপর ক্রোধে।
মিসেস ভরদ্বাজ একদিন বললেন, বেবি।
—বলুন!
—আমি তোমার বন্ধু?
—নিশ্চয়।
—তাহলে…
নীল বড়ির সঙ্গে পরিচয় উনিই করান। বেশি খেও না বেবি, অভ্যেস জন্মে যাবে। শুধু যখন দেখবে যে, আর পারছ না…আর পারছ না…
খাবার টেবিলে যে এসে বসে, সে বেবি খুব শান্ত, হাসিখুশি। একটু প্রগলভও।
—শিপ্রা তো ছোড়দার সেক্রেটারি ইচ্ছে করে হয়েছে। কর্তাকে আঁচলে বেঁধে রাখবে বলে।
—ভালো, খুব ভালো।
—সুকতনিটা খাও বাবা।
—চমৎকার হয়েছে।
মালিনী একটু হাসে। বলে রান্নাবান্না ভুলেই যাচ্ছিলাম বাবা। শেষে বেবি বুদ্ধি দিল, রান্নার বই কিনে নাও। দেখলেই মনে পড়বে।
বেবি বলে, ডলিও বই কিনে নিয়ে গেছে।
শিপ্রা বলে, বই তো আমারও আছে। বাংলা বই পড়তেও তেমন পারি না, বুঝতেও পারি না।
বেবি উদার হয়ে যায়। বলে, বেঁচে গেছ ভাই। বিয়ের পর শাশুড়ি আমাকে দিয়ে যে কি রান্নাই করাতেন! আর কি খুঁত খুঁতে।
—এখনো তো করো মাঝে মাঝে।
—না করে উপায় আছে? ওকে তো জানো না। রান্নাটি ঠিকমতো না হলে প্লেট ছুঁড়ে ফেলবে। ছেলে—মেয়েও তেমনি। এটা চাই, ওটা চাই।
ছোট খোকা বলে, সর্বদা বলি বটে, বাঙালীরা রান্না বিষয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করে…
শিপ্রা খেই ধরিয়ে দেয়, খাওয়ার জন্যে বাঁচে, বাঁচার জন্যে খায় না, এই বলবে তো?
—বলি, বলে যাব নিশ্চয়। কিন্তু মাঝে মাঝে সুকতো ঝাল, ঝোল, বেশ হয়েছে।
মালিনী বলে, দয়া করে এলেই তো পারো। আমিও ভালবাসি…আসলে এখন সবাই এত ব্যস্ত থাকো না। আগে তবু আমাদের ঘনঘন দেখা হ’ত।
শিপ্রা বলে, আমি যখন থেকে দেখছি…
—মালিনী বলে, ততদিনে সবাই ভীষণ ব্যস্ত মানুষ হয়ে গেছি।
বেবি হঠাৎ বলে, মা থাকলে সোদপুরে…মাঝে মাঝে…তবু তো!
বিশ্বনাথ বলেন, ডলি চিঠি লিখেছে?
—হ্যাঁ বাবা। তখনি তো…
—তারপর আর লেখে নি।
ছোট খোকা বলে, ডলিও কাজ করে, নীলাভও কাজ করে, ওখানে সত্যিই ব্যস্ত থাকে ওরা। ঘরের কাজকর্ম সবই তো নিজেদের করতে হয়।
—হ্যাঁ, তা তো বটেই।
—তোমাকে একবার ঘুরিয়ে আনব বাবা।
—এই বয়সে?
শিপ্রা বলে, বয়সটা আবার কি! মনটাই সব। ওদেশে বুড়োরাও বুড়ো হয় না।
বেবি বলে, তা বোল না। বুড়ো হলে সাধারণত একাই থাকে, নয়তো কোনো হোমে।
মালিনী বলে, আমারই যাওয়া হয় নি।
—মেজদা কতবার যায়, গেলেই পারো।
—বাবাকে রেখে…খুব ইচ্ছে ছিল একবার দক্ষিণ ভারতটা ঘুরি। কত মন্দির, কত দেখার জায়গা…
—গেলেই তো হয়।
মালিনী বলে, একবার যাব। আমি, বাবা আর বাবি। বাবিকে একবার তিরুপতি মন্দিরে নিয়ে যাব…
ছোট খোকা বলে, কেন?
মালিনী চোখ নামায়। বলে, এমনি।
বিশ্বনাথ খেয়েদেয়ে উঠে পড়েন। বলেন, আজ তো আবার বিকেলে ভ্রমণ আছে। একটু শুই।
—হ্যাঁ বাবা শুয়ে পড়ুন।
শিপ্রা বলে, বুবাই জায়গা রেখেছে তো?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক জায়গা।
বিশ্বনাথ চলে যান। হাত ধুয়ে ওরা মালিনীর ঘরে বসে। ছোট খোকা বলে আমি বাপু একটু ঘুমোব। এত খেয়েছি…
বেবি বলে, আমিও।
শিপ্রা আর মালিনী দু’জনে মেজ খোকার ঘরে বসে।
মালিনী বলে পান খাবে? আজ আনিয়েছি।
—দাও।
—পান খেতে কি ভালবাসতাম…
—খাও না কেন?
—ও রাগ করে।
—ওঁর যা ইচ্ছে উনি করবেন, তুমি একটু পানও খেতে পারবে না?
—পান খাওয়া তো অসভ্যতা।
—কিসে? তুমি আবার বড্ড ভীতু।
—ভীতু? হয়তো! কিন্তু যে অশান্তি করে…এখন আর সইতে পারি না।
—আমাদের দেখ তো, পরিষ্কার সম্পর্ক।
—তোমার যে মনের জোর আছে।
—কি ভাবছো বলো তো?
—না…এই…
—বলোই না।
মালিনী বলে, বলব?
—বলো। বাবার কথা তো?
—হ্যাঁ।
—অসুবিধে হচ্ছে?
—অসুবিধে হচ্ছে, তবে সেটা ওঁর জন্যে নয়।
—বলো!
—সে সময়ে কথা হলো, ও বাবাকে নিয়ে এল, সব কথা ভাইবোনের হলো, ওরাই ঠিক করল।
—তুমি কিছু বলো না কেন?
—একটু বলছিলাম…ও ধরে নিল ওর বাবাকে আনাতে আমার আপত্তি আছে। ওর বাড়ি, ওর বাবা আসবেন, এইরকম ভাবখানা।
—জানি। আমিও ছিলাম।
—ওর বাড়ি, ওর বাবা আসবেন, সবই ঠিক। কিন্তু…শিপ্রা…এখানে আমাদের জীবন কি রকম…বাড়িতে মদের হুল্লোড়…বেলেল্লাগিরি…বাবা এসব জানতেন না। বাবা আছেন বলে বাবির বাবা যে নিজে একটুও সংযত হয়ে চলবে…
—মেজদার ব্যবসার জন্যেই তো…
—বেশ! ব্যবসার জন্যে বাড়িতে বাজার চলা দরকার। তার মধ্যে বাবাকে আনা…আমার ওপর হুকুম, উনি যেন কিছু টের না পান…তুমি বলো সেটা কি সম্ভব।
—না, সম্ভব নয়।
—বারবার মনে হচ্ছে, কোনদিন কি জানবেন, কি আঘাত পাবেন…উনি অন্য রকম মানুষ।
—আমার ওখানে অবশ্য তোমার মতো সমস্যা নেই। কিন্তু সত্যি বলছি, টাকা দিতে পারি…মাঝে মাঝে নিয়ে যেতে পারি…মাঝে মাঝে আসতে পারি…কিন্তু খোলাখুলি, বলাই ভালো, আমার পক্ষে ওঁকে নিয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়।
—তোমারও…
—না, ও মেজদা নয়। কিন্তু আমার সমস্যা অন্যরকম। কি জানো! আমরা দু’জনে হয়তো বিয়ার খাই বা ব্রান্ডি, কিন্তু সেটা কোন সমস্যা নয়। ব্যাপার হলো, ওর নিজের ফার্ম, ফলে আপিসে কাজ চলে, বাড়িতেও। ও এমন উগ্র কেরিয়ারিস্ট যে ব্যক্তিজীবন বলে আমাদের কিছু নেই।
—আমি ভাই বুঝি নি।
—তা ছাড়া, আমি তো জানি ও আগে বিয়ে করেছিল। জেনে শুনেই বিয়ে করেছি। আমি অতীতের কথা ভুলেও মনে করাই না। আর ও…সব সময়ে আমাকে প্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করে।
—ছিঃ!
—বাবা ফ্ল্যাট দিয়েছেন। তুমিও নিয়েছ। তা’হলে কথায় কথায় তোমার বাবা বড়লোক…তুমি বড়লোকের মেয়ে…সবচেয়ে অবাক হবে একটা কথা জানালে।
—কি?
—কেউ যেন জানে না। ওর এমন হীনমন্যতা যে, ওর বাবাকে ও বাড়ি নিয়ে যেতে লজ্জা পায়।
—লজ্জা!
—হ্যাঁ, লজ্জা। উনি আমার বাবার মতো নন, যথেষ্ট পালিশ নেই…হেন তেন, মানুষ হিসেবে ও এতটা অসম্পূর্ণ, তা আমি আগে বুঝি নি। ও মায়ের জন্যে ওসব করবে? করার সাহসই নেই। বলে কি জানো? ও সব সোদপুরে করা চলে, এখানে নয়।
—জানতাম না ভাই।
—নিজের বাবা—মাকে নিয়ে লজ্জা। ওঁরা কি লজ্জা পাবার মতো মানুষ? অন্যরকম, খুব অন্য রকম, কিন্তু আত্মসম্মানী, অত্যন্ত সভ্য। আর কি জানো! এটা জেনেছি যখন তখন থেকেই ওর ওপর আমার শ্রদ্ধা কমে গেছে। সেই জন্যেই বুবাইকে…
—হস্টেলে দিচ্ছ?
—দিতেই হবে। বাপ—মার মধ্যে অশান্তি দু’জনের কেউ ছেলেকে সঙ্গ দিতে পারি না…আমার একেক সময়ে মনে হয়, প্রিয়া ওকে ছেড়ে গেছে বলে সেই যে ওর পৌরুষে ঘা লাগে, তারপর থেকেই সমাজে কেউকেটা হব বলে…খুব হিসেব কষে আমাকে বিয়ে করে।
—না না, তা কেন হবে?
—তাই। মালিনী, তাই। কত সময়ে বলেও ফেলে। আমি…আমি কিন্তু ওকে ভালবেসেই…
—শিপ্রা! ওর মেজদা হয়তো অন্য রকম…কিন্তু টাকা আর টাকা! কত টাকা ওর দরকার? বাবার কথা বলছ? বাবাকে ওঁর ঘরে সন্ধ্যার পর বন্ধ করে রাখা হয়, সে এক কারণে। যাতে ওর সন্ধ্যা কেমন কাটে তা বাবা জানবেন না। বাবাকে নিয়ে ও—ও তো লজ্জা পায়। লুঙ্গি পরা অসভ্যতা, গামছায় স্নান করা অসভ্যতা, হেন…তেন…
—এরা সবাই যেন নিজের সঙ্গে বাজি রেখে ছুটছে।
—বাবা যদি তাঁর মত ওখানেই থাকতেন তা’হলে আত্মসম্মান নিয়ে থাকতেন।
—বয়সটা বড় বেশি…
—কে ক’বার দেখতে যেত বলো? বাড়ি আছে, জায়গা আছে, টাকা আছে, কিন্তু তোমারই বাবা! তোমার যেমন জীবন, তার মধ্যে ওঁকে এনে…কবে যে কি হবে, ফট করে ও কি বলে বসবে…আমি দুদিক সামলাতে সামলাতে আমার ভালো লাগে ওঁকে, কিন্তু আমি তো সব নই। হয়তো কেউই নই।
—বেবির কাছে বাবা আছেন, ভাবতে পারো?
—অসম্ভব! ওর যা মেজাজ!
শিপ্রা একটু হাসে। বলে হবে না মেজাজ? ও তো ড্রাগ করে।
—ড্রাগ!
—নিশ্চয়! আমি ঠিক বুঝেছি।
—মা গো!
—তোমার ছেলের ওপরেও নজর রাখো। কেন, কেন এ কথা বলছ?
—এই বয়স। এরকম বাড়ি! এ সব বাড়ি তো এখন…এখন এই বয়স…বড়লোকের ছেলেমেয়ে…ড্রাগ…কাঁদছ কেন? মালিনী!
মালিনী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, কেঁদে চলে। বলে, আমি কি করব বলতে পারো? কোনদিকে যাব? ছেলেকে দেখব, না তার বাবাকে দেখব…এই এত বড় বাড়ি, এত ব্যবসা কারবার। এ সব কিছু দরকার ছিল না আমার। আমি আর পারছি না।
—এই যাও! মুখ ধোও। বেবি বোধ হয় উঠেছে। গলা পাচ্ছি বলে মনে হয়।
—বাবিকে একবার তিরুপতিনাথে নিয়ে যেতে পারলে…অনেকের কাজ হয়েছে।
—মেজদা জানেন?
—জানলে আমাকে আস্ত রাখবে না।
মালিনী বাথরুমে ঢুকে যায়।
সোনালি বিকেল গড়িয়ে নেমে আসে। ছেলেমেয়েরা বলেছিল…ওরা বিকেলে লুচি খায়।
চা খেয়ে বেবি ও ছোট খোকারা চলে যায়। মালিনী বাবির ঘরে ঢুকে কি যেন বলে অনেকক্ষণ ধরে নিচু গলায়।
তারপর বলে, চলুন বাবা!
বকুলবাগানে খুঁজে খুঁজে মালিনী ওকে নিয়ে গিয়ে ঠিক হাজির করে সনকার বড় বোনের বাড়ি। যেমন বাড়ি তেমনি আছে, অপরিবর্তিত। বিশ্বনাথের খুবই অবাক লাগে।
শেষ কবে এসেছেন এখানে?
সনকার দিদি মেনকার শিরদাঁড়ায় বাত, শয্যাশায়ীও বটেন। কিন্তু কথায় দাপট কমেনি।
—বড়লোক বোনপোরা তো মাসির বাড়ি ভুলেই গেছে। বউমা কেমন করে চিনে এলে তাই ভাবি।
অপ্রতিভ মালিনী বলে, সময় পাই না মাসিমা।
—ছেলেরা বলে, মেজ খোকা, ছোট খোকা, সব এখন রাজপ্রাসাদে থাকে।
—ফ্ল্যাট বাড়ি।
—এখন তো ফ্ল্যাটেরই যুগ গো বউমা! আমার ছেলেরাও নেচে আছে, বুড়ি মরলেই বাড়ি বেচে যে যার মতো ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবে।
—ছেলেরা কোথায়?
—সব ডাকি।
ওঁর ছেলেরা, বউরা, নাতি নাতনি। এক নাত বউ—সবাই আসে। প্রণাম করে।
—চা জলখাবার আনে।
—না না, আমি কিছু খাব না।
—আমিও না।
—সনকা চলে গেল!
—রাখতে পারলাম না।
—ভাগ্যিমানী ছিল, আপনাকে রেখে গেল! আর আমি! তার চেয়ে বয়সে বড়। সে কবে কপাল পুড়েছে, আজ পাঁচ বছর শয্যা ধরেছি, তা যম আমাকে তো নেবে না।
ছেলেরা বলে, মেসোমশাই কি সোদপুরের বাড়ি বেচে দিলেন?
—না না, বেচব না।
মেনকা বলেন, ছেলেদের কাছেই থাকবেন। বাড়ি রেখে আর হবে কি?
—সে আমি চলে গেলে…
—আপনি তো বেশ শক্ত আছেন।
—তা আছি।
—কোন ছেলের কাছে আছেন?
—মেজ খোকার কাছে।
—শুনেছি খুব বড় বাড়ি। তা যাওয়া—আসা তো নেই। আগে বরং…
—না, এরা সবাই দেখি ব্যস্ত খুব।
—মেনকা, সনকা, কনকা তিন বোন। তা কনকা তো বিয়ের পরেই…সনকাও চলে গেল! ছেলেদের ঘরে ছেলেপিলে কি?
—সব একটি একটি। বেবির দুটি।
—আমার দুই ছেলে দুই মেয়ে। তা নাতি—নাতনি সতেরটি। রবিবার হলেই সব আসে, থাকে!
—সেই তো ভালো।
—দুঃখ হয়। সনকার ছেলে—মেয়েদের সঙ্গে আমায় দেখুন। এক শহরে বাস করেও…
—এখন তাই! বড় খোকা আমেরিকা, ছোট মেয়ে জার্মানী, এদের নিজেদের মধ্যেই কি যোগাযোগ থাকবে? থাকবে না, থাকা সম্ভব নয়।
—এই মেজ বউমাই আসত আগে।
—এখন আর…
—তা, তুমিও মা চুল কাটলে?
—ওর সখে মাসিমা।
—আমার নাতনিও নেচেছিল। তিন ধমকে মাথার ভূত ছাড়ালাম। ও মা! বিয়ের পর শাশুড়ী তাকে ফ্যাশনী করবে বলে চুল কাটাল।
বিশ্বনাথ বলেন, বাড়ি, বাগান সবই তো রেখেছেন। এমন কি, বাড়িও ঠিক তেমনি আছে।
—আমি যতদিন, ততদিন। আমার নামে বাড়ি তো।
—সোদপুরের বাড়িও চমৎকার। কত গিয়েছি একসময়ে।
শুধু বাড়ি নয়, মেনকার বোধ হয় আরো জোর আছে। কথা যা বলবার উনি একাই বলে যান, প্রৌঢ় ছেলেরা, শাশুড়ী হয়ে যাওয়া বউরা চুপ করে থাকে। মালিনীর দিকে ওরা এমন ভাবে তাকায়, যেন অন্য গ্রহের জীব।
মেনকার কানে তার বউ কি যেন বলে। মেনকা বলেন, কি? তোতার কথা? তুমিই বলো না।
তারপর মালিনীকে বলেন, আমার সেজ নাতি তোতার কথা গো বউমা!
—কি কথা, মাসিমা?
—বেচারার কপালে শনি। কত পরীক্ষা দিচ্ছে তো দিচ্ছেই।
—কমার্সে এম এ, টাইপ জানে। মেজ খোকাকে বলে ওর একটা কাজ…কদ্দিন বলেছি, যা না, গিয়ে দেখা কর। কাকা তো হয়! তা লজ্জা পায় ভীষণ।
মালিনী বলে, নিশ্চয় বলব। তোতা একদিন বাড়িতেই এসো না। বলেও রাখব, কথাও বলিয়ে দেব। তোতা কোথায়?
—সে গেছে ক্লাবে। ওরা বেশ সব…খেলাধূলা, পুজো, ফাংশান…কত প্রতিযোগিতা করে।
তারপরেই বলেন, বাবা বলতেন, শ্বশুর দেখে মেনকার বিয়ে দিয়েছি, ছেলে দেখে সনকার। কনকার তো ঘরে ঘরে হলো আমারই মামাত দেওরের সঙ্গে। তা দেখুন না, শ্বশুরের তৈরি এই বাড়ি, পঁচিশ ইঞ্চি দেয়াল। সামনে দু—কাঠা জমি, ওপরে নিচে দশখানা ঘর, এতে ছেলেদের মন ওঠে না।
—এক ছেলে হেসে বলে, আর যে ধরে না মা!
—না ধরে তো সামনে জমি আছে বাড়াও। তা কি করবে? বাড়িতেই দুটো হেঁসেল চলছে। তখন মাড়োয়ারিকে বেচবে আর যে যার মতো সরে পড়বে।
বিশ্বনাথ সহাস্যে বলেন—আপনি কার ভাগে পড়লেন? বড়, না ছোট?
—ছ’ মাস এর, ছ’ মাস ওর।
—আমরা উঠি।
—এলেন বলে দেখা হলো। নইলে…সনকার কপাল ছিল, চলে গেল। আমি আর বউমা! মেজ খোকাকে বোল। তবু এলে মুখটা দেখলাম। ছোট খোকা…বেবি…কেউ আসে না। এক শহরে বাস, কেউ কাউকে চিনবে না।
মালিনী বলে, তোতা কোথায় পড়েছে?
—এ বাড়ির সব ছেলে মিত্র স্কুলে, সব মেয়ে বেলতলা স্কুলে, ছেলেমেয়ে সবাই আশুতোষ কলেজে, যোগমায়াতে, শ্যামাপ্রসাদে।
—ইংরেজি বলে ভালো?
—ওই যা জানে। পরীক্ষায় তো ভালোই করেছে বরাবর। এখন চারিদিকে ইংরিজি স্কুলের হাওয়া…
না। এ বাড়িতে হাওয়া ঢোকে নি। সবাই খুব বাঙালী থেকে গেছে। মেঝেতে পঙ্খের কাজ করা লুডোর ছক। কোনো সময়ে মাসিমারা খেলতেন। বাইরে বারান্দা অত্যন্ত চওড়া।
ওঁদের এগিয়ে দিতে দিতে এক ছেলে বলে, যেদিকে তাকাবেন, জায়গার অপচয় মেসোমশাই। দুটো রাক্ষুসে উঠোন, ওপরে প্রতি ঘরের সামনে বারান্দা, তখনকার লোকের কোনো বুদ্ধি ছিল না।
মালিনী বলে, ওঁরা থাকার জন্যে বাড়ি করেছিলেন। ভাড়া দেবার জন্যে তো নয়।
—যা আছে, তাতেই ভেঙ্গেচুরে বড় ফ্ল্যাট বাড়ি উঠতে পারে। প্রত্যেকের ফ্ল্যাট থাকল, কিছু বেচাও গেল। মা থাকতে তা হবার নয়। এ বাড়ি মেরামত করা…ট্যাক্স দেয়া…আমাদের কি সে ক্ষমতা আছে?
গাড়িতে উঠে বিশ্বনাথ বলেন, কেউই তার নিজের অবস্থায় সুখী নয় এখন।
মালিনী বলে, ওঁদের অবশ্য মানুষও অনেক বেড়ে গেছে।
বহুতল বাড়ি বেলতলায়, হাজরায়, বকুলবাগানে। না। কলকাতা বদলে যাচ্ছে বলে ক্ষোভ করে লাভ নেই। মানুষ বাড়ছে, আবাসন চাই।
বিশ্বনাথ বলেন, সবই বুঝলাম। কিন্তু মানুষের তো এখন সমাজের একটা স্তরে বড্ড বেশি চাই সব। সব কিছু অনেক অনেক। বড় বেশি চাহিদা।
মালিনী চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আপনি এলেন বলে আমার একটু আসা হলো।
তোমার ইচ্ছে হলেই চলে এস।
না। তা পারে না মালিনী। মেজ খোকার কড়া নির্দেশ, নো আত্মীয়স্বজন। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে চার—পাঁচটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারো, ওরা স্টেটাসে সমান না হোক, কাছাকাছি।
আর যাঁরা আছেন, এই কলকাতাতেই আছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ? একেবারে নয়। ওদের তুমি চেনো না। ঢুকতে দিলেই আসতে থাকবে। তখন আমি কেন, তুমিও লজ্জায় পড়বে।
একদল হচ্ছে মনে মনে ভিখিরি, প্রার্থী, কোনো না কোনো ধান্দায় আসবে।
আরেক দল হচ্ছে, সামনে প্রশংসা করবে কিন্তু হিংসেয় জ্বলে মরবে। এ সব লোক ভয়ানক বিপজ্জনক। আসতে দিলেই পেছনে তল্লাস চালাবে। কোথা থেকে, কেমন করে তোমার এত রমরমা হলো।
কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবে! তুমি কি জানবে মালিনী! আমি সর্বদা টুরের সময় বই পড়ি, পত্রিকা পড়ি, তাতে হরদম দেখছি—সাংবাদিক বলো, যে কোন লোক বলো, পেছনে লেগে থেকে কি সর্বনাশ করতে পারে।
কেঁচো খুঁড়তে সাপ কেন বেরোবে। সে কথা মালিনী কখনো জিগ্যেস করে নি। মেজ খোকা বা দীপকের রমরমার পেছনে অনেকটাই যে অন্ধকার ঘোর প্যাঁচ তা মালিনী বোঝে। এখন তেমনি সব লোকজনের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখবে যারা আমাদের সঙ্গে সমানে সমান। ভিখিরি ভিখিরি চেহারার লোকজন এলে…
মালিনী জানে, ভিখিরি ভিখিরি চেহারার সংজ্ঞাটা মেজ খোকার কাছে কি! যারা ওদের মতো নয় তারাই….অথচ তারা কেউ দীনদরিদ্র নয়, আত্মসম্মানী মধ্যবিত্ত।
না, মধ্যবিত্ত না কি এখন মেজ খোকা, ছোট খোকা, দীপক। ওরা তাহলে নিম্ন—মধ্যবিত্ত। এ শহরের প্রতি অঞ্চল মেজ খোকাদের মতো বাঙ্গালী, অবাঙ্গালীর হাতে চলে যাওয়াটা ওরা খুব সমর্থন করে। মেজ খোকা হরদম বলে, তেমন বহুতল বাড়িতে বাস করা যায় না, যেখানে শুধু বাঙ্গালী থাকে।
মালিনী ভেবে পায় না ওকে নিয়ে ওর স্বামী লজ্জায় পড়ে না কেন। অনেক কিছুই ভেবে পায় না মালিনী। বর্তমানে ওর দুটি সমস্যা। বিশ্বনাথ কবে অপমানিত হয়ে চলে যাবেন।
বাবির কি হবে। কাকে জিগ্যেস করবে ও, কে ওকে বলে দেবে কি কর্তব্য।
এ সব ভাবতে গেলেই মালিনীর মনে হয় ও ভেসে যাচ্ছে অন্ধকার সমুদ্রে। হিংস্র স্রোত ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দূরে, কিছু করতে পারছে না ও।
এরকম মনে হয় বলেই এ বাড়ির ছাদে ওঠে না মালিনী। ছাতটা প্রকাণ্ড, খেলার মাঠ বললেও হয়। বহু টিভি অ্যান্টেনা, তবু অনেকটা ফাঁকা আছে।
বিশ্বনাথ আসার আগে আগেই এই থেকে কেডিয়াদের মাদ্রাজী ঝি রাজাম্মা লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। ও সন্তানসম্ভাবিতা ছিল। কোনো তদন্তই হয় নি।
ছাদে উঠতে মালিনীর ভয় করে। প্রেত ভয় নয়, অন্য ভয়। এত বড় ছাত। এমন বাতাস, ছাতের চারিদিকে সমুদ্র শূন্যতা। ভয় হয়, যদি ও লাফিয়ে পড়ে? যদি এই অন্ধকার বাতাস ও নির্জনতা ওকে পেয়ে বসে? তাহলে কি হবে?
বিশ্বনাথ বলেন, পৌঁছে গেছি।
—পৌঁছে গেলাম!
মালিনী এতক্ষণ অন্যত্র ছিল। সেখান থেকে ফিরতে খুব অসুবিধে হয়।
—কি ভাবছ মা?
—ভাবছি পরের রবিবার কোথায় যাব।
—যাবার মতো আত্মীয়স্বজন তো অনেক কিন্তু কি জানো মা! তোমাদের সঙ্গে তো সকলের যোগাযোগ নেই…
—আপনার যেখানে ইচ্ছে যাবেন।
—দাঁড়াও দাঁড়াও, আগামী রবিবার তারিখ কত?
—একুশে।
—দিলীপ আসতে পারে।
—লিখেছে?
—আমিই লিখেছি। চিঠি লিখি, জবাব পায় না, বাড়ির কি হচ্ছে না হচ্ছে…
মালিনীর বুক শুকিয়ে যায়। এ বাড়িতে দিলীপ, মানে মীরার বর। এ বাড়িতে রবিবার মানে অনেক রকম হতে পারে। যদি মেজ খোকা থাকে, যদি তার ব্যবসার জন্য একুশেটা ‘বিশেষ’ রবিবার হয়, তাহলে? দিলীপকে দেখলে…না, অনেকদিন করা হয় না, সে নিশ্চয় মালিনীর দোষ। কিন্তু দিলীপ এলে…
৪
সুপ্রভাতের ঘরে বসেছিলেন বিশ্বনাথ। পার্ক থেকে ফিরতে হয়েছে। বৃষ্টি হঠাৎ নামল। হচ্ছে তো হচ্ছেই বৃষ্টি সেই থেকে।
এ ঘরে দেয়ালে দেয়ালে গাছের ছবি, বড় বড় রঙ্গিন। খুব সবুজ, খুব শান্ত। দেয়ালের তাকে অনেক বই। সবই অরণ্য সম্পর্কীয়। একটি হাতির ছবি, পিঠে সুপ্রভাত।
—হাতির পিঠে আপনি?
—আমরা তো জঙ্গলের কাজে হাতিকে দিয়ে গাছ টানাতাম, জঙ্গলে যেতাম। উনি বেদানা, আমি তখন আসামে। আমার খুব বাধ্য হয়ে গেছল। হাতির বুদ্ধি খুব বেশি, জানে তো ওরা বিশ্বস্ত হতে জানে। মানুষের মতো নয়…
—এ আপনি বলতে পারেন না। কেন, এই বাহাদুর কি আপনার জন্যে কম করে?
—তা বটে। তা রবিবার তো আসেন নি?
—বউমা নিয়ে গেল বড় শালীর বাড়ি।
—আছেন ভালো।
—বউমা খুব যত্ন করেন।
—কপাল থাকা চাই। ছেলে?
—সে তো সদাই ব্যস্ত।
—তাই মনে হয়।
কোথা থেকে উৎকট গানের সুর আসে। সুপ্রভাত মাথা নাড়েন, সবই ভালো মশাই। তবে বরদানন্দের খপ্পরে পড়েছেন, দেখুন কি হয়।
—ওদের তো গুরু।
—এই সৈকতে কারা থাকে তা বুঝতেই পারছেন। সমাজের কোন মহলের মানুষেরা! মজা কি জানেন, এমন ফ্ল্যাট নেই যেখানে কোনো না কোনো গুরু নেই। শক হূণ দল, পাঠান মোগলের মতো সত্য স্বামীবাবা, বরদানন্দ, লোকপিতা এমন নানা গুরুর আক্রমণের কাছে এখানকার বাসিন্দারা সব মাথা মুড়িয়েছে।
—সবাই?
—দু’ঘর মুসলিম, এক ইহুদী ছাড়া সবাই।
—আশ্চর্য।
—প্রত্যেকটি গুরু কোটিপতি তো বটেই, তার চেয়েও বেশি কিছু…
—কিন্তু কেন?
—সেটাই তো মজা। ঘরে ঘরে বেলেল্লাপনা, ঘরে ঘরে ভি ডি ও—তে পর্ণো ফিল্ম, বাচ্চারা, বাপ—মা সবাই ড্রাগ করছে, অথচ গুরুভক্তি সকলের।
—এ যে ভয়াবহ কথা।
সুপ্রভাতের চোখ যেন জ্বলে ওঠে। বলেন, পাখি দেখার দুরবীণ দিয়ে অনেক সময়ে মানুষ দেখি। সময়ও অঢেল আমার। এ সব কেন হচ্ছে জানেন :
—কেন?
—কোরাপশান। এরা সব আসলে পাপী। এই গুরুর দলও এদের দল। এদের এত আছে, তবু গুরু চাই। কেন না এদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ নেই।
—তাই হয়তো হবে।
—এই যে কেডিয়ারা! এদের ছেলে—মেয়েগুলা ফ্ল্যাটের যত ছেলে—মেয়ে সব বখাচ্ছে।
—আপনি কিছু বলেন না?
—ড্রাগের পর এরা তো হিংস্র হয়ে থাকে। এমনিতেই আপনার নাতি আসছে না বলে ওরা ক্ষেপে আছে আমার ওপর।
—ও আসত, তাই না?
—আসত, এখন দেখছি না।
—এদের বাড়িতে শাসন নেই।
—কে কাকে শাসন করবে! বাপ—মা—ই সাহস পায় না, আমি তো কোন ছার।
—না। আমার নাতিকে দেখলে বলবেন।
—এখানে…কি হয় না হয়..
—আপনি এখানে এলেন কেন?
—সেটাই তো ভুল হয়েছে। তখন জানি গাছপালা পাব। ন্যাশনাল লাইব্রেরি, হর্টিকালচার সোসাইটি, সব কাছে…
—আমাকে তো এরাই নিয়ে এল।
—সে আপনার কপাল। হালদাররা তো বুড়ো বাপকে কোন হোমে পাঠিয়ে তবে ফ্ল্যাটে ঢুকল।
—হোম?
—হ্যাঁ, খুব দামী হোম। না ”আশ্রয়”। কলকাতার দক্ষিণে মিসেস দেশাই না কোন এক মহিলার বিরাট ব্যাপার। মাসে হাজার টাকা দিতে হয়।
—হাজার টাকা!
—হ্যাঁ মশাই। অসুখ হলে চিকিৎসা খরচ আলাদা। আরে, বুড়ো বাপকে সঙ্গে রাখবে? হাজার টাকা যায় যাক, আপদ বিদায় হোক।
—খুব বড়লোক ছাড়া…
—সে তো বটেই। কলকাতায় কালো টাকা উড়ছে। সৈকতে আমার মত পেনশনার ক’জন?
—আমার ছেলে অবশ্য বিজনেস করে।
—জানি।
—সত্যি ওদের যে কত টাকা, আমি ভেবে পাই না। এই বাড়িতে দুটো ফ্ল্যাট…তিন—চারটে চাকর…দুটো ড্রাইভার…আমি ভাবতেই পারি না।
—ভাববেন কেন? ভাববেন না। ভাবতে গেলেই আমার আপনার মতো লোক গোলমালে পড়ে যাব।
—ভাবতাম না। এখন সামনে আছি, ভাবি।
—সময় কাটে কি করে?
বিশ্বনাথের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
—শুনলে আপনি হয়তো হাসবেন।
—হাসব কেন?
—ছেলেরা, মেয়ে, বউ জানে না।
—খুবই গোপন ব্যাপার।
—হ্যাঁ…আমার স্ত্রী আর আমি…আমারই পাগলামি…একটা কমদামী টেপ—রেকর্ডার কিনে কথাবার্তা টেপ করতাম।
—এমনি কথাবার্তা?
—হ্যাঁ…সাধারণ, ঘরোয়া কথা…কথা ছিল, একজন তো আগে যাবেই, ইচ্ছামৃত্যু তো হয় না…তখন আরেকজন বাজাবে আর শুনবে।
—তাই শোনেন?
—হ্যাঁ সুপ্রভাতবাবু। একলা ঘরে…ওর গলা শুনতে শুনতে…মনটা যেন শান্ত হয়।
বিশ্বনাথ সহাস্যে চেয়ে থাকেন। সুপ্রভাত অবাক, মুগ্ধ। তারপর বলেন, আপনি ভাগ্যবান।
—ভাগ্যবান হলে সে কি যায়?
—না না, ভাগ্যবান।
—কাউকে বলবেন না।
—না, এ বড় পবিত্র কথা। কাকে বলব?…আর আমি…না, আমাদের কোনোদিন তেমন সম্পর্ক হয়তো ছিল না। সেজন্যেই ও চলে যেতে পারল।
—বড় দুঃখের কথা।
—ও চলে গেল…আমিও কেমন যেন হয়ে গেলাম…ওর ছবি, চিঠি…সব পোড়ালাম…এখন মনে হয় অতটা না করলেও পারতাম!
—কি বলব, বলুন!
—তখন…সে যখন নিজের শ্রাদ্ধ নিজে করে পূর্বজীবনকে মুছে দিয়ে যেতে পারল…
—মাথা ঠিক থাকে না।
—আমার তো থাকে নি।
—খুবই দুঃখ হয় ভাবলে।
—উঠবেন?
—উঠি। আমি তো আবার কারফুতে বাস করি…সন্ধ্যার পর ছেলের লোকজন আসে…আমি বেরোই না আর…ঘরেই খাই…
—আমি যদি আপনি হতাম, আর দেখার লোকজন থাকত, আমি তাহলে বারুইপুরেই থাকতাম।
—সোদপুর।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, সোদপুর।
—সেখানেও নানারকম হচ্ছে আজকাল। তবে আমাদের পাড়াটা ভালো। আমরাও কারো সাতে—পাঁচে থাকতাম না। তাই তেমন আঁচ লাগে নি।
—আপনি ভাগ্যবান, বলেছি তো?
—যদি দেখাতে পারতাম…আপনি তো গাছ ভালবাসেন…কত গাছ…কত গাছ…
—হয়তো দেখব।
—হয়তো বর্তমানে একটু মনঃকষ্টে আছি। ছেলেরা তো মায়ের বাৎসরিক কাজ করবে না বলে মনে হয়…আচ্ছা, আসি।
”সৈকত” বহুতল বাড়ি। আলিপুরের বহুতল বাড়িকে চমকে দেয়া বা বিব্রত করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। লালবাজার থেকে কাস্টমস, কারোর পক্ষেই সম্ভব নয় ”সৈকত”—এর সম্পর্কে কোনো তদন্ত চালানো, হঠাৎ হানা দেয়া।
কেন না এ বাড়িতে কয়েক ঘর বাদ দিলে সকলেই এমন প্রভাবশালী যে, কলকাতা থেকে দিল্লী, কোথাও না কোথাও তাদের টিকেতে আগুন দেবার লোক আছে।
তবু তেমন ঘটনা ঘটে যায়।
কারণ, মালিনীর ছেলে বাবি।
মুনদের বাড়িতে সে সবে যেতে শুরু করেছিল, নেশাতে সবে ডুবছিল, কিন্তু পরের দিনটি ভয়াবহ।
কেন না মা ওকে ধরেছিল। মালিনী সব সময়ে কাগজ পড়ুক না পড়ুক, চরস হেরোইন ইত্যাদি ইত্যাদির পরিণাম কি হয়, তা বাংলা মেয়েদের পত্রিকাতে পড়েছিল। ছেলের কখনো বুঁদ হয়ে থাকা, কখনো ভয়ংকর রেগে ওঠা, কখনো ফুরফুরে হাসি, ওর সন্দেহ হচ্ছিল।
সেদিন রাতে তো সব সংশয় ঘুচে যায়।
মেজ খোকাকে বলার আগে ও ছেলেকেই ধরেছিল। মালিনীর এমন রুদ্রমূর্তি বাবি কখনো দেখে নি। মালিনী জেরা করেছিল নির্মমভাবে।
সবই ও বলে ফেলে। কেন না এখনো ও তেমন পাকা হয় নি। আর মালিনী, মুন, টিংকা, জনি, রাহুল এদের মাদের মতো নয়। সে বাড়িতেই থাকে এবং মুনদের কাছে ওর মা গেঁয়ো বাঙালী। বহু সময়ে মা কেঁদে বলেছে, তুমি আমার একমাত্র ভরসা বাবি।
বাবি জানে, বাবার কারণে ওর মার মনে কোনো দুঃখ আছে এবং বাবাকে মা ভয় পায়।
সেই মা কথার চাবুক মেরেছিল।
—হস্টেলে দিই নি, ছেড়ে থাকতে পারব না বলে, তার খুব প্রতিদান দিলে।
—তোমার ওপর ভরসা করেছিলাম, তার খুব প্রতিদান দিলে!
—এসব করতে হলে বাড়ি থেকে বেরোও।
—দুঃখ ভুলতে ড্রাগ! কিসের দুঃখ। কি জন্যে দুঃখ? ছুটিতে ইউরোপ যেতে পারো নি। তুমি নিজেকে কি মনে করো, সুপারম্যান? একজন জিনিয়াস?
—বিদেশে যাবে, যখন নিজে লেখাপড়ার জন্যে যাবার মত যোগ্য হবে। না চাইতে পেয়ে পেয়ে গোল্লায় গেছ। তোমারই দাদু এখানে আছেন…বলতে লজ্জা করে না, যে মুনরা ওঁকে বলে ক্রীপ! চাকরদের মতো ফানি পোশাক করেন। মুনরা তোমার দাদুকে, মাকে নিয়ে হাসে, তুমি সয়ে যাও। ছি ছি ছি! ওদের বাপ—মা সম্পর্কে কিছু বলে দেখো ওরা কি করে?
—না, আর পকেটমানি নয়, ওদের বাড়ি নয়, ওদের সংশ্রব নয়। তোমার ব্যবস্থা আমি করছি। যদি নিজেকে না শোধরাও, তোমাকে মেরে আমি আত্মহত্যা করব, এটা জেনে রেখো। তোমার মতো একটা পাপকে রেখে যাব না।
মা’র মুখ—চোখ দেখে বাবির মনে হয়েছিল, শেষের কথাগুলো মা ওর বাবাকে বলছে। যা হোক, বাবি ভয় পেয়ে যায়।
কাউকে না জানিয়ে মা ডাক্তারের কাছে ওকে নিয়ে যায়। সেখানেও জেরা, জেরা, জেরা!
এখন ও সকালে জগিং করছে, তিনটে থেকে ছয়টা থাকছে জিমনাসিয়ামে।
আশ্চর্য, ওর ভাল লাগছে।
কিন্তু বর্তমানে ও গভীর জটাজালে পড়েছে।
মুন ফোন করে করে ওকে পাগল করে দিচ্ছে। না, ফোন নামিয়ে রেখেও লাভ নেই। লিফট দিয়ে উঠতে—নামতে ওকে দেখে ওরা ঈষৎ হাসে।
গতকালের অভিজ্ঞতাটা ভয়ংকর।
ফোনে মুন হিশহিশ করে বলেছে, আজ সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে ছাতে দেখা করছ। না করলে পরিণামটা ভেবে রেখো। চাঁদ…সানিয়াল।
পার্কে চাঁদ সানিয়ালের হাতে—মুখে হালকা হালকা ধারালো ব্লেডের টান।
পার্কে!
তার মানে বিগ জনি।
ভীষণ ভয়ে বাবি ছাতে গিয়েছিল। মুন বলেছিল (ইংরিজিতে) ভীরু! মায়ের খোকা! শোনো, তুমি যে ভাবছ বেঁচে গেছ, সে কথা ভুলে যাও। আমাদের ক্লাবে জয়েন করলে কেউ বেরোতে পারবে না।
—আমি…আমি…
—হাজার টাকা ক্যাশ দিচ্ছ। তাহ’লে আমরা…
—কোথায় পাব?
—চুরি করো, যা ইচ্ছে করো।
—হাজার টাকা।
—বিগ জনিকে দিতে হবে।
—কেন?
—বাচ্চু! খোকাবাবু! বিগ জনি ছাড়া কে সাপ্লাই করবে? এটা তোমার পেনাল্টি।
—মুন! আমি তো আগে আগে…
—ও সব রোজ দশ—পঞ্চাশের ব্যাপার নয়।
—মা টাকা সব সরিয়ে রাখে।
—হাজার টাকা!
বাবি ভীষণ ভয়ে সাদা হয়ে নেমে আসে। পরদিন, বহু ডিকেটটিভ বই পড়ে পড়ে অভিজ্ঞ বাবি বাড়ি থেকে দূরে পোস্টাপিসের পাবলিক ফোন থেকে থানায় ফোন করে। ভয়ে ও সাদা, কিন্তু নাম বলে নি। শুধু বলেছিল, এই বাড়িতে, এত নম্বর ফ্ল্যাটে নিয়মিত চরস, হেরোইন…আপনারা সন্ধ্যার পর আসুন।
—গলা শুনে…আপনি কে?
বাবি ফোন রেখে দিয়েছিল।
এর ফলেই সৈকতকে চমকে দিয়ে পুলিশ ঢোকে। সাদা পোশাক। তবুও পুলিশ। মুন ও জিনকে জেরা করে। ছোকরা অফিসার এখনো তেমন পোক্ত নয়। ও জানে না, কাস্টমস ড্রাগ র্যাকেট ধরলে যা পাবে, ও তার সিকির সিকিও পাবে না। ওর কানে শুধু ভীত, অসহায় একটি কিশোরের গলা বাজছিল।
যা বেরোয় তা যথেষ্ট নয়। মুন হিংস্র আক্রোশে বলে (ইংরিজিতে), তা হলে এসব ফ্ল্যাটেও যান (নাম করে করে বলে)। আমাদের এটা দরকার (ও নেশায় ছিল)। বিগ জনি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।
যেসব ফ্ল্যাটে ও যেতে বলে, সেসব ফ্ল্যাটে ঢোকার এলেম এর নেই। নামগুলোই ভয়ংকর ভয়ধরানো। তবে বিগ জনিকে ধরা যায়। কাস্টমসে ফ্ল্যাটের নাম ও তালিকা পৌঁছে যায়। অতঃপর কোনো ফোন চলে যায় প্রতি ফ্ল্যাটে। তারপর কাস্টমস হানা দেয়।
সামান্যই উদ্ধার হয়। মিসেস দারুওয়ালা অত পোক্ত নন। তাঁর ফ্ল্যাট থেকে কিছু…
কিন্তু ‘সৈকত’ তোলপাড় হয়ে যায়। উচ্চপর্যায়ে ফোন ও সাক্ষাৎ চলতে থাকে। আজ ড্রাগ, কাল কালো টাকা, সরকার ভেবেছে কি? সৈকতবাসীরা হেঁজিপেঁজি লোক? কেডিয়ার যুবতী ঝি রাজাম্মা গর্ভ হলে আত্মহত্যা করে, মদ ও ড্রাগের পার্টিতে কলগার্ল খুন হয়, বাইরে থেকে ডবগা মেয়ে এনে নীল ছবি তোলা হয়, কবে কোন ব্যাপারে তদন্ত হয়েছে?
উৎসাহী পুলিশ অফিসারটির সামনেই এলেবেলে হয়ে যায় সব।
মুন হিংস্র ক্ষুব্ধ, অপমানিত মুন। বাবিকে সন্দেহ করে না। দুধের খোকার কাজ নয়।
ওই সুপ্রভাত দত্ত!
বিগ জনি ঠিক বেরিয়ে আসবে। সে মুনকেই ধরবে।
বিগ জনির প্রতিশোধ বড় ভয়ংকর।
ওই সুপ্রভাত দত্ত!
পুলিশ বাবির কাছেও গিয়েছিল। মেজখোকা বেইজ্জত, বেইজ্জত। মালিনী বাবিকে বাঁচায়। আর মেজখোকা মালিনীকে আক্রমণ করে।
বিশ্বনাথ সবই শুনতে পেয়েছিলেন।
—তোমার উচিত ছিল বাবিকে সামলে রাখা!
—বাবির দায়িত্ব আমার একার?
—ঘরে বসে করো কি?
—যা করাও তাই করি।
—তোমার মতো স্ত্রীলোক…
—তুমি বুঝতে পারছ না, এভাবে চললে ছেলেকে বাঁচাতে পারবে না, আমরাও বাঁচব না…আমাদের জীবন সবটাই অসুস্থ…অসভ্য।
—রাবিশ!
—মিনতি করছি, তুমি যা বলবে তাই করব। চিরদিন তাই করেছি, শুধু তুমি বাবিকে বাঁচাও।
—আঃ, অমন কোর না।
—তোমার ব্যবসার জন্যে যা করার, তা হোটেলে করো, ওই ফ্ল্যাটে করো, বাড়িটা বাড়ির মতো থাকতে দাও। এই পরিবেশে ছেলে মানুষ করা যায় না।
—কি বলছ কি? বাড়িতে যদি লোকজনকে ডাকতে না পারলাম, এত বড় ফ্ল্যাট কেনা কেন?
মালিনীর গলা কান্নায় ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমি যে আর পারছি না। এর মধ্যে বাবি…এর মধ্যে বাবাকে…
—আমার বাবা তোমার কি করলেন?
—এ সব কতদিন লুকিয়ে রাখা যাবে? সব জানতে দিই না, যতটা পারি আগলে চলি…কিন্তু এত বড় শোকের পর এই বয়সে…এসব তো উনি জানেন না, জানলে ওঁর কি রকম আঘাত লাগবে? একেই তো ছোট খোকা মায়ের কাজ নিয়ে যেমন করছে তাতে ওঁর মনে…
—তুমি কি বলছ? বাবা থাকবেন বলে আমি আমার জীবনযাত্রা পালটে ফেলব?
বেশ কিছুক্ষণ বাদে মালিনী বলে, বেশ। কিছুই কোর না। সব যেমন চলছে তেমন চলুক…আমিও দেখে যাই।
—কি দিই নি আমি তোমাকে?
মালিনী ওর কথা শোনে না। যেন নিজেকেই বলে, অনেক আগে আমি অনেক ভালো ছিলাম। তুমি আমার কাছে থাকতে সন্ধ্যায়। বাবি পাড়ার নার্সারিতে পড়ত…আমরা মাসে মাসে সোদপুর যেতাম…নারকেল পাড়া হলেই মা লিখতেন…এত টাকা ছিল না, নিজেদের বাড়িও না, তবু…
—তুমি সেই খোঁয়াড়ের জীবনে ফিরে যেতে চাও?
—কোনটা খোঁয়াড়, কোনটা স্বর্গ, সব হিসেব আমার গুলিয়ে গেছে। আমি তো নির্বোধ, তুমি বলো, বেবি বলে, ছোটখোকা বলে। থাক, আর কথা থাক। বাবা এখন বেড়াতে যাবেন। আর কথা থাক।
মেজ খোকা দুমদাম করে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। মালিনী যখন ওঁর ঘরে ঢোকে বিশ্বনাথ বিছানায় বসে সনকার ছবির দিকে চেয়ে আছেন।
—বাবা!
—কাছে এসো মা।
মালিনী ওঁর পায়ের কাছে বসে পড়ে। হাঁটুতে মুখ ঢোকে। বিশ্বনাথ ওর মাথায় হাত বুলোতে থাকেন। জীবনেও বোলান নি।
আস্তে বলেন, কেঁদ না মা! তুমি ভেঙ্গে পড়লে কি চলে? সব ঠিক হয়ে যাবে।
—সব?
—নিশ্চয়।
বিশ্বনাথ প্রাচীন বিশ্বাসে বলেন, অশুভ শক্তি কখনো শেষ অবধি জয়ী হয় না মা।
—এখন যে…
—বিশ্বাস রাখো, স্থির হও।
বিশ্বনাথ কি সব শুনেছেন? মালিনী মুখ—চোখ মোছে। তারপর হাসতে চেষ্টা করে। বলে, আপনার ছেলেকে তো চেনেন…ও শুধু হম্বিতম্বি করে…নইলে ওর মনটা খুব ভালো। আসলে…
বিশ্বনাথ যেন অনেক দূরে চলে গেছেন। তেমনই গলায় বলেন, এই মেজখোকাকে আমি চিনি না। তোমাকে চিনছি…জানছি…জীবনে এটাও কম পাওনা নয় মা।
—যদি…কিছু শুনে থাকেন…ওকে ক্ষমা করবেন। ব্যবসা ব্যবসা করে ওর মাথায় আর কিছুই নেই।
—নিশ্চয়। সব বুঝি…
—বেড়াতে যাবেন?
—হ্যাঁ, একটু হাঁটি।
সুপ্রভাত আজ অন্যমনস্ক। যেন চিন্তিত।
—কি ভাবছেন।
—যে প্রহসনটা হয়ে গেল…
—ওই পুলিশ আর কাস্টমস?
—হ্যাঁ।
—প্রহসনই বটে। দেখুন…সোদপুরেও সবই আছে। অস্থিরতা, অশান্তি, দাঙ্গা—হাঙ্গামা, মস্তানি, থানার নিষ্ক্রিয়তা, রাজনীতির নামে গুণ্ডামি…
—সৈকতের মতো এক জায়গায় সব সোদপুরে নেই। সেখানে তো আপনিও থাকতেন।
—হ্যাঁ…তবে সমাজের কোন কোন মহল এমন উঁচু, তাও জানতাম না, আর সেখানে যে এত রকম…কি ভাবছেন বলুন তো?
—পুলিশে প্রথম জানাল কে?
—কে জানে!
—কেডিয়ার ছেলে—মেয়ে আমাকে সন্দেহ করছে। দরজায় লিখে রেখে গেছে, ”র্যাট”।
—অর্থাৎ ইঁদুর?
—ওদের ভাষা তো আলাদা। তাতে ”র্যাট” মানে যে পুলিশকে খবর দেয়।
—ছি ছি! কি করলেন?
—ওরা লিখে যাচ্ছে। আমি মুছে যাচ্ছি।
—বলেন নি কিছু?
—লিখতে দেখি নি, বলতে পারি না।
—তবু বুঝছেন?
—হ্যাঁ…বুঝেছি…ভয় পাচ্ছি।
—ভয়!
—হ্যাঁ ভয়। এদেরও তো বস আছে। তাকেই ভয়। সে মানুষ নয়।
—শুনলাম কাকে ধরেছে।
—ওকে কতবার ধরল, কতবার ছাড়ল। ওর বাবার পোর্টে বিশাল কারবার…সমাজবিরোধী এবং ধনী বাপের লাফাঙ্গা ছেলে…ওকে ধরে রাখবে কে?
—বাপ—মা জানে?
—ওর বাপ—মা জানলেও বা কি! ছেলে যা ছোট স্কেলে করছে বাপ তো তাই করছে বড় স্কেলে।
—এসব…পড়েছি কাগজে…
—সবই সত্যি।
—পুলিশকে বললে…
—পুলিশ। পুলিশ ওদের পকেটে থাকে। যাক গে, আজ আমার মনটা বিশেষ খারাপ।
—কেন?
—আসামেও শালগাছ হত। আমি একটা জঙ্গলকে শালগাছে ভরে দিয়েছিলাম। এ একটা অদ্ভুত আনন্দ। এখানে থাকি বটে, কিন্তু মনে করতে ভালো লাগত, যে সব জায়গায় কাজ করেছি, কত গাছ লাগিয়েছি, কত গাছ বিশাল হয়ে গেছে, কোথাও সেসব আকাশছোঁয়া গাছ আছে ভাবলেও শান্তি পেতাম।
—তা তো বটেই।
—আজকের কাগজে দেখলাম, সেসব বন সাফ, নির্মূল। উন্মাদ সরকার, উন্মাদ অরণ্যনীতি। অসাধু বনবিভাগ আর লোভী ঠিকাদার, মাটি থেকে সবুজ মুছে দিচ্ছে। দেখে আমার…
—সর্বত্র এক রকম।
—একটা গাছ বড় হতে, বয়স্ক হতে কত বছর লাগে, গাছ কি ভাবে মানুষকে বাঁচায়…
—একবার বহরমপুরের ওপারে বসনতলায় যাবেন। দেখবেন কি বড়ো, কত জায়গা জোড়া একটা বটগাছ! আমার দেশের বাড়িতেও একটা অর্জুন গাছ ছিল। আমরা তার নিচে পোষলা করতাম।
—মনটা বড় খারাপ আজ।
—ভেবে কি করবেন?
—কিছু না। কি করব? আমি কে? বয়স তিয়াত্তর, জীবন নিঃসঙ্গ…জীবনে কোনো ছোট কাজ করলাম না। আজ একটা ছোট মেয়ে আমাকে ”র্যাট” বলছে। কি করতে পারছি?
—চলুন ফেরা যাক।
—একবার আপনার সোদপুরেও যাব।
—নিশ্চয় যাবেন। আমিও চিন্তায় আছি। ওখানকার খবর পাই না। ভাদ্র মাস পড়লে নারকেল পাড়াতে হয়, গাছ পরিষ্কার করতে হয়, ওঁর বড় শখের গাছ। কিছুই নয়, সামান্য গাছের ফল। সকলকে বিলিয়ে দিয়ে কি যে আনন্দ পেতেন!
দুই বৃদ্ধ বাড়ি ফেরেন। বাড়ি! বাড়ি বলতে আজও বিশ্বনাথের মনে হয় সনকাবাসের কথা। মালিনী আজ ওঁর মনটি ব্যথায় ভরে দিয়েছে।
বিশ্বনাথ বলেন বাড়িটা কত উঁচু!
—হ্যাঁ, বিশাল।
—সুখের সব উপকরণ যাদের হাতে…
—তারাও সুখী নয়।
—”সুখ” শব্দের মানেও পালটে গেছে।
—বলতে পারেন।
—এরা মনে করে ভূমৈব সুখমল্পে নাস্তি। তা কিন্তু সত্যি নয়। সব সময় ভূমাতেই সুখ হয় না। সুখী হতে যে জানে সে অল্পেই সুখী হতে পারে।
—কাকে বোঝাবেন, কে বুঝবে?
দুজনে দুই ফ্ল্যাটে চলে যান। কেডিয়াদের দরজা খোলা। দরজায় হেলান দিয়ে মুন দাঁড়িয়ে। চামড়ার সঙ্গে আঁটা লাল নাইলনের গেঞ্জি ও প্যান্ট। মুখে বিচিত্র হাসি। সুপ্রভাত ঢুকে যান।
কিছুক্ষণ বাদে ফোন বাজে।
—র্যাট! বিগ জনি বেরোচ্ছে শীঘ্রই।
—কে, কে?
সুপ্রভাত টেলিফোন নামান, রিসিভার টেবিলে রাখেন। মুনের গলা নয়। অন্য কেউ, অন্য কোথাও থেকে ফোন করছে।
সুপ্রভাত কি করবেন? কোথায় নিরাপত্তা চাইবেন? কার কাছে?
না, কিছুই করবেন না।
ভয়ের কাছে হেরে যাবেন?
কখখোন না।
কিন্তু পুলিশকে খবর কে দিল?
সুপ্রভাত নিশ্চল বসে থাকেন। বয়স তিয়াত্তর। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ। চারদিকে গাছের ছবি।
তিনিও বৃদ্ধ, বাহাদুরও তাই। টেলিফোনে শাসানি। শাসানি থেকে আরো রক্তাক্ত কিছু গড়ালেও…সুপ্রভাতের মনে হয়, এর চেয়ে সে সময়ে ছেলেদের কথামতো বিদেশে চলে গেলে হয়তো ভালো হত।
কিংবা হত না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন