হরার স্টোরি – মনোজ সেন

মনোজ সেন

আমাদের প্রস্তাব শুনে আমাদের ক্লাবের একমাত্র সদস্য মুকুল গাঙ্গুলী বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর চিন্তিতমুখে প্রশ্ন করল, ‘হরার স্টোরি বলতে তোমরা কী বোঝো?’

অন্যতম সদস্য নিরঞ্জন তার চশমা ঠিক করতে করতে বলল, ‘হরার স্টোরি বলতে আমি বা বুঝি তা হল, এমন কোনো ঘটনা বা অভিজ্ঞতার গল্প যা আতঙ্কে আমাদের ভীত এবং সন্ত্রস্ত করে তোলে আর আমাদের শান্তিতে বেঁচে থাকার ব্যাপারে সন্দিহান করে তোলে।’

‘যথা?’

‘যেমন ধরো, একদিন এই ক্লাবের একজন মেম্বার, হয়তো ওই ভেতো বা প্রভাত সান্যাল এসে আমাদের বলল যে, গতকাল সে যখন সন্ধেবেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল, তখন ট্রামরাস্তা থেকে আমাদের গলিতে ঢুকে দেখে যে নবীনবাবুর সুন্দরী ছোটোমেয়ে বান্টি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার লোক চলাচল দেখছে। নীচের থেকেই ভেতো সবে বান্টির সঙ্গে বেশ ইনিয়েবিনিয়ে আমড়াগাছি শুরু করেছিল, এমন সময় হঠাৎ নবীনবাবুর বাড়ির উলটো দিকের সরু গলিটা থেকে কুচকুচে কালো প্রকাণ্ড লম্বা একটা লোক হুস করে বেরিয়ে এনে বান্টিকে বারান্দা থেকে উঠিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে কড়মড়িয়ে খেয়ে ফেলল। আর তারপরেই আবার হুস করে গলিতে ঢুকে গেল।

‘এই গল্পটা, আমার মতে একটা হরার স্টোরি বা আতঙ্ক-কাহিনি। এখন দেখ, এই গল্পটা আমাদের ভীত আর সন্ত্রস্ত করে তোলে আর আমাদের নিরাপত্তা ও শান্তিতে বেঁচে থাকার ব্যাপারে সন্দিগ্ধ করে তোলে। ঠিক কি না?’

ফিক করে হেসে মুকুল বলল, ‘তুমি খুব সংক্ষেপে একটা বেশ ভয়াবহ আতঙ্ক-কাহিনি বলেছ আর, নিতান্ত অবাস্তব আর অবিশ্বাস্য হলেও, খুব ভালো বলেছ। তবে, আমার অভিজ্ঞতায়ও একটা ঘটনা আছে, সেটা গল্পই বলো আর যাই বলো, অত সুন্দর আর সংক্ষিপ্ত হয়তো হবে না। তাও বলছি। ঘটনাটা এমনভাবে ঘটেছিল যা আমি কোনোদিন স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। এই ভয়ংকর ঘটনার অভিঘাতের ফলে আমি এখনও মাঝে মাঝে রাত্রে ঘুমোতে পারি না। আর এই যন্ত্রণা থেকে আমি জীবনেও আর কোনোদিন যে বেরিয়ে আসতে পারব তাও তো মনে হচ্ছে না। যাই হোক, গল্পটা বলছি।’

আমরা অবাক হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নীরবে ঘাড় নাড়লুম।

***

একটু চুপ করে থেকে মুকুল বলতে শুরু করল, ‘মৃগাঙ্ক মাইতি আমার বহুদিনের বন্ধু। মৃগাঙ্কর বাবা অ্যাডভোকেট নবকৃষ্ণ মাইতি কলকাতা পুলিশ কোর্টের একজন নামজাদা উকিল ছিলেন। মৃগাঙ্কর পরিবার ছিল মেদিনীপুরের ওরান্দা অঞ্চলের জমিদার বা ওইরকম কিছু। কিন্তু ব্যাবসাসূত্রে মধ্য কলকাতার পোস্তা অঞ্চলের অনেক দিনের বাসিন্দা, প্রায় বন কেটে বসত যাকে বলে।

‘আমার মামাবাড়িও ছিল পোস্তায়। মৃগাঙ্কদের বাড়ির প্রায় সমবয়সি আর ঠিক পেছনে। দুটো বাড়ির সামনের সদর দরজা ছিল দুটো পাশাপাশি গলির ওপরে। একটা হরিমোহন দাঁ লেন, অন্যটা নীলকৃষ্ণ বসাক স্ট্রিট। মাঝখানে একটা পাঁচিল ছিল। একবাড়ি থেকে অন্যবাড়িতে যেতে বেশ অনেকটা ঘুরে যেতে হত। এসব সত্ত্বেও দুই পরিবারের মধ্যে হৃদ্যতার কোনো অভাব ছিল না। তিনতলার ছাদ দুটো খুব কাছাকাছিই ছিল। রোজ রোদ পড়লে, দুই বাড়ির কাকাবাবু কাকিমারা আর মেশোমশাই মাসিমাদের উচ্চকিত হাসি আর ইটের চওড়া রেলিঙের ওপরে রাখা চা সহযোগে তুমুল আড্ডা শুরু হত। চলত প্রায় নীচের গলিতে রাস্তার আলো জ্বলে ওঠা পর্যন্ত।’

আমি বললুম, “তা কী করে হবে? একটা বাড়ির পেছনে তো দশ ফুট জায়গা ছাড়তে হয়। তা হলে তো তোমার মামাবাড়ি আর তোমার বন্ধুর বাড়ির দূরত্ব কুড়ি ফুট হতে হয়। এত দূর থেকে কি আড্ডা হতে পারে?’

‘আহা, একি তোমার আজকালকার নতুন বাড়ি নাকি? দুটোরই তো তখনই দেড়-শো থেকে দু-শো বছর বয়েস। তখন কি মিউনিসিপ্যালিটি ছিল, না তার আইনকানুন ছিল? যে যেমন খুশি বাড়ি বানাত। তাই, দুটো বাড়িরই পেছনে দশ ফুট নয়, আড়াই ফুট বা মেরেকেটে তিনফুট জমি ছাড়া ছিল। ওটাকে বলা হত ব্যাক-প্যাসেজ। কাজেই, পাঁচ বা ছ-ফুটের দূরত্বে বেশ ভালোই আড্ডা হত। শুধু আড্ডা কেন, চাই কী প্রেমালাপ করতেও কোনো অসুবিধে হত না।

‘সে যাই হোক, আমার বাবা হৃষিকেশ গাঙ্গুলী রেলে চাকরি করতেন। আর, আমার মা আমি যখন খুবই ছোটো তখন মারা যান। বাবার বদলির চাকরি ছিল। যাতে আমার পড়াশুনোয় কোনো ছেদ বা ব্যাঘাত না ঘটে, সেইজন্যে তিনি আমাকে মামাবাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। তাই, আমার স্কুল জীবনের বেশিরভাগটা ওখানেই কাটাতে হয়েছিল। আমার নিঃসন্তান বড়োমামি আর বড়োমামা, দু-জনেই তখন সবে মধ্য-যৌবনে পা রেখেছেন, আমাকে সাদরে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আমার বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিটা কোনোদিন বুঝতে দেননি। আমি তো আমার বড়োমামিকে তাঁর শেষদিনটি পর্যন্ত বড়োমা বলে ডাকতুম। এঁরা দু-জনেই আমার বাবার থেকে সামান্য ছোটো। মারা যাওয়ার সময় তাঁরা দু-জনেই যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়েছিলেন।

‘আমি আর মৃগাঙ্ক একসঙ্গে শিয়ালদার কাছে একটি খ্রিস্টান মিশনারিদের স্কুলে ক্লাস টু-তে ভরতি হয়েছিলুম। ওই স্কুল থেকেই ন-বছর বাদে আমরা স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষা পাশ করি । সেই পর্যন্ত আমরা ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলুম। পাশ করে আমি গেলুম আর্টসে আর মৃগাঙ্ক গেল সায়েন্স হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। কলেজ আলাদা হয়ে গেল। আমিও ছাত্র-রাজনীতির কাজকর্মে ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়লুম। কিছুদিন পরে বাবা রিটায়ার করে কাঁচরাপাড়ায় বাড়ি করে চলে এলেন। আমি তখন মামাবাড়ির আশ্রয় ছেড়ে বাবার কাছে চলে এলুম। পড়াশুনোর পাট যখন চুকে গেল, তখন অধ্যাপনা আর রাজনীতিতে পুরোপুরি যোগ দিয়ে শুরু হল প্রবল কাজের চাপ। ফলে, পোস্তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা ফিকে হতে শুরু করল।

করোনা অতিমারি শুরু হবার বছর খানেক আগে ভারত সরকার ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসে তিনবছরের জন্য একটা রাজনৈতিক কাজে পাঠালেন। সেখানেই খবর পেলুম যে বড়োমা আর বড়োমামা কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাঁদের তখন অনেক বয়েস হয়েছিল। ফলে, আমি খুব একটা বিচলিত হয়নি। তা ছাড়া তখন আমেরিকাতেও কোভিডের তাণ্ডব নৃত্য চলছে। সকলেই প্রায় গৃহবন্দি। আমি যে দেশে আসব সেই উপায়ও নেই। কাজেই, ঘরে বসে অশ্রুবিসর্জন করা ছাড়া অন্য কিছু করবার ছিল না।

‘আর একটা খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, মাইতিরা বাড়ি তালাবন্ধ করে তাঁদের দেশ ওরান্দায় চলে গেছেন। সেইজন্যে বড়োমা আর বড়োমামার মারা যাবার খবরটা পেতে বাবার একটু সময় লেগেছিল। সেটা তো হতেই পারে। আমার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি।

‘২০২২ সালে বাবা দেহরক্ষা করবার খবর পেয়ে আমি দেশে ফিরে আসি। সেই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা দপ্তরের অনুরোধে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ব্যাপারে গোপনে অনুসন্ধান চালানোর জন্যে আমাকে শান্তিনিকেতনে যেতে হয়। ওখানে সপরিবারে থাকবার জন্যে প্রান্তিকপল্লীতে তিনটে শোবার ঘরওয়ালা দোতলার একটি ফ্ল্যাটে আশ্রয় পাওয়া গিয়েছিল।

ততদিনে মৃগাঙ্ক স্মৃতির পাতায় ছবি হয়ে গেছে।

‘শান্তিনিকেতনে আসবার তিন-চার দিন বাদে এক রোববারের সকালে আমরা সেজেগুজে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আড্ডা মারতে যাব বলে তৈরি হচ্ছি, হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। ফোনের ওপার থেকে একটা মোটা গলা শোনা গেল, “আমি মৃগাঙ্ক বলছি।”

আমি উত্তেজিত হয়ে বললুম, “মৃগাঙ্ক, মানে পোস্তা মৃগাঙ্ক?”

“হ্যাঁ, তাই বটে। তোকে কাল দেখলুম অভিনব এম্পোরিয়াম থেকে কীসব কিনে বেরোচ্ছিস। সঙ্গে একজন মহিলা। বোধ হয় তোর স্ত্রী হবেন। অভিনবর মালিক নিতাই ঘোষের কাছে তোর নম্বর পেলুম।”

‘বেশ, এখন শোন, আজ সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে চলে আয়। প্রান্তিক পল্লীতে। ঠিকানাটা লিখে নে।’

***

“মৃগাঙ্ক একাই এল। স্বাস্থ্য অটুট, সোজা হয়ে দাঁড়ায়, গটগট করে হাঁটে, আমার মতো বুড়ো হয়ে পড়েনি।

‘একথা-সেকথার পর মৃগাঙ্ক বলল, “তোর বড়োমা আর বড়োমামার মারা যাওয়ার খবরটা যে তুই পেয়েছিস, সেটা আমি জানি। আমিই তোর বাবাকে জানিয়েছিলুম। তুই তখন বিদেশে ছিলি। এখন, তোর বড়োমামা, মানে আমার বরেন জ্যাঠামশাই আর বিজয়া জ্যেঠিমা কীভাবে মারা গিয়েছিলেন, সেটা তোর বাবা বোধ হয় তোকে বিস্তারিতভাবে জানাননি।”

‘আমি বললুম, ওঁরা কোভিডে মারা গেছেন, এইটুকুই জানিয়েছিলেন। আর বেশি কিছু জানাবার ছিল কি?

“মৃগাঙ্ক মাথা নীচু করে বলল, “ছিল। অনেক কিছু ছিল। সেসব কথা তোকে জানানো উচিত কি না, সে বিষয়ে আমার মনে সন্দেহ ছিল। কাল তোকে দেখে মনে হল, তুই বুড়োটে চেহারা সত্ত্বেও বেশ শক্তপোক্তই আছিস। তোকে বললে, তুই ঝটকাটা নিতে পারবি।”

‘বললুম, বাজে ভনিতা রেখে আসল কথাটা বল।

‘মৃগাঙ্ক একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, “তবে শোন।”

***

“তুই তো জানিস, কলকাতায় করোনা ভাইরাস আসে বোধ হয় ২০২০-র মার্চের গোড়ার দিকে আর সেটা অতিমারীর রূপ নেয় ২০২১-এ। তখন, সে কী এক ভয়াবহ অবস্থা! প্রত্যেকদিন হাজার হাজার লোক আক্রান্ত হচ্ছে, মাছির মতো লোক মারা যাচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় মুখোশ পরা আতঙ্কিত লোকেরা পরস্পর পরস্পরকে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলছে। ছেলেরা তাদের বাবা-মাদের বাড়ি থেকে বেরুতে যথাসাধ্য বাধা দিচ্ছে আর বাবা-মারাও ছেলেমেয়েদের বাড়ির ভেতরে আটকে রাখার সবরকম চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সে সব দিনের কথা তোর নিশ্চয়ই মনে আছে।”

“আমি বললুম— আমার খুব ভালোই মনে আছে। ওসব আর মনে করিয়ে দিস না।

‘মৃগাঙ্ক মাথা নীচু করে বলে চলল, “করোনা যখন অতিমারীর রূপ নিয়েছে সেই সময়ে হঠাৎ একদিন বরেন জ্যাটার ফোন পেলুম। জানা গেল, বরেন জ্যাঠা তখন ওঁদের বাড়িতে থাকতে একটু ভয় পাচ্ছেন। তার কারণ, ওর ছোটোভাই সুরেনকাকা গুজরাটে গিয়েছিলেন ছেলের কাছে, সেখানে গিয়ে আটকে পড়েছেন আর ওঁর মেয়ে মানু, মানে আমাদের মনীষাদি, তখন আমেরিকায়। কাজেই, ওঁদের দোতলা বাড়িটা রাত্রে প্রায় খালি। থাকার মধ্যে আছে ওঁদের তিনজন কাজের লোক আর প্রাগৈতিহাসিক দরওয়ান রাজু সিং। কিন্তু, তারা থাকে বাড়ির বাইরে সামনে জমিতে দু-পাশে দুটো অ্যাসবেস্টসের ঘরে। তুই তো জানিস, রাজুকে বরেন জ্যাঠার পরিবার সবচেয়ে বিশ্বাসী আর নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করত।

“বরেন জ্যাঠার ভয় পাবার প্রথম কারণ হল, রাজু দশদিনের জন্যে দেশে চলে গেছে ওর বড়ো ছেলে, যে মজঃফরপুরে একটা ছোটো ফ্যাক্টরিতে সুপারভাইসারের কাজ করত, করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। সেখানেই সে মারা গিয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, বাড়িতে বাকি তিনজন যারা আছে, তাদেরও হাবভাব জ্যাঠার ভালো লাগছিল না। কেমন একটা আনমনা ভাব, মনে হচ্ছিল যেন একটু এদিক-ওদিক কিছু হলে তারাও পালাবে। তৃতীয় কারণ, বাড়িতে যদি তাঁরা দু-জন ছাড়া আর কেউ না থাকে, তাহলে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার কী হবে। জ্যেঠিমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। জ্যাঠামশাই ওঁকে বাড়িতে একা রেখে যেতে পারবেন না। দু-জনে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আরও একটা কারণও ছিল, কিন্তু সেটা বরেন জ্যাঠা ভাবেননি। ভাবা উচিত ছিল।

“আমি বরেন জ্যাঠাকে বার বার বলেছিলুম যে ওঁদের ও বাড়িতে থাকার কোনো দরকার নেই। পত্রপাঠ ওঁরা যেন কাজের লোকেরা পালাবার আগেই আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। এতে কারোরই কোনো অসুবিধে হবে না। যদি কোনোদিন আমাদেরও পালাতেই হয়, আমরা না-হয় তখন একসঙ্গেই পালাব। আমাদের গ্রামের বাড়িটাতো আছেই। সেখানে অন্তত থাকবার জায়গার কোনো অভাব নেই। বরেন জ্যাঠা কিন্তু কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন যে, যদি সুরেন কাকা ফিরে আসেন, তখন তিনি আবার খালি বাড়িতে থাকবেন নাকি? তা হতে পারে না। অতএব, সুরেন কাকা না-ফেরা পর্যন্ত তাঁরা বাড়ি থেকে কোথাও যাবেন না। তারপর তিনি আমাকে বললেন, তুই শুধু আমাদের বাজারটা করে দে। তাহলেই হবে। আর বললেন, তুই ব্যাপারটা গগনবাবুর ছেলে সহদেবকে জানিয়ে রাখ। ও-ই আমাদের লক ডাউনের সময় এ পাড়ার লোকেদের দেখাশুনো করছে। ওকে আমার কথা বলিস?”

“গেলুম সহদেবদার কাছে। এলাকার একজন করিতকর্মা লোক বলে ওঁকে চিনতুম। দেখি, গলির মুখে কিছুটা অন্তর সারি দিয়ে চেয়ার পেতে পাড়ার মাতব্বররা আর কমবয়সি ছেলেরা বসে রয়েছে। যেন, পাহারা দিচ্ছে যাতে কোনো উটকো লোক গলিতে ঢুকে পড়তে না পারে। অফিস, স্কুল সব বন্ধ। এই অপ্রত্যাশিত ছুটিতে কিন্তু কারোর মুখেই হাসি নেই। বরং একটা ভয় ভয় ভাব।

“আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে পাহারাদারদের মধ্যে থেকে সহদেবদা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “কিরে মিঙ্কু, তুই এখানে? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো?”

“আমি বললুম, আমাদের সব ঠিকই আছে সহদেবদা। আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন বরেন জ্যাঠামশাই। তোমার একটা অনুমতি নেবার আছে।

“বলামাত্র চেয়ার পেতে বসে থাকা মাতব্বরদের একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, ‘এক মিনিট দাঁড়াও, ছোকরা। তোমার বরেন জ্যাঠামশাই নিজে না এসে একটা বেপাড়ার বাজে ছেলেকে পাঠালেন কেন? আমাদের সঙ্গে কথা বললে কি তাঁর গায়ে ফোসকা পড়ত? না কি, তোমার বরেন জ্যাঠামশাই নিজে আসাটা তাঁর পক্ষে অসম্মানজনক হবে বলে মনে করছেন?’

“এই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে আমি ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। খিটখিটে, বদমেজাজী, ঝগড়াটে, সব ব্যাপারে ব্যাগড়া দেওয়া তার স্বভাব। উনি ওখানে বসে আছেন দেখলে আমি হয়তো সহদেবদার সঙ্গে তখন কথাই বলতুম না।”

“আমি বললুম, কে বলতো? ওই শচীনন্দন কাঞ্জীলাল নয়তো?

“হ্যাঁ, ও-ই। তোর মনে আছে দেখছি। নামটা পর্যন্ত।”

‘মনে আছে মানে? ওইরকম একটা মালকে ভোলা যায় নাকি? চোখে যেন সবসময় একটা কালোচশমা এঁটে বসে রয়েছে। সব খারাপ, সব বাজে, সবাই চোর, সবাই ঠক, সবাই মিথ্যেবাদী। যারা জীবনে উন্নতি করেছে তারা সবাই ঘরের বউ বেচে করেছে। যারা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে, ছেলে হলে তারা টাকা ঘুষ দিয়ে আর মেয়ে হলে দুর্নীতি করে হেড একজামিনারের সঙ্গে শুয়ে করেছে। কেন, আমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার পর ওই মহাপ্রভু কি বলেছিল তোর মনে নেই? ওরা বড়োলেকের ছেলে, ভালো রেজাল্ট তো করবেই। আমাদের ছেলেপেলেরা ভালো রেজাল্ট করবে কোত্থেকে? অত কাঁচা পয়সা পাবে কোথায়?

“মৃগাঙ্ক বলল, যা বলেছিস। আর কথায় কথায় বলত, আমি বাপু সবসময় সাদা কে সাদা আর কালো কে কালো বলি। কোনো শালাকে ভয় পাই না আমি। আসলে কী জানিস? বেশিরভাগ লোকের ভদ্রতাবোধকে এরা মনে করে দুর্বলতা। একজন ভদ্রলোককে মুখের ওপর যা খুশি তাই বলে তাঁকে আচ্ছাসে অপমান করলুম, কোনো প্রতিবাদ শুনতে হল না-এটা তারা নিজেদের একটা বিরাট বীরত্ব বলে মনে করে। আমি তো জানি, এরা কেঁচোর চেয়েও ভীতু। সময়মতো ঘাড়ে একটা প্রমাণ সাইজের রদ্দা এসে পড়লে কোনো শালাকে ভয় না পাওয়া বেরিয়ে যায়। এতদিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বহু রকমের লোকের সংস্পর্শে এসে আমার এই বোধোদয়টা হয়েছে।”

‘দেখলুম, মৃগাঙ্ক তখনও খুব উত্তেজিত হয়ে আছে। বললুম – ওই বরাহ নন্দনের কথা বাদ দে। তোর কথাটা শেষ কর।

“মৃগাঙ্ক মুখের ওপর হাত বুলিয়ে বলল – হ্যাঁ, যা বলছিলুম। আমি আর কথা বাড়াবার আগেই সহদেবদা আমার হাত ধরে টেনে ওখান থেকে সরিয়ে দিলেন। বললেন— এখানে নয়। বড়োরাস্তায় চল। সেখানে কথা হবে। পেছন থেকে শুনলুম তোর বরাহনন্দন চ্যাচাচ্ছেন— বড়োরাস্তাই যাও আর জাহান্নামেই যাও, আমাদের কাছে এসে হাতজোড় করে অনুরোধ না করলে ওই ঘোষালবাড়িতে কোনো বাজার যাবে না, এই কথা বলে দিলুম। আমরা কিছু ফ্যালনা লোক নই, এই কথা বরেন ঘোষালকে জানিয়ে দিয়ো।

“বড়োরাস্তায় এসে সহদেবদা আমাকে বললেন— তুই কথাটা ওই বুড়োর সামনে বলতে গেলি কোন আক্কেলে? এখন তো সব ভেস্তে গেল। আমরা লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে লোকটা আমাদের জান নিকলে দেবে। কী করবি এখন?

“বললুম— দেখি। কিছু একটা করতে হবে। তবে যাই করি, তোমাকে বিপদে ফেলব না।

***

“বরাহনন্দনের কথা শুনতে শুনতেই একটা প্ল্যান করে ফেলা গিয়েছিল। বাড়ি ফিরেই কাজে লেগে গেলুম। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হল আমার ছোটোভাই শঙ্কু মানে শশাঙ্ক। সেদিনের আমার অভিজ্ঞতার কথা বাবাকে বললুম, কিন্তু বরেন জ্যাঠামশাইকে আর কিছু বললুম না। শুধু বললুম, এই সময়ে কাউকে বাজার করে দিতে বলাটা সমীচীন হবে না। আমাদের বাড়িতে তো বাজার হচ্ছেই, রান্নাও হচ্ছে। তার থেকেই দু-জনের মতো খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে আপনাকে পৌঁছে দেব। সেই খাবার রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। তাই, আকাশপথে আপনাদের বাড়িতে খাবার চলে যাবে। বরেন জ্যাঠা কি বুঝলেন জানি না। ফোনের ওপাশে ক্ষীণ গলা শুনলুম— যা ভালো বুঝিস, কর।

“এইবার আমাদের বাড়ির ছাদের এক কোনায় একটা ফুট দশেক লম্বা বাঁশ দাঁড় করানো ছিল রেডিয়োর অ্যানটেনা লাগানোর জন্যে। তখন তো কেউ আর রেডিয়ো শুনত না। তাই, বাঁশটা বেকার হয়ে গিয়েছিল। সেটাকে নামিয়ে ফেললুম। আমাদের বাড়ির সিঁড়ির নীচে দুটো বড়ো বড়ো মাছ ধরার ছিপ আর কাপড় শুকোনোর সরু কিন্তু শক্ত দড়ি ছিল। সেগুলো আর রান্নাঘর থেকে একটা উঁচু টুল নিয়ে চলে গেলুম ছাদে।’

“বাবা আর মা আমার পেছন পেছন ছাদে এলেন। ওঁদের সব কথা সবিস্তারে বলাই ছিল। দেখি, বাবা আমাদের কাজ দেখতে ছাদে একটা চেয়ার পেতে ছাতা মাথায় বসে গেছেন।

“প্রথমে, বাঁশটার একদিকে একটা কপিকল লাগিয়ে অন্যদিকে ছিপের হুইলটা বেঁধে ফেলা হল। এই কপিকল আর হুইলের মাঝে বাঁশের গায়ে একফুট ছেড়ে ছেড়ে ছবি টাঙানোর হুক গেঁধে দিয়ে, সেগুলোর ভেতর দিয়ে একটা শক্ত দড়ি হুইল থেকে কপিকল পর্যন্ত চালিয়ে দেওয়া হল। এখন বাঁশটা একটা অতিকায় ছিপে পরিণত হল। সেটা উঁচু টুলটার ওপরে তুলে এমনভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল যাতে তার একটা দিক দিয়ে সাতফুট আর অন্যদিক তিনফুট থাকে। এইসব করে আমরা দুই ভাই টুলের ওপরে বাঁশটার তিনফুটের দিকটা ধরে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দেখে নিলুম যে টুলটা দিব্যি ফালক্রামের কাজ করে গেল। কোনো গোলমাল করল না। এরপর দেখে নেওয়া হল যে বাঁশটা আমাদের বাড়ির ছাদের প্রান্ত থেকে ঘুরিয়ে পেছনে ঘোষাল বাড়ির ছাদের ওপর নিয়ে গেলে প্রায় ফুট আড়াই ঢুকে যাচ্ছে।

“ব্যাস! তাহলে আমাদের প্রাথমিক কাজ শেষ।

“বাবা হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চমৎকার। আমি এখুনি বরেনদাকে খবরটা ফোন করে দিয়ে দিচ্ছি। আমি তো কি করব ভেবে পাচ্ছিলুম না। তুই করে দেখিয়ে দিলি।

***

“সেইদিন সন্ধে থেকেই আমাদের ক্রেন খাবার ডেলিভারির কাজ শুরু করে দিল। বরেন জ্যাঠামশাইকে ফোন করে দেবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওঁরা দু-জনেই হাসতে হাসতে চিলেকোঠা থেকে বের হয়ে এলেন। বাবা আর জ্যাঠামশাই কথা বলতে বলতেই জ্যাঠিমা একটা থলে থেকে গোটা কয়েক বাটি বের করে খাবারটা ঢেলে নিয়ে ক্রেনে টিফিন ক্যারিয়ারটা বেঁধে দিলেন। সেটা নিঃশব্দে আমাদের বাড়িতে ফিরে এল। এইরকম চলল কিছুদিন।”

‘আমি বললুম, ঢের হয়েছে। এবার তোর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যাখ্যান বন্ধ করে মূল ঘটনায় আয় তো। আর, একটু সংক্ষেপ কর। ‘আমার কথায় মৃগাঙ্ক কিঞ্চিৎ বিমর্ষ হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের এই যুগান্তকারী যন্ত্রটি কিন্তু বেশি দিন কাজ করতে পারল না। সাত কি আট দিন পরেই বাবা আমাকে ডেকে বললেন— একটা খুব খারাপ খবর আছে। আজ সকালে বরেনদা আমাকে ফোন করেছিলেন। বললেন, বউদির শরীর খারাপ হয়েছিল। ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছিল। তিনি দু-জনেরই রক্ত পরীক্ষা করান। দু-জনেরই কোভিড পজেটিভ ধরা পড়েছে। ডাক্তারবাবু ফোনে জানিয়েছেন কোনো হাসপাতালে জায়গা নেই। বাড়িতেই থাকতে হবে আর প্যারাসিটামল খেতে হবে। আর কোনো উপায় নেই।”

“মা প্রশ্ন করেছিলেন— কী সর্বনাশ! এঁরা এখন খাবেন কী? ছাদে তো আর খাবার নিতে আসতে পারবেন না।”

“বাবা বললেন— সেই প্রশ্ন আমিও করেছিলুম। বরেনদা বললেন— আমরা এতদিন যে খাবার পাঠিয়েছি, ওঁরা নাকি তার অর্ধেকের অর্ধেকও খেয়ে উঠতে পারেননি। সে সব খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। তাতে নাকি তাঁদের আরও ছ-সাত দিন চলে যাবে।”

তবুও আমরা নজর রাখতে লাগলুম। ঘোষালবাড়ির দোতলার ভেতরের করিডরে আলো জ্বললে সেটা ও বাড়ির একটা কাচের জানলা দিয়ে দেখা যেত। সেদিকেই আমাদের নজর ছিল। কিছুদিন প্রত্যেক দিনের মতো রোজ সন্ধ্যেবেলা ছ-টা নাগাদ আলোটা জ্বলে উঠত আর রাত আটটা নাগাদ নিভে যেত। তার পরে, হঠাৎ একদিন আলোটা আর নিভল না। দেখা গেল তিনদিন ধরে সেটা জ্বলেই আছে।

“বাবা অসহায় রাগে কম্পিত গলায় বললেন- “ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না রে, মিঙ্কু। সহদেবকে গিয়ে বল যে মনে হচ্ছে সব বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে। ওরা যেন একটা ব্যবস্থা নেয়। আমি সুরেনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছি। ও তো ফিরে আসবার জন্যে ছটফট করছে। কোত্থাও কোনো টিকিট নেই। থাকবেই বা কোত্থেকে? যা ভিড়। তবে, হয়তো আজকে বিকেলের প্লেনে দুটো টিকিট পেতে পারে। সেও তো বাড়ি আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে। বড্ড দেরি হয়ে যাবে রে। আমাদের তো কিছু করতে দেবে না। শুনলুম, সেটা না কি আমাদের উপকারের জন্যে। ভণ্ডামির তো কোনো শেষ দেখছি না।”

‘আমি বাবাকে বললুম যে আমি এক্ষুণি যাচ্ছি। বলে, রওনা হচ্ছি যখন তখুনি মা এসে আমাকে চুপি চুপি বললেন – “তুই সহদেবকে বলবি যে আমি ভোররাত্রি থেকে একটা বিচ্ছিরি গন্ধ পাচ্ছি। তোর বাবা তো সকাল থেকে মুখে চুরুট লাগিয়ে বসে থাকে। আর তুইও চারমিনার না কি একটা কটু গন্ধের সিগারেট খাস। তাই তোরা বোধ হয় গন্ধটা এখনও পাসনি।”

“আমি বললুম— বলব মা, সহদেবদা কে সব কথা বলব।

***

“বড়ো রাস্তা ঘুরে সহদেবদার গলিতে ঢুকতে গিয়ে দেখি, সেখানে খুব একটা গোলমাল বেঁধেছে। গলির মুখে একটা পুলিশের গাড়ি আর একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। আর সেগুলোর পাশেই একটা বড়ো জটলা। ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শ্রীযুক্ত শচীনন্দন কাঞ্জিলাল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ খনখনে গলায় আপ্রাণ চেঁচাচ্ছেন আর লোকাল থানার অফিসার তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে শান্ত করবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

“শ্রীযুক্ত শচীনন্দন কাঞ্জিলাল চিৎকার করে পুলিশকে যে কথাটা বলবার চেষ্টা করছেন তা হল বরেন ঘোষাল মারা গেছেন না ছাই। লোকটা আগাপাস্তলা শয়তান। দিন সাত-আট আগে লোকটার সস্ত্রীক কোভিড পজেটিভ ধরা পড়বার পর তিনি বেপাড়ার একটা উটকো বখাটে লোককে এখানে পাঠিয়েছিলেন বাজার করে দেবার আছিলায়। ওসব বাজার-টাজার কিছু নয়, ওই লোকটার উদ্দেশ্য হল, প্রথমদিন থেকে শ্রীযুক্ত শচীনন্দন কাঞ্জিলাল ব্যারিকেড করে পাড়ায় কাউকে ঢুকতে না-দিয়ে কোভিডের সংক্রমণ যে ঠেকিয়ে রেখেছেন সেটা ভণ্ডুল করে দেওয়া। সেই লোকটা বাজারে যাবে আর সেখান থেকে যত রাজ্যের কোভিডের জার্ম এনে পাড়ায় ছড়িয়ে দেবে। এটাই ছিল আসল ব্যাপার। এ সবই শ্রীযুক্ত শচীনন্দন কাঞ্জিলালের খুব ভালো করে জানা আছে। থানায় যে ফোন করেছিল, সে ঘোষালের কথাই করেছিল। গন্ধ-টন্ধ সব বাজে কথা। কাজেই, এ ব্যাপারে পুলিশের ইনভেস্টিগেশনের এখনই কোনো দরকার নেই। অতএব, তাঁরা যেন মানে মানে ফিরে যান।

“আমি আর সহ্য করতে পারলুম না। সোজা গিয়ে পুলিশ অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে আমার অফিসের ছবি লাগানো পরিচয়পত্রটা দেখিয়ে বললুম— আমিই সেই বেপাড়ার একটা উটকো বখাটে লোক। শ্রী বরেন্দ্রনাথ ঘোষাল একজন সমাজে প্রতিষ্ঠিত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। একসময়ে তিনি কলকাতার শেরিফ ছিলেন। আমি ওঁর বাড়ির পেছনেই থাকি। উনি আমাকে কোভিড শুরু হবার আগেই এখানে সদানন্দ বারিকের কাছে পাঠিয়েছিলেন ওঁর বাজারটা করে দেবার অনুমতি নেবার জন্যে। কিন্তু ওই ভদ্রলোক সেই অনুমতি দিতে তো দেনইনি, উলটে আমাকে গালাগাল করে গলি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

“আমাকে দেখেই শচীনন্দন এক লাফে এসে আমার জামা টেনে ধরে চিৎকার শুরু করলেন— অ্যাই, অ্যাই, তুমি এখানে কী করছ? এটা আমাদের পাড়ার ব্যাপার। এখানে তুমি কোনো কথা বলবে না। এক্ষুনি চলে যাও এখান থেকে নইলে তোমাকে জুতো মারতে মারতে আমরা এখান থেকে তাড়িয়ে দেব।

“এইবারে এযাবৎ শান্ত হয়ে থাকা পুলিশের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। হঠাৎ অফিসারের গলা দিয়ে একটা ভয়ংকর হুংকার বেরিয়ে এল – চুপ! একদম চুপ! আপনি অনেক চিৎকার করেছেন। আমাকে এর কথা শুনতে দিন। আর একটি শব্দ করলে আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হব। আপনার মনে থাকা উচিত যে পুলিশের তদন্তে বাধা দেওয়া একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

“শচীনন্দন চোখ-মুখ কুঁচকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পুলিশের রুদ্রমূর্তি দেখে মুখ বন্ধ করলেন। অফিসার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন— বরেনবাবুর বাড়িতে কোনো বাজার করে দেবার মতো লোক নেই?

“বললুম— না। ওই দোতলা বাড়িটাতে কেবল বরেন জ্যাঠামশাই আর তাঁর স্ত্রী থাকেন আর কেউ থাকে না। ওঁর ছোটোভাই সপরিবারে কলকাতার বাইরে গিয়েছিলেন, এখন কোভিডের চক্করে আটকে গেছেন। ওঁর মেয়ে বিদেশে থাকেন। তাঁরও অবস্থাও তথৈবচ। বাড়িতে কাজের লোকেরা সবাই রাতারাতি পালিয়েছে। এখন আমার স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন, কারণ জ্যেঠিমাকে একা বাড়িতে রেখে তাঁর পক্ষে বাজারে যাওয়া আর সম্ভবপর নয়। কারণ, জ্যেঠিমার শরীর তখন ভালো ছিল না। রক্তচাপ আর সুগার দুটোই বেশ বিপজ্জনক ছিল। এখন তো কোভিডই ধরা পড়েছে। কিন্তু এই ভদ্রলোক আমাকে কিছুতেই অনুমতি দিলেন না। তখন নিরুপায় হয়ে আমরা রান্না করা খাবার লম্বা বাঁশের ডগায় বেঁধে আমাদের ছাদ থেকে ওঁদের ছাদে নামিয়ে দিতে শুরু করলুম। সেইসঙ্গে ফোনে জানিয়ে দিতুম।

“এই ব্যবস্থাটা ভালোই চলছিল। কিন্তু গত কয়েক দিন যাবৎ দেখছি সেই খাবার ছাদের ওপর পড়েই আছে আর ওঁরা টেলিফোনেও কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। আমাদের তো মনে হচ্ছে যে কিছু একটা ঘটে গেছে। তাই এখানে এসেছিলুম সহদেবদাকে আমাদের চিন্তার কথাটা জানাতে।

“আমার পাশ থেকে খনখনে গলাটা আবার ঝনঝন করে উঠল— তোমাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই হে, ছোকরা। মানুষ অত সহজে মরে না, বুঝলে? কে এক যতীন না যোগেন না কি যেন নামের বিপ্লবী ছিল না? সে অনশন করতে করতে মরে গিয়েছিল। তার মরতে সময় লেগেছিল দু-মাসের ওপর আর তোমার জ্যাঠা যদি উপোশ করেই থাকে, সে তো মাত্ৰ কয়েক দিনের। তাতেই ফিনিশ? চেহারা দেখে তো ফুলের ঘায়ে মুচ্ছো যাওয়া টাইপ মনে হয়নি কখনো। শুনুন পুলিশবাবু, কিসসু হয়নি লোকটার। গিয়ে দেখুন, সে আর তার বউ দিব্যি খাটে শুয়ে শুয়ে ঠ্যাঙ নাচাচ্ছে। যত সব বাজে লোকের আদিখ্যেতা।

“এবার পুলিশবাবুর গলা থেকে মধু ঝরে পড়ল— দেখুন স্যার, আমাদের কাছে একটা কমপ্লেন যখন এসেছে, তখন আমাদের একটা ইনভেস্টিগেশন তো করতেই হয় আর তার একটা রিপোর্টও জমা দিতে হয়। কিন্তু সেটা তো কারোর মুখের কথায় হয় না। অন্তত একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান সেখানে থাকতেই হয়। তাই আমি বলি কি, আপনি যদি একটু গিয়ে একটা কাগজে মি. ঘোষালকে দিয়ে লিখিয়ে আনেন যে উনি বহাল তবিয়তে জীবিত আছেন, তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

“শচীনন্দন সন্দিগ্ধমুখে বললেন— আমি যাব কোন দুঃখে। যেতে হলে আপনি যান।

“পুলিশবাবু মুখটা যথাসাধ্য করুণ করে বললেন— ওরে বাবা, আমার ভীষণ ভয় করছে। যদি ভূত হয়ে আমার ঘাড় মটকায়? বাজে লোক, বলা তো যায় না।

“আমি সুযোগ বুঝে বললুম— আপনি যান না, শচীনন্দনবাবু। দেখছেন তো, ইনি ভয় পাচ্ছেন। আর আপনি তো সবসময় বলেন যে এই দুনিয়ায় আপনি কাউকে ভয় পান না। এখন অসুস্থ বৃদ্ধ বরেন জ্যাঠামশাইকে ভয় পাচ্ছেন না নিশ্চয়ই।

“শচীনন্দন রেগে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই, সেখানে সমবেত জনতা সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল— হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি যান শচীনন্দনবাবু। ভয় পাচ্ছেন না কি? আপনি তো ভয় পাওয়ার লোক নন। কীসের ভয়? আমরা সবাই এখানেই তো আছি। আপনি চলুন, আমরা আপনাকে সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছি।

***

“জনতা আর পুলিশের শোভাযাত্রা বরেন জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ির দিকে রওনা হল। আগে আগে নিতান্তই শুকনো মুখে শচীনন্দন কাঞ্জিলাল। গন্তব্যে পৌঁছে দেখা গেল বাড়ির সদর দরজা থেকে শুরু করে সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শচীনন্দনবাবু পেছন ফিরে কম্পিত কণ্ঠে বললেন- দ… দ…

“আমি বললুম— দরজা বোধ হয় খোলাই আছে। ধাক্কা দিন, খুলে যাবে।

“আমার পাশ থেকে পুলিশ অফিসার বললেন— চিন্তা করবেন না। বন্ধ থাকলে আমরা দরজা ভেঙে ফেলব। আপনারা সবাই সাক্ষী থাকবেন তো?

“সমবেত জনতা আবার সমবেত গলায় বলে উঠল— অবশ্যই থাকব।

‘অগত্যা নিরুপায় শচীনন্দনবাবু কাঁপতে কাঁপতে দরজায় একটা ঠেলা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল আর তৎক্ষণাৎ একটা বীভৎস ভ্যাপসা পচা দুর্গন্ধ একপাল ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল! সকলে পাগলের মতো যে যা পারল নাকে-মুখে চাপা দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাল, অনেকে বমি করে ফেলল।

“আমিও পালালুম। ছুটতে ছুটতে দেখি, শচীনন্দন কাঞ্জিলাল ঘোষালবাড়ির সদর দরজার সামনে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে আছেন আর ভেউ ভেউ করে কাঁদছেন।

“সেইদিনই রাত্রে বাবা আমাদের নিয়ে ওরান্দায় চলে গেলেন।”

***

একটু চুপ করে থেকে মুকুল বলল, ‘এই আমার বন্ধুর অভিজ্ঞতার গল্প। এটা কি ধরনের গল্প সেটা তোমরা স্থির করো। হরার স্টোরি শ্রেণিতে পড়ল কি? এতে কিন্তু দানবাকৃতি কোনো রাক্ষস নেই, একটা মানুষকে কড়মড়িয়ে খেয়ে ফেলা নেই, ভূতপ্রেত কিছুই নেই। অথচ, নিরঞ্জন যেমন বলছিল, এই গল্পটা কিন্তু আমাকে আতঙ্কে সন্ত্রস্ত করে তোলে আর মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক এখানে দেখা যাচ্ছে সেটা আমাকে শান্তিতে বেঁচে থাকার ব্যাপারেও সন্দিহান করে তোলে।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন