২৫. কত অজানারে

আবুল মনসুর আহমদ

কত অজানারে
পঁচিশ অধ্যায়

১. লালফিতার দৌরাত্ম্য

মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়া প্রথম সুযোগেই শিল্পকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে হস্তান্তর করিয়া এবং লাইসেন্সিং-এর ব্যাপারে উভয় প্রদেশের জন্য স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কন্ট্রোলার আফিস স্থাপন করিয়া দিয়াছিলাম বটে, কিন্তু অল্পদিনেই বুঝিলাম, ওতেই আমার কর্তব্য শেষ হয় নাই। প্রাদেশিক সরকারদ্বয় তাতেই পুরা অধিকার ও সুবিধা পান নাই। ধরুন আগে শিল্পের কথাটাই। শিল্প প্রাদেশিক বিষয় বটে, কিন্তু শিল্প প্রতিষ্ঠা করিতে এবং চালাইতে বিদেশী মুদ্রা লাগে। বিদেশী মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে। কেন্দ্র বিদেশী মুদ্রা দিবার আগে নিজে স্বাভাবতঃই দেখিয়া লইতে চায়, তার সদ্ব্যবহার হইবে কিনা। প্ল্যানিংটা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। কোনও শিল্প প্ল্যান-মোতাবেক হইতেছে কিনা, তাও দেখা কেন্দ্রীয় সরকারের এলাকা। এই সব কারণে প্রাদেশিক সরকারের সব শিল্পায়ন-প্রচেষ্টাই কেন্দ্রের দ্বারা অনুমোদিত হইতে হয়। এই অনুমোদন পাইতে অনেক সময় লাগে। প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষতঃ পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করা হয় যে তাঁরা এলটেড টাকা খরচ করিতে পারেন না বলিয়া বছর শেষে টাকা ফেরত যায়। কথাটা সত্য। সত্যই পূর্ব পাকিস্তান সরকার অনেক সময় তাঁদের ভাগের টাকা খরচ করিতে পারেন নাই বলিয়া টাকা ফেরত গিয়াছে। বলা হয় এতে দুইটা কথা প্রমাণিত হইতেছে এক, পূর্ব-পাকিস্তানে এব্যবিং ক্যাপাসিটি (হম করিবার ক্ষমতা) নাই। দুই, প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে শিলোয়তির মত বড় কাজ চালান সম্ভব না। সুতরাং যারা অধিকতর অটনমির দাবি করে তারা ভ্রান্ত।

ব্যাপারটা সত্যই আমাকে চিন্তায় ফেলিল। আমি লাহোর প্রস্তাবের দুই পাকিস্তানে বিশ্বাসী। আসলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দুইটা পৃথক দেশ, দুইটা পৃথক জাতি। তাদের অর্থনীতি সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে দুইটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হইলেই ঠিক হইত। কিন্তু তা হয় নাই। পাকিস্তান এক রাষ্ট্র হইয়াছে। সেই জন্য এক পাকিস্তান কায়েম রাখিয়া উভমু অঞ্চলকে সমানভাবে উন্নত করার পন্থা হিসাবেই আমি একুশ দফার ১৯ দফা রচনা করিয়াছিলাম। সকল শ্রেণীর পূর্ব পাকিস্তানবাসী, বিশেষতঃ যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগ, লাহোর-প্রস্তাব-নির্ধারিত পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসনে বিশাসী। এই হিসাবে ১৯৫৬ সালের শাসন ঘোরতর কুটি পূর্ণ। তবু এই শাসন অনুসারে কাজ করিতে রাযী হইয়াছি এবং মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াছি। আশা এই যে শাসনতান্ত্রিক পন্থার দ্বারাই আমরা এই শাসনন্ত্রকে সংশোধন করিয়া পূর্ব আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করিতে পারি। আমরা বিপ্লব করিয়া সে পরিবর্তন আনিতে চাই না। তা করিলে পরিণামে পাকিস্তানের অনিষ্ট হইতে পারে। সে জন্য আমরা সারা প্রাণ দিয়া সাধারণ নির্বাচন করিতে চাই। বস্তুতঃ এই একটি মাত্র উদ্দেশ্যেই আমাদের নেতা শহীদ সাহেব মাইনরিটি দলের নেতা হইয়াও মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব নিয়াছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সাধারণ নির্বাচন হইলেই তিনি মেজরিটি লাভ করিবেন এবং মেজরিটি দলের নেতা হিসাবে জাতিগঠনমূলক কাজে হাত দিতে পারিবেন। নেতার সহিত আমিও সম্পূর্ণ একমত ছিলাম। আমিও আগামী নির্বাচনে মেজরিটি লাভ করিয়া শাসনতন্ত্র সংশোধনের আশা করিতেছিলাম।

কিন্তু ইতিমধ্যে শাসনতন্ত্রের আওতার মধ্যে থাকিয়া যত বেশি প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা বাড়ান যায় তার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। এই সত্য স্বীকার করিতে আমার লজ্জা নাই যে প্রধানতঃ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার বাড়াইবার চেষ্টাতেই আমি সব করিয়াছি। কিন্তু ঐ সংগে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের অধিকার বাড়াইতেও ক্রটি করিনাই। প্রাদিশেক সরকারের এলাকা বাড়াইবার উদ্দেশ্যে যা-কিছু করিয়াছি, সে সবেই স্বভাবতঃই পূর্ব পাকিস্তানের সাথে-সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকারও বাড়িয়াছে। এমনকি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকার, পি.আই.ডি.সি.এবং এস,এন্ড ডি, প্রভৃতি কেন্দ্রীয় সংস্থার সাথে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বিরোধ বাধিলে আমি প্রায়শঃ পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন করিয়াছি এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের পক্ষে রায় দিয়াছি। এ কাজ শাসনতন্ত্রের বিধানকে যথাসম্ভব টানিয়া মোচড়াইয়া প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে নিতে কসুর করি নাই।

২. কেন্দ্রীয় অনুমোদনের নামে

কেন্দ্রীয় সরকারী অনুমোদনের নামে প্রাদেশিক সরকারের প্রজেক্টগুলি নিষ্ঠুরভাবে অবহেলিত অবস্থায় কেন্দ্রীয় বিভিন্ন দফতরের পায়রার খোপে পড়িয়া থাকে। এই কারণেই প্রাদেশিক সরকারদ্বয় বিশেষতঃ পূর্ব-পাক সরকার তাঁদের ভাগের বরাদ্ধ টাকা সময় মত খরচ করিতে পারেন না, এটা বুঝিতে আমার সময় লাগিয়াছিল। প্রাদেশিক সরকার কোন বরাদ্দ-টাকা খরচ করিতে পারেন না, তার সন্ধান করিতে গিয়া আমি দেখিয়া তাজ্জব হইলাম যে পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের প্রস্তুত কোন-কোন প্রজেক্ট তিন-চার বছর ধরিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের দফতরে পচিতেছে। কারণ বাহির করিতে গিয়া যা দেখিলাম তাতে আরও বিম্বিত ও লজ্জিত হইলাম। প্রাদেশিক সরকারের কোন বিভাগের একটি প্রজেক্ট কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনের জন্য প্রথমে ঐ প্রজেক্টের সব কাগপত্র কেন্দ্রীয় সরকারের করেসপন্ডিং দফতরে (অর্থাৎ শিল্প হইলে শিল্প দফতরে, শিক্ষা হইলে শিক্ষা দফতরে। পাঠাইতে হয়। কেন্দ্রীয় দফতর উহা সংশোধন-অনুমোদন করিলে পর উহা প্রাদেশিক সরকারে ফেরত যাইবে। প্রাদেশিক সরকার যদি সংশোধন না মানেন, তবে লেখালেখি শুরু হইবে। যদি সংশোধন মানিয়া লন, তবে ক্রমে ক্রমে (এক সাথে নয়) শিল্প, বাণিজ্য, প্লানিং ইকনমিক এফেয়ার্স এবং ফাইনান্স দফতরে পাঠাইতে হইবে। এক দফতরে অনুমোদন পাইয়া অপর দফতরে যাইতে হইবে। এক দফতরের বাধা পাইলে, সংশোধন করিতে চাইলে, ত কথাই নাই। তাতে যে ‘রথিডং বুথিডং’ ‘ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাক’ শুরু হয় তাতে বছরকে-বছর চলিয়া যাইতে পারে। আর বাধা যদি কেউ না-ও দেন সংশোধন যদি কেউ না-ও করেন, তথাপি একটি প্রাদেশিক প্রজেক্টকে সাতটি সিংহদরজা পার হইয়া মণিকোঠায় ঢুকিয়া কেন্দ্রীয় অনুমোদনের রাজকন্যার সাক্ষাৎ পাইতে কয়েক বছর কাটিয়া যায়। ইতিমধ্যে বরাদ্দ টাকা ফিরিয়া যায়! সুতরাং দোষ কেন্দ্রীয় সরকারের। প্রাদেশিক সরকারের কোনও দোষ নাই। তবু দীর্ঘদিন ধরিয়া প্রাদেশিক সরকার বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তান সরকার ও মন্ত্রীরা চুপ করিয়া এই মিথ্যা তহমত বরদাশত্ করিয়া আসিতেছেন। আমি এই অবস্থার প্রতিকারে উদ্যোগী হইলাম। প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন পাইয়া প্রসিডিওর সংক্রান্ত নিয়ম বদলাইলাম। নিজের সভাপতিত্বে কেবিনেটে এসব পাস করাইলাম। আশ্চর্য এই, পশ্চিম পাকিস্তানের মন্ত্রীরাও এর প্রতিবাদ করিলেন না। বরঞ্চ উৎসাহের সাথে সমর্থন করিলেন। পরিবর্তিত ও সংশোধিত নিয়মে এই ব্যবস্থা করা হইল যে প্রাদেশিক সরকার তাঁদের প্রজেক্টের সাত-আট কপি একই সময়ে সংশ্লিষ্ট সকল কেন্দ্রীয় দফতরে এক-এক কপি পাঠাইয়া দিবেন। ছয় সপ্তাহের মধ্যে অনুমোদন বা সংশোধন

আসিলে অনুমোদিত বলিয়া ধরিয়া লইবেন এবং কার্যে অগ্রসর হইবেন। আরও নিয়ম করা হইল যে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের টাকা কোন অবস্থাতেই ল্যাপস বা বাতিল হইবে না। কারণ পূর্ব-বাংলায় ছয় মাসের বেশি বর্ষার দরুন নির্মাণকার্য বন্ধ থাকে। প্রাকৃতিক কারণে কাজ বন্ধ থাকার দরুন টাকা খরচ না করা গেলে তার জন্য কর্তৃপক্ষকে দোষ দেওয়া যুক্তিসংগত নয়। পূর্ব-বাংলার ঋতুর সাথে সম্পর্ক রাখিয়া পাকিস্তানের আর্থিক বছর এপ্রিলের বদলে জুলাই হইতে শুরু করার প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের আতাউর রহমান মন্ত্রিসভাই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে করিয়াছিলেন। আমাদের আমলে সব গোছাইয়া ইহা করিয়া উঠিতে পারি নাই। ফিরোয় খ মন্ত্রিসভার আমলে তা করা হইয়াছিল। বর্তমান সরকাও তা বজায় রাখিয়াছেন।

নিয়ম-কানুন বদলান ছাড়া শিল্প বাণিজ্য দফতরে কতকগুলি বিশেষ সংস্কার প্রবর্তন করিতে হইয়াছিল। তার মধ্যে এই কয়টির নাম বিশেষভাবে উল্লখযোগ্য : (১) সওদাগরি জাহাজ (২) আট সিল্ক-শিল্প (৩) ডবল লাইসেন্সিং, (৪) বোগাস লাইসেন্সিং, (৫) ফিল্ম লাইসেন্সিং এবং নিউকামার। এছাড়া আমার অধীনস্থ দুইটি দফতরেই যথাসাধ্য চাকুরি-গত প্যারিটি প্রবর্তনের চেষ্টা করিয়াছিলাম। চাকুরির ব্যাপারে দু-একটি চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ পরে করিব। আগে সংস্কারের চেষ্টাতার প্রতিক্রিয়ার কথাটাই বলিয়া নেই।

. সওদাগরি জাহাজ

সওদাগরি জাহাজের কথাটাই সকলের আগে বলি। সওদাগরি জাহাজের দিকে আমার নযর পড়ে পূর্ব-পাকিস্তানের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিচার করিতে গিয়া। পূর্ব-পাকিস্তান তার প্রয়োজনীয় চাউল সিমেন্ট সরিষার তেল লবণ সূতা কাপড় ইত্যাদি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আমদানি করিয়া থাকে। জাহাজ ছাড়া এসব আমদানির আর কোনও যান-বাহন নাই। কাজেই এসব আমদানির ব্যাপারে পূর্ব-পাকিস্তান সরকার ও ব্যবসায়ীদের একমাত্র জাহাজের দিকেই চাহিয়া থাকিতে হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে এইসব জিনিসের দামের চেয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের দাম অনেক বেশি। এর একমাত্র কারণ জাহাজের মালিকরা গলাকাটা চড়া রেটে ভাড়া আদায় করিয়া থাকেন। আমি সরকারী কর্মচারী ও এক্সপোর্টারদের অভিমত লইয়া জানিতে পারিলাম, জিনিস-ভেদে করাচি হইতে চাটগা পর্যন্ত প্রতি টনে পঁয়তাল্লিশ হইতে পঞ্চাশ টাকার বেশি ভাড়া হইতে পারে না। কাজেই আমি প্রতি টন একান্ন টাকা বাঁধিয়া ফরমান জারি করাইলাম। জাহাজে স্থান বন্টন-বিতরণে দুর্নীতি মূলক পক্ষপাতিত্ব নিবারণের কড়া ব্যবস্থা করিলাম। কিন্তু অল্পদিনেই খবর পাইলাম সরকার-নির্ধারিত রেট অমান্য করিয়া মালিকেরা নব্বই-পচানব্বই টাকা টন প্রতি ভাড়া আদায় করিতেছেন। স্বয়ং ব্যাপারীরাই প্রতিযোগিতা করিয়া বেশি ভাড়া দিয়া থাকেন। জাহাজে জায়গার অভাব কেন? অফিসারদের লইয়া পরামর্শ করিতে বসিলাম। তাঁরা সবাই আমার চেয়ে অভিজ্ঞ লোক। তাঁরা খাতা-পত্রের হিসাব দেখাইয়া বলিলেন, উপকূল বাণিজ্যের জন্য আমাদের মোট উনচল্লিশটা জাহাজ আছে। অত জাহাজ থাকিতে জায়গার অভাব কেন, সে প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা যা বললেন, তাতে বুঝা গেল আসলে কাজের জাহাজ অত নাই। তদারক করিয়া দেখা গেল,মাত্র উনিশটা জাহাজ চালু আছে। বাকী বিশটাই মেরামতে আছে। মেরামতের দিন-তারিখ হিসাব করিয়া দেখা গেল, বহু বছর ধরিয়া ওদের মেরামত চলিতেছে। অভিজ্ঞ অফিসারেরা তাঁদের বহু অভিজ্ঞতার নযির দিয়া আমাকে বুঝাইয়া দিলেন, জাহাজের মালিকদের চালাকি ধরা খুব কঠিন। আসল ব্যাপার এই যে তারা বরাবর একই জাহাজ বিকল ও ‘আন্ডার রিপেয়ার’ দেখায় না। একটার পর আর একটা দেখায়। এই সমস্ত সওদাগরি জাহাজের মালিক মাত্র জন তিন-চারেক। কাজেই খুব প্রভাবশালী। ইচ্ছা করিলে তাঁরা গোটা কোস্টাল ট্রাফিক অচল করিয়া দুই পাকিস্তানের যোগাযোগ বন্ধ করিয়া দিতে পারেন। পরামর্শ সভার ফল বিশেষ কিছু হইল না। জাহাজ ভাড়ার ‘রেট’ এবং পরিণামে পূর্ব পাকিস্তানী কনফিউমারদের দুর্দশা আগের মতই চলিল। আমি নিরুপায় হইয়া দাঁতে হাত কামড়াইতে থাকিলাম।

ইতিমধ্যে সওদাগরি জাহাজের মালিকদের যিনি প্রধান তিনি অসুস্থতার অজুহাতে ইযি-চেয়ারে শুইয়া লোকের কাঁধে চড়িয়া আমার সাথে দেখা করিলেন। তিনি খোলাখুলি আমাকে বলিলেন : টন প্রতি একান্ন টাকা ভাড়া বাঁধিয়া দেওয়া সরকারের ঘোরর অন্যায় হইয়াছে। তথ্য ও বৃত্তান্তমূলক আমার সমস্ত যুক্তির জবাবে তিনি বলিলেন : তাঁরা সরকারের বাঁধা দর মানিতেছে না, মানিবেও না। তিনি সগর্বে আমাকে জানাইয়া দিলেন, তাঁরা বর্তমানে পচানব্বই টাকা ভাড়া আদায় করিতেছেন এবং সেজন্য রশিদ দিতেছেন। ইচ্ছা করিলে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করিতে পারেন। সে ভয়ে কম্পিত নন তিনি।

আমি ভদ্রলোকের দুঃসাহস দেখিয়া অবাক হইলাম। এত সাহস তিনি পাইলেন কোথায়? অফিসার যাঁরা এই যোগাযোগের সময় হাযির ছিলেন তাঁরা আমাকে বুঝাইলেন, খুঁটির জোরেই ছাগল কুঁদে। অল্পদিন পরেই জানিতে পারিলাম, ঐ ভদ্রলোক করাচির সবচেয়ে বড় ক্লাবে বসিয়া (আমাদের বড়-বড় অফিসাররাও ঐ ক্লাবের মেম্বার) সগর্বে অফিসারদের বলিয়াছেন : ‘বলিয়া দিবেন আপনাদের মন্ত্রীকে, প্রেসিডেন্ট আমার ডান পকেটে। প্রধানমন্ত্রী আমার বাম পকেটে। অমন মন্ত্রীকে আমি থোড়াই কেয়ার করি।‘

যে অফিসাররা আমাকে এই রিপোর্ট দিলেন তাঁরা এই বলিয়া আমাকে তসল্লি দিলেন, লোকটা স্বভাবতঃই অমন গাল-গল্পী; ওর কথা যেন আমি সিরিয়াসলি না নেই। তাঁদের তসল্লির দরকার ছিল না। সিরিয়াসলি নিবার কোনও উপায় ছিল না। মিনিস্টাররা কি সত্যই অমন নিরুপায়?

কথায় বলে ‘নিরুপায়ের উপায় আল্লা’। আমার বেলায় তাই হইল। এই সময় আমি পরপর কতকগুলি বেনামী পত্ৰ পাইলাম। তার মধ্যে নামে-যাদে জাহাজের মালিকদের শয়তানির বিস্তারিত বিবরণ থাকিত। উহাদের বিরুদ্ধে স্টেপ নেওয়ার অনুরোধ থাকিত। অতীতে কোনও মন্ত্রী বা অফিসার এসব শয়তানি রোধ করিতে পারেন নাই, আমিও পারিব কিনা, সে সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করিয়া আমাকে রাগাইবার চেষ্টা থাকিত। এইসব পত্রের মধ্যে দুইটির কথা আমার আজও মনে আছে। একটিতে ছিলঃ উক্ত বড় মালিকের ফলানা নামে একটি জাহাজ করাচি বন্দরে বহুদিন অকেজো পড়িয়া আছে, যদিও কাগযে-পত্রে মাঝে-মাঝেই উহাকে চালু দেখান হইয়াছে। তদন্তু কমিশনের খবর পাইয়া এই জাহাজখানাকে মেরামতের নামে ফলানা তারিখে করাচি বন্দর ত্যাগ করিয়া বোম্বাই মুখে রওনা করান হইবে। আর ফিরিয়া আসিবে না। পথে সমূদূরে আত্মহত্যা (স্কাটল) করিয়া জাহাজ ডুবির রিপোর্ট দিবে এবং সরকার ও ইনসুরেন্স কোম্পানির কাছে বিপুল ক্ষতিপূরণ আদায় করিবে। এটা বন্ধ করা দরকার। খুব গোপনীয়ভাবে কাজ করিতে হইবে। জানাজানি হইলে সব ব্যর্থ হইবে। নির্ধারিত দিনের আগেই ওটাকে সরান হইবে। ইহাই পত্রের সারমর্ম। পত্রখানি ‘ব্যক্তিগত’ মার্ক করিয়া আমার নামে দেওয়া হইয়াছিল। কাজেই অফিসারেরা কেউ খোলেন নাই।

আমি নৌবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এ্যাডমিরাল চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করিয়া ইতিমধ্যে একটা তদন্ত কমিশন বসাইয়াছিলাম। কমিশনের রিপোর্টের আশায় অপেক্ষা করিতেছিলাম। যথাসাধ্য গোপনীয়তা রক্ষা করিয়া বাণিজ্য দফতরের সেক্রেটারি মিঃ আযিয় আহমদের সহিত গোপনে পরামর্শ করিলাম। সব ব্যাপারে আমরা একমত হইলাম। তিনি সেখানে বসিয়াই একটি অর্ডার শিটে কন্ট্রোলার-অব-শিপিং-এর উপর একটি যাত্রী অর্ডার লিখিলেন। তাতে উক্ত জাহাজের নামোল্লেখ করিয়া পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাকে করাচি বন্দর ত্যাগ করিতে না দেওয়ার আদেশ দেওয়া হইল এবং তাতে আমার অনুমোদন লইয়া সেক্রেটারি সাহেব আমার পার্সনাল স্টাফ ডাকিয়া ‘আর্জেন্ট ইমিডিয়েট’ ‘মোস্ট ইমিডিয়েট’ ‘স্ট্রিক্টলি কনফিডেনশিয়াল’ ‘স্পেশ্যাল ম্যাসেঞ্জার’ ইত্যাদি অনেক রকমের বড় বড় স্ট্যাম্প মারিয়া গালামোহর করাইয়া ‘স্পেশাল ম্যাসেঞ্জার’ মারফত ডেলিভারি দিবার ব্যবস্থা করিলেন। আমি সেক্রেটারি সাহেবের ক্ষিপ্র নিপুণতার তারিফে প্রশংসমান দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চাহিয়া রহিলাম।

তিনি ঐ কাজ শেষ করিলে আমি এই পত্ৰখানাও অমনভাবে স্পেশাল ম্যাসেঞ্জার মারফত এডমিরাল চৌধুরীর নিকট পাঠাইয়া দিবার অনুরোধ করিলাম। কথাটা তিনি খুব পসন্দ করিলেন। কিন্তু জানাইলেন এডমিরাল চৌধুরী সরকারী কাজে পাকিস্তানের বাহিরে গিয়াছেন। দুই-এক দিনের মধ্যেই তিনি ফিরিয়া আসিবেন। তখনই ওটা তাঁর কাছে ব্যক্তিগত ভাবে পৌঁছাইতে হইবে।

সমস্ত ব্যবস্থার পাকা-পুতিতে নিশ্চিন্ত হইয়া অন্যান্য কাজের চাপে ব্যাপারটা ভুলিয়াই গিয়ছিলাম। হঠাৎ একদিন আরেকখানা বেনামী পত্র পাইলাম। তাতে লেখা হইয়াছে? হাজার আসোস যথাসময়ে হুশিয়ার করা সত্ত্বেও আমি ‘ফলানা জাহাজ সম্পর্কে কোনও সতর্কতা অবলম্বন করি নাই। জাহাজখানা উল্লিখিত তারিখে কিম্বা তার একদিন আগেই মেরামতের পারমিশন লইয়া করাচি বন্দর ত্যাগ করিয়াছে। আমার মত মন্ত্রীর দ্বারা কোনও কাজ হইবে না, পত্র-লেখক আগেই সে সন্দেহ করিয়াছিলেন। তবু লোম্মুখে আমার তেজস্বিতার কথা শুনিয়া তিনি ঐ পত্র লিখিয়াছিলেন। ইত্যাদি। আমি পত্র পড়িয়া স্তম্ভিত হইলাম। সেক্রেটারি মিঃ আযিয আহমদকে ডাকিলাম। তিনিও পত্র পড়িয়া অবাক হইলেন। কন্ট্রোলার-অব-শিপিংকে তৎক্ষণাৎ টেলিফোন করিলেন। কন্ট্রোলার ঐ ধরনের কোনও নোট বা অর্ডার পান নাই। আযিয আহমদ সাহেব কড়া অফিসার বলিয়া মশহুর। সত্যই তাই। তিনি কয়দিন ধরিয়া সমস্ত বিভাগ তোলপাড় করিলেন। ডিসপ্যাঁচ বুক ডেলিভারি রেজিষ্টার পিয়ন বুক সব তন্নতন্ন করিয়া তদারক করিলেন। কোথায় সে অর্ডারশিটটা গায়েব হইয়াছে, তিনিও ধরিতে পারিলেন না।

কয়েকদিন পরে খবরের কাগয়ে পড়িলাম, ঐ ফলানা জাহাজ সত্য-সত্যই বোম্বাইর নিকটবর্তী স্থানে ডুবিয়া গিয়াছে। ব্যাপারটা যথারীতি তদন্ত কমিশনের কাছে পাঠান হইল।

আরও কয়দিন পরে আরেকটি জাহাজ সম্পর্কে এক-বেনামী পত্ৰ আসিল। তাতে লেখা হইয়াছে। ঐ বড়লোক জাহাজওয়ালা অস্ট্রেলিয়া হইতে একটি জাহাজ খরিদ করার জন্য সরকার হইতে তেত্রিশ লাখ টাকার বিদেশী মুদ্রা নিয়া সেখানে বড়জোর তিন-চার লাখ টাকা দামের একটি বড় জাহাজ কিনিয়াছেন। ওয়েলিংডন বন্দর হইতে উক্ত জাহাজ নামক লক্কড়টি অন্য একটি জাহাজের পিছনে বাঁধিয়া টোড করিয়া টানিয়া আনার ব্যবস্থা হইয়াছে। করাচি বন্দরে ইহা প্রবেশ করার আগে বিশেষ করিয়া রেজিস্ট্রেশন দিবার আগে যেন আমি এই জাহাজ সম্পর্কে গোপনীয় তদন্ত করাই। ইত্যাদি। মনে হইল, এই পত্রের লেখক আগের লেখক নন। কারণ এতে আগের পত্রের কোনও উল্লেখও নাই। আমার যোগ্যতা সম্পর্কে কোনও সন্দেহ প্রকাশও নাই।

 সেক্রেটারি সাহেবের সহিত গোপন পরামর্শ করিয়া এ সম্পর্কে পাকা ব্যবস্থা করিলাম। অতিরিক্ত সাবধানতা স্বরূপ আযিয আহমদ সাহেব এবার জয়েন্ট সেক্রেটারি মিঃ ইউসুফ সাহেবকেও এ-বিষয়ে সংগে লইলেন। উভয়ে পরামর্শ করিয়াই আট ঘাট বাঁধিলেন। মিঃ ইউসুফ খুব মেথডিক্যাল মানুষ। কাজেই এবার চোর ধরা পড়িবেই মনে করিয়া আমি নিশ্চিন্ত হইলাম। আবার আমি কাজের চাপে সব ভুলিয়া গেলাম। কিছুদিন পরে আরেকটা বেনামা পত্র পাইলাম। তাতে দুঃখ করিয়া লেখা হইয়াছে, আগে হইতে সাবধান করা সত্ত্বেও আমরা কিছুই করিলাম না। উক্ত লক্কড় জাহাজটি যথাসময়ে করাচিতে পৌঁছিয়া সিওয়ার্দির সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী। সাটিফিকেট লইয়া রেজিস্ট্রেশন পাইয়া সার্ভিসে কমিশন্ড় নিয়োজিত) হইয়া গিয়াছে। এই পত্রখানিও বাণিজ্য সেক্রেটারি ও জয়েন্ট সেক্রেটারিকে দেখাইলাম। আমার মত তাঁদেরও তালু-জিত লাগিয়া গেল। কি ভৌতিক ব্যাপার! অনারেবুল মিনিস্টার, দোর্দন্ডপ্রতাপ সেক্রেটারি, কর্তব্য-চেতন জয়েন্ট সেক্রেটারি সবারই চোখে ধুলা দিয়া, কার্যতঃ আমাদেরে বুড়া আংগুল দেখাইয়া, রাষ্ট্র ও সমাজের শত্রুরা তাদের মতলব হাসিল করিয়া যাইতেছে। অথচ তারা আমাদের হাত দিয়াই ত তামাক খাইয়া যাইতেছে। আমাদেরই দফতরের কোনও স্তরে আমাদের আদেশ আটকাইয়া বা বাতিল হইয়া যাইতেছে। মনে পড়িল প্রধানমন্ত্রী সুহরাওয়ার্দীর এক দিনের হংকারের কথা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই তিনি একটি আদেশ দিয়াছিলেন। পাঁচ মাস পরে তিনি জানিতে পারিলেন, তাঁর আদেশ তখনও কার্যকারী হয় নাই। সংশ্লিষ্ট দফতরের সেক্রেটারি সহ কতিপয় সেক্রেটারির সামনে তিনি হুংকার দিয়া বলিয়াছিলেন : ‘আমি জানিতে চাই আমিই প্রধানমন্ত্রী না আর কেউ?’ এর পর তাঁর সেই আদেশ কার্যকরী হইয়াছিল। বাণিজ্য-সেক্রেটারিদ্বয়ের ও-ব্যাপার জানা ছিল। আমি তাঁদেরে সে কথা স্মরণ করাইয়া বলিলাম। আমাদেরও সেই দশা নয় কি? তাঁরা উভয়ে এই অবস্থার প্রতিকারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা জানাইলেন।

যথা সময়ে এডমিরাল চৌধুরী কমিশনের রিপোর্ট পাইলাম। ঐ রিপোর্ট বুঝাইতে তিনি আমার সাথে দেখাও করিলেন। আমরা বিস্তারিত আলোচনা করিলাম। উভয়ে সম্পূর্ণ একমত হইলাম। বেনামা পত্রগুলির সব অভিযোগই সত্য। এ ছাড়াও আরও বহু কেলেংকারি আছে। তিনি সুপারিশ করিলেন। একমাত্র প্রতিকার ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশন গঠন করিয়া কোস্টাল শিপিং পুরাপুরিভাবে কর্পোরেশনের হাতে তুলিয়া দেওয়া। এডমিরালের সুপারিশ আমার খুবই পছন্দ হইল। দুই অংশের মধ্যে নিয়মিত মাল বহন ছাড়াও গরিব জনসাধারণের যাতায়াত সহজ ও সস্তা করিয়া উভয় পাকিস্তানের মধ্যে অধিকতর যোগাযোপ স্থাপনের ব্যবস্থা হইবে। উভয় পাকিস্তানের মধ্যে একাত্মবোধ সৃষ্টি করিয়া পাকিস্তানী জাতি গড়িতে হইলে জনগণের মিলা মিশারব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। রাজধানীর সাথে পূর্ব-পাকিস্তানী জনগণের সস্তা যোগাযোগ স্থাপন শুধুমাত্র জাহাজ-পথেই হইতে পারে। পি. আই. এ.-র যোগাযোগটা বড় লোক ও মধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কাজেই এডমিরাল চৌধুরীর সুপারিশে আমি অত্যন্ত উৎসাহিত হইলাম।

৪. উপকূল বাণিজ্য জাতীয়করণ

আমি সেক্রেটারি মিঃ আযিয আহমদ ও জয়েন্ট সেক্রেটারি মিঃ ইউসুফের সাথে পরামর্শ করিয়া ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশন গঠন করা স্থির করিলাম। কোস্টাল শিপিং সম্পর্কে খুঁটি-নাটি জানিবার জন্য মিঃ ইউসুফকে বোম্বাই পাঠান হইল। কিছুদিন আগে হইতেই ভারত সরকার এই উদ্দেশ্যে ইস্টার্ন শিপিং কর্পোরেশন নামে বোম্বাই এ একটি কর্পোরেশন চালাইয়া আসিতেছিলেন। তিনি বোম্বাই হইতে ফিরিয়া ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশন বিলের কাঠামো খাড়া করিলেন। আমার অনুমোদনক্রমে বিলের মুসাবিদা রচনার জন্য আইন দফতরে উহা পাঠান হইল। জাহাজের মালিকরা প্রেসিডেন্ট মির্যা ও প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের কাছে হত্যা দিয়া পড়িলেন। মালিকদের প্ররোচনায় খবরের কাগযে হৈ চৈ পড়িয়া গেল : বাণিজ্য মন্ত্রী আবুল মনসুর দেশে কমিউনিয়ম আনিতেছেন। ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ করিতেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে জাহাজের মালিকদেরে আমার দফতরে ডাকিয়া বুঝাইতে উপদেশ দিলেন। আমি তদনুসারে জাহাজের মালিকদের সভা ডাকিলাম। তাঁদেয়বুঝাইলাম। কর্পোরেশন তাঁদেরে শেয়ার দেওয়া হইবে, তাঁদেরে জাহাজগুলি কর্পোরেশনের কাছে উপযুক্ত মূল্যে বেচিতে চাইলে কর্পোরেশন খরিদ করিয়া নিবে, এমন কি কর্পোরেশনের ডিরেক্টর বোর্ডে তাঁদের প্রতিনিধি নেওয়া হইবে, সব কথা বুঝাইলাম। এতে কমিউনিয়মের কিছু নাই, তা বলিলাম। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সাহেব পি. আই. এ. স্থাপন করিতে গেলে তৎকালীন ওরিয়েন্ট এয়ার ওমেঘনামক কোম্পানির মালিকরা যে হৈ চৈ করিয়াছিলেন, তার দৃষ্টান্ত দিলাম। কর্পোরেশনের শুধু উপকূল বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ থাকিবে। বৈদেশিক বাণিজ্যে মালিকরা নিজ-নিজ ব্যবসা অবাধে চালাইয়া যাইতে পারিবেন, এসবকথাও বলিলাম।

কিছুতেই কিছু হইল না। মালিকরা খবরের কাগযে আন্দোলন করিয়াই চলিলেন। অনেকগুলি কাগ সম্পাদকীয় লিখিয়া আমার কাজের নিন্দা করিতে লাগিলেন। প্রস্তাবিত কর্পোরেশন টন প্রতি পঞ্চাশ টাকাও জনপ্রতি তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়া কুড়ি টাকা বাঁধিয়া দিলে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে জনগণের ইনটিগ্রেশন যে কত ত্বরান্বিত হইবে আমার এসব কথা অরণ্যে রোদন হইল। অনেকে মনে করেন, সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পতনের অন্যতম প্রধান কারণ আমার এই প্রস্তাব। অসম্ভব নয়। প্রেসিডেন্টের সহিত জাহাজের মালিকদের যোগাযোগ পুরাদমে চলিল। প্রেসিডেন্ট আমাকে ধমকাইলেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে আস্তে চল’-নীতি গ্রহণের উপদেশ দিলেন। আমি আস্তে চলিলাম।

বাণিজ্য-সেক্রেটারি মিঃ আযিয আহমদ কড়া লোক। তিনি নিজের যিদ ছাড়িলেন। অন্য পথ ধরিলেন। দুই দুইবার একই ব্যক্তির হাতে মার খাইয়া তিনি অন্যদিকে এর প্রতিকারের উপায় বাহির করিলেন। একই ব্যাক্তি মানে একই মালিক। যে দুইটি জাহাজের ঘটনা উপরে বলা হইল, উভয়টির মালিক একই ব্যক্তি। এডমিরাল চৌধুরী কমিশনের রিপোর্টে এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনেক কুকীতির কথা বলা হইয়াছে। ঐ রিপোর্ট ভিত্তি করিয়া সেক্রেটারি নৌ-আইন অনুসারে চারটে ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করার প্রস্তাব করিলেন। আমি তাঁর সাথে একমত হইলাম। তিনি সব মোকদ্দমার পূর্ণাঙ্গ নথিপত্র তৈয়ার করিয়া পাবলিক প্রসিকিউটরের অনুকূল মন্তব্য সহ আমার দস্তখতের জন্য পেশ করিলেন। বলিলেন : শিগগির দস্তখত দিবেন। দেরি হইলে উপর হইতে চাপ আসিবে।

সত্য-সত্যই উপর হইতে চাপ আসিল। আমি দেওয়ানি উকিল। খুটি-নাটি না দেখিয়া কাগয় সই করি না। সেক্রেটারি সাহেবের হুশিয়ারি ও তাগিদ সত্ত্বেও সই করিবার জন্য মাত্র একটা দিন সময় নিলাম। সেক্রেটারি সাহেবকে বিদায় করার দুই এক ঘন্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্টের ফোন পাইলাম। মামলার আয়োজনের কথা তাঁর কানে গিয়াছে। আপাততঃ ঐ সব বন্ধ রাখিতে এবং তাঁর সাথে কথা না বলিয়া মামলা দায়ের না করিতে তিনি আমাকে অনুরোধ করিলেন। প্রেসিডেন্টের ফোন রাখিয়াই প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করিলাম। তিনি বলিলেন : প্রেসিডেন্ট স্বয়ং যখন অনুরোধ করিয়াছেন, তখন শুধু তাঁর খাতিরে দুই-একদিন বিলম্ব করা তোমার উচিৎ।

আমি অতঃপর প্রধানমন্ত্রীর সহিত দেখা করিলাম। সেক্রেটারির সহিত পরামর্শ করিলাম। সেটা ছিল বোধ হয় বৃহস্পতিবার। সোমবার পর্যন্ত স্থগিত রাখিতে সেক্রেটারি সাহেব রাজি হইলেন। আমি ঐ মর্মে অর্ডার শীটে অর্ডার লিখিয়া সমস্ত কাগপত্র সেক্রেটারিকে দিয়া দিলাম। তিনি সোমবারের মধ্যেই নথিপত্র পাবলিক প্রসিকিউটর মিঃ রেমও (বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তান হাই কোর্টের জজ) সাহেবের কাছে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে এবং প্রেসিডেন্টকে জানাইলাম ও তাঁদের আদেশ আমি রক্ষা করিয়াছি।

যথাসময়ে চার-চারটা মামলা দায়ের হইয়া গেল। বড়লোক আসামী বিলাত, হইতে ব্যারিস্টার আনিলেন। সমানে-সমানে লড়াইর জন্য সরকার পক্ষ হইতেও। বিলাতী ব্যারিস্টার আনার কথা উঠিল। পাবলিক প্রসিকিউটর মিঃ রেমও বলিলেন তিনিই যথেষ্ট। আমি তাঁর সাথে একমত হইলাম। মামলা এত পরিষ্কার যে বিলাতী ব্যারিস্টারের দরকার নাই। তাই হইল। একটা মামলায় সরকারের জিত হইল। বাকী তিনটা মামলা বিচারাধীন থাকাকালেই সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পতন ঘটিল। পরে শুনিলাম ঐ সব মামলা প্রত্যাহার করা হইয়াছে।

৫. ডবল ও বোগাস লাইসেন্সিং

বাণিজ্য দফতরের ডবল লাইসেন্সিং ও বোগাস লাইসেন্সিং এর দিকে আমার নযর পড়িল। বোগাস লাইসেন্সিংটা দুর্নীতি। কিন্তু ডবল লাইসেন্সিং দুর্নীতি নয়। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়ম মোতাবেকই এই প্রথা চালু ছিল। লাইসেন্সিং দুই প্রকারের : একটা কমার্শিয়াল, অপরটা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল। এছাড়া এক প্রকার লাইসেন্সিং আছে, সেটা কর্মাশিয়ালও নয় ইণ্ডাস্ট্রিয়ালও নয়। সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কলেজ-ইউনির্ভাসিটিকে এবং কোন-কোনও বিশেষ অবস্থায় ব্যক্তিকে নিজ-নিজ প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য বিদেশ হইতে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্যও লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু আমার এখানকার বক্তব্য তাদের সম্বন্ধে নয়। শুধু প্রথমোক্ত কর্মাশিয়াল ও ইণ্ডাস্ট্রিয়াল লাইসেন্সিং এখানকার আলোচ্য। আমি মন্ত্রিত্ব গ্রহণের কয়েকদিন মধ্যেই কোন কোনও অফিসার এবং পাবলিকের কেউ-কেউ ডবল লাইসেন্সিং-এর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং এটা যে পরিণামে জনসাধারণেরই ক্ষতিকর তা বুঝাইয়া দেন। একই ব্যক্তিকে উভয় প্রকার লাইসেন্স দেওয়ার নাম ডবল লাইসেন্সিং। কর্মাশিয়াল লাইসেন্সওয়ালারা বিক্রির উদ্দেশ্যে বিদেশ হইতে মাল আমদানি করেন। আর ইণ্ডাস্ট্রিয়াল লাইসেন্সওয়ালারা নিজ-নিজ শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির জন্য লাইসেন্স পান। সুতরাং কর্মাশিয়াল লাইসেন্স সওদাগর-ব্যবসায়ীদের জন্য। আর ইণ্ডাস্ট্রিয়াল লাইসেন্স শিল্পপতিদের জন্য। শিল্পপতিদের কর্মাশিয়াল লাইসেন্স দিলেই এটা হয় ডবল লাইসেন্সিং। ধরুন, ঔষধ তৈয়ারের একটি কারখানাকে যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল লাইসেন্স দিলেন। তার উপরেও তৈয়ারী ঔষধ আমদানির কর্মাশিয়াল লাইসেন্স তাকেই দেওয়া হইল। এতে জনসাধারণের কিভাবে ক্ষতি হইল, তার বিচার করা যাউক। দেশী কারখানার তৈয়ারী ঔষধ আমদানি করা বিদেশী ঔষধ একই মালিক-বিক্রেতার হাতে পড়িল। তাতে তারা কৌশলে কৃত্রিম ঘাটতি ও অভাব সৃষ্টি করিয়া উভয় প্রকার ঔষধের দাম বাড়াইয়া অতিরিক্ত মুনাফা লুটিতে পারে। কার্যতঃ অনেকে তাই করিতেছিল। এ ধরনের প্রথম অভিযোগ আসে কয়েকটি ঔষধ তৈয়ারীর কারখানার বিরুদ্ধে। এরা সকলেই নামকরা বিদেশী কোম্পানী। আইন বাঁচাইবার জন্য এরা পাকিস্তানে কোম্পানি রেজিস্টারি করিয়াছে। কিন্তু লোক-দেখানো-গোছের নাম মাত্র ঔষধ এদেশে তৈয়ার করে। আসলে যার-তার দেশের ঔষধ-পত্র মাস-স্কেলে বাহু আমদানি করিয়া এ দেশে শুধু বটলিং ও লেভেলিং করে। বোতলও এদেশে কিনে না। লেভেলও এদেশে ছাপে না। সব যার-তার দেশ হইতে আনে। তবু এদের ঔষধের নাম ‘মেড-ইন-পাকিস্তান’। এরা যে লুটতরাজ করিতেছে তার প্রমাণ বাজারের দাম। জনসাধারণ যে অভিযোগ করিতেছে তার প্রমাণ দফতরেই অনেক নালিশ অভিযোগ পত্র পড়িয়া আছে। অফিসারের সাথে পরামর্শ করিলাম। প্রায় সবাই এক বাক্যে ডবল লাইসেন্সিং এর বিরুদ্ধে সুপারিশ করিলেন। আমি ডবল লাইসেন্সিং উঠাইয়া দেওয়ার আদেশ দিলাম। ভাবিলাম, তবে এতদিন এই ব্যবস্থা চলিল কেমন করিয়া? আমার আদেশ জারী হওয়ায় ঐসব কোম্পানির স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আমার সহিত সাক্ষাত করিয়া আমার আদেশের প্রতিবাদ জানাইলেন। স্থানীয় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদেরও কেউ-কেউ তাঁদের পক্ষে সুপারিশ করিতে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করিলেন। এই অন্যায় ব্যবস্থা এতদিন কেন চলিতেছিল, এখন তার কারণ বুঝিলাম। কোম্পানিগুলি আসলে বিদেশী হইলেও এ সবের পাকিস্তানী সংস্থায় স্থানীয় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ অংশীদার। এদের সুপারিশে আমি টলিলাম না। এঁরা আমার উপর গোস্‌সা হইলেন।

আরেক প্রকার লাইসেন্সিং চলিতেছিল। তাকে বলা যায় বোগাস লাইসেন্সিং। আদতে শিল্পের নামগন্ধ নাই। অথচ এইসব অস্তিত্বহীন ‘শিল্পের জন্য যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের ইণ্ডাস্ট্রিয়াল লাইসেন্স এবং তৈয়ারী মালের কর্মাশিয়াল লাইসেন্স বছরের-পর বছর ইশু হইয়া আসিতেছে। এইরূপ অনেকগুলি বোগাস লাইসেন্সিং এর অভিযোগ আমার কানে আসে। আমি বিনাদ্বিধায় এক-ধারসে এদের লাইসেন্স বাতিল করিয়া দেই। এইরূপ একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করিয়া পারিতেছি না। ইতিহাস বিখ্যাত একজন মুসলিম বৈজ্ঞানিকের নাম অনুসারে এই কোম্পানির কত অজানারে গালভরা নাম। প্রতি শিপিং পিরিয়ডে অর্থাৎ ছয়মাসে এগার লাখ করিয়া এই কোম্পানি ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল ও কর্মাশিয়াল লাইসেন্স বাবৎ বছরে বাইশ লক্ষ টাকার লাইসেন্স পাইয়া আসিতেছিল। আমি পরপর কয়েকটি বেনামাপত্র পাই। অভিযোগ গুরুত্তর। কাজেই যাঁকে-তাঁকে দিয়া তদন্ত করান চলিবে না। স্বয়ং শিল্প-সেক্রেটারি মিঃ মোহাম্মদ খুরশিদের উপর এই তদন্তের ভার দিলাম। বলিয়া দিলাম তাঁর নিজের তদন্ত করিতে হইবে।

যথাসময়ে তার রিপোর্ট পাইয়া স্তম্ভিত হইলাম। যতদূর মনে পড়ে তাঁর রিপোর্টের সারমর্ম ছিল এই : করাচির বাহিরে এক রাস্তার ধারে একটি ভাঙ্গা দালানে ঐ নামে একটি সাইনবোর্ড লটকানো। দালানের বারান্দায় কয়েকটি ভেড়া বান্ধা। পাশেই দড়ির খাঁটিয়ায় একটি বুড়া শুইয়া ঘুমাইতেছে। তাকে ডাকিয়া তুলিয়া ঔষধের কারখানার কথা জিগাসা করিলে বুড়া ভড়কাইয়া গেল। সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় ভিতর-বাহির তালাশ করিয়া একটি একসারসাইজ বুক পাওয়া গেল। তাতে করাচি শহরের তিন জায়গার-ঠিকানা-দেওয়া তিনজন লোকের নাম পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে দুইজনকে পাওয়া গেল। অবশেষে তারা স্বীকার করিল যে তারা কথিত কোম্পানি হইতে মাসে একশ টাকা বেতন পায়। ঔষধ বিক্রির তারা এজেন্ট মাত্র এই কথা বলাই তাদের কাজ। ঔষধ বিক্রি তারা কোনও দিন করে নাই। সেক্রেটারির সুপারিশ মত আমি তৎক্ষণাৎ ঐ লাইসেন্স বাতিল করিয়া দিলাম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি লাগাইবার ব্যবস্থা করিতে সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলাম। সেই দিন বা পরের দিন রাত্রে প্রেসিডেন্টের বাড়িতে এক ডিনারে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ও প্রাইম মিনিস্টার এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার সাথে আমার পরিচয় করাইয়া দিলেন। উতয়ে প্রায় এই ধরনের কথা বলিলেন : এঁরা আমার বিশেষ বন্ধু লোক। এদের কোনও উপকার করিলে আমি ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হইব। আমি ওদের সঙ্গে আলাপ করিয়া জানিলাম, ঐ কোম্পানি এঁদেরই। সরলভাবে তারা স্বীকার করিলেন, ওটা অপরাধ হইয়াছে। কৈফিয়ত দিলেন, করি-করি করিয়াও প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও কারখানাটা আজো করিয়া উঠিতে পারেন নাই। সেজন্য তাঁরা দুঃখিত। অতএব তাঁদের বিরুদ্ধে। কোনও ব্যবস্থা গ্রহণে বিরত হইতে হইবে। তাঁদের লাইসেন্সটা অন্ততঃ অংশতঃ মঞ্জুর করিতে হইবে। তাঁরা বাদশাহী বংশের লোক। বর্তমানে অভাবে আছেন। আমাদের দেশের টগরিব ভদ্রলোক’ আর কি? ঐ করিয়াই তাঁরা দুইটা পয়সার মুখ দেখেন। নিজেদের অপরাধকে লঘু করিবার উদ্দেশ্যে যুক্তি দিলেন, নিজেরা কারখানা করিতে না পারিলেও তাঁদের লাইসেন্স তাঁরা কালাবাজারে বিক্রয় করো না। জেনুইন ঔষধের কারখানাওয়ালার কাছে সামান্য মাত্র লাভে বিক্রয় করেন। কাজেই আমার বিবেচনা করা উচিৎ যে সরকারের বিদেশী মুদ্রার ঐ লাইসেন্স অপব্যয়িত হয় না, বরঞ্চ সৎকাজেই লাগে।

আমি ভদ্রলোক ও ভদ্র মহিলার দুঃসাহসিক বুকের পাটা দেখিয়া স্তম্ভিত হইলাম। বলা বাহুল্য তাঁদের প্রতি আমি বিন্দুমাত্র দরদ দেখাইতে পারিলাম না। কিন্তু ফৌজদারিও লাগাইতে পারিলাম না।

৬. আর্টসিল্ক ইণ্ডাস্ট্রি

বোগাস লাইসেন্সের কথা বলিতে গিয়া মনে পড়িতেছে একটি এজমালি বোগাস লাইসেন্সের লুটপাটের কথা। এটি আর্ট-সিল্কের ব্যাপার। আর্টিফিশিয়াল সিল্ক নকল রেশম) শিল্প পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বিলাসদ্রব্য-শিল্প। আমি শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রী হওয়ার সাথে-সাথেই এই শিল্পপতিদের মোলাকাত দাওয়াত ও অভিনন্দনের হিড়িক দেখিয়া আমার মনে সন্দেহ হয়। আমি অফিসারদের মতামত লইতে শুরু করি। এঁদের মধ্যে মিঃ ইসমাইল নামে জনৈক ডিপুটি সেক্রেটারিকে আমার খুব পসন্দ হয়। অফিসারটি সৎ ও ধার্মিক বলিয়া মনে হয়। তিনি এ ব্যাপারে আমাকে অনেক জ্ঞান ও পরামর্শ দান করেন। এই সময় পাকিস্তান সরকার বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার বিদেশী মুদ্রা আটসিল্ক শিল্পে ব্যয় করিতেন। বোঝা গেল, প্রচুর অপব্যয় অবিশ্বাস্য দুর্নীতি ঐ ব্যাপারে চলিতেছে। কাগ-পত্রে দেখা গেল পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় পাঁচ হাজার একশ ও পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ছিয়ানব্বইটা তাঁত চালু আছে। আমার প্রাদেশিক সংকীর্ণ মন প্রথম চোটেই ঐ বিপুল অসাম্যে আহত হইল বটে, কিন্তু দ্বিতীয় চিন্তায় অন্য কথা মনে আসিল। কাগযে-পত্রে ঐ তাঁত চাটগাঁয়ে প্রতিষ্ঠিত বলিয়া দেখা যায়। কিন্তু তথায় কিম্বা পূর্ব পাকিস্তানের কোনও শহরে নকল সিল্কের তাঁত দেখিয়াছি বলিয়া মনে পড়িল না। আমি আগামী সফরে চাটগাঁয় গিয়া ঐ শিল্প পরিদর্শন করিব একথা অফিসে রটনা করিয়া দিলাম। তাতে ফল হইল। সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাঁদের আগের রিপোর্ট সংশোধন করিয়া বলিলেন, পূর্ব-পাকিস্তানের তাঁত সংখ্যা ছিয়ানব্বই নয়, ছয়চল্লিশ। আমার যা বুঝিবার বুঝিলাম। সত্য-সত্যই চাটগাঁয়ে ছয়চল্লিশ কেন ছয়টি তাঁতও পাইলাম না।

আমি মিঃ ইসমাইলকে গোপনে তদন্ত করিবার ভার এবং লিখিতভাবে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দান করিলাম। গোটা ব্যাপারটা প্রধানমন্ত্রীর গোচর করা দরকার মনে করিলাম। আশ্চর্য ও খুশী হইলাম। তিনি নিজেও কিছুদিন হইতে এই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করিতেছিলেন এবং আমাকে কিছু-একটা করিতে বলিবেন বলিবেন মনে করিতেছিলেন। আমি মিঃ ইসমাইলকে গোপন তদন্তের ভার দিয়াছি শুনিয়া তিনি খুশি হইলেন। বুঝিলাম মিঃ ইসমাইলের প্রতি তারও বিশ্বাস আছে। তবে তিনি বলিলেন : এ ধরনের ব্যাপারে একজনের তদন্তে ক্রটি থাকিতে পারে। কাজেই আরেকজনকে দিয়া তদন্ত কান দরকার। তবে দু’জনের একজনও জানিবেন না যে আরেকজনও তদন্ত করিতেছেন। গোপনতদন্ত ষোলআনাই গোপনরাখিতে হইবে।

মনে-মনে প্রধানমন্ত্রীর বুদ্ধির তারিফ করিলাম। তাঁরই প্রস্তাব-মত কর্নেল নাসির নামে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের একজন অফিসারের উপর গোপন তদন্তের ভার দিলাম। মিঃ ইসমাইলের কথা তাঁকে ঘুণাক্ষরেও জানিতে দিলাম না। বলিলাম : ‘ব্যাপারটা সম্পূর্ণ গোপন রাখিবেন। কর্নেল মিলিটারি মানুষ। হাসিয়া জবাব দিলেন : সেকথা আর বলিতে হইবেনা, সার।

যথাসময়ের মাত্র দু-চার দিনের আগে-পরে উভয় রিপোর্টই পাইলাম। আশ্চর্য! উভয় রিপোর্টরই তথ্য-বিবরণই প্রায় এক। সত্যতা ও নির্ভুলতার অকাট্য প্রমাণ। উভয় রিপোর্টের সারমর্ম এই : (১) পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁতের সংখ্যা একান্ন শ না, মাত্র বত্রিশ শ। (২) পূর্ব পাকিস্তানে পাঁচটি তাঁত আছে বটে, তবে চালু না। ইনস্টলই করা হয় নাই। (৩) পশ্চিম পাকিস্তানের বত্রিশ শ’র অধিকাংশ (প্রায় দুই হাজার) তাঁতের যে হিসাব সরকারে দাখিল হইতেছে এবং আমদানি লাইসেন্স পাইতেছে, সবই বোগাস। যে তাঁতগুলি চালু আছে তাদেরও ক্যাপাসিটি অনেক বেশি করিয়া দেখান হয়। অত সূতা খাইবার ক্ষমতা তাদের নাই। (৪) যে বত্রিশ শ তাঁতের অস্তিত্ব আছে, তারও মধ্যে প্রায় অর্ধেক (পনর শ) দেশী কারিগরের তৈয়ারী। এ কথার তাৎপর্য এই যে সমস্ত চালু তাঁতের বাবতই মালিকরা বিদেশী মুদ্রা নিয়াছেন বিদেশী তাঁতের মূল্য বাবৎ। অথচ এই তাঁতগুলি বিদেশ হইতে আমদানি করা হয় নাই। এইসব তাঁত মেরামত করিবার নাম করিয়া স্পেয়ার পার্টস বাবৎ যে বিদেশী মুদ্রা নেওয়া হয়, তাও পাটস আমদানিতে ব্যয় না করিয়া অন্য অসদুপায়ে ব্যয় করা হয়। (৫) বছরে যে সাড়ে তিন কোটি টাকার সূতা আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হয় উপরোক্ত কারণে তার অর্ধেক সূতাও আমদানি হয় না। বাকী টাকা দিয়া উচ্চ চাহিদার মাল আনিয়া শতা চার-পাঁচ শ টাকা মুনাফায় বিক্রি করা হয়।

রিপোর্ট দুইটি বিস্তারিত তথ্য-বিবরণ-পূর্ণ বিশাল আকারের দলিল হইয়াছিল। নষ্ট করা না হইয়া থাকিলে আজও নিশ্চয়ই শিল্প-দফতরে বিদ্যমান আছে। এই রিপোর্ট দুইটি বিচারবিবেচনা করিয়া প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে আমি চলতি শিপিং পিরিয়ডের (ছয় মাসের) সব আমদানি লাইসেন্স এক হুকুমে বাতিল করিয়া দিলাম। করাচি ও সারা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিবাদের ঝড় উঠিল। খবরের কাগযওয়ালারাও আমার উপর আগুন হইয়া গেলেন। পশ্চিমা অনেক মন্ত্রী ও মেম্বর এবং অফিসারদেরও কেউ-কেউ আমাকে বলিলেন : সৎ-অসৎ সবাইকে আমি এক সঙ্গে শাস্তি দিয়াছি। ফলে আট সিল্ক-শিত একদম মারা পড়িবে। জবাবে আমি বলিলাম যদি শিল্পপতিরা লাইসেন্সের পরিমাণ মত সূতা আমদানি করিয়া থাকেন, তবে এক শিপিং পিরিয়ডের আমদানিতে এক বছরের বেশি চলিবার কথা। কাজেই এই ছয়মাসে শিল্প বন্ধ হইবে না।

সহকর্মী ও অফিসাররা নানা যুক্তি দিলেন। হঠাৎ বিনা-নোটিসে বন্ধ করা উচিৎ হয় নাই। আগে নোটিস দিলে এক বছরের খোরাকি জমা রাখিত। জেনুইন মিল কতকগুলি আছে যাদের কাজে ও হিসাবে কোনও ক্রটি নাই। অন্তত এইসব মিলের লাইসেন্স দেওয়া উচিৎ। ইত্যাদি ইত্যাদি। কারও উপর অবিচার ও পক্ষপাতিত্ব না করিয়া কি করা যায়, অফিসারদের সঙ্গে সে বিষয়ে পরামর্শ করিতেছিলাম। এমন সময় খবরের কাগযে এক রিপোর্ট বাহির হইল। তেষট্টি লক্ষ টাকা আদান-প্রদানের ফলে শিল্প-দফতরের আট-সিল্ক-বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা শীঘ্রই প্রত্যাহৃত হইবে।

এই সময় ন্যাশনাল এসেমব্লির বৈঠক চলিতেছিল। বন্ধু ফরিদ আহমদ হাউসের ফ্লোরে, প্রশ্ন করিলেন এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রীর কি বলিবার আছে? আমি উত্তরে বলিলাম : ‘কতিপয় পশ্চিম পাকিস্তানী সহকর্মীর অনুরোধে ও উচ্চপদস্থ বিভাগীয় অফিসারদের পরামর্শে আমি উক্ত নিষেধাজ্ঞার আংশিক সংশোধনের চিন্তা করিতেছিলাম। কিন্তু এই গুজব প্রকাশের পর এ বিষয়ে আর কোনও উপায় থাকিল না।

পার্লামেন্ট শান্ত হইল বটে, কিন্তু শিল্পপতিরা অশান্ত হইয়া উঠিলেন। আমার সঙ্গে মোলাকাত চাহিলেন। আমি দেখা দিলাম না। আসিল্ক এসোসিয়েশনের পক্ষ হইতে বর্ডার-ঘেরা এক বিশালাকারের বিজ্ঞপ্তিতে তাঁরা মাফ চাহিলেন এবং পর পর কয়েক দিন ধরিয়া ঐ বিজ্ঞপ্তি বড়-বড় দৈনিকে ছাপা হইল। তাতে যা বলা হইল তার সারমর্ম এই ঐ গুজবের মূলে তাঁদের কোনও হাত নাই। শিল্পপতিদের অনিষ্ট করার উদ্দেশ্যেই শত্রুপক্ষ হইতে ঐ গুজব রটান হইয়াছে। গুজবটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আট সিল্ক-শিল্প মালিকদের পক্ষ হইতে এ ব্যাপারে কোনও আদান-প্রদান করা বা তার কথা হয় নাই। শিল্প মালিকরা এই গুজবের জন্য শিল্প মন্ত্রীর খেদমতে ক্ষমা চাহিতেছেন। এই গুজবে প্রভাবিত না হইয়া আট-সিল্ক-মালিকদের প্রতি সুবিচার করিবার জন্য মন্ত্রী মহোদয়কে অনুরোধ করা যাইতেছে। ইত্যাদি।

ওদের কথা সত্য হইতে পারে। কিন্তু আমার কোনও উপায় ছিল না। প্রাপ্ত দুইটি রিপোর্টের ভিত্তিতে আমাকে কাজ করিতে হইবে। যে কিছু সংশোধন আমি করিতে রাযী হইয়াছিলাম, তাও আমি এখন পারি না। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি লইয়া আমি ব্যাপারটা কেবিনেটে পাঠাইলাম এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন করিলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে আমার শত্রুর সংখ্যা ও শক্তি উভয়টাই বাড়িয়া গেল।

৭. তঞ্চকী লাইসেন্স

বোগাস লাইসেন্সিং-এর প্রকারান্তর ছিল তঞ্চকী লাইসেন্স। এমনি একটা ব্যাপারের দৃষ্টান্ত দেই। খুব বড় এক শিল্পপতি। বর্তমানে আরও বড় হইয়াছেন। হরেক রকমের শিল্প করেন। তৎকালে এরা পাইপ ম্যানুফেকচারিং করিতেন। খুব নিচের তলা হইতে একটি মোটা ফাইল আপিলের আকারে আমার সামনে পেশ হইল। আমি কি কারণে মনে নাই, ফাইলটির আগাগোড়া পড়িলাম। হঠাৎ খুব নিচের তলার একজন কোনির একটি নোট আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। তাতে লেখা আছে যে অমুক ব্যাপারটা সম্বন্ধে উক্ত অফিসার একাধিক বার উপরস্থ অফিসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। কিন্তু কোনও ফল হয় নাই। উক্ত বড় শিল্পপতির কারখানার তৈয়ারী পাইপ সরকারের বিভিন্ন দফতরের পক্ষে ডি. জি. এস, এণ্ড ডি. খরিদ করিয়াছেন। কয়েক লক্ষ টাকার বিল বাকী পড়িয়া আছে। অনেকবার তাগাদায়ও কোম্পানি টাকাটা পাইতেছে না। এই জন্যই মন্ত্রী পর্যায়ে এই নালিশ আসিয়াছে। বিভিন্ন দফতর বিভিন্ন অজুহাতে নিজেদের বিলম্বের হেতু দেখাইয়াছে। বিল চেক হয় নাই, মাল শট সাপ্লাই আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এরই মধ্যে এক দফতরের নিম্নস্তরের উক্ত কর্মচারি এক্সেসিভ বিলিং এর হেতু খাড়া করিয়াছেন। ভদ্রলোকের নোটে বলা হইয়াছে, তিনি এর আগেও এই হেতু দিয়াছিলেন। কিন্তু উপরস্থ কর্তৃপক্ষ তাঁর কথায় কান দেন নাই। আমার কান খাড়া হইল। সুতরাং কান দিতে বাধ্য হইলাম। ফাইলটা আরও পিছন দিক হইতে পড়িলাম। বুঝিলাম পাইপ-নির্মাতা কোম্পানি আমদানি মালের যে দাম বলেন, আসলে তার অর্ধেক দামে মাল আনেন। কিন্তু বেশি দাম দেখাইয়া তৈয়ার খরচা বেশি লেখাইয়া সরকার ও পাবলিক উভয়ের নিকট হইতে প্রায় ডবল দাম আদায় করিয়া থাকেন। আমি ব্যাপারটা লইয়া অর্থমন্ত্রী মিঃ আমজাদ আলীর সঙ্গে পরামর্শ করিলাম। তাঁর উপদেশ মত বিদেশে খবর নিলাম। পাইপ তৈয়ারি হইত পশ্চিম জার্মানি হইতে আমদানি-করা স্টিলের পাত দিয়া। আমি বনে অবস্থিত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত কর্মাশিয়াল সেক্রেটারি ও ডি, জি, এস,এও ডি-র অফিসারের মারফত অতি সহজেই উক্ত পাতের জার্মান সরবরাহকারীর-নেওয়া দাম জানিতে পারিলম। হিসাব করিয়া দেখা গেল, উক্ত শিল্পপতি এইরূপ তঞ্চকতা করিয়া এই কয় বছরে সরকারকে বহু লাখ টাকা ঠকাইয়াছেন। পাবলিকের দেওয়া টাকার হিসাব ধরিলে কয়েক কোটি হইবে। আমি স্বভাবতই খুব কড়া আদেশ দিলাম। বিচারাধীনে বিলের টাকা আটক দিলাম। অতীতের দেওয়া টাকা কেন রিফাও হইবে না, তার কারণ দশাইবার অর্ডার দিলাম। লাইসেন্স বাতিল করিলাম। খুবই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী পার্টি। সুরাং ব্যাপারটা কেবিনেটে গেল। তথায় অর্থমন্ত্রী মিঃ আমজাদ আলী আমাকে জোর সমর্থন দিলেন। শিল্পপতি ন্যায্য দামের হিসাবে টাকা নিবেন এই শর্তে শেষ পর্যন্ত সংশোধিত হারে তাঁর লাইসেন্স বজায় রাখা হইল। সরকারের বহু টাকা বাঁচিয়া গেল। আমি উক্ত নিম্নস্তরের কর্মচারির প্রমোশনের সুপারিশ করিয়াছিলাম।কিন্তু শিল্পপতিটি বোধ হয় জীবনেও আমাকে মাফ করিতে পারেন নাই।

৮. নিউ কামার

বাণিজ্য দফতরে আমি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রবর্তন করিয়াছিলাম। এটি আমদানি ব্যবসায়ে ‘নিউ কামারের’ সুবিধা দান। পূর্ববর্তী সরকারেরা আমদানি ব্যবসায়টি একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করিয়াছিলেন। এদেবেলা হইত ‘কেটিগরি হোল্ডার’। ১৯৫২ সালে যাঁরা আমদানি-ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন, সরকার তাদের একটা তালিকা করিয়াছিলেন। এদের নামই কেটিগরি-হোন্ডার। শুধু এরাই আমদানি লাইসেন্স পাইতেন। আমি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়া যখন ব্যাপারটা দেখিতে পাইলাম তখন ঘোষণা করিলাম এটা ন্যায়-নীতি গণতন্ত্র এমনকি ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার বিরোধী। কেটিগরি-হোল্ডার নামক শ্রেণী সৃষ্টি করিয়া কার্যতঃ মুসলিম সমাজে এক বৈশ্য সম্প্রদায় আমদানি করা হইয়াছে। ১৯৫২ সালে বা তার আশেপাশে পূর্ব-বাংগালীরা আমদানি ব্যবসায়ে কোনও উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করে নাই। ফলে কেটিগরি হোন্ডারদের মধ্যে কি সংখ্যায় কি পরিমাণে পূর্ব বাংগালীর কোনও স্থান ছিল না বলিতে পারা যায়। এই ধরনের কেটিগরি-হোর শ্রেণী রাখিলে পূর্ব-বাংলার লোকেরা চিরতরে আমদানি ব্যবসা হইতে বাদ থাকিবে। এই ঘোষণায় কেটিগরি হোন্ডারদের মধ্যে হৈ চৈ পড়িয়া গেল। তাঁরা সবাই বিত্তশালী ও প্রভাবশালী লোক। তাঁদের প্রভাব কাটাইয়া উঠিতে সময় লাগিয়াছিল। অনেক সাধ্য-সাধনার পর বিশেষতঃ প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় সমর্থনের ফলে শেষ পর্যন্ত আমার প্রস্তাবিত ‘নিউ কামার’ নীতি গৃহীত হইল। ব্যবস্থা হইল, নূতন লোক বিশেষতঃ পূর্ব-পাকিস্তানী নূতন ব্যবসায়ীকে আমদানি লাইসেন্সের অধিকার দেওয়া হইবে এবং পুরাতন কেটিগরি হোল্ডারদের কার্য-তৎপরতা, সাধুতা, সততা বিচার করিয়া ঐ তালিকা সময়-সময় সংশোধন করা হইবে। এই ব্যবস্থা প্রবর্তনে পূর্ব-পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের মধ্যে যেমন উল্লাস সৃষ্টি হইল, পশ্চিম পাকিস্তানী বিশেষতঃ করাচির ব্যবসায়ী মহল আমার প্রতি উম্মায় তেমনি ফাটিয়া পড়িল।

৯. দেওয়ানী কার্যবিধির প্রবর্তন

লাইসেন্সিং ব্যাপারে আমার আরেকটি সংস্কার একেবারে ছিল অভিনব ধরনের। এটি ছিল দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের ব্যবস্থা প্রবর্তন। দেওয়ানী কার্যবিধিতে মামলার পক্ষগণের প্রতিকারের উপায় তিনটি : রিভিউ, আপিল ও রিভিশন। আমি লাইসেন্সিং ব্যাপারে এই তিনটি স্তরের প্রবর্তন করিলাম। লাইসেন্স ইশুর ব্যাপারে কারও আপত্তি থাকিলে প্রার্থীকে সর্বপ্রথম ইশুইং অফিসারের কাছে রিভিউ পিটিশন দিতে হইবে। তাঁর বিচারে যে পক্ষ আপত্তি করিবেন তিনি বাণিজ-সেক্রেটারির কাছে আপিল দায়ের করিবেন। সেক্রেটারির উভয় পক্ষকে যথাযোগ্য শুনানি দিবার পর রায় দিবেন। সেই রায়ে যে পক্ষের আপত্তি থাকিবে, তিনি সর্বশেষ পন্থা হিসাবে মন্ত্রীর কাছে রিভিশন পিটিশন দায়ের করিবেন। এই তিন প্রকারের দরখাস্তে দেওয়ানী মোকদ্দমার মতই নির্ধারিত হারে কোট-ফি দেওয়ার আইন করিলাম।

এই ব্যবস্থা করিয়াছিলাম, প্রধানতঃ মন্ত্রীর সাথে মোলাকাতীর ভিড় কমাইবার উদ্দেশ্যে। তাছাড়া এই ব্যবস্থায় প্রকৃত অবিচারিত লোকদের উপকার হইয়াছিল। কিভাবে, এখানে তার উল্লেখ প্রয়োজন। মন্ত্রীদের দরবারে স্বভাবতঃই সমর্থক ও উপকার-প্রত্যাশীদের ভিড় হয়। হওয়া স্বাভাবিক। মন্ত্রীরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। নিয়ম-কানুনের সাত দরজা প্য হইয়া মন্ত্রীদের সাক্ষাৎ পাওয়া এবং নিজেদের দুঃখের কথা বলার সুযোগ অ লোকের ভাগ্যেই ঘটিয়া থাকে। কাজেই মন্ত্রীরা মফস্বলে সফর করিতে বাহির হইলে অভিনন্দন-সম্বর্ধনার নামে এবং ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ-মোলাকাত করিয়া তাঁরা নিজেদের অভাব-অভিযোগের কথা বলেন। রাজধানীতে আসিয়া তাঁরা অফিসে দেখা-সাক্ষাতের আশা ত্যাগ করিয়া মন্ত্রীদের বাড়িতে ভিড় করেন। রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে এটা আমার জানা ছিল। জন প্রতিনিধি হিসাবে এ ব্যাপারে আমি খুবই সচেতনও ছিলাম। কাজেই ফাইলপত্র ডিসপোয় করা বিলম্বিত হওয়া সত্ত্বেও সাক্ষাৎ-প্রার্থীদের সহিত অল্পক্ষণের জন্য হইলেও মোলকাত দিতাম। এই ধারণা ও পণ লইয়াই আমি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াছিলাম। প্রথম-প্রথম চালাইলামও ঐভাবে। কিন্তু নয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানের শিল্প দফর ও বাণিজ্য দফতর যে কত বড় মহা সমুদ্র এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট মোলাকাতীর সংখ্যা যে কি পরিমাণ হইতে পারে, মন্ত্রিত্ব জীবনের ছয় মাস যাওয়ার আগে তা সঠিকভাবে অনুভব করিতে পারিলাম না। যখন পারিলাম, তখন আমার অনাহারে মরিবার দশা। সকালে ছয়টার সময় হইতেই দর্শনপ্রার্থীর ভিড়। একাধিক ড্রয়িং রুম, অফিস ঘর, ওয়েটিং রুম ও বারান্দাসমূহ লোকারণ্য। গোসল নাশতা সারিয়া সাতটার আগে নিচে নামা সম্ভব হইত না। সাতটা হইতে নয়টা পর্যন্ত বাড়িতে মোলাকাতীদের চার ভাগের একভাগ লোককেও দেখা দিয়া সারিতে পারিতাম না। এদের সকলেই বিনা-এপয়েন্টমেন্টে আসিয়াছেন। সুতরাং প্রাইভেট সেক্রেটারিরাই এদের ক্রম নির্ধারণ করিয়া এক জনের পর আরেক জনকে আমার সামনে আনিতেন। এ ব্যাপারে প্রাইভেট সেক্রেটারিদের বিবেচনাকেই চূড়ান্ত বলিয়া না মানিয়া উপায় ছিল না। কিন্তু দর্শনপ্রার্থী যাঁরা পিছে পড়িতেন এবং তার ফলে বাদ পড়তেন, তাঁদের অনেকের অভিযোগ ছিল যে প্রাইভেট সেক্রেটারিরা পক্ষপাতিত্ব করিয়া তাঁদের পিছে ফেলিয়াছেন এবং ঐ কৌশলে মন্ত্রীর সাথে তাঁদের মোলাকাত হইতে দেন নাই। এই শ্রেণীর অভিযোগের কোনও সীমা ছিল না। প্রতিকারের কোনও উপায় ছিল না। _ তারপর ঘড়ির কাঁটায়-কাঁটায় নয়টার সময় উঠিয়া পড়িতাম। মোলাকাতীদের এড়াইয়া পিছনের গেট দিয়া বাহির হইয়া পড়িতাম। এই উদ্দেশ্যে ড্রাইভার গাড়ি লইয়াঅফিস ঘরের ঠিক পিছনেই অপেক্ষা করিতে থাকিত।

১০. মন্ত্রীর দুদর্শা

আফিসে কিন্তু মোলাকাতীর ভিড় ঠেলিতে হইত না। মোলাকাতী থাকিতেন ঢের। কিন্তু তাঁদের জন্য ওয়েটিং রুম ছিল। বান্দায় দাঁড়াইয়া থাকিতে দেওয়া হইত না। লম্বা বারান্দার আগা-গোড়াই সেক্রেটারি, জয়েন্ট-সেক্রেটারি ও ডিপুটি সেক্রেটারিদের অফিস-ঘর। কাজেই আমি যখন এক প্রান্তের সিঁড়ি দিয়া দূতালায় উঠিয়া আগাগোড়া বারান্দাটা হাঁটিয়া অপর প্রান্তে আমার অফিসে ঢুকিতাম, তখন সবগুলি অফিস-ঘরের সামনে দিয়া আমার যাওয়া, প্রকারান্তরে পরিদর্শন, হইয়া যাইত। অথচ মোলাকাতীরা আমার পথ আটকাইয়া দাঁড়াইতে পারিতেন না। আমি অসুস্থ বলিয়া ডাক্তারদের এবং বিশেষ করিয়া আমার স্ত্রীর তাগিদ ছিল ঠিক একটার সময় বাসায় ফিরিয়া খানা খাইতে হইবে। দুইটার মধ্যে খানা শেষ করিয়া পান খাইয়া ও হার নল মুখে লইয়া বিছানা লইতে হইবে। দুই ঘন্টা ঘুমাইয়া চারটা সাড়ে চারটায় উঠিতে হইবে। আধ ঘন্টায় হাত-মুখ ধুইয়া বিকালের চা খাইয়া তারপর বাসার অফিস ঘরে বসিতে পারা যাইবে।

কিন্তু কার্যতঃ তা হইতে পারি না। কারণ অফিসের চার ঘন্টা সময়ের মধ্যে সেক্রেটারি-প্রাইভেট সেক্রেটারিরা পরামর্শ করিয়া মাত্র এক ঘন্টা মোলাকাতের জন্য রাখিতেন। বাকী তিন ঘন্টা মিনিট-সেকেণ্ড হিসাব করিয়া অফিসের কাজ ও বিদেশী ডেলিগেশন ইত্যাদির জন্য মোরর করিতেন এবং সময় ঠিক রাখিবার কড়াকড়ি চেষ্টা করিতেন। বিদেশী ডেলিগেশন ইত্যাদি ঠিক টাইম মত আসিতেন। আফিসের ফাইল-পত্র দেখা ও অফিসারদের সাথে আলোচনা নির্ধারিত সময়-মতই হইয়া। যাইত। কিন্তু মুশকিল হইত মোলাকাতীদেরে লইয়া। প্রাইভেট সেক্রেটারি হয়ত প্রতিজনের জন্য পাঁচ-ছয় মিনিট করিয়া এক ঘন্টায় দশজন মোলাকাতী রাখিলেন। তাঁদের একাজে অসুবিধা হইত না। কারণ চিঠিপত্র-যোগে এপয়েন্টমেন্ট না করিয়া এখানে কেউ মন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাইতেন না। কিন্তু মুশকিল হইত আমার। বোধ হয় সব মন্ত্রীরই। কারণ পাঁচ মিনিটের জন্য প্রবেশাধিকার দেওয়া হইলেও আধঘন্টা অন্ততঃ দশ-পনর মিনিটের কমে কেউ বাহির হইতেন না। আফিসের কাজ শুরু করিবার আগে মোলাকাতী শেষ করার নিয়ম ছিল। কিন্তু আমি এই নিয়ম পাল্টাইয়া দিয়াছিলাম। আফিসের কাজ শেষ করিয়াই মোলাকাত শুরু করিতাম। তদনুসারে মোলকাতীরা আগের মত সকালে না আসিয়া বিকালে আসিতেন। তাঁদের পাওয়া পত্রে অবশ্যই মোলাকাতের সময় ঘন্টা-মিনিটিসহ লেখা থাকিত। কিন্তু প্রথম মোলাকাতী ছাড়া আর কেউ সেই নির্ধারিত সময়ে সাক্ষাৎ পাইতেন না। কারণ প্রথম মোলাকাতীই বেশি সময় নিয়া পরবর্তীদের আনুপাতিক হারে পিছাইয়া দিতেন। যেহেতু আফিসের কাজ আগেই শেষ হইয়া যাইত, সেইজন্য নির্দিষ্ট সব মোলাকাতী শেষ না করিয়া আমি উঠিলাম না। মনে করিতাম, বেচারা আগে হইতে এপয়েন্টমেন্ট করিয়া আসিয়াছেন। তাঁকে মোলাকাত দেওয়া আমার অবশ্য কর্তব্য। অপরাপর মোলাকাতীরা তাঁদের প্রাপ্য সময়ের বেশি সময় নিয়াছেন বলিয়া কাউকে ত বঞ্চিত করা যায় না। সময় কন্ট্রোল না করার জন্য কাউকে যদি শাস্তি পাইতে হয়, তবে আমাকেই। কাজেই শাস্তি আমিই বহন করিতাম। মোলাকাত শেষ করিতে-করিতে প্রায়ই আমার তিনটা বাজিয়া যাইত। বাড়ি হইতে স্ত্রীর কম-সে-কম দশটা টেলিফোন পাইতাম। প্রথম প্রথম অনুরোধ, তারপর তাগাদা, তারপর ধমক ও রাগ। আসি-আসি করিয়াও আসিতে পারিতাম না। প্রাইভেট সেক্রেটারিরাও তাগিদ করিতেন। শুকনা হাসি-হাসিয়া বলিতাম : আর কতজন আছেন?

অবশেষে ক্ষুধায় ক্লান্ত পিয়াসে শুকনা-মুখ ও স্ত্রীর রাগে মেযাজ খারাপ করিয়া তিনটার পরে যখন বাসায় ফিরিতাম, তখন দেখিতাম গেট হইতে সিঁড়ি পর্যন্ত মোলাকাতীর ভিড়। দারওয়ান, ডাইভার, বডিগার্ড, প্রাইভেট সেক্রেটারি সকলের তাগাদা এ অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁরা পথ ছাড়িতেন না। কাজেই গেটেই গাড়ি হইতে নামিয়া হাঁটিয়া ঘর পর্যন্ত পৌঁছিতে আমার খুব কম করিয়া হইলেও আধঘন্টা লাগিত। আমি ক্ষিধায় মারা গেলাম, রোগী মানুষ, ঔষধ খাইতে হইবে ইত্যাদি কত আবেদন নিবেদন করিতাম হাতজোড় করিয়া। বডিগার্ড ও গেটকিপাররা পুলিশের লোক। তারা বাধ্য হইয়া প্রথম-প্রথম পুলিশী মেযাজ ও কায়দা দেখাইতে চাহিত। আমি ধমক দিয়া বারণ করিতাম। কারণ আমি মোলকাতীদেরই চাকর। কিন্তু আমার মনিব’রা আমার স্বাস্থ্য ও সুবিধার কথা চিন্তা করিয়া আমাকে ছাড়িয়া দিতেন না। তাঁদের পক্ষেও যুক্তি ছিল। বহুদূর হইতে তাঁরা আসিয়াছেন। করাচিতে অত-অত করিয়া আর থাকিতে পারেন না। তুলনায় তাঁদের অসুবিধা কত। আমার ত মাত্র একদিনই খাওয়ার সামান্য বিলম্ব হইবে। এইটুকু অসুবিধা কি আমি তাঁর জন্য মানিয়া নিব না? সকলেরই ঐ এক কথা। সকলেই মনে করেন তাঁর অসুবিধাটাই বড়। সকলেই মনে করেন, তারটা শুনিলেই আমার কর্তব্য শেষ হইবে। সমবেত লোকদের সকলকে পাঁচ মিনিট করিয়া শুনিলেও আমাকে ঐখানেই রাত দশটা পর্যন্ত ঠায় দাঁড়াইয়া থাকিতে হইবে, একথা যেন কারও মনে পড়ে না। প্রত্যেক দিনের এই দর্শনার্থীদের ধারণা শুধু ঐ একটা দিনই আমি তিনটার সময় অভুক্ত ক্লান্ত ও পিপাসার্ত হইয়া বাড়ি ফিরিতেছি। কাজেই একটা দিন না খাইয়া থাকিলেই বা কি? তাঁরা নিজেরা কতদিন অমন সারাদিন অনাহারে থাকিয়া রাত্রে খানা খাইয়াছেন। আমি মন্ত্রী হইয়াছি বলিয়াই কি তা পারিব না? তাঁদের দিক হইতে ঐ অভিযোগ ঠিক। কারণ তাঁরা সকলে জানিতেন না, জানিলেও বুঝিতেন না, যে ঐ এক দিন নয়, দিনের পর দিন মাসের পর মাস এই গরিব বেচারা মন্ত্রীর উপর দিয়া অমনি ধরনের মোলাকাতীর ঝড়-তুফান চলিতেছে।

কাজেই দেওয়ানী কার্যবিধি-আইন চালাইয়া নিজেকে বাঁচাইলাম। কয়েকদিন সময় লাগিল।অফিসে ও বাড়ির সাইনবোর্ডে খবরের কাগযে প্রেসনোট এবং ব্যক্তিগত পত্রের জবাবে এই নব-বিধান প্রচারিত হইতে কয়েক দিন কাটিয়া গেল। আল্লার মর্জিতে তারপর সব পরিষ্কার। বাড়ির বৈঠকখানা ওয়েটিং রুম বারান্দা এবং অফিসের ওয়েটিং রুম একেবারে সাফ। শূন্য ময়দান খা খা করিতেছে। নিজের বুদ্ধির তারিফ করিলাম নিজেই। অফিসাররাও বাহ-বাহ করিতে লাগিলেন। দর্শনাভিলাষীরা গাল দিতে লাগিলেন। সভা-সমিতি ও পথে-ঘাটে প্রতিবাদ করিতে লাগিলেন। আমি নীরবে, নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে অফিসের কাজে ও পলিসি নির্ধারণে প্রচুর সময় পাইলাম ও তার সদ্ব্যবহার করিলাম।

১১. শিল্প-বাণিজ্যের যুক্ত চেম্বার

শিল্প-বাণিজ্য দফতরের সংস্কার প্রবর্তন ছাড়াও আমি স্বয়ং শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের চেষ্টাও করিয়াছিলাম। এই উদ্দেশ্যে আমি চেম্বার অব-কমার্স ও চেম্বার-অব-ইণ্ডাস্ট্রিসকে একত্রে করিয়া চেম্বার-অব-কমার্স এও ইণ্ডাস্ট্রিজ করিবার পরামর্শ দেই। উভয় চেম্বারের নেতাদের সভা ডাকিয়া বক্তৃতা করি। মন্ত্রী হিসাবে যেখানেই এঁরা আমাকে অভ্যর্থনা-অভিনন্দন দিয়াছেন সেখানেই আমি এই উপদেশ বর্ষণ করিয়াছি। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, প্রতিযোগিতা হইতে রেষারেষি, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে শত্রুতার ভাব, বিদ্যমান ছিল। কাজেই তাঁরা আমার উপদেশ মানেন নাই। বরঞ্চ তাঁদের স্বার্থবিরোধী কথা বলিতেছি মনে করিয়া অনেকেই আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছেন। আমার কার্যকলাপে শিল্পপতি ও সওদাগরদের অনেকেই আমাকে তাঁদের দুশমন মনে করিতেন। কাজেই আমার দ্বারা তাঁদের স্বার্থের অনুকূল কোনও সদুপদেশ সম্ভব, এটা তাঁরা বিশ্বাস করিতেন না। আমি কিন্তু সত্য-সত্যই তাঁদের ঐক্যে বিশ্বাস করিতাম। আমি মনে করিতাম তাঁদের ঐক্যে সরকার ও তাঁরা নিজেরা উভয় পক্ষই লাভবান হইবেন। দেখিয়া শুনিয়া আমার এই অভিজ্ঞতা হইয়াছিল যে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে যতদিন সমাজবাদের প্রতিষ্ঠা না হইতেছে, ততদিন সংঘবদ্ধ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের যুক্ত উপদেশ পাওয়া সরকারের সুষ্ঠু নীতির জন্য অপরিহার্য। ব্যক্তিগতভাবে কোনও শিল্পপতির বা ব্যবসায়ীর কিছু না করার একমাত্র রক্ষাকবচ এঁদের চেম্বার। ওঁদের যা বলার চেম্বার হইতে বলা হউক, এই কথা বলিতে পারিলেই আপনি ব্যক্তি সন্তুষ্টির চাপ হইতে রক্ষা পান। ঠিক তেমনি পৃথক-পৃথকভাবে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সন্তুষ্টির চাপ হইতে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র প্রতিষেধক তাঁদের যুক্ত প্রতিষ্ঠান। আমি অল্পদিনের অভিজ্ঞতা হইতেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম বাণিজ্যনীতি নির্ধারণ ও ঘোষণার সময় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা শুধু যার-তার সম্প্রদায়ের স্বার্থ বিবেচনা করিয়া তদবির ও চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। তাঁদের অনুরোধ বা সুপারিশ শুধু পরস্পরের বিরোধী হয় না, সরকার ও দেশের স্বার্থবিরোধীও হইয়া থাকে। সেজন্য আমি তাদের মধ্যে বক্তৃতা করিয়া সরলভাবে আমার মনের কথা যেমন বলিলাম, তেমনি তাঁদের শক্তিবৃদ্ধির নিশ্চিত সম্ভাবনাও দেখাইলাম। আমি বলিলাম : শিল্প ও বাণিজ্য-নীতি নির্ধারণে সরকার কোনও ভুল না করেন, সেজন্য শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী উভয় সম্প্রদায়ের সুচিন্তিত ও সংঘবদ্ধ উপদেশ পাওয়া দরকার। সরকার ভুল করিলে দেশবাসীর সাথে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হয়। সেজন্য সরকারকে উপদেশ দেওয়ার অধিকার ও দায়িত্ব তাঁদের। আর সংঘবদ্ধভাবে উপদেশ দিলে সরকার সে উপদেশ মানিতে বাধ্য হইবেন।

আগেই বলিয়াছি, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা আমার অমন ভাল উপদেশটাও সন্দেহের চক্ষে দেখিতেন। কাজেই তাঁরা আমার কথা রাখেন নাই। সুখের বিষয় মার্শাল লর আমলে সরকার একরূপ জোর করিয়াই যুক্ত চেম্বার-অব-কমার্স এণ্ড ইণ্ডাষ্ট্রিজ করাইয়াছেন। এতদিনে নিশ্চয় তাঁরা বুঝিয়াছেন এতে তাঁদের ভালই হইয়াছে।

১২. চাকুরিতে পূর্ব-পাকিস্তানী

মন্ত্রী হিসাবে আমার অপর উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চাকুরিতে পূর্ব-পাকিস্তানীদের দাবি যথাসম্ভব পূরণের চেষ্টা করা। চাকুরি-বাকুরিতে প্যারিটির পক্ষে আমি যত বক্তৃতা করিয়াছি, তেমন আর কেউ করেন নাই। কিন্তু কিছুদিন মধ্যেই আমি বুঝিয়াছিলাম স্বাভাবিক অবস্থায় প্যারিটি দাবি করা অবাস্তব, আশা করা পাগলামি। একথা আমাকে সমঝাইয়াছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চ পদাধিকারী একজন রাষ্ট্র নেতা। তিনি আমাকে অত্যন্ত সরলভাবে বলিয়াছিলেন : মনে রাখিও মুসলমানেরা ভারতে সরকারী চাকুরিতে অংশ দাবি করায় হিন্দুরা তাদের ভারত মাতাকে দ্বিখণ্ডিত করিতে রাযী হইয়াছে তবু চাকুরিতে অংশ বসাইতে দেয় নাই। অতঃপর প্যারিটি লাভের আশা মনে মনে ত্যাগ করিলেও মুখে-মুখে প্যারিটির কথা পুনঃপুনঃ উচ্চারণ করিতাম। তাই আমার অধীনস্থ দুইটা দফতরে কোনও ভ্যাকেন্সি হইলেই পূর্ব পাকিস্তানী নিবার প্রস্তাব দিতাম। আমার অভিপ্রায় ব্যাহত করিবার জন্য অফিসারেরা কত যে প্রথারীতি আইন-কানুন রুল ও রেগুলেশন দেখাইতেন তাতে আমার মত অনভিজ্ঞ ও অল্পবুদ্ধির লোক ভেবাচেকা খাইতে বাধ্য হইত। রাগ করা ছাড়া কোন উপায় থাকিত না। আমার রাগকে বিষহীন ধোঁড়া সাপের ফনা মনে করিয়া অফিসাররা বোধ হয় আস্তিনের নিচে হাসিতেন। অনেক ঘটনার মধ্যে একটির কথা বলিতেছি।

আমার কথামত একজন ‘পূর্ব-পাকিস্তানীকে’ তাঁরা একবার চাকুরি দিলেন। আমার সন্দেহ হওয়ায় কাগপত্র তলব করিয়া দেখিলাম। একজন লোক মাত্র দুই বছর আগে মাদ্রাজ হইতে পাকিস্তানে আসিয়াছেন। তাঁর কোনও আত্মীয় কোয়েটার চাকরি করেন। সেখানেই তিনি দুই বছর যাবত আছেন। পূর্ব পাকিস্তানীর কোটায় এই চাকুরিটি খালি হওয়ার পর ঐ যুবক পূর্ব-পাকিস্তানী হিসাবে দরখাস্ত করিয়াছেন। দফতর হইতে তাঁর নাম পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিবেচনার জন্য পাঠান হইয়াছে। কমিশন যথারীতি কর্তব্য করার পর তাঁর নিয়োগ সুপারিশ করিয়াছেন। তিনি চাকরিতে বহাল হইয়াছেন। কোয়েটাবাসী মাদ্রাজী যুবক পূর্ব-পাকিস্তানী হইলেন কিরূপে? অতি সহজে। ঢাকা জিলা কর্তৃপক্ষ সার্টিফিকেট দিয়াছেন যে উক্ত যুবক এক বৎসরের অধিককাল পূর্ব-পাকিস্তানের ডমিসাইল। আমার তালু-জিহ্বা লাগিয়া গেল। আমি এ বিষয় লইয়া ভোলপাড় শুরু করিলাম। কমিশন ঠিকই জানাইলেন সরকারী ডমিসিল সার্টিফিকেট পাইবার পর ও বিষয়ে আর তাঁদের করণীয় কিছু ছিল না। আমাকে শান্ত করিবার জন্য বিভিন্ন দিক হইতে এবং অফিস ফাঁইলে এমনও ‘নোট’ আসিল যে একজন পাকিস্তানীর চাকুরি যেভাবেই হউক যখন হইয়া গিয়াছে, তখন এটা নিয়া এখন হৈ চৈ করা ঠিক হইবে না। আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে ত যে ভারত হইতে আগত মোহাজেরদেরও আমাদের চাকুরি-বাকুরিতে একটা দাবি আছে। সব নোটর শেষে আমি লিখিতে বাধ্য হইলাম। কিন্তু একথাও আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে যে পাকিস্তানের দুইটি মাত্র উইং। ভারতে ইহার কোনও তৃতীয় উইংনাই।

আরেকটি ঘটনা আরও মর্যাদার। বিভিন্ন দফতরের অফিসারদেরে বিদেশে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য ১ জন অফিসার পাঠাইতে হইবে। আমার কাছে অভিযোগ আসিল সিলেকশনে একজন পূর্ব-পাকিস্তানীও নেওয়া হয় নাই। আমি তখন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। কাজেই সংশ্লিষ্ট দফতরের সেক্রেটারিকে ডাকিয়া পাঠাইলাম। তিনি একা আসিলেন না। সঙ্গে আনিলেন জয়েন্ট সেক্রেটারিকে। আমি তাঁদের কাছে আমার উদ্দেশ্য বলিলাম। তাঁরা পূর্ব-পাকিস্তানী একাধজন পাঠান নিতান্ত উচিত ছিল স্বীকার করিয়াও পরিতাপের সাথে বলিলেন : বড় দেরি হইয়া গিয়াছে সার। নামগুলি বিদেশে পাঠান হইয়া গিয়াছে। তাঁরা সেজন্য বড়ই দুঃখিত। আয়েন্দাতে তাঁরা এর ক্ষতিপূরণ করিয়া দিবেন। আমি তাঁদের আশ্বাসে আশস্ত হইলাম না। বলিলাম : ওটা ফিরান যায় না? তাঁরা বলিলেন : অসম্ভব। কারণ ওটা এতদিনে গন্তব্য স্থানে যদি পৌঁছিয়া নাও থাকে তবে পথিমধ্যে আছে। পাকিস্তানের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে নিশ্চয়। ততক্ষণে আমার যিদ বাড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু ভিতরের গরম গোপন করিয়া শান্তভাবে বলিলাম : এক্ষুণি এই মর্মে উক্ত সরকারের কাছে ক্যাবল করিয়া দেন যে ঐ নামগুলি বাতিল করা হইল, নূতন নামের তালিকা অনতিবিলম্বেই পাঠান হইতেছে।

একটু দম ধরিয়া বলিলাম আর হ, এক্ষুণি টেলিফোনে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে বলিয়া দেন যে ঐ মর্মে আমরা তাঁদের সরকারকে ক্যাবল করিয়াছি। তাঁরাও তাঁদের সূত্রে তাঁদের সরকারকে পাকিস্তান সরকারেরমত জানাইয়া দেন।

দুইজন অফিসারই পুরান অভিজ্ঞ আই. সি. এস, দোর্দণ্ডপ্রতাপ বলিয়া সারা সেক্রেটারিয়েটে সুনাম আছে। অতিশয় দক্ষ অফিসার তাঁরা। কিন্তু আমার এই সব কথার পিঠে কোনও কথাও বলিলেন না। আমার হুকুম তামিলের কোনও লক্ষণও দেখাইলেন না।

আমি আমার টেবিলের একাধিক টেলিফোন গুলি দেখাইয়া বলিলাম : কই বিলম্ব করিতেছেন কেন? টেলিফোন করুন।

দুইজনই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে থাকিলেন। একটুও নড়িলেন না। আমি তাগিদের সুরে বলিলাম। একজন সংশ্লিষ্ট এমবেসিতে টেলিফোন করুন। আরেকজন টেলিগ্রামের মুসাবিদা করুন এখানেই। ঐ যে সামনেই প্যাড আছে। কাগ কলমহাতে নিন।

অতবড় ঝানু দোর্দণ্ডপ্রতাপ দুইটি আ. সি. এস. সি. এস. পি. নয়) অফিসার অমনোযোগী অপরাধী ছাত্রের মত বসিয়া রহিলেন। আর আমি পাঠশালার কড়া গুরুর মত আদেশ দিতে লাগিলাম। আমার ভাষায় তিরস্কারের উবা নাই। কিন্তু অনমনীয়তার দৃঢ়তা আছে। তাঁদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তায় রাগ করিলাম না। মৃদু হাসিলাম। বলিলাম : আপনারা দেরি করিতেছেন কেন? কিছু ভাবিতেছেন কি? কিছু বলিতে চান?

ছোটটির দিকে এক নজর চোখ বুলাইয়া বড়টি বলিলেন : বেআদবি মাফ করিবেন সার, একটা কথা আরয করিতে চাই।

আমি যেন কত জ্ঞানী অভিজ্ঞ মুরবি। যেন ভীতিগ্রস্ত নাবালকদের মনে সাহস ভরসা দিতেছি এমনিভাবে হাসি মুখে বলিলাম : বলুন বলুন। তাঁরা উভয়ে পালা করিয়া এ-ওঁরে সমর্থন করিয়া যা বলিলেন, তার মর্ম এই যে বিদেশী সরকারকে টেলিগ্রাম ও এমবেসিতে টেলিফোন করিবার আগে তাঁরা নিশ্চিত হইতে চান, ঐসব কাগ-পত্র সত্য-সত্যই চলিয়া গিয়াছে কিনা। কারণ যদিও বেশ কিছুদিন আগে সহি-সাবুদ হইয়া লিকাটা ও সংগীয় আবশ্যকীয় কাগয়-পত্র তাঁদের দফতর হইতে চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু সত্য-সত্যই করাচির বাইরে চলিয়া গিয়াছে কি না তাঁরা তা বলিতে পারেন না। কত যে ফর্মালিটির দেউড়ি পার হইয়া চিঠি-পত্র বাইরে যায় তা আমি আন্দায করিতে পারিনা।

আমি মুচকি হাসিলাম। সে হাসির অর্থ তাঁরা বুঝিলেন। তাঁদের চালাকি ধরা পড়িয়াছে। কিন্তু কি সাংঘাতিক ঝানু-বুরোক্র্যাট! একটু শরমিন্দা হইলেন না। হইলেও বাহিরে সে ভাব দেখাইলেন না। আমি বলিলাম : যাক, এখন আপনাদের তালিকা বদলাইয়া নয় জনের পাঁচ জন পূর্ব-পাকিস্তানী ও চারজন পশ্চিম পাকিস্তানীর একটা নূতন তালিকা করুন। এতদিন পূর্ব-পাকিস্তানীরা বাদ গিয়াছে বলিয়া তাদেরে একটু ওয়েটেজ দেওয়া দরকার। কি বলেন?

উভয়ে সমস্বরে বলিলেন : তা বটেই সার। তাত বটেই। কথায় জোর দিবার জন্য খুব জোরে মাথা ঝুকাইলেন এবং বলিলেন : পূর্ব-পাকিস্তানী কারে-কারে দিব, নাম বলিয়া দিলে ভাল হয় সার।

টেবিলের উপর হইতে চট করিয়া একশিট কাগ নিয়া একজন কলম উঠাইয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

আমি আবার একটা মুচকি হাসি-হাসিয়া বলিলাম। আমি নূতন মন্ত্রী হইয়াছি। অফিসারদের সঙ্গে এখনও যথেষ্ট পরিচয় হয় নাই। অফিসারদের কার কি গুণ, কে পূরবী আর কে পশ্চিমা আমি বিশেষ খবর রাখি না। আর অফিসার বাছাই করিতে আপনারাই বা মন্ত্রীর মতামত জিগ্গাসা করেন কেন? আপনারা অভিজ্ঞ সিনিয়র অফিসার। অধীনস্থ অফিসারদেরও ভালরূপ জানেন। কার কি ট্রেনিং দরকার তাও আপনারাই ভাল বুঝেন। কাজেই তালিকাটা আপনারাই করিবেন। শুধু দেখিবেন, পূর্ব পশ্চিমের আমার নির্দেশিত রেশিও যেন ঠিক থাকে।

সেক্রেটারিদ্বয় পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলেন। স্পষ্ট নৈরাশ্যের এবং বিস্ময়ের ভাব। একটা অফিসার-তালিকা বদলাইবার জন্য মন্ত্রী সাহেব এমন আকাশ-পাতাল তোলপাড় করিলেন, অথচ তাঁর নিজের একটা লোকও নাই? এটা কিরূপে সম্ভব? কিন্তু এঁদেরে দোষ দিয়া লাভ নাই। এতেই এঁরা অভ্যস্ত। আমার

বেলায়ও গোড়া হইতেই এই সন্দেহই তাঁরা করিয়াছিলেন।

আমি গম্ভীরভাবে বলিলাম : আর কিছু বলিবার আছে?

উভয়ে সমস্বরে বলিলেন : না সার।

আমি চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া বিশাল টেবিল পাথালি হাত বাড়াইয়া দিলাম। তার অর্থ : এইবার আপনারা বিদায় হন।

উভয়ে ঝটপট করিয়া উঠিয়া মাথা অতিরিক্ত নোওয়াইয়া মুসাফেহা করিয়া বিদায় হইলেন।

অফিস হইতে ফিরিয়া দুপুরের খানা খাইতে বাজিত আমার তিনটা। খাওয়ার পর বিছানায় লম্বা গইড় দিয়া হুক্কা টানিতে-টানিতে ঘুমাইয়া পড়িতাম। উঠিলাম একেবারে পাঁচটায়। বিকালে অফিস করিতাম বাসাতেই।

সেদিন পাঁচটায় উঠিয়া চা খাইবার সময় প্রাইভেট সেক্রেটারি খবর দিলেন সেই সেক্রেটারিদ্বয় দেড় ঘন্টার বেশি নিচের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করিতেছেন। তাড়াতাড়ি তাঁদেরে উপরে ডাকিয়া আনিলাম। একেবারে বিনয়-নম্রতার অবতার! ফাইলপত্র সব নিয়াই আসিয়াছেন। কত হাঙ্গামা করিয়া গোটা সেক্রেটারিয়েট তচনচ্ করিয়া ডিচপ্যাঁচ দফতর পর্যন্ত ধাওয়া করিয়া কথিত ফাইলটি উদ্ধার করিয়াছেন। একজন বলেন, অপরজন সমর্থন করেন। আমি চোখ কপালে তুলিয়া মুচকি হাসিলাম। অমানুষিক পরিশ্রমের জন্য ধন্যবাদ দিলাম। তাঁরা বুঝিলেন ওঁদের একটা কথাও আমি বিশ্বাস করিলাম না। কিন্তু তাঁরা বিন্দুমাত্র লজ্জা পাইলেন না। বলিলেন : সার, আপনার আদেশ মতই তালিকা করিয়াছি। শুধু আপনার অনুমোদন-সাপেক্ষে একটা রদ-বদল করিয়াছি। উভয় প্রদেশে চারজন-চারজন করিয়া দিয়া করাচিকে একজন দিয়াছি। তবে যদি সারের আপত্তি থাকে তবে ওটা কাটিয়া আরেকজন পূর্ব-পাকিস্তানী দিতে পারি। সে নামও আমাদের কাছে আছে। এখন সারের যাহুকুম।

বলিয়া ফাইলটা আমাকে দেখাইবার জন্য একজন উঠিয়া আমার দিকে আগ বাড়িলেন। আমি হাতের ইশারায় তাঁকে বিরত করিয়া বলিলাম : যে-যে মিনিস্ট্রির অফিসার তালিকাভুক্ত করিয়াছেন, তাঁদের সুপারিশ মতই করিয়াছেন ত?

উভয়ে বলিলেন : নিশ্চয় সার, নিশ্চয়।

আমি এবার সরল হাসি মুখেই বলিলাম : এবারের জন্য আপনাদের সুপারিশ মানিয়া নিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে পূর্ব-পাকিস্তানের ভাগে ভাল ওয়েটেজ দিবেন ত?

এটা তাঁরা আশা করেন নাই। তাঁদের চোখ-মুখে স্বস্তির ভাব ফুটিয়া উঠিল। বলিলেন : তা আর বলিতে সার? বাস্তবিকই পূর্ব-পাকিস্তানীরা এতকাল বঞ্চিত হইয়া আসিয়াছে। সত্য বলিতে কি সার পূর্ব-পাকিস্তানীদের জন্য এমন করিয়া আর কোন মন্ত্রী–

শেষ করিতে দিলাম না। উঠিয়া মোসাফেহার জন্য হাত বাড়াইলাম। মুসাফেহা করিয়া সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত তাঁদেরে আগাইয়া দিলাম।

পরদিন সেক্রেটারিয়েটে ছড়াইয়া পড়িল, এমন কড়া বদ-মেযাজী মন্ত্রী আর আসে নাই। বাংগালী অফিসাররা খুশী হইলেন। পশ্চিমারা গম্ভীর হইলেন। কলিগরা পুছ করিলেনঃ কি ঘটিয়াছিল বলুন ত!

সকল অধ্যায়

১. ০১. রাজনীতির ক খ
২. ০২. খিলাফত ও অসহযোগ
৩. ০৩. বেংগল প্যাক্ট
৪. ০৪. প্রজা-সমিতি প্রতিষ্ঠা
৫. ০৫. ময়মনসিংহে সংগঠন
৬. ০৬. প্রজা-আন্দোলন দানা বাঁধিল
৭. ০৭. প্রজা আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি
৮. ০৮. আইন পরিষদে প্রজা পার্টি
৯. ০৯. নির্বাচন-যুদ্ধ
১০. ১০. হক মন্ত্রিসভা গঠন
১১. ১১. কালতামামি
১২. ১২. কৃষক-প্রজা পার্টির ভূমিকা
১৩. ১৩. পাকিস্তান আন্দোলন
১৪. ১৪. পাকিস্তান হাসিল
১৫. ১৫. কলিকাতায় শেষ দিনগুলি
১৬. ১৬. কালতামামি
১৭. ১৭. আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা
১৮. ১৮. যুক্তফ্রন্টের ভূমিকা
১৯. ১৯. পাপ ও শাস্তি
২০. ২০. ঐতিহাসিক মারি-প্যাকট
২১. ২১. আত্মঘাতী ওয়াদা খেলাফ
২২. ২২. ওয়ারতি প্রাপ্তি
২৩. ২৩. ওযারতি শুরু
২৪. ২৪. ভারত সফর
২৫. ২৫. কত অজানারে
২৬. ২৬. ওযারতির ঠেলা
২৭. ২৭. ওযারতি লস্ট
২৮. ২৮. ঘনঘটা
২৯. ২৯. ঝড়ে তছনছ
৩০. ৩০. কালতামামি
৩১. ৩১. পুনশ্চ
৩২. ৩২.০১ প্রথম জাতীয় সাধারণ নির্বাচন
৩৩. ৩২.০২ নয়া যমানার পদধ্বনি
৩৪. ৩২.০৩ পৃথক পথে যাত্রা শুরু
৩৫. ৩২.০৪ ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক
৩৬. ৩২.০৫ মুক্তিযুদ্ধ-জন-যুদ্ধ
৩৭. ৩২.০৬ মুজিবহীন বাংলাদেশ
৩৮. ৩২.০৭ নৌকার হাইলে মুজিব
৩৯. ৩২.০৮ সংবিধান রচনা
৪০. ৩২.০৯ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন
৪১. ৩২.১০ কালতামামি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন