সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২৬

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই সংখ্যায় শ্রীযুক্ত গোপালচন্দ্র শাস্ত্রী লিখিত “সহরৎ-এ-আম্‌’ প্রবন্ধটি বিশেষ ঔৎসুক্যজনক। মুসলমান শাসনকালে ভারতবর্ষে পব্লিক-ওয়র্কস-ডিপার্টমেন্ট ছিল–লেখক প্রাচীন গ্রন্থাদি হইতে তাহার প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছেন। সেই বিভাগের পারসি নাম ছিল সহরৎ-এ-আম, অর্থাৎ সাধারণের সুবিধা। তাহার এইরূপ কর্তব্য বিভাগ ছিল– “১ম, প্রজাসাধারণের কৃষিকার্য ও জলের সুবিধা। ২য়, ডাকখানার বন্দোবস্ত। ৩য়, ঝটিতি শুভাশুভ সমাচার প্রেরণ বা জ্ঞাপন। ৪র্থ, সমাচার পত্র প্রকাশ করা। ৫ম, পূর্তবিভাগ অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ারিং।’ এই প্রবন্ধে তৎকালীন সংবাদপত্র, ও ডাক বন্দোবস্তের যে আলোচনা আছে তাহা কৌতূহলজনক। পয়ঃপ্রণালী দ্বারা বহুদূর হইতে বিশুদ্ধ জল আনিবার যে ব্যবস্থা ছিল তৎপ্রসঙ্গে লেখক বলিতেছেন– “এখন water works-এর সহিত তখনকার জলের কলের প্রভেদ এই যে, ইঞ্জিনের ব্যবহার মুসলমানদের সময়ে ছিল না, অথচ ইংরাজের জলের কলের ন্যায় অনায়াসে অনর্গল নির্মল জল দিবারাত্রি মিলিত, সুতরাং প্রজাসাধারণের নিকট জলের ট্যাক্স লওয়া হইত না। … পিপাসিতকে পানীয় জল দিয়া তাহার নিকট হইতে পয়সা লওয়া আসিয়ার (oriental) রাজাদিগের ধর্ম ও আচারবিরুদ্ধ। জয়পুর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যের রাজারা প্রজাসাধারণকে জল জোগাইয়া কর গ্রহণ করেন না।’ ইংরাজের ব্যবস্থায় জলও যেমন কলে আসে, সঙ্গে সঙ্গে করও তেমনি কলে আদায় হইয়া যায়। ইংরাজরাজ্যের সুশাসন ও সুব্যবস্থা যে আমাদের কাছে কলের মতো বোধ হয়, তাহা যে অনেক সময় আমাদের কল্পনা এবং হৃদয় আকর্ষণ করিতে পারে না তাহার কারণ ইংরাজ-রাজকার্যে রাজোচিত প্রত্যক্ষ ঔদার্য দেখিতে পাওয়া যায় না। রাজত্ব যেন একটি বৃহৎ দোকান : সওদাগরের “একচেটে’ রাজকার্য-নামক মালগুলি প্রজাদিগকে অগত্যা কিনিতে হয়। এমন-কি, রাজদ্বারে বিচারপ্রার্থী হইলেও দীনতম প্রজাকেও ট্যাঁক হইতে পয়সা গণিয়া দিতে হয়। হইতে পারে, সে কালে বিচারক ঘুষ লইতে ছাড়িত না, কিন্তু তাহা রাজার দাবি নহে, তাহা কর্মচারীর চুরি। তখন রাজপথ, পান্থশালা, দীর্ঘিকা রাজার দান বলিয়া প্রজারা কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করিত। এখন পথকর পাবলিক কর গণিয়া দিয়াও তাহার প্রত্যক্ষফল অল্প লোকে দেখিতে পায়। পূর্বে রাজার জন্মদিনে রাজাই দান বিতরণ করিয়া সাধারণকে বিস্মিত করিয়া দিতেন, এক্ষণে রাজকীয় কোনো মঙ্গলউৎসবে প্রজাদিগকেই চাঁদা জোগাইতে হয়। জেলায় ছোটোলাট প্রভৃতি রাজপ্রতিনিধির শুভাগমনকে আপনাদের নিকট স্মরণীয় করিবার জন্য প্রজাদের আপনাদিগকেই চেষ্টা করিতে হয় এবং তাহাদের সেই কৃতকীর্তিতে রাজা নিজের নাম অঙ্কিত করেন। কানুজংশনে যখন প্লেগ-সন্দিগ্ধদের বন্দীশালা দেখিতাম তখন বারংবার এ কথা মনে হইত যে, অশোকের ন্যায় আকবরের ন্যায় কোনো প্রাচ্য রাজা যদি সাধারণের হিতের জন্য এইপ্রকারের অবরোধ আবশ্যক বোধ করিতেন তবে তাহার ব্যবস্থা কখনোই এমন দীনহীন ও একান্ত অপ্রবৃত্তিকর হইত না– অন্তত নিরপরাধ অবরুদ্ধদের পানাহার রাজব্যয়ে সম্পন্ন হইত; যথেষ্ট বেতনভুক ডাক্তার প্রভৃতিরা সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করিতেছেন অথচ রাজ্যের হিতোদ্দেশে উৎসৃষ্ট যে-সকল দুর্ভাগা তাঁহাদের সযত্নসেব্য অতিথিস্থানীয়, যাহারা পরদেশে বিনাদোষে নিরুপায়ভাবে বন্দীকৃত, হয়তো পাথেয়বান সঙ্গীগণ হইতে বিচ্ছিন্ন, তাহাদিগকে স্বচেষ্টায় নিজব্যয়ে কষ্টে জীবনধারণ করিতে দেওয়া অন্তত প্রাচ্য প্রজাদের চক্ষে কোনোমতে রাজোচিত বলিয়া বোধ হয় না। সাধারণের জন্য রাজার হিতচেষ্টা বিভীষিকাময় না হইয়া যথার্থ রমণীয় মূর্তি ধারণ করিত যদি এই-সকল অবরোধশালা এবং মারী হাসপাতালের মধ্যে যত্ন ও ঔদার্য প্রকাশ পাইত। দৃষ্টিমাত্রেই যাহার বহিরাকারে দৈন্য এবং অবহেলা পরিস্ফুট হইয়া উঠে তাহার মধ্যে যে সাংঘাতিক অবস্থায় যথোপযুক্ত সেবা-শুশ্রূষা মিলিবে ইহা কাহারও প্রতীতি হয় না; রাজপুরুষের নিকট সর্ববিষয়ে আমাদের মূল্য যে কতই অল্প তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া সংকটের সময় আমাদের আতঙ্ক বাড়িয়া যায় এবং তখন ভীতসাধারণকে সান্ত্বনাদান করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠে। ঘোষণাদ্বারা আশ্বাসের দ্বারা যথেষ্ট ফল হয় না; যে-সকল প্রত্যক্ষ রাজচেষ্টা বরাভয় উদারমূর্তি ধারণ করিয়া আমাদের কল্পনাবৃত্তিকে রাজার কল্যাণ ইচ্ছার দিকে স্বতই আকর্ষণ করিয়া লইয়া যায় তাহাই ফলদায়ক। যাহা সংকল্পে শুভ এবং যাহা পরিণামে শুভ তাহাকে আকারেপ্রকারেও শুভসুন্দর করিয়া না তুলিলে তাহার হিতকারিত্ব সম্পূর্ণ হয় না, এমন-কি, অনেক সময় তাহা হিতে বিপরীত হয়। যাহা হউক, আলোচ্য প্রবন্ধের জন্য শাস্ত্রীমহাশয় আমাদের ধন্যবাদার্হ। শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার বড়াল ইংরাজি কবি হুড্‌ রচিত “এ প্যেরেন্টাল ওড্‌ টু মাই সন্‌’ নামক কবিতার মর্ম গ্রহণ করিয়া “আদর’ নামক যে কবিতা রচনা করিয়াছেন তাহা সুন্দর হইয়াছে– তাহাতে মূল কবিতার হাস্যমিশ্রিত স্নেহরসটুকু আছে অথচ তাহাতে অনুবাদের সংকীর্ণতা দূর হইয়া কবির স্বকীয় ক্ষমতা প্রকাশ পাইয়াছে। ডাক্তার যোগেন্দ্রনাথ মিত্রের “প্লেগ বা মহামারী’ সুলিখিত সময়োচিত প্রবন্ধ। শ্রীযুক্ত আবদুল করিমের “খলিফাদিগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইয়া গেছে– নব্যভারতে তাহার খণ্ডশ পুনঃপ্রকাশ বাহুল্যমাত্র।

ভারতী, আষাঢ়, ১৩০৫। নব্যভারত, জৈষ্ঠ্য ও আষাঢ়, ১৩০৫

সকল অধ্যায়

১. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ০১
২. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ০২
৩. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ০৩
৪. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ০৪
৫. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ০৫
৬. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ০৬
৭. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ০৭
৮. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ০৮
৯. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ০৯
১০. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ১০
১১. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ১১
১২. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ১২
১৩. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ১৩
১৪. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ১৪
১৫. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ১৫
১৬. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ১৬
১৭. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ১৭
১৮. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ১৮
১৯. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ১৯
২০. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২০
২১. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২১
২২. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২২
২৩. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২৩
২৪. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২৪
২৫. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২৫
২৬. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২৬
২৭. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২৭
২৮. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২৮
২৯. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ২৯
৩০. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ৩০
৩১. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ৩১
৩২. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ৩২
৩৩. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ৩৩
৩৪. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ৩৪
৩৫. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ৩৫
৩৬. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ৩৬
৩৭. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ৩৭
৩৮. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ৩৮
৩৯. সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – ৩৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন