০৮. আইন পরিষদে প্রজা পার্টি

আবুল মনসুর আহমদ

আইন পরিষদে প্রজা পার্টি
আটই অধ্যায়

১. প্রজা-সমিতির নাম পরিবর্তন

ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত প্রজা সম্মিলনীর সময় হইতেই নিখিল-বংগ প্রজা সমিতির সেক্রেটারি মওলানা মোহাম্মদ আম খাঁ প্রজা-সমিতির কাজে নিরুৎসাহ হইয়া পড়েন। কিন্তু সমিতির সহকারী সেক্রেটারি সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদীর সহকারী সম্পাদক মৌঃ নযির আহম্মদ চৌধুরী পূর্বের মতই উৎসাহের সাথে সমিতির কাজ চালাইয়া যাইতে লাগিলেন। সার আবদুর রহিমের স্থলে সমিতির স্থায়ী সভাপতি নির্বাচনের জন্য ময়মনসিংহ সম্মিলনীর কিছুদিন পরেই মোহদী’ অফিসে কাউন্সিলের অধিবেশন দওয়া হইল। মওলানা সাহেবের সকল প্রকার বিরুদ্ধতা ঠেলিয়া আমরা হক সাহেবকে সভাপতি নির্বাচন করিতে সমর্থ হইলাম। মওলানা সাহেব অধিকতর নিরুৎসাহ এমনকি অসহযোগী হইয়া পড়িলেন।

নিখিল-বংগ প্রজা সম্মিলনীর পরবর্তী অধিবেশন ঢাকায় হইবে, মনমনসিংহ বৈঠকেই তা স্থির হইয়াছিল। ১৩৩৬ সালে এপ্রিল মাসে এই সম্মিলনীর অধিবেশন বসিল। বিখ্যাত দন্ত-চিকিত্সক ডাঃ আর, আহমদ অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান, ঢাকা বারের বিখ্যাত উকিল মৌঃ নঈমুদ্দিন আহমদ অভ্যর্থনা সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি, চৌধুরী গোলাম কবির, মৌঃ রেযায়ে করিম, মির্যা আব্দুল কাদির (কাদির সরকার), ‘আমান’-সম্পাদক মৌঃ তফাযল হোসেন, খ্যাতনামা মোখতার সৈয়দ আবদুর রহিম অভ্যর্থনা সমিতির বিভিন্ন পদ অলংকৃত করেন। খান বাহাদুর আবদুল মোমিন ও মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের দল প্রতিযোগিতা না করায় এবারও জনাব ফলকেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সম্মিলনীর সভাপতি নির্বাচিত হন।

এই সম্মিলনী ছিল মুসলিম বাংলার রাজনৈতিক জীবনেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে প্রাদেশিক আইনপরিষদের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ছিল আসন্ন। কার্যকরী সমিতির নির্দেশে আমি সম্মিলনীর বিবেচনার জন্য একটি ইলেকশন মেনিফেস্টো আগেই রচনা করিয়াছিলাম। জিন্না সাহেবের চৌদ্দ দফার নামানুকরণে আমি প্রজা পার্টির দাবিগুলোকে টানিয়া-খেচিয়া চৌদ্দতে স্ফীত-সীমিত করিয়া উহার নাম দিয়াছিলাম ‘প্রজা সমিতির চৌদ্দ দফা।‘ সেই মেনিফেস্টোতে বিনা-ক্ষতি পূরণে জমিদারি উচ্ছেদ, খাযনার নিরিখ হ্রাস, নয়র-সেলামি রহিতকরণ, খাযনা-ঋণ মওকুফ, মহাজনী আইন প্রণয়ন, সালিশী বোর্ড গঠন, হাজা-মজা নদী সংস্কার, প্রতি থানায় হাসপাতাল স্থাপন, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক বাধ্যতামূলক করণ, বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, শাসন ব্যয় হ্রাসকরণ, মন্ত্রি-বেতন এক হাজার টাকা নির্ধারণ ও রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন দাবি লিপিবদ্ধ করা হইয়াছিল। এই সম্মিলনীতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হইয়াছিল। কুমিল্লা ও নোয়াখালী জিলার প্রজা-আন্দোলন কৃষক-আন্দোলন নামেই পরিচত ছিল। বাংলার আর সব জিলাতেই উহার নাম ছিল প্রজা-আন্দোলন। নির্বাচনের মুখে প্রজা-সমিতিকে ঐক্যবদ্ধ করা আবশ্যক বিবেচিত হওয়ায় সকল মতের কর্মীদের সমন্বয় বিধান করা হয় সমিতির নাম কৃষক-প্রজা সমিতি করিয়া। মেনিফেস্টোও কৃষক-প্রজার চৌদ্দ দফা নামে পরিচিত হয়। অসুস্থতা সত্ত্বেও সম্মিলনীর প্রধান প্রস্তাব মেইন রেযুলিউশন আমাকেই মুভ করিতে হয়। সকল জিলার নেতৃবৃন্দ ঐ প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তৃতা করেন। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে সম্মিলনীর কাজ শেষ হয়।

২. মুসলিম ঐক্যের চেষ্টা

সমিতির নাম কৃষক-প্রজা হওয়ার সুযোগ লইয়া খান বাহাদুর মোমিন ও মওলানা আকরম খাঁর দলের কতিপয় নেতা। পূর্ব নামে সমিতি চালাইবার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হন। অল্পদিন পরেই নবাব হবিবুল্লার নেতৃত্বে কলিকাতায় ‘ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি’ গঠন করা হয়। জনাব শহীদ সুহরাওয়ার্দী ঐ পার্টিতে যোগদান করেন। খান বাহাদুর আবদুল মোমিন ও মৌঃ তমিয়ুদ্দিন খাঁ আনুষ্ঠানিকভাবে ঐ পার্টিতে যোগ না দিলেও এবং কাগজে-কলমে কৃষক-প্রজা সমিতিতে কৃষক-প্রজা সমিতির সহিত সক্রিয় সম্পর্ক রাখিলেন না। মওলানা আকরম খাঁর স্থলে মৌঃ শামসুদ্দিন আহমদ সমিতির সেক্রেটারি নির্বাচিত হইলেন।

‘ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি’ নামক এই নয়া সংস্থায় মুসলিম বাংলার সব নাইট নবাব ও জমিদার সওদাগররা সংঘবদ্ধ হইলেন এবং পার্টি কণ্ডে পাঁচ-সাত জন বড় লোকের প্রত্যেকে দশ হাজার টাকা করিয়া চাঁদা দিয়াছেন বলিয়া খবরের কাগযে ঘোষণা করিলেন। ইহাতে আমরা কৃষক-প্রজা কর্মীরা একটু চঞ্চল হইয়া উঠিলাম। এই সময় ডাঃ আর, আহমদ, মিঃ আব্দুর রহমান সিদ্দিকী ও মিঃ হাসান ইসপাহানির, নেতৃত্বে ‘নিউ মুসলিম মজলিস’ নামে কলিকাতায় প্রগতিবাদী মুসলিম তরুণদের একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। মুসলমান নাইট-নবাব খান বাহাদুরদেরে সংঘবদ্ধ হইতে দেখিয়া এরাও একটু চিন্তাযুক্ত হইলেন। প্রতিকার কি করা যায়, এই লইয়া ইহাদের সাথে আমাদের কথাবার্তা চলিতে থাকে। ইতিমধ্যে নবাব হবিবুল্ল বাহাদুরের হাংগারফোর্ড স্ট্রিটের বাড়িতে ‘ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির’ নেতারা কৃষক-প্রজা সমিতির সহিত একটি আপোস-রফার বৈঠক আহবান করেন। প্রজা-সমিতির বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা (যথা মৌঃ ফযলুল হক, মৌঃ আব্দুল করিম, মৌঃ সৈয়দ নওশের আলী) উক্ত সভায় গেলেন না। তাঁদের বদলে মৌঃ তমিযুদ্দিন খাঁ, মৌঃ শামসুদ্দিন আহমদ, মৌঃ আশরাফুদ্দিন চৌধুরী ও আমাকে পাঠাইলেন। সেখানে কর্মপন্থা নিয়া বিশেষ বিরোধ হইল না। কিন্তু পার্টি লিডার লইয়া আপোস-আলোচনা ভাংগিয়া গেল। আমরা চাইলাম হক সাহেবকে লিডার করিতে, তাঁরা চাইলেন নবাব হবিবুল্লাকে। মুসলমানদের নেতা মানেই এবার বাংলার প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং কোনও দলই নরম হইলাম না। আলোচনা ভাংগিয়া গেল। নেতৃত্বের ইশুতে আলোচনা ভাংগিয়া দেওয়ার ব্যাপারে মৌঃ তমিসুদ্দিন সাহেব আমাদের সংগে চলিয়া আসিলেন না। মৌঃ শামসুদ্দিন আহমদ যদিও মৌঃ তমিয়ুদ্দিনের মতের সমর্থক ছিলেন, অর্থাৎ নেতৃত্বের ইশুতে আলোচনা ভাংগিবার বিরোধী ছিলেন, তবু শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে বাহির হইয়া আসেন।

কিন্তু যাঁর নেতৃত্বের জন্য আমরা এত গলদঘর্ম হইলাম তাঁর কাছে পুরস্কার পাইলাম তিরস্কার। বন্ধুবর আশরাফুদ্দিনই একাজে আমাদের নেতা ছিলেন। সুতরাং হাংগারফোর্ড স্ট্রিট হইতে বাহির হইয়া তিনি সোজা আমাদেরে ঝাউতলা রোড নিয়া গেলেন এবং হক সাহেবের নেতৃত্বের জন্য কি মরণপণ সংগ্রামটা করিলাম সবিস্তারে তার বর্ণনা করিলেন। জবাবে হক সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিলেন : দেখতেছি তোমরা আমার সর্বনাশ করবা। আমারে নেতা করবার কথা তোমাদেরে কে কইছিল? যেখানে মরহুম নবাব সলিমুল্লা বাহাদুরের সাহেবযাদা আছেন, সেখানে আমি লিডার হৈবার পারি? এমন অন্যায় দাবি কৈরা তোমরা আমার শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার চান্সটাও নষ্ট কৈরা দিলা? না, এসব ছেলেমি আমি মানবো না।

আমরা চোখ-চাওয়া-চাওয়ি করিলাম। আমি রসিকতা করিয়া বলিলাম। সার, আপনের একদিকে মুসলিম বেংগল ও অপরদিকে আহসান মনযিলের সংগ্রামটা আমরা ভুলতে পারি না। আশরাফুদ্দিন বলিলেন : ‘আপনে নিজে প্রধানমন্ত্রী হৈতে চান না, আমরা জানি। কিন্তু বাংলার কৃষক-প্রজারা চায় আপনেরেই তারার প্রধানমন্ত্রী রূপে। নবাব-সুবা প্রধানমন্ত্রী তারা চায় না। আপনেরে প্রধানমন্ত্রী করতে পারি কি না, তা আমরা দেখব। আপনে কথা কইতে পারবেন না। কাগজে বিবৃতিও দিতে পারবেন না। চুপ কৈরা থাকবেন।‘ হক সাহেব তাঁর অতি পরিচিত দুষ্টামিপূর্ণ হাসিটি হাসিলেন। আর কিছু বলিলেন না। অর্থাৎ তিনি রাযী হইলেন। ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির নেতারা আমাদের অসম্মতিকেই হক সাহেবের অসম্মতি ধরিয়া নিলেন। কৃষক-প্রজা পার্টি ও ইউনাইটেড পার্টির রেষারেষি চলিতে থাকিল।

. মিঃ জিন্নার সমর্থন লাভের চেষ্টা

১৯৩৪ সালের শেষ দিকে জিন্না সাহেব তাঁর লণ্ডনের স্বয়ং-নির্বাসন ত্যাগ করিয়া বোম্বাই আসেন। সঙ্গে সঙ্গেই কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত হন। তাঁরই সমর্থনে সার আবদুর রহিম স্পিকার নির্বাচিত হন, সে কথা আগেই বলিয়াছি। ১৯৩৫ সালে তিনি মুসলিম লীগ পুনর্গঠনে মন দেন। পাঁচ বৎসর তিনি দেশে না থাকায় মুমলিম লীগ ইতিমধ্যে মৃত প্রায় হইয়া গিয়াছিল। এই সময় বংগীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ আমাদের দলের দখলে। মৌলবী মুজিবুর রহমান ইহার প্রেসিডেন্ট, ডাঃ আর, আহমদ সেক্রেটারি। আমার নিজের জিলার আমি উহার প্রেসিডেন্ট, উকিল মৌঃ আবদুস সোবহান এই সময় উহার সেক্রেটারি। এইভাবে মুসলিম লীগ তখনও আমাদের মত কং’গ্রেসী মুসলমানদেরই’ দখলে। কিন্তু আমরা সকলে প্ৰজা-আন্দোলন লইয়া এত ব্যস্ত যে মুসলিম লীগ সংগঠনের দিকে মন দিবার আমাদের সময়ই ছিল না। তবু আমরাই ছিলাম বাংলায় জিন্না নেতৃত্বের প্রতিনিধি।

আমাদের দলের ডাঃ আর. আহমদের সংগে কলিকাতার প্রভাবশালী তরুণ মুসলিম নেতা মিঃ হাসান ইস্পাহানি, তাঁর সহকর্মী আব্দুর রহমান সিদ্দিকী প্রভৃতির অন্তরংগতা ছিল অন্য দিক হইতে। তাঁরা এই সময় ‘নিউ মুসলিম মজলিস’ নামে একটি প্রগতিবাদী প্রতিষ্ঠান চালাইতেন। মিঃ হাসান ইস্পাহানি জিন্না সাহেবের একান্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। বাংলার পয়সাওয়ালা নাইট-নবাবদের সাথে টক্কর দিতে গেলে

আইন পরিষদে প্রজা পার্টি জিন্ন সাহেবের সমর্থন কাজে লাগিবে, এই সিদ্ধান্ত করিয়া মিঃ ইস্পাহানির মারফতে আমরা জিন্ন সাহেবকে দাওয়াত করিলাম। তিনি আসিলেন। ইস্পাহানিদের ৫নং ক্যামাক স্ট্রিটের বাড়িতে উঠিলেন। রাতে ডিনারের পরে আলোচনা শুরু হইল। মৌঃ ফযলুল হক, আবদুল করিম, মৌঃ সৈয়দ নওশের প্রভৃতি আমরা আট-দশজন ডিনারে আলোচনায় শরিক হইলাম।

আলোচনায় নীতিগতভাবে সকলে অতি সহজেই একমত হইলাম। মুসলমানদের একতাবদ্ধ হওয়া, নাইট-নবাবদের ধামাধরা রাজনীতি হইতে মুসলিম সমাজকে মুক্ত করা, সাম্প্রদায়িক ঐক্যের মধ্য দিয়া মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করা ইত্যাদি ব্যাপারে কোনও মতভেদ দেখা দিল না। কিন্তু খুটিনাটি ব্যাপারে আস্তে আস্তে বিরোধ দেখা দিতে লাগিল। জিন্না সাহেব ইতিমধ্যে মুসলিম লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে নূতন গঠনতন্ত্র রচনা করিয়াছেন। তাতে মুসলিম ভারতের রাজনীতিক আদর্শ-উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রগতিবাদী দাবি-দাওয়া লিপিবদ্ধ হইয়াছে। সেই আদর্শ-উদ্দেশ্যকে বুনিয়াদ করিয়া মুসলিম লীগ সর্বভারতীয় ভিত্তিতে নির্বাচন-সংগ্রাম পরিচালনা করিবে, জিন্না সাহেবের উদ্দেশ্য তাই। কাজেই আমরা বুঝিলাম, আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হইতে বাধ্য। অতএব জিনা সাহেবের সহিত আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তৃত আলোচনা চালাইবার জন্য একটি প্রতিনিধি দল গঠন করা হইল। মৌঃ শামসুদ্দিন, মৌঃ আশরাফুদ্দিন, মৌঃ রেযায়ে করিম, নবাবযাদা হাসান আলী, অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ও আমি প্রতিনিধি দলের মের হইলাম। সৈয়দ নওশের আলী এই দলের লিডার হইলেন। সৈয়দ সাহেব দুই-একবার গিয়াই ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। আমরা যা করিব, তাতেই তাঁর মত আছে বলিয়া তিনি খসিয়া পড়িলেন। অতঃপর নেতাহীন অবস্থাতেই আমরা দিনের পর দিন আলোচনা চালাইয়া যাইতে থাকিলাম। ইতিমধ্যে আমরা আলবার্ট হলে এক জনসভার আয়োজন করিলাম। বক্তা এক জিন্না সাহেব। তিনি যুক্তিপূর্ণ সারগর্ভ বক্তৃতা করিলেন। তাতে তিনি ইংরাজের ধামাধরা তল্পিবাহক নাইট-নবাবদের কষিয়া গাল দিলেন এবং নেতৃত্ব হইতে তাহাদিগকে ঝাটাইয়া তাড়াইবার জন্য জনসাধারণকে উদাত্ত আহ্বান জানাইলেন। উপসংহারে তিনি প্রাণশশী ভাষায় বলিলেন : ‘লেট দি ক্রিম অব হিন্দু সোসাইটি বি অর্গেনাইযড় আন্ডার দি বেনার অব দি কংগ্রেস এও দি ক্রিম অব মুসলিম সোসাইটি আন্ডার দি বেনার অব দি মুসলিম লীগ। দেন লেট আস পুট আপ এ ইউনাইটেড ডিমান্ড ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স অব আওয়ার ডিয়ার মাদারল্যান্ড। আওয়ার ডিমান্ড উইল বি ইররেফিস্টিবল।‘ কানফাটা করতালি ধ্বনি ও বিপুল উৎসাহের মধ্যে সভা ভংগ হইল।

৪. লীগ-প্ৰজা আপোস চেষ্টা

কিন্তু আলোচনা যতই দীর্ঘ হইতে লাগিল আমাদের উৎসাহ ও আশা ততই কমিতে লাগিল। জিন্না সাহেবের দাবি ছিল এই : (১) কৃষক-প্রজা সমিতিকে মুসলিম লীগের টিকিটে প্রার্থী বাড়া করিতে হইবে; (২) কৃষক-প্রজা পার্টির মেনিফেষ্টো হইতে জমিদারি উচ্ছেদ দাবি বাদ দিতে হইবে; (৩) পার্লামেন্টারী বোর্ডে কৃষক প্রজা পার্টির শতকরা ৪০ জন এবং মুসিলম লীগের শতকরা ৬০ জন প্রতিনিধি থাকিবেন; (৪) মুসলিম লীগের প্রতিনিধি জিন্না সাহেব নিজে মনোনীত করিবেন। তাঁর দাবির পক্ষে জিন্না সাহেব বলিবেন। গোটা ভারতের সর্বত্র একমাত্র মুসলিম লীগের টিকিটেই নির্বাচন চালাইতে হইবে। মুসলিমসংহতি প্রদর্শনের জন্য এটা দরকার। জমিদারি উচ্ছেদ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এই যে ঐ দাবি বস্তুতঃ ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাযেয়াফত করার দাবি। উহা মুসলিম লীগের মূলনীতি-বিরোধী। তিনি মুসলিম লীগের নয়া ছাপা গঠনতন্ত্রের ৭নং ধারা আমাদিগকে দেখাইলেন।

পক্ষান্তরে কৃষক-প্রজা সমিতির তরফ হইতে আমাদের দাবি ছিল? (১) কৃষক-প্রজা সমিতির টিকিটেই বাংলার নির্বাচন হইবে; তবে কেন্দ্রীয় পরিষদে কৃষকপ্রজা প্রতিনিধিরা মুসলিম লীগ পার্টির সদস্য হইবেন এবং নিখিল-ভারতীয় সমস্ত ব্যাপারে কৃষক-প্রজা সমিতি মুসলিম লীগের নীতি মানিয়া লইবে; (২) পার্লামেন্টারী বোর্ডে কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের প্রতিনিধি আধাআধি হইবে; (৩) মুসলিম লীগ প্রতিনিধিরাও কৃষক-প্রজা প্রতিনিধিদের মতই প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন। আমাদের দাবির পক্ষে যুক্তি ছিল এই ও বাংলার তফসিলী হিন্দুরা কৃষক-প্রজা পার্টির সমর্থক। মুসলিম লীগ টিকিটে নির্বাচন চালাইলে আমরা তাদের সমর্থন হারাই। জিন্না সাহেবের মনোনয়নের বিরুদ্ধে আমরা যুক্তি দিলাম যে পার্লামেন্টারি বোর্ডের মুসলিম লীগ প্রতিনিধিরা প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত হইলে আমরা দেশের মুসলিম লীগ কর্মীদের পূর্ণ সহযোগিতা পাইব। পক্ষান্তরে নমিনেশনের পিছন দুয়ার দিয়া যদি কোনও অবাঞ্ছিত লোক পার্লামেন্টারি বোর্ডে স্থান পায় তবে কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ও প্রার্থী নির্বাচনে গন্ডগোল দেখা দিবে।

জিন্না সাহেব আমাদের যুক্তি মানিলেন না। তিনি বলিলেন : কেন্দ্রীয় পরিষদে কৃষক-প্রজা প্রতিনিধির মুসলিম লীগ পার্টির যোগ দেওয়ার কথাটা বর্তমানে অর্থহীন, কারণ কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচন এখন হইতেছে না। তফসিলী হিন্দুদের সহযোগিতা সম্বন্ধে তিনি বলিলেন, স্বন্ত্র নির্বাচন প্রথার ভিত্তিতে যখন নির্বাচন হইতেছে, তখন মুসলিম লীগ টিকিটে নির্বাচিত হইবার পরও তফসিলী হিন্দুদের সহযোগিতা পাওয়া যাইবে। আর পার্লামেন্টারি বোর্ডে প্রাদেশিক লীগের প্রতিনিধি নির্বাচন সম্বন্ধে তিনি বলিলেন যে, প্রাদেশিক লীগ কৃষক-প্রজা সমিতির লোকেরই করতলগত। নির্বাচনেও তাঁদের লোকই আসিবেন। তাতে পার্লামেন্টারি বোর্ড এক দলের হইয়া পড়িবে, সর্বদলীয় মুসলমানদের হইবে না।

উভয় পক্ষ স্ব স্ব মতে অটল থাকা সত্ত্বেও আলোচনা কোন পক্ষই ভাংগিয়া দিলাম না। শেষ পর্যন্ত আপোস-চেষ্টা সফল হইবে, উভয় পক্ষই যেন এই আশায় থাকিলাম। ইতিমধ্যে আমরা জানিতে পারিলাম জিন্না সাহেব আমাদের সাথে আলোচনা চালাইবার কালে সমান্তরালভাবে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির নাইট-নবাবদের সাথেও আলোচনা চালাইতেছেন। আমাদের প্রশ্নের জবাবে তিনি তা স্বীকার করিলেন। বলিলেন : সকল দলের মুসলমানকে এক পার্টিতে আনাই আমার উদ্দেশ্য।’

৫. উভয়সংকট

এক দিনের বৈঠকে হঠাৎ জিন্না সাহেব আমাদিগকে জানাইলেন। পার্লামেন্টারি বোর্ড সম্পর্কে জিন্না সাহেবের দাবি কৃষক-প্রজা সমিতির সভাপতি হক সাহেব ও সেক্রেটারি শামসুদ্দিন সাহেব মানিয়া লইয়াছেন, আমাদের এ বিষয়ে নূতন কথা বলিবার কোনও অধিকার নাই। আমরা বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইলাম। শামসুদ্দিন সাহেব সে দিনের আলোচনায় ছিলেন না। আমাদের বিষয় দূর করিবার জন্য জিন্না সাহেব মুচকি হাসিয়া এক টুকরা কাগজ দেখাইলেন। দেখিলাম, তাঁর কথা সত্য।

আমরা ক্ষুব্ধ ও লজ্জিত হইয়া সেদিনের আলোচনা অসমাপ্ত রাখিয়াই চলিয়া আসিলাম। হক সাহেব ও শামসুদ্দিন সাহেবকে চ্যালেঞ্জ করিলাম। তাঁদের কথাবার্তা আমাদের পছন্দ হইল না। কলিকাতায় উপস্থিত কৃষক-প্রজা নেতাদের লইয়া একটি জরুরী পরামর্শ সভা ডাকিলাম। ঢাকায় বলিয়াদির জমিদার খান বাহাদুর কাযিমুদ্দিন সিদ্দিকী সাহেব আমাদের সমর্থক ছিলেন। লোয়ার সার্কুলার (নোনাতলা) রোডস্থ তাঁর বাড়িতে এই পরামর্শ বৈঠক বসিল। হক সাহেব ও শামসুদ্দিন সাহেব এই সভায় তাঁদের কাজের সমর্থনে বক্তৃতা করিলেন। তাঁরা জানাইলেন যে জিন্না সাহেব জমিদারি উচ্ছেদের দাবি মানিয়া লইয়াছেন। এ অবস্থায় পার্লামেন্টারী বোর্ডের প্রতিনিধিত্ব লইয়া ঝগড়া করিয়া আপোস-আলোচনা ভাংগিয়া দেওয়ার তাঁরা পক্ষপাতী নন। আমরা ইতিমধ্যেই খবর পাইয়াছিলাম যে সার নাষিমূদ্দিনের পরামর্শে জিন্না সাহেব জমিদারি উচ্ছেদের বিরোধিতা অনেকটা শিথিল করিয়াছেন। হক সাহেব ও শামসুদ্দিন সাহেবের কথায় এখন আমরা খুব বেকায়দায় পড়িলাম। আমরা নিজেদের সমর্থনে খুব জোর বক্তৃতা করিলাম। মুসলিম লীগের লিখিত গঠনতন্ত্রের বিরোধী জিন্ন সাহেবের ঐ মৌখিক প্রতিশ্রুতির মূল্য কি, সে সব কথাও বলিলাম। তারপর শুধু জমিদারি উচ্ছেদের কথাটাও যথেষ্ট নয়; বিনা ক্ষতিপূরণে উচ্ছেদটাই বড় কথা। আমাদের মেনিফেস্টোর কথাও তাই। এ সম্পর্কে জিন্না সাহেব হক সাহেবকে কি প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন, তা সভা সমক্ষে স্পষ্ট করিয়া বলিতে আমরা হক সাহেবকে চ্যালেঞ্জ করিলাম। হক সাহেব বা শামসুদ্দিন এ ব্যাপারে সভাকে সন্তুষ্ট করিতে পারিলেন না। বুঝা গেল, আসলে ক্ষতিপূরণের কথাটা তাঁরা জিন্না সাহেবের কাছে তুলেনই নাই। এই পয়েন্টে আমরা জিতিয়া গেলাম। কিন্তু এটা আমরা বুঝিলাম যে বিনা-ক্ষতিপূরণের শর্ত জিন্না সাহেব মানিয়া লইয়া থাকিলে পার্লামেন্টারী বোর্ডে মাইনরিটি হইয়াও আপোস করা উপস্থিত সদস্যগণের অধিকাংশেরই মত। যাহোক জিন্ন সাহেবের কাছে একমাত্র বিনা-ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটা পরিষ্কার করিবার তার প্রতিনিধিদলের উপর দেওয়া হইল।

৬. আপোসের বিরোধিতা

আমরা প্রতিনিধিদলের মেম্বার। সেখান হইতে সার্কাস রোডস্থিত ডাঃ আর, আহমদের বাড়ি গেলাম। সমস্ত অবস্থা পর্যালোচনা করিলাম। আমরা একমত হইলাম যে হক সাহেব ও শামসুদ্দিন সাহেব সহ অধিকাংশ সদস্য এই আপোসের পক্ষপাতী এটা যেমন সত্য, এই আপোস করিলে কৃষক-প্রজা সমিতির অস্তিত্ব এই খানেই খতম এটাও তেমনি সত্য। আমরা সংকটের দুই শিংগার ফাঁকে পড়িলাম। একমাত্র ভরসা জিন্ন সাহেব। তিনি যদি মেহেরবানি করিয়া বিনা-ক্ষতিপূরণের দাবিটা গ্রাহ্য করেন, তবেই আমরা বাঁচিয়া যাই। সকলে মিলিয়া আল্লার দরগায় মোনাজাত করিতে লাগিলাম : জিন্না সাহেব যেন আমাদের দাবি না মানেন। নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে জীবনে আব্লেকবারমাত্র আল্লার দরগায় মোনাজাত করিয়াছিলাম। এক টাকা দিয়া ত্রিপুরা স্টেট লটারির টিকিট করিয়াছিলাম। প্রথম পুরস্কার এক লক্ষ। তৎকালে সারা ভারতবর্ষে বিশ্বাসী এথচ মোটা টাকার লটারি ছিল মাত্র এই একটি। কয়েক বছর ধরিয়া এই লটারির টিকিট কিনিতেছিলাম। টিকিট কিনার পরদিন হইতে খেলার ফল ঘোষণার দিন পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস কাল খোদার দরগায় দিনরাত মোনাজাত করিতাম জিতার জন্য। কিন্তু একবার হরিবার জন্য তেমনি মোনাজাত করিয়াছিলাম। কারণ পকেটে টিকিটসহ পাঞ্জাবিটা ধুপার বাড়ি দিয়া ফেলিয়াছিলাম। ধূপার ভাটিতে পড়িয়া তার চিহ্ন ছিল না। তেমনি এবার পাঁচ-ছয় বন্ধুতে দোয়া করিতে থাকিলাম : ‘হে খোদ, জিন্না সাহেবের মন কঠোর করিয়া দাও।‘

পরদিন নির্ধারিত সময়ে জিন্না সাহেবের সহিত দেখা করিলাম। দু’এক কথায় বুঝিলাম, বিনা-ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদে তিনি কিছুতেই রাযী হইবে না; কারণ ওটাকে তিনি ফান্ডামেন্টাল মনে করেন। তখন আমরা নিশ্চিন্ত হইয়া বিনা ক্ষতিপূরণের উপর জোর দিলাম। এমনকি, আমরা এতদূর বলিলাম যে পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠনে কৃষক-প্রজা পার্টিকে শতা ৪০-এর স্থলে আরও কমাইয়া দিলেও আমরা মানিয়া নিতে পারি, কিন্তু বিনা-ক্ষতিপূরণের প্রশ্নের মত ফাণ্ডামেন্টালে আমরা কোনও আপোস করিতে পারি না। জিন্না সাহেবের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাযেয়াফতের যুক্তির খণ্ডনে আমরা কর্নওয়ালিস, পাঁচসালা, দশমালা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উল্লেখ করিয়া দেখাইবার চেষ্টা করিলাম যে জমিদাররা আসলে জমির মালিক নয়, ইজারাদার মাত্র। তাছাড়া, কৃষক-প্রজা সমিতি বাংলার সাড়ে চার কোটি কৃষক-প্রজার কাছে এ ব্যাপারে ওয়াদাবদ্ধ। আমরা সে ওয়াদা কিছুতেই খেলাফ করিতে পারি না। জিন্না সাহেব আমাদেরে মাফ করিবেন।

জিন্না সাহেব তাঁর অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে বুঝিয়া ফেলিলেন, আমরা ভাংগিয়া পড়িবার চেষ্টা করিতেছি। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরিয়া তিনি আমাদিগকে ধমকাইয়াছেন, কোনঠাসা করিয়াছেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিয়াছেন, কিন্তু কখনও তিনি ভাংগাভাংগি চাহেন নাই। সেটা যদি চাইতেন, তবে এক দিনেই আমাদেরে বিদায় করিয়া দিতে পারিতেন। তিনি এক কথার মানুষ। দর-কষাকষি তাঁর ধাতের মধ্যেই নাই। এমন লোক যে এক সপ্তাস্ত্রে বেশি দিন ধরিয়া দিনের পর দিন আমাদের সাথে আলোচনা চালাইয়া গিয়াছেন, তাতে কেবলমাত্র এটাই প্রমাণিত হয় যে আমাদের সাথে তাঁর মূলগত পার্থক্য যতই থাকুক, তিনি আমাদের মধ্যে ভাংগাভাংগি চান নাই। এই দিন আমাদের মধ্যে ভাংগাভাংগির মনোভাব দেখিয়া তিনি বেশ একটু চঞ্চল এবং তাঁর ধাতবিরোধী রকম নরম হইয়া গেলেন। অতিরিক্ত রকম মিষ্টি ভাষায় তিনি আমাদের দাবির অযৌক্তিকতা বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন। তিনি আমাদেরে দেখাইলেন, বিনা-ক্ষতিপূরণের কথাটা আমরা নূতন তুলিতেছি। আমরা বলিলাম যে, উচ্ছেদ কথাটার মধ্যেই বিনা-ক্ষতিপূরণ নিহিত রহিয়াছে। উচ্ছেদ কথার সংগে খরিদ বা পাচেষ, হুকুম দখল বা একুইযিশন-রিকুইযিশনের পার্থক্য আমরা জিন্না সাহেবের মত বিশ্ববিখ্যাত উকিলকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম। জিন্না সাহেব আর কি করিবেন? আমাদের এই অপচেষ্টাকে তিনি শুধু চাইন্ডিশ বা শিশু-সুলভ বলিয়াই ছাড়িয়া দিলেন এবং আমাদিগকে এই ছেলেমি না করিয়া ‘সেনসিবল’ হইতে উপদেশ দিলেন।

৭. আলোচনা ব্যর্থ

কিন্তু আমরা সেনসিবল হইলাম না। কারণ আমরা মন ঠিক করিয়াই আসিয়াছিলাম। ক্ষতিপূরণের প্রশ্নেই জিন্ন সাহেবের সহিত আমাদের ভাংগাভাংগি হইল, বিনা-ক্ষতিপূরণের দাবি মানিয়া নিলে আমরা পার্লামেন্টারি বোর্ডে আরও কম সীট নিতে রাযী ছিলাম, এই মর্মে পরদিনই খবরের কাগযে বিবৃতি দিবার জন্য আমরা তৈয়ার হইতেছিলাম। আমাদের পার্টির মুসাবিদা-বিশারদ ইংরাজীতে সুপণ্ডিত অধ্যাপক হুমায়ুন কবির সাহেব এই মর্মে একটি মুসাবিদা খাড়া করিয়াই আজিকার বৈঠকে আসিয়াছিলেন। সুতরাং আমরা আর বিলম্ব করিলাম না। উঠিয়া পড়িলাম। আপোস না হওয়ার জন্য আমরা যারপরনাই দুঃখিত হইয়াছি, সেই মর্মবেদনা জানাইয়া অতিরিক্ত নুইয়া ‘আদাব আরয’ বলিয়া আমরা বিদায় হইলাম। জিন্না সাহেব আসন হইতে উঠিয়া আমাদের দিকে আসিলেন বিদায়ের শিষ্টাচার দেখাইবার জন্য। দরজার পর্দা পার হইবার আগেই জিন্না সাহেব আমাকে নাম ধরিয়া ডাকিলেন। আমি ফিরিয়া দাঁড়াইলাম। বন্ধুরা স্বভাবতঃই ফিরিলেন না। জিন্না সাহেব আমার কাছে আসিয়া আমার কাঁধে হাত দিলেন। বলিলেন : ‘ডোন্ট বি মিসগাইডেড বাই আশরাফুদ্দিন। হি ইয এ হোলহগার। ইউআরএ সেনিসিবল ম্যান। আই কোয়াইট রিএলাইয ইওর এংযাইটি ফর দি ওয়েলফেয়ার অব দি পেযেন্টস। বাট টেক ইট ফ্রম মি উইদাউট মুসলিম সলিডারিটি ইউ উইল নেভার বি এবল্টু ডু এনি গুড টু দেম।‘

আমি এ কথার বিরুদ্ধে যুক্তি দিবার জন্য মুখ খুলিতেছিলাম। ধমক দিয়া আমাকে থামাইয়া দিলেন এবং আমার কাঁধ হইতে ডান হাতটা আমার মাথায় রাখিয়া বলিলেন : ‘ডোন্ট আণ্ড উইথ মি। আই নো মোর দ্যান ইউ ডু। প্লিয গো টু এভরি হোম, এন্ড ক্যারি দি ম্যাসেজ অব মুসলিম ইউনিটি টু ইচ এন্ড এভরি মুসলিম। দ্যাট উইল সার্ব দি পেযেন্টস মোর দ্যান ইওরপ্রজা পার্টি।‘

আমি বুঝিলাম এটা তর্ক নয় আদেশ। এর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি চলে না। কাজেই কোন কথা বলিলাম না। আসলে বলিবার সময়ই তিনি দিলেন না। কথা শেষ করিয়াই আমার মাথা হইতে হাতটা নামাইয়া আমার দিকে বাড়াইয়া দিলেন। আমি ভক্তি– ভরে ঈষৎ নুইয়া তাঁর হাত ধরিলাম। তিনি দুইটা ঝাঁকি দিয়া বলিলেন : গুড বাই এও গুডলাক।

বন্ধুরা বিশেষ কৌতূহলের সংগে আমার অপেক্ষায় বারান্দায় পায়চারি করিতেছিলেন। দু-এক মিনিটের মধ্যে আমি বাহির হইয়া আসায় তাঁদের কৌতূহলের স্থান দখল করিল বিষয়। শুধু বন্ধুবর আশরাফুদ্দিন তাঁর স্বাভাবিক ঘাড়-দোলানো হাসিমুখে বলিলেন : তোমারে নরম পাইয়া একটু আলাদা রকমে ক্যানভাস করলেন বুঝি? গলাইতে পারলেন?

সকলেই হাসিলেন। আমিও হাসিলাম। গুতেই কাজ হইল। কোনও জবাবের দরকার হইল না। তার সময়ও পাওয়া গেল না। নূতন বিষয় আমাদের সকলের মন কব্য করিল। ইসপাহানি সাহেবদের বাড়িতে জিন্ন সাহেবের জন্য যে কামরা নির্দিষ্ট ছিল, সেটা হইতে বাহির হইয়া প্রথমে একটা প্রশস্ত বারান্দায় পড়িতে হয়। সে বারান্দা পার হইয়া বিশাল ড্রয়িং রুমে ঢুকিতে হয়। আমরা ড্রয়িং রুমে ঢুকিয়াই দেখিলাম, হক সাহেব ও মোমিন সাহেব একই সোফায় পাশাপাশি বসিয়া আছেন। আমরা উভয়কেই আদাব দিলাম। হক সাহেব জিগাসা করিলেন। কি হৈল? অধ্যাপক কবির জানাইলেন ফাঁসিয়া গিয়াছে। মোমিন সাহেব আমাদের দিকে না চাহিয়া শুধু নবাব্যাদা হাসান আলীকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন : তোমরা মাথা গরম রাজনৈতিক নাবালকেরা নিজেরা ত কিছু করতে পারবেই না, আমরা প্রবীণদেরেও কিছু করতে দিবে না।

আমরা মোমিন সাহেবের সহিত তর্ক না করিয়া দু’চার কথায় হক সাহেবকে আমাদের মোলকারে রিপোর্ট দিয়া চলিয়া আসিলাম।

পরদিনই খবরের কাগযে বাহির হইল জিন্না সাহেব কৃষক-প্রজা সমিতি বাদ দিয়া ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির সহিত আপোস করিয়াছেন। ঐ পার্টি নিজেদের নাম বদলাইয়া মুসলিম লীগ নাম ধারণ করিয়াছেন। আমাদের পক্ষ হইতে অবশ্য বিবৃতি বাহির হইল যে ক্ষতিপূরণের প্রশ্নেই জিন্না সাহেবের সহিত আমাদের আপোস হইতে পারিনা।

ইহার পর প্রকাশ্য মাঠের সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়িল। যদিও আগের প্রাদেশিক মুসলিম লীগ আমাদেরই দখলে ছিল, কিন্তু জিন্না সাহেবের মোকাবেলায় আমাদের সে দাবি টিকিল না। তাছাড়া কৃষক-প্রজা সমিতির মত অসাম্প্রদায়িক শ্ৰেণী-প্রতিষ্ঠান আর মুসলিম লীগের মত সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান এক সংগে চালাইবার চেষ্টার মধ্যে যে অসংগতি এমন কি রাজনৈতিক অসাধুতা ছিল, অল্পদিনেই তা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। আমরা অবস্থা গতিকেই মুসলিম লীগের দখল ছাড়িয়া দিয়া কৃষক-প্রজা সমিতিতে মনোনিবেশ করিলাম। ফলে এই নির্বাচন যুদ্ধ কৃষক-প্রজা সমিতি ও মুসলিম লীগের সম্মুখযুদ্ধে পরিণত হইল।

সকল অধ্যায়

১. ০১. রাজনীতির ক খ
২. ০২. খিলাফত ও অসহযোগ
৩. ০৩. বেংগল প্যাক্ট
৪. ০৪. প্রজা-সমিতি প্রতিষ্ঠা
৫. ০৫. ময়মনসিংহে সংগঠন
৬. ০৬. প্রজা-আন্দোলন দানা বাঁধিল
৭. ০৭. প্রজা আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি
৮. ০৮. আইন পরিষদে প্রজা পার্টি
৯. ০৯. নির্বাচন-যুদ্ধ
১০. ১০. হক মন্ত্রিসভা গঠন
১১. ১১. কালতামামি
১২. ১২. কৃষক-প্রজা পার্টির ভূমিকা
১৩. ১৩. পাকিস্তান আন্দোলন
১৪. ১৪. পাকিস্তান হাসিল
১৫. ১৫. কলিকাতায় শেষ দিনগুলি
১৬. ১৬. কালতামামি
১৭. ১৭. আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা
১৮. ১৮. যুক্তফ্রন্টের ভূমিকা
১৯. ১৯. পাপ ও শাস্তি
২০. ২০. ঐতিহাসিক মারি-প্যাকট
২১. ২১. আত্মঘাতী ওয়াদা খেলাফ
২২. ২২. ওয়ারতি প্রাপ্তি
২৩. ২৩. ওযারতি শুরু
২৪. ২৪. ভারত সফর
২৫. ২৫. কত অজানারে
২৬. ২৬. ওযারতির ঠেলা
২৭. ২৭. ওযারতি লস্ট
২৮. ২৮. ঘনঘটা
২৯. ২৯. ঝড়ে তছনছ
৩০. ৩০. কালতামামি
৩১. ৩১. পুনশ্চ
৩২. ৩২.০১ প্রথম জাতীয় সাধারণ নির্বাচন
৩৩. ৩২.০২ নয়া যমানার পদধ্বনি
৩৪. ৩২.০৩ পৃথক পথে যাত্রা শুরু
৩৫. ৩২.০৪ ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক
৩৬. ৩২.০৫ মুক্তিযুদ্ধ-জন-যুদ্ধ
৩৭. ৩২.০৬ মুজিবহীন বাংলাদেশ
৩৮. ৩২.০৭ নৌকার হাইলে মুজিব
৩৯. ৩২.০৮ সংবিধান রচনা
৪০. ৩২.০৯ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন
৪১. ৩২.১০ কালতামামি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন