১৯. সুরুজ আলি অনেক রাতে খেতে বসেছে

হুমায়ূন আহমেদ

সুরুজ আলি অনেক রাতে খেতে বসেছে। অন্দরবাড়িতেই তাকে খেতে দেয়া হয়। আজ বাংলাঘরে খাচ্ছে। পুষ্প ভাত-তরকারি এগিয়ে দিচ্ছে। দরজার বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে কুসুম।

মনোয়ারার ব্যথা ওঠেছে। ব্যথায় কাটা মুরগির মত ছটফট করছেন। মনোয়ারার বড় বোন আনোয়ারা বোনের পাশে আছেন। আজ তার চলে যাবার কথা ছিল। মনোয়ারার ব্যথা ওঠার কারণে যেতে পারছেন না। আনোয়ারা এসেছিলেন কুসুমের বিয়ের ব্যাপারটা ফয়সালা করতে। তিনি মোটামুটিভাবে করেছেন। ছেলে তার খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি কুসুমকে বলেছেন–অনাথ ছেলে হলেও সে যে উঁচু বংশের তা বোঝা যায়। কারণ ভাত খাওয়ার সময় এই ছেলে ছোট ছোট ভাতের নলা করে মুখে দেয়। ভাতের নলা যার যত ছোট তার বংশ তত উঁচু।

কুসুম তার উত্তরে বলেছে, তাহলে তো খালাজান মুরগির বংশ সবচাইতে উঁচা।

মুরগি একটা একটা কইরা ভাত খায়।

কুসুমের কথায় তিনি খুবই বিরক্ত হয়েছেন। তার ধারণা হয়েছিল, কুসুম বোধূয় এই বিয়েটা চাচ্ছে না। তিনি কুসুমকে আড়ালে ডেকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিন্ত হলেন যে, কুসুমের কোন আপত্তি নেই। ছেলে কুসুমেরও পছন্দ।

তিনি কুসুমকে আশ্বস্ত করে বলেছেন–ছেলে কাজকাম করে না এইটা নিয়া তুই চিন্তা করিস না। রুটি-রুজির মালিক মানুষ না, আল্লাহপাক। আর পুরুষ মাইনষের ভাগ্য থাকে ইস্তিরির শাড়ির অঞ্চলে বান্দা।

আমার শাড়ির অঞ্চলে তো খালাজান কিছুই নাই।

আছে কি নাই এইটা তোর জানার কথা না। জাঞ্জেল্লাহপাক। আর আমরা তো আছি। বানে ভাইস্যা যাই নাই।

কুসুমের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে তার খালুজনই অবস্থাসম্পন্ন। কুসুমের বিয়ের খরচপাতির বেশিরভাগই তিনি করবেন কাজে তার কথাবার্তা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হয়।

 

আড়াল থেকে কুসুম মানুষটার খাওয়া দেখছে। ভিতরবাড়িতে সে সামনে যায় কিন্তু বাংলাঘরে পুরুষের সামনে যাওয়া যায় না। সুম মনে মনে হাসছে। খালা এই মানুষটাকে যত বড় ঘরের মনে করছেন সে তত বড় ঘরের না। এই তো বিরাট বিরাট নলা করে মুখে দিচ্ছে। খিদে মনে হয় খুব লেগেছে। খাওয়া দিতে অনেক দেরি হল।

এক সময় কুসুম বলল, আফনের পেট ভরছে? লোকটা ধড়মড় করে উঠল। কুসুম যে এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়েছিল সে বুঝতে পারেনি।

অযত্ন হইলে ক্ষমা দিবেন। মার শইলডা ভালা না।

অযত্ন হয় নাই।

পুষ্প, যা পান বানাইয়া আন।

পুষ্প পান আনতে গেল। কুসুম ঘরে ঢুকল।

গ্রামের একেবারে এক প্রান্তে বাড়ি, তার উপর বলতে গেলে নিশুতি রাত। সে কি করছে না করছে দেখার কেউ নেই। কুসুমকে ঢুকতে দেখে সুরুজ আরও হকচকিয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল। কুসুম বলল, বসেন বসেন। সুযোগ বুইজ্জ্যা দুইটা কথা বলতে আসছি।

সুরুজ বলল, কি কথা?

কুসুম সঙ্গে সঙ্গে বলল, ব্যাঙের মাখা।

সুরুজ অকিয়ে আছে অবাক হয়ে। কুসুম বলল, আমার কথায় অবাক হইয়েন। আমি জ্বীনে ধরা মেয়ে। আমার কথাবার্তা কাজকর্মের ঠিকঠিকানা নাই।

সুরুজ বিস্মিত হয়ে বলল, জ্বীনে ধরা?

হুঁ। অনেক তাবিজাবিজ দিছে। তাবিজে কাজ হয় না। আফনে চিন্তা কইবেন, বিয়ার পরে জ্বীন থাকে না।

কুসুম চৌকির উপর বসল। সহজ ভঙ্গিতেই বসল। যেন অনেক দিনের চেনা মানুষের সঙ্গেই গল্প করতে বসেছে। পুষ্প পান নিয়ে এসে কুসুমের চোখের দিকে তাকাল। কুসুম বলল, থালাবাটি লইয়া ভিতরে যা পুষ্প, আমি আসতাছি।

পুষ্প থালাবাটি নিয়ে চলে গেল। কুসুম সুরুজের দিকে পানদান এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আফনেরে সবের খুব পছন্দ হইছে। আমারও হইছে।

সুরুজ খুক খুক করে কাল।

কুসুম বলল, জ্বীনের কথা শুইন্যা ভয় পাইয়েন না। পুরুষ মানুষের ভয় ভাল জিনিশ না। আর জ্বীন তো আমারে রোজদিন ধরে না, মাঝে মইধ্যে ধরে।

সুরুজ ক্ষীণ স্বরে বলল, তখন কি হয়?

এইসব আফনের শুইন্যা লাভ নাই। আমার যে বিয়া হয় না, এই কারণেই হয় না। কত সম্বন্ধ আইল, কত সম্বন্ধ ভাঙল। নেন, পান খান।

কুসুম নিজেই পান এগিয়ে দিল। সুরুজ পান নিল ভয়ে ভয়ে। কুসুম বলল, এক রাইতে কি হইছে শুনেন–জ্বীনের আছর হইছে–নিশুঁত রাইত, আমি দরজা খুইল্যা বাইর হইছি। উপস্থিত হইছি মতি ভাইয়ের বাড়িতে। ছিঃ ছিঃ, কি কেলেঙ্কারি! মতি ভাই থাকে একলা। জোয়ান পুরুষ, সে দরজা খুইল্যা আমারে দেইখ্যা অবাক। আমার কথা শুইন্যা মনে কিছু নিয়েন না। আফনেরে আপন ভাইব্যা বলতেছি।

সুরুজ আবার কাশল। তার মুখ ভর্তি পান। কিন্তু সে পান চিবুতে পারছে না। কুসুম ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আফনে ঘুমান। রাইত মেলা হইছে।

কুসুম ঘর থেকে বের হয়ে দেখল, অন্ধকারে দরজার ওপাশে পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে। সে থালাবাটি নিয়ে চলে যায়নি, নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল। পুষ্প নরম গলায় বলল, বুবু, তুমি নিজেই বিয়া ভাইঙ্গা দিলা!

কুসুম বলল,। কাউরে কিছু বলিস না পুষ্প। আমি কাউরে কিছু বলব না, কিন্তুক সুরুজ ভাই বলব। বাপজানরে বলব।

না, সেও কিছু বলব না। কাউরে কিছু না বইলা পালাইয়া যাইব।

উহুঁ।

কুসুম তীক্ষ্ণ গলায় বলল, উহুঁ বলছস ক্যান?

সুরুজ ভাই পালাইব না। তোমারে তার খুব মনে ধরছে। জ্বীন-ভূতের কথা বইল্যা তারে খেদাইতে পারবা না।

 

ব্যথায় মনোয়ারা সারারাত কষ্ট পেলেন। মোবারক ফিরলেন মাঝরাতে—খালি হাতে। রাজবাড়ির মেয়ের লেখা ওষুধ নিন্দালিশ বাজারের ফার্মেসিতে পায় গেল না।

ভোরবেলা ব্যথা কমে গেল। মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলেন–কুসুমের বিয়ে হচ্ছে। চারদিকে বাদ্যবাজনা বাজছে। রাজবাড়ির মেয়েটা এসে কুসুমকে সাজিয়ে দিচ্ছে। সে কালো একটা বাক্সভর্তি গয়না নিয়ে এসেছে। বাক্স থেকে গয়না নিয়ে একের পর এক পরিয়ে দিচ্ছে। পাথর বসানো কি সুন্দর ঝলমলে গয়না!

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার ভয় ভয় লাগছে
২. ০২. পায়ের কাছে প্রকাণ্ড জানালা
৩. ০৩. সারারাত বৃষ্টিতে ভেজার ফল
৪. ০৪. আমার সালাম নিও
৫. ০৫. আকাশ দেখে কে বলবে
৬. ০৬. মতির জ্বর পুরোপুরি সারেনি
৭. ০৭. শহরের বাড়িগুলির সুন্দর সুন্দর নাম থাকে
৮. ০৮. পরাণ ঢুলীর বাড়িতে
৯. ০৯. মতি ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে
১০. ১০. ইরতাজুদ্দিন সাহেব তাঁর শোবার ঘরে
১১. ১১. পুষ্পকে নতুন শাড়ি কিনে দেয়া হয়েছে
১২. ১২. ইরতাজুদ্দিন সাহেব নীতুকে সঙ্গে নিয়ে
১৩. ১৩. মতি টাকা ধার করেছে
১৪. ১৪. গানের আসর বসেছে
১৫. ১৫. গান ভোররাত পর্যন্ত হবার কথা
১৬. ১৬. চিঠি লেখা বন্ধ করে শাহানা উঠে দাঁড়াল
১৭. ১৭. মনোয়ারার মনে সকাল থেকে কু ডাকছিল
১৮. ১৮. ইরতাজুদ্দিন খেতে বসেছেন
১৯. ১৯. সুরুজ আলি অনেক রাতে খেতে বসেছে
২০. ২০. সুখানপুকুর নামের মানে কি
২১. ২১. মোহসিন একাই এসেছে
২২. ২২. আকাশে প্রকাণ্ড থালার মত চাঁদ উঠেছে
২৩. ২৩. শাহানা ঢাকায় রওনা হবে
২৪. ২৪. কুসুম নৌকা ঘাটায় যায় নি
২৫. ২৫. তুই যদি আমার হইতি রে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন