হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
কুৎসিত সুন্দর
সারা রাত্রের যাত্রা শেষে বেলা দশটা নাগাদ স্টেট বাসটা তন্ময়কে নামিয়ে দিল অক্রুরগঞ্জের মোড়ে৷ বাস থেকে নেমে চারপাশে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেল তন্ময়৷ সে ভেবেছিল জায়গাটার নামের সঙ্গে যখন ‘গঞ্জ’ শব্দটা আছে তখন এ-জায়গাটা শহর না হলেও অন্তত গঞ্জ হবে৷ কিন্তু কোথায় কী! বাস-রাস্তার দু-পাশে যতদূর চোখ যায় ততদূরই পতিত জমি৷ আর তার মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও শিরিষ-শাল-সেগুনের বড়ো বড়ো গাছের জঙ্গল৷ উত্তরবঙ্গের এ-জায়গাতে এর আগে কোনোদিন আসেনি তন্ময়৷ সত্যি কথা বলতে কি, এর আগে সে কলকাতা ছেড়ে এতদূরে কোনোদিন আসেনি৷ বাস তাকে যেখানে নামাল তার কিছুটা তফাতে রাস্তার ধারে টিনের চালা আর দরমার বেড়া দেওয়া একটা চায়ের দোকান৷ তার সামনে বাঁশের মাচায় বসে চায়ের গেলাস হাতে আড্ডা দিচ্ছে কয়েকজন স্থানীয় লোক৷ তন্ময় যেখানে যাবে সে জায়গাটা ঠিক কোথায় তা জেনে নেবার জন্য সে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল৷ তারপর একটু চুপ করে থেকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, এখানে চিড়িয়াখানাটা কোথায়? খড়িশ সামন্তর চিড়িয়াখানা?’
তন্ময়ের প্রশ্ন শুনে যে লোকগুলো বসে ছিল তারা ফিরে তাকাল তার দিকে৷ লোকগুলো যেন তন্ময়ের মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল৷ তারপর একজন মৃদু বিস্ময়ের স্বরে বলল, ‘আপনাকে দেখে তো ঠিক তেমন লোক বলে মনে হচ্ছে না, বরং কী সুন্দর চেহারা আপনার, যেন ফিল্মের হিরো৷’
লোকটার কথা কাকতালীয় ভাবে ঘা দিল তন্ময়ের মনে৷ সে যে সিনেমার নায়কদের মতো সুন্দর দেখতে তা সে ছোটোবেলা থেকেই শুনে এসেছে৷ আর এ কথাটাই তো সর্বনাশ ঘটাল তার জীবনে৷ লোকজনের কথা শুনে তার মনের মধ্যেও কেমন একটা বিশ্বাস জন্মেছিল, সে সিনেমার হিরো হবেই৷ হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলকাতার স্টুডিও পাড়ায় ছুটল সে৷ কিন্তু অভিনয় করতে হলে শুধু চেহারা দিয়েই হয় না৷ অনেক কিছু জানতে হয়, শিখতে হয়৷ তাছাড়া আরও অনেক ব্যাপার-স্যাপার আছে৷ শেষ পর্যন্ত সিনেমায় নামা তো তার হলই না, সংসারের যৎসামান্য যা সঞ্চয় ছিল তাও চলে গেল, তাকে সিনেমাতে নামাবে বলে কথা দেওয়া এক ঠগের পাল্লায় পড়ে৷ তন্ময় আর তার বাড়ির লোকের এখন খাওয়া বন্ধ হবার উপক্রম৷ একটা চাকরি এখন তন্ময়ের খুব দরকার৷ যে কারণে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে কলকাতা ছেড়ে এতদূর ছুটে এসেছে৷ এসব কথা অবশ্য লোকগুলোকে বলার প্রয়োজন নেই৷ লোকটার কথা শুনে তন্ময় মৃদু বিস্মিত ভাবে বলল, ‘আমাকে তেমন লোক বলে মনে হচ্ছে না মানে?’
লোকটা তার পানের ছোপ ধরা দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ওই অদ্ভুত চিড়িয়াখানায় যাবেন বলে এসেছেন? এ ক-দিন বেশ কয়েকজন লোক সেখানে গেল, আবার ফিরেও চলে গেল৷ বাস থেকে নেমে তারাও আপনার মতো আমাদের থেকেই ঠিকানা জেনেছে৷ তাদের কেউ খোঁড়া, কেউ নুলো, কেউ বা অন্ধ৷ আপনার সব ঠিকঠাক আছে দেখে কথাটা বললাম৷ যাই হোক ওই যে শালের বন দেখছেন, ওর পিছনে বাজার আছে৷ ওখানে গিয়ে কাউকে জিগ্যেস করলে সে অদ্ভুত চিড়িয়াখানার রাস্তা দেখিয়ে দেবে৷’
যা জানার দরকার ছিল তা জানা হয়ে গেছে৷ কাজেই লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার দেখানো পথ ধরে এগোল তন্ময়৷ হাঁটতে হাঁটতে তন্ময় বুঝতে পারল লোকটা কেন খোঁড়া, নুলো, বা অন্ধ লোকদের আসার ব্যাপারে বলল৷ তন্ময়ের খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের কথাটা মনে পড়ল৷ বিজ্ঞাপনে মাঝে মাঝে খুব অদ্ভুত সব কথা লেখা থাকে৷ তেমনই যে বিজ্ঞাপন দেখে তন্ময় এখানে হাজির হয়েছে তাতে—‘প্রাইভেট চিড়িয়াখানার জন্য সৎ, কর্মঠ যুবকের প্রয়োজন৷ থাকার সুব্যবস্থা ও আকর্ষণীয় বেতন…’ এ-কথার পাশাপাশি ব্র্যাকেটে ছোটো হরফে লেখা ছিল—‘শরীরে খুঁত থাকলে অগ্রাধিকার৷’ তন্ময়ের শরীরে অবশ্য কোনো খুঁত নেই৷ তবে সে সৎ ও কর্মঠ৷ এ দুটোর ওপর ভরসা করেই সে চাকরিটার খোঁজে এসেছে৷ খঞ্জ, নুলো বা অন্ধ যে মানুষরা এসেছিলেন তাঁরা সম্ভবত বিজ্ঞাপনের ওই অদ্ভুত কথাটা—‘শরীরে খুঁত থাকলে অগ্রাধিকার…’ কথাটা দেখে এসেছিলেন৷ তবে লোকটার একটা কথা বেশ আশ্বস্ত করল তন্ময়কে৷ সে বলল ওই লোকগুলো এসেছিল আবার চলেও গেছে৷ অর্থাৎ সম্ভবত চাকরিটাতে লোক নিয়োগ হয়নি এখনও৷ দেখা যাক কী হয়? এই ভেবে তন্ময় হাঁটতে লাগল৷
শালের বনের আড়ালে সত্যিই একটা ছোটো বাজার মতো জায়গাতে উপস্থিত হল তন্ময়৷ বেশ কয়েকটা দোকান ঘর, একটা টেলিফোন বুথ আর একটা ছোটো পোস্ট-অফিস আছে সেখানে৷ কিছু লোকজনও আছে সে জায়গাতে৷ পোস্ট-অফিসে কাউন্টারে খাকি পোশাকের একজন লোক বসেছিল৷ তন্ময় তার কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল, ‘আচ্ছা, চিড়িয়াখানাটা কোন দিকে?’
লোকটা বলল, ‘অদ্ভুত চিড়িয়াখানা তো? এই সুরকির রাস্তা ধরে চলে যান৷ রাস্তা যেখানে গিয়ে শেষ হবে সেখানেই অদ্ভুত চিড়িয়াখানা৷ দেখবেন উঁচু প্রাচীরঅলা একটা বাড়ি৷ খড়িশ সামন্তর অদ্ভুত চিড়িয়াখানা৷’
লোকটার কথা শুনে রাস্তা ধরতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল তন্ময়৷ এরা চিড়িয়াখানাটাকে ‘অদ্ভুত চিড়িয়াখানা’ বলছে কেন?
সে একটু ইতস্তত করে প্রশ্ন করল, ‘চিড়িয়াখানাটা অদ্ভুত কেন?’
লোকটা মৃদু হেসে বলল, ‘ওখানে গেলেই বুঝতে পারবেন৷ ও-বাড়ির, চিড়িয়াখানার সব কিছুই অদ্ভুত!’ এই বলে সে নিজের কাজে মনোনিবেশ করল৷ সুরকি বিছানো রাস্তা ধরে তন্ময়ও এগোল সেই ‘অদ্ভুত চিড়িয়াখানার’ দিকে৷ সুরকির রাস্তাটা বাজার ছেড়ে এগিয়েছে সোজা সামনের দিকে৷ বাজার ছাড়ালেই আবার দু-পাশে অনাবাদি ঘাসজমি৷ সে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় চিড়িয়াখানার কাছে পৌঁছে গেল তন্ময়৷ বিরাট উঁচু প্রাচীর ঘেরা জায়গা, সম্ভবত বারো ফুট উঁচু প্রাচীর৷ তার ওপর আবার কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া৷ বাইরে থেকে জায়গাটার ভিতর তেমন কিছু দেখা যায় না৷ বিশাল লোহার গেটটা বন্ধ৷ জায়গাটার ভিতর থেকে কোনো একটা প্রাণীর অদ্ভুত ডাক শোনা গেল এবার৷ তা শুনে তন্ময় বুঝতে পারল যে ঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছে৷
৷৷ ২৷৷
লোহার দরজায় ঘা দিল তন্ময়৷ বারকয়েক সেখানে ঘা দেবার পর ভিতর থেকে কে যেন বলল, ‘কে, কী ব্যাপারে এসেছেন?’
তন্ময় জবাব দিল, ‘কলকাতা থেকে আসছি৷ খবরের কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে, ইন্টারভিউ দিতে৷’
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা৷ বড়ো দরজার গায়ে একটা ছোটো দরজা আছে সেটা খুলে গেল এরপর৷ ভিতরের লোকটা বলল, ‘ঢুকে পড়ুন’৷ সেই ছোটো দরজাটার ফাঁক দিয়ে মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকল তন্ময়৷ ভিতরে ঢোকার পর সে যে লোকটাকে সামনে দেখল তাকে দেখে সে বেশ অবাক হয়ে গেল৷ এত লম্বা লোক জীবনে দেখেনি৷ উচ্চতায় লোকটা অন্তত সাত ফুট হবে৷ কিন্তু প্যাকাটির মতো চেহারা, কাঠির মতো হাত-পা৷ মুখ তো নয় যেন করোটির ওপর চামড়া বসানো আছে৷ তার চোখ দুটো আর দাঁত যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায় বাইরে৷ এ মূর্তি রাতে কেউ দেখলে নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যাবে৷ তন্ময় যেন বিস্মিত ভাবে লোকটার দিকে তাকাল৷ তেমনই লোকটাও তার ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ দুটোতে একটু বিস্মিতভাবেই যেন দেখল তাকে৷ তারপর ফ্যাসফ্যাসে গলায় কিছুটা দূরে কম্পাউন্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা থামওয়ালা বাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ও-বাড়ির বারান্দায় গিয়ে উঠুন৷ একটা বড়ো কাঠের দরজা দেখতে পাবেন, দরজায় টোকা দেবেন৷ ওটাই অফিস-ঘর৷’
বাড়িটা একতলা হলেও বেশ বড়ো৷ বিরাট বিরাট থাম ধরে রেখেছে মাথার ওপরের কড়িবরগার ছাদটাকে৷ সাবেক কালের বাড়ি৷ কিন্তু সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন৷ বারান্দায় গিয়ে উঠল তন্ময়৷ ঠিক সে সময় বাড়ির পিছন থেকে প্রাণীর ডাক ভেসে এল৷ সে ডাক অবশ্য তন্ময়ের চেনা৷ ঘোড়ার ডাক৷ বারান্দার একপাশে সার সার ঘর বাইরের থেকে তালা বন্ধ৷ শুধু একটা ঘর ভিতর থেকে বন্ধ৷ সেটাই অফিস-ঘর হবে অনুমান করে তন্ময় দরজায় টোকা দিল৷ এবারও ভিতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘কে?’
তন্ময় জবাব দিল, ‘ইন্টারভিউ দিতে এসেছি কাজের জন্য৷’
একটা শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল৷ কিন্তু দরজা খুলল কে? সামনে তো কেউ নেই! হঠাৎ এবার সে মেঝের দিক থেকে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ‘ওই সোফায় গিয়ে বসুন৷ আমি বাবুকে ডেকে দিচ্ছি৷’
তন্ময় সেই কণ্ঠস্বর লক্ষ করে তাকাতেই যে লোকটাকে দেখতে পেল তাতে চমকে উঠল৷ খাকি পোশাক, মাথায় টুপি পরা একটা লোক৷ তার মুখমণ্ডল দেখে মনে হচ্ছে সে নেপালি হবে৷ কিন্তু তার উচ্চতা খুব বেশি হলে সাড়ে তিনফুট হবে৷ লোকটা বামন, মাথাটা শরীরের তুলনায় বেশ বড়৷ তার কোমরের বেল্ট থেকে বেশ বড়ো একটা কুকরি ঝুলছে৷ সেটা প্রায় তার গোড়ালির কাছে নেমে এসেছে৷ পরপর দুটো অদ্ভুত লোককে দেখতে পেয়ে তন্ময় বেশ অবাক হয়ে গেল৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে কার্পেট পাতা মেঝেতে একটা নিচু কাচের টেবিলের দু-পাশে দুটো সোফা রাখা আছে৷ লোকটার নির্দেশ মতো তারই একটাতে গিয়ে বসল তন্ময়৷ আর সেই বামন লোকটাও ঘরের অন্য পাশের একটা দরজার ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল তার বাবুকে ডাকার জন্য৷ একলা ঘরে বসে তন্ময় ভাবতে লাগল এ-পর্যন্ত এ-বাড়িতে ঢুকে সে যে দুজনকে দেখেছে তারা দুজনেই বেশ অদ্ভুত৷ তাদের মালিকও তাদের মতোই অদ্ভুত হবেন না তো? যদিও ভদ্রলোকের নামটা বড়ো অদ্ভুত—‘খরিশ’! এ-শব্দটা শুনলেই সাপের কথা—খরিশ গোখরোর কথা মনে পড়ে যায়৷ নামটা সে আগে শোনেনি বলে কৌতূহলবশত নামটা সম্বন্ধে জিগ্যেস করেছিল তার বাড়িঅলা অবনী মাস্টারকে৷ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ ‘খরিশ’ মানে ‘খরিশ গোখরো’—মহাদেবের সঙ্গী৷ যে জড়িয়ে থাকে মহাদেবের বাহুতে৷ যে জন্য গ্রামদেশে অনেকের নাম খরিশ হয়৷ অর্থাৎ মহাদেবের সঙ্গী৷’
তন্ময় এ-সব কথা ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকলেন একজন লোক৷ তাঁকে দেখেও অবাক হয়ে গেল তন্ময়৷ তবে তা অন্য কারণে৷ নির্মেদ চেহারার ছ-ফুট লম্বা একজন লোক৷ সাহেবের মতো ধবধবে ফর্সা রং, নিখুঁত ভাবে কামানো মুখমণ্ডলে দীঘল চোখ, তীক্ষ্ণ নাসা, পাতলা লাল ঠোঁট, মাথা ভরতি কোঁকড়া ঘন চুল৷ সৌন্দর্যের দেবতা যেন তার সব সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছেন লোকটার ওপর৷ ছবির বইতে অথবা সিনেমার পর্দাতেই শুধু এত সুন্দর লোক দেখা যায়৷ লোকে তন্ময়কে দেখতে নায়কের মতো বলে কিন্তু এ-লোক সত্যিই যেন রূপকথার রাজপুত্রের মতো সুন্দর! লোকটার পরনে তাঁর চেহারার সঙ্গে মানানসই নিখুঁত সাহেবি পোশাক৷ গায়ে গলাবন্ধ কোট, পায়ে পালিশ করা ঝকঝকে জুতো৷ দস্তানা পরা হাতে একটা রুপো বাঁধানো কালো ছড়ি ধরা আছে৷ লোকটার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই একটা সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে৷ যেন ঝলমল করে উঠল ঘরটা৷ তাঁকে দেখার পর তন্ময় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর উদ্দেশে হাত জোড় করে নমস্কার করল৷ লোকটা তা দেখে তাঁর দস্তানা পরা ছড়ি ধরা হাতটা একটু ওপরে তুলে প্রতি-নমস্কারের ভঙ্গি করে ইশারায় বসতে বললেন তন্ময়কে৷
খরিশ সামন্ত এসে বসলেন তন্ময়ের মুখোমুখি সোফাটাতে৷ তাঁকে কাছ থেকে দেখে তন্ময় অনুমান করল তাঁর বয়স সম্ভবত মধ্য চল্লিশ হবে৷ কয়েক মুহূর্তের জন্য মৃদু দৃষ্টি বিনিময় হল দুজনের মধ্যে৷ তারপর খরিশ সামন্ত বললেন, ‘আপনার নাম কী? কোথা থেকে এসেছেন?’ ভদ্রলোকের চেহারার মতো তাঁর গলার স্বরও অদ্ভুত সুন্দর৷ এই সামান্য কথাতেই যেন জলতরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে৷ তন্ময় তাঁর কথার জবাব দিল৷
ভদ্রলোক মৃদু বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘অতদূর কলকাতা থেকে এসেছেন! আমার চিড়িয়াখানার কিছু কাজ আর বাড়ির বাইরেরও কিছু কাজ করতে হবে আপনাকে৷ এখানে থেকেই করতে হবে৷ যদিও তার জন্যে বেশ মোটা বেতন দেব আপনাকে৷ কুড়ি হাজার টাকা৷ পারবেন তো করতে?’
টাকার পরিমাণটা শুনে ঘাবড়ে গেল তন্ময়৷ সে ভেবেছিল ও কাজে খুব বেশি হলে হয়তো সাত-আট হাজার টাকা বেতন হবে, তার বদলে কুড়ি হাজার টাকা! তন্ময়ের যা যোগ্যতা তাতে এ তো আকাশের চাঁদ পাবার মতো! সে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘পারব স্যার, পারব৷ আপনি যা বলবেন করতে পারব৷ আর বাড়িতে বিধবা মা, আর অনেকগুলো ছোটো-ছোটো ভাইবোন আছে৷ চাকরিটা আমি যে কোনো শর্তে—’
‘যে কোনো শর্তে? ভেবে বলছেন তো?’
‘হ্যাঁ স্যার, যে কোনো শর্তে—’ জবাব দিল তন্ময়৷
খরিশ সামন্ত এবার জানতে চাইলেন, ‘আপনার শরীরে কোনো খুঁত আছে?’ প্রশ্নটা শুনে মৃদু ভয় পেল তন্ময়৷ সে বলল, ‘আমার হাঁটুতে একটা কাটা দাগ আছে৷ ওটাকে তো খুঁত বলে ধরাই যেতে পারে৷ তাছাড়া আপনি বিজ্ঞাপনে যে ‘সৎ’ ও ‘কর্মঠ’ শব্দ দুটো লিখেছেন সে দুটো কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সত্যি৷’
তন্ময়ের জবাব শুনে খরিশ সামন্ত বললেন, ‘অমন দু-একটা কাটা-ছেঁড়ার দাগ সবারই শরীরে থাকে৷ বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না৷’
তন্ময় বলল, ‘তবে কি আপনি খুঁত বলতে প্রতিবন্ধী মানুষের কথা বুঝিয়েছিলেন?’
খরিশ সামন্ত বললেন, ‘না, ঠিক তাও নয়৷ বিজ্ঞাপনে ওই ‘খুঁত’ শব্দটা দেখে কয়েকজন প্রতিবন্ধী মানুষ চাকরির প্রত্যাশায় এসেছিলেন৷ কিন্তু তাঁদের দিয়ে আমার কাজ হবে না৷ ‘খুঁত’ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম যে…’
কথাটা বলতে গিয়েও হঠাৎ যেন থেমে গেলেন খরিশ সামন্ত৷ এরপর তিনি বললেন, ‘চলুন আমার চিড়িয়াখানাটা আগে দেখাই৷ তারপর বাকি কথা হবে৷’
৷৷ ৩৷৷
বাড়িটার পিছনেও বেশ খানিকটা জায়গা৷ উন্মুক্ত জমিটার মধ্যে রয়েছে বিরাট বিরাট ঘরের মতো সার সার খাঁচা৷ তাছাড়া দু-একটা প্রাচীর ঘেরা উন্মুক্ত খোপও আছে৷ বাড়ি থেকে বেরিয়ে খরিশ সামন্তর সঙ্গে সে জায়গাতে উপস্থিত হল তন্ময়৷ খরিশ সামন্ত বললেন, ‘দাঁড়ান, আগে আপনাকে প্রথমে পাখির খাঁচাগুলো দেখাই৷’ এ কথা বলে তিনি তন্ময়কে নিয়ে প্রথমে হাজির হলেন একটা খাঁচার সামনে৷ বড়ো খাঁচাটার ভিতর একটা মরা গাছের ডালের ওপর বসে আছে বিশাল আকৃতির একটা পাখি—ম্যাকাও৷ কিন্তু নীল মাথাঅলা পাখিটার গলার নীচ থেকে কোনো পালক নেই! সারা দেহে তার লালচে-কোঁচকানো চামড়া ঠিক পালক ছাড়ানো মুরগির মতো৷ দেখলেই কেমন যেন গা ঘিনঘিন করে! ম্যাকাওয়ের পরের খাঁচাটা একটা ময়ূরের৷ ম্যাকাওয়ের থেকেও অনেক বেশি সৌন্দর্য ময়ূরের৷ কিন্তু এই ময়ূরটাকে দেখে তা মনে হয় না৷ তার একটা ডানা ভাঙা৷ সেটা প্রায় মাটিতে লুটোচ্ছে৷ ভাঙা ডানা নিয়ে ঘষটে ঘষটে খাঁচার একপাশ থেকে অন্য পাশে সরে গেল ময়ূরটা৷ এরপর একটা ধনেশের খাঁচা৷ কিন্তু সে বেচারার বিশাল ঠোঁটটার অর্ধেক ভাঙা৷ তন্ময়রা খাঁচাটার সামনে দাঁড়াতেই পাখিটা আতঙ্কে ডাক ছেড়ে খাঁচার কোনায় চলে গেল৷
খরিশ সামন্ত বললেন, ‘ধনেশটা নতুন এসেছে, এখনও ওর ভয় কাটেনি৷’ এরপর একটা খাঁচায় দুটো শকুন রাখা৷ তা দেখে তারা এগোল চিড়িয়াখানার পশুদের জায়গার দিকে৷ ছোটো একটা উন্মুক্ত জায়গাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ সুন্দর একটা হরিণ৷ ভালো করে তার দিকে তাকাবার পর প্রাণীটার অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারল তন্ময়৷ সুন্দর প্রাণীটার একটা চোখের ওপর বেশ বড়ো একটা আব বা টিউমার৷ একটা চোখ তাই খুলতে পারে না প্রাণীটা৷ হরিণের জায়গাটার পাশেই একই রকম জায়গায় রয়েছে একটা ঘোড়া৷ জন্মগত কোনো ত্রুটির কারণে প্রাণীটার পিছনের পা-দুটো অস্বাভাবিক রকম ছোটো৷ যেন তার পিছনের পা-দুটো গাধার পা৷ কিম্ভূতকিমাকার দেখতে লাগছে তাকে৷ সে জায়গার পরই একটা খাঁচার মধ্যে রয়েছে একটা হায়না৷ এমনিতেই প্রাণীটা কুৎসিত দেখতে তার ওপর আবার প্রাণীটার লেজ আর কান দুটো কাটা! খরিশ সামন্ত বললেন, ‘প্রাণীটা জঙ্গল ছেড়ে লোকালয় ঢুকে পড়ে হাঁস-মুরগি মারত৷ গ্রামবাসীরা ফাঁদ পেতে ধরে ওর কান আর লেজ কেটে দেয়৷’
তাঁর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণীটা এমন হাঃ হাঃ করে বীভৎস হাসল যে চমকে গেল তন্ময়৷ এরপর খরিশ সামন্ত আরও বেশ কয়েকটা খাঁচা দেখালেন তন্ময়কে৷ তার মধ্যে কোথাও আছে এক ঠ্যাং কাটা হনুমান বা দুটো মাথাঅলা ময়াল সাপ! তন্ময় চিড়িয়াখানার পশু-পাখিগুলোকে দেখে বুঝতে পারল, চিড়িয়াখানার সবকটা প্রাণী হয় প্রকৃতির নিয়মেই কুৎসিত দেখতে অথবা অন্য কোনো কারণে তাদের চেহারার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়েছে! খরিশ সামন্তর চিড়িয়াখানাকে লোকে কেন ‘অদ্ভুত চিড়িয়াখানা’ বলে তা এবার অনুমান করতে পারল তন্ময়৷
চিড়িয়াখানা দেখানো শেষ করে আবার বাড়িটার দিকে ফিরতে ফিরতে খরিশ সামন্ত বললেন, ‘এ-বাড়িতে আমি ছাড়া যে সব মানুষ বা পশুপাখি আছে তারা প্রত্যেকেই তাদের জন্মগত ত্রুটির কারণে হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক তাদের চেহারার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়েছে৷ এদের সবাইকে আমি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি৷ তবে সাধারণ মানুষ এদের কষ্ট বোঝে না৷ সেই একমাত্র এদের কষ্ট বুঝতে পারে যার নিজের চেহারাতেও খুঁত বা বিকৃতি আছে৷ যে কারণে আমি বিজ্ঞাপনে এ-কথাটা লিখেছিলাম৷ আপনি কি পারবেন এই প্রাণীগুলোকে ভালোবাসতে? এরা যতই কুৎসিত দেখতে হোক, এরাও কিন্তু প্রাণী৷ জানি, আমার এই অদ্ভুত চিড়িয়াখানা নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করে তবু এদের নিয়েই আছি৷’
খরিশ সামন্তর কথা শুনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে উঠল তন্ময়ের মন৷ সত্যিই মানুষটা দেখতেও যেমন সুন্দর তেমনই তাঁর মনটাও সুন্দর৷ নইলে এ-সব প্রাণী কেউ পোষে?
তন্ময় বলল, ‘আপনি ভাববেন না স্যার৷ আমার চেহারায় কোনো খুঁত না থাকলেও আমি ওদের আপনার মতোই ভালোবাসব৷’
খরিশ সামন্ত বললেন, ‘কদাকার দেখতে কাউকে ভালোবাসা খুব কঠিন কাজ৷ পশুপাখির কথা না হয় ছেড়েই দিন, আমার কর্মচারী দুজনের কথাই ধরুন৷ ইদানীং আর ওদের বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না৷ ওদের চেহারার জন্য লোকে ওদের পিছনে লাগে, ঢিল মারে৷ আর হ্যাঁ, আপনাকে কিন্তু বাড়ির বাইরের কাজগুলোও করতে হবে যা ওদের দিয়ে করাতাম আমি৷’
তন্ময় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ স্যার, আপনি যা যা বলবেন সে সবই আমি করব৷’
খরিশ সামন্ত বললেন, ‘বেশ৷ আপনি যখন এত জোর দিয়ে পারবেন বলছেন তখন আপনাকেই বহাল করব আমি৷ আমার কাগজপত্র টাইপরাইটারে তৈরি করতে দশ মিনিট সময় লাগবে৷ পশু-পক্ষী নিয়ে কাজ তো, কোনো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে৷ যদিও এমন ঘটনা এখনও পর্যন্ত কোনোদিন ঘটেনি৷ আমার প্রাণীগুলো খুব নিরীহ প্রকৃতির৷ এমনকি ওই হায়নাটাও৷ তবুও আপনি যে স্বেচ্ছায় এই চাকরি নিচ্ছেন সে সম্বন্ধে কাগজ রাখা জরুরি৷ আপনি স্বাক্ষর করে দেবেন কাগজটাতে৷’
তন্ময় বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই করে দেব৷ তা কবে থেকে যোগ দেব কাজে?’
খরিশ সামন্ত বললেন, ‘আজ থেকেই৷ লোক ছাড়া আমার আর চলছে না৷ গুরুং অর্থাৎ আমার ওই বামন সঙ্গী আপনাকে সব কাজ বুঝিয়ে দেবে৷ কী ভাবে পশু-পাখিগুলোকে পরিচর্যা করতে হবে সেই কাজ সহ অন্য কাজ৷ আজ বিশ্রাম নিয়ে কাল থেকেই কাজে লেগে যান আপনি৷ অবশ্য যদি কাজটা করার ইচ্ছা থাকে আপনার৷’
তন্ময় বলল, ‘না, না, অবশ্যই৷ কিন্তু বাড়িতে কিছু বলে আসা হয়নি যে থাকার ব্যাপারে…’
বাড়ির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে খরিশ সামন্ত বললেন, ‘আজ মাসের পনেরো তারিখ৷ এ মাসের পনেরো দিনের বেতন, আর আগামী দু-মাস অর্থাৎ তিনমাসের বেতন পঞ্চাশ হাজার টাকা আপনাকে এখনই দিয়ে দিচ্ছি আমি৷ টাকাটা পোস্ট-অফিসে গিয়ে ‘মানি অর্ডার’ করে আসুন৷ তিনমাস পর আপনি বাড়ি যাবেন৷ আপনার কাছে মোবাইল ফোন আছে?’
তন্ময়ের কাছে একটা মোবাইল ফোন আছে ঠিকই৷ কিন্তু তাতে আবার টাকা ভরার সামর্থ্য নেই বলে সে সেটা বাড়িতে রেখে এসেছে৷ তাই সে কৌশলে জবাব দিল, ‘না, নেই৷ আমি মোবাইল ফোন ব্যবহার করি না৷’ তন্ময়ের জবাব শুনে খরিশ সামন্ত হেসে বললেন, ‘আমিও করি না৷ আমার ল্যান্ডফোন আছে৷ যাই হোক মানি অর্ডার করার পর বাজারের পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করে জানিয়ে দিন যে তিনমাস পর আপনি ছুটিতে বাড়ি ফিরবেন৷’
তন্ময় জবাব দিল, ‘আচ্ছা স্যার৷’
তন্ময়কে সেই আগের সোফাসেটটাতে বসিয়ে রেখে খরিশ সামন্ত চলে গেলেন অন্য ঘরে তার কাগজপত্র টাইপ করে আনবার জন্য৷
৷৷ ৪৷৷
মিনিট পনেরো-কুড়ির মধ্যেই একটা স্ট্যাম্প পেপারে কী সব টাইপ করে নিয়ে এলেন খরিশ সামন্ত৷ সেটা তিনি তন্ময়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এখানে আপনার মায়নাপত্র ইত্যাদির ব্যাপারেও লেখা আছে৷ ভালো করে পড়ে নিন৷ এমনও তো হতে পারে যে এই কাগজটাতে আমি আপনার সব সম্পত্তি লিখিয়ে নিচ্ছি৷’ এই বলে নিজের রসিকতাতেই মৃদু হাসলেন তিনি৷
তন্ময় কিন্তু বেশ লজ্জা পেল খরিশ সামন্তর কথায়৷ সে সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘আমার থেকে নেবার মতো কিছুই নেই আপনার৷ বরং কাজটা দিয়ে আপনি আমার পরিবারকে বাঁচিয়ে দিলেন৷’ এই বলে সে তাড়াতাড়ি ইংরেজিতে টাইপ করা কাগজটার নীচে সই করে দিল৷ কাগজটা হাতে নিলেন খরিশ সামন্ত৷ তারপর হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, এই কুৎসিত প্রাণী আর মানুষদের মাঝে আমাকে দেখতে কেমন লাগছে আপনার?’
তন্ময় বলল, ‘আপনি খুব সুন্দর দেখতে স্যার৷ আর এই পরিবেশে আপনাকে আরও সুন্দর লাগছে৷’
কথাটা শুনে ঝকঝকে দাঁত বার করে হাসলেন খরিশ সামন্ত৷ এরপর তিনি পকেট থেকে পাঁচশো টাকার নোটের বান্ডিল বার করে তন্ময়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এই আপনার টাকা৷ যান পোস্ট-অফিস থেকে বাড়িতে মানি অর্ডার করে আসুন৷’ টাকাগুলো হাতে নিয়ে তন্ময় বলল, ‘আমি এত টাকা একসঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরোনো তো দূরে থাক, হাতেই ধরিনি কখনও৷ তার ওপর এটা অচেনা জায়গা…’
খরিশ সামন্ত বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি অচেনা লোক৷ সঙ্গে এতগুলো টাকা দেখলে কারো মনে কোনো সন্দেহ হতে পারে৷ ঠিক আছে চলুন আমি আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি৷’
একটা পুরোনো মডেলের অথচ প্রায় নতুনের মতো যত্নে রাখা গাড়ি আছে খরিশ সামন্তর৷ তাতে করে কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্ময়কে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি৷ যেতে যেতে তন্ময় পিছনের সিট থেকে প্রশ্ন করলে, ‘স্যার আপনি অনেক বড়ো চাকরি বা ব্যবসা করেন তাই না?’
গাড়ি চালাতে চালাতে খরিশ সামন্ত বললেন, ‘না, আমি কিছুই করি না এখন৷ পশু-পাখিগুলোকে নিয়েই থাকি৷ আমার বাবা বড়ো ব্যবসায়ী ছিলেন৷ আমি তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলাম৷ ছোটোবেলা থেকেই পশু-পাখিদের প্রতি আমার আকর্ষণ৷ ভেটেরিনারি সার্জেনের ডিগ্রি আছে আমার৷ কয়েক বছর একটা পশু হাসপাতালে চাকরি করেছি এককালে৷ সেটা অবশ্য শখে৷ এমনিতে এখন প্রাইভেট চিড়িয়াখানা বা বন্য জন্তু পোষা নিষিদ্ধ৷ আমার পশু চিকিৎসায় ডিগ্রি আছে বলেই ধরে নিন ওদের চিকিৎসার অজুহাতেই প্রাণীগুলোকে কাছে রাখতে পেরেছি আমি৷’
তন্ময় জানতে চাইল, ‘আপনার এই চিড়িয়াখানা দেখতে লোক আসে?’
খরিশ সামন্ত হেসে বললেন, ‘এখানে তো আশেপাশে কোনো কিছু তেমন দেখার নেই, তাই মাঝে মাঝে লোকজন চিড়িয়াখানা দেখতে আসে৷ তবে টিকিটের কোনো ব্যাপার নেই৷ আমার প্রাণীগুলো তো দেখতে খুব একটা সুন্দর নয়, তাই হয়তো চিড়িয়াখানা দেখে ফেরার পর তারা শুধু আমাকেই মনে রাখে৷’
একটু কথা বলতে না বলতেই বাজারের মতো জায়গাটাতে পৌঁছে গেল তারা৷ পোস্ট-অফিসের সামনে গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে ঢুকল দুজন৷ কাউন্টারের জালের ওপাশে বসে কাজ করছে কয়েকজন লোক৷ মানি অর্ডার করার কথা শুনে একটা ফর্ম বাড়িয়ে দিয়ে একজন কর্মী সেটা ভর্তি করতে বলল৷ কাজটা করে টাকা জমা দিয়ে যখন তারা বাইরে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে তখন হঠাৎই তাদের কানে এল কাউন্টারে বসা দুজন পোস্ট-অফিস কর্মীর কথোপকথন৷ একজন বলল, ‘ছেলেটা কে? খরিশ সামন্তর ছেলে বা ভাই নাকি? ওরই মতো ছেলেটাও সুন্দর দেখতে!’
অপরজন জবাব দিল, ‘আমার তো ওর চেয়েও সুন্দর মনে হল ছেলেটাকে৷ ওইরকমই হবে কিছু একটা৷ আমি তো ওবাড়িতে চিঠি দিতে গিয়ে যাদের দেখি তাদের খরিশ সামন্তর মতো দেখতে হওয়া দূরে থাক, লোকগুলো এত জঘন্য দেখতে যে ভালো করে তাদের দিকে তাকানোই যায় না!’
লোক দুজনের কথা কানে যেতেই মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন খরিশ সামন্ত৷ তাঁর মুখটা যেন কালো হয়ে গেল৷ এর পরক্ষণেই অবশ্য তিনি তন্ময়কে বললেন, ‘যান, ওই যে টেলিফোন বুথ৷ বাড়িতে খবরটা দিয়ে আসুন৷’
পোস্ট-অফিসের কাজ, ফোন করা এসব সেরে আবার বাড়ি ফিরতে আধঘণ্টার মতো সময় লাগল তন্ময়দের৷ বাড়ি ফিরে বৈঠকখানায় ঢুকে খরিশ সামন্ত তন্ময়কে বললেন, ‘এখানে থাকা-খাওয়ার জন্য এক পয়সা লাগবে না আপনার৷ আজ সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে কাল থেকে কাজ করবেন৷ এই গুরুং আপনাকে আপনার ঘরে নিয়ে যাবে৷ আপনি যান ওর সঙ্গে৷ ও-ঘরের দুটো ঘর পরে বাথরুমও আছে৷’
সে ঘর ছেড়ে এরপর গুরুং বলে বামন লোকটার পেছনে তার কিটব্যাগ নিয়ে এগোল তন্ময়৷ বাড়িটার অধিকাংশ ঘরই তালাবন্ধ৷ যেতে যেতে সে গুরুং বলে লোকটাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি এখানে কত বছর আছেন?’
লোকটা জবাব দিল, ‘পাঁচ বছর৷’
তন্ময় এরপর জানতে চাইল, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
সে জবাব দিল, ‘এখন যখন এখানে থাকি এটাই আমার বাড়ি৷’
এ জবাব শুনে তন্ময়ের মনে হল যে লোকটা তার সঙ্গে তেমন কথা বলতে আগ্রহী নয়৷ সম্ভবত সে হয়তো তাকে পছন্দ করছে না৷
লোকটা তন্ময়কে একটা ঘরের কাছে নিয়ে গিয়ে দরজা খুলল৷ তারপর ইশারায় তাকে দেখিয়ে দিল ঘরের ভিতরটা৷ ছিমছাম ঘরটা বেশ বড়ো বলা চলে৷ ঘরের আর একপাশের দেওয়ালেও একটা দরজা আছে৷ সেটা অন্য পাশ থেকে বন্ধ৷ খাট, পরিষ্কার বিছানা, একটা আয়না, আলমারি, মোটামুটি সবই আছে ঘরে৷ তন্ময় মনে মনে ভাবল, একটা মানুষের এর চেয়ে বেশি আর কী চাই? তন্ময় ঘরে ঢুকে খাটে বসে চারপাশে তাকিয়ে ঘরটা দেখতে লাগল৷ হঠাৎ সে খেয়াল করল গুরুং চলে যায়নি৷ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তন্ময়ের দিকে৷ কেমন যেন অস্বস্তিকর চাহনি৷ কদাকার বামন লোকটা৷ তন্ময়ের নিজেরও বেশ অস্বস্তিবোধ হল তার দিকে তাকিয়ে৷ সে বলল, ‘আপনি কিছু বলবেন?’ গুরুং তার কোনো জবাব দিল না৷ কোমরের কুকরিটা দোলাতে দোলাতে সে অদৃশ্য হয়ে গেল৷
সে চলে যাবার পর কিছুক্ষণ নরম বিছানায় শুয়ে রইল তন্ময়৷ এভাবে এত টাকার একটা চাকরি তার হয়ে যাবে তা এখনও যেন সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না৷ মনে মনে সে বলল, ‘হ্যাঁ, ভগবান যখন কাউকে কিছু দেন তখন শুনেছি ছপ্পর ফুঁড়েই দেন৷’
এরপর বিছানা ছেড়ে উঠে পোশাক পালটাতে যাচ্ছিল তন্ময়৷ ঠিক তখনই তার খেয়াল হল খরিশ সামন্তর কলমটা রয়ে গেছে৷ পোস্ট-অফিসে মানি অর্ডার ফর্ম ভরার পর দামি কলমটা আর ফেরত দেওয়া হয়নি তাঁকে৷ হয়তো খরিশবাবু কলমটা খুঁজছেন৷ কথাটা মনে হতেই তন্ময় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল কলমটা তাঁকে ফেরত দেওয়ার জন্য৷ বাড়িটার ভিতর একটু খোঁজাখুঁজির পরই একটা ঘরের দরজা খোলা দেখতে পেয়ে উঁকি দিল ঘরের মধ্যে৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন খরিশবাবু এবং গুরুং! কিন্তু অনেকজন খরিশবাবু আর অনেকজন গুরুং! ব্যাপারটা অবশ্য ধরে ফেলল তন্ময়৷ ঘরের চারপাশের দেওয়ালেই অনেক ক-টা আয়না আছে! ঘরে যখন খাট আছে এটা তাঁর বেডরুমই হবে৷ অদ্ভুত ঘর৷ খরিশবাবু গুরুং-এর উদ্দেশে বললেন, ‘কাজটা কিন্তু আজ রাতেই করতে হবে৷’ একথা বলার পরই তাঁর চোখ পড়ল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তন্ময়ের ওপর৷ সঙ্গে সঙ্গে তিনি গুরুংয়ের সঙ্গে কথা থামিয়ে তন্ময়কে প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার?’
তন্ময় কলমটা তুলে দেখাল৷ খরিশবাবু দরজার কাছে এসে কলমটা নিয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ৷’ তন্ময় ফিরে গেল তার ঘরে৷
৷৷ ৫৷৷
তন্ময়ের যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকাল হয়ে গেছে৷ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে দেখল দূরে শালবনের আড়ালে সূর্য ঢলতে শুরু করেছে৷ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বাথরুমটা খুঁজে নিয়ে সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে জামাকাপড় পালটে ঘর ছেড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল সে৷ তার মনে হল একবার বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে চিড়িয়াখানাটা দেখে আসা যাক৷ সেদিকেই এগোল সে বাড়িটাকে বেড় দিয়ে৷ খাঁচাগুলোর কাছে পৌঁছে গেল সে৷ ঘুরে ঘুরে সে দেখতে লাগল একটার পর একটা খাঁচা৷ খাঁচার সামনে নতুন লোক দেখে পশু-পাখিগুলোর কেউ কেউ কুঁকড়ে দূরে সরে যাচ্ছে, কেউ বা হিংস্র চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে৷ একটার পর একটা খাঁচা দেখতে দেখতে তন্ময় এসে দাঁড়াল হায়নার খাঁচাটার সামনে৷ প্রাণীটা গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিল খাঁচার এক কোণে৷ তন্ময়কে দেখেই সে উঠে দাঁড়াল৷ ঠিক সেই সময় সে শুনতে পেল হায়নার খাঁচার দেওয়ালের আড়াল থেকে একটা কণ্ঠস্বর৷ সে বলল, ‘আজ রাতেই লোকটাকে যা করার করতে হবে৷ দেরি করা চলবে না৷’ যার উদ্দেশে লোকটা কথাগুলো বলল সেও যেন লোকটার কথার জবাবে কিছু বলল৷ কিন্তু তার কথা তন্ময় ঠিক বুঝতে পারল না৷ কারণ ঠিক সেই সময় হায়নাটা ‘হ্যা, হ্যা’ করে একবার ডাক ছাড়ল তন্ময়কে দেখে৷ আর সেই ডাক শুনেই যেন খাঁচার দেওয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দুজন লোক৷ বামন গুরুং আর গেটম্যান সেই কিম্ভূতকিমাকার লম্বা লোকটা৷ তন্ময়কে এখন সেখানে দেখে যেন অবাক হয়ে গেল তারা৷ আর তার পরমুহূর্তে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল অন্য দিকে৷ তন্ময়ের মনে হল লোক দুজন সম্ভবত গোপনে কোনো শলা-পরামর্শ করছিল৷ তাকে দেখেই তারা অন্য দিকে সরে পড়ল! তন্ময় আজই নতুন এসেছে এ-বাড়িতে৷ ওসব ব্যাপারে তার মাথা গলিয়ে দরকার নেই৷ মালিকের অগোচরে কর্মচারীরা অনেক সময় শলা-পরামর্শ করে৷ হয়তো বা তেমনই করছিল লোক দুজন৷ কাজেই সে আবার খাঁচাগুলো দেখতে লাগল৷
তন্ময় খাঁচাগুলো দেখতে দেখতে এসে দাঁড়াল ধনেশ পাখিটার খাঁচার সামনে৷ পাখিটা ভিতরের মরা গাছটার মাথার ওপরের ডালে উঠে বসেছে৷ তন্ময় খাঁচাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একবার সে তন্ময়ের দিকে তাকাল ঠিকই, কিন্তু যেন তাকে বিশেষ পাত্তা দিল না৷ উত্তেজিতভাবে ঠোঁট-ভাঙা পাখিটা ঘাড় ফিরিয়ে খাঁচার জালের ভিতর থেকে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে৷ বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে তাকে৷ কী দেখছে পাখিটা? ব্যাপারটা বোঝার জন্য তন্ময়ও তাকাল পিছন দিকে৷ কিছুটা তফাতেই বাড়ির পিছন দিকটা৷ দিনের শেষ আলো এসে পড়েছে পুবমুখী বাড়িটার পিছন দিকে৷ সার সার বন্ধ জানলার মধ্যে একটা জানলাই খোলা৷ বেলাশেষের আলোতে জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন খরিশবাবু৷ তন্ময় সেদিকে তাকাতেই কেন জানি তিনি জানলার পাশ থেকে সরে গেলেন৷ আর এরপরই যেন কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল পাখিটা! আর তার সঙ্গে সঙ্গেই হায়নাটাও ‘হ্যা, হ্যা’ করে চিৎকার করে উঠল৷ অন্য প্রাণীরাও যে যার মতো করে চেঁচাতে লাগল৷ এক অদ্ভুত ভয়ংকর কনসার্ট! পশু-পাখিগুলো ডেকেই যাচ্ছে৷ কেমন যেন অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি হল চারপাশে! অদ্ভুত প্রাণীগুলোর অদ্ভুত চিৎকার শুনে হঠাৎই কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল তন্ময়ের৷ এ-পরিবেশে সে এই প্রথম৷ কাজেই সে এই জায়গা ছেড়ে তাড়াতাড়ি এগোল বাড়িটার সামনের দিকে ফিরে যাবার জন্য৷
বাড়িটার সামনে পৌঁছে একটু ধাতস্থ হল সে৷ বাড়ির পিছন দিক থেকে আসা পশু-পাখিদের ডাকও থেমে গেল৷ তন্ময়ের এবার মনে হল, সে যা দেখেছে তা তার মনের ভুল৷ বাড়ির সামনের জমিটাতে ঘুরে বেড়াতে লাগল সে৷ বেলা পড়ে আসছে৷ সূর্য ডুবতে চলেছে৷ এই অপরিচিত পরিবেশে সূর্য ডুবে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই৷ হঠাৎ তন্ময়ের চোখ পড়ল গেটের দিকে৷ সেই অদ্ভুত ঢ্যাঙা লোকটা ফিরে এসেছে সেখানে৷ অক্ষিকোটর থেকে বাইরে বেরোনো চোখ দুটো দিয়ে সে তাকিয়ে দেখছে তন্ময়কে৷ হয়তো এটাই লোকটার তাকাবার ভঙ্গি৷ এ লোকগুলোকে আজকের আগে দেখেনি তন্ময়৷ হয়তো সে কারণেই লোকগুলোকে দেখে অস্বস্তি হচ্ছে তার৷ যাই হোক লোকটার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে লাগল সে৷ কিন্তু এরপরই আরেকজনকে খেয়াল করল সে৷ বাগানেই বসে আছে সে৷ তার সামনে রাখা একটা পাথর৷ গুরুং নামের লোকটা বসে কোমর থেকে তার বিরাট কুকরিটা খুলে পাথরে ঘসে ঘসে ধার দিচ্ছে৷ ধারালো নেপালি কুকরি! তন্ময়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বামনটা প্রথমে অদ্ভুতভাবে তাকাল তার দিকে৷ তারপর কুকরিটা উঁচিয়ে ধরে কী যেন ইশারা করল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তালঢ্যাঙা লোকটাকে৷ আর এরপরই যেন তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে হাসল তারা দুজন৷ তাই দেখে হঠাৎ কেন জানি তন্ময়ের মনে হল লোক দুজন হায়নার খাঁচার আড়ালে তাকে নিয়েই কোনো আলোচনা করছিল না তো? লোক দুটোকে দেখে, বিশেষত বামনের হাতে ধরা কুকরিটা দেখে সত্যিই এবার কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হল তন্ময়ের৷ সে আর সেখানে না দাঁড়িয়ে বাড়ির বারান্দায় উঠে ঘরে ফেরার জন্য এগোল৷ সূর্য ডুবে গেছে, এবার সন্ধ্যা নামবে৷
বারান্দায় উঠতে যাচ্ছিল তন্ময়৷ ঠিক তখনই বারান্দা থেকে নেমে এলেন খরিশবাবু৷ পরনে সেই সাহেবি পোশাক, দস্তানাপরা হাতে ছড়িটা ধরা আছে৷ তাঁর মুখোমুখি হয়ে গেল তন্ময়৷ তিনি তাকে জিগ্যেস করলেন, ‘কী? বাড়ির চারপাশটা বেড়ালেন নাকি?’
খরিশবাবুর প্রশ্নের জবাবে তন্ময় বলল, ‘হ্যাঁ, ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সব৷’
তিনি বললেন, ‘চিড়িয়াখানার ওদিকে গেছিলেন নাকি?’
তন্ময়ের হঠাৎ মনে পড়ে গেল, জানলায় তাঁকে দেখার কথা৷ অবশ্য তন্ময় সে কথা না বলে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ ওদিকে গেছিলাম৷ কিন্তু পশু-পাখিগুলো এমনভাবে ডাকতে শুরু করল যে এদিকে চলে এলাম৷’
কথাটা শুনে খরিশ সামন্ত বললেন, ‘হ্যাঁ, ওরা সূর্যোদয়ের পর একবার, আর সূর্যাস্তের পর একবার এমন ভাবে একসঙ্গে ডেকে ওঠে৷ ব্যাপারটা আপনার অভ্যস্ত হয়ে যাবে ক-দিনের মধ্যেই৷ ওদের নিয়েই তো আপনাকে কাজ করতে হবে৷’
খরিশ সামন্ত এরপর বারান্দা ছেড়ে নেমে গেলেন আর তন্ময় বাড়ির ভিতর গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল৷
ঘরে ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল তন্ময়৷ রাত আটটা নাগাদ দরজায় টোকা দেবার শব্দ শুনে সে ঘুম ভেঙে দরজা খুলে দেখল গুরুং এসে দাঁড়িয়েছে৷ সে গম্ভীরভাবে বলল, ‘খাবার দেওয়া হয়েছে৷ আমার সঙ্গে আসুন৷’ স্পষ্ট অসন্তাোষের দৃষ্টি তার চোখে৷
তার পিছন পিছন ঘর থেকে বেরিয়ে খাবার ঘরে গেল তন্ময়৷ একটা টেবিলে ভাতের থালা আর বাটিতে ডাল ও মুরগির ঝোল৷ ইশারায় থালা-বাটিগুলো দেখিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷ খাবারগুলো দেখেই খিদে চনমন করে উঠল তার৷ তন্ময় খেতে বসে গেল৷ গুরুং আর ফিরল না৷ খাওয়া সেরে নিজের ঘরে ফিরে এল সে৷ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে সে দেখল দরজার ছিটকিনিটা ভাঙা৷ কী আর করা যাবে৷ অবশ্য দরজা খোলা থাকলেও তেমন কোনো অসুবিধা নেই৷ কে আর ঢুকবে তার ঘরে৷ এ কথা ভেবে সে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ তার চোখ গেল জানলার দিকে৷ চমকে উঠল তন্ময়৷ চাঁদের আলোতে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক দীর্ঘকায় মূর্তি৷ সে তাকিয়ে আছে ঘরের ভিতর৷ কিন্তু এর পরক্ষণেই তাকে তন্ময় চিনতে পারল৷ বিকাশ নামে সেই অদ্ভুত লম্বা লোকটা! তন্ময় জানলার বাইরে তাকাতেই সে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল সেখান থেকে৷ লোকটা হয়তো রাতে বাড়ির চারপাশে টহল দিতে বেরিয়েছে—এ কথা ভেবে নিয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল তন্ময়৷ সারা বাড়িটা কেমন যেন নিঝুম হয়ে গেল এরপর৷ কোনো একটা প্রাণী যেন কান্নার মতো ডেকে উঠল একবার৷ সম্ভবত সেটা শকুনের ডাক৷ শকুনের ডাক নাকি অনেকটা কান্নার মতো শোনায় এ কথাটা একবার যেন কার মুখ থেকে শুনেছিল তন্ময়৷ হায়নাটাও একবার ‘হ্যা, হ্যা’ করে হাসির মতো ডাক দিল৷ তারপর বাইরেটাও যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল৷ এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল তন্ময়৷
৷৷ ৬৷৷
মাঝরাত৷ হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তন্ময়ের৷ যেন একটা ঠক করে শব্দ হল তার খাটের নীচে৷ কিন্তু চোখ মেলে আর কোনো শব্দই সে শুনতে পেল না৷ একদম নিস্তব্ধ ঘর৷ বাতি নেভানো থাকলেও খোলা জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলোতে প্রায় সব কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ না, কোথাও কিছু নেই৷ বাড়ির বাইরে বা ভিতর থেকেও কোনো শব্দ আসছে না৷ যদিও তন্ময়ের মনে হল যে খাটের তলায় একবার উঁকি মেরে দেখে, কিন্তু চাদর মুড়ি দেওয়া অবস্থায় আর নড়তে ইচ্ছা করল না তার৷ নিশ্চয়ই শব্দটা মনের ভুল ছিল এই ভেবে আবার পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় একটা ক্যাঁচ করে শব্দ শুনল সে৷ কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শব্দের উৎসটা বুঝতে পারল সে৷ তার ঘরে অন্য পাশ থেকে বন্ধ যে দরজাটা ছিল সেটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে, আর তার ভিতর থেকে সন্তর্পণে প্রবেশ করছে এক ছায়ামূর্তি!
কে? নির্ঘাত তবে চোর হবে৷ তন্ময় ঘাবড়াল না৷ ঘুমের ভান করে সে চাদর মুড়ি দিয়ে নিশ্চল ভঙ্গিতে শুয়ে রইল লোকটা কী করে তা দেখার জন্যে৷ পা টিপে টিপে লোকটা এসে দাঁড়াল খাটের পাশে৷ তার এক হাতে একটা ছোটো কী যেন আছে৷ চাঁদের আলোতে মৃদু ঝিলিক দিল সেটা৷ বেশ কয়েক মুহূর্ত খাটের পাশে দাঁড়িয়ে লোকটা যেন আগে নিশ্চিত হয়ে নিল যে তন্ময় ঘুমিয়ে পড়েছে বলে৷ তারপর সে ঝুঁকে পড়ল তন্ময়ের ওপর৷ ঠিক সেই সময় জানলা দিয়ে সরাসরি চাঁদের আলো এসে পড়ল লোকটার মুখে৷ এবার আর তন্ময়ের মড়ার মতো শুয়ে থাকা সম্ভব হল না৷ সে এক ঝটকায় চাদর সরিয়ে বিছানায় উঠে বসে বিস্মিত ভাবে বলে উঠল, ‘স্যার, আপনি এ ঘরে এত রাতে?’
তাকে হঠাৎ এমন ভাবে উঠে বসতে দেখে খরিশবাবুও একটু চমকে গেলেন ঠিকই তারপর কেমন যেন ফিসফিস করে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই৷ আমিই এসেছি৷’
তন্ময় বলে উঠল, ‘কেন স্যার? কী ব্যাপার?’
কেমন যেন একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল খরিশবাবুর ঠোঁটের কোণে৷ তিনি একই রকম ফিসফিস করে বললেন, ‘জানেন তো এ-বাড়িতে একমাত্র আমি ছাড়া সব মানুষ বা পশুপাখির শরীরে কোনো না কোনো ছোটোবড়ো খুঁত আছে? এ বাড়িতে সেটা যাতে বজায় থাকে সে জন্যই এ ঘরে এসেছি আমি৷ গুরুংকে আপনার খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশাতে দিয়েছিলাম, বুঝতে পারছি হতভাগাটা কাজটা করতে ভুলে গেছে৷’
তাঁর কথা শুনে তন্ময় খাট থেকে নেমে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘আপনি কী বলতে চাচ্ছেন তা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি!’
‘সামান্য ব্যাপার৷ আমি শুধু ছোটো খুঁত করে দেব আপনার শরীরে৷ সামান্য কিছুটা কষ্ট হয়তো হবে আপনার৷ কিন্তু তার জন্যও আমি টাকা দেব৷ আরও এক লাখ টাকা৷’ বললেন খরিশবাবু৷
তাঁর কথা শুনে তন্ময় চমকে উঠে বলল, ‘তার মানে?’
খরিশবাবু বললেন, ‘কিছুই না৷ সামান্য একটা ব্যাপার৷ আপনার একটা কান কেটে নেব আমি৷ তাও পুরোটা নয় অর্ধেকটা মাত্র৷ এতে আপনার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না৷’
এ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তন্ময় খরিশবাবুর দস্তানাপরা হাতের দিকে তাকিয়েই দেওয়ালের একপাশে সরে এল৷
খরিশবাবুর দস্তানাপরা ডান হাতে ঝিলিক দিচ্ছে একটা ক্ষুর!
তন্ময় আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠল, ‘এ কী বলছেন আপনি?’
খরিশবাবু বললেন, ‘বাধা দেবেন না৷ তাতে বেশি ক্ষতি হতে পারে আপনার৷ কাজটা করতে দিন আমাকে৷ আপনার যা যোগ্যতা তাতে এত টাকা বেতনের চাকরি কেউ আপনাকে দেবে না৷ তাছাড়া আপনার ওই কানটার জন্য আরও টাকা দেব আমি৷’
তন্ময় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আমি পুলিশে যাব৷’
খরিশবাবু বললেন, ‘তাতে বিশেষ লাভ হবে না৷ যে কাগজটায় আপনি সই করেছেন তাতে লেখা আছে আপনি স্বেচ্ছায় হায়নার খাঁচায় কাজ করতে চেয়েছিলেন৷ হায়নাটাই আক্রমণ করেছিল আপনাকে৷ আপনি মিথ্যা বলছেন৷ তাছাড়া এই কাগজে লেখা আছে আপনি পাঁচ লাখ টাকা ধার নিয়েছেন আমার থেকে৷ সেটা আত্মসাৎ করার জন্যই গল্প ফেঁদেছেন৷ উলটে বিপদে পড়বেন আপনি৷ টাকাটা ফেরত দেবেন কী ভাবে?’ কথাগুলো বলে তার দিকে এগোতে শুরু করলেন খরিশবাবু৷ তন্ময় যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে দুটো দরজার যে কোনো একটার দিকে যেতে হলেই খরিশবাবুর সামনে দিয়ে যেতে হবে৷ তাঁর হাতের ক্ষুরটাকে এড়াতে পারবে না তন্ময়৷ কিন্তু ক্ষুরটা বাগিয়ে এক পা এক পা করে তার দিকে এগিয়ে আসছেন খরিশবাবু৷ চাঁদের আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে৷ চোখে-মুখে জেগে আছে জান্তব জিঘাংসা৷ খরিশ সামন্তর মুখটা যেন খরিশ গোখরোর মতো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে৷ এমন কুৎসিত মুখ কোনো দিন দেখেনি তন্ময়৷
ক্ষুরটা বাগিয়ে ধরে তন্ময়ের একদম কাছে চলে এলেন তিনি৷ তন্ময় প্রস্তুত হল তার আঘাতটা কোনোক্রমে এড়াবার জন্য৷ ঠিক সেই মুহূর্তে ভোজবাজির মতো খাটের তলা থেকে বেরিয়ে তাদের দুজনের মাঝে আবির্ভুত হল এক খর্বাকায় ব্যক্তি৷ তার হাতেও ধরা একটা জিনিস চাঁদের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠল৷ একটা কুকরি!
তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন খরিশবাবু৷ তারপর মৃদু বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ‘গুরুং তুমি এ ঘরে! লোকটাকে ধরো৷’ তার কথা শুনে তন্ময় আরও চমকে গেল৷ অস্ত্রধারী দু-জন লোককে সে সামলাবে কী ভাবে?
গুরুং কিন্তু বলে উঠল, ‘না৷ আমি ওঁকে ধরব না৷’
খরিশবাবু বলে উঠলেন, ‘মানে?’
গুরুং বলে উঠল, ‘অনেক সহ্য করেছি আপনার পাগলামি৷ কিন্তু আর নয়৷ এ লোকটাকে কিছু করতে দেব না আপনাকে৷ আপনি যখন ওঁর খাবারে ওষুধ মেশাতে বলেছিলেন তখনই একটা সন্দেহ হয়েছিল আমার৷’
খরিশবাবু বলে উঠলেন, ‘তোমাকে কত টাকা বেতন দিই খেয়াল আছে তো? ওতে তোমার পরিবার চলে৷ কাল চাকরি চলে গেলে কী হবে? সরে যাও বলছি৷’
গুরুং কঠিন স্বরে বলে উঠল, ‘না, সরব না৷’
খরিশবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে তবে সরো না৷ কাল সকালেই তুমি এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে৷’
গুরুং ‘আচ্ছা’ বলে তার কুকরিধরা হাতটা নামিয়ে নিল৷ ঠিক এই সময় একটা কাজ করলেন খরিশবাবু৷ তিনি সজোরে লাথি মারলেন গুরুংকে৷ তার হাত থেকে ছিটকে পড়ল কুকরিটা৷ জান্তব রাগে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘এবার তোকেই শেষ করব৷’
গুরুংয়ের কুকরিটা উঠিয়ে নিয়ে এক হাতে সেটা আর অন্য হাতে ক্ষুরটা নিয়ে তার দিকে এগোলেন তিনি৷ মাটিতে পড়ে আছে অসহায় গুরুং৷ ঠিক এই সময় ঘরের ভিতরের বাতিটা হঠাৎ খুট করে জ্বলে উঠল৷ দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে সেই তালঢ্যাঙা লোকটা৷ পরিবেশটা বুঝতে পেরে সে পিছন থেকে জাপটে ধরল খরিশবাবুকে৷ প্রচণ্ড ঝটাপটি শুরু হল তাদের দুজনের মধ্যে৷ কিন্তু কোন অদ্ভুত কৌশলে যেন সেই ঢ্যাঙা লোকটাকেও মাটিতে ছিটকে ফেললেন খরিশবাবু৷ তারপর এক হাতে কুকরি আর অন্য হাতে ক্ষুরটা বিজয়ীর ভঙ্গিতে উঁচিয়ে ধরলেন৷ ঠিক এই সময় চিড়িয়াখানার দিক থেকে হায়নাটার ‘হ্যা, হ্যা’ করে হাসি শোনা গেল৷ হেসে উঠলেন খরিশবাবু৷ দুটো জান্তব হাসি মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল৷ যেন ঘরের বাইরে আর ভিতরে দুটো হায়না হাসছে!’
কিন্তু তারপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল৷ খরিশ সামন্তর হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল ঘরের আয়নাটার ওপর৷ মুহূর্তের মধ্যে তাঁর মুখের ভাব যেন পালটে গেল৷ অস্ত্র ধরা হাত দুটো যেন ঝুলে পড়ল৷ তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘আমার এ কী হল!’ আর তখনই ব্যাপারটা ধরা পড়ল তন্ময়ের চোখে৷ খরিশ সামন্তর গালের একপাশে ইঞ্চিচারেক লম্বা একটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে৷ রক্ত ঝরতে শুরু হয়েছে সেখান থেকে! ঝটাপটির সময় খরিশবাবু নিজের অস্ত্রেই খুঁত করে ফেলেছেন নিজের মুখে! লম্বা গভীর একটা ক্ষত! ক্রমশ রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে তাঁর কানের একপাশ!
আর এরপরই তিনি শুধু চিৎকার করে একটাই কথা বললেন, ‘আমার বন্দুক৷’ তারপরই তিনি ছুটে বেরিয়ে পড়লেন ঘর ছেড়ে৷ বামন আর লম্বা লোকটা সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল মাটি ছেড়ে৷ গুরুং, তন্ময়কে বলল, ‘এবার আর ও আমাদের কাউকে ছাড়বে না৷ চলুন এখনই পালাতে হবে আমাদের৷’
ঘর ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেটের দিকে ছুটল তারা তিনজন৷ তারা যখন গেট ছেড়ে বেরোতে যাচ্ছে তখন পিছন থেকে গুলির শব্দ ভেসে এল ‘গুড়ুম’ করে৷ গুলি অবশ্য কারো গায়ে লাগল না৷ লোক দুটোর পিছন পিছন ছুটতে লাগল তন্ময়৷ বেশ অনেকক্ষণ ছোটার পর একটা রেল স্টেশনে উঠে এল তারা৷
ফাঁকা রেল স্টেশন৷ কোথাও কেউ নেই৷ একটা বেঞ্চে বসে বেশ কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে নিল তারা৷ তারপর বিকাশ বলে ঢ্যাঙা লোকটা তন্ময়কে বলল, ‘খুব বাঁচা বেঁচে গেলেন আপনি!’
তন্ময়ের আতঙ্ক তখনও পুরোপুরি কাটেনি৷ সে বলল, ‘লোকটা এত সুন্দর দেখতে কিন্তু কী ভয়ঙ্কর!’
গুরুং বলল, ‘হ্যাঁ৷ ওই সুন্দর মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক কুৎসিত লোক৷ ও কখনও চায় না ওর চেয়ে সুন্দর কোনো লোক হোক৷ চিড়িয়াখানায় ওই রকম পশু-পাখি বা আমাদের মতো কদাকার লোককে ও বাড়িতে স্থান দেওয়া হয়েছিল কারণ কুৎসিতের মধ্যে যাতে ওর সৌন্দর্য আরো ভালোভাবে লোকের চোখে ধরা পড়ে তাই৷ যে জন্য ও সুন্দর প্রাণীদেরও বাড়িতে এনে কুৎসিত করল৷ ময়ূরটার ডানা ভাঙল, হায়নার কান কেটে তাকে আরও কুৎসিত করল, শেষে ভাঙল ধনেশের সুন্দর ঠোঁটটা৷ ভাবতে পারেন?’
তন্ময় এবার বুঝতে পারল যে জানলায় খরিশ সামন্তকে দেখে কেন আতঙ্কে ডেকে উঠেছিল ধনেশ পাখিটা৷
বিকাশ বলে ঢ্যাঙা লোকটা বলল, ‘ওর কাছে নিজের সৌন্দর্য সবচেয়ে দামি৷ ওর ঘরে অনেক আয়না হয়তো দেখেছেন আপনি৷ সারাদিন ও ঘরে বসে শুধু নিজের সৌন্দর্য দেখে৷ আপনি এত সুন্দর দেখে আমাদের অনুমান হয়েছিল আপনার বিপদ হতে পারে৷ পশু-পাখিগুলোকে যখন ও খুঁত করল তখন পেটের দায়ে আমরা দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করেছি৷ কিন্তু এবার আর সহ্য করতে পারলাম না৷ আপনাকে বাঁচাবার জন্যই খাঁচার আড়ালে পরামর্শ করছিলাম আমরা৷ আমি আপনার ঘরে উঁকি দিয়েছিলাম৷ গুরুং ধার দিচ্ছিল তার কুকরিতে৷ আপনি নিশ্চয়ই আমাদের চেহারার কারণে অন্য কিছু ভেবেছিলেন তাই না?’ কথা শেষ করে একটু বিষণ্ণ ভাবে হাসল লোকটা৷ গুরুং বলল, ‘আমাদের চেহারা দেখে আসলে কেউ ভালো লোক বলে ভাবে না৷ আপনিও ভাবেননি৷’ তার কণ্ঠেও বিষণ্ণতার ছোঁয়া৷
তন্ময় একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার চেহারা নিয়ে আমার নিজেরও বেশ গর্ব ছিল, সেটা আপনাদের দেখে ভেঙে গেল৷ আজ বুঝতে পারছি যে সত্যি সত্যি বাইরের মানুষটা নয় ভিতরের মানুষটাই আসল৷ কিন্তু এখন আপনারা কী করবেন?’
বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তারা দুজন৷ গুরুং হেসে বলল, ‘ও বাড়িতে ফেরার পথ বন্ধ৷ শুনেছি কাছেই এক গ্রামে একটা সার্কাস পার্টি এসেছে৷ সেখানে গিয়ে দেখি যদি কোনো কাজ মেলে৷ আমাদের মতো কুৎসিত মানুষদের তো অন্য কেউ কাজ দেবে না৷ কিন্তু পেট-সংসার চালাতে হয় আমাদেরও৷ একটু পরই কলকাতা যাওয়ার ট্রেন আসবে, ভোর হয়ে এল৷ ট্রেনে উঠে পড়বেন৷’ এই বলে তন্ময়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা হাঁটতে শুরু করল প্ল্যাটফর্মের বাইরে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই আধো- অন্ধকারে হারিয়ে গেল তন্ময়ের দেখা সেরা সুন্দর দুজন মানুষ৷
পুনশ্চ: কলকাতায় ফিরে মানি অর্ডারের টাকাটা হাতে পাবার পর তন্ময় সেটা পালটা মানি অর্ডার করেছিল খরিশ সামন্তর নামে৷ কিন্তু টাকা প্রাপক না থাকায় ফিরে এল৷ ক-দিন পর কিছুটা কাকতালীয় ভাবেই পুরোনো একটা সংবাদপত্রে একটা খবর চোখে পড়ল তার৷ ছোট্ট খবর:
অক্রুরগঞ্জের অদ্ভুত চিড়িয়াখানার মালিক খরিশ সামন্ত নামের এক ব্যক্তি নিজের বন্দুকের গুলিতে রাতে আত্মহত্যা করেছেন৷ নিজের সৌন্দর্য সচেতন খরিশবাবুর মুখে কোনোভাবে কেটে খুঁত হয়ে যাওয়াতেই তিনি অবসাদে আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশের অনুমান৷
খরিশ সামন্তর দেওয়া টাকাটা অবশ্য খরচ করেনি তন্ময়৷ কলকাতায় অনেক সার্কাস আসে৷ এবার থেকে তন্ময় সার্কাস দেখতে যাবে৷ সেখানে যদি সে সেই সুন্দর মানুষদের দেখা পায় তবে সে টাকাটা তুলে দেবে তাদের হাতে৷
—
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন