উলুখড়ের বিপদ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাবুদের নায়েব গিরিশ বসুর অন্তঃপুরে প্যারী বলিয়া একটি নূতন দাসী নিযুক্ত হইয়াছিল। তাহার বয়স অল্প; চরিত্র ভালো। দূর বিদেশ হইতে আসিয়া কিছুদিন কাজ করার পরেই একদিন সে বৃদ্ধ নায়েবের অনুরাগদৃষ্টি হইতে আত্মরক্ষার জন্য গৃহিণীর নিকট কাঁদিয়া গিয়া পড়িল। গৃহিণী কহিলেন, “বাছা, তুমি অন্য কোথাও যাও; তুমি ভালোমানুষের মেয়ে, এখানে থাকিলে তোমার সুবিধা হইবে না।” বলিয়া গোপনে কিছু অর্থ দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন।

কিন্তু পালানো সহজ ব্যাপার নহে, হাতে পথ খরচও সামান্য, সেইজন্য প্যারী গ্রামে হরিহর ভট্টাচার্য মহাশয়ের নিকট গিয়া আশ্রয় লইল। বিবেচক ছেলেরা কহিল, “বাবা, কেন বিপদ ঘরে আনিতেছেন।” হরিহর কহিলেন, “বিপদ স্বয়ং আসিয়া আশ্রয় প্রার্থনা করিলে তাহাকে ফিরাইতে পারি না।”

গিরিশ বসু সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া কহিল, “ভট্টাচার্যমহাশয়, আপনি আমার ঝি ভাঙাইয়া আনিলেন কেন। ঘরে কাজের ভারি অসুবিধা হইতেছে।” ইহার উত্তরে হরিহর দু-চারটে সত্য কথা খুব শক্ত করিয়াই বলিলেন। তিনি মানী লোক ছিলেন, কাহারো খাতিরে কোনো কথা ঘুরাইয়া বলিতে জানিতেন না। নায়েব মনে মনে উদ্গতপক্ষ পিপীলিকার সহিত তাঁহার তুলনা করিয়া চলিয়া গেল। যাইবার সময় খুব ঘটা করিয়া পায়ের ধুলা লইল। দুই-চারিদিনের মধ্যেই ভট্টাচার্যের বাড়িতে পুলিসের সমাগম হইল। গৃহিণীঠাকুরানীর বালিশের নীচে হইতে নায়েবের স্ত্রীর একজোড়া ইয়ারিং বাহির হইল। ঝি প্যারী চোর সাব্যস্ত হইয়া জেলে গেল। ভট্টাচার্যমহাশয় দেশবিখ্যাত প্রতিপত্তির জোরে চোরাই-মাল রক্ষার অভিযোগ হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন। নায়েব পুনশ্চ ব্রাক্ষ্মণের পদধূলি লইয়া গেল। ব্রাক্ষ্মণ বুঝিলেন, হতভাগিনীকে তিনি আশ্রয় দেওয়াতেই প্যারীর সর্বনাশ ঘটিল। তাঁহার মনে শেল বিঁধিয়া রহিল। ছেলেরা কহিল, “জমিজমা বেচিয়া কলিকাতায় যাওয়া যাক, এখানে বড়ো মুশকিল দেখিতেছি।” হরিহর কহিলেন, “পৈতৃক ভিটা ছাড়িতে পারিব না, অদৃষ্টে থাকিলে বিপদ কোথায় না ঘটে।”

ইতিমধ্যে নায়েব গ্রামে অতিমাত্রায় খাজনা বৃদ্ধির চেষ্টা করায় প্রজারা বিদ্রোহী হইল। হরিহরের সমস্ত ব্রক্ষ্মোত্তর জমা, জমিদারের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নাই। নায়েব তাহার প্রভুকে জানাইল, হরিহরই প্রজাদিগকে প্রশ্রয় দিয়া বিদ্রোহী করিয়া তুলিয়াছে। জমিদার কহিলেন, “যেমন করিয়া পার ভট্টাচার্যকে শাসন করো।” নায়েব ভট্টাচার্যের পদধূলি লইয়া কহিল, “সামনের ঐ জমিটা পরগনার ভিটার মধ্যে পড়িতেছে; ওটা তো ছাড়িয়া দিতে হয়।” হরিহর কহিলেন, “সে কী কথা। ও যে আমার বহুকালের ব্রক্ষ্মত্র।” হরিহরের গৃহপ্রাঙ্গণের সংলগ্ন পৈতৃক জমি জমিদারের পরগনার অন্তর্গত বলিয়া নালিশ রুজু হইল। হরিহর বলিলেন, “এ জমিটা তো তবে ছাড়িয়া দিতে হয়, আমি তো বৃদ্ধ বয়সে আদালতে সাক্ষি দিতে পারিব না।” ছেলেরা বলিল, “বাড়ির সংলগ্ন জমিটাই যদি ছাড়িয়া দিতে হয় তবে ভিটায় টিঁকিব কী করিয়া।”

প্রাণাধিক পৈতৃক ভিটার মায়ায় বৃদ্ধ কম্পিতপদে আদালতের সাক্ষ্যমঞ্চে গিয়া দাঁড়াইলেন। মুন্সেফ নবগোপালবাবু তাঁহার সাক্ষ্যই প্রামাণ্য করিয়া মকদ্দমা ডিস্‌‌‌মিস্‌‌‌ করিয়া দিলেন। ভট্টাচার্যের খাস প্রজারা ইহা লইয়া গ্রামে ভারি উৎসবসমারোহ আরম্ভ করিয়া দিল। হরিহর তাড়াতাড়ি তাহাদিগকে থামাইয়া দিলেন। নায়েব আসিয়া পরম আড়ম্বরে ভট্টাচার্যের পদধূলি লইয়া গায়ে মাথায় মাখিল এবং আপিল রুজু করিল। উকিলরা হরিহরের নিকট হইতে টাকা লন না। তাঁহারা ব্রাক্ষ্মণকে বারংবার আশ্বাস দিলেন, এ মকদ্দমায় হারিবার কোনো সম্ভাবনাই নাই। দিন কি কখনো রাত হইতে পারে। শুনিয়া হরিহর নিশ্চিন্ত হইয়া ঘরে বসিয়া রহিলেন।

একদিন জমিদারি কাছারিতে ঢাকঢোল বাজিয়া উঠিল, পাঁঠা কাটিয়া নায়েবের বাসায় কালীপূজা হইবে। ব্যাপারখানা কী। ভট্টাচার্য খবর পাইলেন, আপিলে তাঁহার হার হইয়াছে।
ভট্টাচার্য মাথা চাপড়াইয়া উকিলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বসন্তবাবু, করিলেন কী। আমার কী দশা হইবে।”

দিন যে কেমন করিয়া রাত হইল, বসন্তবাবু তাহার নিগুঢ় বৃত্তান্ত বলিলেন, “সম্প্রতি যিনি নূতন অ্যাডিশনাল জজ হইয়া আসিয়াছেন তিনি মুন্সেফ থাকা কালে মুন্সেফ নবগোপালবাবুর সহিত তাঁহার ভারি খিটিমিটি বাধিয়াছিল। তখন কিছু করিয়া উঠিতে পারেন নাই; আজ জজের আসনে বসিয়া নবগোপালবাবুর রায় পাইবামাত্র উলটাইয়া দিতেছেন; আপনি হারিলেন সেইজন্য।” ব্যাকুল হরিহর কহিলেন, “হাইকোর্টে ইহার কোনো আপিল নাই? ” বসন্ত কহিলেন, “জজবাবু আপিলে ফল পাইবার সম্ভাবনা মাত্র রাখেন নাই। তিনি আপনাদের সাক্ষীকে সন্দেহ করিয়া বিরুদ্ধ পক্ষের সাক্ষীকেই বিশ্বাস করিয়া গিয়াছেন। হাইকোর্টে তো সাক্ষীর বিচার হইবে না।”

বৃদ্ধ সাশ্রুনেত্রে কহিলেন, “তবে আমার উপায়? ”

উকিল কহিলেন, “উপায় কিছুই দেখি না।”

গিরিশ বসু পরদিন লোকজন সঙ্গে লইয়া ঘটা করিয়া ব্রাক্ষ্মণের পদধূলি লইয়া গেল এবং বিদায়কালে উচ্ছ্বসিত দীর্ঘনিশ্বাসে কহিল, “প্রভু, তোমারই ইচ্ছা।”

সকল অধ্যায়

১. রাজপথের কথা
২. পোস্ট‌্মাস্টার
৩. গিন্নি
৪. রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা
৫. ব্যবধান
৬. ঘাটের কথা
৭. তারাপ্রসন্নের কীর্তি
৮. খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন
৯. সম্পত্তি-সমর্পণ
১০. মুক্তির উপায়
১১. দালিয়া
১২. ত্যাগ
১৩. একটা আষাঢ়ে গল্প
১৪. কাবুলিওয়ালা
১৫. সম্পাদক
১৬. জয়পরাজয়
১৭. জীবিত ও মৃত
১৮. একরাত্রি
১৯. অসম্ভব কথা
২০. অনধিকার প্রবেশ
২১. আপদ
২২. একটি ক্ষুদ্র পুরাতন গল্প
২৩. কঙ্কাল
২৪. খাতা
২৫. ছুটি
২৬. দান প্রতিদান
২৭. প্রায়শ্চিত্ত
২৮. বিচারক
২৯. মহামায়া
৩০. মেঘ ও রৌদ্র
৩১. রীতিমত নভেল
৩২. শাস্তি
৩৩. সমস্যাপূরণ
৩৪. সমাপ্তি
৩৫. সুভা
৩৬. স্বর্ণমৃগ
৩৭. দিদি
৩৮. দুরাশা
৩৯. পুত্রযজ্ঞ
৪০. প্রতিহিংসা
৪১. ক্ষুধিত পাষাণ
৪২. ঠাকুরদা
৪৩. মানভঞ্জন
৪৪. ইচ্ছাপূরণ
৪৫. অতিথি
৪৬. অধ্যাপক
৪৭. অপরিচিতা
৪৮. উদ্ধার
৪৯. উলুখড়ের বিপদ
৫০. চোরাই ধন
৫১. ডিটেকটিভ
৫২. তপস্বিনী
৫৩. দর্পহরণ
৫৪. দুর্বুদ্ধি
৫৫. দৃষ্টিদান
৫৬. দেনাপাওনা
৫৭. নামঞ্জুর গল্প
৫৮. নিশীথে
৫৯. পণরক্ষা
৬০. পয়লা নম্বর
৬১. পাত্র ও পাত্রী
৬২. প্রগতিসংহার
৬৩. প্রতিবেশিনী
৬৪. ফেল
৬৫. বদনাম
৬৬. বলাই
৬৭. বোষ্টমী
৬৮. ভাইফোঁটা
৬৯. ভিখারিনী
৭০. মধ্যবর্তিনী
৭১. মাল্যদান
৭২. মাস্টারমশায়
৭৩. মুকুট
৭৪. মুসলমানীর গল্প
৭৫. যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ
৭৬. রাজটিকা
৭৭. রাসমণির ছেলে
৭৮. শুভদৃষ্টি
৭৯. শেষ পুরস্কার
৮০. শেষের রাত্রি
৮১. সদর ও অন্দর
৮২. স্ত্রীর পত্র
৮৩. হালদারগোষ্ঠী
৮৪. হৈমন্তী
৮৫. করুণা – ০১
৮৬. করুণা – ০২
৮৭. করুণা – ০৩
৮৮. করুণা – ০৪
৮৯. করুণা – ০৫
৯০. করুণা – ০৬
৯১. কর্মফল – ০১
৯২. কর্মফল – ০২
৯৩. কর্মফল – ০৩
৯৪. কর্মফল – ০৪
৯৫. গুপ্তধন
৯৬. নষ্টনীড় – ০১
৯৭. নষ্টনীড় – ০২
৯৮. নষ্টনীড় – ০৩

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন