২২. মুইন-উস-সুলতানে

সৈয়দ মুজতবা আলী

আগেই বলেছি, আমার বাসা ছিল কাবুল থেকে আড়াই মাইল দূরে–সেখান থেকে আরো মাইল দুই দূরে নূতন শহরের পত্তন হচ্ছিল। সেখানে যাবার চওড়া রাস্তা আমার বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গিয়েছে। অনেক পয়সা খরচা করে অতি যত্নে তৈরী রাস্তা। দুদিকে সারি-বাঁধা সাইপ্রেস গাছ, স্বচ্ছ জলের নালা, পায়ে চলার আলাদা পথ, ঘোড়সোয়ারদের জন্যও পৃথক বন্দোবস্ত।

এ রাস্তা কাবুলীদের বুলভার। বিকেল হতে না হতেই মোটর, ঘোড়ার গাড়ি, বাইসিকেল, ঘোড়া চড়ে বিস্তর লোক এ রাস্তা ধরে নূতন শহরে হাওয়া খেতে যায়। হেঁটে বেড়ানো কাবুলীরা পছন্দ করে না। প্রথম বিদেশী ডাক্তার যখন এক কাবুলী রোগীকে হজমের জন্য বেড়াবার উপদেশ দিয়েছিলেন তখন কাবুলী নাকি প্রশ্ন করেছিল যে, পায়ের পেশীকে হয়রান করে পেটের অন্ন হজম হবে কি করে?

বিকেলবেলা কাবুল না গেলে আমি সাইপ্রেস সারির গা ঘেঁষে ঘেঁষে পায়চারি করতুম। এসব জায়গা সন্ধ্যার পর নিরাপদ নয় বলে রাস্তায় লোক চলাচল তখন প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেত।

এক সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরছি তখন একখানা দামী মোটর ঠিক আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। স্টিয়ারিঙে এক বিরাট বপু কাবুলী ভদ্রলোক, তার পাশে মেমসায়েবের পোষাকে এক ভদ্রমহিলা হ্যাটের সামনে ঝুলানো পাতলা পর্দার ভিতর দিয়ে যেটুকু দেখা গেল তার থেকে অনুমান করলুম, ভদ্রমহিলা সাধারণ সুন্দরী নন।

নমস্কার অভিবাদন কিছু না, ভদ্রলোক সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন, ফার্সী বলতে পারেন?

আমি বললুম, অল্প স্বল্প।

দেশ কোথায়? হিন্দুস্থান।

তখন ফার্সী ছেড়ে ভদ্রলোক ভুল উর্দুতে, কিন্তু বেশ স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রায়ই আপনাকে অবেলায় এখানে দেখতে পাই। আপনি বিদেশী বলে হয়ত জানেন না যে, এ জায়গায় সন্ধ্যার পর চলাফেরা করাতে বিপদ আছে।

আমি বললুম, আমার বাসা কাছেই।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি করে হয়? এখানে তো অজ পাড়াগাঁ–চাষাভুষোরা থাকে।

আমি বললুম, বাদশা এখানে কৃষিবিভাগ খুলেছেন— আমরা জনতিনেক বিদেশী এক সঙ্গে এখানেই থাকি।

আমার কথা ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে ফার্সীতে তর্জমা করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি হাঁ, না, কিছুই বলছিলেন না।

তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কাবুল শহরে দোস্ত-আশনা নেই? একা একা বেড়ানোতে দিল হায়রান হয় না। আমার বিবি বলছিলেন, বাচ্চা গম্ মীখুরদ–ছেলেটার মনে সুখ নেই। তাইতে আপনার সঙ্গে আলাপ করলুম। বুঝলুম, ভদ্রমহিলার সৌন্দর্য মাতৃত্বের সৌন্দর্য। নিচু হয়ে আদাবতসলিমা জানালুম।

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, টেনিস খেলতে পারেন?

হাঁ।

তবে কাবুলে এলেই আমার সঙ্গে টেনিস খেলে যাবেন।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, অনেক ধন্যবাদ কিন্তু আপনার কোর্ট কোথায়, আপনার পরিচয়ও তো পেলুম না।

ভদ্রলোক প্রথম একটু অবাক হলেন। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, আমি? ওঃ, আমি? আমি মুইন-উস্‌-সুলতানে। আমার টেনিস-কোর্ট ফরেন অফিসের কাছে। কাল আসবেন। বলে আমাকে ভালো করে ধন্যবাদ দেবার ফুসৎ না দিয়েই মোটর হাঁকিয়ে চলে গেলেন।

এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি, মোটরের প্রায় বিশ গজ পিছনে দাঁড়িয়ে আমার ভৃত্য আবদুর রহমান অ্যারোপ্লেনের প্রপেলারের বেগে দুহাত নেড়ে আমাকে কি বোঝাবার চেষ্টা করছে। মোটর চলে যেতেই এঞ্জিনের মত ছুটে এসে বলল, মুইন-উস্‌-সুলতানে, মুইন-উস্‌-সুলতানে।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, লোকটি কে বটেন?

আবদুর রহমান উত্তেজনায় ফেটে চৌচির হয় আর কি। আমি যতই জিজ্ঞাসা করি মুইন-উ-সুলতানে কে, সে ততই মন্ত্রোচ্চারণের মত শুধু বলে, মুইন-উস-সুলতানে, মুইন-উস-সুলতানে। শেষটায় নৈরাশ্য, অনুযোগ, ভর্ৎসনা মিশিয়ে বলল, চেনেন না, বরাদরে-আলা-হজরত, বাদশার ভাই,–বড় ভাই। আপনি করেছেন কি? রাজবাড়ির সকলের হাতে চুমো খেতে হয়।

আমি বললুম, রাজবাড়িতে লোক সবশুদ্ধ কজন না জেনে তো আর চুমো খেতে আরম্ভ করতে পারিনে। সক্কলের পোষাবার আগে আমার ঠোঁট ক্ষয়ে যাবে না তো?

আবদুর রহমান শুধু বলে, ইয়া আল্লা, ইয়া রসুল, করেছেন কি, করেছেন কি

আমি জিজ্ঞেস করলুম, তা উনি যদি রাজার বড় ভাই-ই হবেন তবে উনি রাজা হলেন না কেন?

আবদুর রহমান প্রথম মুখ বন্ধ করে তার উপর হাত রাখল, তারপর ফিসফিস করে বলল, আমি গরীব তার কি জানি; কিন্তু এসব কথা শুধোতে নেই।

সে রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর আবদুর রহমান যখন ঘরের এক কোণে বাদামের খোসা ছাড়াতে বসল তখন তার মুখে ঐ এক মুইন-উস-সুলতানের কথা ছাড়া অন্য কিছু নেই। দুতিনবার ধমক দিয়ে হার মানলুম। বুঝলুম, সরল আবদুর রহমান মনে করেছে, আফগানিস্থান যখন কাকামামাশালার দেশ, অর্থাৎ বড়লোকের নেকনজর পেলে সব কিছু হাসিল হয়ে যায় তখন আমি রাতারাতি উজীরনাজির কেউ-কেটা, কিছু-না-কিছু একটা, হয়ে যাবই যাব।

ততক্ষণে অভিধান খুলে দেখে নিয়েছি মুইন-উস্‌-সুলতানে সমাসের অর্থ যুবরাজ।

যুবরাজ রাজা হলেন না, হলেন ছোট ভাই। সমস্যাটার সমাধান করতে হয়।

সকল অধ্যায়

১. ০১. চাঁদনী থেকে শর্ট কিনে
২. ০২. গাঁয়ের পাঠশালার বুড়ো পণ্ডিতমশাই
৩. ০৩. সর্দারজী যখন চুল বাঁধতে
৪. ০৪. যতই বলি
৫. ০৫. পাঠান অত্যন্ত অলস এবং আড্ডাবাজ
৬. ০৬. আফগানিস্থান যেতে হলে
৭. ০৭. আরবী ভাষার প্রবাদ
৮. ০৮. খাইবারপাস তো দুঃখে-সুখে পেরলুম
৯. ০৯. আফগানিস্থানের অফিসার যদি কবি হতে পারেন
১০. ১০. সব কিছু পণ্ড না হলে পণ্ডিত হয় না
১১. ১১. মোটর ছাড়ল অনেক বেলায়
১২. ১২. ভোরের নমাজ শেষ হতেই
১৩. ১৩. ফ্রান্সের বেতারবাণী
১৪. ১৪. অরক্ষণীয়া মেয়ে
১৫. ১৫. খাজামোল্লা গ্রাম
১৬. ১৬. শো কেসে রবারের দস্তানা
১৭. ১৭. কাবুলে দুই নম্বরের দ্রষ্টব্য তার বাজার
১৮. ১৮. কাবুলের সামাজিক জীবন
১৯. ১৯. দোস্ত মুহম্মদ
২০. ২০. দরজা খাঁখাঁ করছে
২১. ২১. কাবুলের রাস্তাঘাট বাজারহাট
২২. ২২. মুইন-উস-সুলতানে
২৩. ২৩. যুবরাজ রাজা না হয়ে ছোট ছেলে কেন রাজা
২৪. ২৪. ভারতবর্ষের রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ
২৫. ২৫. রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ কানমন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন
২৬. ২৬. গ্রীষ্মকালটা কাটল ক্ষেত-খামারের কাজ দেখে
২৭. ২৭. শান্তিনিকেতন থেকে মৌলানা জিয়াউদ্দীন
২৮. ২৮. হেমন্তের কাবুল
২৯. ২৯. শীতের দুমাসের ছুটি
৩০. ৩০. ফিরে দেখি সর্বত্র বরফ
৩১. ৩১. শীত আর বসন্ত ঘরে বসে
৩২. ৩২. বক্তৃতা দেবার বদ অভ্যাস
৩৩. ৩৩. এক অপরূপ মূর্তি
৩৪. ৩৪. এমন সময় যা ঘটল
৩৫. ৩৫. জনমানবহীন রাস্তা
৩৬. ৩৬. বাঘ হতে ভয়ঙ্কর অরাজক দেশ
৩৭. ৩৭. দৈনিক বুলেটিন
৩৮. ৩৮. আফগান প্রবাদ
৩৯. ৩৯. আমান উল্লা কাফির
৪০. ৪০. ফরাসডাঙার জরিপেড়ে ধুতি
৪১. ৪১. অন্তহীন মহাকাল ভ্যাজর ভ্যাজর
৪২. ৪২. শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়
৪৩. ৪৩. পরিশিষ্ট – গুরুদেব রচিত মৌলানা জিয়াউদ্দিন কবিতা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন