০৫. এশার নামাজের পর

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

One men illumines you with his
ardur/another sets in you his
sorrow/O Nature!
–Baudelaire

রাতের প্রথম যামে ‘এশা’র নামাজের পর কিছুক্ষণ প্রবীণ মুসল্লিরা হুজুরের সান্নিধ্যে কাটিয়ে পুণ্য অর্জনের ফিকিরে থাকেন। প্রায় একমাস হয়ে গেল এখনও হুজুর বদিউজ্জামান স্ত্রীর রান্না খাওয়ার সুযোগই পাচ্ছেন না। মৌলাহাট অবস্থাপন্ন মানুষের গ্রাম। ভক্ত শিষ্যবৃন্দ হজুরকে তাঁর বাড়ির খাওয়া খেতে না দেওয়ার জন্য যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিরক্তি ধরে গেলেও বদিউজ্জামান বাধা দিতে পারেন না। এ রাতের খানা এসেছিল এক সম্পন্ন গৃহস্থ মনিরুলের বাড়ি থেকে। মসজিদ শুধুমাত্র ভজনালয়। সেখানে খাওয়াদাওয়ার বিধি নেই। মসজিদকে শয়নকক্ষ করাও বেশরিয়তি। তবে কিনা রোজার সময় দৈনন্দিন উপবাসভঙ্গকালে মসজিদের বারান্দায় বসে আহারগ্রহণ করা চলে। এদিকে মৌলানারা বুজুর্গ ব্যক্তি। তাছাড়া বদুপির নামে কিংবদন্তিসিদ্ধ পুরুষের কথাই আলাদা। তিনি নিভৃত মসজিদকক্ষে লণ্ঠনের আলোয় খাওয়াদাওয়া সেরে বাইরে যখন প্রক্ষালন করতে এলেন, দেখলেন প্রধান কিছু ভক্ত বারান্দা ও খোলা চত্বরে বসে তাঁর সান্নিধ্যের প্রতীক্ষা করছে। এতক্ষণ চাপা স্বরে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। হুজুরকে দেখে স্তব্ধ হল সসম্ভ্রমে। হুজুর অনুচ্চ স্বরে ঈশ্বরের প্রশস্তি উচ্চারণ করতে-করতে খোলা চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালেন। রাত্রিটি ছিল ঘন অন্ধকার। আকাশে জ্বলজ্বল করছিল নক্ষত্রমণ্ডলী। বদিউজ্জামান অভ্যাসমতো সেই জ্যোতিষ্করাজ্য দর্শন করছিলেন। এইসব সময় কী এক প্রচণ্ড আবেগ তাঁকে পেয়ে বসে। মুহুর্মুহু বিস্ময়ে তিনি শিহরিত হন। ওই সেই জ্যোতির্ময় অনন্ত স্থানকালের প্রান্তসীমা, যেখানে একদা এক রাতে পবিত্ৰপুরুষ পয়গম্বর সুন্দরী নারীর মুখমণ্ডলবিশিষ্ট পক্ষিরাজ অশ্ব ‘বোররাখে’র পিঠে চেপে ঈশ্বরের আমন্ত্রণে ‘উত্থিত’ হয়েছিলেন! এক রোমাঞ্চকর বিস্ময় বদিউজ্জামানকে শিহরিত করে। ওই অনন্ত স্থান-কাল পেরিয়ে গেলে কোথায় সে পরম জ্যোতির্ময় সিংহাসন আরস’, যাতে সমাসীন এই ‘কুলমখলুকাত’– বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূলাধার, যিনি আল্লাহ, যিনি তুচ্ছাতিতুচ্ছ, এই বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন।

আর শিষ্যরা তাঁকে অন্ধকারে নক্ষত্রমুখী দেখে প্রতিরাতেই সাগ্রহে প্রতীক্ষা করেন কোনও-না-কোনও বিস্ময়কর বার্তা শুনে পুণ্যসঞ্চয়ের অভিপ্রায়ে। আজ তাঁরা দেখলেন, হুজুর একটু বেশি সময় ধরে আসমানে নজর রেখেছেন। তিনি নিশ্চয় কোনও ‘মোজেজা’ প্রত্যক্ষ করছেন। তারাও সেটি দেখার জন্য সাগ্রহে আকাশদর্শনে উন্মুখ হল। সেই সময় বদিউজ্জামান হঠাৎ ডাকলেন, আনিসুর রহমান! মনিরুল! আপনারা আছেন কি?

বারান্দায় আলো নেই। বেঁটে একটি ‘লানটিন’ বা লণ্ঠন জ্বলছিল মসজিদের ভিতর। আলো-আঁধারি রহস্যময়তা মসজিদ চত্বরে। ডাক শুনে আনিসুর মনিরুল এবং বাকি প্রবীণেরা সাড়া দিলেন। বদিউজ্জামান মৃদু হেসে বললেন, হাওয়াবাতাস বন্ধ। আসুন, এখানে বসা যাক।

মসজিদ চত্বরে ‘অজু’ করার জন্য একটি অপ্রশস্ত চৌবাচ্চা আছে। সেটির পরিত্যক্ত এবং জরাজীর্ণ দশা। তার পাড়ে হুজুরকে বসতে দেখে নিচের এবড়ো খেবড়ো মেঝেয় শিষ্যরা বসে পড়লেন। মসজিদটি প্রাচীন। আজানের মিনারটি কবে ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি মসজিদের আমূল সংস্কারের ব্যবস্থা হয়েছে। শিগগির কাজ শুরু হয়ে যাবে। শিষ্যরা নিচে বসলে বদিউজ্জামান ব্যস্তভাবে বললেন, এ কী! আপনারা নিচে বসছেন কেন? আমরা সবাই খোদার বান্দা। এখানে বসুন।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁরা হুজুরের সঙ্গে ঈষৎ দূরত্ব রেখে চৌবাচ্চার নিচু পাড় ঘিরে বসলেন। তখন বদিউজ্জামান বললেন, একটা কথা বলা দরকার মনে করছি। কদিন থেকেই কানে আসছে, শফিউজ্জামানের ইংরাজি স্কুলে পড়া নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে–

আনিসুর এখন মৌলাহাটে হুজুরের প্রধান শিষ্য। প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক। তিনি দ্রুত বললেন, তওবা! তওবা! এমন কথা কোন বেতমিজের জবান দিয়ে নিকলেছে শুনলে তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে!

মনিরুল এবং অনন্যরাও একবাক্যে সায় দিলেন। বদিউজ্জামান একটু হাসলেন। বললেন, প্রশ্ন জাগতেই পারে। সত্যিই তো? আমরা ওহাবি ফরাজি। ইংরেজ আমাদের দুশমন। ইংরেজি হল কি না খ্রিস্তানি নাছারার (ন্যাজারেথের যিশু অনুগামীদের) কুফরি এলেম।।

আনিসুর কিঞ্চিৎ লেখাপড়া জানেন। হুজুর! আপনি কি দেওয়ানসাহেবকে বলেননি, নাছারাদের ঢিট করতে হলে নাছারি বিদ্যা শেখা দরকার?

মনিরুল উম্মা দেখিয়ে বলল, হ্যাঁ– কথাটা আমারও কানে এসেছে। আসলে দেওয়ানসাহেব যখনই আসেন, কাদু ‘ওস্তাজিকে ঠাট্টা করে বলেন, ‘আলেফ-বে’ শিখিয়ে কী হবে ওস্তাজি? বাংলা-ইংরেজি পাঠশালা করে মক্তব তুলে দিন। তাই বোধ করি কাদু ওস্তাজি রাগ করে বলেছেন, হুজুর মৌলানাকে গিয়ে বলুন না চৌধুরিসাহেব। তাঁর ছেলে তো হরিণমারা স্কুলে ভরতি হয়েছে।

আরেক প্রধান শিষ্য বদরুদ্দিন লাফিয়ে উঠলেন। এক্ষুণি কাদু ওস্তাজিকে গাঁছাড়া করছি! ভারি আমার মক্তব খুলেছে! পেটের ধান্দা খালি। দয়া করে আমরা তাকে মক্তব খুলে দিয়েছি। নৈলে ভিখ মেঙে বেড়াত গায়ে-গাঁয়ে।

বদিউজ্জামান ভর্ৎসনার সুরে বললেন, ছিঃ বদরুদ্দিন! কাদেরসাহেব মুসল্লি মানুষ। গোনাহের কাজ করবেন না!

অপর শিষ্য হাফিজ বললেন, বড়ো একগুঁয়ে মানুষ বটে। এখনও তওবা করে হুজুরের কাছে ফরাজি হলেন না। নামুপাড়ার লোকেরা যে ফরাজি হল না এখনও কিংবা ধরুন আলাদা মসজিদে নমাজ পড়ছে, সেও ওস্তাজির সাহসে। নয় কি না। বলুন আপনারা?

বিতর্ক এককথায় থামিয়ে বদিউজ্জামান বললেন, আজ রাতে আল্লার মেহেরবানিতে ঝড়-পানি হবে মনে হচ্ছে। ওই দেখুন, আসমানের কোনায় ঝিলিক দিচ্ছে। হাওয়া-বাতাস বন্ধ।

মৌলাহাটের এই মানুষগুলো সবাই কৃষিজীবী। সারা চৈত্রমাস গেছে। মাঝে মাঝে একটু-আধটু ঝড় এসেছে। সবই ধুলো-ওড়ানো, গাছপালার ডাল মুচড়ে দেওয়া পাতাছেঁড়া হিংস্র রাঢ়মাটির স্বভাবগ্রস্ত ঝড়। আকাশ ভয়ঙ্কর লাল করে দেওয়া সেইসব ঝড় মৌলাহাটের প্রত্যাশায় মুঠোমুঠো ধুলো ছড়িয়ে চলে গেছে। গত জুম্মাবারই তো কথা উঠেছিল মাঠে গিয়ে বৃষ্টির জন্য নমাজ পড়ার। হুজুর বলেছিলেন, সবুরে মেওয়া ফলে। আল্লার করুণা সময় হলেই দুনিয়াকে ভিজিয়ে দেবে। এ রাতে হুজুর আসলে আসমানে তাকিয়ে তাহলে সেই সংকেতই টের পেয়েছেন। লোকগুলো মুহূর্তে সবকিছু ভুলে দিগন্তের দিকে তাকাল। তারা আবার শিহরিত হল নৈঋতে ঝিলিক দেখে। কেউকেউ মসজিদপ্রাঙ্গণঘেরা ভাঙা পাঁচিলের কাছে গিয়ে ঈশ্বরের প্রশংসা করতে থাকল অস্ফুট উচ্চারণে। তারপর বদিউজ্জামান ঘোযণা করলেন, মেহেরবানি করে আপনারা বাড়ি যান। আমি এবার নফল (অতিরিক্ত) নমাজে বসব।

অনেক রাত পর্যন্ত বদিউজ্জামান নফল নমাজ পড়েন। তারপর বহুক্ষণ লানটিনের আলোয় কোরান পাঠ করেন। অতি মৃদু সুরেলা সেই পাঠ। রাতের প্রকৃতির সব ধ্বনির সঙ্গে সেই ধ্বনি একাকার হয়ে ওঠে। প্রাঙ্গণের পাঁচিলের ওপর কিছু নিচু গাছ ও আগাছার ঝোঁপ রাতের হাওয়ায় শনশন কী এক অপার্থিব ধ্বনি তোলে। পেছনের তালগাছের বাগড়ায় সর-সর শব্দ হয়। রাতপাখি ডাকতে-ডাকতে ডানার শব্দ করে উড়ে যায়। মসজিদের শীর্ষে ঘুলঘুলি থেকে বুনো কবুতরগুলো ঘুম-ঘুম স্বরে হঠাৎ কখনও ডেকে ওঠে। বাদশাহি সড়কে দূরদেশের গাড়োয়ানের ঘুমজড়ানো গলার গান ভেসে আসে। আর সারবদ্ধ গাড়ির চাকার টানা ঘসঘস শব্দ রাতের নিঝুমতায় চাপা ও গভীরতর হতে-হতে দূরে মিলিয়ে যায়। যাম ঘোষণা করে ব্রাহ্মণী নদীতীরে শেয়ালের পাল। সবাই রাতের বিশ্বপ্রকৃতির সুতি-ও শ্ৰতিপারের এক ধারাবাহিক অর্কেস্ট্রা। আর তার মধ্যে বদিউজ্জামানের মৃদু কোরান ধ্বনির কোনও ভিন্নতা থাকে না। পাঠ শেষ করে সেটা অনুভব করেন বদিউজ্জামান। কিছুক্ষণ বাইরে এসে দাঁড়ান। নক্ষত্রের দেশে দৃষ্টি প্রসারিত করেন। তারপর সেই বিস্ময়কর আবেগে আপ্লুত হয়ে অবেশেষে ফিরে আসেন শয্যায়। তাঁর মনেও থাকে না স্ত্রীপুত্ৰপরিবারের কথা। খালি মনে হয় তাঁর জন্ম এ পৃথিবীতে কী এক ব্রতপালনে। অথচ এতদিন পরে হঠাৎ আজ রাতে তিনি বিচলিত বোধ করছিলেন।

তিনি শফির কথাই ভাবছিলেন কদিন থেকে। বড়ো ছেলে নুরুজ্জামান নিজের তাগিদেই সুদূর দেওবন্দ শরিফে এলেম অর্জনে গেলেও তাঁর মনে কোনও দ্বিধা বা বিষণ্ণতা জাগেনি। নুরুজ্জামান বাল্যকাল থেকে পিতার আদর্শের অনুরাগী। নিজের সঙ্গে তার পার্থক্য আজও খুঁজে পান না বদিউজ্জামান। অথচ শফিউজ্জামানকে বরাবর মনে হয় এক ভিন্ন ও অপরিচিত সত্তা। তার সঙ্গে নিজের কোনও মিল নেই। তাকে যে মক্তবে নয় পাঠশালায় ভরতি করে দিয়েছিলেন, শুধু এই গভীর গোপন কারণে –তা তো কাউকে বলা যাবে না।

আজ যখন সত্যিই মসজিদের পেছনের দেয়াল মধ্যরাতের কালবোশখি এসে ধাক্কা দিল, কেন যেন শফির কথাই মনে পড়ে গেল তারও তীব্রভাবে। শয্যা থেকে উঠে বসলেন বদিউজ্জামান। নিবুনিবু লণ্ঠনের দম বাড়িয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে ঈশ্বরের ধ্যানে মন দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বারবার ওই কিশোর তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। আর তখন বাইরে প্রকৃতি উত্তাল। মসজিদের জানালা শুধু পূর্বদিকেই। তবু প্রমত্ত ঝড় ঘুরপাক খেতে-খেতে প্রাঙ্গণ পেরিয়ে উঠে বারান্দার জীর্ণ থামের পলেস্তারা খসিয়ে ভেতরে উঁকি দিচ্ছিল। তিনটি দরজা ও দুটি জানালা বন্ধ করে দিলেন। শুধু একটি দরজা খোলা রইল। সেখানে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের ওই উপদ্রবকে দেখার চেষ্টা কবলেন বদিউজ্জামান।

বিস্ময়ের কথা, প্রাকৃতিক উপদ্রবের সময় অভ্যাসমতো আজ পবিত্র কোরানের ‘সুরা ইয়াসন’ আবৃত্তির কথাও তার মনে এল না। তাঁর শুধু মনে হচ্ছিল শফি এখন হরিণমারায় কেমন ঘরে আছে, কী করছে। নবাববাহাদুরের দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরি তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, শফি খুব ভালো জায়গায় আছে । খোন্দকার হাশমত আলি অবস্থাপন্ন মানুষ। বনেদি ‘আশাবফ’ (উচ্চবণীয়) পরিবার। তাঁদের বাড়ি থেকে শফির পড়াশোনায় কোনও অসুবিধে হবে না। আর পিরসাহেবের ছেলেকে তাঁরা প্রচুর যত্ন-আত্যিও করবেন। তবু বদিউজ্জামান কেন যেন আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না।

পারছিলেন না কতকটা সাইদা বেগমের কথা ভেবেও বটে। মেজো ছেলে মনিরুজ্জামান জন্মপ্রতিবন্ধী। বড়ো ছেলে ছোটোবেলা থেকেই বাইরে। তাই সাইদার। কাছে শফির মূল্য অনেক বেশি। এক মুহূর্ত চোখের বাইরে রাখতে পারেন না। বদিউজ্জামানের সন্দেহ হয়েছিল, এবার যেন স্বামীর ওপর তীব্র অভিমানেই শফিকে চোখছাড়া হওয়ার দুঃখ সইতে মনকে তৈরি করেছেন। স্বামী যখন হুকুম দিয়েছেন। (দরিয়াবানু আর চৌধুরিসাহেবের কথামতো) তখন তিনি তো অসহায়। বাধা দেবার সাধ্য কী তাঁর?

এই ঝড়ের রাতে বদিউজ্জামান এই কথাটা তীব্রভাবে টের পাচ্ছিলেন। আর সেই বিচলিত সময়ে অনিবার্যভাবে তাঁর মনে পড়ে গেল, প্রায় একমাস হতে চলল তিনি মসজিদবাসী। সেই একদিন নতুন বাসস্থান দেখে এসেছেন মাত্র। তারপর আর সাইদার সঙ্গে তাঁর দেখা নেই। এ কী করছেন তিনি? বদিউজ্জামান নিজেকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলেন। তিনি কি তাহলে তাঁর ‘সুফি’ এবং ‘মজনুন’ (ঈশ্বর প্রেমে উন্মাদ) ছোটোভাই ফরিদুজ্জামানেই পরিণত হলেন অবশেষে?

বালিকা সাইদাকে বিয়ে করেই বিপত্নীক মৌলানা প্রায় তিন বছর নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিলেন। সেই ঘটনাটি মাঝে-মাঝে মনে পড়ায় বিব্রত বোধ করতেন বদিউজ্জামান। এ রাতে সেই অপরাধবোধও তাঁকে আড়ষ্ট করে ফেলল। চৌকাঠ আঁকড়ে ধরে প্রাঙ্গণ থেকে আকাশব্যাপী তুমুল প্রাকৃতিক আলোড়ন দেখতে দেখতে ক্রমশ একটা আতঙ্ক তাঁকে পেয়ে বসল, জনপদের প্রান্তে নির্জনে অবস্থিত এই জীর্ণ প্রাচীন মসজিদসুদ্ধ তাঁকে যেন গায়রত’ (ধ্বংস) করে ফেলতেই আল্লাহ এই প্রলয় সৃষ্টি করেছেন। গর্জন করছে মুহুর্মুহু নক্ষত্রকা প্রমত্ত মেঘ। ঝলসে উঠছে ফেরেশতাদের জ্যোতির্ময় খরসানের মতো ক্ষিপ্ত বিদ্যুৎরেখা। যে-কোনো মুহূর্তে মসজিদ বুঝি ওই মিনারের মতো ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। তিনি তো সর্বত্যাগী সাধকপুরুষ নন। তিনি ভ্রান্ত মতানুগামী সুফিও নন। তিনি ওহাবপন্থী ফরাজি মুসলিম। ইহলোকের সবরকম নৈতিক সুখ উপভোগ করাই তো যথার্থ ইসলাম। তিনি তাঁর নিরুদ্দিষ্ট সুফি ভাইয়ের মতো নারীবিদ্বেষী তো নন। বরং পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলেছেন, কৃষক যেমন শস্যক্ষেত্রের দিকে গমন করে, পুরুষ তার নারীর দিকে একই নিষ্ঠা ও প্রেমে অনুগমন করবে বলেই আদিমানব আদমের বুকের বাঁ পাঁজর থেকে নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ তিনি এ কী করছেন? কেন করছেন?…

আর সেই ঝড়ের সাইদাও তখন ভাবছিলেন শফির কথা। এমন সব রাতে একপাশে মনি অন্যপাশে শফি –আর মনি তো প্রাণীমাত্র; শফি তাঁকে আঁকড়ে ধরে ফিশফিশ করে শুধোত, আম্মা, এখন কোন ফেরেশতা ঝড় করছে, বলুন না! ও আম্মা, বলুন না কেন ঝড় হয়? পানি ঝরায় যে ফেরেশতা, তার নাম কী আম্মা? তারপর বাজ পড়লেই সে মায়ের বুকে মুখ খুঁজত। আর সাইদা বলতেন, আর শুধোবি ও কথা? ওই শোন, কোড়া পড়ল শয়তানের পিঠে। শয়তান তোর মুখ দিয়ে কথা বলাচ্ছে যে!

সেই শফি একা কার বাড়িতে শুয়ে আছে ভেবে চোখ ফেটে জল আসছিল সাইদার। ঝড়, মেঘের গর্জন যত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল, তত তিনি নিজেকে দারুণ একা আর অসহায় বোধ করছিলেন। তারপর একসময় হঠাৎ তার মাথার ভেতর একটা কথা এসে বাইরের ওই বিদ্যুতের মতোই একমুহূর্তের জন্য ঝলকে উঠল। নুরুকে, তারপর শফিকে তাঁর কাছ ছাড়া করার পেছনে তাঁর স্বামীর কোনও চক্রান্ত। নেই তো? তাকে কি এমনি করে একা করে ফেলতে চাইছেন মৌলানা কোনও গোপন উদ্দেশ্যে? মেজোছেলে মনি তো সাইদার আশ্রয় হতে পারবে না কোনোদিনও। শাশুড়ি কামরুন্নিসা কবরের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছেন। মৌলানার ছোটো ভাই ফরিদুজ্জামানকে সাইদা দেখেননি। শাশুড়ির কাছে তাঁর কথা শুনেছেন মাত্র। শাশুড়ি বেগম দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, বউবিবি! এই খান্দান যেন মাজনুন ফকিরেরই খান্দান। এরা আল্লা-আল্লা করেই দুনিয়াদারির মুখে ঝাটা মারতে ওস্তাদ। বদুকে একটু কাছে টেনে রেখো, মা! নইলে আখেরে পস্তে কূল পাবে না। কামরুন্নিসা। বলতেন, ফরিদ! আমার ফরিদ! তাকে যদি দেখতে বউবিবি! তোমার ছোটো বেটার চেয়ে খাপসুরত ছেলে ছিল সে। সেই ছেলে যোয়ান হয়ে মাথায় রাখল আওরতলোকের মতন লম্বা-লম্বা চুল। সারারাত গোরস্থানের ধারে গিয়ে বসে জিকির (জপধ্বনি) হাঁকত। আর সে কী গলা, সে কী গান! বুকে চিমটে টুকত আর মারফতি গান গাইত। তখন বদু একদিন জোর করে লোকজন নিয়ে গিয়ে তার চুল মুড়ো করে দিলে। চিমটে কেড়ে নিলে। সে বড়ো দুঃখের কথা বউবিবি! বদুকে কম ভেবো না! সোদর ভাইটাকে জুলুম করে শরিয়তে টানতে গেল। আর সোনার বাছা আমার পালিয়ে গেল কোথায়। আর তাকে জিন্দেগিভর দেখতে পেলাম না। বউবিবি, বদুকে আমি গোরে গিয়েও মাফ করতে পারব না।

ঝড়ের রাতে শাশুড়ির সেইসব কথা মনে এলে সাইদা চমকে উঠেছিলেন। তাহলে কি তাঁর স্বামীও সংসারত্যাগী মাজনুন হতে চলেছেন? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, এতকাল ধরে তাঁকে যতখানি বুঝেছেন, মৌলানা মাজনুনদের একেবারে উলটো। সাইদা অকুণ্ঠিতভাবে দ্রুত স্মরণ করলেন স্বামীর সঙ্গে রাত্রিযাপনের সেইসব তীব্র সুন্দর সময়গুলোকে। বরং তাঁর তো মনে হয়েছে, মৌলানা এসব গোপনীয় শারীরিক ব্যাপারে কি নির্লজ্জ আর প্রবল পুরুষ হয়ে ওঠেন। তাঁকে কদাচিৎ শয্যায় পাশে পান বলেই সাইদার মনে যেমন রাক্ষসীর ক্ষুধা জেগে ওঠে, মৌলাদাকেও তেমনি মনে হয় ভয়ঙ্কর ক্ষুধার দাউদাউ আগুন। আর সাইদার মনে হয় ওই প্রজ্বলনে নিজেকে নাই করতে পারলেই পরম সুখ।

তাহলে কি মৌলানার কাছে এতদিনে তার আকর্ষণ ফুরিয়ে গেছে? উনি কি ভেতর-ভেতর নিকাহের (বিয়ে) মতলব করেছেন? মৌলাহাটে আসার পর সাইদা লক্ষ করেছেন এখানকার মেয়েরা পরদানসীনা নয়। এদের মধ্যে স্বৈরিণী ও স্বাস্থ্যবতী সুন্দরীরাও বড়ো কম নেই। তার চেয়ে ভাবনার কথা, এখানকার পুরুষগুলোর হাবভাব কেমন যেন সন্দেহজনক। তারা ওঁকে আমরণ আটকে রাখার জন্য ব্যস্ত। তাহলে কি তারাই ওঁকে কৌশলে প্ররোচিত করছে কারুর সঙ্গে নিকাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে?

ভীষণ গর্জনে বজ্রপাত হল। থরথর করে কেঁপে উঠলেন সাইদা। প্রতিবন্ধী ছেলেকে আঁকড়ে ধরে অন্ধকার ঘরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। পাশের ঘরে পক্ষাঘাতগ্ৰস্তা শাশুড়ি আছেন। কবে কখন তাঁর মৌলানাপুত্র এসে বউবিবির পাশে রাত্রিযাপন করবেন ভেবেই বরাবর তিনি আলাদা শুয়ে থাকেন। মৌলাহাটে আসার পর কোনো-না-কোনো বয়স্কা মেয়ে, তারা বিধবা অথবা স্বামী পরিত্যক্তা, পিরজননীর পাশে শুয়ে পুণ্য সঞ্চয় করে। এ রাতে আয়মনি এসে শুয়েছে। একটু আগে সে বেরিয়ে এসে সাইদার ঘরের বদ্ধ কপাটের ওধার থেকে জেনে গেছে, বিবিজির ডর লাগছে কি না। মেঘের গর্জন বাড়লে সাইদা আবার তার সাড়া পেয়ে বিরক্ত হলেন। বললেন, তোমার চোখে কি নিদ নাই, আয়মণি? চুপচাপ শুয়ে থাকতে পারছ না?

আর সাইদা যখন ফুঁপিয়ে কাঁদছেন, তখনই বৃষ্টির শব্দ শোনা গেল বাইরে। প্রথমে দড়বড় করে ঘোড়সওয়ারদলের ছুটে যাওয়ার মতো, তারপর হাওয়ার। শনশনানির মতো ঝরঝর ধ্বনি। মেঘের ডাকে যেন ছন্দ এল । কিন্তু হাওয়া থামল না। তার একটু পরেই আবার আয়মনির ডাক শুনলেন সাইদা। সে কপাটে ধাক্কা দিচ্ছিল। এবার তার কণ্ঠস্বর চাপা। বিবিজি! ও বিবিজি! লম্ফ জেলে শিগগিরি উঠুন দিকিনি! আমার লক্ষ বুতে গেল।

সাইদা দ্রুত চোখ মুছে উঠে বসলেন। শলাইকাঠি ঘষে লক্ষ জাললেন। তাঁর বুক ধড়াস করে উঠেছে। শাশুড়ি-বেগমের কি মউত হতে চলেছে, তা না হলে আয়মনির গলার স্বর অমন কেন?

দরজা খুললেন কাঁপা-কাঁপা হাতে। অন্যহাতে লক্ষ্যের শিখাও প্রবলভাবে কাঁপছে। সামনে আয়মনিকে এক পলকের জন্য দেখলেন। উঠোনে বিদ্যুতের ঝলসানিতে ঘন বৃষ্টিরেখা বাঁকা। আর আয়মনির মাথায় এমন ঘোমটা টানা যে তার চোখ ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সে দ্রুত ছিটকে গেল। আর সামনে যাঁকে দেখলেন সাইদা, তাঁকে স্বপ্নের মূর্তি মনে হল। ভিজে শাদা পোশাকপরা ম্রিয়মাণ মূর্তিটিকে খর্বাকার বিভ্রম হল। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন সাইদা বেগম। আর সেই কুঁকড়েথাকা, বিষঃ ঝড়ের রাতের আগন্তুক জড়ানো গলায় কী উচ্চারণ করে সাইদাকে ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। তখন সাইদা আচ্ছন্নতা থেকে জেগে উঠে বুঝলেন, এই কাকতাড়ুয়াবৎ মূর্তিটি তাঁর স্বামীরই।

পরাক্রমশীল এক ‘দেও’ (দৈত্য), এতকাল সাইদা যার সামনে অবচেতন ভয় আর সংস্কারলালিত ভক্তিতে বিনত থেকেছেন, এই ঝড়বৃষ্টির রাতে তাঁর দিকে নির্লিপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে ছিলেন।

আর বদিউজ্জামান ওই নতুন চাহনি দেখে ঈষৎ বিস্মিতও হয়েছিলেন। কিন্তু যে অতর্কিত আবেগ এমন রাতে তাঁকে ঐশী আবহমণ্ডল থেকে মাটিতে নিক্ষেপ। করে কাদামাটিতে গড়া নিছক আদম-সন্তানে পরিণত করেছে, সেই আবেগই তাঁকে একটু হাসি দান করল। মৃদু হাস্যে তিনি বললেন, কী হল সাইদা? দেখছো না আমি ভিজে গেছি? আমাকে শিগগির শুকনো কিছু ‘লেবাস’ পোশাক) দাও। জাড় মালুম হচ্ছে।

একটিও কথা না বলে সাইদা ছোট্ট কাঠের সিন্দুকটি খুললেন। ভাঁজ করে রাখা শাদা একটি তহবন্দ (লুঙ্গি) আর দড়ির আলনা থেকে একটি তাঁতের নতুন গামছা এনে দিলেন। লস্ফটি সিন্দুকের ওপর রেখে তিনি দরজার কাছে গিয়ে বৃষ্টি দেখার ছলে আয়মনিকে খুঁজলেন। আয়মনি আবার তার শাশুড়ির ঘরে গিয়ে শুয়ে। পড়েছে। দরজা বন্ধ। চাপা স্বরে কথা বলছে কামরুন্নিসার সঙ্গে ও কানে এল সাইদার।

বদিউজ্জামান দ্রুত পোশাক বদলে নিতে-নিতে আড়ষ্টস্বরে বললেন, আমার সেই কামিজটা? তখন সাইদা দরজা থেকে মুখ না ঘুরিয়ে আস্তে বললেন, সিন্দুকে আছে।

অমনি বদিউজ্জামান তাঁর কাছে এসে দরজা বন্ধ করে দুহাতে স্ত্রীর দুই কাঁধ ধরে তাঁকে ঘোরালেন নিজের দিকে। সাইদা একমুহতের জন্য স্বামীর উজ্জ্বল গৌর বুকের কাঁচাপাকা রোমগুলির দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, আঃ! মনি আছে।

মনিরুজ্জামান অবশ্য গাঢ় ঘুমে কাঠ। রাতে জ্বালাতন করে বলে দরিয়াবানুর পরামর্শে পাশের গ্রাম দুনিতলার কবরেজের বড়ি খাওয়ানো হয়। বড়িটিতে আফিম মেশানো। বদিউজ্জামান একথা জানেন না। তাই চকিতভাবে ঘুরে বিছানায় মেজো ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর তার কুঁকড়ে পাশফিরে শুয়ে থাকা দেখে আবার স্ত্রীকে আকর্ষণ করলেন। তখন সাইদা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু তফাতে সরে গেলেন।

বিস্মিত, ব্যথিত বদিউজ্জামান চাপাস্বরে বললেন, তোমার কী হয়েছে সাইদা? তুমি এমন করছ কেন?

সাইদার নাসারন্ধ ফুরিত। লম্ফের আলো তত উজ্জ্বল নয়। আলো অন্ধকারে তাঁর এই অদ্ভুত চেহারা বড়ো অবিশ্বাস্য লাগছিল বদিউজ্জামানের। তিনি স্বভাবে একরোখা, তেজী এবং আবেগপ্রবণ মানুষ। স্থির দৃষ্টে স্ত্রীকে দেখতে-দেখতে ভাবছিলেন, কী কথা এবার বলবেন? তিনি নির্জন মসজিদ থেকে এই দুর্যোগের রাতে এমন করে কেন ছুটে এসেছেন, সেকথা বলার জন্য ব্যাকুল। অথচ সাইদার হাবভাব দেখে তিনি এত অবাক যে মুখে কথা আসছে না। কষ্ট করে আবার একটু হাসলেন শুধু। আর সাইদা হিসহিস করে বলে উঠলেন, আমার কাছে আপনার কী দরকার? তারপরই দুহাতে মুখ ঢেকে ঘুরে দাঁড়ালেন। তাঁর পিঠের দিকটা কাঁপতে থাকল।

নাদান আওরত! বদিউজ্জামান ম্লান হেসে এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলেন। তুমি কি জানো না, কোরান শরিফে আল্লাহ বলেছেন–

কান্নাজড়িত স্ববে সাইদা বললেন, চুপ করুন! ওসব বুলি মসজিদে শোনান গিয়ে। আমার কাছে নয়।

নাউজবিল্লাহ! সাইদা! কী বলছ তুমি! এ যে গোনাহ!

সাইদা বেগম ঘুরে দাঁড়ালেন। গোনাহ। আর নিজের বিবির ভালোমন্দ না। তাকিয়ে মাস-কাল ধরে মসজিদে পড়ে থাকাটা বুঝি নেকি (পুণ্য)? আবার না তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সাইদা। –আমার বাছাদের দূর-দূরান্তে পাঠিয়ে আমার কোলছাড়া করে দেওয়া নেকি? আর ওই মনি –তার কী হাল, আর বিবিজি –যাঁর পেট থেকে পড়ে দুনিয়ার মুখ দেখেছেন– তিনি হরবখত কাঁদছেন, মউতের আগে বেটার হাতের পানি মুখে পাব না– এও বুঝি নেকির কাজ?

বদিউজ্জামান কাতরস্বরে বললেন, আমাকে ভুল বুঝো না সাইদা! এসো তোমাকে শুয়ে শুয়ে সব বাতলাব। এসো।

সাইদাকে টেনে এনে মেঝেয় পাতা বিছানায় বসালেন। তারপর একটু চমকে উঠে বললেন, এঘরে তত্তাপোশ নেই দেখছি! মহিউদ্দিনকে বলেছিলাম–

বাধা দিয়ে সাইদা বললেন, আমি ছপ্পরখাটে শোব। আর বিবিজি মেঝেয় শোবেন? তক্তাপোশ ওঘরে আছে।

স্ত্রীর মুখচুম্বনের চেষ্টা করতে গিয়ে বাধা পেলেন বদিউজ্জামান। শুকনো হাসলেন। কিন্তু তুমি এমন বেরহম (নিষ্ঠুর) কেন হলে সাইদা? আমি তো হরবখত এত্তেকাফ নিয়ে মসজিদে হপ্তাভর থেকেছি। কখনও তো তুমি এমন করোনি।

হঠাৎ সাইদা মুখ নিচু করে বললেন আপনি নিকাহ করবেন– আমি বুঝতে পেরেছি।

বদিউজ্জামান আবার হাসলেন– আড়ষ্ট শুকনো হাসি।…আমার হুজুর পয়গম্বরসাহেব কতগুলো নিকাহ করেছিলেন তুমি তো জানো। কিন্তু আমি নাদান আদমি সাইদা! এই দেখো না, তোমার ওপরই কত অবিচার করি– আবার নিকাহের কথা কি আমার ভাবা সাজে? তবে তোমার ভাবা উচিত ছিল, এমনকরে ঝড়পানির মধ্যে কেন ছুটে এলাম তোমার কাছে।

অস্ফুটস্বরে সাইদা বললেন, কেন?

একটু চুপ করে থাকার পর শ্বাস ছেড়ে বদিউজ্জামান বললেন, তুমি শফির কথা বলছিলে। হঠাৎ কেন কে জানে ঝড়টা ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে শফির কথা মনে এসে গেল। আমার বুকটা কেমন করতে লাগল । সাইদা, অমনি মনে হল শফিকে তুমি নজর-ছাড়া করতে পারো না। তাহলে কী অবস্থায় তোমার দিন কাটছে। কত কষ্ট তোমাকে সইতে হচ্ছে!

সাইদা কান্না চেপে বললেন, খোদার মেহেরবানি যে আপনি কথাটা ভেবেছেন।

ভেবেছি। ভেবেই মনে হয়েছে, আমি গোনার ভাগী হচ্ছি। তোমাকে বঞ্চনা করছি।

আপনি বুজুর্গ মানুষ। সাইদার বাঁকা ঠোঁট থেকে কথাটা ব্যঙ্গমিশ্রিত হয়ে বেরিয়ে এল।

ছিঃ! তামাশা কোরো না সাইদা।

সাইদা একটু চুপ করে থাকলেন। বাইরে অঝোর বৃষ্টির শব্দ এখন। মাঝে মাঝে মেঘ ডাকছে। পিঠে স্বামীর হাতের আদর অনুভব করছিলেন সাইদা। তবু আজ তার দেহ যেন নিঃসাড়। অবিশ্বাস তাঁকে ঘিরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পরে বললেন, তামাশা করছি না। আমি জানি জিনেরা এসে আপনার সঙ্গে কথা বলে। আপনি বজুর্গ না তো কী?

ওসব কথা থাক, সাইদা! রাত হয়েছে। শুয়ে পড়া যাক। ফজরের আগেই আমাকে মসজিদে যেতে হবে।

মসজিদে তো অনেকদিন থাকলেন। এবার বাড়ি ফিরবেন না?

বদিউজ্জামান কথাটা বলেই শুয়ে পড়েছিলেন। সাইদা শুলেন না! তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে লক্ষ্যটা আনার জন্য উঠতে গেলেন। কিন্তু বদিউজ্জামান তাঁকে উঠতে দিলেন না। বললেন, আজ তোমাকে একটু দেখি। কতদিন তোমাকে দেখিনি, সাইদা!

আপনি কবে বাড়ি ফিরবেন, আগে বলুন?

সাইদা, সত্যি বলছি– হয়তো আমার এক্তিয়ারে আর কিছু নেই।

ভীষণ চমক খেয়ে সাইদা বললেন, কেন?

জানি না। বদিউজ্জামান আচ্ছন্ন কণ্ঠস্বরে বললেন। কী একটা ঘটছে, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। খালি মনে হচ্ছে, এই মসজিদে আমার জিন্দেগির একটা পরদা খুলে যাচ্ছে। যা কখনও বুঝিনি, তা সব বুঝতে পারছি!….নাঃ! আমার খামোশ থাকা উচিত।

এ ধরনের কথাবার্তা সাইদা কখনও স্বামীর মুখে শোনেননি। তাঁর বুগুর্জপনা বা কেরামতির কথা সবই শাশুড়ির কথায় কিংবা অন্য লোকের কাছে পরোক্ষে আঁচ করেছেন মাত্র। তাই তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন সাইদা। তারপর কী এক হঠকারিতাবশে তিনি বলে উঠলেন, আমাকে নাদান আওরত ভেবে আপনি যা বললেন, আমি তা মানব না। আমি জানি আপনি কেন আমার কাছ-ছাড়া হয়ে আছেন এতদিন।

ছিঃ সাইদা! আবার ওই কথা! বলে বদিউজ্জামান নিজেই উঠে গিয়ে লম্ফটা নিবিয়ে দিয়ে এলেন। তারপর স্ত্রীকে আকর্ষণ করলেন। নিজের জৈবসত্তার তীব্রতা তাঁকে অস্থির করে ফেলছিল ক্রমশ।

কিন্তু সাইদা বাধা দিয়ে বললেন, আপনি যাই বলুন, নিকাহ করার মতলব হয়েছে, আমি জানি।

সাইদা! আল্লার দোহাই, তুমি চুপ করো!

সাইদা ক্রমশ প্রগলভা আর আর সাহসী হয়ে উঠছিলেন বদিউজ্জামানের পরিবর্তিত আচরণ আর ভাবভঙ্গি দেখে। অন্ধকারে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, মেয়েটি বুঝি কুঠো আবদুলের বউ?

কী বললে? বদিউজ্জামান মুহূর্তে নিঃসাড় হয়ে গেলেন। বাইরের আকাশের বজ্ৰ যেন তাঁরই মাথায় পড়ল।

হ্যাঁ, ওই মেয়েটার পেছনে যেভাবে লেগেছেন শুনতে পাই–

বদিউজ্জামান সরোষে অন্ধকারে স্ত্রীর গালে থাপ্পড় মারলেন। থাপ্পড়টা সাইদার মাথায় লাগল। তারপর বদিউজ্জামান শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সশব্দে দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেলেন। খালি পায়েই ছুটে এসেছিলেন মসজিদ থেকে। এখন তাঁর পরনে শুধু তহবন্দ, খালি গা, খালি পা।

আর সাইদা তেমনি বসে আছেন। মাথা দুহাঁটুর ফাঁকে। খোলা দরজা। উঠোনে ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে। ঝড়ের ভীষণতা শান্ত হয়ে গেছে। শুধু মাঝে-মাঝে একদমক করে বিভ্রান্ত হওয়ার ঝাঁপটা নিতে গাছপালা দুলে উঠছে। সাইদার মনে হচ্ছিল বিশাল খোলামেলা প্রান্তরে বসে বৃষ্টিতে অসহায় ভিজছেন।

ভোরে যখন বৃষ্টি থেমেছে, আয়মনি পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে সাইদাবেগমের ঘরের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল। দরজা খোলা। আর নগ্ন মাটির মেঝেয় চুল এলিয়ে উপুড় হয়ে মাথা কোটার ভঙ্গিতে পড়ে আছেন বিবিসাহেবা।…

সকল অধ্যায়

১. ০১. কালো জিন এবং শাদা জিন বৃত্তান্ত
২. ০২. বিম্ব এবং প্রতিবিম্ব
৩. ০৩. নতুন বাসস্থান
৪. ০৪. দেওয়ান সাহেবের আবির্ভাব
৫. ০৫. এশার নামাজের পর
৬. ০৬. খানবাহাদুর দবিরউদ্দিন চলে যাওয়ার পর
৭. ০৭. ঘোড়া এবং তলোয়ার
৮. ০৮. কালো ঘোড়াটির পিঠে
৯. ০৯. স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ
১০. ১০. জ্যোৎস্নার মৃত্যুর ঘ্রাণ
১১. ১১. সব পাখি ঘরে ফেরে
১২. ১২. কানা ঘোড়ার সওয়ার  
১৩. ১৩. শনশন শব্দ
১৪. ১৪. একটি কথোপকথন
১৫. ১৫. চান্দ্রমাস জেলহজ্জের দশম দিবসে কেয়ামত
১৬. ১৬. বেদা’য়াতে সাইয়্যেয়া
১৭. ১৭. নারী এবং প্রকৃতি
১৮. ১৮. কেশবপল্লীতে হাজারিলালের কুটিরে
১৯. ১৯. স্বাধীন মূর্ছিতা রত্নময়ীর চেতনা
২০. ২০. হুল্‌ হুল্‌ জুল্‌ জুল্‌ উম্‌কি বুস্‌বার জুর্‌
২১. ২১. পদ্মার চরে ঘুরতে
২২. ২২. উন্মাদ হইবার পূর্বে রাজা লিয়র
২৩. ২৩. রফিকুজ্জামানের সহিত জুলেখার শাদির দিন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন