নসিব পঞ্চম জিহাদী
প্ৰায় তিন বছর পর স্বপ্নটা দেখে আমি আবার জেগে উঠলাম।
ভূতের সিনেমা দেখতে দেখতে অনেকের কল্পনা একেবারে বদ্ধ একটা জায়গাতে এসে আটকে গিয়েছে। কাউকে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছি বললেই ভাবে ঘুমের মধ্যে বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করেছি, তারপর কথা নেই বার্তা নেই ধুপ করে উঠে একদম বসে পড়েছি। চোখে মুখে ছিলো ভয়ে মরে যাবার একটা অভিব্যক্তি। এরপর বিছানার পাশে থাকা পানির গ্লাসটা শুন্য হয়েছে মাত্র এক চুমুকে।
বাস্তবে কিন্তু ঘটনা একেবারেই আলাদা।
আমি স্বপ্নটা দেখা শেষ করে আরাম করে একটা ঘুম দিয়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠেছি বেশ স্বাভাবিকভাবেই। সবার সাথে কথাবার্তা বলে অনেকদিন পর দেশে ফেরার কারণে যেসব বিরক্তিকর আত্মীয়স্বজন আমাকে দেখার ছুঁতোয় বাসায় এসেছিলো, তাদের সাথে অমায়িক আচরণ করে নাস্তা পানি খাইয়েছি। তারপর শুরু হলো আব্বার সাথে রাজনীতি বিষয়ক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। সব শেষে বিকেলবেলা পুরানো বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে বাসাবো পর্যন্ত একটা রিকশা ঠিক করে রওনা দেওয়ার মিনিট পাঁচেক পরই আমার মনে পড়লো স্বপ্নটা আমি আবার দেখেছি।
এবার আমি ভয় পেলাম। আসলেই ভয় পেলাম। ভূতের সিনেমাগুলোর মতন আর কিছুক্ষণ পরেই চোখ উল্টে যাবে– এমন একটা অনুভূতি আমার চেহারায় ফুটে উঠেছিলো কিনা আমি জানি না; তবে ভয়ে আমার পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আমি ঘামতে থাকলাম। গলা এমন বাজেভাবে শুকিয়ে গেলো যে মনে হলো আমি তিন-চার দিন ধরে পানি নামক কোন তরল পদার্থের অস্তিত্ব চোখে দেখিনি।
আমার কানের কাছে বাজছিলো, ‘ওকে ধরো, যেভাবে পারো ওকে ধরো। ওকে আমার লাগবেই!’
অডিটরি হ্যালুসিনেশান, জানি আমি। তারপরও এতটা বাস্তব আওয়াজ কানের কাছে বাজে কিভাবে?
আমি কোন মতে বললাম, ‘মামা, রিকশা ঘোরান।
অটো সাজেশান দিতে থাকলাম নিজেকে, আমার কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু না। আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি।
বলাটাই বৃথা গেলো। কাজের কাজ কিছুই হলো না।
কানের কাছে বাজতে থাকলো, ওকে মেরে ফেলতে হবে। অল্পবয়েসী একটা ছেলেই আমার দরকার!
শরীরটাই শুধু এই সময়ে থাকলো। মন চলে গেলো চার বছর আগে। আমার কাছে মনে হলো আমি জেগে উঠেছি। অনেকদিন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এখন আবার জেগে উঠেছি।
প্রায় তিন বছর বছর পর স্বপ্নটা দেখে আমি আরেকবার জেগে উঠেছি।
তিন মাস পর।
খসরুর বাড়িটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় আমার কাছে ঈর্ষণীয় একটা জায়গা ছিলো। গুলশান দুই এর শেষের দিকে যে ক’টা পুরনো ধাঁচের আলিশান বাড়ি এখনো অবশিষ্ট আছে, সেটার মধ্যে বসন্ত বিলাপ একটা। খসরুর মা নেই, বাবা দেশের বাইরে। ছেলের দায়িত্বে বাড়িটা দিয়ে গেছেন তিনি। তিন তলা পর্যন্ত ভাড়া দিয়ে চার তলায় দু’টো ফ্ল্যাট নিয়ে সে সম্পূর্ণভাবে নিজের একটা দুনিয়া বানিয়ে রেখেছে সেখানে। খসরু আমার দেখা প্রথম ছেলে, যে প্রচন্ড পয়সাওয়ালা একজন বাবার একমাত্র ছেলে হওয়ার পরও ভাদাইম্মা হিসেবে নিজেকে কখনও প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
খসরুর সাথে ওর চাচাতো ভাই থাকে। আরও ভালো ভাবে বলতে গেলে সে ওর আপন ভাইয়ের মতনই। খসরুর বাবার বড় ভাই আর ভাবি একটা দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর ভাইয়ের ছেলেকে তিনি নিজের কাছে রেখেই বড় করেছেন। বলতে গেলে খসরু আর রাদিফ একই সাথে বড় হয়েছে।
দেশে ফেরার পর এই প্রথম ওদের এদিকটায় পা রাখলাম।
আমাকে দেখে দু’জন একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে পরবে সে কথা মাথাতেও রাখিনি আমি। বাঁধ ভাঙা অনুভূতি কাউকে দেখিয়ে ফেলা ওদের ধাতেই নেই বলতে গেলে। তবুও আমাকে দেখে ভালো-লাগাটা ওরা লুকাতে পারলো না। খসরু এগিয়ে এসে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।
‘আমি কাকে দেখছি! সত্যিই এটা আমাদের সৌধ তো?’
‘হ্যাঁ, আমিই। এবার দয়া করে ছাড়। তোর জঘন্য পারফিউমের গন্ধে আমার বমি চলে আসছে!,’ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বললাম আমি।
খসরু এক ঝটকায় আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘এটা আমার স্পেশাল কালেকশন শালা মূর্খ! তোর দেশে আসার খবর পেয়েছি আরও দু’ তিন মাস আগে। আর এতোদিনে চেহারা দেখালি নিজের? কোন ফোন নেই, মেসেজ নেই, যোগাযোগ করার কোন মাধ্যমই তো তুই খোলা রাখিসনি! একটাই উপায় বাকি ছিলো– প্রাগৈতিহাসিক কালের মতন তোকে চিঠি লেখা। শেষ মেষ সেটা করতেই বাধ্য করলি! হয়েছেটা কি তোর! কি করেছিস তুই এতোদিন?’
‘এই সত্যি করে বলতো লুকিয়ে বিয়ে টিয়ে করিসনি তো আবার?,’ রাদিফ বেশ সন্দেহজনক কন্ঠে বলে উঠলো, ‘নারী ঘটিত কোন ঝামেলা?’
‘নারী ঘটিত ঝামেলায়? তাও আবার আমি? আমাকে নতুন চিনিস নাকি তোরা!’
‘কামঅন ব্রো! মানুষ পাল্টাতে কতক্ষণ? আগে প্রতি সপ্তায় একবার আমাদের এখানে না এলে তোর ইমিউন সিস্টেম কাজ করতো না। আর এখন? দেশে ফেরার তিন মাস পর তোকে খবর পাঠিয়ে আনতে হলো!,’ একটা নিঃশ্বাস ফেললো রাদিফ, ‘যার এতোবড় পরিবর্তন আসতে পারে, তার জন্য নারী ঘটিত কোন গ্যাঞ্জামে জড়ানো বিচিত্র কিছু না।’
কিছু বললাম না আমি। প্রতুত্তরে একটা শুকনো হাসি উপহার দিলাম ওদের।
‘না…না,’ খসরু মাথা নাড়লো, ‘একটা ঘাপলা তো অবশ্যই আছে। তুই এভাবে চোরের মতন হাসছিস কেন?
‘অনেক লম্বা কাহিনি, খসরু,’ আমি শুকনো কন্ঠে বললাম, ‘আমি ভয়াবহ একটা সমস্যায় পড়েছি।’
‘কি-রকম সমস্যা?,’ খসরু জানতে চাইলো।
‘অনেক সময় নিয়ে বলতে হবে। তোদের সময় আছে হাতে? সম্ভব হলে আজকের রাতটা এখানেই থাকতে চাই।’
রাদিফ ওর দাঁত বের করে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘তোর জন্য সময়ই-সময়। এতো প্যারা নিচ্ছিস কেন? তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে এতোদিন বনবাসে ছিলি, মাস খানেক খেতে পাসনি ঠিকমতন। খেয়ে দেয়ে একটু রিল্যাক্স হ। তোর সমস্যা শোনার মতন মনযোগী আর আগ্রহী শ্রোতা আমাদের থেকে ভালো এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।’
প্রতুত্তরে আমি আরেকবার শুকনো হাসি হাসলাম।
*
আমি আহমেদ রাদিফ। সৌধ ইবনে মুসার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রাক্তন ক্লাশ-মেট। ওর ভেঙে যাওয়া ব্যান্ডের পিয়ানিস্ট এবং গিটারিস্ট। সাথে ওর ভাষ্যমতে, একজন রেসিস্ট।
আজ শ্রাবণ মাসের আঠারো তারিখ। বাইরে ভয়াবহ ঝড় হচ্ছে। এরকম আবহাওয়ার মাঝে সৌধ এসে উপস্থিত হতে পারে সেটা আমার মাথাতে একদমই ছিলো না। তবে আজ আমার সামনে যে সৌধ বসে আছে তাকে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না। ওকে বেশ অন্যরকম লাগছে। চোখে মুখে কেমন একটা দিশেহারা ভাব। চুলগুলো উস্কো-খুশকো। গালের দাড়িগুলোতে শেষ কবে ছুরি কাঁচির ছোঁয়া লেগেছিলো সে কথা ঈশ্বর জানেন। পরণের কাপড়গুলোও আধ-ময়লা। অথচ আমরা সারাজীবন ওকে পরিপাটি দেখে অভ্যস্ত। কোনদিনও কোঁচকানো শার্ট, আধময়লা জিন্স বা ময়লা জুতা পরতে দেখা যায়নি ওকে, অন্তত আমি কখনওই দেখিনি। ওর পরিষ্কার থাকার বাতিক আছে। এমনকি সৌধের রুমের কি-বোর্ড উল্টেও কখনও এক কণা ধুলো পড়তে দেখিনি আমরা।
সে বুভুক্ষু মানুষের মতন খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে এসে বললো, ‘তোদের গান-বাজনা কেমন চলছে?’
‘যক্ষা রোগীর মতো ধুঁকে ধুঁকে। আগের মতন অ্যাকটিভ না আমরা,’ খসরু দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো, ‘তবে আমার মনে হয় আমাদের খবর জানার আগে তোর এই সন্ন্যাসীর মতন বেশভূষা আর রহস্যময় অন্তর্ধাণের খবরটা আমাদের আগে জানানো উচিত।’
এবার সে বেশ সুন্দর করে হাসলো সে। বললো, ‘বলবো। ঘটনাটা বেশ বড়। তাই একটু সময় নিয়ে মাথায় কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি।’
সৌধর চোখে মুখে কেমন একটা নির্লিপ্ত ভাব। সে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা পাশের ফ্ল্যাটের ওই বড় বারান্দাটা কি এখনো আছে?’
‘থাকবে না কেন!,’ আমি অবাক হলাম, ‘বারান্দা কি ভেঙে ফেলে দেবো নাকি?’
সৌধ হাসলো, ‘তাহলে চল ওখানে গিয়ে বসি।’
‘এই ঝড়ের মধ্যে?’
‘হ্যাঁ,’ সে বললো, ‘কোন সমস্যা আছে?’
‘একদমই না,’ আমি হাসিমুখে উত্তর দিলাম।
ছোটবেলা থেকেই এই বারান্দাটা আমাদের খুব প্রিয়। চাচাঁদের বাড়িটা পুরানো বলেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে এই গরাদ-বিহীন বারান্দাটা করা হয়েছিলো। নাহলে এই সময়ে কেউ বারান্দার জন্য এতখানি জায়গা ছাড়তে চায় না।
ইদানিং খসরুর গাছপালা লাগানোর শখ হয়েছে। খুঁজে খুঁজে অপরিচিত সব গাছ নিয়ে আসে সে। বিচিত্র সেসব গাছের ল্যাবরেটরি হচ্ছে এই জায়গাটা। পুরোটা বারান্দা বিচিত্র সব লতাপাতায় ভরে থাকে সবসময়।
আমরা তিনটা চেয়ার, এক ফ্লাস্ক চা আর সিগারেটের একটা প্যাকেট নিয়ে বারান্দাতে এসে বসলাম। খুব সম্ভবত এটা এই বছরের সবথেকে ভয়াবহ ঝড়। থামার কোন নাম গন্ধই নেই। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা যথেষ্ট ভালো, তারপরও দেখা যাচ্ছে পানি জমে গিয়ে একাকার অবস্থা সেটার। শহরের বাকি পথ ঘাটের কথা আমি আর চিন্তাও করতে চাইলাম না।
বারান্দার সামনের অংশটা পানি দিয়ে একেবারে ভেসে গিয়েছে। যদিও আমরা বেশ পেছনে এসে বসেছি। তবুও মাঝে মধ্যে পানির ছাট আমার মুখে এসে লাগছে। হলুদ সোডিয়াম বাতি, তুমুল ঝড়, আর সৌধের রহস্যময় আচরণ– সব মিলিয়ে বেশ নাটকীয় একটা পরিবেশ।
খসরু হাতে চা নিয়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘শুরু কর এবার।’
সৌধ বেশ ধীরে সুস্থে মগে একটু চা ঢাললো। একটা সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষণ কেশে সেটায় সুদীর্ঘ একটা টান দিয়ে বললো, ‘ফাইনাল ইয়ারের একদম শেষের দিকে ইমতিয়াজ সালেহীন নামের এক ভদ্রলোকের কথা প্রায়ই বলতাম। মনে আছে তোদের?’
খসরু বললো, ‘মনে আছে। ভদ্রলোকের খুব সম্ভবত বই সংগ্রহ করার বাতিক ছিলো … আর কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। তাই না?’
‘হ্যাঁ,’ সৌধ বললো, ‘আমার সমস্যাটার সাথে এই ভদ্রলোকের বেশ বড় একটা সম্পর্ক আছে। অবশ্য ঘটনা শেষ করার পর তোরা নিজেরাই সব বুঝে ফেলবি।’
‘অনেক ভ্যাজর ভ্যাজর হয়েছে,’ বিরক্ত হয়ে বললাম আমি, ‘এবার শুরু কর দেখি।
সৌধ শুরু করলো। বাইরে তুমুল বৃষ্টির সাথে ছন্দ মেলানো রিমঝিমে একটা শব্দ। ঠান্ডা ঝড়ো বাতাস, বাতাসে ভেজা গন্ধ, সেই সাথে রাস্তার সোডিয়াম বাতির আলো এসে খসরু আর সৌধের চোখে মুখে পড়ে কেমন একটা অপ্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারণা ঘটালো।
সৌধের গল্প বলার ধরণও যথেষ্ট চমকপ্রদ। আমরা একেবারে তন্ময় হয়ে শোনা শুরু করলাম। কেমন বিচিত্র একটা অনুভূতি। বেশ বিচিত্র।
পুরানো বই সংগ্রহ করার বাতিকটা বলতে গেলে আমার রক্তে। আমার বাবা তার জীবনে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বই জমিয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক আমার দাদার কাছ থেকে পাওয়া। হলদে হয়ে ওঠা কাগজ, আঠা খুলে আসা পৃষ্ঠা, প্রাচীন প্রাচীন একটা গন্ধ আমাকে সবসময় টানতো। নীলক্ষেতের কিছু দোকানদারের সাথে আমার ভালো খাতির ছিলো তখন। কোথাও পুরানো বইপত্র খুঁজে পেলেই ওরা সাথে সাথে আমাকে খবর দিতো।
এই বই খুঁজতে গিয়েই একসময় পরিচয় হলো মনসুর ভাই এর সাথে। ভদ্রলোক খুব সৌখিন। মিন্টো রোড ধরে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের দিকে এগোতে থাকলেই হাতের বামে শাদা দেয়ালে ঘেরা ছিমছাম একটা তিনতলা বাড়ি চোখে পড়বে। এই বাড়িটার নীচতলায় প্রায় যক্ষের ধনের মতন আগলে এবং লুকিয়ে রাখা হয়েছে ক্যাফে বুকওঅর্ম নামের একটা লাইব্রেরি। বলতে গেলে লোকচক্ষুর অন্তরালেই। উন্মাদ পর্যায়ের বইখোর না হলে মনসুর ভাই এর এই হীরার খনির কথা কারও পক্ষে জানা সম্ভব না।
কাজটা তিনি করেছেন নিতান্তই শখের বশে। নিজে পড়েন, অন্যদেরও পড়তে দিতে ভালোবাসেন। বই এর মাঝে থাকার লোভ সামলাতে না পেরে বাড়িটার নীচতলা খালি করে ভয়ংকর সুন্দর একটা লাইব্রেরি দিয়ে দিলেন। যেখানে চা-কফি খেতে খেতে বই পড়া যাবে, পাওয়া যাবে এক্কেবারে আসল বিদেশী বই, আড্ডা দিতে দিতে শোনা যাবে ষাট-সত্তুরের দশকের কান্ট্রি সং এবং কেনা যাবে মাত্রাতিরিক্ত হৃদয়গ্রাহী কিছু স্টেশনারি আর অ্যন্টিক আইটেম। লাইব্রেরির বই এর সংগ্রহ এককথায় অস্বাভাবিক!
তার নিজের একটা বিশাল বইপড়ুয়া সার্কেল ছিলো। লাইব্রেরিটা দেওয়ার পর তারাই হয়ে উঠলেন এর প্রধান ক্রেতা। সেই ক্রেতাদের থেকে আস্তে ধীরে আরও কিছু মানুষ জানা শুরু করলো। ব্যবসা জমে উঠলো। তার মতে অনাকাঙ্ক্ষিত উপদ্রব এড়াতে তিনি জায়গাটার কোনরকম মার্কেটিং করেননি। এমনকি বাড়ির বাইরে একটা সাইনবোর্ডও না। প্রায় পাঁচ বছর আগের কুয়াশায় আচ্ছন্ন এক ডিসেম্বরের বিকেলে আমি প্রথম মনসুর ভাই এর ক্যাফে বুকওঅর্ম-এ হাজির হয়েছিলাম।
লাইব্রেরির সংগ্রহ দেখে তখন মাথা মোটামুটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে আমার। এমন সব বই সেখানে দেখছিলাম যেগুলোর নাম সারা জীবন নাম শুনে এসেছি, অনেক খোঁজা-খুঁজি করে হয়তো অ্যামাজনে দু-এক কপি পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু আনাবো আনাবো করে আর কখনও আনা হয়নি।
সেই দিশেহারা মুহূর্তে আমার সামনে হাজির হলেন মাথা কাঁচাপাকা চুলে ভর্তি সৌম্য চেহারার একজন ভদ্রলোক। হাসি-খুশি, বন্ধুসুলভ একটা ভাব। চোখে রিমলেস চশমা। পরণের শাদা পাঞ্জাবিটাতে সুতোর সুক্ষ কাজ করা। চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ করা বেশ কঠিন।
তিনি মুচকি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি … কোনটা নেবেন ঠিক করতে পারছেন না?’
আমি একটু অপ্রস্তুত বোধ করলাম, ‘হ্যাঁ। একটু দ্বিধা-দন্দ্বে ভুগছি। মনে হচ্ছে চোখের সামনে যা দেখছি সব কিনে নিয়ে চলে যাই।’
তিনি আমাকে কয়েকটা বই পছন্দ করে দিলেন। আমি সেগুলো কিনে ফেললাম। ভদ্রলোকের বই-বাতিক বেশ সাংঘাতিক। এমন কোন বিষয় নেই যেটা তার পছন্দের নয়। রাজনীতি থেকে শুরু করে দর্শন, থ্রিলার, হরর, ইতিহাস, রম্য– সবকিছুই তিনি পড়তেন। আমি অবশ্য বইয়ের বিষয়ে এতোটা সর্বভুক নই, খুব বেছে বেছে বই পড়তাম। তার দোকান থেকে নিয়মিত বই কিনতে কিনতে, মাঝে মধ্যে বই ধার নিতে নিতে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেলো। প্রায় সন্ধ্যাতেই আমি সেখানে গিয়ে বসে থাকতাম। আড্ডা দিতাম। উনার বন্ধু-বান্ধবরাও ছিলো বেশ চমৎকার ব্যক্তিত্বের। সময়টা নেহাত মন্দ কাটতো না।
পরের বছর মার্চ মাসের দিকে একটা পেপার প্রেজেন্ট করতে মনসুর ভাইকে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া যেতে হয়। তবে তার আসল প্ল্যান ছিলো ইউরোপ ট্যুর। ক্যাফে বুকওঅর্ম প্রায় তিন মাসের মতন তিনি আমার দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে যান। প্রস্তাবটা পেয়ে আগে পিছে কিছু না ভেবেই আমি রাজি হয়ে যাই। বই এর মধ্যে থাকতে আমার সবসময়ই ভালো লাগে। আর সেটা যদি মনসুর ভাই এর লাইব্রেরি হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তাছাড়া তিনি আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন। তার ভাষ্যমতে, এই পছন্দের জায়গাটা দেখে-শুনে রাখবার জন্য আমিই সবথেকে উপযুক্ত!
ততদিনে আমার গ্র্যাজুয়েশন প্রায় শেষের পথে। দেশের বাইরে মাস্টার্স করার জন্য নানান পাঁয়তারা করছিলাম, আর সাথে লাইব্রেরির দেখা-শোনা। দিনে দশ-বারো জনের বেশি ক্রেতা কখনওই আসততা না। আমার কাজ ছিলো তাদের থেকে বই আর আনুসাঙ্গিক জিনিসের দাম রেখে হিসেব রাখা। তারপর ন’টা অব্দি সেখানে থেকে সবকিছু গুছিয়ে সাড়ে ন’টায় লাইব্রেরি বন্ধ করে সাইকেলে করে বাসায় চলে যেতাম।
সে বছর পনেরো এপ্রিলে বিশাল কালবৈশাখী শুরু হয়েছিলো বিকেল বেলা। পাঁচটা না বাজতেই আকাশ একেবারে রাতের মতন অন্ধকার করে ঝড় নামলো। এর মাঝে কারও বই কিনতে আসার প্রশ্নই আসে না। তবে দোকান বন্ধ করে বাড়িতেও ফিরতে পারছিলাম না। কারণ শহরের অধিকাংশ রাস্তা ঘাটই আজকের মতন পানির নীচে চলে যাচ্ছিলো ক্রমশ। সাড়ে ছ’টার দিকে ঝড়ের প্রকোপ একটু কমলো। যেই না আমি লাইব্রেরি বন্ধ করার কথাটা মাথায় এনেছি, ঠিক তখনই একদম কাকভেজা হয়ে লাইব্রেরিতে এক আগন্তুকের আগমণ, আর প্রায় সাথে সাথেই ভয়াবহ আওয়াজে একটা বাজ পরে বিদ্যুত চলে গেলো। একেবারে যেন হরর সিনেমার প্লট!
টেবিলের ড্রয়ারে একটা টর্চ ছিলো। সেটা জ্বালিয়ে দু’টো মোমবাতি জ্বালালাম। আগন্তুক আমাকে বেশ উদ্বেগ দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘লাইব্রেরি কি বন্ধ করে দিচ্ছেন?’
‘না,’ আমি উত্তর দিলাম, ‘তবে দেবো ভাবছিলাম। আপনি এই ঝড়ের মধ্যে কি মনে করে?
আসলে এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। এর মাঝে ঝড় শুরু হলো। গাড়ির কাঁচে পানি এমন ভাবে আছড়ে পড়ছিলো যে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম এখানে এসে বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করি।’
আমি তার দিকে এবার ভালো মতন তাকালাম। বয়েস ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মাঝে। দেখে অনুমান করা কষ্ট। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটা চেহারা। চুল গুলো ভিজে মাথার সাথে লেপ্টে আছে। চোখে চশমা। সেটার পেছনে কেমন একটা কৌতূহলী দৃষ্টি। তবে অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে তিনি যথেষ্ট পরিমাণে বিরক্ত।
প্রথম দর্শনে তাকে বেশি সুবিধের মনে হলো না। কারণ তার ভাষ্যমতে, তিনি গাড়িতে ছিলেন। এই বাড়ির মেইন গেইট থেকে লাইব্রেরি পর্যন্ত হেঁটে আসতে সময় লাগে ত্রিশ সেকেন্ড। দৌড়ে আসলে দশ সেকেন্ড লাগার কথা। তিনি নিশ্চয়ই দৌড়েই এসেছেন। কারণ কালবৈশাখীর মাঝে আটকে পড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে কেউই পার্কে হাওয়া খেতে আসার আরামদায়ক ভঙ্গিতে হাঁটবে না! তাহলে কি উনি গাড়ি আরও কয়েক গলি আগেই পার্ক করে তারপর এখানে এসেছেন?
আমি নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘গাড়ি কোথায় রেখেছেন আপনি?’
‘আপনাদের গেইটের পাশের পার্কিং এর জায়গাটাতেই,’ তিনি চশমা মুছতে মুছতে উত্তর দিলেন, ‘কোন সমস্যা?’
‘না, মানে এতটুকু পথ আসতে আসতে একেবারে কাকভেজা হয়ে গিয়েছেন কিভাবে সেটাই ভাবছিলাম!’
ভদ্রলোক এবার হেসে ফেললেন, ‘মাঝে একবার সিগারেট কিনতে গাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। তখনই আসলে এরকম বাজে ভাবে ভিজে গিয়েছি। ভেজা কাপড়ে বসে থাকতে থাকতে একসময় সিট কভারও ভিজে গেলো। ভেজা সিট নিয়ে ড্রাইভ করা খুবই জঘন্য একটা অভিজ্ঞতা।’
তার উত্তর শুনে মনে হলো আমি বিনা কারণে তাকে উদ্ভট কিছু প্রশ্ন করেই যাচ্ছি। একটু বিব্রত কণ্ঠে বললাম, ‘চাইলে বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করতে পারেন। আপনি আসাতে ভালোই হলো। একা একা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। কফি খাবেন?’
‘হলে তো খারাপ হয় না!,’ তিনি মুচকি হেসে উত্তর দিলেন।
আমি কফি বানিয়ে মিনিট দশেক পরে এসে দেখি তিনি রুমাল দিয়ে মাথা মোছার চেষ্টা করছেন। সামনের রিডিং টেবিলে চশমার সাথে এমিলি ব্রনটি’র উদারিং হাইটস বইটা রাখা।
তিনি আমাকে দেখে সুন্দর করে হেসে বললেন, ‘থ্যাংকস!’
হাসবার পর ভদ্রলোককে আমার একটু ভালো বলে মনে হলো। হিমুর একটা বইয়ে পড়েছিলাম যে হাস্যমুখি মানুষের দিকে ভালোমতন তাকাতে। একমাত্র হাসার সময়ই নাকি মানুষের মনের পর্দা মুখের উপর থেকে সরে যায়। তখন খেয়াল করলে মানুষটা কেমন সে সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। ভদ্রলোকের হাসি দেখে মনে হলো যথেষ্ট প্রাণবন্ত একজন মানুষ। ধন্যবাদ দেবার ভঙ্গিটাও খুব আন্তরিক। আমার বেশ পছন্দ হলো। কিন্তু ওই মুহূর্তে তাকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিলো।
‘আমি দুঃখিত আপনাকে তোয়ালে জাতীয় কিছু দিতে পারছি না বলে। দিতে পারলে খুব ভালো হতো,’ আমি টেবিলে কফি রাখতে রাখতে বললাম।
তিনি চশমাটা চোখে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যেটা দিতে পেরেছেন সেটার জন্যই আপনাকে আরেকবার ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। মনসুর স্যারকে দেখছিনা যে? উনি কোথায়?’
‘একটা রিসার্চ পেপার প্রেজেন্ট করতে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া গিয়েছেন,’ আমি চেয়ার টেনে বসলাম, ‘ওটা আসলে একটা ছুঁতো। তার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউরোপ ভ্রমণ। আর মাস দু’এক পর ফিরবেন। যতদিন বাইরে আছেন ততদিন আমিই এই লাইব্রেরির দেখা-শোনা করছি। আমার নাম সৌধ,’ বলে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম।
‘আমি ইমতিয়াজ সালেহীন, মনসুর স্যারের ছাত্র ছিলাম একসময়। আপনি নিশ্চয়ই স্যারের মতই বই এর পোকা?,’ তিনি কফির মগে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তা না হলে তিনি লাইব্রেরির দায়িত্ব আপনার উপর দেওয়ার সাহস করতেন না!।’
আমি হাসলাম, ‘তার মতো না। আসলে তার ধারে কাছেও আমি নেই। তবে আমি বই ভালোবাসি।’
‘আজকের আলোচনা তাহলে বেশ জমবে মনে হচ্ছে! ভিক্টোরিয়ান এরা’র কোন লেখক সবথেকে প্রিয়?,’ তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন।
‘জর্জ এলিয়ট আর ব্রাম স্টোকার,’ আমি উত্তর দিলাম, ‘আপনার?’
‘আমারও,’ তিনি কেমন রহস্যময় একটা কন্ঠে উত্তর দিলেন।
বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। কমবার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে ভয়ংকর সব আওয়াজ করে বাজ পরছে। সব মিলিয়ে ভয়াবহ একটা
পরিবেশ। এর মাঝে আটকে পড়া দু’জন মানুষ শিল্প-সাহিত্য-সিনেমা-সংগীতের আলোচনায় একেবারে মগ্ন হয়ে গেলো। মাঝে অবশ্য বার তিনেক কফি-সিগারেটের ব্রেক নেওয়া হয়েছিলো। সোজা কথায় ঘন্টা দু-এক এর জন্য আমরা একেবারে আঁতেল সমাজ বনে গেলাম।
‘বৃষ্টি একসময় খুব ভালো লাগতো আমার,’ একটা সিগারেট ধরিয়ে ইমতিয়াজ সালেহীন বললেন, ‘আন্ডারগ্র্যাডে পড়ার সময় একবার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে সাতক্ষীরা গিয়েছিলাম। ভাগ্যগুনে অসাধারণ সুন্দর একটা কটেজে জায়গা হলো আমাদের। দুপুরে ইজি চেয়ার নিয়ে সবাই কটেজের সামনে বসে ছিলাম, কথা নেই বার্তা একেবারে ঝুম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির মধ্যেই আমরা ছাতা নিয়ে ভ্যান গাড়িতে চড়ে গ্রামের বাজারে চলে গেলাম। সেখান থেকে চা সিঙারা খেয়ে আরেকটু হাঁটতেই একটা নদীর পাড় পাওয়া গেলো। সবার সাথে সেখানে গিয়ে বসলাম। একটু দুরেই সুন্দরবন। সেখান থেকে আসছিলো অদ্ভুত সব আওয়াজ। মনে রাখার মতো একটা অভিজ্ঞতা ছিলো।’
‘শুনে তো আমার এখনই চলে যেতে ইচ্ছে করছে,’ আমি বললাম, ‘তবে বৃষ্টি ভালো লাগতো? এখন আর লাগে না?’
‘এক জীবনে রবীন্দ্রনাথ আর হুমায়ুন সাহেব বৃষ্টি নিয়ে কম রোমান্টিসিজম আমার মাঝে ঢুকিয়ে যাননি। কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না। সেটা এক লম্বা কাহিনি,’ সালেহীন শুকনো একটা হাসি হেসে বললেন, ‘অক্টোবার স্কাই সিনেমাটা দেখেছেন?’
‘না, দেখা হয়নি,’ আমি উত্তর দিলাম।
‘আমিও দেখিনি। হোমার হিকহ্যামের গল্প আর জো জনস্টোনের ডিরেকশন। শুনেছি মাস্টারপিস। সময় থাকলে এসে পড়ুন কাল আমার বাড়িতে। একসাথে দেখা যাবে।’
সামান্য পরিচয়ে কাউকে বাড়িতে সিনেমা দেখার দাওয়াত দেওয়াটা একটু অস্বস্তিকর। তবে ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে বেশ আনন্দ পাওয়া যায়। গল্প দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করার একটা ক্ষমতা আছে তার। এর পরদিন ছিলো সোমবার। লাইব্রেরী বন্ধ রাখার দিন। হাতে সময় ছিলো বলে রাজি হয়ে গেলাম।
মূলত আমার ঘটনাটার শুরু এখান থেকেই। আস্তে আস্তে সবকিছু পাল্টাতে শুরু করে এই ইমতিয়াজ সালেহীন আর তার বাড়ি থেকেই।
★
ইমতিয়াজ সালেহীন মানুষটা যে যথেষ্ট রহস্যময়, এই ব্যাপারটা আরও ভালোমতন ধরতে পারি তার বাড়িতে গিয়ে। প্রথমদিন তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই বুঝে ফেলি যে চরিত্র হিসেবে তিনি যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং।
গুলশান এক পোস্ট অফিসের গলি হাতের ডানে রেখে সোজা এগোলে একটা সুন্দর, পীচ ঢালাই করা রাস্তা যাওয়া যাবে। সে রাস্তা ধরে মিনিট তিন সামনে হাঁটলেই শুরু হয় ছোট, তবে চওড়া এবং পরিপাটি একটা গলি। সেই গলিতে বাড়ির সংখ্যা হাতে গুনে তিনটা। সামনে গুলশান লেকের শেষ অংশটা তরতরিয়ে এগিয়ে চলছে। একেবারে শুনশান একটা জায়গা। আশপাশটা গাছ-পালায় ভর্তি। এরকম ঈর্ষণীয় জায়গায় এতো সুন্দর একটা বাড়ি দেখে ভদ্রলোককে আমার রীতিমতো সৌভাগ্যবান মনে হতে লাগলো।
শাদা রঙ করা চারতলা একটা বাড়ি। আধুনিকতায় গা না ভাসিয়ে পুরানো ডিজাইনে বেশ জায়গা নিয়ে বানানো হয়েছে। আমি মনে মনে সালেহীনের রুচির প্রশংসা না করে পারলাম না। তবে সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বাড়ির সদর দরজার উপর কালো রঙের একটা বিশাল সাইনবোর্ড। সেটার উপর শাদা
রঙে লেখা–
‘ফুল লাগলে চেয়ে নিবেন’
একটু কেমন যেন!
বাড়ির সদর দরজার সামনে গিয়ে বেল টিপতেই মাঝবয়েসী একটা লোক এসে সেটা হালকা করে খুলে গলাটা বের করে বললো, ‘আপনার নাম সৌধ?
‘হ্যাঁ, আমি সালেহীন সাহেবের কাছে এসেছি।’
লোকটা সুন্দর করে হেসে বললো, ‘স্যার আমাকে বলে রেখেছে আপনি আসবেন। ভেতরে আসুন।’
আমি তার সাথে ভেতরে ঢুকলাম। বেশ বড় একটা জায়গা ভেতরে। ঘাস দিয়ে ঢাকা এবং সেগুলো খুব সুন্দর করে সমান করা। বোঝাই যাচ্ছে নিয়মিত যত্ন নেওয়া হয়। তবে কোন ফুলগাছ চোখে পড়লো না। লন ধরে কিছুদুর হেঁটে আমরা মূল বাড়িতে ঢুকলাম।
বেশ পরিপাটি করে সাজানো লিভিং রুম। দেয়ালে কয়েকটা পেইনটিং ঝোলানো। নিচে গাঢ় সবুজ কার্পেট। বেশ দামি। বসবার সোফাগুলো আহামরি কিছু নয়। কাঠ দিয়ে বানানো সাধারণ সোফা। তবে পুরো ঘরটাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে বেশ দামি দেখাচ্ছে সেগুলোকে। রুমটার সব আসবাবের মাঝেই একটা অ্যান্টিক ভাব আছে।
লিভিং রুমের একটা কোনায় দু’টো বড় আলমারি রাখা। সেগুলো বইতে বোঝাই। পাশে দুটো বড় জানালা। পর্দা সরানো থাকায় মোলায়েম একটা আলো এসে খেলা করছে ঘরটাতে। আলমারি দু’টোর সামনে একটা সুন্দর টেবিল আর দু’টো চেয়ার রাখা। আমাকে সেখানে নিয়ে বসালো, সে খুব সম্ভবত বাড়ির কেয়ারটেকার।
‘চা-কফি কিছু খাবেন?,’ লোকটা জানতে চাইলো।
‘কফি খাওয়া যেতে পারে।’
‘আপনি বসুন। আমি স্যারকে খবর দিচ্ছি,’ বলে সে চলে গেলো।
বাড়িটার আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। তবে কোথাও কোন এসি চোখে পড়লো না। আমি উঠে গিয়ে বই দেখা শুরু করলাম। লোভনীয় সংগ্রহ। সেবা’র তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন থেকে শুরু করে ওপার বাংলা, ইউরোপ, আমেরিকান এমনকি আফ্রিকান কিছু লেখকের বইও চোখে পড়লো। এখানে খুব সম্ভবত সালেহীন সাহেব পড়াশোনা করেন। তবে ভদ্রলোক যে বেশ পয়সাওয়ালা সেটা বুঝতেও সময় লাগলো না আমার।
মির্চা এলিয়াদের একটা বই নিয়ে আমি টেবিলটাতে বসে পাতা উল্টিয়ে দেখা শুরু করলাম। এর মাঝে লোকটা এসে একটা গোলাপি রঙের মগে কফি দিয়ে গেলো।
‘স্যার ঘুমাচ্ছিলেন। আপনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেছেন,’ সে জানালো।
‘কোনো সমস্যা নেই,’ আমি আন্তরিক কন্ঠে বললাম, ‘আচ্ছা ওই অদ্ভুত সাইনবোর্ডটার অর্থ কি বলুন দেখি!’
‘বাগান করা স্যারের একটা শখ। ছাদে বাগান করেন। আগে কেউ বাগানে গেলে খুব রাগারাগি করতেন। এখন করেন না। এই মাস তিনেক হলো সাইনবোর্ডটা টাঙিয়েছেন। আসলে অনেক ফুল পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। তার থেকে মানুষকে দিয়ে দেয়া ভালো বলেই এই ব্যবস্থা। আপনার কি ফুলের প্রয়োজন আছে?’
‘না। সেটা নেই। তবে বাগানটা দেখার খুব আগ্রহবোধ করছি।’
‘সাইনবোর্ডটা টাঙানোর পর ভেবেছিলাম অনেক মানুষ আসবে। একবার শুধু একজন গেইটে এসে জানতে চেয়েছিলো বিষয়টা আসলে কি। এরপর আর কেউ আগ্রহও দেখায়নি,’ লোকটা বললো, ‘তবে স্যারকে বলে দেখতে পারেন। বন্ধু-বান্ধব এলে অবশ্য তিনি ছাদে নিয়ে যান।’
‘আমি অবশ্যই বলবো।’
‘কোনকিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানাতে পারেন। আমার নাম রবি। নাম ধরে ডাকলেই হবে।’
‘ধন্যবাদ রবি!’ আমি আন্তরিক ভাবে বললাম।
রবি চলে যাওয়ার পর আমি বইটাতে প্রায় ডুবে যেতে বসেছিলাম। তখনই ইমতিয়াজ সালেহীন এসে সামনে দাঁড়ালেন। ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনাকে বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত। আসলে অনেকদিন পর একটু অবসর পাওয়াতে কাল প্রায় সারাটা রাতই জেগে ছিলাম। ঘুমাতে গিয়েছি সকাল এগারোটার দিকে।’
‘এটা ক্ষমা চাওয়ার কোন বিষয় না সালেহীন ভাই,’ আমি হেসে বললাম, ‘আর আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন। আমি বয়েসে ছোট আপনার। অপেক্ষা করতে আমার কোন সমস্যা হয়নি। আপনার বইয়ের সংগ্রহ দেখে সময়টা ভালোই কাটছিলো।’
সালেহীন ভাই একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, ‘রবি বেশ ভালো কফি বানায়। কফিটা শেষ করো। তারপর ছাদে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে সিনেমা নিয়ে বসবো।’
‘চমৎকার প্রস্তাব,’ বললাম আমি, ‘রবির কাছে আপনার ছাদের বাগানের কথা শুনলাম একটু আগে। খুব কৌতূহল হচ্ছে।’
‘তার আগে বলো, তোমার কি ফুল, বাগান এসব নিয়ে আগ্রহ আছে?, তিনি জানতে চাইলেন।
‘না। আমি পুরোদস্তুর শহুরে ছেলে। জন্ম এখানে, বড়ও হয়েছি এখানে। গাছ-পালা, মাটির সাথে আমার সম্পর্ক একটু কম।’
‘তাহলে তোমার জন্য দারুণ একটা অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে,’ তিনি রহস্যময় কন্ঠে বললেন, ‘আসলে এখন অনেকেই ছাদে বাগান করছে। তাদের থেকে আমার বাগানটা একটু আলাদা। যাদের বাগান সম্পর্কে ধারণা কম তারা আমার ছাদে গিয়েই একটা ধাক্কার মতো খায়।’
‘কি রকম ধাক্কা?’
‘সেটা গেলেই বুঝতে পারবে।’
আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর আমি সালেহীন ভাইয়ের সাথে ছাদে উঠলাম। ধাক্কা খাওয়ার কথাটা আসলেই সত্যি। আমি ভালো রকমের একটা ধাক্কা খেলাম। কারণ এটা আলাদা একটা দুনিয়া। তার হাতে বানানো পৃথিবীর মাঝে অন্য একটা জগত। ছাদ নামক মায়াবি জিনিসটা যে এতো বড় আর সুন্দর হতে পারে সেটা আমার কল্পনাতেও ছিলো না।
ছাদটা একটা ছোটখাটো অ্যাপার্টমেন্টের সমান হবে। সেটা দু’টা ফ্লোরে ভাগ করা। উপরের অংশটা বেশ বড়। অনেক রকমের লতানো গাছে জায়গাটা ভরে আছে। মোটা কিছু লতা আর কালচে ডাল পালার দিকে তাকালে শরীর কেমন যেন শির শির করে ওঠে। একটা জায়গায় বড় কিছু ফুলের টবে অদ্ভুত দর্শন কিছু ক্যাকটাস গাছ কিভাবে যেন মানুষের মতন দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোর পাশেই একটা কোনায় সুইমিং পুল। আমি জীবনে এতোটা যান্ত্ৰিকতা মুক্ত পুল দেখিনি। দেখে মনে হয় ছাদে খুব তেলেসমাতি কান্ড করে একটা পুকুর খোঁড়া হয়েছে। গাছ পালা দিয়ে পুলটা এতো সুন্দর করে আড়াল করা যে বাইরে থেকে চোখেই পড়ে না।
আর নিচের অংশটাতে আছে বিরল সব প্রজাতির গাছ। এর বেশির ভাগই অর্কিড। বিশাল ড্রামে ভর্তি কিছু বড় গাছও আছে। কিছু কিছু অর্কিড এতোটাই সুন্দর যে চোখ ফেরানো যায় না। বিচিত্র রকমের একটা সুঘ্রাণ পুরোটা জায়গা জুড়ে ঘুরছে যের। বড়বড় অদ্ভুত কিছু ফুল পুরো ছাদটা পাহারাদারের মতন ঘিরে রেখেছে। আর সবথেকে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে পুরো জায়গাটা ভেজা মাটির গন্ধে ভরা। চোখ বন্ধ করে বাতাসে গাছের পাতা নড়বার আওয়াজ শুনলে মনে হয় অজপাড়া গাঁ-এর কোন একটা ঘন, জংলা মতন জায়গাতে বসে আছি। শরীরে একটা প্রশান্তির আবেশ এনে দেয় সেটা।
সালেহীন ভাই আমাকে পুরোটা জায়গা ঘুরিয়ে দেখালেন। প্রায় মিনিট বিশেক বিভিন্ন গাছ আর ফুল নিয়ে কথা বললেন তিনি।
‘কেমন লাগলো আমার বাগান?,’ কন্ঠে কৌতুক নিয়ে সালেহীন ভাই জানতে চাইলেন।
‘অসম্ভব সুন্দর,’ কন্ঠে উচ্ছ্বাস নিয়ে বললাম।
‘সুন্দর হতে বাধ্য। কম চিন্তা ভাবনা আর পরিশ্রম নিয়ে সাজানো হয়নি এই জায়গাটা,’ কথাটা বেশ গর্বের সাথে বললেন।
পয়সাওয়ালারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের প্রাচুর্য সবাইকে দেখিয়ে আনন্দ পান। আমার কিছুক্ষণের জন্য সালেহীন ভাইকেও এমন মনে হয়েছিলো। জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখানোর সময় বেশ ঘটা করে কোনটা কোথা থেকে কিভাবে সংগ্রহ করেছেন সেসব বলে যাচ্ছিলেন। কণ্ঠে ক্ষমতা দেখানোর একটা ভাব ছিলো বটে। তবে পরক্ষণেই মনে হলো, আমি আমার বই এর সংগ্রহ দেখানোর সময়ও অনেকটা এরকম আচরণ করি। আমিও বেশ বড়াই করে কিছু বই সংগ্রহ করার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করি। বই সংগ্রহ যেমন একটা আর্ট, তেমনি তার এই বাগানও তার নিজের হাতে গড়া বলে একটা উদ্ধত ভাব থাকতেই পারে। এটা তার অধিকার।
ছাদের কোনায় গাছপালার মাঝে সুন্দর একটা কাঠের টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার রাখা। রেলিং এর পাশে আরেকটা টেবিলের উপর কয়েকটা বই আর চা বানানোর সরঞ্জাম। সিগারেট, অ্যাশট্রে’র সাথে ডেকসেটও দেখা গেলো সেখানে। সালেহীন ভাই আমাকে সেখানে নিয়ে বসালেন। বোঝাই যায়, এখানে তিনি প্রায়ই সময় কাটান।
‘মানুষের সাইকোলজি যথেষ্ট অদ্ভুত। ঢোকার সময় সাইনবোর্ডটা নিশ্চই চোখে পড়েছে?,’ সালেহীন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
‘হ্যাঁ,’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম।
‘গত কয়েকটা বছর আশে পাশের মানুষের আমার এই ছাদ আর বাগান নিয়ে অনেক আগ্রহ ছিলো। অনেকেই দেখতে চাইতো। আমি দেখতে দিতাম না। টেলিফোনে, ই-মেইলেও অনেকে বাগানটা দেখতে চাওয়ার অনুরোধ করতো। তিন মাস আগে ভাবলাম, সৃষ্টি আর সৌন্দর্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। সেটাকে আবদ্ধ রাখা কেমন যেন দেখায়। সাইনবোর্ডটা বানিয়ে এনে লাগানো হলো, আগে যারা জায়গাটা দেখতে চাইতো– তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ফোন করে আসবার দাওয়াত করলাম। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, কেউ আসলোই না!’
আমি হেসে ফেললাম, ‘আসলে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আগ্রহটাই অন্যরকম সবার। ‘
‘হুম,’ গুমোট একটা স্বরে উত্তর দিলেন তিনি, চলো, আরেক রাউন্ড কফি খাওয়া যাক। আমি একা কফি খেতে পারি না।’
ইমতিয়াজ সালেহীন কফি বানানো শুরু করলেন। এবারেও গোলাপি মগে। তবে কফি বানানোর আগে ডেকসেটে একটা মিউজিক ছাড়লেন। ইন্সট্রুমেন্টাল ট্র্যাক। সরোদের সাথে আরেকটা অদ্ভুত রকমের যন্ত্র বাজছে। তবে সেটা যে কি অনেক্ষণ চেষ্টা করেও বুঝতে পারলাম না। মেডিটেশনের সময় অনেককে এরকম ট্র্যাক শুনতে দেখেছি আমি।
কফি বানিয়ে এনে সালেহীন ভাই বললেন, ‘মাস্টার্স শুরু করার আগে তিন বন্ধুকে সাথে নিয়ে নেপাল গিয়েছিলাম। ঘোরা ফেরা করার সময় কৌতূহল বশত সোয়ামভু মন্দিরে চলে গেলাম। এরকম হিস্টোরিকাল মন্দির আমার খুব ভালো লাগে। জায়গাটার আর্কিটেক্ট অসম্ভব সুন্দর। লোকেশনটাও মারাত্মক। সেখানে অনেকেই মেডিটেশন করতে আসে। ধ্যান-ট্যান করতে গিয়ে একটা ইন্ডিয়ান ছেলের সাথে পরিচয় হলো। সে প্রায় বছরখানেক মেডিটেশন আর সাউন্ড ওয়েভ নিয়ে পড়াশোনা করে এই ট্র্যাকটা বানিয়েছিলো। আমাকে দিয়ে বলেছিলো এটা শরীর শিথিল করতে সাহায্য করে। প্রথমে বিশ্বাস করিনি। দেশে এসে দেখি এটা আসলেই কাজ করে।’
‘ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো!,’ আমি বললাম, ‘আমি টিনএজে বইপত্র পড়ে এসব করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেভাবে কখনই করা হয়ে ওঠেনি। আসলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম কিছুদিন পর।
‘আমার কাছে ধ্যান-মেডিটেশন নিয়ে লেখা বইপত্র আছে। বিষয়টা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সবসময়ই। প্রতিটা ধর্মের অবতারণার সাথে কিন্তু ধ্যানের বেশ ভালো একটা সম্পর্ক আছে।’
‘এভাবে কখনও ভেবে দেখিনি আমি।’
‘তুমি চাইলে বই ধার নিতে পারো। তবে অবশ্যই ফেরত দেওয়ার শর্তে,’ বলে হাসলেন তিনি, ‘আমি বই ধার দেওয়ার ঘোর বিরোধী। তবে মনসুর স্যার তোমাকে লাইব্রেরির দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন, সেক্ষেত্রে তোমাকে নিশ্চিন্তে বই দেওয়া যেতে পারে।’
আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে পরিবেশটা কিভাবে যেন পাল্টে গেলো। ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে সাথে বাগানের মোলায়েম গন্ধটা জীবন্তু প্রাণীর মতন এদিক ওদিকে ছোটা শুরু করলো। একটু পরপর কফির মগে চুমুক দিচ্ছিলাম। আর কানে বাজছিলো শরীরে আরামদায়ক অনুভূতি এনে দেওয়া একটা যন্ত্রসংগীত। সালেহীন ভাই প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। বিষয়টা নিয়ে আমার ভাসা ভাসা ধারনা ছিলো এতোদিন। আলোচনার একটা পর্যায়ে এসে আমার কেমন ভয় ভয় লাগা শুরু করলো। আসলে বিষয়টাই খুব উদ্ভট। মস্তিস্কে চাপ ফেলে।
হঠাৎ করেই ইমতিয়াজ সালেহীনকে আমার খুব ভালো ভাবে পছন্দ হয়ে গেলো। তার পড়াশোনার পরিধি ব্যাপক। এর মাঝে রবি এসে গাছ গুলোতে পানি দেওয়া শুরু করলো। আমি আর সালেহীন ভাই নিচে নেমে গেলাম মুভি দেখার উদ্দেশ্য।
তার শোবার ঘরটা একটু ভিন্ন। দেখে মনে হয় কোন টিন-এজ ছেলের ঘর। ঘরে কোন খাট নেই। জানালায় গোলাপি পর্দা ঝুলছে। খুব সম্ভবত এই রঙটার প্রতি তার একটু দুর্বলতা আছে। জানালার পাশে একটা গদি বিছানো আর সেটার সামনে বড় একটা টিভি। নিঃসঙ্গ। পুরোটা ঘর পোস্টার দিয়ে সাজানো। আরেক কোনায় একটা লেখালিখি করার টেবিল আর একটা কাঠের আলমারি। সেটার পাশে টেইলরের একটা অ্যাকুইসটিক গিটার।
‘আপনার তাহলে মিউজিক নিয়ে আগ্রহ আছে?,’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘ছিলো একটা সময়। এখন শেষ কবে গিটার ধরেছি সেটাই মনে নেই আমার,’ তিনি হাসলেন, ‘বাইরে তো খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আজকে হরর মুভি ভালো জমবে। অক্টোবার স্কাই আরেকদিন দেখা যাবে নাহয়, কি বলো?’
‘আমার কোন সমস্যা নেই।’
‘অরফ্যান দেখেছো?’
‘না।’
উত্তর শুনে সালেহীন ভাই আলমারী খুললেন। সেটা সিনেমার ডিভিডিতে বোঝাই। পয়সা খরচ করার বেশ উপযুক্ত একটা জায়গা– মনে মনে ভাবলাম আমি।
সিনেমাটা বেশ জমলো। বাইরের আবহাওয়া, বাড়ির পরিবেশ আর সিনেমার গল্প, তিনটে মিলিয়ে গা ছমছম করা পরিবেশ। সিনেমা শেষ করতে করতে রাত নয়টা বেজে গেলো। পুরো বাড়িতে কোথাও কোন আলো জ্বালানো হয়নি। সালেহীন ভাই আমাকে এগিয়ে দেবার জন্য সাথে আছেন। তবুও একটা অপরিচিত বিশাল বাড়িতে একজন স্বল্প পরিচিত মানুষের সাথে হাঁটতে কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিলো।
আমার ইতস্তত ভাব দেখে তিনি বললেন, ‘অন্ধকার দেখে কি অবাক হচ্ছো? লাইটের আলো আমার অসহ্য লাগে। একেবারেই দায় না পরলে আমি বাতি জ্বালাতে বলি না। মাথা ব্যাথা করে আমার।’
‘অন্ধকারে চলতে ফিরতে সমস্যা হয় না?
‘নাহ। অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। পকেটে একটা টর্চ থাকে। ওটা দিয়ে বইপত্র খুঁজে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে পড়ি। খাওয়া দাওয়া করা ছাড়া আমার আলোর তেমন একটা দরকার পরে না।
চারতলা বিশাল একটা বাড়ির সদস্য সংখ্যা মাত্র দু’জন। বাড়ির মালিকের চরিত্র যথেষ্ট অদ্ভুত, তার উপর অন্ধকারে তিনি আরামসে চলাফেরা করছেন। আমার অস্বস্তিটা বেড়ে গেলো আরও। এই অনুভূতির সাথে জন্ম নিলো কৌতূহল।
‘তুমি যখন খুশি চলে আসতে পারো। আগামী চার মাস আমি অলস সময় কাটাবো আর একটা বই লিখবো। ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছি। তুমি এলে গল্পের প্লট নিয়ে আলোচনা করা যাবে,’ তিনি কথাটা শান্ত স্বরে বললেন। কন্ঠে একটা বন্ধুসুলভ ভাব। কিন্তু একটু খেয়াল করে শুনলে কেন যেন একটু মেকি মনে হয়, ‘আমার মানুষের সঙ্গ তেমন একটা ভালো লাগে না। বাড়িতেও তেমন কেউ আসে না। তুমি আসলে সময়টা ভালোই কাটবে মনে হচ্ছে।’
আমি নিঃশব্দে বাড়িটা ত্যাগ করেছিলাম সেদিন। ফেরার আগে অবশ্য একবার পেছনে ফিরে তাকিয়েছিলাম। ঝড়ো রাতে এলাকার শেষ প্রান্তে শাদা, প্রায় নিঃসঙ্গ একটা বাড়ি। যেখানে সদর দরজা ছাড়া আর কোথাও আলো জ্বালা নেই। সেই আলোতে একটা অদ্ভুত সাইনবোর্ড জ্বলজ্বল করছে।
‘ফুল লাগলে চেয়ে নিবেন’
এরপরে একটানা বেশ কিছুদিন তার বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিলাম। কিন্তু পরের সপ্তাহ থেকে লাইব্রেরিতে মানুষজন একটু বেশি পরিমাণে আসতে শুরু করলো। বেচা-বিক্রিও বেড়ে গেলো। একটা সপ্তাহ বেশ ব্যস্ত সময় কাটালাম। তবে এই ব্যস্ততার মাঝেও সালেহীন ভাইকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছি। ভদ্রলোকের চরিত্র, কথাবার্তায় খুব রহস্যময়তার ছাপ আছে। নিজের আশে-পাশে কেমন একটা দেয়াল তুলে রেখেছেন। সবসময় একটু রহস্য করে কথা বলেন। আর তার জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতারও কোন অভাব নেই। একেবারে মিসির আলির বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র। বন্ধুত্বের ভাবটা মাঝে মধ্যে একটু মেকি মনে হলেও তার বাড়িতে যাবার যথেষ্ট আগ্রহ অনুভব করতাম প্রতিদিন
এরই মাঝে একদিন একটা জাতীয় দৈনিকের ভেতরের পাতায় চার কলাম– চার ইঞ্চি সাইজের সাদা-কালো একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো। যেটাতে শুধুমাত্র চারটা শব্দ আর একটা ফোন নাম্বার লেখা।
ফুল লাগলে চেয়ে নিবেন
০১১০৬৬১১৯
আমি প্রচলিত সহজ বাঙলা ভাষায় টাস্কি খেলাম। ঘটনাটা যে কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারলাম না। একটা মানুষ ফুল দেবার জন্য এতোটা নিবেদিতপ্রাণ কিভাবে হতে পারে, আমার মাথায় ঢুকছিলো না। ব্যবসায়িক প্রমোশন হিসেবে যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং। কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সালেহীন ভাইয়ের পয়সার অভাব নেই, সেই সাথে নেই ব্যবযায়িক উদ্দেশ্য। সবথেকে বড় কথা তিনি মানুষের সঙ্গ তেমন একটা পছন্দ করেন না। খুব বেছে বেছে তার ধরণের মানুষের সাথেই যে শুধু ওঠা বসা করেন সেটা একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। এই বিজ্ঞাপনের পরে তো মানুষের ঢল নামার কথা তার বাড়িতে। ফুল দেওয়ার খাতিরে কি তিনি এতোটা বিরক্তি সহ্য করবেন? ফুল দেওয়া কি এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ?
প্রশ্নগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। তখনই ঠিক করলাম আজ একবার তার বাড়িতে গিয়ে দেখবো ব্যাপারটা আসলে কি। কিন্তু সেদিন লাইব্রেরি বন্ধ করতে করতেই দশটা বেজে গেলো। তারপর যেতে হলো একটা হলুদের দাওয়াতে। পরদিন সারাটা সময় পড়ে পড়ে ঘুমালাম। এরও একদিন পর রাত সাড়ে আটটার দিকে লাইব্রেরি বন্ধ করে তার বাড়িতে যাওয়ার সময় হলো। তবে সালেহীন ভাই আমাকে দেখে যে এতোটা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়তে পারেন সেকথা আমি ভুলেও ভাবিনি।
‘সৌধ!,’ সালেহীন ভাই বললেন, ‘তুমি এসে আমাকে বাঁচালে!’
‘কেন কি হয়েছে?’ আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম।
‘ক’দিন আগে পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। চোখে পড়েছিলো?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি। খুব ইন্টারেস্টিং আইডিয়া ছিলো কিন্তু!’
‘আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু ঘটনা দেখে বোঝা গেলো আসলে একদমই ইস্টারেস্টিং নয়।
‘তাহলে কি রকম?’
‘অর্কিড অনেক ঝড়-বৃষ্টি সহ্য করতে পারে। তবুও গত কয়েকদিনের একটানা ঝড়ে অনেকগুলো ফুল নষ্ট হয়ে গেলো। এতো খারাপ লাগলো যে বলে বোঝাতে পারবো না। পরে ভাবলাম এগুলোর একটা গতি করতে হয়। পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দিলাম। সারাদিন পর বিকেল পর্যন্ত ফোন পেলাম মাত্র তিনটা। এর মধ্যে দু’টো ছিলো ফুলের দোকান থেকে। আসলে কি হয়েছে বলতো? মানুষ কি পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছে? নাকি কারও মাঝে কোন কৌতূহল কাজ করছে না?’
আমি হাসলাম। বললাম, ‘আসলে আমিও এটা ধরতে পারছি না।
‘শেষে গতকালকে এক বৃদ্ধমতন ভদ্রলোক আর অল্পবয়েসী একটা ছেলে এসেছিলো। দু’জনকেই ব্যাগভর্তি ফুল দিয়ে বিদেয় করেছি। তবে তাদের সাথে কথা বলতে আর খাতিরদারি করতে গিয়ে আমার খবর হয়ে গিয়েছে। আমি বোধহয় সাইকোপ্যাথ হয়ে যাচ্ছি, বুঝলে? হাতে-গোনা ক’জন মানুষ ছাড়া ইদানিং কাউকে সহ্য করতে পারছি না। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে টেলিফোন করে ডাকি। কিন্তু লাইব্রেরি সামলাতে ব্যস্ত থাকতে পারো ভেবে আর করিনি।’
আমি আবার হাসলাম। ঝড়ে ফুল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষ বাড়িতে এনে ফুল গছিয়ে দিতে হবে?
যথেষ্ট অ্যাবসার্ড!
মানলাম ভদ্রলোক পয়সাওয়ালা এবং খামখেয়ালি। কিন্তু তারপরও ঘটনাটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। তার কথা বার্তায় মনে হয় তিনি বাগান, ফুল নিয়ে যথেষ্ট প্যাশনেট। কিন্তু কাজে কর্মে এটা ঠিক ফুটে উঠছে না। বেশ কিছুদিন আগে আমি আর সালেহীন ভাই ছাদে আড্ডা দেওয়ার সময় রবি বাগানের যত্ন নিচ্ছিলো। ডালগুলো ছাঁটার সময় একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় কাজটায় সে একেবারেই কাঁচা। এরকম একটা লোককে তিনি কেন বাগানের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন সেটাও আমার কাছে পরিষ্কার না।
সেদিন অক্টোবার স্কাই দেখে শেষ করলাম দু’জন। তবে তার আগে সালেহীন ভাই বেশ কিছুক্ষণ গিটার বাজিয়েছেন। তার বাজানোর হাত চমৎকার। তিনি আমাকে আলমারি থেকে অক্টোবার স্কাই এর ডিভিডিটা বের করতে বলে কফি আনতে গিয়েছিলেন। ডিভিডিটা খুঁজবার ফাঁকে অনেকটা দূর্ঘটনাবশতই একটা ছবি বের হয়ে গেলো। নীচের সারির অনেকগুলো ডিভিডির মাঝে চাপা দেওয়া ছিলো সেটা। ছবিতে একেবারে তরুণ বয়েসি ইমতিয়াজ সালেহীনের সাথে আকাশী-শাদা চেক শার্ট আর নীল বেল-বটম পরা সুন্দরী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু’ জনের দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও খুব আন্তরিক। আমি বিব্রতবোধ করে ছবিটা আবার জায়গামতন রেখে দিলাম।
সেদিনের পর থেকে বেশ নিয়মিত ভাবে তার বাড়িতে যাওয়া আসা চলতে থাকলো। গান-বাজনা করতাম, সিনেমা দেখতাম, তবে সব থেকে আকর্ষণীয় সময়টা কাটতো ছাদে আড্ডা দেওয়ার সময়। তিনি অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। সেখানে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। ছাদের আলো আঁধারী, গাছ-পালার শব্দের মাঝে সেসব যখন বলতেন, গা ছমছম করে উঠতো আমার। একসময় তার সাথে বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ় হতে শুরু করলো। দেখা গেলো সপ্তাহে দু’তিন-দিন তার ছাদে নাহয় বাসায় রাত কাটাচ্ছি। এর মাঝে পত্রিকায় আরও একবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিলো। আগেরবারের তুলনায় এবার বেশ ভালোই সারা পান তিনি। কিছু উটকো লোকজন সহ বিয়েবাড়ি থেকেও মানুষ চলে এসেছিলো। তিনি সবাইকে ফুল দিয়ে বিদেয় করেছেন।
তবে এবার কিন্তু ফুল নষ্ট হয়ে যাবার কোন লক্ষণ দেখা দেয়নি। প্রয়োজনের তুলনায় বেশ খালিই দেখাচ্ছিলো গাছগুলোকে। তার এই অদ্ভুত আচরণের কারণ আমার মনে কৌতূহল আর যথেষ্ট পরিমানে খচখচানি সৃষ্টি করলেও তাকে ঠিক জিজ্ঞেস করে উঠতে পারছিলাম না।
এর মাঝে মনসুর ভাই ফিরে এসেছেন। ইউরোপের অনেক জায়গা ঘুরে চেহারায় এক নতুন রকমের তারুণ্য ভর করছিলো তখন। দেশে ফিরেই নিজের চোখে পিরামিড দেখবেন বলে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে দিলেন। ঘোরার পাশাপাশি একটা রিসার্চ পেপারের জন্য তথ্যও সংগ্রহ করতে হবে সেখানে। কিন্তু তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে ঘোরাটাই মুখ্য!
অবস্থা দেখে বুঝলাম তিনি আরও বেশ কয়েকমাসের জন্য ক্যাফে বুকওঅর্ম এর দায়িত্ব আমার উপর গছিয়ে দিয়ে যাবেন। ততদিনে আমার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়ে গিয়েছে। পাশ করার পর এভাবে মাগনা খাটা পোষাচ্ছিল না বলে ইনিয়ে বিনিয়ে পয়সাকড়ির কথাটা বলবো ভাবছিলাম। কিন্তু ফেরার তিনদিন পর লাইব্রেরিতে বসে খোশগল্প করার সময় তিনি নিজেই আমাকে তিনমাস তার শখের ব্যবসার দেখ-ভাল করার জন্য ভালো একটা অংক দিয়ে উল্টো ধন্যবাদ দিয়ে এমন একাকার অবস্থা করলেন যে আমি লজ্জাই পেয়ে গেলাম।
‘তোমাকে পেয়ে যে কি বাঁচাটা বাঁচলাম বলে বোঝাতে পারবো না,’ মনসুর ভাই বললেন, ‘ব্যবসাটা যদিও শখে করি তবুও পয়সা আসলে কিন্তু মন্দ হয় না। ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে গিয়ে এখানে সেভাবে সময়ই দিতে পারিনি আমি। তুমি তো তিন মাসে ব্যবসার চেহারাই পাল্টে দিয়েছো।’
‘কি বলছেন আপনি এসব! আমি অতিরিক্ত কিছুই তো করিনি! ‘ কন্ঠে বিব্রত একটা ভাব নিয়ে বললাম।
‘স্বাভাবিক জিনিস মন দিয়ে করলে সেটাও কিন্তু অতিরিক্ত থেকে কম না। আসলে কখনও বাইরের কাউকে এটার দায়িত্ব যে দিতে চাইনি তা কিন্তু না। অনেকবারই ভেবেছি। কিন্তু কখনই কারও উপর ভরসা করতে পারিনি।’
‘আপনি কিন্তু এবার সত্যিই লজ্জা দিচ্ছেন আমাকে মনসুর ভাই!’
তিনি হাসলেন, ‘তা ইদানিং কি করা হচ্ছে?’
‘মাস্টার্সের জন্য এখানে সেখানে এপ্লাই করে বেড়াচ্ছি…’ এটা বলার সাথে সাথেই আমার ইমতিয়াজ সালেহীন এর কথা মনে পড়লো, ‘আচ্ছা মনসুর ভাই, ইমতিয়াজ সালেহীন নামে আপনার কোন স্টুডেন্ট ছিলো?’
‘ইমতিয়াজ?,’ মনসুর ভাই কিছুক্ষণ ভাবলেন, ‘হ্যাঁ! ওর কথা কেন মনে থাকবে না? আমার বেশ প্রিয় ছাত্র ছিলো সে। ইতিহাস বিষয়টার প্রতি একটা অন্যরকম আগ্রহ ছিলো ওর। মেডিকেলে তিন বছর পড়াশোনা করে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিফট করেছিলো। বেশ ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হয়েছে। এখন যতদুর জানি কোন একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ার লেকচারার।’
‘মেডিকেল থেকে ইতিহাস!’ আমি বিষ্ময় প্রকাশ করলাম, ‘বাপরে! তার পড়াশোনা যে ব্যাপক সেটা আগেই ধারণা করেছিলাম।’
‘তুমি চেনো নাকি ওকে?’
‘আপনি বাইরে যাওয়ার কিছুদিন পর একবার এসেছিলো এখানে। সেখান থেকেই পরিচয়। সিনেমা দেখবার দাওয়াত দিয়েছিলেন। এখন বেশ ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে। প্রায়ই উনার বাড়িতে আড্ডা দিতে যাই।’
‘মানুষ হিসেবে কিন্তু সে খুব রহস্যময়। একটু খেয়ালিও বটে।’
‘সেটা বুঝতে আমার আর বাকি নেই।’
‘ছেলেটা বর্ন স্টোরি টেলার। সাধারণ একটা গল্প এমনভাবে বলে যে মনে হয় আমি নিজেই সেখানে চলে গিয়েছি। ডিপার্টমেন্ট থেকে একবার সবাই মিলে দার্জিলিং এ গিয়েছিলাম। রাতে ঘুম আসছিল না বলে কটেজের সামনে আগুন জ্বালিয়ে আমরা কয়েকজন বসে ছিলাম। শরীয়তপুরের কোন একটা পোড়ো বাড়িতে ওর বন্ধুদের সাথে রাত কাটানোর একটা গল্প বলেছিলো সেদিন। বিশ্বাস করবে না, আমরা কেউই ভয়ে সে রাতে আর ঘুমাতে পারিনি।’
‘উনার আসলে লেখালিখি করা উচিত,’ আমি বললাম, ‘আমাকেও কয়েকটা এরকম গল্প বলেছেন। প্রতিবারই আমি ভয় পেয়েছি।’
‘ঠিক বলেছো,’ মনসুর ভাই বললেন, ‘দেখি, কায়রোর কাজটা সেরে নিয়ে ওর সাথে একদিন জম্পেশ আড্ডা দেবো।’
‘তাহলে তো খুবই ভালো হয়!’
বারোদিন পর মনসুর ভাই কায়রোর উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়লেন অ্যানালিটিকাল হিস্ট্রি অফ দ্য রিডিসকভারি অফ এনশেন্ট ইজিপ্ট টপিকে কাজ করার জন্য। যাওয়ার সময় একটা ভালো অংকের মাসিক বেতনে ক্যাফে বুকওঅর্ম এর অফিসিয়াল লাইব্রেরিয়ান বানিয়ে দিয়ে গেলেন আর সাথে তার রিসার্চের রিসার্চ এ্যাসিসটেন্ট। এটার বেতন আবার আলাদা। বেশকিছু টাকা অগ্রীম ও দিয়ে গেলেন। সে এক হুলুস্থুল অবস্থা। দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিলো তখন।
এর তিনদিন পর ইমতিয়াজ সালেহীনের বাসায় যাবার ফুসরত পেলাম। এবারও আমাকে দেখে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন তিনি। এবার আর সেটাকে মেকি মনে হলো না। মনে হলো ভদ্রলোক আসলেই আমাকে পছন্দ করেন।
সেদিন রাতে ছাদে আড্ডা দেবার সময় অনেকদিনের কৌতূহল দমাতে না পেরে আমি বলেই বসলাম, ‘সালেহীন ভাই, যদি কিছু মনে না করেন আপনার এই আজব শখটার মানে জানতে পারি?’
সিগারেটে আগুন ধরাতে গিয়ে তিনি থেমে গেলেন, ‘কোনটাকে আজব শখ বলছো তুমি?’
‘এই যে ফুল বিলিয়ে বেড়ানোটা,’ আমি উত্তর দিলাম।
‘এটাকে আজব শখ কেন বলছো?, তিনি কৌতূহলী চোখে জানতে চাইলেন, ‘একটা মানুষ শখে বাগান করতেই পারে। অর্কিডগুলো আমার একরকমের সৃষ্টি। নিজের সৃষ্টি সবার মাঝে ছড়িয়ে যাক এটা সবাই চায়। গায়ক চায় তার গান মানুষ শুনুক। লেখক চায় সবাই তার লেখা পড়ুক।’
‘সেটা ঠিক আছে,’ আমি নির্বিকার কন্ঠে বললাম, ‘আমার যতদূর মনে হয় অর্কিডগুলো আপনার সৃষ্টি না। বাগান করাটা আসলে আপনার জোর করে আনা একটা শখ। সেই সাথে ফুল বিলিয়ে বেড়ানোর অভ্যেসটাও।’
আমি ভেবেছিলাম সালেহীন ভাই হয়তো রেগে যাবেন। কিন্তু তিনি কেমন রহস্যময় স্মিত একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা খেলাসা করো দেখি!’
‘প্রথমত, শখ করে ফুল বিলিয়ে বেড়ানো যদি আপনার শখ হতো, বাগানটা আপনার বাড়ির ছাদে না হয়ে সামনের খোলা জায়গাটাতে থাকতো। আমি অনেককেই শখে বাগান করতে দেখেছি। বাগানের প্রতি তাদের অন্যরকম একটা মমতা থাকে। আপনারও আছে। কিন্তু মমতার ধরণটা খুবই অন্যরকম। বাগানটা যদি একান্তই আপনার শখ থেকে হতো, তাহলে আপনি নিজেই সেটার যত্ন আত্তি করতেন। কিন্তু সেটা আপনি না করে পুরো ভারটাই দিয়ে রেখেছেন রবির উপর। আমি আজ পর্যন্ত আপনাকে বাগানে পানিও দিতে দেখিনি কখনও। যাবতীয় কাজ সবসময় রবিই করে থাকে।
সালেহীন ভাই সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে বললেন, ‘সেটা হয়তো যুক্তির খাতিরে মানা যায় …..
কিন্তু শখ করে ফুল দিয়ে বেড়ানোর সাথে সেটা বাড়ির সামনে হওয়ার সম্পর্ক কিসের?’
‘আমি আপনাকে যতদুর চিনি, আপনি মানুষ হিসেবে নিঃসঙ্গ। কোলাহল, নিত্য নতুন মানুষের সাথে প্রতিদিন ওঠা বসা করা আপনার ধাতের বিষয় না। প্রথমদিন রবি বলেছিলো কেউ ছাদে উঠলে আপনি খুবই বিরক্ত হতেন। আর আপনার বাড়িতে বাইরের কাউকে আপনি একেবারেই সহ্য করেন না। সেটা প্রথমবার বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর কয়েকজনের আগমন থেকে আপনার প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা গিয়েছে। ফুল দিয়ে বেড়ানো যদি আপনার শখ হতো, তাহলে সেটা কখনই আপনার ছাদে থাকতো না। আপনি এমন কোন শখ কখনওই পুষতে চাইবেন না যেটার কারণে মাঝে মধ্যেই আপনার বাড়ির ভেতরে অপরিচিত কারও আগমন ঘটবে। এটা যদি একান্তই আপনার শখ হতো তাহলে পুরো ঘটনাটা দাঁড়াতো এরকম– আপনি সবসময় বাগানের দেখভাল, যত্নআত্তি করেন। রবি আপনাকে সেসব কাজে সাহায্য করে। কেউ ফুল নিতে এলে রবি তাকে পছন্দমত ফুল দিয়ে বাগান থেকেই বিদেয় করে দেয়। এতে অপিরিচিত লোকজনদের আর ভেতরে ঢুকতে হয় না। আর এখন হচ্ছে ঠিক উল্টো। দেখে মনে হয় কোন একটা বিচিত্র কারণে আপনি বাগানটা করতে আর ফুল বিলিয়ে দিতে বাধ্য। রবি এটার দেখা শোনা করে আর আপনি মাঝে মধ্যে তাকে সাহায্য করেন।’
একটানা অনেকক্ষণ বলার পর আমি থামলাম তার অভিব্যক্তি দেখবার জন্য। তিনি রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে সিগারেটে একটা বড় টান দিয়ে চোখে ইশারা করে চালিয়ে যেতে বললেন। আমি আবার শুরু করলাম, ‘আসলে পুরো ব্যাপারটার সারমর্ম হচ্ছে বাগান আর শখ করে ফুল বিলিয়ে বেড়ানোটা আপনার কোন শখ না। এই কাজটা করার পেছনে অন্য কোন কারণ আছে।
এমনও হতে পারে ছাদে বাগান দেওয়ার পর কোন কারণে আপনার এমন একটা শখ তৈরী হয়েছে, সেই শখের খাতিরে আপনি বাড়ির ভেতর অনেক রকমের লোকজন যাওয়া আসা করবে– এটা আপনি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তারপরও একটা কিন্তু থেকেই যায়,’ আমি একটু থেমে তারপর আবার শুরু করলাম, ‘আপনি ফুলগুলো বিলিয়ে দেবার জন্য কেন যেন খুব মরিয়া হয়ে আছেন। বাড়ির সামনের সাইনবোর্ডটা শখের খাতিরে হয়তো মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু পত্রিকায় বিজ্ঞাপনটা একটু কেমন যেন দেখায়। দেখে মনে হয় খুব অপছন্দের একটা ব্যবসা পারিবারিক ভাবে আপনার হাতে এসে পড়েছে বলে আপনি নিতান্তই অনিচ্ছায় সেটা করে যাচ্ছেন। কিন্তু কাজটা যে আপনার ভালো লাগছে সেটা আপনি অভিনয় করে দেখাতে চাইছেন। তবে সব কথা শুধুমাত্র একটা কথায় শেষ করা যায় এতোটা না টেনে…’
‘কি সেটা?’ সালেহীন ভাই নির্বিকার কন্ঠে জানতে চাইলেন।
‘আমার মনে হয় বাগানটা আপনার না। আপনার স্ত্রীর। যিনি বর্তমানে আপনার থেকে দূরে আছেন।’
পুরো ছাদটা জুড়ে একটা অস্থির নীরবতা নেমে এলো। আমি সালেহীন ভাইয়ের দিকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। তার মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। অনেকক্ষণ পর তিনি নিজেই নীরবতা ভাঙলেন। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘মানুষ হিসেব তুমি ভয়াবহ রকমের অবজারভেন্ট সৌধ। তোমার প্রতিটা কথাই আসলে সত্যি। বাগান করা, ফুল দিয়ে বেড়ানো এসব আমার শখ না। বাগানটাও আসলে আমার না। এ সবকিছুই আমার স্ত্রীর। কিন্তু তুমি এটা বুঝলে কি করে?’
‘আসল কথা হচ্ছে,’ আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম, ‘চরিত্র হিসেবে আপনি অনেক রহস্যময়। সাথে আপনার কাজগুলোও। আজকে যেই খটকাগুলোর কথা বললাম সেগুলো আপনার বাড়িতে আসার ক’দিন পর থেকেই আমাকে খোঁচানো শুরু করেছে। রহস্যময় জিনিস নিয়ে ভাবতে আমার বরাবরই ভালো লাগে, আর মনসুর ভাই এর লাইব্রেরিতে চিন্তা করার অনেক সুযোগ পাওয়া যায়। আপনাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই এসব সম্ভাবনা একটা একটা করে উঁকি দিচ্ছিলো। যেদিন আপনি আমাকে অক্টোবার স্কাই এর ডিভিডি বের করতে বলে কফি বানাতে গেলেন, ডিভিডি ঘাটতে গিয়ে অনেকটা দূর্ঘটনা বশতই আপনার পুরনো একটা ছবি পেয়ে যাই। সেটা আপনার আর আপনার এক বান্ধবীর। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা বেশ ঘনিষ্ঠ। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো আপনার প্রাক্তন প্রেমিকা। কিন্তু তখনই আমার গোলাপি মগগুলোর কথা মনে হলো।’
সালেহীন ভাই অবাক হলেন, ‘গোলাপি মগ?’
‘হ্যাঁ,’ আমি হেসে বললাম, ‘প্রথম যেদিন আপনার বাড়িতে এলাম, আপনার কেয়ারটেকার রবি এসে কফি দিয়ে গেলো গোলাপি মগে। ছাদে যখন আপনার সাথে কফি খেলাম, সেটাও ছিলো গোলাপি মগে। প্রথম সেদিন আপনার ঘরে ঢুকলাম, দেখলাম আপনার পর্দাও গোলাপি রঙের। প্রথমে ভেবেছিলাম এই রঙটার প্রতি আপনার একটু দুর্বলতা আছে। যদিও এই রঙটা ছেলেরা সাধারণত এড়িয়ে চলে। কিন্তু একটু ভাবতেই মনেহলো কফির মগ আর পর্দাগুলো হয়তো কোন মেয়ে মানুষের কেনা। এই ভাবনাটা ছেঁড়া সুতোর মতন ঝুলছিলো। যখন এটাকে ওই ছবিটার সাথে মেলালাম তখন ইকুয়েশন মিলে গেলো। মনে হলো আপনি বিবাহিত। শোবার ঘরের পর্দার রঙে স্ত্রী ছাড়া আর কারও অধিকার থাকতে পারে না। মগগুলোও হয়তো তার কেনা। কিন্তু কোন কারণে আপনি তার থেকে দূরে আছেন অথবা সে।’
‘এটা কিভাবে বুঝলে?’
‘সালেহীন ভাই, পুরো বাড়িতে তার কোন ছবি নেই। একটা ছবি পাওয়া গেলো, তাও আবার লুকানো। এটাতো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে আপনি তাকে ভুলে থাকতে চাইছেন! সাধারণত ছাড়াছাড়ি হলেই মানুষ এ সমস্ত কাজ করে থাকে। কেউ একজন চলে গিয়েছে– কিন্তু কফির মগ, শোবার ঘরের পর্দা থেকে তাকে কিছুতেই সরানো যাচ্ছে না।’
সালেহীন ভাই আবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। উঠে গিয়ে ছাদের রেলিং ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মিনিট। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তোমার অবজারভেশন ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছি। সবকিছুই ঠিক আছে। শুধু একটা বিষয় ছাড়া।’
‘কি সেটা?’
‘আমার স্ত্রী শাহানা আমার থেকে দূরে আছে। কিন্তু কতটা দুরে তুমি সেটা এখনো বুঝতে পারোনি। শাহানা মারা গিয়েছে তিন বছর আগে … আর এসব ফুল বিলিয়ে বেড়ানো, বাগানের পিছনে আমার আসলেই অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে। এসব কথা যদিও কখনও কাউকে বলিনি খোলাসা করে। তবে আজ তোমাকে বলবো।’
সালেহীন ভাই বেশখানিকটা সময় নিয়ে দু’কাপ কফি বানালেন। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বড় সড় একটা টান দিয়ে বললেন, ‘ঘটনাটা কিন্তু বড়। যদি শুরু করতে চাই তাহলে অনেক পেছন থেকে শুরু করতে হবে। পুরোটা শোনার ধৈর্য্য হবে তো?
‘অবশ্যই। এ নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।’
সালেহীন ভাই বলা শুরু করলেন। আগেই বলেছিলাম তার গল্প বলার দক্ষতা অসাধারণ। মিনিট খানেকের মধ্যেই তিনি আমাকে তার ঘটনায় একেবারে গেঁথে ফেললেন। আমি তন্ময় হয়ে শোনা শুরু করলাম। অনেকটা আজকের মতন। আমার ঘটনাটা তুই আর খসরু যেভাবে শুনছিস মনযোগ দিয়ে, ঠিক এভাবেই।
তবে সেদিন আজকের মত ঝড়-বৃষ্টি ছিলো না। তবে আবহাওয়ায় ঝড়ের একটা আভাস ছিলো। গায়ে কাঁটা দেওয়া হিম শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছিলো একটু পর পর। রাতের সাথে সাথে ইমতিয়াজ সালেহীনের গল্পও গম্ভীর হওয়া শুরু করলো।
তিনি বলতে থাকলেন। বিরতিহীন। একটানা। একটা সময় আমি তার গল্পে এতোটাই মগ্ন হয়ে গেলাম যে মনে হচ্ছিলো সবকিছু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন