শেষ পুরস্কার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

খসড়া

সেদিন আই. এ. এবং ম্যাট্রিক ক্লাসের পুরস্কারবিতরণের উৎসব। বিমলা ব’লে এক ছাত্রী ছিল, সুন্দরী ব’লে তার খ্যাতি। তারই হাতে পুরস্কারের ভার। চার দিকে তার ভিড় জমেছে আর তার মনে অহংকার জমে উঠেছে খুব প্রচুর পরিমাণে। একটি মুখচোরা ভালোমানুষ ছেলে কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। সাহস করে একটু কাছে এল যেই, দেখা গেল তার পায়ে হয়েছে ঘা, ময়লা কাপড়ের ব্যাণ্ডেজ জড়ানো। তাকে দেখে বিমলা নাক তুলে বললে, “ও এখানে কেন বাপু, ওর যাওয়া উচিত হাসপাতালে।”

ছেলেটি মন-মরা হয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল। বাড়িতে গিয়ে তার স্কুলঘরের কোণে বসে কাঁদছে, জলখাবারের থালা হাতে তার দিদি এসে বললে, “ও কী হচ্ছে জগদীশ, কাঁদছিস কেন।”

তখন তার অপমানের কথা শুনে মৃণালিনী রাগে জ্বলে উঠল; বললে, “ওর বড়ো রূপের অহংকার, একদিন ঐ মেয়ে যদি তোর এই পায়ের তলায় এসে না বসে তা হলে আমার নাম মৃণালিনী নয়।”

এই গেল ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়। দিদি এখন ইন্‌স্পেক্‌ট্রেস্‌ অব স্কুল্‌স্‌। এসেছেন পরিদর্শন করতে। তিনি তাঁর ভাইয়ের এই দুঃখের কাহিনী মেয়েদের শোনালেন। শুনে মেয়েরা ছি ছি করে উঠল; বললে, কোনো মেয়ে কখনও এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে না—তা সে যত বড়ো রূপসীই হোক-না কেন।

মৃণালিনী মাসি বললেন, জগতে যা সত্য হওয়া উচিত নয়, তাও কখনও কখনও সত্য হয়।

আজ আবার পুরস্কারবিতরণের উৎসব। আরম্ভ হবার কিছু আগেই মৃণালিনী মাসি মেয়েদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, সেদিন সেই-যে ভালোমানুষ ছেলেটিকে অপমান করে বিদায় করা হয়েছিল, সে আজ কী হলে তোমরা খুশি হও।”

কেউ বললে, কবি; কেউ বললে, বিপ্লবী; বাইরে থেকে নিয়মিত একটি মেয়ে বললে, হাইকোর্টের জজ।

ঘণ্টা বাজলো, সবাই প্রস্তুত হয়ে বসল। যিনি প্রাইজ দেবেন তিনি এসে প্রবেশ করলেন, জগদীশপ্রসাদ— হাইকোর্টের জজ। তিনি বসতেই সেই নিমন্ত্রিত মেয়ে যে মজঃফরপুরে মেয়েদের হাইস্কুলে তৃতীয় বর্গে অঙ্ক কষাত, সে এসে প্রণাম করে তাঁর পায়ে ফুলের মালা দিয়ে চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে দিলে। জগদীশপ্রসাদ শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, “এ আবার কী রকমের সম্মান! ”

মাসি বললেন, “নতুন রকমের বলছ কেন— অতি পুরাতন। আমাদের দেশে দেবতাদের পূজো আরম্ভ হয় পায়ের দিক থেকে। আজ তোমার সেই পদের সম্মান করা হল।”

এইবার পরিচয়গুলো সমাপ্ত করা যাক। এই মেয়েটি এককালকার রূপসী ছাত্রী বিমলাদিদি, বোর্ডিং স্কুলের অহংকারের সামগ্রী ছিল। পিতার মৃত্যুর পরে আজ ক্লাস পড়াবার ভার নিয়েছে; আর এ দিক ও দিক থেকে কিছু টিউশনি করে কাজ চালায়। যে পা’কে একদিন সে ঘৃণা করেছিল সেই পা’কে অর্ঘ্য দেবর জন্য আজ তার বিশেষ করে নিমন্ত্রণ হয়েছে। মৃণালিনী মাসি— সেই সেদিনকার দিদি। আর সেই তার ভাই জগদীশপ্রসাদ, হাইকোর্টের জজ।

এটা গল্পের মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু কখনও কখনও গল্পও সত্যি হয়। আর যে লোকটা এই ইতিহাসটা লিখছে সে হচ্ছে অবিনাশ, সেদিন সে লম্বা লম্বা পা ফেলে বড়ো বড়ো পরীক্ষা ডিঙিয়ে চলত— সেও উপস্থিত ছিল সেই প্রথমবারকার পুরস্কারের উৎসবে। সেদিন নানারকম খেলা হয়েছিল— হাইজাম্প্‌, লম্বা দৌড়, রশি-টানাটানি—তার মধ্যে এই অবিনাশ আবৃত্তি করেছিল রবিঠাকুরের ‘পঞ্চনদীর তীরে’। কবিতার ছন্দের জোর যত, তার গলায় ছিল জোর চার গুণ বেশি। সেই-ই সব চেয়ে বড়ো পুরস্কার পেয়েছিল। আজ সে জজের অনুগ্রহে সেরেস্তাদারের সেরেস্তায় হেড-কেরানির পদ পেয়েছে।

সকল অধ্যায়

১. রাজপথের কথা
২. পোস্ট‌্মাস্টার
৩. গিন্নি
৪. রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা
৫. ব্যবধান
৬. ঘাটের কথা
৭. তারাপ্রসন্নের কীর্তি
৮. খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন
৯. সম্পত্তি-সমর্পণ
১০. মুক্তির উপায়
১১. দালিয়া
১২. ত্যাগ
১৩. একটা আষাঢ়ে গল্প
১৪. কাবুলিওয়ালা
১৫. সম্পাদক
১৬. জয়পরাজয়
১৭. জীবিত ও মৃত
১৮. একরাত্রি
১৯. অসম্ভব কথা
২০. অনধিকার প্রবেশ
২১. আপদ
২২. একটি ক্ষুদ্র পুরাতন গল্প
২৩. কঙ্কাল
২৪. খাতা
২৫. ছুটি
২৬. দান প্রতিদান
২৭. প্রায়শ্চিত্ত
২৮. বিচারক
২৯. মহামায়া
৩০. মেঘ ও রৌদ্র
৩১. রীতিমত নভেল
৩২. শাস্তি
৩৩. সমস্যাপূরণ
৩৪. সমাপ্তি
৩৫. সুভা
৩৬. স্বর্ণমৃগ
৩৭. দিদি
৩৮. দুরাশা
৩৯. পুত্রযজ্ঞ
৪০. প্রতিহিংসা
৪১. ক্ষুধিত পাষাণ
৪২. ঠাকুরদা
৪৩. মানভঞ্জন
৪৪. ইচ্ছাপূরণ
৪৫. অতিথি
৪৬. অধ্যাপক
৪৭. অপরিচিতা
৪৮. উদ্ধার
৪৯. উলুখড়ের বিপদ
৫০. চোরাই ধন
৫১. ডিটেকটিভ
৫২. তপস্বিনী
৫৩. দর্পহরণ
৫৪. দুর্বুদ্ধি
৫৫. দৃষ্টিদান
৫৬. দেনাপাওনা
৫৭. নামঞ্জুর গল্প
৫৮. নিশীথে
৫৯. পণরক্ষা
৬০. পয়লা নম্বর
৬১. পাত্র ও পাত্রী
৬২. প্রগতিসংহার
৬৩. প্রতিবেশিনী
৬৪. ফেল
৬৫. বদনাম
৬৬. বলাই
৬৭. বোষ্টমী
৬৮. ভাইফোঁটা
৬৯. ভিখারিনী
৭০. মধ্যবর্তিনী
৭১. মাল্যদান
৭২. মাস্টারমশায়
৭৩. মুকুট
৭৪. মুসলমানীর গল্প
৭৫. যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ
৭৬. রাজটিকা
৭৭. রাসমণির ছেলে
৭৮. শুভদৃষ্টি
৭৯. শেষ পুরস্কার
৮০. শেষের রাত্রি
৮১. সদর ও অন্দর
৮২. স্ত্রীর পত্র
৮৩. হালদারগোষ্ঠী
৮৪. হৈমন্তী
৮৫. করুণা – ০১
৮৬. করুণা – ০২
৮৭. করুণা – ০৩
৮৮. করুণা – ০৪
৮৯. করুণা – ০৫
৯০. করুণা – ০৬
৯১. কর্মফল – ০১
৯২. কর্মফল – ০২
৯৩. কর্মফল – ০৩
৯৪. কর্মফল – ০৪
৯৫. গুপ্তধন
৯৬. নষ্টনীড় – ০১
৯৭. নষ্টনীড় – ০২
৯৮. নষ্টনীড় – ০৩

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন