গীতা – অধ্যায় ০৩ – কর্মযোগ

কালীপ্রসন্ন সিংহ

তৃতীয় অধ্যায় – কর্মযোগ

“অর্জুন কহিলেন, ‘হে কেশব! যদি তোমার মতে কর্ম অপেক্ষা জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ হয়, তবে আমাকে এই মারাত্মক কর্মে কী নিমিত্ত নিয়োজিত করিতেছ? তুমি কখন জ্ঞানের, কখন বা কর্মের প্রশংসা করিয়া আমার বুদ্ধিকে মুগ্ধপ্রায় করিতেছ; এক্ষণে যাহাতে আমার শ্রেয়োলাভ হয়, এমন এক পক্ষ নিশ্চয় করিয়া বল।’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে পার্থ! আমি পূর্বেই কহিয়াছি যে, ইহলোকে নিষ্ঠা দুই প্রকার;–এক, শুদ্ধচেতাদিগের (নির্মল হৃদয়) জ্ঞানযোগ; দ্বিতীয়, কর্মযোগীদিগের কর্মযোগ। পুরুষ কর্মানুষ্ঠান না করিলে জ্ঞান প্রাপ্ত হয় না এবং জ্ঞান প্রাপ্ত না হইলে কেবল সন্ন্যাস দ্বারা সিদ্ধি লাভ করিতে পারে না। কেহ যখন কর্ম না করিয়া ক্ষণমাত্র অবস্থান করিতে সমর্থ হয় না; পুরুষ ইচ্ছা না করিলেও প্রাকৃতিক (স্বাভাবিক) গুণসমুদয়ই তাহাকে কর্মে প্রবর্তিত করে। যে ব্যক্তি কর্মেন্দ্রিয়সকলকে সংযম করিয়া মনে মনে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সকল স্মরণ করে, সেই মূঢ়াত্মা কপটচারী বলিয়া কথিত হয়। হে অর্জুন! যে ব্যক্তি মনোদ্বারা জ্ঞানেন্দ্রিয়গণকে বশীভূত করিয়া আসক্তি পরিত্যাগপূর্বক কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা কর্মানুষ্ঠান করে, সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ। অতএব তুমি নিয়ত কর্ম অনুষ্ঠান কর; কর্মত্যাগ করিলে শরীরযাত্রা নির্বাহ হইবে না। যে কর্ম বিষ্ণুর উদ্দেশে অনুষ্ঠিত হয় না, লোকে তদ্দ্বারাই বন্ধ হইয়া থাকে; অতএব হে কৌন্তেয়! তুমি আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া বিষ্ণুর উদ্দেশে কর্মানুষ্ঠান কর। পূর্বে প্রজাপতি প্রজাগণকে যজ্ঞের সহিত সৃষ্টি করিয়া বলিয়াছেন,–হে প্রজাগণ! তোমরা যজ্ঞদ্বারা উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হও; যজ্ঞ তোমাদিগের কামনা পরিপূর্ণ করুক। তোমরা যজ্ঞ দ্বারা দেবগণকে সংবর্দ্ধিত কর; দেবগণও তোমাদিগকে সংবর্দ্ধিত করুক; এইরূপ পরস্পর সংবর্দ্ধিত হইয়া তোমাদিগকে অভিলষিত ভোগ্যসকল প্রদান করিবেন। যে ব্যক্তি দেবগণপ্রদত্ত ভোগ্যসকল তাঁহাদিগকে প্রদান না করিয়া উপভোগ করে, সে চোর। সাধুগণ যজ্ঞাবশিষ্ট ভোজন করিয়া সর্বপ্রকার পাপ হইতে মুক্ত হয়েন; কিন্তু যাহারা কেবল আপনার নিমিত্ত পাক করে, সেই পাপাত্মগণ পাপই ভোজন করিয়া থাকে। প্রাণিগণ অন্ন হইতে, অন্ন পর্জ্জন্য (বারিবর্ষণকারী মেঘ–বৃষ্টি) হইতে, পর্জ্জন্য যজ্ঞ হইতে, যজ্ঞ কর্ম হইতে, কর্ম বেদ হইতে এবং বেদ ব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভব হইয়াছে; অতএব সর্বব্যাপী ব্রহ্ম নিয়তই যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন। যে ব্যক্তি ইহলোকে বিষয়াসক্ত হইয়া পূর্বোক্ত প্রকারে প্রবর্তিত কর্মাদি চক্রের অনুবর্তী না হয়, তাহার আয়ু পাপময় ও জীবন বৃথা।
“আত্মাতেই যাঁহার প্রীতি। আত্মাতেই যাঁহার আনন্দ এবং আত্মাতেই যাঁহার সন্তোষ, তাঁহাকে কোন কর্ম অনুষ্ঠান করিতে হয় না; কর্মানুষ্ঠান করিলেও তাঁহার পুণ্য হয় না, কর্ম না কইরলেও তাঁহার পাপ হয় না এবং তাঁহাকে মোক্ষের নিমিত্ত ব্রহ্মা অবধি স্থাবর পর্যন্ত কাহারও আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয় না। পুরুষ আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া কর্মানুষ্ঠান করিলে মোক্ষ লাভ করেন; অতএব তুমি আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া কর্মানুষ্ঠান করল জনক প্রভৃতি মহাত্মগণ কর্ম দ্বারাই সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা আচরণ করেন, ইতর ব্যক্তিরা তাহারই অনুষ্ঠান করিয়া থাকে এবং মান্য (কর্মপ্রবর্তক ও কর্মনিবর্তক যে শাস্ত্রকে প্রমাণরূপে গ্রহণ) করেন, তাহারা তাহারই অনুবর্তী হয়, অতএব তুমি লোকদিগের ধর্মরক্ষণার্থ কর্মানুষ্ঠান কর। দেখ, ত্রিভুবনের মধ্যে আমার অপ্রাপ্য কিছুই নাই; সুতরাং আমার কোন প্রকার কর্তব্যও নাই; তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠান করিতেছি। যদি আমি আলস্যহীন হইয়া কখন কর্মানুষ্ঠান না করি, তাহা হইলে সমদুদয় লোকে আমার অনুবর্তী হইবে; অতএব আমি কর্ম না করিলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হইয়া যাইবে এবং আমিই বর্ণসঙ্কর ও প্রজাগণের মলিনতার হেতু হইব। অতএব মূর্খেরা যেমন ফলপ্রত্যাশী হইয়া কর্ম করে, তদ্রুপ বিদ্বানেরা আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া লোকদিগের ধর্মরক্ষণের নিমিত্ত কর্ম করিয়া থাকেন। বিদ্বান ব্যক্তি কর্মাসক্ত অজ্ঞদিগের বুদ্ধিভেদ উৎপন্ন না করিয়া স্বয়ং সর্বপ্রকার কর্মানুষ্ঠানপূর্বক তাহাদিগকে কর্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত করিবেন। সকল প্রকার কর্মই প্রকৃতির গুণস্বরূপ ইন্দ্রিয়গণ কর্তৃক নিষ্পন্ন হইতেছে; কিন্তু অহঙ্কারবিমূঢ়মতি (অহঙ্কারে মোহাপন্ন) ব্যক্তি আপনাকে ঐ সকল কর্মের কর্তা বলিয়া মনে করিয়া থাকে। ইন্দ্রিয়গণই বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতেছে জানিয়া গুণকর্মবিভাগের তত্ত্বজ্ঞ ব্যিক্তি বিষয়ে আসক্ত হয়েন না। যাহারা প্রকৃতির সত্ত্ব প্রভৃতি গুণে সাতিশয় মুগ্ধ হইয়া ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের কার্য্যে আসক্ত হয়, সর্ব্বজ্ঞ ব্যক্তি তাদৃশ অল্পদর্শী মন্দমতিদিগকে বিচালিত করিবেন না।
“তুমি আমাতে সমুদয় কর্ম সম্পর্পণ করিয়া, আমি অন্তর্যামী পুরুষের অধীন হইয়া কর্ম করিতেছি, এই রূপ ভাবিয়া, কামনা, মমতা ও শোক পরিত্যাগপূর্বক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। যাহারা শ্রদ্ধাবান ও অসূয়াশূন্য হইয়া নিরন্তর আমার মতের অনুসরণ করে, তাহারা সকল কর্ম হইতে মুক্ত হয়। যাহারা অসূয়াপরশব হইয়া অনুষ্ঠান না করে, সেই সকল বিবেকশূন্য ব্যক্তি সমুদয় কর্ম ও ব্রহ্মবিষয়ে মুগ্ধ হইয়া বিনাশ প্রাপ্ত হয়। জ্ঞানবান ব্যক্তিও স্বীয় স্বভাবের অনুরূপ কর্ম কইয়া থাকেন; অতএব যখন সকল প্রাণীই স্বভাবের অনুবর্তী, তখন ইন্দ্রিয় নিগ্রহ করিলে কি হইতে পারে? প্রত্যেক ইন্দ্রিয়েরই স্ব স্ব অনুকূল বিষয়ে অনুরাগ ও প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষ আছে; ঐ উভয়ই মূমূক্ষুর (মুক্তিকামীর) প্রতিবন্ধক (বাধাসৃষ্টিকারক); অতএব উহাদের বশবর্তী হইবে না। সম্যক্‌ অনুষ্ঠান পরধর্ম অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অঙ্গহীন স্বধর্মও শ্রেষ্ঠ; পরধর্ম অতি ভয়ানক; অতএব স্বধর্মে মরণও শ্রেয়স্কর।’
“অর্জুন কহিনে, ‘হে বাসুদেব! পুরুষ ইচ্ছা না করিলেও কে কাহাকে বলপূর্বক পালাচরণে নিয়োজিত করে?’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জুন! এই কামই ক্রোধরূপে পরিণত, রজোগুণ হইতে সমুৎপন্ন দুষ্পুরণীয় (অনায়াসে যাহার পূরণ হয় না–পর পর আশা আকাঙ্খা বাড়িতেই থাকে। অতি অধিক আহারী ব্যক্তির যেমন পেট কিছুতেই ভরে না) ও অতিশয় উগ্র; ইহাকেই মুক্তপথের বৈরী বলিয়া জানিবে। যেমন ধূম হইতে অগ্নি, মল দ্বারা দর্পণ (আয়না) ও জরায়ু দ্বারা গর্ভ আবৃত তাহকে, সেইরূপ জ্ঞানিগণের চির-বৈরী, দুষ্পূরণীয়, অনলস্বরূপ কাম জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি ইহার আবির্ভাবস্থান (উৎপত্তিস্থান); এই কাম আশ্রয়ভূত ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করিয়া দেহীকে বিমোহিত করে; হে অর্জুন! অতএব তুমি অগ্রে ইন্দ্রিয়গণকে দমন এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানবিনাশী পাপরূপ কামকে বিনাশ কর; দেহাদি বিষয় অপেক্ষা ইন্দ্রিয়গণ শ্রেষ্ঠ; ইন্দ্রিয়গণ অপেক্ষা মন শ্রেষ্ঠ; মন অপেক্ষা সংশহরহিত বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ; যিনি সেই বুদ্ধি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তিনিই আত্মা। হে মহাবাহো! তুমি আত্মাকে এইরূপ অবগত হইয়া এবং মনকে সংশয়রহিত বুদ্ধি দ্বারা নিশ্চয় করিয়া কামরূপ দুরাসদ (দুর্জয়) শত্রুকে বিনাশ কর।’”

সকল অধ্যায়

১. গীতা – অধ্যায় ০১ – সৈন্যদর্শন, অর্জুনবিষাদ
২. গীতা – অধ্যায় ০২ – বিষাদনাশক সাংখ্যযোগ, কর্মযোগ প্রশংসা
৩. গীতা – অধ্যায় ০৩ – কর্মযোগ
৪. গীতা – অধ্যায় ০৪ – জ্ঞানযোগ
৫. গীতা – অধ্যায় ০৫ – সন্ন্যাসযোগ
৬. গীতা – অধ্যায় ০৬ – ধ্যানযোগ
৭. গীতা – অধ্যায় ০৭ – জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ
৮. গীতা – অধ্যায় ০৮ – অক্ষরব্রহ্মযোগ
৯. গীতা – অধ্যায় ০৯ – রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগ
১০. গীতা – অধ্যায় ১০ – বিভূতিযোগ
১১. গীতা – অধ্যায় ১১ – বিশ্বরূপদর্শন
১২. গীতা – অধ্যায় ১২ – ভক্তিযোগ
১৩. গীতা – অধ্যায় ১৩ – ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞযোগ
১৪. গীতা – অধ্যায় ১৪ – গুণত্রয়বিভাগযোগ
১৫. গীতা – অধ্যায় ১৫ – পুরুষোত্তমযোগ
১৬. গীতা – অধ্যায় ১৬ – দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ
১৭. গীতা – অধ্যায় ১৭ – শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ
১৮. গীতা – অধ্যায় ১৮ – মোক্ষযোগ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন