বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২১

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একটি লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হল, তিনি বারবার বলতে লাগলেন, এমন বদলে গেল! এমন বদলে গেল! কথা বলার সময় তাঁর কপালের একটি শিরা কাঁপে।

-এখানে তেত্রিশ নম্বর বাড়িটা ছিল, কোথায় গেল?

পার্কের উল্টোদিকের ফাঁকা মাঠে চুন, সুরকি, বালি ডাঁই করা। মিস্ত্রিরা বসে—বসে ইট ভেঙে খোয়া করছে, কয়েকটা বাঁশ পুঁতে তার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়েছে ছাতা। এমন রোদ্দুর যেন মানুষগুলো চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। লাল শাড়িপরা একটি মেয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল, যেন বহে গেল একটা লাল ঢেউ, জাপানি ছবির মতন যেন অদৃশ্য চারিদিকের মধ্যে একটি লাল রেখার ঝলক। লাল রং গ্রীষ্মকে বেশি আকর্ষণ করে, মেয়েটি যেন এক দুপুরের সমস্ত গ্রীষ্ম সরিয়ে নিয়ে অত্যন্ত প্রশান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল। এই রোদ্দুরে তার সামান্য আক্ষেপ নেই। মেয়েরা শীত এবং গ্রীষ্ম উভয় সময়েই সমুদ্বিগ্নমনা।

ভদ্রলোক মেয়েটির অপস্রিয়মাণ মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করলেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে, ইট-ভাঙা মজুরদের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে পানের দোকানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে তেত্রিশ নম্বর বাড়িটা ছিল, কোথায় গেল।’

লোকটি বেশ লম্বা অথবা অত্যন্ত রোগা বলেই বেশি লম্বা দেখায়, রং কালো, সুপুরুষ বলা যায়না, কিন্তু চোখে এমন-একটা ক্লান্তি ও বিষণ্নতা আছে যাতে তার মুখকে একটা আলাদা সৌন্দর্য দিয়েছে। ফাঁকা মাঠের দিকে তাকিয়ে তিনি তেত্রিশ নম্বর বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করছেন। লোকটির লম্বা ছায়া পড়েছিল ফুটপাতে, অজান্তে সেই ছায়ার ওপর আমি দাঁড়িয়েছিলাম বলেই হয়তো লোকটির সঙ্গে অল্পক্ষণের মধ্যে আমার আত্মীয়তা হয়ে গেল।

—বাড়ি তো ছবছর আগে ভাঙা হয়ে গেছে!

—তা তো দেখছি। কিন্তু সে বাড়ির লোকেরা?

—পালবাবুরা! জীবনবাবু চলে গেলেন বোম্বাই, তাঁর ভাই এ-বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চম্পাহাটিতে বাড়ি করেছেন, আশি হাজার দাম পেয়েছিলেন, বাড়ির তো নয়, বাড়ি তো লঝুঝরে হয়ে গিয়েছিল, জমিরই তো দাম!

—না, না তুমি ভুল করছ। আমি তেত্রিশ নম্বর বাড়ির কথা বলছি। সে বাড়িতে তো পাল বলে কেউ থাকতনা। ওটা ছিল রায়চৌধুরীদের বাড়ি। পরমেশ রায়চৌধুরী, অনিমেষ, অবিনাশ

—না বাবু, আমি তো এসে পালবাবুদেরই দেখছি। আপনার বোধহয় ঠিকানা ভুল হয়েছে। এ-বাড়ি পালবাবুরাই বিক্রি করেছেন।

–না আমার ভুল হয়নি। দোতলা বাড়ি, সামনে ঝুল বারান্দা, বারান্দাটা পুরো ছিল জাল দিয়ে ঘেরা, ওখানে পরমেশবাবু ঝাঁক-ঝাঁক মুনিয়া পাখি পুষতেন। বাড়ির দুপাশে রোয়াক, তিন-চার ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে সদর দরজা

কথা বলতে-বলতে লোকটি আবার চুন-সুরকির স্তূপ আর মিস্ত্রি বসে-থাকা ফাঁকা মাঠের দিকে তাকালেন। এইসময় এগিয়ে এসে আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বুঝি অনেকদিন পর কলকাতায় এলেন?’

–হ্যাঁ, প্রায় পনেরো-ষোলো বছর। ঠিক ষোলো বছর চার মাস পর। আপনি রায়চৌধুরীদের চিনতেন?

–না, আমি এদিককার কিছু চিনিনা। তবে মনে হচ্ছে, রায়চৌধুরী ও-বাড়ি বিক্রি করেছিলেন পালদের, পালরা আবার বিক্রি করে গেছে। এখন ভেঙে ফেলা হয়েছে।

— কিন্তু রায়চৌধুরীদের তো এ-বাড়ি বিক্রি করার কোন কারণই ছিলনা।

—ষোলো বছর বড় দীর্ঘ সময়।

–তা ঠিক।

লোকটি একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। রাস্তার আশেপাশে অন্য বাড়িগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার। তারপর আপন মনেই বলতে লাগলেন, অনেক বদলে গেছে। আর কোন্-কোন্ বাড়ি ভেঙে নতুন হয়েছে বা অদৃশ্য হয়েছে ঠিক মনে পড়ছেনা, কিন্তু বুঝতে পারছি, অনেক বদলে গেছে।

তারপর আমার দিকে ফিরে আবার বললেন, ‘রায়চৌধুরীদের ঠিকানা কোথা থেকে পাই বলতে পারেন?’

আমি আগেই জানিয়েছি যে আমি এ-অঞ্চলের লোক নই, রায়চৌধুরীদের চিনিনা, সুতরাং আমাকে ও -প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা অবান্তর। তবু লোকটির অন্যমনস্কতা লক্ষ করে বললাম, ‘আপনার অন্য কোন চেনা লোকদের কাছে খোঁজ করুন, যাঁরা রায়চৌধুরীদেরও চিনতেন। তাঁদের কাছে ঠিকানা পেতে পারেন। আপনি কি আজই এলেন?’

–কাল রাত্রে। ষোলো বছর পর প্রথম এলাম দেরাদুন থেকে। আগে কিছুদিন কার্সিয়াং ছিলাম।

এরপর আর-কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত কিনা বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোক নিজেই বললেন, ‘আমার টি-বি হয়েছিল। বাঁচার কোন আশাই ছিলনা। অনেকের হয়তো ধারণা আমি মরেই গেছি। আমি কিন্তু এখন ভালো হয়ে গেছি, সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছি!’ . লোকটা শেষের কথাটা এমন ব্যগ্রভাবে বললেন যেন আমার বিশ্বাস করা না-করার ওপরে অনেক-কিছু নির্ভর করছে।

–দশবছর আগেই আমার প্রথম সেরে যায়। কিন্তু তখুনি আমি কলকাতায় ফিরে না-এসেই ওখানেই থেকে গিয়েছিলাম। শরীরটাও সারিয়ে ফেরার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তারপর দুবার আমার রিলাপস্ করে রক্তবমি করতে-করতে আমার গলার স্বর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন সম্পূর্ণ সেরে গেছি। তিনবছর আগেই ডাক্তার আমাকে গ্যারান্টি দিয়েছিলেন যে, আমার আর হবেনা। তবু দীর্ঘ তিনবছর আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছি। আর-কোন উপসর্গ দেখা দেয়নি। এখন আমি সুস্থ, প্রায় আপনাদের মতোই স্বাভাবিক মানুষ। ভেবেছিলাম এদিকে আর ফিরবনা। ও-দিকেই থেকে যাব। কিন্তু —

–শেষপর্যন্ত কলকাতা টেনে আনলে।

–কলকাতায় আমার তেমন আকর্ষণ নেই। আমি চলে যাবার পর প্রথম দু-তিন বছর বন্ধু-বান্ধবরা খুব চিঠিপত্র দিত— তারপর আস্তে-আস্তে কমে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। বছরে একবার শুধু দাদা গিয়ে আমাকে দেখে আসতেন। দাদা মারা গেছেন গত বছর। শুধু আকর্ষণ ছিল এই তেত্রিশ নম্বর বাড়ির। যখন সুস্থ হয়ে উঠলাম, তখন বারবার মনে পড়তে লাগল কৈশোর–প্রথম যৌবনে যখন আমি সুস্থ ছিলাম, সেই দিনগুলোর কথা। সেই সময়টা কেটেছে এই বাড়িতে। এ-বাড়িতে আমার বন্ধু অনিমেষ থাকত। আর ওর তিন বোন। লীলাদি, মায়া আর ছায়া। ওরা চার ভাইবোন ছিল কাছাকাছি বয়সের–সকলেই আমার বন্ধু। একটা আশ্চর্য কথা কী জানেন, তখন যে লাল শাড়িপরা একটি মেয়ে গেল–তাকে দেখে আমি বিষম চমকে গিয়েছিলাম। আচ্ছা মেয়েটিকে আপনিও দেখেছিলেন, না আমার চোখের ভ্রম?

–আমিও দেখেছি।

–আশ্চর্য। বিশ্বাস করুন, অবিকল অনিমেষের ছোট বোন ছায়ার মতো দেখতে। ঠিক সেইরকম মন্থর অহংকারী হাঁটার ভঙ্গি। অথচ ছায়া তো হতেই . পারেনা, এতদিনে ছায়ার আরও ষোলো বছর বয়েস বেড়েছে। তাছাড়া ছায়া ও—রকম একা রাস্তায় বেরুতনা, সবসময় সঙ্গে চাকর বা দারোয়ান থাকত।

কী জানি, কী ভেবে হঠাৎ আমি বলে ফেললাম হয়তো আপনার দেরাদুনে থেকে যাওয়াই উচিত ছিল। না-ফিরলেই পারতেন।

লোকটি ঈষৎ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর আমার অনধিকার চর্চায় বিরক্ত না-হয়েই বললেন, ‘ফিরব না-ই ভেবেছিলাম।’

কলকাতা থেকে যখন জ্বরে আচ্ছন্ন অবস্থায় চলে যাই, বিষম অভিমান নিয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এ-শহর আমাকে চায়না, আমিও আর এ-শহরের কাছে ফিরে আসবনা! কিন্তু কলকাতাকে মনে পড়ার একটা সাইক্ল্ আছে। পাঁচবছর পর-পর বিষম মন কেমন করে। গতবছর থেকেই ফেরার জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। ওখানে থাকতাম একা-একা। আলাদা একটা ঘর ভাড়া নিয়ে! কিন্তু একাকীত্ব মানুষকে ক্রমশ নির্বোধ করে দেয় কবিরা যাই বলুক, একাকীত্বই আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। কিন্তু যদি জানতাম তেত্রিশ নম্বর বাড়িটা নেই—! জানেন, ঐ জায়গায় ভদ্রলোক আমাকে আঙুল দিয়ে একটা শূন্যস্থান দেখিয়ে বললেন ছিল সদর দরজা, তারপর একটা গলির মতন, পরে চাতাল, সেখানে একটা লম্বা কাঠের বেঞ্চ পাতা থাকত। ওখানে আমরা বসে রাস্তার মানুষ চলাচল দেখতাম; চোখে পড়ত উলটোদিকের পার্ক, ফুচকাওলাকে ডেকে নিয়ে যেতাম ভেতরে। অনিমেষ বাড়িতে না-থাকলেও আমি ওর বোনদের সঙ্গে বসে গল্প আর হাসিঠাট্টা করতাম। তখন আমি বুঝতে পারিনি, লীলা, ছায়া আর মায়া এর মধ্যে কাকে আমি ভালোবাসতাম। পরে নির্জন প্রবাসে বসে অনেক ভেবেছি, বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম, আর-একবার ঐ বাড়িতে ঢুকে কাঠের বেঞ্চিটায় বসতে পারলেই মনে পড়বে। কিন্তু—

একটুক্ষণ চুপ। ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটি বললে, ‘যাক্ তবু বাড়িটা ভেঙে ফেলে এখন ও শূন্য মাঠ। আমি মাঠের মধ্যে বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি কল্পনায়। কিন্তু এর বদলে যদি দেখতাম, চৌকো লম্বা দেশলাই-এর বাক্সের মতো, আধুনিক বিশ্রী একটা নতুন বাড়ি, তাহলে খুব খারাপ লাগত।

কথাবার্তা অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং সেন্টিমেন্টাল দিকে চলে যাচ্ছে দেখে আমি ঘোরাবার চেষ্টা করে বললাম, ‘কলকাতা শহরের আর কী-কী বদল দেখলেন? আমাদের তো চোখে পড়েনা।’

–কলেজ স্ট্রিট! চেনাই যায়না। সিনেট হলের গম্ভীর থামগুলো আর প্রসন্নকুমার ঠাকুরের মূর্তিটাই নেই, সেখানেও উঠছে একটা দেশলাই-এর বাক্স—বাড়ি। কাল রাত্রের দিকে চৌরঙ্গি-অঞ্চলের দিকে ঘুরছিলাম, নতুন নিয়ন আলোয় এ-শহর সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে আমার কাছে। কোন্ কোন্ জিনিশ বদলে গেছে আমি ঠিক বলতে পারবনা, কিন্তু বুঝতে পারছি অনেক-কিছু বদলে গেছে। অনেক, প্রায় একটা অন্য শহর।

আমি বললাম, ‘বৌদ্ধ গাথায় আছে, এক নদীতে কেউ দুবার স্নান করতে পারেনা। নদীর নাম এক থাকলেও নদীর জল বদলে যাচ্ছে অনবরত। সেইরকম একবার চলে গেলে এক শহরে বোধহয় কেউ আর দ্বিতীয়বার ফিরে আসতে পারেনা। ফিরতে হয় অন্য শহরে।’

–হয়তো তাই। বুঝতে পারছি, এ-শহর আমার সে-চেনা শহর একটুও নয়। দেখি যদি রায়চৌধুরীদের ঠিকানা খুঁজে পাই। অনিমেষ আর ওর বোনদের সঙ্গে দেখা হলে হয়তো সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়বে।

বিদায় নেবার সময় আমি মনে-মনে ভাবলাম, অনিমেষ রায়চৌধুরী আর তার বোনদের সঙ্গে এই লোকটির আর দেখা না-হলেই বোধহয় ভালো হয়। সেই বাড়ির বদলে চৌকো দেশলাইয়ের বাক্সমার্কা বাড়ি দেখলে ভদ্রলোক যেমন দুঃখিত হতেন — সেই রায়চৌধুরীদের এখন দেখলে বোধহয় তার চেয়েও বেশি দুঃখিত হবেন। শহর আর কী বদলেছে, বদলেছে এ-শহরের মানুষ। মানুষের মুখ দেখে বুঝতে পারছেননা। এরকম নিস্পৃহ, কঠিন, তিক্ত, সেকেন্ডব্রাকেট-ভুরু মুখের মিছিল কী আগে ছিল এ-শহরে? যে-কোন মানুষের মুখ দেখলেই বুঝতে পারতেন। এমনকী আমার মুখ দেখেও।

সকল অধ্যায়

১. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১
২. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২
৩. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৩
৪. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৪
৫. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৫
৬. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৬
৭. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৭
৮. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৮
৯. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৯
১০. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১০
১১. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১১
১২. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১২
১৩. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৩
১৪. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৪
১৫. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৫
১৬. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৬
১৭. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৭
১৮. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৮
১৯. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৯
২০. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২০
২১. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২১
২২. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২২
২৩. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২৩
২৪. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২৪
২৫. বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২৫

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন