১৮. কাবুলের সামাজিক জীবন

সৈয়দ মুজতবা আলী

কাবুলের সামাজিক জীবন তিন হিস্যায় বিভক্ত। তিন শরিকে মুখ দেখাদেখি নেই।

পয়লা শরিক খাস কাবুলী; সে-ও আবার দুভাগে বিভক্ত জনান, মদনা। কাবুলী মেয়েরা কট্টর পর্দার আড়ালে থাকেন, তাঁদের সঙ্গে নিকট আত্মীয় ছাড়া, দেশী-বিদেশী কারো আলাপ হওয়ার জো নেই। পুরুষের ভিতরে আবার দুভাগ। একদিকে প্রাচীন ঐতিহের মোল্লা সম্প্রদায়, আর অন্যদিকে প্যারিস-বার্লিন-মস্কো ফেৰ্তা এবং তাদের ইয়ারবক্সীতে মেশানো ইয়োরোপীয় ছাঁচে ঢালা তরুণ সম্প্রদায়। একে অন্যকে অবজ্ঞা করেন, কিন্তু মুখ দেখাদেখি বন্ধ নয়। কারণ অনেক পরিবারেই বাপ মশাই, বেটা মসিয়োঁ।

দুসরা শরিক ভারতীয় অর্থাৎ পাঞ্জাব ফ্রন্টিয়ারের মুসলমান ও ১৯২১ সনের খেলাফৎ আন্দোলনের ভারতত্যাগী মুহাজিরগণ। এদের কেউ কেউ কাবুলী মেয়ে বিয়ে করেছেন বলে শ্বশুরবাড়ির সমাজের সঙ্গে এরা কিছু কিছু যোগাযোগ বাঁচিয়ে রেখেছেন।

তিসরা শরিক ইংরেজ, ফরাসী, জর্মন, রুশ ইত্যাদি রাজদূতাবাস। আফগানিস্থান ক্ষুদে গরীব দেশ। সেখানে এতগুলো রাজদূতের ভিড় লাগাবার কোনো অর্থনৈতিক কারণ নেই, কিন্তু রাজনৈতিক কারণ বিস্তর। ফরাসী জর্মন ইতালী তুর্ক সব সরকারের দৃঢ়বিশ্বাস, ইংরেজ-রুশের মোষের লড়াই একদিন না একদিন হয় খাইবারপাসে, নয় হিন্দুকুশে লাগবেই লাগবে। তাই দুদলের পাঁয়তারা কষার খবর সরজমিনে রাখার জন্য একগাদা রাজদূতাবাস।

তবু পয়লা শরিক আর দুসরা শরিকে দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয়। দুসরা শরিকের অধিকাংশই হয় কারবারি, নয় মাস্টার প্রোফেসর। দুদলের সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে থাকা অসম্ভব। কিন্তু পয়লা ও তেসরা ও দুসরা-তেসরাতে কখনো কোনো অবস্থাতেই যোগাযোগ হতে পারে না।

যদি কেউ করার চেষ্টা করে, তবে সে স্পাই।

মাত্র একটি লোক নির্ভয়ে কাবুলের সব সমাজে অবাধে গতায়াত করতেন। বগদানফ সায়েবের বৈঠকখানায় তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। নাম দোস্ত মুহম্মদ খান জাতে খাস পাঠান।

প্রথম দিনের পরিচয়ে শেকহ্যাণ্ড করে ইংরেজী কায়দায় জিজ্ঞেস করলেন, হাও ডু ইয়ু ডু?

দ্বিতীয় সাক্ষাৎ রাস্তায়। দূরের থেকে কাবুলী কায়দায় সেই প্রশ্নের ফিরিস্তি আউড়ে গেলেন, খুব হাস্তী, জোর হাস্তী ইত্যাদি, অর্থাৎ ভালো আছেন তো, মঙ্গল তো, সব ঠিক তো, বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েননি তো?

তৃতীয় সাক্ষাৎ তাঁর বাড়িরই সামনে। আমাকে দেখা মাত্র চিৎকার করে বললেন, বফরমাইদ, বফরমাইদ (আসুন আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক), কদমে তান মবারক (আপনার পদদ্বয়। পূতপবিত্র হোক), চশমে তান রওশন (আপনার চক্ষুদ্বয় উজ্জ্বলতর হোক), শানায়ে তান দরাজ (আপনার বক্ষস্কন্ধ বিশালতর হোক)

তারপর আমার জন্য যা প্রার্থনা করলেন সেটা ছাপালে এদেশের পুলিশ আমাকে জেলে দেবে।

আমি একটু থতমত খেয়ে বললুম, কি যা তা সব বলছেন?

দোস্ত মুহম্মদ চোখ পাকিয়ে তম্বী লাগালেন, কেন বলব না? আলবত বলব, এক শ বার বলব। আমি কি কাবুলের ইরানী বললেন, কী অসম্ভব বদমায়েশ! আর আমাকে বেকুব বানাবার কায়দাটা দেখলেন গর্ভস্রাবটার! শুধু তাই, নিত্য নিত্য আমাকে বেকুব বানায়।

তারপর মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে আপন মনেই বললেন, কিন্তু দাঁড়াও বাচ্চা, স্যাকরার ঠুকঠাক, কামারের এক ঘা। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওর পাঁচ বছরের মাইনে তিন শ টাকা আমার কাছে জমা আছে। সেই টাকাটা লোপাট মেরে রাইফেল কাঁধে করে একদিন পাহাড়ে উধাও হয়ে যাব; তখন যাদু টেরটি পাবেন।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, আপনি কলেজ যাবার সময় ঘরে তালা লাগান?

তিনি বললেন, একদিন লাগিয়েছিলুম। কলেজ থেকে ফিরে দেখি সে তালা নেই, আরেকটা পর্বতপ্রমাণ তালা তার জায়গায় লাগান। ভাঙ্গবার চেষ্টা করে হার মানলুম। ততক্ষণে পাড়ার লোক জমে গিয়েছে আগা আহমদের দর্শন নেই। কি আর করি, বসে রইলুম হী হী শীতে বারান্দায়। হেলে দুলে আগা আহমদ এলেন ঘণ্টাখানেক পরে। পাষণ্ড কি বলল জানো? ও তালাটা ভালো নয় বলে একটা ভালো দেখে তালা লাগিয়েছি। আমি যখন মার মার করে ছুটে গেলুম তখন শুধু বললো, কারো উপকার করতে গেলেই মার খেতে হয়।

আমি বললুম, তালা তা হলে আর লাগাচ্ছেন না বলুন।

কি হবে? আগা আহমদ আফ্রিদী, ওরা সব তালা খুলতে পারে। জানো, এক আফ্রিদী বাজী ফেলে আমীর হবীব উল্লার নিচের থেকে বিছানার চাঁদর চুরি করেছিল।

আমি বললুম, তালা যদি না লাগান তবে একদিন দেখবেন আগা আহমদ আপনার দামী রাইফেল নিয়ে পালিয়েছে।

দোস্ত মুহম্মদ খুশী হয়ে বললেন, তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি আছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি তো কাঁচা ছেলে নই। আগা আহমদের দাদা আমাকে আর বছরে ছ শ টাকা দিয়েছিল ওর জন্য দাও মত একটা ভালো রাইফেল কেনার জন্য। এটা সেই টাকায় কেনা কিন্তু আগা আহমদ জানে না। ও যদি রাইফেল নিয়ে উবে যায় তবে আমি তার ভাইকে তক্ষুণি চিঠি লিখে পাঠাব, তোমার ভ্রাতৃহস্তে রাইফেল পাঠাইলাম; প্রাপ্তি-সংবাদ অতি অবশ্য জানাই। তারপর দুই ভাইয়েতে–

আমি বললুম, সুন্দ-উপসুন্দের লড়াই।

দোস্ত মুহম্মদ জিজ্ঞাসা করলেন, রাইফেলের জন্য তারা লড়েছিল?

আমি বললুম, না, সুন্দরীর জন্য।

দোস্ত মুহম্মদ বললেন, তওবা! তওবা! স্ত্রীলোকের জন্য কখনো জব্বর লড়াই হয়? মোক্ষম লড়াই হয় রাইফেলের জন্য। রাইফেল থাকলে সুন্দরীর স্বামীকে খুন করে তার বিধবাকে বিয়ে করা যায়। উত্তম বন্দোবস্ত। সে বেহেস্তে গিয়ে হুরী পেল তুমিও সুন্দরী পেলে।

রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ভেবো না, লক্ষ্য করিনি যে, তুমি আমাকে আপনি বলছে। আর আমি তুমি বলে যাচ্ছি। কিন্তু বেশী দিন চালাতে পারবে না। সমস্ত আফগানিস্থানে আমাকে কেউ আপনি বলে না, ইস্তেক আগা আহমদ পর্যন্ত না।

টাঙ্গায় চড়বার সময় দাঁড়াও বলে ছুটে গিয়ে একখানা বই নিয়ে এসে আমার হাতে গুঁজে দিলেন। মন্তব্য প্রকাশ করলেন, ভালো বই, কর্সিকা আর আফগানিস্থানে একই রকম প্রতিশোধের ব্যবস্থা। চেয়ে দেখি কলঁবা।*

———-

* আগুনের ফুলকি নাম দিয়ে চারু বন্দ্যোপাধ্যায় অনুবাদ করেছেন।

সকল অধ্যায়

১. ০১. চাঁদনী থেকে শর্ট কিনে
২. ০২. গাঁয়ের পাঠশালার বুড়ো পণ্ডিতমশাই
৩. ০৩. সর্দারজী যখন চুল বাঁধতে
৪. ০৪. যতই বলি
৫. ০৫. পাঠান অত্যন্ত অলস এবং আড্ডাবাজ
৬. ০৬. আফগানিস্থান যেতে হলে
৭. ০৭. আরবী ভাষার প্রবাদ
৮. ০৮. খাইবারপাস তো দুঃখে-সুখে পেরলুম
৯. ০৯. আফগানিস্থানের অফিসার যদি কবি হতে পারেন
১০. ১০. সব কিছু পণ্ড না হলে পণ্ডিত হয় না
১১. ১১. মোটর ছাড়ল অনেক বেলায়
১২. ১২. ভোরের নমাজ শেষ হতেই
১৩. ১৩. ফ্রান্সের বেতারবাণী
১৪. ১৪. অরক্ষণীয়া মেয়ে
১৫. ১৫. খাজামোল্লা গ্রাম
১৬. ১৬. শো কেসে রবারের দস্তানা
১৭. ১৭. কাবুলে দুই নম্বরের দ্রষ্টব্য তার বাজার
১৮. ১৮. কাবুলের সামাজিক জীবন
১৯. ১৯. দোস্ত মুহম্মদ
২০. ২০. দরজা খাঁখাঁ করছে
২১. ২১. কাবুলের রাস্তাঘাট বাজারহাট
২২. ২২. মুইন-উস-সুলতানে
২৩. ২৩. যুবরাজ রাজা না হয়ে ছোট ছেলে কেন রাজা
২৪. ২৪. ভারতবর্ষের রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ
২৫. ২৫. রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ কানমন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন
২৬. ২৬. গ্রীষ্মকালটা কাটল ক্ষেত-খামারের কাজ দেখে
২৭. ২৭. শান্তিনিকেতন থেকে মৌলানা জিয়াউদ্দীন
২৮. ২৮. হেমন্তের কাবুল
২৯. ২৯. শীতের দুমাসের ছুটি
৩০. ৩০. ফিরে দেখি সর্বত্র বরফ
৩১. ৩১. শীত আর বসন্ত ঘরে বসে
৩২. ৩২. বক্তৃতা দেবার বদ অভ্যাস
৩৩. ৩৩. এক অপরূপ মূর্তি
৩৪. ৩৪. এমন সময় যা ঘটল
৩৫. ৩৫. জনমানবহীন রাস্তা
৩৬. ৩৬. বাঘ হতে ভয়ঙ্কর অরাজক দেশ
৩৭. ৩৭. দৈনিক বুলেটিন
৩৮. ৩৮. আফগান প্রবাদ
৩৯. ৩৯. আমান উল্লা কাফির
৪০. ৪০. ফরাসডাঙার জরিপেড়ে ধুতি
৪১. ৪১. অন্তহীন মহাকাল ভ্যাজর ভ্যাজর
৪২. ৪২. শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়
৪৩. ৪৩. পরিশিষ্ট – গুরুদেব রচিত মৌলানা জিয়াউদ্দিন কবিতা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন