শিশিরবাবুর স্বপ্ন – মনোজ সেন

মনোজ সেন

শিশিরবাবু বিরক্ত মুখে খবরের কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘দুর, দুর!’

শিশিরবাবুর স্ত্রী বিজয়া টেবিলের অন্যপাশে বসে দুধের গ্লাসে চিনি দিচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল?’

‘কী আবার হবে। কিছুই হয়নি। সেটাই তো কথা। পয়সা দিয়ে কাগজ কেনা, পয়সা জলে দেওয়ার সমান!’

‘কী হবে আশা করছিলে?’

‘যাহোক কিছু। যুদ্ধ, ভূমিকম্প, বিপ্লব- একটা কিছু। কিন্তু নাঃ কিচ্ছু হচ্ছে না, কিচ্ছু হয় না। খালি রাজনীতির কচকচানি। সবাই বসে বসে ল্যাজ নাড়ছে আর বড়ো বড়ো বক্তৃতা দিচ্ছে। আমাদের ছোটোবেলায় এরকম ছিল না। রোজ যাকে বলে রোমহর্ষক ঘটনায় কাগজ রমরম করত। বিপ্লবীরা গুলি ছুড়ছে, ইন্দোচীনে অগ্ন্যুৎপাত ঘটছে, হিটলার, মাউ মাউ— সে এক হইহই ব্যাপার। আর এখন দ্যাখো! যা-কিছুই হতে যায়, সবাই দৌড়ে এসে বন্ধ করে দেয়। এমন করলে এখানে উত্তেজনা বলে কিছু থাকে?’

বিজয়া বললেন, ‘রিটায়ার করে তোমার জীবনটা একেবারে মিইয়ে গেছে, তাই না? তা কী করবে বলো? একসময় না-একসময় তো সকলকেই এই অবস্থায় এসে পৌঁছাতে হয়। সবসময় উত্তেজনার মধ্যে থাকতে চাও, অথচ তার বয়েস আছে? তার চেয়ে চলো না কিছু তীর্থভ্রমণ করে আসি।’

শিশিরবাবু দুধে চুমুক দিচ্ছিলেন। বিষম খেয়ে বললেন, তীর্থভ্রমণ? আমি? এতদিনেও আমাকে চিনে উঠতে পারলে না? কোনোদিন আমাকে ঠাকুর-দেবতার প্রতি ভক্তিতে গদগদ দেখেছ?’

‘না, তা দেখিনি। কিন্তু এখন তো তোমার বয়েস হয়েছে। এই সময়েও…’

‘থামো, থামো। এই বয়সে কী হয়েছে যে আমাকে হঠাৎ বসে বসে ঘণ্টা নাড়তে হবে?’ বলে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। তারপর নীচু গলায় বললেন, ‘কিছু কিছু লেখায় পড়েছি, তাঁরা নাকি গ্রহান্তরের মানুষ। কোনো সুদূ র অতীতে একবার বা হয়তো একাধিকবার পৃথিবীতে এসেছিলেন এবং সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে আবার আসবেন। তাঁরাই আমাদের আগুনের ব্যবহার শিখিয়েছিলেন, সভ্য করেছেন, কাঁচা মাংসের জায়গায় রান্না করা খাবাব খেতে শিখিয়েছেন। আমি পুজো করলে, ঘণ্টা নাড়লে, মন্ত্র পড়লে, যদি আবার তাঁরা আসেন, তো আমি রাজি আছি! মহাভারতে দেখো আছে, সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী নিনাদিত করে ইন্দ্রের রথ ভূমিতে অবতীর্ণ হত। অর্থাৎ সেটা ছিল একটা মেকানিক্যাল মহাকাশযান। সেই রকম মহাকাশযানে করে তোমার উপাস্য দেবতারা যদি আসেন তো বলো, গঙ্গাস্নান করে এখনই ইন্দ্রের পুজোয় বসি।’

বিজয়া বিরক্ত গলায় বললেন, ‘যত সব হিজিবিজি বই পড়ে মাথার বারোটা বাজাচ্ছ! তার চেয়ে দুটো ভালো বই পড়ো- মনে শান্তি পাবে। এমন ছটফট করে বেড়াতে হবে না।’

শিশিরবাবু কোনো কথা না-বলে চুপ করে আকাশের দিকেই চেয়ে বসে রইলেন।

কিন্তু বসে থাকলে কিছু হয় না। কখনোই কিছু হয় না। কাজেই শিশিরবাবুকে উঠতে হল। আজ বাজার করবার দরকার নেই; তাই ভাবলেন, বাগানের কাজই করা যাক।

শিশিরবাবুর বাগানটা প্রকাণ্ড। বেশ কয়েক বিঘে জমি নিয়ে। ফলের গাছ, ফুলের গাছ, তরিতরকারি— সবই আছে। রুক্ষ পাথুরে জমিকে এই সবুজ খেতে পরিণত করেছিলেন শিশিরবাবুর ঠাকুরদা, রায়বাহাদুর প্রমথনাথ রায়। হাজারিবাগে এসেছিলেন ডাক্তারি করতে, এই বাড়ি আর বাগান তৈরি করে এখানেই থেকে গেলেন। তাঁর ছেলেরা কেউই হাজারিবাগে থাকেননি, সবাই কলকাতায় নয়তো দিল্লির স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন। শিশিরবাবু আবার এসে এখানে উঠেছেন, কারণ রিটায়ার করার পর কলকাতা শহর তাঁর কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। প্রথমত জিনিসপত্রের দামের জন্যে আর দ্বিতীয়ত, বিরামহীন গোলমালের জন্য। নির্জনে বসে বই পড়বেন এই ইচ্ছে নিয়ে এখানে এসে উঠলেন। ছেলেরা এল না, মেয়ের তো বিয়েই হয়ে গিয়েছিল। তাতে অবশ্য তাঁর কোনো আফশোস নেই, কেবল বিজয়া মাঝে মাঝে ঘ্যানঘ্যান করে থাকেন। এতবড়ো বাড়ি, এতবড়ো বাগান— এর মধ্যে আজন্ম কলকাতায় থাকা বিজয়া বোধ হয় হাঁপিয়ে ওঠেন।

শিশিরবাবুর বাড়িটা শহরের একপ্রান্তে। একসময় বাইরেই ছিল, এখন শহর বাড়তে বাড়তে প্রায় ধরে ফেলেছে। তবে ছাড়িয়ে যায়নি। তাঁর বাগানের পেছনে এখনও রয়েছে বড়ো বড়ো পাথর ছড়ানো দিগন্তবিস্তৃত রুক্ষ জমি। সন্ধের পর এখনও নামে আশ্চর্য নৈঃশব্দ, আকাশে ঝকঝক করে তারা। বাড়ির সামনে কিছু লোকজন, দোকানপাট, সাইকেলরিকশার আওয়াজ। আর পেছনে বাগান পেরিয়ে সীমাহীন নির্জনতা। শিশিরবাবুর পড়া বা গান শোনার এখনও কোনো অসুবিধে নেই কিন্তু বাগানটা শুকিয়ে আসছে। মালী দীনদয়াল যত বুড়ো হচ্ছে, বাগানটাও যেন তেমনই বুড়িয়ে যাচ্ছে। শিশিরবাবু মাঝে মাঝে ভাবেন দীনদয়ালকে ছাড়িয়ে দেবেন, কিন্তু পারেন না। দীনদয়ালের বাবা প্রমথবাবুর মালী ছিল।

শিশিরবাবু দীনদয়ালকে জোরে দু-বার ডেকে বাগানের ভেতর হাঁটতে শুরু করলেন। ফুলের বেড়াগুলো ছাড়িয়ে তরিতরকারির বাগানটা কিছুক্ষণ দেখলেন। আগে ফুলের বাগানটা আরও বড়ো ছিল, এখন ছোটো হয়ে এসেছে। তরিতরকারির খেতটা হয়তো একটু বাড়ালে ভালো হত। দীনদয়ালের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। কিন্তু দীনদয়াল কোথায়? আবার জোরে ডাকলেন শিশিরবাবু। সাড়া নেই। গেল কোথায় লোকটা? শিশিরবাবু বাগানের পেছন দিকে চললেন।

জাপানিরা নাকি বলে থাকে যে বাগান করার মতো সুখ আর নেই। শিশিরবাবু তা মানেন না। বুদ্ধিমান লোকের সুখ হওয়া উচিত এমন ব্যাপারে যাতে মস্তিষ্ক চালাতে হয়, যুক্তি তর্ক, বিশ্লেষণ-আলোচনা ইত্যাদি প্রয়োজন হয়, যা কল্পনাকে উত্তেজিত করে। সার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট বা কলম করে ফুলের রং পালটানোর মধ্যে সুখের সন্ধান তিনি কোনোদিন পাননি। আসলে সুখ আর নেই। ভালো বই আর লেখা হয় না। এমন কোনো ঘটনা ঘটে না, যা বুদ্ধিমান লোককে উত্তেজিত করতে পারে। পাঞ্জাবের নির্বোধ ছেলেমানুষি, ইউরোপের আত্মঘাতী রণসজ্জা, মধ্য আমেরিকার নির্বিবেক খুনোখুনি, কোনোটাই যুক্তিশীল প্রকৃত বুদ্ধিমান লোকের খোরাক হতে পারে না। বুদ্ধিমান লোকের উত্তেজনার দিন ফুরিয়ে গেছে। এখন নির্বোধ, অশিক্ষিত, গোঁয়ারদের রাজত্ব, কাজেই তাদের উত্তেজিত করার মতো ঘটনাই তো এখন ঘটবে। অতএব বাগান করা ছাড়া শিশিরবাবুদের আর গত্যন্তর কী? কিন্তু দীনদয়ালের এখনও কোনো সাড়া নেই।

বাগানের পেছন দিকে কোনো একসময় গোয়ালঘর ছিল, একটা কুয়ো ছিল, হাঁসের ঘর, কাপড় কাচার আর জল গরম করার উনুন ছিল— এখন সেসব ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। কুয়োটাও শুকিয়ে গেছে বহুদিন আগে। শিশিরবাবু রোজই একবার এখানে এসে দাঁড়ান আর ভাবেন এ জায়গাটায় কিছু একটা করা দরকার, কিন্তু করা আর হয়ে ওঠে না। আজও পোড়ো গোয়ালঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল, ভেতরে কী যেন নড়াচড়া করছে। মানুষ বলেই তো মনে হল।

এদিকে দীনদয়াল ছাড়া আর কারোর আসার কথা নয়। কাজেই শিশিরবাবু দু-পা এগিয়ে ডাক দিলেন, ‘ওখানে কে? দীনদয়াল নাকি?’

বোধ হয় তাঁর ডাক শুনেই ভাঙাচোরা দেওয়ালের ওপাশ থেকে একটা ফোকর টপকে দু-জন লোক বেরিয়ে এল। একজন অবশ্যই দীনদয়াল— মাথার কাঁচাপাকা চুল, গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি আর খাকি হাফপ্যান্ট। তার সঙ্গে একজন ভদ্রলোক শিশিরবাবুর মতোই পাজামা আর পাঞ্জাবি পরা, তারই সমবয়সি হবেন। ভদ্রলোককে দেখে শিশিরবাবুর ভীষণ চেনা চেনা লাগল, কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারলেন না। কোথায় যেন দেখেছেন, খুব কাছ থেকেই দেখেছেন, অথচ মনে করতে পারলেন না।

আগন্তুক ভদ্রলোকের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে শিশিরবাবু দীনদয়ালকে বললেন, ‘এতক্ষণ ছিলি কোথায়? ওখানে কী করছিলি? ইনি কে?’

দীনদয়াল এতগুলো প্রশ্নের একটারও জবাব না-দিয়ে ফিক করে লাজুক হাসল। তারপর বরাভয়ের ভঙ্গিতে একহাত তুলে শিশিরবাবুকে একটু অপেক্ষা করতে বলে হাফপ্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট কালো মতন যন্ত্র বের করে তার ওপর অদ্ভুত কায়দায় হাত বুলোতে লাগল। একটু বাদেই হঠাৎ কালো যন্ত্রটার ওপর একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠল আর টিং করে একটা শব্দ হল। অমনি দীনদয়াল মুখ তুলে আবার ফিক করে হেসে বলল, ‘শিশিরবাবু, নমস্কার’।

শুনে শিশিরবাবু ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘তার মানে? ব্যাপারটা কী? ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি আমার সঙ্গে? এই ভদ্রলোক কে? ওখানে কী করছিলি?’

বলতে বলতে আবার টিং করে শব্দ হল। শিশিরবাবু মুখ ফিরিয়ে দেখেন আগন্তুক ভদ্রলোকের হাতেও একটা কালো যন্ত্র, তাতে সবুজ আলো জ্বলছে। দেখে একটু যে ভয় পেলেন না, তা নয়। কিন্তু একে সকাল আটটা, তার ওপর পাশেই দীনদয়াল, কাজেই বিশেষ বিচলিত হলেন না।

এবার আগন্তুক ভদ্রলোক কথা বললেন। অত্যন্ত বিনীতভাবে নমস্কার করে হেসে বললেন, ‘আপনার এই সুন্দর বাগান এমন চমৎকার রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন, এমন নির্মল পরিবেশ দেখে এখানে না-এসে আর থাকতে পারিনি। আপনার সঙ্গে অবশ্যই পূর্বনির্ধারিত সময়ের ব্যবস্থা করে আসা উচিত ছিল, কিন্তু কতগুলো বিশেষ কারণে, যা একটু বাদেই আমরা আপনাকে ব্যাখ্যা করে জানাব, তা সম্ভব হয়নি। অতএব আপনার কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’

এ আবার কোন পাগল? দীনদয়াল পারেও যত অদ্ভুত অদ্ভুত লোক ধরে আনতে। এই প্রথম নয়, এর আগেও কয়েক বার এরকম হয়েছে। পরে তাদের বিদেয় করতে প্রাণান্ত! যাহোক, এসব লোকের সঙ্গে সাবধানে ব্যবহার করতে হয়।

অতএব প্রতিনমস্কার করে শিশিরবাবু যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘না, না, তাতে কী হয়েছে? তবে আপনি যখন বাগান দেখতে এসেছেন, তখন ওদিকে চলুন না, বাগানটা ওদিকেই। এটা তো পোড়ো জায়গা।’

শিশিরবাবুর পুরো কথাটা শেষ করতে না-দিয়ে আগন্তুক বলে উঠলেন, ‘না না ঠিক আছে। আমাদের এখানে কোনো অসুবিধে নেই। আমরা অবশ্য আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চাই, বাগান দেখাটা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। সে কাজটা আমরা এখানেই সারতে পারি।’

শিশিরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘কথা বলতে চান তো বাড়ির ভেতরে চলুন। আমরা সেখানেই বসে আলোচনা করাতে পারব। সেইসঙ্গে একটু চা…’

শুনে আগন্তুক ভদ্রলোক আর দীনদয়াল—দু-জনেই চমকে উঠলেন। ভদ্রলোক বললেন, ‘চা, মানে একপ্রকার পানীয়? না, না, তার আমাদের প্রয়োজন নেই। কোনোরকম পানভোজন আমরা করতে পারব না। আমরা শুধু আপনার সঙ্গে একটু বাক্যালাপ করতে চাই।’

শিশিরবাবু বললেন, ‘তা, বাক্যালাপটা বাড়ির ভেতরে বসে করলেই ভালো হত না? এখানে এই রোদে…’

ভদ্রলোক পূর্ববৎ বিনীতভাবে বললেন, না, না, তাতে আমাদের কোনো অসুবিধে নেই। মানে, আলোচনাটা একটু নির্জনে হলেই ভালো হয়, এই আর কী! ‘

শিশিরবাবু আর জোর করলেন না। ভাবলেন, এই রোদে বেশিক্ষণ বাক্যালাপ তো চলবে না, সেটাই ভালো হবে। বললেন, ‘বেশ তো, তাহলে এখানেই আমরা কথা বলতে পারি।’

ভদ্রলোক খুশি হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো। প্রথমেই আমাদের পরিচয়টা দিয়ে দিই।’

শিশিরবাবু বাধা দিয়ে বললেন, ‘আমাদের বলছেন কেন? ওকে তো চিনি ও দীনদয়াল। আপনার সঙ্গে পরিচয় নেই অবশ্য, কিন্তু আপনাকে আমার খুবই চেনা চেনা লাগছে। এমনকী আপনার গলার আওয়াজ পর্যন্ত। কোথায় আপনাকে দেখেছি বলুন তো?’

আগন্তুক ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, ‘কী জানি, দেখেছেন হয়তো কোথাও। আমি হচ্ছি, একটা পুস্তক প্রকাশন সংস্থার সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। সারা দুনিয়া চষে বেড়ানো আমার কাজ। কাজেই, দেখা কোথাও হয়ে থাকতেই পারে।’

শিশিরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, তা ঠিক। যখন চাকরিতে ছিলুম, তখন বহু সেলসম্যানই আমার কাছে এসেছেন। তাঁদের অনেককে সাহায্যও করেছি। একটা বড়ো কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে তখন আমার অনেক ক্ষমতাও ছিল। কিন্তু আজ তো অনেক বছর হল রিটায়ার করেছি, কারোর সঙ্গে তেমন যোগাযোগও আর নেই। কাজেই আমার কাছ থেকে খুব একটা সাহায্য কি আর পাবেন আপনি? আজকাল নতুন নতুন লোক, নতুন নতুন সাবজেক্ট, আপনি বরং কলকাতায়…’

আগন্তুক দু-হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘কী যে বলেন স্যার! আপনার কাছ থেকে সাহায্য পাব না তো, কার কাছ থেকে পাব? আমরা হিসাব করে দেখেছি, আপনার জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল, নতুন তথ্যে আপনার প্রচুর আগ্রহ আর আপনার অন্তর শান্ত।’

কৈতববাদে গলে যাওয়ার বয়েস আর এখন নেই শিশিরবাবুর। তা সত্ত্বেও তাঁর মুখে হাসি ফুটল। বললেন, ‘আপনি তো দেখছি মশায় পাক্কা সেলসম্যান। তা, আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’

‘হেঁ, হেঁ, মানে, আপনি স্যার যদি আমাদের সম্বন্ধে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু ভালো করে বলে দেন। অবশ্য, তার জন্যে আপনি কমিশন পাবেন। এই ধরুন, বিক্রির শতকরা একভাগ। তবে, আপনাকে বলছি স্যার, আমি যে বই নিয়ে এসেছি, সেটা আপনাদের এখানে যুগান্তর এনে দেবে। এত বিক্রি হবে যে আপনি তা চিন্তাও করতে পারবেন না।’

শিশিরবাবু ভাবলেন, বুঝেছি, তুমি বাংলাদেশ থেকে আসছ। কিন্তু এখানে কেন? মুখে বললেন, ‘তাহলে তো কলকাতায় যাওয়া আপনার আরও বেশি করে দরকার। সেখানে অনেক বেশি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোকের সন্ধান পাবেন আপনি।’

ভদ্রলোক দপ্তবিকাশ করে হাসলেন। বললেন, ‘অমন সমস্ত লোককেই আমরা বিশ্লেষণ করেছি, তাদের মধ্যে আপনিই মনোনীত হয়েছেন, স্যার।’

শিশিরবাবু পুনশ্চ ভাবলেন, তুমি বাংলাদেশিও বটে, আবার পাগলও বটে। মৃদু হেসে বললেন, ‘তাই নাকি? সমস্ত লোককেই আপনারা বিশ্লেষণ করে ফেলেছেন। কারা করলেন?’

‘আজ্ঞে, আমাদের সৌরমণ্ডল সংক্রান্ত যন্ত্রগণক।’

চমকে উঠলেন শিশিরবাবু। বললেন, ‘সৌরমণ্ডল সংক্রান্ত যন্ত্রগণক? তাতে আপনি সমস্ত ক্ষমতাশালী লোককে বিশ্লেষণ করেছেন?’

‘না, না কেবল ক্ষমতাশালী লোক নয়, আপনাদের পৃথিবীর সমস্ত লোককেই আমরা বিশ্লেষণ করেছি। সামান্য ক-জন তো লোক।’

শিশিরবাবু বিস্ময়ে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। কোনোরকমে বললেন, ‘পৃথিবীতে সামানা কজন লোক। আপনি কে, কোত্থেকেই বা আসছেন, জানতে পারি কি?’

আগন্তুক ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, ‘অবশ্য, অবশ্য। আমি বেশ বুঝতে পারছিলুম যে, আপনি এতক্ষণ আমাদের পাগল ভাবছিলেন। হয়তো, আমার ভাষাটাও ঠিক আপনার মতো হচ্ছিল না। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই, স্যার। মানে, আমাদের যদি আপনার একটু অস্বাভাবিক লেগে থাকে, তার কারণ আমরা স্যার এই পৃথিবীর মানুষ নই। আমরা গ্রহান্তর থেকে আসছি।’

কী অসীম মনোবলের সাহায্যে যে শিশিরবাবু নিজেকে স্থির এবং প্রায় অবিচল রাখলেন, তা কেবল তিনিই জানেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘গ্রহান্তর থেকে আসছেন? ঠাট্টা করছেন না তো আমার সঙ্গে?’

ভদ্রলোক অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে বললেন, ‘কী যে বলেন স্যার! আমি কখনো আপনার সঙ্গে ঠাটা করতে পারি? আমরা সত্যিই বাইরে থেকে আসছি। শ্রবণা নক্ষত্রমণ্ডলের পঞ্চম গ্রহে আমাদের বাড়ি। আমি হলুম, ব্রহ্মাণ্ড পুস্তক প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেডের ছায়াপথ নক্ষত্রপুঞ্জ এলাকার বিক্রয় অধিকর্তা ক্রেংকাঢ়ি নিকাষোক। আমার নাম আপনাদের ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় শান্তিময় অধিকারী। আপনি স্যার, আমাকে শান্তি বলে ডাকতে পারেন।’

শিশিরবাবু তখনও নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। কোনোক্রমে বললেন, ‘শ্রবণা নক্ষত্রমণ্ডল? ক্রেংকাঢ়ি নিকাষোক? আমাকে দিয়ে আপনার কী প্রয়োজন?’

ক্রেংকাঢ়ি ওরফে শান্তিময় বললেন, ‘সে কথাই তো আপনাকে বলব স্যার। আপনি ততক্ষণ এই কুয়োর পাড়ে বসুন, আমাকে একটু বিশদভাবে বলতে দিন।’

বলে শিশিরবাবুকে কুয়োর পাড়ের একটা অংশ ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করে বসিয়ে, পেছনে হাত দিয়ে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে পায়চারি করতে করতে শান্তিময় বলতে লাগলেন। ‘আপনার হয়তো জানা আছে স্যার যে আপনাদের হিসাব মতো কয়েক হাজার বছর আগে; ধরুন, চল্লিশ কী পঞ্চাশ হাজার হবে, বা বড়োজোর এক লাখ, আপনার পূর্বপুরুষ মানুষেরা ছিলেন অসভ্য বা বন্য। না, না, এতে আপনি অপমানিত বা ক্ষুদ্ধ হবেন না, কারণ সব সভ্য প্রাণীকেই একসময় এইরকম একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে পার হতে হয়েছে। তা, আপনার সেইসব পূর্বপুরুষ বনে জঙ্গলে থাকতেন, বাড়ি বানাতে জানতেন না, কাপড়চোপড় পরতেন না, কাঁচা মাংস খেতেন, পাথর ছুড়ে শিকার আর লড়াই করতেন।

এমন সময় আমাদের প্রতিবেশী বিশাখা নক্ষত্রমণ্ডলের একজন লোক এখানে আসে। তারা আপনার পূর্বপুরুষদের আগুনের ব্যবহার শেখায়, জামাকাপড় পরতে শেখায়, অস্ত্রের ব্যবহার শেখায়। সেই হল আপনাদের সভ্যতার বিকাশের শুরু। সেখান থেকে আরম্ভ করে আজ আপনারা যথেষ্ট উন্নতি করেছেন। এমনকী পৃথিবীর বাইরেও যাতায়াত শুরু করেছেন। মানে, একটি শিশু-সভ্যতার পক্ষে এটা একটা সত্যিই প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।

কিন্তু এমন হল কেন? একটি বুনো জানোয়ারকে কাপড় পরালে, আগুন জ্বালাতে শেখালে আর ভালো করে শিকার করার কায়দা ধরিয়ে দিলেই কি সে সভ্য হবে? না মোটেই নয়। তার সভ্য হয়ে ওঠার কারণ অন্যত্র। সেটা হল, তার খাদ্যাভ্যাসে। কাঁচা মাংস খেয়ে কেউ সভ্য হতে পারে না, তা সে যতই জামাকাপড় পরুক না-কেন আর আগুন জ্বালাক না কেন। অন্য দিকে দেখুন, একটি অসভ্য বুনো লোককে ধরে-বেঁধে কিছুদিন ভালো ভালো সুস্বাদু খাবার খাওয়ান, দেখবেন সে দেখতে না-দেখতে সভ্য হয়ে উঠেছে।

এমনি করেই আপনাদের পূর্বপুরুষও যখন থেকে মাংস আর তরিতরকারি রান্না করে, সুস্বাদু করে খেতে শুরু করল, তখন থেকেই শুরু হল মানবসভ্যতার অগ্রগতি। অতএব খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে সভ্যতার একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গাঙ্গি যোগ রয়েছে, যেমন সভ্যতার সঙ্গে যোগ রয়েছে ব্যবহারিক এবং প্রযুক্তিবিদ্যাসমূহের, মানে অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স এবং টেকনোলজির।

এই তথ্যকে সামনে রেখেই স্যার, আমাদের প্রকাশন সংস্থা সম্প্রতি একটা বই প্রকাশ করেছেন। আপনাদের এই পৃথিবীর মতো আরও যেসব উন্নতিশীল সভ্যতা আছে, তাদের সে বই, বুঝতেই পারছেন স্যার, প্রচণ্ড কাজে লাগবে।’

এতক্ষণে শিশিরবাবু কিঞ্চিৎ সামলেছেন। জিজ্ঞেস করলেন ‘কী বই? রান্নার বই নাকি?’

শান্তিময় প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক ধরেছেন স্যার, একেবারে ঠিক ধরেছেন। রান্নার বইই বটে। তবে যেমন-তেমন রান্না নয়- আপনাদের পার্থিব উপাদান সমস্ত হিসাব করে, আপনাদের খাদ্যাভ্যাস হিসাব করে, অন্তত পঞ্চাশটি নীহারিকাপুঞ্জের পনেরো হাজার প্রধান পাচক এবং কম্পিউটারের সাহায্যে বানানো একশো-টি ফর্মুলা। প্রত্যেক গ্রহের আলাদা আলাদা এডিশন। এমন সব রান্না আপনারা কখনো চাখার সুযোগ পাননি। আর, একবার পেলে, আপনাদের উন্নতির গতি রোধ করে কার সাধ্য! ‘

শিশিরবাবু এখনও সম্পূর্ণ শান্ত। বললেন, ‘এই জন্যে আপনি আমার কাছে এসেছেন? রান্নার বই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্রির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে?’

শান্তিময় বিনয়ে বিগলিত হয়ে বললেন, ‘ঠিক তাই, স্যার। কাজটা কঠিন আমি জানি। আমি যদি নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বা অ্যাডভান্সড বায়ো কেমিস্ট্রির মতো শিশু-পাঠ্য কয়েকটা সাবজেক্টের ওপর রংচঙে ছবিওলা কিছু বই আনতুম, তাহলে সেগুলো যে এই সব গ্রহে হু-হু করে বিক্রি হয়ে যেত, তা আমি বুঝি। কিন্তু স্যার, আপনাদের প্রকৃত উন্নতি ওসব বইয়ে নেই, আছে আমাদের প্রকাশিত এই ‘নিম্নস্তরের সভ্যতার উন্নতির জন্য প্রগতিশীল রন্ধনপ্রণালী’ বইটিতে। এই যে স্যার কবার নেড়েচেড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন।’ বলে ভদ্রলোক তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা সবুজ রঙের মলাটওলা বই বের করে শিশিরবাবুর হাতে দিলেন। বললেন, ‘ছাপা বাঁধাইটাও দেখবেন স্যার। এটা বাংলায়, অন্যান্য ভাষার কপিও করে দেওয়া যাবে।’

বইটা নিতে শিশিরবাবু খুব একটা উৎসাহিত বোধ করলেন না। তাহলেও নিলেন। তারপর দীনদয়ালকে বললেন, ‘দীনদয়াল, একবার ভেতরে গিয়ে বউদিকে এখানে আসতে বল তো। এ বই সে যতটা বুঝবে, আমি হয়তো ততটা বুঝতে পারব না।’

শান্তিময় মৃদু হেসে বললেন, ‘ও দীনদয়াল নয়, স্যার। তবে অনেকটাই দীনদয়ালের মতো দেখতে, তাই না? ও আমার সহকর্মী এসানর প্রিংপুটি বা প্রিয়ব্রত মিত্র। ‘

শিশিরবাবুর আর আশ্চর্য হওয়ার ক্ষমতা নেই। বললেন, ‘তাই নাকি? দীনদয়ালটা তাহলে গেল কোথায়?’

‘সে ঠিক আসবে স্যার। আপনি ততক্ষণ বইটা দেখুন। আপনি পণ্ডিত ব্যক্তি, আপনি দেখলেই হবে।

দীনদয়ালের দিকে একবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন শিশিরবাবু — এসানর প্রিংপুটি? সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বিরাট ধাপ্পা নয়তো। সে বিচার আপাতত মুলতুবি রেখে বইটা খুলেই ফেললেন।

ছাপা বাঁধাই সত্যিই চমৎকার। বাংলা বইয়ে এমন কখনো নজরে পড়েনি। তারপর পড়তে শুরু করলেন। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্যে নয়। মিনিট দশেক বাদেই বই বন্ধ করে শিশিরবাবু মুখ তুলে শান্তিময়ের দিকে তাকালেন। ম্লান হেসে বললেন, ‘এই ব‍ই আপনি বিক্রি করতে চান? আপনি আশা করেন এই রন্ধনপ্রণালী অনুযায়ী আমরা রান্না করব আর আমাদের চরচর করে উন্নতি হবে?’

শান্তিময় চিন্তিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন স্যার, কোনো অসুবিধে আছে?’

শিশিরবাবু সে প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে বললেন, ‘অবশ্য, আপনাদের আর দোষ কী? আমাদের খানদানি ডাক্তারবাবুরাই যখন গরিব রুগিকে অম্লানবদনে পথ্য প্রেসক্রাইব করেন— মুরগির স্টু, আপেল সেদ্ধ আর গরম জলে এক পেগ ব্র্যান্ডি, তখন আপনারা লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে যে এই বই আমাদের উপকারার্থে বের করবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী। আপনাদের কম্পিউটার ঠিকই বলেছে যে এখানে গলদা চিংড়ি, পেস্তা, দারুচিনি, গাওয়া ঘি অথবা সুপার ফাইন চাল পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো ছোঁওয়া যায় কি? আপনাদের জগতে বোধ হয় সবাই সব কিছু পেতে পারে, এখানে কিন্তু তা নয়। আপনার এই রান্নার বই বিক্রি করা আমার সাধ্য নয় মশায়। যাকে রেকমেন্ড করব, সে আমাকে মারতে আসবে। আজ থেকে হাজার বছর বাদে হয়তো আমাদের দেশের অবস্থা আপনাদের মতোই হবে যখন সবাই সব কিছু ভোগ করতে পারবে। তখন হয়তো আপনার এই বইয়ের কাটতি হবে। তার আগে নয়।’

শান্তিময় যেন হতাশ হলেন। বললেন, ‘বলছেন, স্যার? আমাদের কম্পিউটার বলেছে যে আপনি কখনো বাজে কথা বলেন না, অতএব আপনার বিশ্লেষণ আমি অবশ্যই মেনে নেব। তবে মাত্র হাজার বছর তো? তা, হাজার বছর বাদে না-হয় আর একবার আসা যাবে। ততদিন আমরা অন্য গ্রহগুলোতে চেষ্টা করে দেখি।’ শিশিরবাবু আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়লেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো।’

তাহলে আমরা চলি স্যার। আপনাকে বিরক্ত করলুম, কিছু মনে করবেন না যেন।’

‘না, না, কী আশ্চর্য! তা আপনারা ফিরবেন কী করে?’

‘আমাদের মহাকাশযানে। ওই পাকুড় গাছটার পেছনে রাখা আছে।’

‘আমি একবার সেটা দেখতে পারি?’

‘পারবেন না স্যার। সেটা যে পদার্থ দিয়ে তৈরি, তা আপনাদের দৃষ্টিগোচর হবে না। মানে, আপনাদের দৃষ্টিশক্তি তো সীমাবদ্ধ, সেই জন্যে। আর হ্যাঁ, ভালো কথা, আপনার মালী দীনদয়াল, ওই ভাঙা ঘরটার মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। আমরা চলে গেলেই ওর জ্ঞান ফিরে আসবে। দেখবেন, তখন যেন ভয় না পায়। আপনি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেই হবে। নয়তো বলবেন, ও যা দেখেছে তা সবই স্বপ্ন।’

‘কী দেখেছে সে?’

‘তেমন কিছু নয়। আমাদের আসল চেহারাটা তো ঠিক আপনাদের মতো নয়, হঠাৎ দেখলে ভয় পাওয়ারই কথা!’

‘একটা প্রশ্ন। আপনাদের হাতে ওই যন্ত্রগুলো কী?’

‘এগুলো অনুবাদক যন্ত্র। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো ভাষায়, যেকোনো ফ্রিকোয়েন্সিতে এ কথা বলতে পারে। আমরা তো এর মধ্য দিয়েই আপনার সঙ্গে কথা বলছি। আমাদের গলার শব্দ তো আপনার পক্ষে শোনা সম্ভব নয়। মানে, আপনাদের শ্রবনশক্তি তো সীমাবদ্ধ, সেই জন্যে। আচ্ছা, তা হলে চলি, স্যার। আবার দেখা হবে। নমস্কার।’

শিশিরবাবুর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। কোনো কথা না-বলে দু-হাত তুলে নমস্কার করলেন।

দু-জনে পাকুড় গাছটার দিকে রওনা হলেন। কিন্তু কিছুটা গিয়েই দাঁড়িয়ে গেলেন। শিশিরবাবু কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেন, ওঁদের দেখে হয়তো হাত নাড়তে নাড়তে বিজয়া এগিয়ে আসছেন। কাছে এসে উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘এই যে, তোমরা এখানে। তোমার বড়ো ছেলে ফোন করেছিল, তারা আজ বিকেলে এসে পৌঁছোবে। শিগগির বাড়ি এসো, সব ব্যবস্থা করতে হবে না?’ বলেই পেছন ফিরে হনহন করে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।

একটু দূর থেকে দৃশ্যটা দেখে হঠাৎ শিশিরবাবুর মনে পড়ল, ওই ক্রেংকাঢ়ি নিকাষোক ঠিক তাঁর মতো দেখতে। অবিকল এক, এমনকী গলার স্বরটা পর্যন্ত। আবার তাঁর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। দীনদয়ালকে তো বটেই, নিজেকেও বোঝাতে হবে, স্বপ্নই দেখেছেন। হাতের বইটা কুয়োর মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিয়ে শিশিরবাবু বাড়ির দিকে রওনা হলেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন