চন্দ্রদেবতার মূর্তি

হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

চন্দ্রদেবতার মূর্তি

সমুদ্রের তটরেখা বরাবর গাড়িটা ছোটাচ্ছিল অতনু৷ তার পাশে বসে আছেন মিউজিয়ামের অধিকর্তা ডক্টর বিনায়ক মাথুর৷ কিছুটা তফাতেই সমুদ্রের উচ্ছল তরঙ্গরাশি এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তটরেখা৷ সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন মাথুর৷ গতকাল সারারাত এভাবেই সমুদ্রতট বরাবর গাড়ি চালিয়ে এসেছে অতনু৷ গন্তব্য তার জানা নেই৷ মাথুর সাহেব যেমন বলছেন তেমনই এগোচ্ছে সে৷ এদিকের পথঘাটও তেমন চেনা নেই তার৷ মাসখানেক আগে আমেদাবাদের মিউজিয়ামে চাকরি নিয়ে আসার পর এই প্রথম সে শহর ছেড়ে বেরোল৷ মিউজিয়ামে চাকরি করলেও অতনু কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদ বা জীবাশ্মবিদ এ ধরনের কেউ নয়৷ অতনুর চাকরিটা মিউজিয়ামের কম্পিউটার বিভাগের৷ মিউজিয়ামের নানা জিনিসের ক্যাটালগ ইত্যাদি তাকে নথিভুক্ত করতে হয় কম্পিউটারে৷ আর অঘোষিত ভাবে তাকে মাথুর সাহেবের আপ্ত সহায়কের কাজও করতে হয়৷ প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পণ্ডিত ব্যক্তি মাথুর সাহেব৷ বিশেষত প্রাচীন মূর্তি নিয়ে তাঁর অনেক গবেষণা ও বইপত্তর আছে৷ তিনি বেশ স্নেহ করেন অতনুকে তার কাজের জন্য৷ সম্প্রতি গুজরাটের বিভিন্ন মন্দির, সংগ্রহশালা বা ব্যক্তিগত হেফাজতে যে সব প্রাচীন মূর্তি আছে তার একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা বা ক্যাটালগ তৈরি করছেন মাথুর৷ সে কাজে তাঁকে উদয়-অস্ত সাহায্য করছে অতনু৷ সূর্যের আলো ফোটার পর বালুতট বেয়ে এগোতে এগোতে বেশ কয়েকবার অতনুর মনে হয়েছে যে সে মাথুর সাহেবকে জিগ্যেস করে যে তাদের গন্তব্য কোথায়? কিন্তু মাথুর সাহেব এমন চিন্তামগ্ন হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন যে অতনু তাঁকে প্রশ্নটা করে উঠতে পারছে না৷ কথা বললে হয়তো তাঁর চিন্তাজাল ছিন্ন হতে পারে৷ পণ্ডিত মানুষ, কতরকম ভাবনা ঘোরে তাঁর মাথায়৷ মাইলের পর মাইল নির্জন সমুদ্রতট, কোথাও কোনো লোকবসতি নেই৷ এদিকে কোনো মেছো বন্দরও নেই৷ তার মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগল অতনু৷ ঘড়ির কাঁটাও ঘুরতে লাগল তার সঙ্গে সঙ্গে৷

সামনের দিকে চোখ রেখেই গাড়ি চালাচ্ছিল অতনু৷ এভাবে চলতে বেশ একঘেয়েও লাগছিল মাঝে মাঝে৷ হঠাৎ একসময় অনেক দূরে সমুদ্রতট যেখানে ধনুকের মতো বাঁক নিয়েছে সেই বাঁকের শেষ প্রান্তে একটা কালো বিন্দু যেন চোখে পড়ল অতনুর৷ যেন আকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেটা৷ হ্যাঁ, কিছু একটা আছে সেখানে! একটু ইতস্তত করে সে এবার সেটার প্রতি মাথুর সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘স্যার, ওটা কী? লাইট হাউস নাকি?’

অতনুর কথা শুনে মাথুর তাকালেন সেদিকে৷ ধীরে ধীরে আবছা হাসি ফুটে উঠল তাঁর ঠোঁটের কোণে৷ তিনি বললেন, ‘আমরা সম্ভবত জায়গাটাতে পৌঁছে গেছি৷ যদিও আমি কোনোদিন ওখানে যাইনি, তবু ওটাই হবে৷’

অতনু আবার প্রশ্ন করল, ‘ওটা কী স্যার?’

উৎসাহী চোখে সেদিকে তাকিয়ে মাথুর বললেন, ‘ওটা একটা প্রাচীন মন্দির৷ অনেক প্রাচীন৷ হাজার বছর বয়স হবে৷’

এ কথা বলার পর তিনি যেন একটু আশঙ্কিত ভাবে স্বগতোক্তি করলেন, ‘কিন্তু এখনও সেটা ওখানে আছে তো? শেষ যিনি সেটা দেখেছিলেন, ছবি তুলেছিলেন তারপর পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে…’

অতনু জানতে চাইল, ‘কী জিনিস স্যার?’

মাথুর বললেন, ‘আগে জায়গাটায় পৌঁছই তারপর বলছি৷’

তাঁর নির্দেশমতো অতনু গাড়ি নিয়ে এগোল সেদিকে৷ ক্রমশ তাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হতে লাগল এক প্রাচীন কাঠামোর অবয়ব৷ সমুদ্রের তটরেখা ঢালু হয়ে এগিয়েছে সেদিকে৷

একসময় তারা পৌঁছে গেল সেই মন্দিরের সামনে৷ না, ঠিক সামনে নয়৷ মন্দির থেকে বেশ খানিকটা তফাতেই তাদের থামতে হল৷ সামনের বালি খুব নরম৷ বোঝাই যায় জোয়ারের জল ভাসিয়ে দেয় জায়গাটাকে৷ গাড়ি আর এগোলে বসে যাবে মাটিতে৷ কিট ব্যাগ দুটো কাঁধে নিয়ে তারা এগোল মন্দিরের দিকে৷ বলা ভালো সেই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের দিকে৷ একদম সমুদ্রের গায়েই মন্দিরটা৷ সমুদ্রের জলরাশি এসে আছড়ে পড়ছে তার গায়ে৷ একসময় নিশ্চয়ই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হত মন্দির প্রাঙ্গণে৷ অন্তত নিশ্চয়ই মাটি থেকে কুড়ি ফুট উঁচু ছিল মন্দির প্রাঙ্গণ৷ সেটা এখন মাটির গভীরে বসে গেছে৷ মন্দির চত্বর আর সমুদ্রতল প্রায় সমতলে চলে এসেছে৷ যে পঁচিশ-তিরিশ ফুট স্তম্ভগুলো দিয়ে মন্দিরের ছাদগুলোকে ধরা ছিল তার বেশ কটা ভেঙে গিয়ে সমুদ্রের জলে খসে পড়েছে৷ বিশেষত সমুদ্রের জলরাশি মন্দিরের যে দিকে এসে গুম গুম শব্দ তুলে ধাক্কা মারছে সেদিকের স্তম্ভগুলো এমনভাবে সমুদ্রের দিকে ঝুঁকে গেছে যে মনে হয় এই বুঝি পুরো মন্দিরটাই হুড়মুড় করে সমুদ্রে ভেঙে পড়বে৷ সেদিকেই হেলে আছে মন্দিরটা৷ তবুও চত্বরটার ওপর এখনও বেশ কিছু ঘর দাঁড়িয়ে আছে, আর অদ্ভুতভাবে মহাকালকে অতিক্রম করে আজও দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরের লম্বাটে চুড়োটা৷ যেটা দূর থেকে দেখতে পেয়েছিল অতনুরা৷ যদিও তার গায়ের সব অলঙ্করণ খসে পড়েছে সমুদ্রের নোনা বাতাসে, মন্দিরচুড়োর ফাটলগুলোতে কাঠকুটো দিয়ে বাসা বেঁধেছে সাদা গাঙচিলের দল, তবু সে এখনও দাঁড়িয়ে আছে৷ মন্দির চত্বরে বা চারপাশে কোথাও কোনো লোকজন নেই৷ শব্দ বলতে শুধু পাথরের গায়ে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ৷

গাড়ি থেকে নেমে তারা দুজন এগোল সেদিকে৷ যেতে যেতে অতনু বলল, ‘স্যার, এ মন্দির কে বানিয়েছিলেন? এর ইতিহাস কী? এ কার মন্দির?’

মন্দিরের দিকে চোখ রেখে এগোতে এগোতে মাথুর জবাব দিলেন, ‘যতটুকু জানি এটা চন্দ্রদেবতার মন্দির৷ দশম শতাব্দী নাগাদ নির্মিত হয়েছিল৷ মন্দিরের গঠনশৈলী দেখেও আমার তাই ধারণা হচ্ছে৷ তবে এ মন্দির নিয়ে এখনও তেমন কিছু কাজ করা হয়নি৷ দুজন গবেষক অবশ্য কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন৷ তাঁদের একজন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ কানিংহামের এক সহকারী, আর অম্বিকা শাহ নামের স্থানীয় এক গুজরাটি প্রত্নতত্ত্ববিদ৷ অম্বিকাই শেষ এসেছিলেন এখানে পঞ্চাশ বছর আগে৷ মন্দিরের বেশ কিছু জিনিসের ছবিও তুলেছিলেন৷ তার একটা আমার কাছে আছে৷ তবে কানিংহামের সেই সহকারী বা অম্বিকা কেউই কাজ শেষ করতে পারেননি৷ তার আগেই তাঁদের মৃত্যু হয়৷ অম্বিকা এ মন্দির প্রসঙ্গে সামান্য কিছু লিখে গেছেন মাত্র৷’

অতনু বলল, ‘এত প্রাচীন মন্দির নিয়ে আর কেউ কাজ করেননি? আর এ মন্দিরে তো পূজা-পাঠ হয় বলেও মনে হয় না৷’

মাথুর হেসে বললেন, ‘মন্দিরময় দেশ ভারতবর্ষ৷ এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে কত মন্দির ছড়িয়ে আছে তার সঠিক হিসাব কেউ জানে না৷ তাছাড়া এসব ভাঙা মন্দির নিয়ে ক’জনেরই বা আগ্রহ থাকে৷ মূর্তির ক্যাটালগ তৈরি করতে গিয়ে আমি একটা ছবি পেলাম আর সেই সূত্র ধরে অম্বিকা শাহর একটা লেখা পড়ে এ মন্দিরের ব্যাপারে আগ্রহ জাগল৷ হ্যাঁ, এ মন্দিরে পুজো হয় না৷ তবে পঞ্চাশ বছর আগে তিনি যখন এখানে এসেছিলেন তখন এখানে একজন পুরোহিতের মতো লোককে দেখেছিলেন৷ সেই বৃদ্ধ লোকটার কপালে নাকি অর্ধচন্দ্রের মতো অদ্ভুত দাগ ছিল৷ এখন নিশ্চয়ই সে লোক বেঁচে নেই৷ তবে সে সময়ও এ মন্দিরে লোকে পুজো দিতে আসত না৷ কাছে লোকালয় বলতে মাইল পাঁচেক দূরে একটা গ্রাম ছিল সে সময়৷ গবেষক অম্বিকা সে গ্রামে গিয়ে শুনেছিলেন তারা কেন এড়িয়ে চলে এ মন্দিরকে৷ তারা ভয় পেত এ মন্দিরটাকে৷’

মন্দির চত্বরের সামনে এখনও যে দু-ধাপ সোপান আছে সেখানে পৌঁছে গেছে অতনুরা৷ সে মাথুর সাহেবের কথা শুনে প্রশ্ন করল, ‘কেন? তারা মন্দিরটাকে এড়িয়ে চলত কেন?’

মাথুর মৃদু হেসে বললেন, ‘প্রাচীন জনশ্রুতি, এই মন্দির চত্বরে পা রাখলে কেউ বাঁচে না৷ মন্দিরে একসময় তো ধনরত্ন, সোনাদানা থাকত৷ এ মন্দির যে সময় হয় তখন তুর্কিরা মন্দিরে মন্দিরে হানা দিত তার লোভে৷ সম্ভবত সে কারণেই সে সময় এ কথা প্রচার করা হয়েছিল বলে আমার ধারণা৷ যুগ যুগ ধরে সে গল্প আজও বহমান৷’ এ কথা বলে তিনি সোপান বেয়ে মন্দির চত্বরে পা রাখলেন৷ তাঁর পিছন পিছন সেখানে উঠল অতনুও৷

৷৷ ২৷৷

চত্বরের একটা অংশও জলে ভেজা৷ বোঝাই যায় জোয়ারের জলে ধুয়ে যায় জায়গাটা৷ হয়তো বা সে সময় জল প্রবেশ করে মন্দিরের ভিতরেও৷ সমুদ্রের জলে ভেসে আসা ছোট ছোট ঝিনুক ছড়িয়ে আছে জায়গাটাতে৷ সূর্যকিরণে ঝলমল করছে ছোট ছোট ঝিনুকের কুচিগুলো৷ তারা দুজনে সেই ভগ্ন মন্দির প্রাঙ্গণে পা রাখতেই একদল গাঙচিল সম্ভবত তাদের দেখে ভয় পেয়ে ডানা মেলে কর্কশ ডাক ছেড়ে উড়ে গেল সমুদ্রের মাথার আকাশে৷ তাদের চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল মন্দির চত্বরে৷ মন্দিরের ভিতরে কক্ষগুলো যেখানে আছে সেখানে খেলা করছে আধো-অন্ধকার৷ অতনুরা সেদিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সে সময় তারা দেখতে পেল একজনকে৷ জটাজূটধারী একজন লোক! পরনে তাঁর নামমাত্র বস্ত্রখণ্ড৷ মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে একটা বিশাল থাম গোড়া থেকে উপড়ে ঢালু হয়ে নেমে গেছে সমুদ্রের জলে৷ সেই পাটাতন বেয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে উঠে আসছেন সেই লোকটা৷ তাঁকে দেখে মন্দিরের ভিতরে না ঢুকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা দুজন৷ লোকটি উঠে এসে দাঁড়ালেন তাদের সামনে৷ বৃদ্ধের চোখে ফুটে উঠেছে মৃদু বিস্ময়ের ভাব৷ তার যে দুটো জিনিস অতনুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল তা হল বৃদ্ধের হাতে ধরা একটা রাজকাঁকড়া৷ তার লেজের মতো অংশটা মুঠোতে ধরে আছেন তিনি৷ ঝুলন্ত প্রাণীটা এখনও জ্যান্ত৷ মাঝে মাঝে নড়ছে৷ আর একটা জিনিস হল বৃদ্ধের কপালে সূর্যের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা অদ্ভুত চিহ্ন৷ কেউ যেন একটা অর্ধচন্দ্র এঁকে দিয়েছে তাঁর কপালে৷ না, সেটা রঙে আঁকা বা কোনো উল্কি নয়, চামড়ার ওপরই আঁকা জন্মদাগ৷ তবে কি এই সেই বৃদ্ধ যাঁকে সেই গবেষক পঞ্চাশ বছর আগে দেখেছিলেন! হতে পারে, অতনু কোথায় যেন শুনেছিল যে অনেক সাধু-সন্ন্যাসী নাকি এক-দেড়শো বছর বাঁচেন!

প্রাথমিক দৃষ্টি বিনিময়ের পর সেই বৃদ্ধ জানতে চাইলেন, ‘তোমরা কারা? এখানে এলে কীভাবে?’

মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই, তাই মাথুর নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমরা সরকারি লোক৷ শুনেছি এ মন্দিরে একটা মূর্তি আছে সেটা দেখতে এসেছি৷ চন্দ্রদেবতার মূর্তি৷ এখানে কি সেটা আছে? আপনি কে?’

বৃদ্ধ একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, এর আগেও তোমাদের মতো কিছু লোক এখানে এসেছিল বটে৷ একবার এক সাহেব, আর একবার একজন দেশীয় লোক; অম্বিকা নাম তার৷ আমি এই মন্দিরেই থাকি৷ ওই চন্দ্রদেবতার পূজারী বা উপাসক বলতে পার৷’

অতনুরা মৃদু চমকে উঠল লোকটার কথা শুনে৷ তাহলে এ লোকটাকেই দেখেছিলেন সেই প্রত্ন গবেষক অম্বিকা শাহ! আর কানিংহামের সহকারী সেই সাহেবকে যদি লোকটা তাঁর দেখা সাহেব বলে থাকেন তবে লোকটার বয়স কত? দেড়-দুশো বছর নাকি!

বিস্ময় গোপন করে মাথুর বললেন, ‘যাক নিশ্চিন্ত হলাম৷ আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে মূর্তিটা এখনও আছে৷ সেটা দেখব আমরা৷’

তাঁর কথা শুনে মুহূর্তখানেক কী যেন ভাবলেন বৃদ্ধ৷ তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে আমার সঙ্গে এসো৷’

বৃদ্ধের পিছন পিছন মন্দিরের ভিতর আধো-অন্ধকার গোলকধাঁধায় এরপর প্রবেশ করল তারা৷ স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ মন্দিরের ভিতর৷ আবছা আলোতে তারা যতটুকু বুঝতে পারছে তাতে একসময় অসম্ভব সুন্দর অলঙ্করণ ছিল মন্দিরের ভিতর৷ এখনও তারা সময়কে অগ্রাহ্য করে কোথাও কোথাও জেগে আছে৷ চন্দ্রদেবতার উপাসককে অনুসরণ করে বেশ কয়েকটা জীর্ণ কক্ষ অতিক্রম করে তারা এসে উপস্থিত হল মন্দিরের গর্ভগৃহে৷ বেশ বড় একটা ঘর৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা স্তম্ভ মাটি থেকে ওপরে উঠেছে৷ সেই স্তম্ভের গায়ে মাটি থেকে ফুট পাঁচেক ওপরে একটা খোপের মতো জায়গা৷ আর সেই খোপ বা কুলুঙ্গির মধ্যে অবস্থান করছে দণ্ডায়মান চন্দ্রদেবের প্রস্তরখচিত মূর্তি৷ সম্ভবত মূর্তিটা কষ্টিপাথরের হবে৷ আকারে তিন ফুট মতো৷ মাথার ওপরের ছাদে একটা ছোট গোলাকার ছিদ্র আছে৷ তা দিয়ে আলো এসে পড়েছে স্তম্ভের কুলুঙ্গিতে রাখা মূর্তির ওপর৷ তাঁর মাথার পাথরখোদিত মুকুটে জ্বলজ্বল করছে কী যেন একটা পাথর৷ গলায় তাঁর ঝিনুকমালা৷ মাথুর পকেট থেকে একটা সাদা-কালো ছবি বার করলেন৷ পঞ্চাশ বছর আগে আসা সেই গবেষকের তোলা ছবি৷ সে ছবির সঙ্গে মূর্তিটাকে মিলিয়ে নিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, ‘হ্যাঁ, এটাই সেই চন্দ্রদেবতার মূর্তি৷ অন্তত হাজার বছর বয়স হবে মূর্তিটার৷ এ মূর্তি কোনো মিউজিয়ামে নেই!’ এরপর তিনি ভালো করে মূর্তিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘মূর্তিটার মাথায় ওটা কী জ্বলজ্বল করছে?’

পূজারী অতনুদের বেশ অবাক করে দিয়ে জবাব দিলেন, ‘ওটা হল চন্দ্রকান্ত মণি৷’

বিস্মিত গলায় মাথুর বললেন, ‘তাই নাকি? আর মূর্তিটা কি পাথরের তৈরি?’

তিনি উত্তর দিলেন, ‘চাঁদের পাথর৷’

চাঁদের পাথর! এ কথাটা অবশ্য বিশ্বাস হল না তাদের দুজনের কারোরই৷ তবে মূর্তির মাথার ওই উজ্জ্বল রত্ন আর মূর্তিটা যে অত্যন্ত মূল্যবান তা বুঝতে অসুবিধা হল না তাদের দুজনের৷ মাথুর সেই বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এমন দুর্মূল্য একটা জিনিস এখানে এমন অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে!’

চন্দ্রদেবতার উপাসক মৃদু হেসে বললেন, ‘অরক্ষিত নয়, দেবতা নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারেন৷ যুগ যুগ ধরে কতবার কতজন এখানে হানা দিল ওই চন্দ্রকান্ত মণির লোভে৷ কখনও তুর্কি মামুদের অনুচররা, আবার কখনও সমুদ্রপথে হার্মাদের দল৷ হ্যাঁ, তারা মন্দিরগাত্রের সোনা-রুপোর অলঙ্করণ খুলে নিয়ে গেছে ঠিকই, ওই সময় এই স্তম্ভগুলো সোনা-রুপোর পাতে মোড়া ছিল, সে সব নিয়ে গেলেও বিগ্রহ বা এই চন্দ্রকান্ত মণি হরণ করতে পারেনি তারা৷ দেবতা নিজেই নিজেকে রক্ষা করেছেন৷’

অতনু কথাটা শুনে বলে উঠল, ‘কীভাবে রক্ষা পেল এই বিগ্রহ?’

বৃদ্ধ এ প্রশ্নর সরাসরি জবাব না দিয়ে বললেন, ‘বললাম তো দেবতা নিজেই নিজেকে রক্ষা করেন৷ মামুদ সোমনাথ বিগ্রহ ধ্বংস করলেও এ বিগ্রহ ধ্বংস করতে পারেনি৷ তার সেনারা পালিয়েছিল এ মন্দির ছেড়ে৷’ তাঁর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন থরথর করে কাঁপতে লাগল চারপাশ৷ সম্ভবত জলস্রোতের ধাক্কায় মন্দিরটা কেঁপে উঠল৷ মন্দিরটা ভেঙে পড়বে না তো? একটু ভয় পেয়ে গেল অতনু৷ মাথুর সাহেব এরপর মূর্তিটাকে ভালো করে কাছ থেকে দেখার জন্য হাত কুড়ি দূরে স্তম্ভটার দিকে এগোতে যাচ্ছিলেন কিন্তু চন্দ্রদেবতার উপাসক সেই বৃদ্ধ মাথুর সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আর তোমাদের এখানে থাকা নিরাপদ নয়৷ চলো বাইরে গিয়ে কথা বলি৷’

মন্দিরটা কাঁপছে৷ হয়তো বা তা ভেঙে পড়তে পারে, সে জন্যই তিনি কথাটা বলছেন৷ এ কথা ভেবে নিয়ে মাথুর সাহেব একটু অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইরে বেরোবার জন্য অনুসরণ করলেন তাঁকে৷

রৌদ্রকরোজ্জ্বল মন্দির প্রাঙ্গণে আবার এসে দাঁড়াল তারা৷ তাদের নিয়ে মন্দিরের ভগ্নপ্রান্তের সামনে এসে উপস্থিত হলেন সেই বৃদ্ধ৷ যেদিকে হেলে আছে মন্দিরটা, সমুদ্রের ঢেউ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে মন্দিরকে৷ সেদিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বললেন, ‘আজ পূর্ণিমা৷ চন্দ্রদেবতার উপাসনার দিন৷ তাই সমুদ্রের এত জলোচ্ছ্বাস৷ এই মূর্তিটা সমুদ্র থেকে তুলে আনা হয়েছিল একদিন৷’

মাথুর সাহেব জানতে চাইলেন, ‘আপনার বয়স কত? কতদিন আছেন এখানে?’

তিনি বললেন, ‘কোনো হিসাব নেই৷ আমি বহু যুগ আছি এখানে৷ মামুদের সেনাদলকে আমি হানা দিতে দেখেছি এখানে৷ কত মানুষকে হত্যা করল তারা৷ আমি সমুদ্রে নেমে গেছিলাম বলে তারা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি৷ বিগ্রহটাকে তারা উৎপাটিত করে প্রথমে ভাঙার চেষ্টা করে৷ ভাঙার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ায় সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি৷ কিছুদূর গিয়ে তারা মূর্তিটা ফেলে পালায়৷ আমি আবার তাকে তার নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠা করি৷ হার্মাদরাও মূর্তিটা নিয়ে একই চেষ্টা করেছিল৷ পারেনি৷’

মামুদ! সে তো হাজার বছর আগের ঘটনা! লোকটার বয়স একশো বছর পেরোতে পারে, কিন্তু তা বলে কোনো লোকের পক্ষে হাজার বছর বাঁচা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ এই নির্জন মন্দিরে বহু বছর ধরে একলা থাকতে থাকতে নিশ্চয়ই লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! তাঁর এই কথাটা বিশ্বাস করল না মাথুর সাহেব বা অতনু৷ মাথুর সাহেব তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ‘এখানে তো কোনো লোকজন নেই তবে কীভাবে বেঁচে আছেন আপনি? খাবারের যোগান আসে কীভাবে?’

বৃদ্ধ তাঁর হাতে ধরা রাজকাঁকড়াটা তুলে ধরে বললেন, ‘এই কাঁকড়া খেয়ে৷ এছাড়া আমি অন্য কিছু খাই না৷ এই কাঁকড়া খেয়েই আমি বেঁচে আছি৷ তাও রান্না করা নয় কাঁচাই খাই৷ সর্বরোগহরা এই কাঁকড়া৷’

প্রাণীটাকে কাঁচা খাওয়ার কথা শুনেই অতনুর গা-টা গুলিয়ে উঠল৷

মাথুর সাহেব মূর্তিটা দেখার পর থেকেই মূর্তিটার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন৷ তাই তিনি এরপর কোনো রাখ-ঢাক না করেই সেই বৃদ্ধের উদ্দেশে বললেন, ‘এভাবে এখানে এই দুর্মূল্য মূর্তি পড়ে থাকা বিপজ্জনক৷ যে কোনো দিন মূর্তিটা চোর-ডাকাত এসে নিয়ে যেতে পারে৷ তাছাড়া মন্দিরটা যেভাবে সমুদ্রের দিকে হেলে পড়েছে তাতে মূর্তিসমেত মন্দিরটা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হতে আর বেশি দেরি নেই৷ এ মন্দিরে কোনো পুজোও হয় না৷ তাই সরকারি তরফে মূর্তিটা নিয়ে যেতে আমাদের কোনো বাধা নেই৷ মূর্তিটাকে আমরা মিউজিয়ামে নিয়ে যাব৷ এটা তো সরকারি সম্পত্তি৷’

চন্দ্রদেবতার উপাসক তাঁর কথা শুনে একটু বিস্মিতভাবে বললেন, ‘মূর্তিটা নিয়ে যাবে? কীভাবে নিয়ে যাবে?’

মাথুর সাহেব জবাব দিলেন, ‘আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে৷ ওই ছোট মূর্তিটা নিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা হবে না আমাদের৷ আর আমাদের যদি সরকারি লোক বলে পরিচয়পত্র দেখেও আপনার বিশ্বাস না হয় তবে আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন আপনি৷’

বৃদ্ধ বললেন, ‘মূর্তিটা আপনারা নিয়ে যাবেন? আমি যদি বাধা দেই?’

মাথুর সাহেব শান্ত অথচ কঠিন স্বরে বললেন, ‘আশা করি আপনি তা করবেন না৷ তাহলে আমি পুলিশ-প্রশাসনের সাহায্য নিতে বাধ্য হব৷ এই অমূল্য জিনিসকে এভাবে এখানে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না৷ মিউজিয়ামে নিয়ে গেলে বহু মানুষ মূর্তিটা দেখতে পাবে৷ সরকারি হেফাজতে সুরক্ষিত থাকবে চন্দ্রদেবতার মূর্তি৷’

মাথুরের কথা শুনে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল চন্দ্রদেবতার উপাসকের মুখে৷ তারপর তিনি বলে উঠলেন, ‘যে মূর্তি মহাপরাক্রমশালী মামুদ শাহর সেনারা নিয়ে যেতে পারেনি, ভয়ঙ্কর হার্মাদ জলদস্যুরা নিয়ে যেতে পারেনি সে মূর্তি তোমরা নিয়ে যাবে!’ এই বলে পরম কৌতুকে যেন অট্টহাস্য করে উঠলেন তিনি৷ তাঁর হাসি মিলিয়ে যেতে লাগল সমুদ্র-গর্জনের সঙ্গে৷ তারপর একসময় তিনি হাসি থামিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, ‘ও কাজ তোমরা ভুলেও করতে যেও না৷ ও মূর্তি স্পর্শ করলে তোমাদের মৃত্যু অবধারিত৷ যেমন মরেছিল তুর্কি সেনারা, জলদস্যুরা৷ সাধারণ চোরদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম৷ এমন কী মন্দিরের গর্ভগৃহে থাকলেও তোমাদের বিপদ হতে পারে৷ তাই তোমাদের বাইরে আনলাম সেখান থেকে৷ আমার অনুরোধ তোমরা মন্দির ছেড়ে চলে যাও৷ আমি এখন বিশ্রাম নিতে যাব৷ আজ চন্দ্রদেবতার উপাসনার তিথি৷ তার জন্য সন্ধ্যাবেলায় ঝিনুক সংগ্রহ করতে যেতে হবে আমাকে৷ চলে যাও তোমরা৷’ এই বলে তিনি প্রাঙ্গণ ছেড়ে এগোলেন মন্দিরের অন্তঃপুরে৷

৷৷ ৩৷৷

চলে গেলেন সেই বৃদ্ধ৷ অতনুরা দাঁড়িয়ে রইল সেই মন্দির চত্বরে৷ সূর্য মাথার ওপর৷ বেলা প্রায় একটা বাজে৷ বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সেখানে তারা দুজন দাঁড়িয়ে রইল৷ সমুদ্রের গর্জন মাঝে মাঝে কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে৷ মৌনতা ভঙ্গ করে অতনু একসময় জিগ্যেস করল, ‘তবে কি করবেন স্যার?’

‘লোকটা আমাদের ভয় দেখিয়ে গেল৷ আসলে মূর্তির অধিকার ও ছাড়তে চায় না৷ তবে মধ্যযুগের অশিক্ষিত তুর্কি বা হার্মাদ আর আমি এক নই যে লোকটার কথা শুনে ভয় পাব৷ চলো আপাতত গাড়িতে ফেরা যাক৷ খুব খিদে পেয়েছে৷ খেতে হবে৷ তারপর কর্তব্য স্থির করা যাবে৷’

মন্দির প্রাঙ্গণ ছেড়ে নীচে নামার জন্য এগোল তারা৷ হঠাৎ একটা স্তম্ভের পাশে স্তূপাকৃত রাজকাঁকড়ার খোল দেখতে পেল তারা৷ সম্ভবত সেই লোকটার ভুক্তাবশেষ জমা হয়ে আছে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে৷ সেটা চোখে পড়তেই মাথুর বললেন, ‘কোন একটা জার্নালে যেন পড়ছিলাম যে এই রাজকাঁকড়া থেকে বিজ্ঞানীরা নাকি ক্যানসারের প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা করছেন৷ এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা মনে পড়ে গেল৷ কাঁকড়া-কর্কট-ক্যানসার৷ গবেষক অম্বিকা শাহ আর কানিংহামের সেই ব্রিটিশ সঙ্গী দুজনেই নাকি ক্যানসারে মারা গেছিলেন৷’

মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে তারপর মাথুর বললেন, ‘ভাগ্যিস অ্যান্টিক কারবারীরা এখনও এটার খোঁজ পায়নি, পেলে কবে হাতিয়ে নিত এটা৷ তাছাড়া মূর্তির মাথার মণিটা চন্দ্রকান্ত মণি হোক বা না হোক দুর্মূল্য কোনো পাথর তো বটে৷ ওটার দামই হয়তো বা লক্ষ লক্ষ টাকা৷ কোটি টাকা হওয়াও আশ্চর্য নয়৷ ভাগ্যিস মন্দিরে পা রাখলে মৃত্যু—এ কাহিনিটা প্রচলিত আছে৷ তাই অশিক্ষিত চোর-ডাকাতের দল ভয়ে হানা দেয়নি এখানে৷ মূর্তির ক্যাটালগ তৈরি করতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে আমি জানতে পারলাম এর কথা৷ ভাবছি পুলিশ নিয়ে কাল-পরশু আবার ফিরে আসব৷ লোকটা তখন ভয় পেয়ে নিশ্চয়ই আর বাধা দেবে না৷ তবে সে এতদিন ধরে মূর্তিটা আগলে রেখেছে৷ সে জন্য আমি চেষ্টা করব তাকে সরকারি তরফে আর্থিক সাহায্য করার….৷’ কথা বলতে বলতে তারা পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে৷

গাড়িতে কিছু খাবার ছিল তা দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সাঙ্গ করল তারা৷ তারপর গাড়িতে বসে সমুদ্রের জলস্রোতের দিকে তাকিয়ে তাঁর কর্তব্য নির্ধারণের চেষ্টা করতে লাগলেন মাথুর৷

বেশ কিছু সময় পর অতনু ডক্টর মাথুরকে প্রশ্ন করল, ‘তাহলে কি এবার রওনা হব স্যার?’

এবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন মাথুর৷ তিনি বললেন, ‘না, মূর্তিটা না নিয়ে আমি যাব না৷ হয়তো আমরা পুলিশ নিয়ে ফিরে আসার আগেই লোকটা সরিয়ে ফেলল মূর্তিটা৷ অথবা মন্দিরটা তলিয়ে গেল সমুদ্রতলে৷ মন্দিরটা কেমন কাঁপছে দেখেছ?’

‘তবে?’

অতনুর প্রশ্নর জবাবে মাথুর সাহেব বললেন, ‘লোকটা তো বলল যে চন্দ্রদেবতার উপাসনার জন্য মন্দির ছেড়ে সমুদ্রতটে ঝিনুক সংগ্রহ করতে যাবে৷ আমরা এখন এখানেই অপেক্ষা করব৷ এখন বেলা দুটো বাজে৷ শীতকাল, আর ঘণ্টা তিনেক পরই অন্ধকার নামতে শুরু করবে৷ তখন মন্দিরে ঢুকে মূর্তিটা সংগ্রহ করে গাড়িতে তুলে রওনা হব আমরা৷’

অতনু বলল, ‘কিন্তু স্যার, ব্যাপারটা কি ঠিক হবে? লোকটা যে বলল…’

অতনুকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মাথুর বললেন, ‘কী বলল? তুমি লোকটার ওসব কথায় বিশ্বাস করো নাকি? ওসব কথায় মধ্যযুগের লোকরা ভয় পেতে পারে, আমি পাই না৷ আমাদের মিউজিয়ামে এমন নানা প্রত্নসামগ্রী আছে যাদের সম্বন্ধে এমন নানা মিথ চালু আছে৷ জিনিসটা আমি নিয়ে যাবই৷’

অতনু আর কোনো কথা বলল না এরপর৷ সময় এগিয়ে চলল৷ দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল৷ তারপর একসময় সমুদ্রের বুকে রঙ ছড়াতে শুরু করল সূর্যদেব৷ তার আভা এসে পড়ল ভাঙা মন্দিরটার গায়ে৷ হাজার বছর ধরে এমন কত সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়ে আছে মন্দিরটা৷ সূর্য যখন প্রায় ডুবুডুবু ঠিক তখন অতনুরা দেখতে পেল মন্দির প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই উপাসক৷ তিনি প্রাঙ্গণ থেকে অতনুদের দিকে একবারও তাকালেন না৷ হয়তো তিনি তাঁদের উপস্থিতি খেয়াল করেননি৷ প্রাঙ্গণ থেকে নামলেন বৃদ্ধ৷ তারপর সমুদ্রতীর ধরে অতনুদের উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করলেন সম্ভবত কোথাও থেকে ঝিনুক সংগ্রহের জন্য৷ তাঁর অবয়ব যত ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল তত অন্ধকার নামতে লাগল সমুদ্রতটে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রদেবের আবির্ভাবের প্রস্তুতি শুরু হল৷

কিছু সময়ের জন্য অন্ধকারে ডুবে গেল পৃথিবী৷ চারপাশে শুধু সমুদ্রের অবিশ্রান্ত গর্জন৷ অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে সে৷ একসময় মাথুর বললেন, ‘চলো এবার যাওয়া যাক৷’ গাড়ি ছেড়ে তারা দুজন এগোল মন্দিরের দিকে৷ সত্যিই সমুদ্র যেন এগিয়ে আসছে৷ জোয়ারের জলে ভিজে যাচ্ছে পায়ের পাতা৷ সমুদ্রের গর্জন যেন তালা ধরিয়ে দিচ্ছে কানে৷ মন্দির প্রাঙ্গণে উঠে পড়ল অতনুরা৷ তারপর ধীরে ধীরে প্রবেশ করল অন্ধকার মন্দির গহ্বরে৷ অন্ধকার হাতড়ে তারা পৌঁছে গেল সেই গর্ভগৃহতেও৷ সেখানে পৌঁছে তারা দুজন বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ অন্ধকার ঘর কিন্তু যেন এক অদ্ভুত স্নিগ্ধ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে কুলুঙ্গিতে রাখা মূর্তিটার গা থেকে৷ চাঁদের আলোর মতোই স্নিগ্ধ-মায়াবী সেই আলো! মন্ত্রমুগ্ধের মতো, সম্মোহিতের মতো তারা চেয়ে রইল সেই মূর্তির দিকে৷ সে আলোর উজ্জ্বলতা যেন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে!

তবে একসময় সেই সম্মোহিত ভাব কাটিয়ে উঠে মাথুর বললেন, ‘সম্ভবত কোথা থেকে কোনো আলো এসে পড়েছে ওর ওপর৷ তাই অমন দেখাচ্ছে ওকে৷’

ঠিক এই সময় সমুদ্রের প্রবল গর্জন শোনা গেল৷ অতনু পায়ের তলায় জলের স্পর্শ অনুভব করল৷ মন্দিরের গর্ভগৃহে জল ঢুকছে৷ মৃদু মৃদু যেন কাঁপতে শুরু করেছে মন্দিরটা৷ মাথুর তা দেখে বললেন, ‘তুমি গাড়ির কাছে যাও৷ বলা যায় না সে পর্যন্ত জল পৌঁছলে গাড়ির চাকা বসে যেতে পারে৷ আমি মূর্তিটা নিয়ে আসছি৷ আর সময় নষ্ট করো না৷’

তাঁর নির্দেশ মেনে গর্ভগৃহ ছেড়ে বাইরে পা বাড়াল অতনু৷ পূর্ণিমার চাঁদ উঠতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে৷ প্রাঙ্গণে এসে অতনু বুঝতে পারল জল সত্যিই বাড়ছে৷ সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস উঠে এসেছে প্রাঙ্গণে৷ সেখান থেকে গাড়ির দিকে এগোল অতনু৷ পা ডুবে যাচ্ছে জলে৷ সেই জল ভেঙে গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল সে৷ জল প্রায় গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে৷ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রতীক্ষা করতে লাগল মাথুরের জন্য৷ চাঁদ আলো ছড়াতে শুরু করেছে মাথার ওপর৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই অতনু দেখতে পেল একটা আলো যেন বেরিয়ে আসছে মন্দিরের ভিতর থেকে৷ মাথুর সাহেব বেরিয়ে আসছেন মন্দির থেকে৷ অতনু বুঝতে পারল তাঁর বুকের কাছে জাপটে ধরা চন্দ্রদেবতার মূর্তিটাই সে আলো ছড়াচ্ছে! কিন্তু কষ্টিপাথরের মূর্তি থেকে কীভাবে এই আলোক বিচ্ছুরণ সম্ভব? বিস্মিত অতনু চেয়ে রইল সেদিকে৷

প্রাঙ্গণ ছেড়ে নীচে নামলেন মাথুর সাহেব৷ তারপর জল ভেঙে এগোতে লাগলেন গাড়ির দিকে৷ মাথার ওপর পূর্ণিমার চাঁদ যেন দ্রুত উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে চন্দ্রদেবতার মূর্তিটা! এগোচ্ছেন মাথুর সাহেব৷ হঠাৎ অতনুর মনে হল মাথুর সাহেব যেন টলতে শুরু করেছেন৷ হয়তো বা ভারী মূর্তিটা নিয়ে জল আর ভেজা বালিতে পা রাখতে গিয়ে টলছেন তিনি৷ প্রাথমিক ভাবে তাই ভেবেছিল অতনু৷ কিন্তু গাড়ির প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎই একটা আর্তনাদ করে উঠলেন মাথুর সাহেব৷ তারপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন! ঠিক সেই সময় প্রবল এক অট্টহাস্য কানে এল অতনুর৷ চন্দ্রালোকে সমুদ্র থেকে উঠে আসছেন একজন! সেই চন্দ্রদেবতার উপাসক! তাঁর অট্টহাস্য আর উত্তাল সমুদ্র-গর্জন মিলেমিশে এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে৷ লোকটা এগোচ্ছেন যেখানে মাথুর মূর্তিটাকে নিয়ে পড়ে আছেন সেদিকেই৷ প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে অতনুও এগোল সে জায়গার দিকেই৷ একই সময় বৃদ্ধ আর অতনু দু’পাশ থেকে পৌঁছে গেল সেখানে৷ তাদের মধ্যে হাত কুড়ি ব্যবধান, আর তাদের ঠিক মাঝখানে জলের মধ্যে মূর্তিটা নিয়ে পড়ে আছেন ডক্টর মাথুর৷ জল ভেদ করে আলোক বিচ্ছুরিত হচ্ছে মূর্তিটা থেকে৷ অতনু মাথুর সাহেবের দিকে এগোতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু সেই চন্দ্রদেবতার উপাসক অট্টহাস্য করে বলে উঠলেন, ‘আর এগিও না৷ তাহলে তোমার পরিণতি হবে এ লোকটার মতোই৷ মৃত্যু অনিবার্য তোমার৷ মামুদ পারেনি, হার্মাদরা পারেনি, তোমরাও নিয়ে যেতে পারবে না চন্দ্রদেবতাকে৷ আমি আগে দেবতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাই, তারপর তুমি তোমার সঙ্গীর দেহটা তুলে নিয়ে যেও!’

তাঁর কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অতনু৷ চাঁদের আলো এসে পড়েছে লোকটার মুখে৷ তাঁর কপালে ফুটে উঠেছে সেই অর্ধচন্দ্র৷ তিনি এগিয়ে এলেন জলের মধ্যে পড়ে থাকা মাথুরের দেহের কাছে৷ ঝুঁকে পড়ে আলিঙ্গনমুক্ত করলেন চন্দ্রদেবতাকে৷ তারপর তাঁকে নিয়ে এগোলেন সমুদ্রের বুকে৷

একসময় সম্বিত ফিরল অতনুর৷ সে ছুটে গিয়ে উঠিয়ে নিল মাথুর সাহেবের দেহটাকে৷ তারপর জলের মধ্যে দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে তাঁকে নিয়ে চলল গাড়ির দিকে৷ দেহটাকে যখন সে গাড়িতে উঠিয়ে চালকের আসনে উঠে বসল তখন এক অদ্ভুত ঘটনা প্রত্যক্ষ করল সে৷ চন্দ্রদেবতার উপাসক সমুদ্রের যেখানে দেবতাকে নিয়ে বিলীন হয়ে গেলেন ঠিক সেখানের সমুদ্র হঠাৎ যেন আলোকিত হয়ে উঠল৷ জলতল থেকে এক উজ্জ্বল আলোকবৃত্ত যেন উত্থিত হয়ে নিক্ষিপ্ত হল আকাশের দিকে৷ গর্জন করে উঠল সমুদ্র৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গেই সমুদ্রে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল হাজার বছরের প্রাচীন চন্দ্রদেবতার মন্দির!

পরিশিষ্ট: মাথুর সাহেবের মৃতদেহটা নিয়ে আমেদাবাদে ফিরে এসেছিল অতনু৷ ডাক্তাররা সে দেহ পরীক্ষা করে বলেছিলেন তীব্র তেজস্ক্রিয়তার কারণেই নাকি মৃত্যু হয়েছে মাথুর সাহেবের৷ ব্যাপারটা শুনে অতনুর মনে পড়ে গেছিল চন্দ্রদেবতার উপাসকের একটা কথা—মূর্তিটা চাঁদের পাথর দিয়ে তৈরি৷ চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল সেই দৃশ্য—সমুদ্রতল থেকে মহাকাশে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এক আলোক বলয়! তবে কে ছিলেন সেই চন্দ্রদেবতার উপাসক? যিনি হাজার বছর আগে দেখেছিলেন তুর্কি মামুদের হানাদার বাহিনীকে? আলোক বিচ্ছুরিত চন্দ্রদেবতার মূর্তিকে নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলেন? সমুদ্রতলে নাকি মহাকাশে চাঁদের দেশে?

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন