গীতা – অধ্যায় ১৪ – গুণত্রয়বিভাগযোগ

কালীপ্রসন্ন সিংহ

চতুর্দশ অধ্যায় – গুণত্রয়বিভাগযোগ

“ভগবান বলিলেন, ‘হে অর্জুন! আমি পুনরায় উৎকৃষ্ট জ্ঞান কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। মহর্ষিগণ ইহা অবগত হইয়া দেহান্তে মোক্ষলাভ করিয়া থাকেন এবং ইহা আশ্রয় করিলে আমার সারূপ্য প্রাপ্য হইয়া সৃষ্টিকালেও জন্মগ্রহণ করেন না ও প্রলয়কালেও ব্যথিত হয়েন না! হে অর্জুন! মহাপ্রকৃতি আমার গর্ভাধানস্থান; আমি তাহাতে সমস্ত জগতের বীজ নিক্ষেপ করিয়া থাকি; তাহাতেই ভূতসকল উৎপন্ন হয়। সমস্ত যোনিতে যে সকল স্থাবরজঙ্গমাত্মক মূর্তি সম্ভূত হয়, মহৎ প্রকৃতি সেই মূর্তি-সমুদয়ের যোনি এবং আমি বীজপ্রদ পিতা। প্রকৃতি-সম্ভূত স্বত্ত্ব, রজঃ ও তম এই তিনটি গুণ দেহের অভ্যন্তরে অব্যয় দেহীকে আশ্রয় করিয়া আছে। তন্মধ্যে সত্ত্ব-গুণ নির্মলত্ব প্রযুক্ত নিতান্ত ভাস্বর (উজ্জ্বল) ও নিরুপদ্রব; এই নিমিত্ত উহা দেবীকে সুখী ও জ্ঞানসম্পন্ন করে। রজোগুণ অনুরাগাত্মক এবং অভিলাষ ও আসক্তি হইতে সমুদ্ভূত; উহা দেবীকে কর্মে নিবন্ধ করিয়া রাখে। সত্ত্বগুণ প্রাণীগণকে সুখে মগ্ন, রজোগুণ কর্মে সংসক্ত এবং তমোগুণ জ্ঞানকে তিরোহিত করিয়া প্রমাদের বশীভূত করে। সত্ত্বগুণ রজঃ ও তমকে, রজোগুন সত্ত্ব ও তমকে, তমোগুণ রজঃ ও সত্ত্বকে অভিভূত করিয়া উদ্ভূত হইয়া থাকে। যখন সত্ত্বগুণ পরিবর্দ্ধ্বিত হয়, তখন এই দেহে সমুদয় ইন্দ্রিয় দ্বারা জ্ঞানরূপ প্রকাশ জন্মে। রজোগুণ প্রবৃদ্ধ হইলে লোভ, প্রবৃদ্ধি, কর্মারম্ভ, স্পৃহা ও অশান্তির সঞ্চার হইয়া থাকে। তমোগুণ প্রবৃদ্ধ হইলে অপ্রকাশ, অপ্রবৃত্তি, প্রমাদ ও মোহ জন্মিয়া থাকে। সত্ত্বগুণ পরিবর্দ্ধিত হইলে যদি কেহ কলেরব পরিত্যাগ করে, সে হিরণ্যগর্ভোপাসকদিগের (ব্রহ্মার উপাসকগণের) প্রকাশময় লোকসকল প্রাপ্ত হয়। রজোগুণ পরিবর্দ্ধিত হইলে যদি কাহারও মৃত্যু হয়, তাহা হইলে কর্মাসক্ত মনুষ্যযোনিতে তাহার জন্ম হইয়া থাকে; আর যদি কেহ তমোগুণ পরিবর্দ্ধিত হইলে দেহ ত্যাগ করে, তাহা হইলে তাহার পশ্বাদিযোনিতে জন্ম হয়। সাত্ত্বিক কর্মের ফল সুনির্মল সাত্ত্বিক সুখ; রাজস কর্মের ফল দুঃখ এবং তামস কর্মের ফল অজ্ঞান। সত্ত্ব হইতে জ্ঞান, রজ হইতে লোভ এবং তম হইতে প্রমাদ, মোহ ও অজ্ঞান সমুত্থিত হইয়া থাকে। সাত্ত্বিক লোক ঊর্দ্ধে ও রাজসিক লোক মধ্যে অবস্থান করেন এবং জঘন্য-গুণসঞ্জাত (নিন্দিত গুণ হইতে জাত) প্রমাদ-মোহাদির বশীভূত তামসিক লোক অধোগতি লাভ করিয়া থাকে। মানব বিবেকী হইয়া গুণসকলকে সমস্ত কার্যের কর্তা বলিয়া নিরীক্ষণ করিলে এবং গুণ হইতে অতিরিক্ত আত্মাকে অবগত হইলে ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হইয়া থাকে। দেহী দেহসমুদ্ভূত এই তিনটি গুণ অতিক্রম করিয়া জন্ম-মৃত্যু-জরা-জনিত দুঃখ-পরস্পরা হইতে পরিত্রাণ লাভ করিয়া মোক্ষ প্রাপ্ত হয়।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! মনুষ্য কোন্‌ সকল চিহ্ন ও কিরূপ আচারসম্পন্ন হইলে এই তিনটি গুণ অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়?’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জুন! যিনি প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও মোহ স্বতঃ-প্রবৃত্ত হইলে দ্বেষ করেন না, যিনি উদাসীনের ন্যায় আসীন (স্থির) হইয়া সুখ-দুঃখাদি গুণকার্য দ্বারা বিচলিত হয়েন না, প্রত্যুত (বাস্তবিক) গুণসকল স্বকার্যেই ব্যাপৃত আছে, তৎসমুদয়ের সহিত আমার কোন সংস্রব নাই, এইরূপ বিবেচনা করিয়া ধৈর্য অবলম্বন করিয়া থাকেন, যিনি সমদুঃখসুখ, আত্মনিষ্ঠ ও ধীমান্‌, যিনি লোষ্ট্র, প্রস্তর ও কাঞ্চন সমদৃষ্টিতেই দর্শন করেন, যাঁহার প্রিয় ও অপ্রিয় উভয়ই একরূপ, যিনি আত্মনিন্দা, আত্মপ্রশংসা, মান ও অভিমান এবং শত্রু ও মিত্র তুল্যরূপই বিবেচনা করিয়া থাকেন আর যিনি সর্বকর্মত্যাগী (দৃষ্ট ও অদৃষ্টফলজনক কর্মবিষয়ে উদ্যমপরিত্যাগী), তিনিই গুণাতীত। যে ব্যক্তি অসাধারণ ভক্তিযোগ সহকারে আমাকে সেবা করেন, তিনি উক্ত সমস্ত গুণ অতিক্রম করিয়া মোক্ষলাভে সমর্থ হয়েন। হে অর্জুন! আমি ব্রহ্ম, নিত্য, মোক্ষ, শাশ্বত ধর্ম ও অখণ্ড সুখের আস্পদ।’”

সকল অধ্যায়

১. গীতা – অধ্যায় ০১ – সৈন্যদর্শন, অর্জুনবিষাদ
২. গীতা – অধ্যায় ০২ – বিষাদনাশক সাংখ্যযোগ, কর্মযোগ প্রশংসা
৩. গীতা – অধ্যায় ০৩ – কর্মযোগ
৪. গীতা – অধ্যায় ০৪ – জ্ঞানযোগ
৫. গীতা – অধ্যায় ০৫ – সন্ন্যাসযোগ
৬. গীতা – অধ্যায় ০৬ – ধ্যানযোগ
৭. গীতা – অধ্যায় ০৭ – জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ
৮. গীতা – অধ্যায় ০৮ – অক্ষরব্রহ্মযোগ
৯. গীতা – অধ্যায় ০৯ – রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগ
১০. গীতা – অধ্যায় ১০ – বিভূতিযোগ
১১. গীতা – অধ্যায় ১১ – বিশ্বরূপদর্শন
১২. গীতা – অধ্যায় ১২ – ভক্তিযোগ
১৩. গীতা – অধ্যায় ১৩ – ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞযোগ
১৪. গীতা – অধ্যায় ১৪ – গুণত্রয়বিভাগযোগ
১৫. গীতা – অধ্যায় ১৫ – পুরুষোত্তমযোগ
১৬. গীতা – অধ্যায় ১৬ – দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ
১৭. গীতা – অধ্যায় ১৭ – শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ
১৮. গীতা – অধ্যায় ১৮ – মোক্ষযোগ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন