বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২৩

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমার মামাতো বোনের স্বামীকে কেন যে আমি কোনদিন আর পছন্দ করতে পারবনা সেকথা কারুকে খুলে বলতে পারবনা। কিছুদিন আগে বিয়ে হল, দেখতে খারাপ নয় ছেলেটি এবং তার চেয়েও বড় কথা, বেশ ভালো চাকরি করে, হাসিখুশি, দরাজ হাতে সিনেমা-থিয়েটার দেখাচ্ছে, অল্পবয়সী শ্যালক-শালিকাদের সঙ্গে প্রভূত ঠাট্টা-ইয়ার্কি এবং গুরুজনদের দেখলেই ঢিপঢাপ করে প্রণাম করা, অর্থাৎ নতুন জামাই হিসাবে ঠিক যে-রকম হওয়া উচিত। আমি সম্পর্কে গুরুজন, কিন্তু ভারিক্কি নই বলে বেশ-একটা মার্জিত রসিকতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। ছেলেটিকে অপছন্দ করার কোনই কারণ নেই আমার, বরং খুবই ভালো লাগার কথা। কিন্তু আমি ওকে দেখলেই এড়িয়ে যাই। পারতপক্ষে কথা বলিনা। যদিবা কথা বলতে হয় কখনো, মুখে হাসি থাকলেও, ভিতরে একটা অদ্ভুত ঝাঁঝ ও ঘৃণা মেশানো থাকে।

কারণ, আমি ওকে চিনতে পেরেছি। ও আমাকে চেনেনা, কিন্তু এ-বিয়ে হবার অনেক আগে ওকে আমি একবার মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখেছিলাম। সেই থেকে, ওর মুখ আমার চিরকাল মনে থাকবে। ওকে না-ঘৃণা করে আমার উপায় নেই। অথচ সেকথা মনে করিয়ে দিয়ে ওকে এখন আর অভিযোগ করা যায়না।

বাসে বিষম ভিড় ছিল, বছর পাঁচেক আগের কথা। অসম্ভব গরম, অন্যলোকের ঘাম আমার গায়ে এসে লাগছে, পায়ের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে রকমারি জুতো। এক-একবার ঢেউয়ের মতো ধাক্কায় হেলে পড়ছি। হঠাৎ আমার পাশের সীটের ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তিনি এবার নামবেন, একটা জায়গা খালি হবে এবং সে জায়গাটা আমারই সবচেয়ে কাছে। ভদ্রলোক বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। হঠাৎ একটু দূর থেকে, দু-তিনজন লোকের পিঠ সরিয়ে একটা ব্যাগ-সুদ্ধ হাত এগিয়ে এল, ধপ করে ব্যাগটা রাখল সেই জায়গায়। যেন জায়গাটা রিজার্ভড হয়ে গেল। তারপর শরীর এঁকেবেঁকে, দুমড়িয়ে ঠেলেঠুলে একটি যুবক এসে ধপ্ করে সেই জায়গায় বসে পড়ল। বসেই অন্যদিকে তাকাল যাতে আমাদের সঙ্গে চোখাচোখি না-হয়। যুবকটির সেই চরম নির্লজ্জতায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সুবেশ, সুদর্শন যুবকটি, এমন নয় যে শরীর অসুস্থ, শুধু একটু বসবার জন্য ঐরকম ঠেলেঠুলে জঘন্য অভদ্রতার পরিচয় দেবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আমি বিষম অপমানিত হলাম! আমার পাশে দাঁড়ানো আর-একটি লোক আমার দিকে সহানুভূতিসূচক হাসল বলে অপমানে আমার শরীর আরও জ্বলে গেল।

আমার অপমান বসতে না-পারার জন্য নয়। লোকটির অভদ্র ব্যবহারে। ও—লোকটা আমাদের ভদ্র হবার সুযোগ দিলনা। আমি ভিড়ের ট্রামে-বাসে কখনো বসিনা। বিশেষত যদি একা থাকি। যদি দৈবাৎ আমার সামনে কোন বসার জায়গা খালি হয়, আমি সেটার সামনে আগলে দাঁড়াই, তারপর তাকাই লোকের চুলের দিকে। দেখি, কার মাথার বেশি চুল পাকা। সেই বৃদ্ধ বা বৃদ্ধোপম লোকের দিকে চেয়ে গলায় এক রাজ্যের বিনয় ঢেলে বলি, আপনি বসুন। তারপর, না, না, সেকি, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, না তা কি হয়, হ্যাঁ আপনি বসুন, বেঁচে থাকো বাবা, আজকাল এরকম! লোকটিকে শেষপর্যন্ত বসিয়ে ছাড়ি। হাতের কাছে বৃদ্ধ না-পেলে, কোন স্ত্রীলোক বা বালককে। এই বিনয় বা ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আমি গর্বোদ্ধত মুখে তাকিয়ে থাকি। বলা বাহুল্য, আমার উদারতার কথা এখানে লিখতে বসেছি, এতটা ক্যাড আমি নই। উদারতা নয়, ওটা আমার অহংকার। ঐ সীট-লোভী, শকুনের মতো জনতা যাদের সবারই চোখ তখন ঐ একটি খালি সীটের দিকে সেখানে আমি দাঁড়িয়ে অন্যরকম ব্যবহার করতে, সীট ছেড়ে দেবার উদারতা দেখাতে যে আনন্দ পাই, তার তুলনায় নিজে বসার পর সামান্য পশ্চাৎদেশের সুখ কিছুই না। তখন মনে হয়, ঐ সীটটার আমি মালিক, রাজা, যাকে ইচ্ছে বিলিয়ে দিতে পারি। মানুষের প্রতি দয়া দেখাতে পাবার সুযোগের মতো সুখের সুড়সুড়ি আর কিছুতে পাওয়া যায়না

কিন্তু সেদিন ঐ যুবকটি ছিঁচকে চোরের মতো আগে থেকে ব্যাগ বাড়িয়ে জায়গাটা দখল করে নিতে, আমার অসম্ভব রাগ হয়। রাগ হয়, আমার ভদ্রতা দেখাতে না-পারার ক্ষোভে। তাছাড়া ঐ ছেলেটা, বা অন্য লোকেরা কী ভাবল, আমিই ঐ জায়গাটায় বসার জন্য উৎসুক, লোভী ছিলাম? পাশের লোকটা, তবে আমার দিকে সমবেদনার হাসি হাসল কেন?

তখন, ঐ সীটে-বসা ছেলেটির মুখ দেখতে আমার খুব ইচ্ছে হয়। ব্যাগ হাতে নিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে সুবেশ যুবকটি বসে আছে। কিন্তু, আসলে সাধুবেশে একটি পাকা চোর। পরের জায়গা চুরি করে। ইতর, জোচ্চোর কোথাকার! তোমার মুখ না-দেখে আমি ছাড়ছিনা। তোমার মতো ঘৃণ্য চরিত্রের মানুষকে আমার সারাজীবন চিনে রাখা দরকার।

আমি মুখ নিচু করে সেই যুবকটিকে জিজ্ঞেস করি, ‘এখন কটা বাজে?’ ছেলেটি বোধহয় উৎকর্ণ হয়ে ছিল, নিজের অপরাধবোধে বোধহয় সজাগ হয়েছিল, কেউ কোন মন্তব্য করে কিনা। যদিও তাকিয়ে ছিল জানালা দিয়ে বাইরে, কিন্তু কান খাড়া ছিল বোধহয় এদিকে। আমার প্রশ্নে ধড়মড় করে নড়েচড়ে উঠে বলে, ‘অ্যাঁ?’

–কটা বাজে?

–কী বলছেন?

–ক-টা বাজে, বলবেন দয়া করে? আমি চিবিয়ে-চিবিয়ে প্রশ্ন করি। যুবকটি অবাক হয়ে আমার কঠিন লোহার মতো মুখের দিকে তাকায়। বোধহয় একবার ভাবে যে, আমি অসম্ভব রেগে গেছি, ওর উঠে আমাকেই সীট ছেড়ে দেওয়া উচিত। তা যদি ও করত, অর্থাৎ আমাকে ও ওর নিজের মতো বা জনতার মতো সীট-লোভী মনে করে তা প্রকাশ করত, তাহলে আমি সেইমুহূর্তে বোধহয় ওকে মেরেই বসতাম! তার বদলে, ছেলেটি বসে থেকেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, ভ্যাবাচ্যাকা গলায় বলে, ‘দশটা বাজতে দশ!’ ততক্ষণ আমি ওর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, ওর মুখের ছাঁচ তুলে নিই আমার মনে, ঐ মুখ আমার চিরকাল মনে থাকবে, চিরকাল আমি ঘৃণা করব।

আমারই ভাগ্যের দোষে, সেই ছেলেটি হয়েছে আমার মামাতো বোনের স্বামী। এখন দেখা যাচ্ছে, কী সুন্দর ভালো ছেলে। সবাই বলছে, হীরের টুকরো জামাই। সত্যিই অরুণার ভাগ্য বলতে হবে! আমিও ওর চরিত্রে কোন খুঁত দেখতে পাইনা, এমন মানানসই ব্যবহার, যেখানে ঠিক যেমন দরকার। কিন্তু সেই মুখ আমার মনে আছে, আমার কাছে বিষম ঘৃণ্য ঐ মুখ, দেখলেই আমি মুখ ফিরিয়ে নিই। অথচ ছেলেটির আমাকে নিশ্চয়ই মনে নেই, আমার সঙ্গে ওর ব্যবহার এত সহজ! অর্থাৎ বাসে ও বহুবার সীট চুরি করেছে, এখনো করে চলেছে বোধহয়, আমার সঙ্গে একটা ঘটনা ওর মনে থাকবে কী করে।

অথচ, একথা আমি কারুকে বলতে পারিনা। বললে, বাড়ির সবাই নিশ্চয় হো-হো করে হেসে উঠবে। বলবে, আগ-বাড়িয়ে একটা খালি সীট পেয়ে বসেছিল, এটা আবার দোষের নাকি? তুমি বসতে পারনি, এইজন্য তোমার রাগ? আহা, তখন কি আর পুলকেশ জানত যে একদিন তুমি ওর গুরুজন হবে? তাহলে, নিশ্চয়ই তোমাকেই সীট ছেড়ে দিত। — এসব শুনে আমার মাথায় খুন চড়ে যাবে বলেই আমি কারুকে বলিনা। ওর বিরুদ্ধে আমার একমাত্র অভিযোগ, আমাকে দয়া দেখাবার সুযোগ না-দিয়ে ও কেন নিজেই আগে জায়গা জুড়ে বসেছিল? আমি হয়তো ওকেই বসতে অনুরোধ করতাম।

আহা, অরুণা সুখী হোক্। কিন্তু অরুণার স্বামী পুলকেশকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবনা যতদিন-না ও নিজের মোটরগাড়ি কেনে। মোটরগাড়ি কিনলে একমাত্র তখনই হয়তো আমার মন থেকে ওর সীট চুরির অপবাদটা মুছে যাবে।

সকল অধ্যায়

১. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১
২. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২
৩. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৩
৪. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৪
৫. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৫
৬. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৬
৭. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৭
৮. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৮
৯. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৯
১০. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১০
১১. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১১
১২. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১২
১৩. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৩
১৪. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৪
১৫. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৫
১৬. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৬
১৭. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৭
১৮. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৮
১৯. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৯
২০. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২০
২১. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২১
২২. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২২
২৩. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২৩
২৪. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২৪
২৫. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২৫

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন