০৫. ইমতিয়াজ সালেহীন এর ঘটনা

নসিব পঞ্চম জিহাদী

পাঁচ

ইমতিয়াজ সালেহীন এর ঘটনা

এতোদিনে নিশ্চই বুঝতে পেরেছো আমার গল্প বলার একটা আলাদা ধরণ আছে? তাই একটু নাটকীয় ভাবেই শুরু করলাম। যে সময়কার কথা বলছি, সে সময়ের ইমতিয়াজ আর আজকের ইমতিয়াজের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। যদি টাইম মেশিনে করে তুমি পেছাতে পারতে, সে সময়ের আমাকে দেখলে চিনতে অন্তত আধঘন্টা পরিশ্রম করতে হতো।

আজকের আমি যতটা সম্ভব মানুষকে এড়িয়ে চলি, ক্ষেত্রবিশেষে কথাও কম বলি। একটু ঘরকুনো স্বভাবের। নিতান্তই প্রয়োজন না হলে বাইরে কোথাও বের হই না। পড়াশোনা, লেখালিখি, রিসার্চ আর মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখার মাঝেই নিজেকে আটকে রেখেছি। আর আজ থেকে বারো বছর আগে আমি ঠিক এর উল্টো ছিলাম। সারাক্ষণ একগাদা ছেলে-মেয়ের মাঝে হৈ-হল্লা করে কাটাতাম। একটা ব্যান্ডে বাজাতাম তখন আমি। গান-বাজনা নিয়েই বেশিরভাগ সময় কাটতো। আর একটু সময় পেলেই বন্ধুদের সাথে এদিক সেদিক বেরিয়ে পরতাম। আজ পঞ্চগড়, তো কাল রাঙামাটি। পরশু ইন্ডিয়া, তরশু নেপাল এর পরদিন হয়তো ভুটান। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো আমার। উড়নচন্ডী লেভেল বিপদসীমার কাছাকাছি ছিলো। একদিন টুপ করে অতিক্রম করে ফেললো।

আসলে আমার শৈশবটাই ছিলো একটু আলাদা। আমার বাবা মারা যান চার বছর বয়েসে। এর বছর খানেক পরই আমার মা’র দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তিনি চলে গেলেন অন্য সংসারে। সেখান থেকে মাঝে মধ্যে খবর নিতেন আমার। আমি বড় হতে থাকলাম ফুপুর কাছে। ক্লাশ এইটে উঠবার পর ফুপুর বিয়ে হয়ে গেলো। তিনি চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়া। আমি হয়ে পরলাম একেবারে একা।

একা একাই বড় হতে থাকলাম। বাড়িতে বাবার বই এর বিশাল সংগ্রহ ছিলো। সেসব পড়ে সময় কাটাতাম। বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকতাম আমি।

মেডিকেলে ভর্তি হবার পর হঠাৎ স্বভাব চরিত্র পাল্টে গেলো আমার। এর পেছনে অবশ্য আমার কিছু বন্ধু বান্ধব দায়ী। সাথে মা’র মারা যাওয়ার শকটাও। মুখচোরা স্বভাবের আমি ফট ফট করে সারাক্ষণ কথা বলতাম। চিৎকার চেঁচামেচি করতাম। তখনই আসলে গিটার বাজানো ধরেছিলাম। আর ওটার সাথে ড্রাগস। হেরোইনে কঠিন ভাবে আসক্ত হয়ে গেলাম। আসলে আমাকে দেখে শুনে রাখার কেউ থাকলে এমনটা কখনই হতো না।

সেই সময় বাবার অঢেল সম্পত্তি হাতে এসে পড়লো। গাইডিয়েন্স দেবার কেউ না থাকলে যা হয় আরকি। দু’ হাতে টাকা পয়সা ওড়ানো শুরু করলাম। বাড়িতে ধরতে গেলে থাকতামই না। নিজের অবস্থা যে খুব খারাপ দিকে যাচ্ছিলো সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম। প্রায়ই শরীর খিঁচুনি দিয়ে উঠতো। নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়তো। তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোন হুশ থাকতো না। এতোকিছুর পরও নেশা ছাড়বার কোন চেষ্টা করছিলাম না। আমি আসলে মরতে চাইছিলাম। বেঁচে থাকার কোন অবলম্বন ছিলো না আমার। একদিন দেখলাম তিন মাসে বারো কেজি ওজন কমে গিয়েছে আমার। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমার সময় আসলে শেষ হয়ে আসছে। তাই ঠিক করলাম জীবনের শেষ সময়টা খুব ভালোভাবে উপভোগ করবো।

কাছের কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেলাম। দার্জিলিং-ইন্ডিয়া-নেপাল-ভুটান একসাথে ঘুরে এলাম। দেশে ফিরে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলো। কিছুই খেতে পারতাম না। বমি করে ফেলতাম। তবে আমার অবস্থা কাউকেই তেমন একটা বুঝতে দিইনি। সে বছর ৩১ ডিসেম্বর বাড়িতে কলেজের বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে একটা পার্টি দেই। সেখানেই আমার পরিচয় হয় শাহানার সাথে।

ও সৈমোরের সাথে এসেছিলো, আমার স্কুলের খুব কাছের একজন বন্ধু। সৈমোর ওকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ওর চেহারাতেই কেমন একটা আলাদা দ্যুতি খেলা করতো। দেখে মনে হতো পৃথিবীর কোন মালিন্য ওকে স্পর্শ করেনি।

সেদিন পার্টিতে এভারলি ব্রাদার্স এর অল আই হ্যাভ টু ডু ইস ড্রিম গানটা গেয়েছিলো ও। এর পর মুহূর্ত থেকে আমার জীবনটাকে কেমন অন্যরকম মনে হতে লাগলো। মনেহলো আমি আরও কিছুদিন বাঁচতে চাই। আমি নানা রকমের ছুঁতো বের করে শাহানার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করলাম। একসময় বেশ ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেলো আমাদের। প্রায়ই আমরা বাইরে সময় কাটাতাম। ও মাঝে মধ্যে সৈমোরের সাথে আমার বাড়িতে আসততা। গান টান করতাম। ওর আবার রান্নার হাত খুব ভালো ছিলো। প্রায়ই এটা ওটা রান্না করে আমাদের খাওয়াতো। একটা সময় খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেলো। ওকে জানিয়ে দিলাম মনের কথা।

শাহানা রাজি হলো। আর এর সাথে শুরু হলো আমার জীবনের নতুন একটা অধ্যায়। আমার সবকিছু পাল্টানো শুরু করলো। জীবনধারা, চিন্তাধারা সবকিছু। স্পষ্টতই বুঝতে পারলাম মেডিকেল আসলে আমার জায়গা না। আমি শাহানার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিফট হলাম। ওর সাথে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলাম। জীবনের নতুন একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া শুরু করেছিলাম তখন। সে সময়টায়, বলতে গেলে শাহানা আমাকে একেবারে হাতে ধরে নেশার জগতটাকে থেকে আমাকে ছাড়িয়ে আনলো। ওর এক বছর পর আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করি। আর আমাদের বিয়ে হয় দু’জনের মাস্টার্স একসাথে শেষ হবার পর।

জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কাটাচ্ছিলাম তখন। শাহানা এসে বাড়ির নকশাটাই একদম পাল্টে দিলো। যেই বাড়িতে ছোটবেলা থেকে বড় হচ্ছি সেই পুরনো বাড়ি আমার কাছে নতুন মনে হওয়া শুরু করলো। বাড়িটা আসলে এতোদিন মৃত মানুষের মত পড়ে ছিলো। ও আসাতে একটা নতুন জীবন পেয়েছিলো এই বাড়ি।

আগে এই বাড়ির ছাদটা বাতিল আসবাবপত্র দিয়ে বোঝাই ছিলো। সুইমিং পুলটায় তখন পানি থাকতো না। ওখানে নেমে আমরা বন্ধুরা মিলে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। নিচের অংশটাতে ছিলো একটা টেবিল টেনিস আর বিলিয়ার্ড বোর্ড। শাহানা এসে সেগুলো সরিয়ে পুরো ছাদ ফুল গাছ দিয়ে ভরিয়ে ফেললো। বাগান করাটা ওর হবি ছিলো আর এসব ব্যাপারে ওর প্রচুর পড়াশোনাও ছিলো।

মাস ছয়েক পর পুরোটা ছাদ ভরে উঠলো বিচিত্র সব ফুল গাছে। সুইমিং পুলটা প্রায় একযুগ পর পরিষ্কার করে পানি ভরা হলো। আস্তে আস্তে ছাদটা হয়ে উঠলো অন্য একটা দুনিয়া। আমি আর শাহানা এখানে অনেক সময় কাটাতাম। আমি বাজাতাম, ও গাইতো। কত রকমের স্বপ্ন ছিলো দু’জনের! সারাদিন বসে বসে সেসব নিয়ে কথা বলতাম।

বিয়ের এক বছরের মাথায় শাহানা জানালো আমাদের সংসারে নতুন একজন আসতে যাচ্ছে। বিশ্বাস করবে না সৌধ! নিজের কানতে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি মেনেই নিতে পারছিলাম না যে কেউ একজন আমার কপালে এতোটা সুখ লিখে রেখেছেন।

সেই অনাগত সন্তানের জন্য আমাদের পাগলামী দেখলে তুমি এখন হেসে ফেলতে। বাচ্চাদের এটা সেটা কিনে ঘর আমরা বোঝাই করে ফেলা শুরু করলাম। কত রকমের পরিকল্পনা যে ছিলো আমাদের! আমার মনে হতে থাকলো আমি মনে হয় এ পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ। তবে আমার ধারণাটা ভুল ছিলো। সে ভুল ভাঙতেও আমার বেশি সময় লাগেনি।

শাহানার প্রেগনেন্সির তখন সাত মাস। সে রাতটার আবহাওয়া ছিলো অনেকটা এমনই। সন্ধ্যে থেকেই আকাশে মেঘ করা শুরু হয়েছিলো। ঝড়-বৃষ্টির রাত আমার আর শাহানার সবসময়ই প্রিয় ছিলো। আমরা ঠিক করলাম আমরা এই রাতটা জেগে থাকবো। গল্প করে পুরোটা সময় কাটিয়ে দেবো।

রাত এগারোটার দিকে ঝুম বৃষ্টি নামলো। শাহানা আমার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিলো। আমি গুনগুন করে গান গাইছিলাম আর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম।

ও হঠাৎ বলে উঠলো, ‘ইমতিয়াজ, আমি ছাদে যাবো। এক্ষনি।’

‘পাগল!,’ আমি হতবাক হয়ে বললাম, ‘এই অবস্থায় ছাদে? বাইরে কিন্তু ঝড় হচ্ছে!’

‘আমি ভিজবো না। তুমি আমার মাথার উপর ছাতা ধরে রাখবে। আমি পাঁচ মিনিট বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখে চলে আসবো।’

আমি না করতে থাকলাম। ও অনুরোধ করতেই থাকলো। শেষে ওকে নিয়ে যেতে হলো। ভেজার কথা না থাকলেও ও দু’ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে মাথার উপর থেকে ছাতাটা সরিয়ে আমার কানের কাছে এসে বললো, –আমি চাই আমাদের মেয়েটা যেনো তোমার-আমার মতন বর্ষার প্রতি অসীম মমতা নিয়ে জন্মায়।’

শাহানা তিন-চার মিনিটের মতন ভিজলো। তবে বর্ষার প্রতি অসীম মমতা নিয়ে কেউ আর জন্মায়নি। ছাদ থেকে নামার সময় ভেজা পা নিয়ে পিছলে ও সিঁড়ি থেকে পরে যায়। আমারও হাত ফস্কে গেলো। আর আটকাতে পারলাম না।

পরের ঘটনাগুলো সিনেমার ট্র্যাজিক সিনগুলোর মতন। শাহানা বেশ গুরুতর আঘাত পেলো। সাথে বাচ্চাটাও। ওর গর্ভপাত হলো। অপুষ্ট, কিন্তু দেবী’র মতন চেহারা নিয়ে পৃথিবীতে আসা একটা মৃত মেয়েকে কয়েক পলকের জন্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো অবশ্য। ডাক্তাররা জানিয়ে দিলো ও আর কখনওই প্রেগনেন্ট হতে পারবে না।

কয়েকদিন পর স্তম্ভিত, পাথরের মতন চেহারা দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম। অপরাধবোধ নিজেকে ভেতর থেকে একটু একটু করে শেষ করে ফেলছিলো। সেটাতে আরও দাবানল লাগালো শাহানা। আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, ‘কেন আমাকে ছাদে নিয়ে গিয়েছিলে? কেন আটকাওনি আমাকে? বলো আমাকে!’

শাহানা কেমন যেন হয়ে গেলো। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলো। শুকিয়ে একেবারে মমির মতন হয়ে যেতে থাকলো ওর চেহারাটা। সারাটাদিন বিলাপ করে কাঁদতো। সাইকিয়াট্রিস্টরা বললো এই শক কাটাতে ওর সময় লাগবে। যতটা পারা যায় ওকে সময় দিতে হবে। খুশি রাখার চেষ্টা করতে হবে।

আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। লাভের লাভ কিছুই হলোনা। ওর মানসিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি হয় পাঁচ মাস পর। কাউকেই চিনতে পারছিলো না ও। আমাকেও না। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কিসব বলতো। ওসবের এক বর্ণও বোঝা যেতো না।

সে বছর সেপ্টেম্বরের এক রাতে, শাহানা অসংখ্য ঘুমের ওষুধ খেয়ে ওর দুঃস্বপ্নের জীবন থেকে বিদেয় নেয়। সত্যি বলতে, আমি তেমন একটা কষ্ট পাইনি মৃত্যুতে। বরঞ্চ ও মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলো। এভাবে তিলে তিলে শেষ হবার থেকে একেবারে মরে যাওয়াটাও আসলে ভালো ছিলো। খুলনায় আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে ওর কবর হলো। ওকে দাফন করে যাবতীয় হিসেব নিকেশ চুকিয়ে ঢাকা ফিরে এসে আমি আমার পুরনো জীবনে ফেরত গেলাম।

বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছেই আমার মাঝে কাজ করছিলো না। আবার আত্মহত্যা করার সাহসও পাচ্ছিলাম না। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করলাম। কাজের কাজের কিছুই হলো না। শুধু কাজের সময়টুকু ওর কথা মাথা থেকে দূরে থাকতো, কিন্তু ঘরে ফিরলে– তীব্র অপরাধবোধ, দুঃখ গ্রাস করতো আমাকে। রাতে এক ফোঁটা ঘুম হতো না। শেষ রাতে একটু তন্দ্রার মতন আসততা, ওর মধ্যেই দুঃস্বপ্ন দেখে ঘন্টা দু’এক পর জেগে উঠতাম।

শাহানা মারা যাওয়ার প্রায় এক বছর পার হয়ে গিয়েছে। এই এক বছরে আমি ছাদের গাছগুলোর কোন যত্ন নেইনি। বলতে গেলে এক বছর আমি ছাদেই উঠিনি। এক রাতে তীব্র কালবৈশাখীর মাঝে আমার কোনকিছুই ভালো লাগছিলো না। ভাবলাম ছাদে গিয়ে একটু বসে থাকা যাক। আমি একটা ছাতা নিয়ে ছাদে উঠে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম।

পুরোটা ছাদ মরা গাছে সয়লাব। অন্ধকারে সেগুলোকে বিচিত্রসব অঙ্গভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মতন দেখাচ্ছিলো। মনেহলো একটা গোরস্তানে দাঁড়িয়ে আছি। এর মাঝে পুরো আকাশ দিনের মতন আলোকিত করে দিয়ে একটা বাজ পড়লো। সেই আলোতে আমি স্পষ্ট দেখতে ছাদের মাঝে সবুজ শাড়ি পরা একটা নারী-মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

হরর সিনেমাতে দেখি ভূতের একটু আভাস পেলেই কেউ না কেউ সেদিকে এগোনো শুরু করে। কতবার যে মনের অজান্তেই এ রকম স্টুপিডিটির জন্য গাল দিয়ে উঠেছি হিসেব নেই। তবে আমিও ভয় পেয়ে সেই স্টুপিডের মতন কাজটাই করলাম। হাতের টর্চটা জ্বেলে সেদিকে যাওয়া শুরু করলাম। আমি পরিষ্কার দেখলাম শাহানা সেখানে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো ভিজে মাথার সাথে লেপ্টে আছে। চোখগুলোতে অসম্ভব রাগ।

ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমার বাগানের তুমি এই অবস্থা করে রেখেছো?

আমি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমি নিজেই জানি এটা আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। রাতের পর রাত জেগে থাকা, মানসিক চাপ আর ট্রমা মিলিয়ে আমার মস্তিষ্ক যথেষ্ট রকমের ক্লান্ত। আর অবচেতন মনে শাহানাকে দেখার তীব্র ইচ্ছে কাজ করছে। সব মিলিয়ে ছাদের মাঝে শাহানাকে দেখা খুবই বৈজ্ঞানিক।

আমি মনে মনে ভাবতে থাকলাম চোখ খোলা মাত্র দেখবো আমার সামনে কেউ নেই। চোখ খোলারও সময় পেলাম না। এর আগেই শাহানা আবার বলে উঠলো, ‘তুমি কথা বলছো না কেন ইমতিয়াজ?’

আমি প্রায় দৌড়ে নীচে নামলাম। ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। যা দেখেছি সেটার যথেষ্ট রকমের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু আমি এমন কিছু দেখার জন্য মানসিক ভাবে একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে দীর্ঘদিন পর আমার বেশ আরামের একটা ঘুম হলো। প্রায় দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাতদিনের ছুটি নিলাম। আমার যে বিশ্রাম প্রয়োজন, তখন সেটা আমাকে দেখলে তুরাগ বাসের কন্ডাকটারও বলে দিতে পারতো।

সকালে উঠে স্বভাবতই রাতের ঘটনাটা হাস্যকর মনে হতে লাগলো। তবু সকালে উঠে ছাদে গেলাম একবার। বাগানটার অবস্থা দেখে মনটা একেবারেই

খারাপ হয়ে গেলো। শাহানার এতো শখের বাগান, অথচ অবহেলায় পরে থাকতে থাকতে পুরোপুরি একটা জংলা মতন জায়গায় পরিণত হয়েছে। তখন আমাদের বাড়িতে রবি’র চাচা, রহমান আলী কাজ করতেন। সেদিনই তাকে সাথে নিয়ে বাগানটা পরিষ্কার করা শুরু করলাম। সেটা যতটা না অপরাধবোধ থেকে করলাম, তার থেকে বেশি ছিলো আসলে শাহানার প্রতি ভালোবাসা। ওর যত্ন করে বানানো একটা সৃষ্টি আমার অবহেলার কারণে নষ্ট হয়ে পরে থাকবে সেটা আমি একদমই মেনে নিতে পারছিলাম না। চার মাস অনেক খাটা খাটনি করবার পর বাগানটাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা গেলো।

তখন প্রায় রাতেই ছাদে বসে আমি লেখালিখি করতাম। এরকমই এক রাতের কথা, সেদিনও আবহাওয়াটা আজকের মতই ছিলো। তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। নীচ থেকে ছোট বাচ্চাদের খিল খিল হাসির আওয়াজ কানে আসতে লাগলো। তখন আমি সুইমিং পুলের পাশে একটা টেবিলে বসে লিখছি। প্রথমে কিছুক্ষণ পাত্তা না দিলেও পরে ঘটনাটা কি বুঝতে ছাদের নিচের অংশটায় গিয়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

ছাদের দু-পাশে সারি করে সাজানো অর্কিডের ড্রামগুলোর মাঝে শাহানা দাঁড়িয়ে আছে। ওর পরণে একটা সবুজ শাড়ি। চুল গুলো খুব সুন্দর করে সাজানো। সমস্ত চেহারায় কেমন স্নিগ্ধ একটা ভাব। ওর পাশে সদ্য হাঁটতে শেখা একটা ফুটফুটে বাচ্চা। পুরোটা ছাদ সে দৌড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেদিন আমার ভয় লাগলো না। আমি হতভম্ব হয়ে শাহানার দিকে এগোতে থাকলাম।

কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে ওর নাম ধরে ডাকলাম, শাহানা!’

সে উত্তর দিলো। আগের মতন, সেই পুরনো কণ্ঠে, ‘কি?’

আমি কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর ছুটে গিয়ে ওর হাত ধরলাম।

সেই পুরনো স্পর্শ, পুরনো পারফিউমের গন্ধ।

শাহানা বিড়বিড় করে বললো, ‘আমার বাগানটাকে তুমি আবার ঠিক করেছো দেখে তোমাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছি। তোমার মেয়ে বাগানটা খুব পছন্দ করেছে। ও হয়তো মাঝে মধ্যেই এখানে আসবে। এতো এতো ফুল ফুটে আছে, তুমি এসব কাউকে দিচ্ছে না কেন? ফুল যদি কেউ না-ই নিলো তাহলে এতো ফুলেরই বা দরকার কি?’

এবার ভয় না, গলার কাছে উঠে আসা একটা কান্না গিলে ফেলতে, কষ্টের স্মৃতিগুলো মাটি চাপা দিতে আমি দৌড়ে নিচে নামলাম। নিজেকে অসুস্থ মনে হতে লাগলো। আমি অদ্ভুত একটা ঘোরের মাঝখানে চলে গেলাম।

এই ঘটনার পর অনেকদিন আমি ছাদে যাইনি। একদিন এক কুয়াশা পরা ভোরে ছাদে উঠে আমার মনে হলো ফুল দেওয়ার ব্যাপারটা হয়তো শাহানার কোন সুপ্ত একটা ইচ্ছে। হয়তো ওর ইচ্ছেটা পূরণ হলে ওকে আরও একবার দেখা যাবে। মন্দ কি! হোক এটা আমার এক রকমের অসুস্থতা। কিন্তু শাহানা আর আমার মেয়েটাকে তো দেখতে পাবো।

পরদিনই একটা সাইনবোর্ড বানিয়ে এনে টানিয়ে দিলাম। পত্রিকায় রীতিমতন বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে ডেকে ফুল দেওয়া শুরু করলাম। শাহানাকে দেখবার আশায় প্রায়ই ছাদে রাত কাটাতে থাকলাম। কয়েকটা রাতে তুমিও সাথে ছিলে। কপাল ভালো হলে দু’জনের একসাথে শাহানার সাথে দেখা হয়ে যেতো, আমার কনফিউশনটাও কাটতো।

তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও আসবে। ওকে আসতেই হবে। ও দু’বার আমার সামনে এসেছে। আরও একবার সে অবশ্যই আসবে। এটা প্রকৃতির একটা নিয়ম। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পরপর দু’বার হলে সেটা তিনবার হতে বাধ্য। দানে দানে তিন দান।

আর তিন খুবই রহস্যময় একটা সংখ্যা। পীথাগোরাসের মতে সবথেকে রহস্যময় সংখ্যা।

ছয়

দীর্ঘক্ষণ একটানা কথা বলে সালেহীন ভাই বেশ সময় নিয়ে দু’টো মগে ফ্লাক্স থেকে কফি ঢাললেন। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ টানা শুরু করলেন। সামনের কফির মগটা থেকে ধোঁয়া উড়ছে, সেই সাথে আরেকটা ধোঁয়ার উৎস তিনি নিজে। বেশ অদ্ভুত একটা দৃশ্য।

ভদ্রলোককে দেখে আমার মায়া হলো। মাঝে মধ্যে কিছু মানুষের জীবনের ঘটনা জানলে উপরওয়ালাকে অনেক অবিচারক মনে হয়। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, এমন কেন হলো? তখন আমার ঠিক অমনই মনে হচ্ছিলো।

আমি বেশ খানিকটা সময় নিয়ে কফি শেষ করে নীরবতা ভাঙলাম, ‘সালেহীন ভাই, আপনার পড়াশোনার পরিধি অনেক। আপনি নিজেও হয়তো বুঝতে পারছেন আপনার প্রফেশনাল সাহায্য দরকার। আপনার এ সমস্ত ঘটনা কিন্তু অডিটরি আর ভিজুয়াশল হেলুসিনেশনের বেশ বড় একটা প্রমাণ। মানুষ হিসেবেও আপনি নিঃসঙ্গ, আপনি বেশ বড়সড় একটা ডিলিউশানের মাঝে দিয়ে যাচ্ছেন, সেটা মনে হয় আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন।’

এতোক্ষণের ঠান্ডা বাতাস এবার ঝড়ো বাতাসে রূপান্তরিত হতে শুরু করলো। হীম ঠান্ডা বাতাস একেবারে। আমার কাছে মনে হলো ছাদটাতে আলো কেন যেন খুব কমে গিয়েছে।

সালেহীন ভাই বললেন, ‘প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। একদিন হঠাৎ রহমান চাচা বাড়ি থেকে বিদেয় নিলেন চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে। তার ভাষ্যমতে এই বাড়িতে অশুভ নজর পড়েছে। ছাদে নাকি প্রায়ই মেয়েছেলেদের হাঁটাহাঁটি করতে দেখেন তিনি। সেবার অনেক বছর পর ফুপু আমাকে দেখতে এসেছিলেন বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। সন্ধ্যা বেলা তার ছেলে দু’টো ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালো ছাদ থেকে। কিন্তু কি দেখে ভয় পেয়েছে সেটা কিছুতেই বলে বোঝাতে পারলো না। সবথেকে বড় কথা হচ্ছে শাহানার কথাটা আমি কারও সাথে আলোচনাই করিনি।

‘আপনি হয়তো আপনার স্ত্রী’র ঘটনা বলে এখানে যুক্তি খাটাতে পারছেন না। আবেগটা বেশি কাজ করছে। কিন্তু একটু মাথা ঘামালে এই ঘটনাগুলোর একটা না একটা ব্যাখ্যা অবশ্যই বের করা যাবে।’

সালেহীন ভাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। ততক্ষণে বাতাসের বেগ বেড়েছে। মিনিট দশেকের মাঝেই বৃষ্টি নামবে বলে মনে হচ্ছে।

দীর্ঘক্ষণের নীরবতা ভেঙে তিনি আমার দিকে কেমন অন্যরকম একটা দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন। তার গলার আওয়াজটাও একটু অন্যরকম শোনালো। তিনি বললেন, ‘শাহানার আসবার ব্যাপারে আমার ইনট্যুশন খুব প্রবল সৌধ। আমার খুব করে মনে হচ্ছে শাহানা আজ আসবেই।’

সালেহীন ভাই কথাটা বলে শেষ করলেন। এর কিছুক্ষণ পরই বাচ্চাদের খিলখিল হাসির আওয়াজে ছাদটা কেমন যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো। মনেহলো প্রতিটা গাছ যেন নতুন করে জীবন পেয়েছে। কেমন অদ্ভুতভাবে নাড়াচাড়া করছে সেগুলো। ছায়াগুলোও ভুতুড়ে দেখাচ্ছে।

আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। সালেহীন ভাই একটা রহস্যময় হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু শুনতে পাচ্ছো?’

আমি শুকনো গলায় উত্তর দিলাম, ‘নাতো! কেন?’

আমি এই অনুভূতির সাথে একেবারেই পরিচিত না। আমি কি ভয় পাচ্ছি? কেমন একটা অস্বস্তি আমার শরীরের সাথে একেবারে লেপ্টে আছে। আমি সেটা কাটাতে উঠে দাঁড়ালাম। হাসির আওয়াজটা কোন নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আসছে না। পুরো ছাদ জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।

সালেহীন ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি খুঁজছো তুমি?’

আমি একটা উত্তর দেবার জন্য মুখ খুলেছি, পেছনে ফিরে দেখি ছাদের ঠিক মাঝখানে কালো একটা অবয়ব। প্রথমে মনে হলো চোখের ভুল। একটু ভালো মতন তাকিয়ে দেখি সেখানে একটা অস্পষ্ট ছায়া। প্রথমে দেখে মনে হলো বাতাসে কালো রঙের কোন কাপড় উড়ছে। কিন্তু আস্তে আস্তে সেটার আকার পরিবর্তন হতে শুরু করলো।

আমার থেকে বারো হাত দূরে অবয়বটা। এখন আমার উচিত এক পা দু’ পা করে পেছাতে শুরু করা। কিন্তু আমার চোখের পাতা আমি নামাতেই পারছিলাম না। অদৃশ্য কোন এক টানে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। সেই ছায়া এখন পুরো স্পষ্ট একটা নারীমূর্তি!

এটা সত্য হতেই পারেনা। ইমতিয়াজ ভাইয়ের গল্প আমাকে এতোটাই প্রভাবিত করেছে যে আমি এখন ছাদে কাউকে দেখতে পাচ্ছি!– মনে মনে বললাম আমি।

ছাদে আলোর ব্যবস্থা তেমন একটা নেই। তারপরও আস্তে আস্তে অবয়বটা আমার চোখে স্পষ্ট হওয়া শুরু করলো। আমার পায়ে মনে হলো শেকড় গজিয়ে গিয়েছে। আমি নড়তেও পারছিলাম না ভয়ে।

সে আস্তে আস্তে দিকে এগোনো শুরু করলো। একদম স্পষ্ট শাহানার চেহারা। অবিকল ছবির মতন। আতংকে আমার শরীর অবশ হয়ে গেলো।

সালেহীন ভাই বিড়বিড় করে বললেন, ‘কি সৌধ, বিশ্বাস হলো?, ‘

আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না। নিষ্পাপ একটা চেহারার মাঝে এতোটা ভয়, আতংক কিভাবে লুকানো থাকে আমার জানা নেই।

এটা সত্য হতেই পারে না। সালেহীন ভাই এর ঘটনা শুনে তার প্রতি আমার মমত্ববোধ থেকে অবচেতন মনে আমি চাইছিলাম শাহানার সাথে তার আবার দেখা হোক। মানুষ যা দেখতে চায় মস্তিষ্ক তাই দেখায়। আমি অবচেতন মনে শাহানাকে দেখতে চেয়েছিলাম। মস্তিষ্ক আমাকে সেটাই দেখাচ্ছে।

অটোসাজেশনে কাজ হয়েছিলো কিনা জানি না। আমি প্রবল আতংক নিয়ে দৌড়ানো শুরু করলাম। আমার আশপাশটা এমনভাবে অন্ধকার হয়ে গেলো যে হঠাৎ মনে হলো আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমার মাথায় শুধু কাজ করছিলো যেকোনো মুল্যে আমাকে এই বাড়ি থেকে বের হতে হবে।

সেদিন আমি কিভাবে সেখান থেকে বের হয়েছিলাম আমার একদমই মনে নেই। প্রচন্ড ভয় পেলে মানুষের এরকম হয় কিনা সেটাও আমার জানা নেই। আমার মনে হচ্ছিলো অন্ধকার একটা টানেলের মধ্যে দিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। আর আমাকে তাড়া করছে অনেকগুলো মানুষ।

আমার কানে ভাসতে লাগলো, ওকে ধরো, যেভাবে পারো ওকে ধরো। ওকে আমার লাগবেই!

আমার দৌড়ানোর গতি বেড়ে গেলো। আর ভাসতে থাকলো –ওকে মেরে ফেলতে হবে। অল্পবয়েসি একটা ছেলেই আমার দরকার।

ধরো ওকে!

কোথায় গেলো ও!

*

সেই রাতটার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। ওখান থেকে কিভাবে বাসায় এসেছিলাম আমি বলতে পারি না। সেটা এখন পর্যন্ত বলতেও পারিনি। মনে করার কম চেষ্টা করিনি। এমনকি এক রকমের ধ্যান আছে, যেটা বেশ কিছুদিন চর্চা করলে পুরনো স্মৃতি স্বপ্নের মধ্যে ভেসে ওঠে। টানা কয়েকদিন সেগুলোও চর্চা করেছিলাম। লাভ হয়নি। আজে বাজে অনেককিছু মনে পড়তে লাগলো। কিন্তু সেদিন কিভাবে ফিরেছিলাম সেটা যেন নিউরন থেকে পুরোপুরি মুছে দিয়েছে কেউ!

সেদিন বাড়িতে ফিরেছিলাম কাকভেজা হয়ে। আম্মা নাকি আমাকে দেখে একেবারে আঁতকে উঠেছিলেন। পরণের শার্টের পকেটটা নাকি ছিঁড়ে বুকের কাছে এসে ঝুলছিলো। পাঁক-কাদা মেখে একেবারে ভূতের মতন অবস্থা আর দিশেহারা দৃষ্টি নিয়ে আমি ঘরে ফিরেছিলাম সেদিন।

টানা কয়েকদিন জ্বর গেলো আমার। এর মাঝে বিচিত্র রকমের প্রলাপ ছাড়া আমার মুখ থেকে আর কিছুই বেরোয়নি। সাতদিন পর একটু ধাতস্থ হতেই সে রাতে কি হয়েছিলো ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারলাম না। পুরো ঘটনার অনেক রকমের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করলাম, মন থেকে ভয় কিছুতেই তাড়াতে পারছিলাম না। সে রাতটার কথা মনে পড়লেই আমার শরীর কেমন অসাড় হয়ে আসততা।

আসল সমস্যা শুরু হলো এর এক মাস পর। হঠাৎ হঠাৎ কেমন একটা ঘোরের মাঝে চলে যেতাম আমি। আশ-পাশের সব আওয়াজ গুলো ম্লান হয়ে যেতো। মাথায় তখন তীব্র, সূক্ষ একটা যন্ত্রনার অনুভূতি শুরু হতো। তারপর সেটা ছড়িয়ে পরতো পুরো শরীরে। আশে পাশে তখন অনেক রকমের কন্ঠস্বর শুনতে পেতাম। মনে হতো একজন চিৎকার করে বলছে, ওকে ধরো, যেভাবে পারো ওকে ধরো। ওকে আমার লাগবেই! অল্পবয়েসি একটা ছেলেই আমার দরকার!!

আমি ভয় পেয়ে পালিয়েছিলাম একটা নারীমূর্তি দেখে। সেটার সাথে এসমস্ত কথা বার্তার কি সম্পর্ক আমি অনেক ভেবেও কিছু বের করতে পারলাম না। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের বাজে একটা মানসিক পরিস্থিতি কাটাচ্ছিলাম। রাতে ঘুম হতো না। ঘুমালেই সেদিনকার ঘটনাটা দুঃস্বপ্নে দেখে জেগে উঠতাম।

এর মাঝে ইমতিয়াজ সালেহীন টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। আমি সেটা এড়িয়ে গিয়েছি। আমি কোনভাবেই তার মুখোমুখি হতে চাচ্ছিলাম না। মূলক অথবা অমূলক, ভয়ের যেকোনো একটা ধরণ আমাকে কাজটা করতে বরাবরই নিরুৎসাহিত করছিলো। লাইব্রেরির কাজে তখন একেবারেই মতন বসাতে পারছিলাম না। রিসার্চের কাজটা করতেও বেশ ঝামেলা হচ্ছিলো। মনসুর ভাই সেটা টের পেয়ে গেলেন। আমাকে মেইল করে বললেন কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে আসতে।

তখন আমি তোদের বাসায় এসে উঠি। একটানা পাঁচদিন ছিলাম এখানে। ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু উদ্ভট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম তোদের সাথে তখন। তোদের খুব সম্ভবত মনে আছে। বাস একসিডেন্ট করে রাদিফের তখন ডান হাত ভাঙা। আমি জানতে চেয়েছিলাম, কোন ভূতের গল্প শুনে কারও পক্ষে সেটা চোখের সামনে দেখা সম্ভব নাকি। খসরু বলেছিলো সম্ভব। একজনের ভয়ে প্রভাবিত হয়ে প্রায়ই তার আশে পাশের মানুষও ভয় পাওয়া বা উল্টো পাল্টা কিছু দেখা শুরু করে। এটা বিচিত্র কিছু নয়। পুরো ব্যাপারটাই আসলে এক রকমের ভ্রান্তি।

আর রাদিফ, তুই বলেছিলি কোন নির্দিষ্ট জায়গা বা জিনিসের প্রতি ভয় থাকলে সেটা কাটানোর সবথেকে মোক্ষম অস্ত্র হলো সে ভয়টার মুখোমুখি হওয়া। আসলে এখন মনে হয় তোদের যদি আগেই এসব জানিয়ে দিতাম, তাহলে আমার আজ এরকম একটা পরিস্থিতিতে পরতে হতো না।

ইন্টারনেট ঘেটে কয়েকটা কমিউনিটি ফোরাম, ব্লগে অনেক লেখকের, সাধারণ মানুষের তীব্র ভয়ের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা পড়া শুরু করলাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিল পেলাম বটে। কিন্তু বেশিরভাগ জিনিসই আসলে অন্ধকারে থেকে গেলো।

বাড়ি ফেরার পর দু’দিন বেশ সুস্থ আচরণ করলাম আমি। তেমন কোন সমস্যাও হচ্ছিলো না আমার। তৃতীয় দিন আমি ঠিক করলাম আমি মুখোমুখি হবো। ভয়টাকে ভেতরে পুষে এভাবে পালিয়ে বেড়ানোটা আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না।

সাত

লাইব্রেরি একটানা বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিলো। সেটা পুষিয়ে দিতে আর ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে দু’তিনটা দিন লাইব্রেরিতেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই সাথে সালেহীন ভাই এর বাড়িতে যাবারও মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

সেদিন বেশ গরম ছিলো। মনসুর ভাইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহে অবচেতন মন নিয়ে লেখা ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল এর The power of thinking, without thinking নামে একটা বই পেলাম। ভাবলাম লাইব্রেরি বন্ধ করে এসিটা বাড়িয়ে দিয়ে রাতটা এখানেই কাটাবো, সাথে বইটাও শেষ করবো। তারপর ভোরের দিকে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে বিকেলে সালেহীন ভাই এর বাড়িতে গিয়ে হাজির হবো।

লাইব্রেরিতে তখন মনসুর ভাইয়ের কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব আড্ডা দিচ্ছিলেন। তাদের আলোচনা তখন প্রায় শেষের পথে। ঠিক সেই সময়ে সালেহীন ভাই এসে ঢুকলেন। পরণে ধবধবে শাদা পাঞ্জাবী। চোখে কালো ফ্রেমের পাতলা একটা চশমা। চুলগুলো খুব সুন্দর করে আঁচড়ানো। তাকে দেখে বেশ উৎফুল্ল মনে হচ্ছিলো। তিনি কোনদিকে না তাকিয়ে একেবারে সোজা কাউন্টার টেবিলের সামনে এসে হাজির হলেন।

আমি ভেবেছিলাম সালেহীন ভাইকে দেখেই আমি একটা ধাক্কা খাবো। কিন্তু বাস্তবে সেরকম কিছুই হলো না। তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ঠিক আছো?’

আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘হ্যাঁ।’

তার প্রতি আমার একটা রাগ তৈরী হয়েছে। আমার মনে হচ্ছিলো আমাকে ভয় পাওয়াতে পেরে তিনি খুব আনন্দিত।

মনসুর ভাইয়ের বন্ধুরা একে একে বিদেয় নিলেন কিছুক্ষণ পর। সালেহীন ভাই একটা রিডিং টেবিলে বসে বললেন, ‘এক কাপ কফি খাওয়াতো পারো সৌধ?’

আমি কফি বানিয়ে এসে দেখি কাউন্টার টেবিল থেকে গ্ল্যাডওয়েলের বইটা নিয়ে তিনি পাতা উল্টাচ্ছেন। আমাকে দেখে বইটা বন্ধ করে বললেন, ‘সে রাতের ঘটনাটার উপযুক্ত কোন ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করছো?’

আমার সিগারেট টানার অভ্যাস কোনকালেই তেমন একটা ছিলো না। তবে সেদিন কেন যেন খুব ইচ্ছে করছিলো। আমি সালেহীন ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার কাছে সিগারেট আছে?’

তিনি আর কোন প্রশ্ন না করে পকেট থেকে মার্লবরো রেডের একটা প্যাকেট আর লাইটার আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।

আমি সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ টেনে বললাম, ‘হ্যাঁ, ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করছি। আমি মানুষ হিসেবে যে খুব বিজ্ঞানমনস্ক, তা কিন্তু না। অবৈজ্ঞানিক অনেক কিছুতেই আমার বিশ্বাস করতে ভালো লাগে। তবে আমার অবচেতন মন বলছে আপনার ছাদে ঘটা ঘটনাটার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।’

সালেহীন ভাই একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘আমিও সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি এতোদিন।’

‘কিছু পেলেন?’

‘অনেক কিছু।’

‘যেমন?’

সালেহীন ভাই বড়বড় কয়েকটা টান দিয়ে সিগারেট শেষ করে কফির মগে চুমুক দিলেন। প্রায় অর্ধেকটা কফি শেষ করে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারটায় একটু গা এলিয়ে বসলেন। তারপর বললেন, ‘সাসেক্সের পশ্চিমে কডমুর হিল নামে একটা জায়গা আছে। নাম শুনেছো কখনও?’

‘না।’

‘সেখানকার একটা পুরনো হোস্টেলের ঘটনা। ১৯৬৮ সালের দিকে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে পুরনো একটা বিল্ডিং কিনে নিয়ে মেরামত করে ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। জায়গাটায় আগে ছোট একটা ছাপাখানা ছিলো। পুরানো বাড়ি নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়েই কোন না কোন গুজব থাকে। তবে এ বাড়িটার কোন গুজব ছিলে না। নতুন ছাত্ররা সেখানে উঠবার পরই নতুন করে ভূতের উপদ্রব শুরু হয়।

কি রকম উপদ্রব? সেটা জানতে হলে আগে ঘটনার সূত্রপাত জানতে হবে। হোস্টেলটা ছিলো চার তলা। তিন তলা পর্যন্ত ছাত্রদের ওঠার অধিকার ছিলো, চার তলায় না। কারণ অবশ্য ভৌতিক কিছু না। উপরতলার অবস্থা বিশেষ ভালো ছিলো না। ছাত্রদের চাপের কারণে মেরামত করার আর সময় পাওয়া যায়নি।

তো সেই স্কুলের বড় ক্লাশের কিছু ছেলে লুকিয়ে চারতলায় গিয়ে আড্ডা মারতো, বিড়ি সিগারেট ফুকতো, কার্ড খেলতো। একদিন মাঝরাতে জোসেফ নামের এক ছেলের উপর থেকে হৈ-হল্লার আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। সে ভাবে ওর বন্ধুরা সম্ভবত জমিয়ে আড্ডা মারছে সেখানে। মিনিট খানেক পর ওদের আড্ডার ঘরে ঢুকে দেখে জনা দশেক ছেলে ‘নিল-ডাউন’ হয়ে বসে আছে। এরকম অবস্থা দেখে সে একটু হতভম্ব হয়ে যায়। ওদের পরিচয় জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কোন উত্তর পাওয়া যায় না। জোসেফ ভাবে ওর বন্ধুরা হয়তো মজা করছে। তখন সে পকেট থেকে টর্চ জ্বালিয়ে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখতে পায়।

পর পর নয়জন ছাত্র ‘নিল-ডাউন’ হয়ে একটা সারিতে বসে আছে। মৃত মানুষদের মতন। কোন সাড়া শব্দ নেই। নড়াচড়া নেই। সবথেকে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে কারও চোখ নাক মুখ কিছু নেই। শুধু পরিষ্কার মসৃণ শাদা চামড়া।

এই দৃশ্য দেখে জোসেফ সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যায়নি। সে বেশ ধীরে সুস্থে সেখান থেকে নেমে আসে। পরদিন সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। এমন কিন্তু নয় ওই বাড়িতে কোন রকমের ঝামেলা ছিলো। সেই ছাপাখানার মালিক ত্রিশ বছর ওই বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়ে নির্বিঘ্নে সময় কাটিয়েছেন।

ঘটনার আসল টুইস্ট শুরু হয় এখান থেকে। তারপর থেকে প্রায় রাতেই কেউ না কেউ এই ধরণের দৃশ্য দেখে ভয় পাওয়া শুরু করলো। আজব ব্যাপার হচ্ছে জোসেফের সেই রাতের অভিজ্ঞতা সে কাউকেই জানানোর সুযোগ পায়নি। সকালে তাকে অচেতন অবস্থায় নিজের বেডে উদ্ধার করার পর পরই হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে সেদিনই তার পরিবার এসে নিয়ে যায় তাকে।

সেই মাসেই আরও নয়জন ওই অদ্ভুত মানুষগুলো দেখে ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে গেলো। মজার ব্যপার হচ্ছে ওই নয় জনই ছিলো জোসেফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরাই চারতলার সেই বিশেষ ঘরটায় নিয়মিত আড্ডা দিতো।

পুরো হোস্টেলে একটা আতংক ছড়িয়ে পড়লো। কোন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ছেলেরা এমন করছে এমন সন্দেহে জোসেফ সহ বাকি নয়জনকে প্রিন্সিপালের রুমে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। শেষে গুজবের অবসান ঘটাতে প্রিন্সিপাল সহ আরও তিনজন শিক্ষক রাতে ওই বিশেষ ঘরে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয় … এখন অনুমান করো কি হয়েছিলো তারপর?

‘কি?’ আমি কৌতূহলী কণ্ঠে জানতে চাইলাম।

‘পরদিনই সেই হোস্টেলের ছাত্রদের অন্যকোথাও সরিয়ে পুরো বিল্ডিং সীল গালা করে দেওয়া হয়। প্রিন্সিপাল সহ বাকি শিক্ষকেরা জানিয়েছিলেন সেখানে তাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিলো সেটা ব্যাখ্যার অতীত।

এটা সাসেক্সের অখ্যাত, কম জনপ্রিয় একটা ট্যুরিস্ট স্পট বর্তমানে। লোক সমাগম কোনসময়ই তেমন একটা হয় না। তবে সেখানকার বাসিন্দাদের মাঝে এই ঘটনাটা বেশ মুখরোচক। এখন বলো, সেখানে আসলে কি হয়েছিলো?’

‘অনেকটা আমার অভিজ্ঞতার মতন কিছু? একজনের গল্পে খুব বেশি প্রভাবিত হয়ে ভ্রমের মাঝে পরে যাওয়া?, আমি জানতে চাইলাম।

‘কিভাবে প্রভাবিত হবে? জোসেফ তো ওর অভিজ্ঞতা কাউকে জানানোর সুযোগই পায়নি!’

‘বেশ জটওয়ালা রহস্য দেখছি!,’ চিন্তিত কন্ঠে মন্তব্য করলাম।

সালেহীন ভাই আবার বলা শুরু করলেন, ‘এ ঘটনার পনেরো বছর পর প্যারাসাইকোলজির কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী এই ঘটনাটা নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে। সেই দশজন ছাত্রকে আবার একসাথে করে, খুঁটি নাটি অনেক ইনফরমেশন বিশ্লেষণ করে ঘটনার সম্ভাব্য ব্যাখ্যার বারোটা সম্ভাবনা বের করে। এর মাঝে সবথেকে গ্রহণযোগ্য যেটা ছিলো সেটা নিয়ে একটু কথা বলা যাক,’ সালেহীন ভাই একটু থেমে বাকি থাকা কফিটুকু এক চুমুকে শেষ করে বললেন, ‘বিনোরাল বিটের নাম শুনেছো?’

‘না।’

‘বিষয়টা একটু বিশদভাবে বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তোমাকে সংক্ষেপে বলছি। বিনোরাল বিট দিয়ে অডিটরি ইলিউশন তৈরি করা যায়। এখন বেশ জনপ্রিয় এটা। ইন্টারনেট ঘাটলে মারিউয়ানার অনুভূতি নেওয়ার ইলিউশন থেকে শুরু করে লুসিড ড্রিমিং এর বিনোরাল বিটও খুঁজে পাওয়া যায়। ধরো তোমার ডান কানে পাঁচশ বিশ হার্টর্যের একটা টোন শোনানো হচ্ছে আর বাম কানে পাঁচশ ত্রিশ হার্টয়ের। এই ছোট পার্থক্যটার কারণে তখন তোমার মস্তিস্কে দশ হার্টয়ের একটা অডিটরি ইলিউশন তৈরি হবে। ওটাকেই বিনোরাল বিট বলে ডাকা হয়।

আসলে গান শোনার সময় মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ এক রকম থাকে। আবার ঘুমানোর সময় আরেক রকম। খেলার সময় আরেক রকম। ভালোবাসার সময় আরও অন্যরকম। এই বিনোরাল বিটস দিয়ে এই তরঙ্গগুলো একটু পরিবর্তন করা যায়। তাই গাঁজা টানার পর ব্রেনওয়েভ কেমন থাকে সেটা বের করে বাইনোরাল বিট দিয়ে স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্কের ওয়েভ কিছুক্ষণের জন্য পাল্টে তাকে গাঁজার নেশার একটা অনুভুতি দেওয়া যাবে। পুরো জিনিসটাই হচ্ছে শব্দ-তরঙ্গ নিয়ে খেলা। এসব নিয়ে এখন অনেক গবেষণা হচ্ছে।

সেই ঘটনার পাঁচ বছর পর জোসেফের সিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়েছিলো। সাইকিয়াট্রিস্ট ওর সাথে কথা বলে বুঝতে পারে যে সে আসলে শৈশব থেকেই এই রোগে আক্রান্ত আর সেই উদ্ভট মুখের মানুষগুলো সে ছেলেকাল থেকেই দেখে ভয় পেয়ে আসছে, এবং দেখার পর অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

এখন কথা হচ্ছে ওর সার্কেলের সবাই কিভাবে একই জিনিস দেখে ভয় পেয়েছিলো? ওটা তো জোসেফের একান্তই নিজের হ্যালুসিনেশানের সমস্যা ছিলো। ও যদি সেটা কাউকে বলার সুযোগ পেতো তাহলে হয়তো দেখাটা স্বাভাবিক ছিলো। মানুষের মস্কিষ্ক বড় বিচিত্র। মানুষ যা চায়, মস্তিস্ক তাকে চোখের সামনে সেটাই দেখায়। কিন্তু এখানে তো এটাও হয়নি।

১৯৯৬ সালে মারিয়া গার্সিয়া নামের এক ব্রিটিশ প্রফেসর কনফারেন্সে একটা পেপার প্রেজেন্ট করার সময় একটা হাইপোথিসিস দিয়েছিলেন। যেটার সারমর্ম ছিলো মাঝে মাঝে মানসিক অসুস্থতা ছোঁয়াচে হতে পারে। কিন্তু সেটা কিভাবে?

বিনোরাল বিটসের মাধ্যমে যেভাবে মস্তিষ্কের তরঙ্গ পাল্টানো যায়, তেমনি যারা গল্প বলায় বেশ পারদর্শী, যারা গল্প দিয়ে মানুষের উপর বেশ প্রভাব ফেলতে পারে, মাঝে মাঝে বিচিত্র কারণে তাদের আশে পাশের মানুষের উপরও তাদের কথার একটা অন্যরকম প্রভাব পড়ে যায়। বেশির ভাগ বৰ্ণ স্টোরি টেলার কোন ভূতের গল্প বলার সময় নিজেও ভয়টা অনুভব করে। আর তার কথার টোনের ওঠা নামা দিয়ে কোন একভাবে তার নিজস্ব ভয়টা অবচেতন ভাবেই শ্রোতাদের ব্রেইন ওয়েভ পাল্টে দেয়।

জোসেফ ছিলো একজন অসাধারণ স্টোরিটেলার। বন্ধুদের আড্ডা সবসময় সে-ই জমিয়ে রাখতো। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত গল্পকথকেরা তাদের মস্তিস্কে বয়ে নিয়ে বেড়ানো বিচিত্র সেই তরঙ্গ গল্প করার সময় অবচেতন ভাবেই সুস্থ মানুষের তরঙ্গে প্রভাব ফেলে দেয়। জোসেফের গল্প প্রকৃতির অসংখ্য রহস্যের একটি হয়ে ওর বন্ধুদের সিজোফ্রেনিয়া রোগের সবথেকে পরিচিত উপসর্গ ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশনের সাময়িক পেশেন্ট বানিয়ে দিয়েছিলো। জোসেফসহ বাকি ন’জনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে মনের অজান্তেই প্রিন্সিপাল সহ আরও তিনজন শিক্ষক এই অদ্ভুত রোগটা নিজেদের মধ্যে নিয়ে নিয়েছিলেন কোন একভাবে।

প্রফেসর গার্সিয়া উপযুক্ত প্রমানের অভাবে সেটা ভালোভাবে প্রমাণ করতে পারেননি। মূল জিনিস বোঝাতে গিয়ে তিনি নিজেই অনেকটা এলোমেলো করে ফেলেছিলেন। বেশিরভাগ শ্রোতাই তখন এই বক্তব্যে কোনরকম পাত্তা দেয়নি। আমি যে একজন সিজোফ্রেনিয়াক, সেটা নিশ্চই এখন ভালো করে বুঝতে পারছো? এটা না বোঝার কিছু নেই। আমার মনে একটু সন্দেহ ছিলো। গত সপ্তায় ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি। আর আমি যে ভালো মানের একজন স্টোরি টেলার, সেটাও নিশ্চই এতোদিনে বুঝে নিতে কোন সমস্যা হয়নি তোমার।

এই ঘটনার তদন্তকারী ছাত্রদের মতে এই ছিলো গার্সিয়ান হাইপোথিসিসের সবথেকে বড় প্রমাণ। তবে তারা যদি আজ সৌধ ইবনে মুসা আর ইমতিয়াজ সালেহীনের এই ঘটনা জানতো, আমি শতভাগ নিশ্চিত যে এই হাইপোথিসিস প্রমাণ করতে আমাদের কাছে এসে ঘটনার বিবরণ আর খুঁটি নাটি জানতে চেয়ে জীবন অতিষ্ট করে ফেলতো।’

দীর্ঘসময় একটানা কথা বলে সালেহীন ভাই আরেকটা মালবরোতে আগুন নিয়ে মিনিট খানেক টানলেন। তারপর বললেন, ‘আসলে এমন না যে আমি ঘটনাটার কোন বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার জন্য মারা যাচ্ছি। আমি এতোটা ঘাটাঘাটি করেছি বলতে গেলে সেটা একান্তই তোমার জন্য। আমি কোনভাবেই চাচ্ছিলাম না যে তুমি আমার বাড়ির ছাদে ভূত দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়ে সারাজীবন একটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে থাকো। ঝড় বৃষ্টির রাতে বন্ধু-বান্ধবের কাছে রসিয়ে রসিয়ে জীবনের একমাত্র ভৌতিক ঘটনা হিসেবে এই অভিজ্ঞতাটা শোনাও।

আমরা আমাদের সৌরজগতের বাইরে এখনো যেতে পারিনি। পৃথিবীর মাঝে ঠায় ভেসে থাকা বিশাল সব সমুদ্র সম্পর্কে আমার জ্ঞান একেবারেই কম। সমুদ্রের প্রায় পঁচানব্বই ভাগ এখনো অনাবৃষ্ণিত। মানুষ হিসেবে যদি ষাট বছর বাঁচি কতোটাই বা আর জেনে যেতে পারবো?

এতসব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেবার পরও আমার আসলে ভাবতে ভালো লাগে যে শাহানা একটা বাচ্চা মেয়ে নিয়ে আমাকে দেখতে আসে। এই চেনাজানা জগতের সাথে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবার পরও অদ্ভুত একটা টানে সে কালে ভাদ্রে এখানে আসছে। আমার এই বিশ্বাস তো আর পৃথিবীকে কলুষিত করে ফেলছে না! আমার বিশ্বাস আমার কাছে সযত্নে থাকুক। আমি চাইবো, তুমি যাতে আমার ব্যাখ্যাটাকে বিশ্বাস করে পুরো ঘটনাটাকে অতিপ্রাকৃতের খাতা থেকে মুছে দাও। আমি আসলে দৃঢ় ভাবে এটাই বিশ্বাস করি। তবে প্রকৃতির বিচিত্র এক খেয়ালে আমার কাছে শাহানা সত্যি সত্যি আসে এটা বিশ্বাস করতেই বেশি ভালো লাগে। লাগুক। তাতে কার কি আসে যায়?’

সালেহীন ভাই কথাটুকু শেষ করেই উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি খুব ভালো কফি বানাও। আগে কখনও বলা হয়নি। আজ আসি। পরশু আমার ফ্লাইট। পিএইচডি করতে ট্রুম্যান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি। চাইলে সি অফ করতে এয়ারপোর্টে আসতে পারো।’

সালেহীন ভাই নিঃশব্দে লাইব্রেরী ত্যাগ করলেন। আমি তার পেছন পেছন গেইট পর্যন্ত গিয়েছিলাম সেদিন। রাত তখন প্রায় দেড়টা। কংক্রীটের রাস্তা ধরে সোডিয়ামের আলো গায়ে মাখিয়ে সুদর্শন একজন যুবক বাড়ি ফিরছে। মনে অদ্ভুত একটা বিশ্বাস নিয়ে, যে কেউ একজন তার সাথে অন্য একটা জগত থেকে দেখা করতে আসে। করুক তিনি বিশ্বাস। এটা তার অধিকার।

এই বিশ্বাসের জন্ম আমাদের চেনা-জানা পৃথিবীতে নেই। আছে অন্য কোথাও। অন্ধকারে। ঘনঘোর বর্ষায়।

*

এরপর ইমতিয়াজ সালেহীনের সাথে আমার আর কখনও যোগাযোগ হয়নি। তিনি দেশের বাইরে গিয়েছেন নাকি যাননি সে খবরও আর নেওয়া হয়নি। এর দু’সপ্তাহ পরই আমার স্কলারশিপ হয়ে যায়। একমাস পর মাস্টার্স শেষ করতে আমি রওনা হই ইউনিভার্সিটি অফ ডাবলিনের উদ্দেশ্যে।

ঘটনাটা হয়তো এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। একজন নিঃসঙ্গ ভদ্রলোকের একান্তই নিজস্ব একটা জগতের গল্প, যিনি বিশ্বাস করেন সেটাই সত্য, তবে বিজ্ঞানের মতে সেটা এক রকমের মানসিক ভারসাম্যহীনতা। তিনি থাকুক তার বিশ্বাস নিয়ে। যুক্তিবাদীরা থাকুক তাদের যুক্তি নিয়ে। সবকিছু নিয়েই এই পৃথিবী। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সবকিছুর প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা হলো না।

ডর্মেটরিতে ওঠার দেড় মাস পরের কথা। আমার রুমমেট ড্যানিয়েল অ্যালেন আমাকে একদিন গভীর রাতে ডেকে তুলে বললো, ‘আর ইউ ওকে?’

তখন আমি আসলেই ঠিক ছিলাম না। সেই রাতের ঘটনা তখনও স্বপ্নে কেন যন্ত্রণা দিয়ে বেড়াচ্ছিলো কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। সালেহীন ভাই এর সাথে শেষ দেখা হবার পর এই দুঃস্বপ্ন অনেকদিন বন্ধ ছিলো। ডর্মেটরিতে ওঠার বাইশদিনের মাথায় স্বপ্নটা আবার আমাকে জ্বালাতে শুরু করে। আর এর সাথে শুরু হয় আরেক নতুন উপসর্গ– স্লিপ প্যারালিসিস।

সেদিন ড্যানিয়েল ডেকে দেওয়াতে আমি বেঁচে যাই। ও বলেছিল আমি নাকি বিচিত্র এক ভাষায় বিড়বিড় করে ঘুমের মাঝে কিছু একটা বলছিলাম। আর সেটা শুনেই ওর ঘুম ভেঙে যায়।

অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে দুঃস্বপ্ন দেখবার ভয়ে আমি রাতের পর রাত জেগে থাকতাম। শুনতে একটু আজব শোনাতে পারে, কিন্তু স্বপ্নে মাঝে মধ্যেই শাহানা আর সালেহীন ভাইয়ের চেহারা দেখতে পেয়ে আমি আতংকে অস্থির হয়ে পড়তাম। বিষয়টা এমন নয় যে বিকৃত, ভয়ংকর কোন রূপ চোখে ভেসে উঠতো। সহজ, স্বাভাবিক দু’টো চেহারা। কিন্তু পৃথিবীর অজ্ঞাত একটা কদর্য সেখানে লুকিয়ে থাকতো।

স্বপ্নের মাঝেও আমি অন্ধকার একটা টানেলের মাঝে দিয়ে দৌড়াতাম। মনে হতো অনেকগুলো মানুষ আমাকে তাড়া করছে। আর পেছন থেকে কেউ বলছে– ওকে ধরো, যেভাবে পারো ওকে ধরো। ওকে আমার লাগবেই!

ওকে মেরে ফেলতে হবে। অল্পবয়েসি একটা ছেলেই আমার দরকার!

না ঘুমাতে ঘুমাতে চোখের নিচে কালি পরে শরীর, মুখ সব শুকিয়ে গেলো। দুই মাসে ওজন কমলো দশ কেজি। আমার অ্যাডভাইজার প্রফেসর হ্যাঁনলন একদিন আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, ‘ওহ ডিয়ার গড! তোমার এই অবস্থা কেন?’

তিনি আমাকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে সমস্যার কথা জানতে চাইলেন। আমি কোথা থেকে কি শুরু করবো কিছুই বুঝতে পারলাম না। শুধু বললাম আমার ঘুমে খুব সমস্যা হচ্ছে। একটা স্বপ্ন আমাকে ক্রমাগত যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। তিনি আমার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে তার এক বন্ধুর নাম ঠিকানা দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করতে বললেন।

পরদিন সন্ধ্যায় ক্লাশ শেষ করে একটা ট্যাক্সি ধরে সেই ঠিকানায় গিয়ে হাজির হলাম। ভদ্রলোকের নাম মাইক জোনস, হাসি খুশি প্রাণবন্ত একজন মানুষ। পেশায় সাইকোলজিস্ট।

অনেকটা সময় নিয়ে খোশগল্প করার পর তিনি আমার সমস্যাটার কথা জানতে চাইলেন। আমি ঘটনার শুরু-শেষ কিছুই না বলে স্বপ্নটার কথা বললাম। মাইক জোনস বললেন, এক রকমের জীবন যাত্রায় আমি মিইয়ে গিয়েছি। আর খুব সম্ভবত কোন একটা ট্রমায় আছি, যেখান থেকে আমি বের হতে পারছি না। তিনি বললেন, একটু সময় নিয়ে পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে। অসহনীয় কোন অভিজ্ঞতা যদি খুব যন্ত্রণা দিতে থাকে তবে সেটা কাছের কারও সাথে শেয়ার করলে মানসিক চাপ কমাতে খুব সাহায্য করে। তখন আমার তোর আর খসরুর কথা খুব মনে পড়েছিলো।

বিদেয় নেওয়ার সময় ভদ্রলোক আমাকে বললেন, আমি একটু বেশিই ইন্ট্রোভার্ট। আমার সমস্যাটা একেবারে দূর করতে হলে আমাকে সবকিছু খুলে বলতে হবে। তবে সেটা যে আজই বলতে হবে তা না। আমি সময় নিতে পারি।

জোনস বললেন পরের উইকএন্ডে আমি যাতে অবশ্যই তার বাড়িতে আসি। সেদিন কিছু ছাত্র-ছাত্রী বার্বিকিউ করবে এখানে। গান-বাজনা, খাওয়া দাওয়া হবে। সময়টা উপভোগ করতে পারলে আমার স্ট্রেস কিছুটা কমবে।

একগাদা অপরিচিত ছেলেমেয়ের মাঝে একা যাওয়া যায় না কোনভাবেই। আমি সাথে ড্যানিয়েলকে নিয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কি, সময়টা আসলেই খুব ভালো কাটলো।

খাওয়া দাওয়ার মাঝখানে প্রফেসর হ্যাঁনলন এসে উপস্থিত হলেন বন্ধুর সাথে দেখা করতে। গান-বাজনা বেশ জমে উঠলো এরপর। মাইক জোনসের গানের গলা খুবই চমৎকার। সাইমন এন্ড গারফাঙ্কলের সাউন্ড অফ সাইলেন্স গেয়ে পার্টি জমিয়ে দিলেন তিনি।

রাতটা আরেকটু বাড়ার পর শুরু হলো ভূতের গল্পের আসর। শার্লট নামের একটা মেয়ে বলা শুরু করলো প্রথমে। ওর বাবা কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে বন্ধুদের সাথে অ্যাডভেঞ্চারের লোভে একটা পরিত্যাক্ত পাগলা গারদে রাত কাটাতে গিয়েছিলেন। প্রথমে স্বাভাবিকভাবে গল্প এগোলেও শেষের দিকে এসে সবাই ভয় পেলাম।

তারপর শুরু করলো ড্যানিয়েল। ড্যানিয়েলের গল্প শেষ হবার পরই হ্যাঁনলন আমাকে একটা গল্প বলতে অনুরোধ করলেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে আমি আমার জীবনের একমাত্র ভৌতিক অভিজ্ঞতাটা বলতে শুরু করলাম। এর মাঝে জোনস সাহেব তিনবার ফায়ারপ্লেসের আগুন উস্কে দিয়েছেন। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম সবাই বেশ মনযোগ দিয়ে আমার ঘটনাটা শুনছে। একটানা প্রায় দেড়ঘন্টা বলার পর আমার গল্প শেষ হলো। মাইক জোনস আমাকে বললেন, ‘এখন কেমন লাগছে?’

‘খুব ভালো!,’ আমি প্রাণবন্ত উত্তর দিয়েছিলাম।

আমার ঘটনাটা যে আসলেই সবাইকে একটু হলেও ভয় পাইয়েছে সেটা বুঝলাম বাড়ি থেকে বের হয়ে। শার্লট আমাকে এসে বললো, আমাকে ডর্মে নামিয়ে দিতে পারবে? তোমার গল্প শোনার পর আমি একা ফিরতে সাহস পাচ্ছি না।’

আমি আর ড্যানিয়েল শার্লটকে এগিয়ে দিয়ে আসলাম। ঘুমাবার আগে ড্যানিয়েল আমাকে বললো, ‘তুমি বানিয়ে বানিয়ে অসাধারণ গল্প বলতে পারো।’

‘আমি বানিয়ে কোন গল্প বলিনি, ড্যানিয়েল,’ একটু রাগ হলো আমার।

ড্যানি আমার রিডিং টেবিলের উপর একটা পেপারব্যাক বই রেখে বললো, ‘তোমার গল্প বলার ধরণটা আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। সময়টা খুবই উপভোগ করেছি। বইটা তোমার জন্য একটা গিফট। সময় পেলে পড়ে দেখো।’

শালা! বলে একটা গালি দিয়ে কম্বলটা টেনে নিয়ে বহুদিন পর একটা আরামের ঘুম দিলাম। কোনরকমের স্বপ্ন-ছাড়া, গভীর একটা ঘুম। পরদিন সকালে ঝরঝরে শরীর নিয়ে ক্লাশ করতে গেলাম।

আস্তে আস্তে ড্যানিয়েল, শার্লটের সাথে বন্ধুত্বটা গম্ভীর হতে লাগলো। ওদের সাথে প্রতিদিনই এখানে সেখানে ঘুরতে যাওয়া শুরু করলাম। সন্ধ্যায় ডর্মে ফিরেই টেবিল টেনিস খেলতে দাঁড়িয়ে যেতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির অবস্থাও ছিলো রাজকীয়। সত্যি বলতে জীবনটাকে খুব উপভোগ করা শুরু করেছিলাম সেই সময়টাতে। পরের তিনটা বছর আমার খুব ভালো কাটলো।

দেশে ফেরার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি স্বপ্নটা আর কখনওই দেখিনি।

ওই যে বলেছিলাম, ঘটনাটা ওখানে শেষ হলে খুব ভালো হতো। কিন্তু হয়নি। এখানে শেষ হলেও কিন্তু একেবারে মন্দ হতো না। ঘটনা একেবারে নতুন একটা মোড় নিলো আমি দেশে ফেরার পর।

দেশে ফিরেছি মাত্র দু’দিন হয়েছে তখন। খুব ফুরফুরে মেজাজে আছি। স্কুলের কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা করতে বাসাবো যাচ্ছি রিকশাতে করে। মাঝপথে আমার মনে পড়লো আমি রাতে সেই স্বপ্নটা আবার দেখেছি। তিন বছর পর আমার কানের কাছে আবার বাজতে থাকলো খুব পরিচিত দু’টো লাইন।

ওকে ধরো, যেভাবে পারো ওকে ধরো। ওকে আমার লাগবেই!

ওকে মেরে ফেলতে হবে। অল্পবয়েসি একটা ছেলেই আমার দরকার!

আমি কান চেপে ধরলাম। কোন লাভ হলো না। আমি কোনভাবেই স্বপ্নটাকে আর দেখতে চাইছিলাম না … ভয়ে আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনে হলো আমি এতোদিন ঘুমিয়ে ছিলাম। তিন বছর পর আবার আমার ঘুম ভেঙেছে।

স্বপ্নের মাঝে এখন আবার আমাকে তাড়া করে বেড়ানো হবে।

আট

আমি বখতিয়ার উদ্দিন খসরু। সৌধ ইবনে মুসা’র ভেঙে যাওয়া ব্যান্ডের ড্রামার এবং লিরিসিস্ট। তবে এই মুহূর্তে আমার সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ পরিচয় হচ্ছে, আমি ওর খুব কাছের একজন বন্ধু।

আমি, রাদিফ আর সৌধ এসে বারান্দায় বসেছি প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো হবে। এর মাঝে এক ফ্লাক্স চা আর বারোটা মার্লবরো পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু তিন জনের মাঝে কোন ক্লান্তি নেই। সৌধ’র বলে যাওয়া ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে ও রহস্যগল্প থেকে উঠে আসা একটা চরিত্র। ঘটনাচক্রে আমি রাদিফও সেই বই এর একটা অংশ হয়ে গিয়েছি।

সৌধ খানিকটা বিরতি নিয়ে আবার বলা শুরু করলো, ‘আমি বাড়িতে ফিরে এসেই কেমন একটা অযাচিত আতংক অনুভব করা শুরু করলাম। মনে হতে থাকলো ভয়ংকর অশুভ একটা অনুভূতি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। একটা তীব্র অস্বস্তি সবসময় আমার শরীরের সাথে লেপ্টে থাকতো। আমি স্পষ্টতই বুঝতে পারছিলাম আর সময় নষ্ট না করে সাইকিয়াট্রিস্ট এর সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। ইন্টারনেট ঘেটে যা দেখলাম সেটা আমার জন্য আরও অস্বস্তিকর। বেশির ভাগ উপসর্গের সাথেই সিজোফ্রেনিয়া রোগটা খুব ভালো ভাবে মিলে যাচ্ছিলো।

নিজেকে বোঝাতে থাকলাম, আমার এই রোগ হওয়া কোনভাবেই সম্ভব না। একটা উদ্ভট গল্প শুনে জটিল একটা মানসিক রোগ কোনভাবেই হতে পারে না। গার্সিয়ান হাইপোথিসিস একটা গাঁজাখুরি জিনিস!

কিন্তু যতদিন কাটতে লাগলো আমার মনে হতে থাকলো গাঁজাখুরি না, গার্সিয়া ম্যাডাম চা কফি খেয়েই এসব বলেছিলেন এবং সেটার বাস্তব প্রতিফলন হচ্ছি আমি। ইমতিয়াজ সালেহীন নামের এক সিজোফ্রেনিয়াক স্টোরি টেলারের প্রভাব আমাকে আসলেই মানসিক রোগী বানিয়ে দিচ্ছে!

সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাওয়ার আগে নিজেকে ঠিক করার একটা শেষ চেষ্টা করতে চাইলাম। চৌদ্দদিন পর রওনা হলাম দাদাবাড়ির উদ্দেশ্যে। বহুবছর সেখানে যাওয়া হয় না। যদিও ছোটবেলায় প্রত্যেক ঈদেই সেখানে যাওয়া হতো। কাজিনদের সাথে মিলে নিত্য নতুন বাঁদরামি আবিষ্কার করে সেগুলো বড়দের উপর প্রয়োগ করা হতো। সেখানে কিছুদিন সময় কাটালে আমার অবস্থার একটু উন্নতি হতে পারে, এটাই ছিলো সেখানে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য।

অনেকদিন পর রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর সাথে দেখা হয়ে খুবই ভালো লাগলো। এতোগুলো বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে সবকিছুর। গ্রামেও শহরের আধুনিকতার ছোঁয়া। সেখানেও একটা যান্ত্রিক ভাব এসে পড়েছে। তবে আমাদের গ্রামটা একটু ভেতরের দিকে হওয়ায় প্রকৃতির প্রাগৈতিহাসিক নিস্তব্ধতাটা সেখানে এখনও বেঁচে আছে।

গ্রামে যাওয়ার দু’দিন পর আমার ছোট চাচা রুদ্র এসে হাজির। মানুষ হিসেবে তিনি খুবই মজার। হাসাতে হাসাতে মানুষ মেরে ফেলার একেবারে আক্ষরিক ক্ষমতা নিয়েই তিনি জন্মেছেন। উনি অবশ্য প্রায়ই এখানে আসেন। আমাদের বাড়ির সামনের বাঁশবাগানের ভেতর উনি একটা ট্রি-হাউজ বানিয়েছেন। সেখানে তিনি পড়াশোনা করেন আর টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখেন। একেবারে ছবির মত সুন্দর ট্রি-হাউজটা।

আমি সেখানে সময় কাটানো শুরু করলাম। ভালোই যাচ্ছিলো সবকিছু। সমস্যাটাও আস্তে আস্তে কমতে শুরু করলো। রাতে ঘাসের উপর শুয়ে তারা দেখতাম, ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ শুনতাম, শেয়ালের ডাক শুনতাম, কপাল ভালো থাকলে মাঝে মধ্যে খাটাশের আওয়াজও শুনতাম। সেটা একেবারে কলজে কাঁপানো। চাচা আমাকে খাটাশের ডাক না চিনিয়ে দিলে আমি সারাজীবন ভাবতাম গ্রামে গিয়ে আমি ভূতের হাসি শুনে এসেছি।

ঢাকা থেকে অনেক বই নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। ট্রি-হাউজে বসে একটা একটা করে শেষ করছিলাম। সে রাতে ছোটচাচা সেখানে ছিলেন না। সদরে গিয়েছিলেন কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারতে। গ্রামের রাত সাড়ে নয়টার সম্পর্কে নিশ্চই ধারণা আছে তোদের? একেবারে নিশুতি রাত ধরতে গেলে।

ওই সময় আমি ড্যানিয়েলের দেওয়া পেপারব্যাক বইটা হারিকেনের আলোয় পড়া শুরু করলাম। রাশিয়ান লেখক আদ্রিয়ান পেতরোভের উপন্যাসিকা দ্য ম্যান হু লাভস ডার্কনেস। ইংরেজিতে অনুবাদ করা। বইটা পড়া শেষ করে আমি বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলাম। তোদের মনে আছে মাইক জোনসের বাড়িতে ওই রাতের ঘটনাটা বলার পর ড্যানিয়েল আমাকে কি বলেছিলো?’

‘হ্যাঁ,’ আমি উত্তর দিলাম, ‘বলেছিলো তুই বানিয়ে খুব সুন্দর গল্প বলতে পারিস।’

‘ড্যানিয়েলের কথাটা আসলে সত্য ছিলো,’ সৌধ নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো।

‘মানে,’ রাদিফ অবাক হলো, ‘বুঝলাম না বিষয়টা!’

‘আমার ঘটনাটা আসলে একটা বানোয়াট ঘটনা,’ সৌধ কেমন রহস্যময় কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘…আর যেহেতু আমি ঘটনাটা শুনেছি ইমতিয়াজ সালেহীনের কাছ থেকে, তার মানে তিনি আমাকে সেদিন একটা বানোয়াট গল্প শুনিয়েছিলেন।’

আমি আর রাদিফ হতভম্ব হয়ে কয়েকটা মুহূর্ত বসে থাকলাম। রাদিফ হঠাৎ করে বলে উঠলো, ‘এই কি বলছিস ভালো করে বল দেখি! কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না!’

‘সালেহীন সাহেবের শৈশবের ঘটনা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ট্র্যাজেডি, শাহানা, শাহানা আর তার মেয়ের মৃত্যু, ছাদের বাগানের রহস্য, তার সাইনবোর্ড, ছাদে আমার ভয় পাওয়া এবং লাইব্রেরিতে এসে দেওয়া ব্যাখ্যা– সবকিছুই হচ্ছে বানোয়াট। এসব ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত দ্য ম্যান হু লাভস ডার্কনেস বইটার ঘটনা। সামান্য একটু প্রেক্ষাপট, নিজের জীবনের হালকা মিশেল আর চরিত্রের নাম রদবদল করে তিনি পুরোটা গল্প আমার উপর মেরে দিয়েছেন। স্বীকার করতে হবে যে খুব কারুকার্য করে তিনি জিনিসটা কপি পেস্ট করেছেন।’

আমি আর রাদিফ আবার হতভম্ব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। আমি শুকনো স্বরে মিনমিন করে বললাম, ‘ঘটনাটা বেশ বড় রকমের কোন কাকতাল নাতো?’

‘না না …’ সৌধ প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠলো, ‘তুই পুরো ঘটনাকে একটা ইউনিটে কেন চিন্তা করছিস? ঘটনাটা বেশ ছড়ানো। আর প্রতিটা পয়েন্ট পুরো একটা বই এর সাথে কখনই মিলতে পারে না। এতো বড় কাকতাল কখনওই ঘটা সম্ভব না।’

‘তাহলে তো ব্যাপারটা ভয়ংকর!,’ রাদিফ আঁতকে উঠে বললো, ‘তার মানে তিনি একটা গল্পকে পুরোপুরি নিজের জীবনে রিক্রিয়েট করেছেন! তিনি তো ভয়াবহ রকমের অসুস্থ!’

‘তিনি পুরোপুরি নিজেকে একটা বই এর চরিত্রের মতন সাজিয়েছেন। এবং সেই অনুযায়ী কাজও করছেন,’ সৌধ বললো, ‘হতে পারে এটা এক রকমের পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার …’

‘হতে পারে মানে!,’ রাদিফ সৌধকে থামালো, ‘এটা অবশ্যই মাল্টিপাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার! ইমতিয়াজ সালেহীন নিজেই তো তোকে বলেছেন তিনি একজন সিজোফ্রেনিয়াক। যেটা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর ক্ষেত্র ভুল করা স্বাভবিক। তার ঘটনা শুনলে যে কেউ তাকে তাই ভাববে। কিন্তু তারা তো আর প্রথমেই বুঝতে পারবে না যে তিনি নিজেকে একটা বই এর ক্যারেকটার ভাবছেন!

‘আচ্ছা, ওই বইতেও কি কেন্দ্রীয় চরিত্রের সিজোফ্রেনিয়া থাকে?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘কি বললাম আমি এতক্ষণ! সবকিছু মেলে তার সাথে। কন্ট্রোল সি প্লাস ভি!’

‘ওখানেও কি ছাদে কেউ একজন এই গল্প শোনার পর ভয় পায়?,’ আমি আবার প্রশ্ন করলাম।

‘হ্যাঁ,’ সৌধ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো, ‘আমার মতই ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।’

‘আচ্ছা বোঝা গেলো যে ভদ্রলোক মাল্টিপাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের রোগী। নিজেকে তিনি একটা বই এর চরিত্র ভাবছেন আর পুরো গল্পটা নিজের জীবনে রিক্রিয়েট করছেন। কিন্তু তোকে ভয়টা পাওয়ালো কিভাবে তাহলে?,’ আমি প্রশ্ন করলাম।

সৌধ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, ‘এই জায়গাটাতে এখনো একটু কুয়াশা আছে। ঠিক পরিষ্কার না। সত্যি সত্যি গার্সিয়ান হাইপোথিসিস নাতো?’

‘হতে পারে,’ রাদিফ উত্তর দিলো, ‘মানুষের মন অনেক বিচিত্র। মস্তিস্কের কতকিছুই তো অজানা এখনও। কোনভাবে কি তিনি ক্যারেকটারের দোষ-গুনগুলোও নিজের মাঝে নিয়ে এসেছেন?’

‘এটা বিচিত্র কিছু না কিন্তু,’ আমি বললাম, ‘কয়েকটা কেস স্টাডি পড়েছিলাম এই বিষয়ের উপর। সেখানে পার্সোনালিটি সুইচ করে জীবনে কোনদিন গাড়ির স্টিয়ারিং না ধরা মানুষ গাড়ি চালিয়ে মাইলের পর মাইল চলে গিয়েছে। কারও কারও ক্ষেত্রে ঘটনা আরও অদ্ভুত। ইন্দোনেশিয়ার একটা মেয়ে নাকি পার্সোনালিটি সুইচ করলে অনর্গল স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে পারতো, যে জীবদ্দশায় কখনই সেই ভাষার ধারে কাছেও ছিলো না।’

আমরা তিনজনই বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করলাম। আমি পর পর দু’টা সিগারেট শেষ করলাম। ফ্লাক্সের তলানীতে একটু চা ছিলো, সেটাও অনেক সময় নিয়ে শেষ করলাম। তারপর দীর্ঘক্ষণের নীরবতা ভেঙে রাদিফ বললো, ‘আচ্ছা সৌধ, তোর কি মনে হয় সালেহীন সাহেব আসলেই অসুস্থ?’

‘অবশ্যই, কোন সন্দেহ নেই।’

‘বইটাতে ভয় পাওয়া ছেলেটার বয়স কত থাকে?

‘তেইশ। সে সময় আমার বয়সও এরকমই ছিলো।’

‘গল্প শুনে ভয় পাওয়ার পর ওর মাথায় কি ওকে ধরে মেরে ফেলতে হবে এমন কোন বাক্য ঘুরপাক খেতো?’

সৌধ একটু নড়েচড়ে বসে বললো, ‘না। এ জায়গাতে একটু অমিল আছে।’

‘এটার কোন ব্যাখ্যা কি তোর কাছে আছে?’

‘ভীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে সেখান থেকে সরিয়ে আনার জন্য মস্তিষ্ক অনেক বিচিত্র কিছু কাজ করে। Fear is good, it tells you where the edge is– একটা বইতে এমন একটা লাইন পড়েছিলাম। আসলে সিক্সথ সেন্স এর অনেকগুলো বিষয়ের ট্রিগার পয়েন্ট হিসেবে ভয় জিনিসটা খুব কাজে দেয়। হয়তো ওখান থেকে সরিয়ে আনার জন্য মস্তিস্ক অমন একটা ভ্রম তৈরি করেছিলো।’

‘যুক্তিসঙ্গ ব্যাখ্যা,’ রাদিফ উত্তর দিলো।

‘আচ্ছা এমন কি হতে পারে না,’ আমি বলে উঠলাম, ‘যে সালেহীন সাহেব সুস্থ একজন মানুষ?’

সৌধ ভ্রু কুঁচকে খসরুর দিকে তাকালো, ‘মানে?’

‘ধর, তিনি আসলে সুস্থ। সাবকনসাশলি না, কনসাশলি তিনি একটা গল্প নিজের জীবনে রিক্রিয়েট করেছেন … আর তোকে পুরো গল্পটা নিজের বলে চালিয়ে শোনানোর পেছনেও হয়তো অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে।’

সৌধ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘হতে পারে। আমি এমন একটা শকে আছি –আমাকে যদি এখন কেউ এসে বলে সালেহীন জুপিটারের উপগ্রহ থেকে আসা একজন এলিয়েন, মানুষের উপরে এক্সপেরিমেন্ট করছেন, আমিও সেটাকেও একটা বিশ্বাসযোগ্য সম্ভাবনা হিসেবে নেবো।’

‘আচ্ছা গল্পের বইটাতে ঘটনার শুরু কি কোন লাইব্রেরি থেকে হয়?,’ রাদিফ প্রশ্ন করলো।

‘না। ওই এলাকায় একটা ছেলে নতুন এসে বাড়ির সামনে এরকম একটা অদ্ভুত সাইনবোর্ড দেখে। তারপর কৌতূহলবশত সেখানে যায়। ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়, তারপর সখ্যতা, বন্ধুত্ব– প্রায় পুরোটাই আমার ঘটনার মতো।’

‘গল্পে কি ছেলেটা কোন ছবি খুঁজে পায়?’

‘না। এখানেও অমিল আছে।’

‘এখানে দু’টো জিনিস হতে পারে। হয় ইমতিয়াজ সালেহীন বাড়ির সামনে সাইনবোর্ডটা সচেতন ভাবে টানিয়ে সেই গল্পটা নিজের জীবনে রিক্রিয়েট করতে কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ভেবেছিলেন অনেক সাড়া পাবেন। কিন্তু তার কেয়ারটেকারের মতে তিনি খুব একটা সাড়া পাননি। তাই তোর বয়েসী একজনকে পেয়ে গল্প রিক্রিয়েট করার একেবারে উপযুক্ত একটা চরিত্র পেয়ে যান তিনি। তাই তোকে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়েছিলেন … আর এটা না হলে,’ বলে রাদিফ চুপ হয়ে গেলো। ওকে বেশ চিন্তিত দেখালো।

‘কি?,’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘না হলে কি?’

‘তিনি আসলে অসুস্থ না। অন্য কোন উদ্দেশ্যে তিনি পুরো কাজটা করেছেন’ রাদিফ বললো।

‘তুই শিওর?,’ সৌধ জানতে চাইলো।

‘শতভাগ না। তবে সম্ভাবনা তো আছে অবশ্যই। আচ্ছা, গল্পে কি পত্রিকায় কোন বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিলো?’

‘না।’

‘শালা! তুই যে বললি পুরোটা কপি পেস্ট। এখানে বসে থাকতে থাকতেই তো তিন-চারটা অমিল বেরিয়ে পড়লো,’ আমি সৌধের দিকে তাকিয়ে বললাম।

‘একটু আধটু এদিক সেদিক তো হতেই পারে শালা!।’

‘তারমানে,’ আমি উঠে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। পরপর তিন-চারটা টান নিয়ে বললাম, ‘এখন আমাদের হাতে তিনটা সম্ভাবনা আছে, এক– এটা একটা কাকতাল মাত্র, দুই– সালেহীন সাহেব মানসিক ভাবে অসুস্থ, তিন তিনি কাজগুলো অন্যকোনো উদ্দেশ্যে করেছেন।’

‘ঠিক,’ রাদিফ বললো, ‘সৌধ, তোর কি মনে হয়? কি হতে পারে পুরো ঘটনাটা?’

দুই নাম্বারটাই হয়তো সত্য হবে। এর পেছনে আর এমন কি উদ্দেশ্যই বা থাকবে!’

রাদিফকে চিন্তিত দেখালো, ‘ঘটনাটা কিন্তু বেশ জমে গিয়েছে। কোথাও একটা বড়সড় ঘাপলা আছে। আমি সালেহীন সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর নিতে চাই।’

‘আমিও সেটাই চাই,’ সৌধ বললো, ‘কাকতালীয় যদি না হয়, তাহলে আমি তার আসল ঘটনাটা জানতে চাই। ‘

‘তাহলে আমরা কোথা থেকে শুরু করছি?,’ আমি প্রশ্ন করলাম।

সৌধ হেসে বললো, ‘তোর কি মনে হয়, কোথা থেকে শুরু করা উচিত?’

‘প্রথমে,’ বেশ ভাবের সাথে বলা শুরু করলাম, ‘আমার কোন জানি তিন নাম্বার সম্ভাবনাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। দেখো, গল্পটা তোকে বলার সময় উনি বেশ কিছু নাম বলেছেন তোকে। কিছু বানিয়ে বলা বা লেখার সময় সাধারনত আশপাশের মানুষ থেকেই নাম নেওয়া হয়। যদিও এর ব্যতিক্রম থাকাটা বিচিত্র কিছু না। তবে, আমার মনে হয় এখন আমাদের সালেহীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া উচিত। সেখানে তোর মনসুর ভাই আছে, খোঁজ নেওয়া সহজ হবে। তাকে গিয়ে শাহানা, সৈমোর, রহমান আলী– এই নামগুলো জিজ্ঞেস করতে হবে। যেহেতু তার ছাত্র ছিলো, কিছু না কিছু তো অবশ্যই বলতে পারবেন।‘

‘তোর মাথাটা খুব পরিষ্কার ভাই!,’ সৌধ উচ্ছাসিত কণ্ঠে বললো, ‘এখন একটু ঘুমানোর জায়গা দে। নাহলে এখানেই অজ্ঞান হয়ে পরবো। পরে চ্যাঙদোলা করে কোলে তুলে নিয়ে যেতে হবে আমাকে।’

অনেকদিন পর আমরা তিন বন্ধু বারান্দা কাঁপিয়ে হেসে উঠলাম একসাথে।

নয়

আমি সৌধ ইবনে মুসা। নিজের ভেঙে যাওয়া ব্যান্ডের ভোকাল এবং বেজিস্ট। রাদিফ আর খসরুর খুব কাছের একজন বন্ধু। এর বাইরে পরিচয় দেওয়ার মতন আপাতত কিছু মাথায় আসছে না।

আজ সকালে ঘুম থেকে দশটার সময় উঠে বহুদিন পর তিনজন একসাথে চা-নাস্তা খেয়েছি। হাসাহাসি করেছি। ভেবেছিলাম ওদের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত একটা উপদ্রব হাজির করানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করবো। করেছিলামও। বিনিময়ে বাংলা গালির অভিধানে সংযুক্ত করার মতো নতুন কিছু গালি খেয়েছি। ওরা দু’জন উল্টো ওদের জীবনে একটু ভিন্নতা এনে দেবার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া শুরু করলো। কাজ করতে করতে নাকি ওরা মড়ার মতন বিরক্ত হয়ে থাকে সারাদিন। বাঁচতে হলে অবশ্য মাঝে মধ্যে নতুনত্বের প্রয়োজন আছে।

মনসুর ভাইয়ের কাছে যাওয়ার আগে ইমতিয়াজ সালেহীনের একটা খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। রাদিফকে দিয়ে তার বাড়িতে ফোন দেওয়ালাম। ফোন ধরলো রবি। সে জানালো সালেহীন দেশেই আছেন। কিন্তু কোথায় আছে সেটা বলতে পারলো না। মাসখানেক ধরেই নাকি তিনি ঢাকার বাইরে। যোগাযোগ করার কোন নম্বরও সে দিতে পারলো না।

খসরুর বাবার পুঁজিবাদি গাড়িতে করে আমরা মনসুর ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যখন সেখানে পৌঁছালাম, তিনি তখন ক্লাশে। রাদিফ আর খসরুকে গাড়িতে রেখে আমি তার অফিস রুমে এসে বসলাম। আধঘন্টা বসে থাকার পর মনসুর ভাই ভেতরে এলেন।

‘আরে সৌধ তুমি! তুমি দেশে এসেছো কবে?’

‘তিন মাস হয়েছে,’ আমি আন্তরিক ভাবে উত্তর দিলাম, ‘কেমন আছেন আপনি?’

‘আছি তো ভালোই। তোমার খবর বলো। আসার খবরটাও তো জানালে না আমাকে।’

‘মনসুর ভাই, আসলে আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। তাই আপনাকে কোনকিছু জানাতে পারিনি।’

‘কি রকম সমস্যা?,’ মনসুর ভাই ভ্রু কুঁচকালেন।

‘সেরকম বড় কিছু না,’ আমি বললাম, ‘তবে সেটা অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে। আবার অন্য পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে চিন্তা করলে অনেক বড় রকমের সমস্যাও হতে পারে।’

‘সৌধ!,’ মনসুর ভাই শাসন করার সুরে বললেন, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলবে না। একদম ঝেড়ে কাশো।’

‘পুরো সমস্যাটা ব্যাখ্যা করতে আমার অনেক সময় লাগবে। আপনি কি আজ ফ্রি আছেন?’

‘আজকে আমার আর ক্লাশ নেই,’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আর কাল পরশু তো সাপ্তাহিক ছুটি।’

‘জোশ!,’ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলাম আমি, ‘শার্লক হোমস পড়তে আপনার কেমন লাগতো?,’

‘সবসময়ই ভালো লাগতো, হালকা হাসলেন তিনি, ‘ছোটবেলায় তো আমি শার্লক হবার স্বপ্নও দেখতাম।’

‘এখন যদি আপনাকে শার্লকগিরি করার সুযোগ দেওয়া হয়। করবেন?’

কয়েকটা সেকেন্ড শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন তিনি, ‘কি বলতে চাইছো তুমি?’

‘মনসুর ভাই, এখন এতোকিছু বুঝিয়ে বলার সময় নেই। করবেন নাকি বলুন। আমি অনেক বড় একটা রহস্যের সমাধান করছি।’

মনসুর ভাই বেশ খানিকটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ইন্টারেস্টিং ঘটনা মনেহচ্ছে। হ্যাঁ, সুযোগ পেলে তো অবশ্যই করবো!

‘থ্যাংকস। আপনি সত্যিই খুব উপভোগ করবেন কাজটা। এখন আমাকে কয়েকটা ইনফরমেশন দিয়ে সাহায্য করুন।’

‘ইনফরমেশন? কিসের ইনফরমেশন?’

‘ইমতিয়াজ সালেহীন সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন?’

মনসুর ভাই একটু অবাক হলেন। বললেন, ‘খুব বেশি একটা না। কি হয়েছে?’

‘আপনাকে পরে সব বুঝিয়ে বলছি। আপনি দয়া করে কতটুকু জানেন আমাকে একটু বিস্তারিত বলুন।’

‘তেমন কিছু একটা না। শুধু জানি মেডিকেলে তিন বছর পড়াশোনা করে এখানে এসে আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছিলো।’

‘আর কিছুই না?’

‘এর বাইরে নিজের সম্পর্কে আর তেমন কিছুই বলেনি আমাকে ও

‘তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের নাম বলতে পারবেন? মানে কাদের সাথে চলা-ফেরা করতো, বা থাকতো?’

‘আসলে অনেক আগের কথা তো … খুব একটা মনে পড়ছে না।’

‘সৈমোর, শাহানা– এই নামে কোন বন্ধু ছিলো সালেহীন সাহেবের?’

‘সৈমোর শাহানা …’ মনসুর ভাই বিড়বিড় করলেন, আরে হ্যাঁ! সৈমোরকে কেন চিনবো না। ও তো এখানেই পড়ায় এখন।

‘ভাত না চাইতেই কাচ্চি!,’ আমি বললাম, ‘সৈমোর সাহেবকে কোথায় পাওয়া যাবে?’

‘ওরও তো ক্লাশ শেষ হয়ে যাবার কথা। আচ্ছা দাঁড়াও! বাই এনি চান্স, শাহানার কেসটা কি আবার ওপেন হয়েছে?’

‘শাহানার কেস?,’ আমি অবাক হলাম, ‘শাহানার আবার কিসের কেস? মানে শাহানা নামে কেউ আসলেই আছে?’

‘অদ্ভুত কথা! থাকবে না কেন? কি বলছো এসব?,’ মনসুর ভাই এবার অবাক হলেন, ‘ইমতিয়াজকে নিয়ে এতো কৌতূহল দেখে তো ভাবলাম তুমি বোধহয় শাহানার নিখোঁজের ঘটনাটা নিয়ে কিছু করতে চাচ্ছো। আবার বললে শার্লকগিরি করবো নাকি … ‘

‘মানে শাহানা নামে কেউ একজন আসলেই ছিলো! আর তিনি নিখোঁজ হয়েছেন? কবে?’

মনসুর ভাই এবার আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, ‘সৌধ, কি হয়েছে বলতো আমাকে। অসংলগ্ন কথা বলছো কোন? ‘

‘আ-আমি দুঃখিত সালেহীন ভাই। একটা বিষয় চিন্তা করে কুলকিনারা পাচ্ছি না বলে মাথাটা ঠিক কাজ করছেনা। আপনাকে আজই সব খুলে বলবো। প্রমিস! তার আগে আমাকে বলুন শাহানা কবে নিখোঁজ হয়েছে?’

‘তাও প্রায় দশ বছর তো হবেই।’

‘আপনি কি আমাকে বিস্তারিত বলতে পারবেন পুরো ঘটনাটা?’

‘বিস্তারিত ঘটনা আমি আসলে নিজেও পুরোটা জানি না, মনসুর ভাই জানালেন, ‘তবে সৈমোর হয়তো বলতে পারবে। তুমি ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে একটু স্থির হও। আমি সৈমোরকে নিয়ে ওখানে আসছি।’

আমি অনুরোধের সুরে বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন, আপনি আর সৈমোর সাহেব কি আমার সাথে বাইরে কোথাও বসতে পারবেন? আমি আপনাদের দু’জনকেই আবার যার যার বাড়িতে ড্রপ করে দেবো।’

মনসুর ভাই আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সৈমোরের আজ ছুটির পর আমার সাথে লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথা। চলো, ওখানেই নাহয় বসা যাবে।’

*

আমি, রাদিফ, খসরু, সৈমোর সাহেব এবং মনসুর ভাই ক্যাফে বুকওঅর্ম এর বড় একটা রিডিং টেবিল দখল করে গোল হয়ে বসে আছি।

‘আচ্ছা ঘটনাটা কি?,’ সৈমোর সাহেব জানতে চাইলেন, ‘হঠাৎ ইমতিয়াজকে নিয়ে তোমাদের এতো আগ্রহ কেন?’

‘আসলে,’ রাদিফ উত্তর দিলো, ‘পুরো ঘটনাটা আমরা গতকাল রাতে প্রচন্ড নাটকীয়তার মাঝে দিয়ে সৌধর মুখ থেকে প্রায় চার ঘণ্টা সময় ধরে শুনেছি। ঘটনাটা অনেক বড়। পুরো ঘটনা আপনাদের অবশ্যই জানাবো। কিন্তু তার আগে শাহানার নিখোঁজ হবার ঘটনাটা একটু জানান।

‘বেশ ঘাপলা ওয়ালা ঘটনা মনে হচ্ছে!,’ মনসুর ভাই মন্তব্য করলেন।

‘হ্যাঁ,’ খসরু বললো।

‘আজ কিন্তু আমার হাতে অফুরন্ত সময়,’ সৈমোর সাহেব হাসিমুখে বললেন, ‘আজ এখানে এসেছি বই-পত্র কিনবো বলে। তবে এটা কিন্তু আসল উদ্দেশ্য নয়। আজ সন্ধ্যায় বৃষ্টি হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। আমার আর মনসুর ভাই এর প্ল্যান হচ্ছে একসাথে খিচুড়ি রান্না করে খেয়ে দেয়ে পুরো রাত জম্পেশ একটা আড্ডা দেওয়া।’

‘তাহলে তো ভালোই হলো,’ আমি বললাম, ‘সেক্ষেত্রে সংক্ষেপে পুরো ঘটনাটা আপনাদের বলা যেতে পারে।’

‘আমি কেন জানি একটা অজানা থ্রিল অনুভব করছি। আজকে লাইব্রেরিতে অর্ধ-দিবসের ধর্মঘট ডাকলাম। চলো, উপরে চলো সবাই। বাসায় গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে তোমাদের ঘটনা শোনা যাবে।’

মনসুর ভাইয়ের বাড়ির দোতলায় আমি আগে কখনও আসিনি। সাজানো গোছানো ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট। লিভিং রুমে আমাদের বাসিয়ে রেখে ভেতরে থেকে শার্ট-প্যান্ট পাল্টে টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে আসলেন। তারপর সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শুরু করো।’

সংক্ষেপে বলবো বললেই সংক্ষেপে বলা যায় না। আর এটা সংক্ষেপে বলার মতো কোন ঘটনাও না। বলতে বলতে মাঝপথে ঝুম বৃষ্টি নেমে আকাশ পুরো অন্ধকার করে দিলো। জানালা দিয়ে বাতাসের ভেজা গন্ধ, উৎসুক ক’জন মানুষ আর আমি। তৃতীয়বারের মতন জীবনের একমাত্র ভৌতিক অভিজ্ঞতাটা বললাম। এবার অবশ্য আমি একা বললাম না, দম নিতে খসরু আর রাদিফ অনেক সাহায্য করলো।

বলা শেষ করার পর মনসুর ভাই আর সৈমোর সাহেব মিনিট খানেক ঝিম মেরে বসে থাকলেন। তারপর কেশে গলাটা একটু পরিস্কার করে সৈমোর সাহেব বললেন, ‘ইমতিয়াজ মানুষ হিসেবে চিরকালই অদ্ভুত ছিলো। কিন্তু ও যে মাথায় এতো বড় একটা রোগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা আমরা কখনওই বুঝতে পারিনি।’

‘আপনার কি মনে হয় ইমতিয়াজ সাহেব মানসিক ভাবে অসুস্থ?, রাদিফ সৈমোর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো।

‘সৌধের ঘটনা শুনে তো হাতে নাতে প্রমাণ পেলাম। তবে আমি অবশ্য কলেজে থাকতেই ধারণা করেছিলাম যে ওর মধ্যে একটা ঘাপলা আছে …’

‘যেমন?.’ রাদিফ আবার জানতে চাইলো।

‘ইমতিয়াজের সাথে আমার পরিচয় কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে না, কলেজ থেকে। সে হিসেব করলে ওকে আমি অনেক বড় একটা সময় ধরে চিনি। প্রথম যখন আমাদের হোস্টেলে উঠলো ও– ওর সিট পড়েছিলো রায়হানের সাথে। হোস্টেলে নতুন কেউ এলে তাকে বাজিয়ে দেখা পুরানোদের কর্তব্য। সেই কর্তব্য থেকেই আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম সেখানে। আমাদের দেখেই ও বলে উঠলো, তোমরা আসাতে ভালোই হলো– চলো গান বাজনা করা যাক, বলে ওর মাল-পত্রের সুটকেসের উপর রাখা বাক্স থেকে গিটার বের করে গান গাওয়া শুরু করলো, আমরা তাল দেওয়া শুরু করলাম। আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেলো, র‍্যাগিংও চুলোয় উঠলো।

তবে মানুষের সাথে সহজে মিশে ফেললেও সে নিজের আশে পাশে একটা দেয়াল তুলে রাখতো। সবার সাথে তেমন একটা কথা বলতো না। বেশিরভাগ সময় একা একাই থাকতো আর মন-মেজাজ ভালো থাকলে আমাদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতো। ওর গল্প বলার দক্ষতা আসলেই অসাধারণ। আমরা শীতের রাতে চুরি করে ছাদে গিয়ে আড্ডা মারতাম। সেখানে মাঝে মধ্যে ইমতিয়াজ থাকতো। ও প্রচুর বই পড়তো। ভূতের গল্পগুলো বেশিরভাগ সময়ই ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভে এমনভাবে বলতো যে ভয়ে আমরা প্রায় আধমরা হয়ে যেতাম।

ওর কান্ডকারখানা ছিলো খুব অদ্ভুত। হোস্টেলে যথেষ্ট কড়াকড়ি ছিলো, কিন্তু তারপরও রাতে-বিরাতে ও চুরি করে বের হয়ে যেতো। কিন্তু হাতে নাতে কখনই স্যাররা ওকে ধরতে পারতেন না।

ওর আচার আচরণ অনেকের মনে সন্দেহ জাগালো। ভাবলো ও হয়তো নেশা-টেশা করে। একদিন রায়হানকে বলে রাখলাম রাতে না ঘুমাতে, আর ও বের হওয়ার সাথে সাথে যাতে কুকুরের ডাক ডেকে আমাকে সংকেত দেয়। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো ওর পেছনে পেছন গিয়ে দেখবো ও কোথায় যায়।

রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটার মতন। ও বের হয়েই একটা রিকশা নিলো। আমরাও নিলাম। প্রায় বিশ মিনিট যাবার পর পুরান ঢাকার সামনে এসে রিকশা থেকে নামলো। তারপর শুরু হলো হাঁটা।

প্রায় আধা ঘণ্টা ওর পেছনে হাঁটলাম আমরা। একসময় দেখলাম, ও ছোট, সংকীর্ণ, অদ্ভুত সব গলি পেরিয়ে দেখি প্রায় ভাঙা একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটা ছিলো একটা কানাগলির মধ্যে। অনেক পুরানো। দেখে মনে হচ্ছিলো বৃষ্টির সময় একটু জোরে বাতাস বইলেই ভেঙে পড়বে।

যাইহোক, ও বাড়িটাতে ঢুকলো। আমরা উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম অবশ্য। লাভ হয়নি। কিছু দেখতে পাইনি। তবে বাড়িটার সদর দরজার উপরে লাল রঙে ইংরেজি হরফে খুব সুন্দর করে লেখা ছিলো– Ask for flowers.

মনসুর ভাই সৈমোর সাহেবকে থামালেন, ‘কি লেখা ছিলো বললে?’

‘আস্ক ফর ফ্লাওয়ারস, ইংরেজি হরফে।’

‘জায়গাটা পুরান ঢাকার কোথায় বলতে পারো?’

‘খোঁজা খুঁজি করলে হয়তো বলতে পারবো। শীতের রাত ছিলো। তার উপর ছিলো প্রচন্ড কুয়াশা। এর মধ্যে আবার যাচ্ছিলাম ইমতিয়াজের পেছন পেছন। আশে-পাশে অত খেয়াল করতে পারিনি। ফেরার সময় আমাদের খবর হয়ে গিয়েছিলো।’

‘পরে ওকে জিজ্ঞেস করোনি কোথায় গিয়েছিলো ও?,’ মনসুর ভাই জানতে চাইলেন।

‘করেছি। ও কখনও উত্তর দিতো না। রহস্যময় হাসি হাসততা।’

–জায়গাটার তো তাহলে ভালো একটা তাৎপর্য আছে,’ খসরু উত্তেজিত কন্ঠে বললো, ‘ওনার বাড়ির সামনের সাইনবোর্ডটা কি তাহলে ওই বাড়ি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বানানো? নাকি আদ্রিয়ান পেতরোভের গল্প থেকে?

‘সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না,’ সৈমোর সাহেব মন্তব্য করলেন।

‘সম্ভাবনা দেখছি আরও বেড়ে গেলো,’ আমি বিড়বিড় করলাম।

‘আচ্ছা ইন্টারাপ্ট করার জন্য দুঃখিত, সৈমোর শুরু করো তুমি,’ বলে মনসুর ভাই গভীর মনযোগ দিয়ে শোনা আরম্ভ করলেন।

সৈমোর সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, ‘কলেজের দু’বছর নিজের রহস্যমানব খেতাবটা বজিয়ে রাখলো ইমতিয়াজ। আমাদের সার্কেলের মধ্যে একমাত্র ওর-ই মেডিকেলে জায়গা হয়েছিলো। ও চলে গেলো মেডিকেলে। বাকিরাও অন্যান্য জায়গায় জায়গা করে নিলো। এক বছর পর টিএসসিতে দেখি আমাদের কলেজের উইয়ার্ড কিন্তু সুন্দরি হিসেবে খ্যাত ফারাহ্ র সাথে খুব খুনসুটি করে বেড়াচ্ছে। ফারাহ্ ওর সাথে মেডিকেলে পড়তো তখন। ইমতিয়াজের সাথে অনেক কথা হয়েছিলো সেদিন। কথা বলে মনে হয়েছিলো আগের থেকে একটু পাল্টেছে। ইন্ট্রোভার্ট ভাবটা একটু কমই লেগেছিলো তখন।

এরপর অনেকদিন কোন যোগাযোগ হয়নি। একদিন দেখি আমার ডিপার্টমেন্টে শাহানার সাথে বসে কথা বলছে। শাহানার ভাবভঙ্গিতে বুঝলাম ইমতিয়াজের সাথে ওর কিছু একটা চলছে। সেদিন কথা বলে জানতে পারলাম মেডিকেল ছেড়ে এখন আমাদের ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে ইমতিয়াজ। মনে মনে শালা লুইচ্চা বলে গালিও দিয়েছিলাম।

একদিন কলেজের বন্ধু-বান্ধবদের ও ওর গুলশানের বাড়িতে দাওয়াত করলো। শালার যে এতো টাকা পয়সা আমরা আগে কেউ-ই জানতাম না। আমার যতদূর মনে পরে নুরুল হুদা স্যার নাকি ওকে বিনা বেতনে প্রাইভেটে পড়াতেন বাড়িতে টাকা পয়সার সমস্যা ছিলো বলে। তখন দেখলাম ওসব বেশ প্রতিষ্ঠিত গুজব ছিলো!

যাই হোক, শাহানা আমাদের ডিপার্টমেন্টের খুব আদরের ছোটবোন ছিলো। মেয়েটার গুণ ছিলো অনেক। চমৎকার গান করতো। সেদিন স্পষ্টভাবেই বোঝা গেলো শাহানা আর ইমতিয়াজের গভীর প্রেম চলছে।

দশ-বারো মাস পরের কথা। এক দুপুরে ক্লাশ শেষ করে বের হয়েছি, ডিপার্টমেন্টে দেখি কি নিয়ে যেন ফিসফাস হচ্ছে। পরে জানতে পারলাম শাহানা নাকি নিখোঁজ। তিনদিন ধরে ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনা প্রকাশ হয় শাহানার রুমমেট একটা প্রয়োজনে ওর বাড়িতে ফোন দেওয়ার পর। শাহানা নাকি আরও তিনদিন আগে বাড়িতে যাবার কথা বলে হল ছেড়েছে। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছায়নি আর।

স্ত্রী মারা গেলে স্বভাবতই প্রাইম সাসপেক্ট থাকে স্বামী, আর প্রেমিকার কিছু হলে সেটা হয় প্রেমিক।

খোঁজ করতে গিয়ে ইমতিয়াজের ডাক পড়লো। ইমতিয়াজ কিছুই বলতে পারলো না। শাহানার সাথে নাকি ওর মনোমালিন্য হয়েছিলো একটা বিষয়ে। সাতদিন ধরে ওর সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি।

ইমতিয়াজ হয়তো বেঁচে যেতো, কিন্তু বাঁধ সাধলো শাহানার আরেক বান্ধবী সুরভী। শাহানা নাকি হল ছাড়ার আগে ওকে বলে গিয়েছিলো যে ও বাড়ি যাবার নাম করে ইমতিয়াজের বাড়িতে যাচ্ছে। ওদের নাকি বিয়ে করার কথা ছিলো সেদিন।

এরকম শক্ত স্টেটমেন্টে ইমতিয়াজ বেশ ভালোভাবে ফেঁসে গেলো। ওকে নিয়ে যাওয়া হলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। ও বারবার বলতে থাকলো ও কিছুই জানে না। ওদের যে বিয়ে করার কথা ছিলো, এটা স্বীকার করলো বটে, কিন্তু ও বাড়িতে এসেছে এমন কোন কথাই ওর মুখ থেকে বের করা গেলো না। আর সবথেকে বড় কথা কেউ কিছু দাবি করলেই হয় না, প্রমাণও করতে হয়। শাহানার ইমতিয়াজের বাড়িতে গিয়েছিলো সেদিন, এমন কোন শক্ত প্রমাণই কেউ দিতে পারেনি।

শাহানার বাবা সে সময়কার খুব প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইমতিয়াজকে তিনি এতো সহজে ছাড় দেবার পাত্র না। রিমান্ডে নিয়ে ওকে বেদম পেটানো হলো। একেবারে যা-তা অবস্থা। সাতদিনের অমানুষিক রিমান্ড কাটানোর পর পুলিশ স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে ও আসলেই কিছু জানে না। আর ওই যে বললাম, সুরভীর মুখের কথা ছাড়া আর কোন প্রমাণই ছিলো না ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে।

মামলা টিকলো না। ইমতিয়াজকে ছেড়ে দেওয়া হলো। কিছু পত্র-পত্রিকা অবশ্য এটা নিয়ে বেশ কিছুদিন মাতামাতি করলো। মামলার কোন গতি না দেখে তারাও একসময় হাল ছেড়ে দিলো।

অবশ্য আমরা, মানে ওর বন্ধুরা– ইমতিয়াজকে সন্দেহ করেছিলাম। ওর মতিগতি কখনই সুবিধের মনে হয়নি আমাদের কাছে। আমি অবশ্য দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম এখানে ও কোন না কোন ভাবে জড়িত। কিন্তু সন্দেহ করলেই বা কি! কিছু প্রমাণ তো করতে পারবো না।

সে সময় পুলিশের তদন্ত চলাকালীন সময়ে আরও বেশ কিছু পয়েন্ট উঠে এসেছিলো। যেমন, গুলশানের বাড়িটার কথা। ওটা ইমতিয়াজের দূর সম্পর্কের চাচা ইশফাঁক আহমেদের বাড়ি। তিনি মারা যাওয়ার পর নাকি উইলে দেখা গেলো সেটা তিনি ইমতিয়াজের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। অথচ এরকম কোনকিছু হওয়া স্বাভাবিক ছিলো না। কারণ ইমতিয়াজের সাথে নাকি উনার দু’একবার ছাড়া আর কখনওই দেখা হয়নি। সবথেকে বড় কথা, উনার প্রাপ্তবয়স্ক দু’টো ছেলে ছিলো। তাদেরকে রেখে ইমতিয়াজকে এই বাড়ি লিখে দেওয়া যথেষ্ট রহস্যময়। ছেলে দু’টোও নাকি এ নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য করেনি। সবথেকে বড় কথা ইমতিয়াজের সাথে ওর চাচার সম্পর্কও ভালো ছিলো না।

একসময় আমরা নিজেরাই ব্যাপারটা ভুলে গেলাম। আজ পর্যন্ত মেয়েটার কোন খবরই বের করা গেলো না। ওর কি হয়েছিলো কে জানে! কয়দিন পর ইমতিয়াজ বেশ ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হলো। মাস্টার্স শেষ করে চাকরিতে জয়েন করলো। আস্তে আস্তে যে যোগাযোগটা মাঝে মধ্যে হতো, সেটাও বন্ধ হয়ে গেলো।’

‘এমনকি হতে পাওে না যে শাহানা’র নিখোঁজ হবার ঘটনা, রিমান্ড, এসবের শক মিলিয়ে রোগটা কোনভাবে শুরু হয়েছে? বা আগে থেকেই হয়তো সেটা ছিলো, এই ঘটনার পর সেটা আরও বেড়ে গিয়েছে? আর সেটা থেকেই তিনি নিজেকে একটা বই এর ক্যারেকটার ভাবা শুরু করে পুরো গল্পটা নিজের জীবনে রিক্রিয়েট করছেন?,’ রাদিফ প্রশ্ন তুললো।

‘হতে পারে,’ খসরু উত্তর দিলো, ‘আসলে কোন সম্ভাবনাই এখানে ফেলে দেবার মতন না। ‘

মনসুর ভাই একটু চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘আমার কি যেন একটা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছেনা … আচ্ছা, তোমাদের কি মনে হয় না ঘটনাটা অনেক জট পাকিয়ে গিয়েছে? ইমতিয়াজ সম্পর্কে আমাদের একটু খোঁজ খবর নেওয়া দরকার? এখন কোথায় আছে ও?’

‘উনার বাড়িতে ফোন দিয়েছিলাম। কেয়ারটেকার জানালো ঢাকার বাইরে আছেন বেশ কিছুদিন ধরে। তবে হ্যাঁ, ঘটনা আসলেই জট পাকিয়ে গিয়েছে। আচ্ছা যদি সম্ভাবনার খাতিরেও ধরি সালেহীন শাহানা নিখোঁজ হবার পেছনে দায়ি, সেটা নিয়ে যদি আমরা ব্যক্তিগত তদন্তও করতে চাই– শুরুটা কোথা থেকে করবো?,’ আমি জানতে চাইলাম।

নিঃসন্দেহে সালেহীনের কাছ থেকে, রাদিফ উত্তর দিলো, ‘তিনি যেহেতু নেই, উনার বাড়ি থেকেই কাজটা শুরু করা উচিত।’

‘কিন্তু সেটা কিভাবে?,’ সৈমোর সাহেব কৌতূহলী কণ্ঠে জানতে চাইলেন।

‘যদি সে রকম কিছু তিনি করেও থাকেন, এতোদিনে প্রমাণ-সূত্র কিছুই পাওয়ার কথা না। কিন্তু পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। তার বাড়িতে ঢুকতে পারলে বেডরুম, স্টাডিরুম খুঁজে পেতে যদি কোন ব্যক্তিগত ডায়েরি, চিঠি, ছবি পাওয়া যায়– সেসব ঘেটে হয়তো একটা কিছু বের করা যেতে পারে,’ রাদিফ উত্তর দিলো।

‘কিন্তু সেটা করবে কিভাবে?,’ মনসুর ভাই জানতে চাইলেন।

‘মনসুর ভাই,’ আমি বললাম, ‘সকালে আপনাকে আমি কি বললাম? বললাম না যে শার্লকগিরি করার সুবর্ণ সুযোগ পাবেন! আমাদের চুরি করে তল্লাশী চালাতে হবে উনার বাড়িতে।’

‘চুরি করে!,’ মনসুর ভাই বিস্মিত কন্ঠে বললেন, ‘খুব অ্যাডভেঞ্চারাস শোনাচ্ছে!!’

‘কিছু মনে না করলে,’ সৈমোর সাহেব বললেন, ‘আমি কি আসতে পারি?’

‘অবশ্যই,’ আমি উত্তর দিলাম, ‘আমাদের এখন অনেক ম্যান-পাওয়ার দরকার। তাহলে কিছু কাজ ভাগাভাগি করে নিই আমরা– আর দু’ঘন্টা পর আমি, মনসুর ভাই আর রাদিফ– সালেহীনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি। বাড়িতে মানুষ কম থাকার সম্ভাবনা আছে। কপাল ভালো থাকলে শুধু রবি, মানে ওনার কেয়ারটেকারই থাকবে পুরো বাড়িতে। একা। আমি সালেহীন ভাই এর সাথে দেখা করতে আসার ছুঁতোয় বাড়িতে ঢুকবো। যেহেতু তিনি বাড়িতে নেই, রবি আমাদের চা-কফি খেয়ে যেতে বলবে। ওর কফি বানাতে যাওয়াটাই আমাদের মোক্ষম সুযোগ। মনসুর ভাই আর রাদিফ লিভিং রুমে স্ট্যান্ডবাই থাকবেন। আমি ওয়াশরুমে যাবার নাম করে দো’তলায় তার বেডরুম আর স্টাডিরুমটা সার্চ করে আসবো।’

‘ওয়াও!,’ মনসুর ভাই বিষ্ময় প্রকাশ করলেন, ‘নিজেকে তো উপন্যাসের চরিত্র মনে হচ্ছে।’

‘আর সৈমোর সাহেব,’ আমি বললাম, ‘সালেহীনের পৈতৃক বাড়ি কোথায় বলতে পারেন?’

‘হ্যাঁ, খুলনার বখশীপাড়ায়।’

‘ঠিকানা জানা আছে?’

‘না। তবে জোগাড় করতে পারবো। স্কুলের রিইউনিয়ন পার্টি অ্যারেঞ্জ করার সময় আমাদের ব্যাচের ডাটাবেস পেয়েছিলাম। ওখানে খুঁজলেই পাওয়া যাবে।’

‘তাহলে আপনি আর খসরু যাচ্ছেন খুলনাতে।’

‘মানে!,’ খসরু অবাক হলো, ‘খুলনায় গিয়ে কি করবো?’

‘সালেহীন সম্পর্কে খোঁজ আনবি। গুলশানের বাড়িটা কিভাবে তার হাতে আসলো সেটা জানতে তার পরিবার সম্পর্কে জানতে হবে। সম্ভব হলে বাবা-মা’র সাথে কথা বলবি। সৈমোর সাহেব সাথে থাকলে সমস্যা হবার কথা না। আপনারা ক্লাশমেট ছিলেন, জানতে চাইলে বলবেন রিইউনিয়নের জন্য খোঁজ করছেন।’

সৈমোর সাহেব দাঁত বের করে হেসে বললেন, ‘অনেকদিন পর বোরিং জীবনটায় নতুনত্ব আসবে বলে মনে হচ্ছে! খসরু, চলো রওনা দিই। গাড়িতে গ্যাস আছে তো?’

‘ভরতে হবে,’ কিড়মিড় করে কথাটা বলে সে আমার দিকে একটা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘আর তোরা ঢাকায় বসে কি করবি?’

‘ঢাকার কাজ কি তোর কাছে খুব কম মনে হয়? পুরো একটা বাড়ি চুরি করে তল্লাশী করা কি ঘরের কাছের কথা নাকি?’

রাদিফ বললো, ‘আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা। রহমান আলীর খোঁজ করতে হবে। সালেহীন তার গল্পে বলেছিলেন রহমান নামের কেউ একজন চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, তার বদলে এসেছিলো রবি। শাহানা যদি সেই সময় তার বাড়িতে এসেও থাকে সেটার একমাত্র প্রমাণ হয়তো রহমান নামের মানুষটা। সত্য না মিথ্যা কে জানে! তারপরও খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।

‘গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট,’ খসরু মন্তব্য করলো।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন