২৩. রফিকুজ্জামানের সহিত জুলেখার শাদির দিন

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

‘O Satan, prends pitie de ma longue misere!’

“রফিকুজ্জামানের সহিত জুলেখার শাদির দিন একটি আশ্চর্য্য ঘটনা ঘটিয়াছিল, এই স্থলে তাহার বিবরণ পেশ করিতেছি। কারণ আমার মনে সেই ঘটনাটি খোকা সৃষ্টি করিয়াছে। আর শয়তান সর্বত্র ওত পাতিয়া বেড়ায়। বনু আদমের জীবনের সমুদয় ক্ষেত্রে সে ফাঁদ পাতে।…..

“জোহরের নমাজের সময় শাদির মজলিশ বসিয়াছিল। মসজেদের ভিতর এবং বাহিরে কাতারে ইলাকার মোছলেমগণ দাওয়াত এবং বিনা-দাওয়াতেই হাজের ছিলেন। হরিণমারার হোটগাজি মইদুর রহমান সকল আয়োজনের তদারক করিতেছিলেন! বড়গাজি সইদুর রহমান তালে কলিকাতায় ছিলেন। খত লিখিয়া জানান জে, পরে আসিয়া দুলহা-দুলহিনের নজরানা পেশ করিবেন। প্রকৃত কথা। কী, এতিমখানার ওই খুবছুরত লড়কিকে যাঁহারা দেখিয়াছিলেন, তাঁহারাই তাহার প্রতি খোশ ছিলেন।…..

“শাদির সময় দুলহিন আনিসুর রহমানের বাড়িতে ছিল। তিনিই তাহার মুরুব্বিপদে বহাল, ফলে দুলহিনের এজিন (সম্মতি) লইবার নিমিত্ত উকিল ও দুইজন গাওয়াহ, (সাফ) তাঁহার বাড়ি রওনা হইয়াছেন। এমত সময়ে বাহিরে হল্লা শুনিতে পাইলাম। লোকসকল ধর ধর! মার মার।’–লিয়া চিৎকার করিতেছিল। কী হইয়াছে জানিতে চাহিলে ছোটগাজি বাহিরে গেলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরিয়ে আসিয়া কহিলেন, এক বেশরা মস্তান জোর করিয়া মসজেদে ঢুকিতে চেষ্টা করে। লোকে তাহাকে ধাক্কা মারিতে মারিতে ভাগাইয়া দেয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মস্তানটি রুণ ছিল বলিয়াই বোধ করি মারা পড়িয়াছে।….

“শুনিবামাত্র চমকিয়া উঠিলাম। দেলে আচানক ধাক্কা বাজিল। আমার মুখের চমক ছোটগাজিছাহেবের নজরে পড়িয়া থাকিবে। তিনি আমার পার্শ্বে বসিয়া অনুচ্চ স্বরে কহিলেন, কোনও প্রকার ঝামেলার ডর নাই। বাদশাহী শড়কে এইরূপ দৃশ্য অভাবিত নহে জে, কখনও-কখনও ফকিরমস্তান-হিন্দুসাধুদিগেরও লাস দেখা যায়। বিমার, পেরেন বিবিধ কারণে উহারা পথিমধ্যেই ইন্তেকাল করে। এই কথা বলিয়া ছোটগাজিছাহেব উচ্চহাস্য করিলেন। মজলিসের উদ্দেশে ফের কহিলেন, বেশরা মস্তান দেখিলেই হজরত তাহাদের ভাগাইয়া দিবার ফতোয়া জারি করেন নাই কি? মোছলেমবৃন্দ সমস্বরে সায় দিলেন।……

“শাদি চুকিয়া গেলে লোকসকল খানায় বসিল। সেই সময় ছোটগাজিছাহেবকে নিরাশায় ডাকিয়া পুছ করিলাম, মস্তানের লাস কোথায় পড়িয়া আছে, একবার দেখিতে ইচ্ছা করি। তিনি ঈষৎ বিস্মিত হইয়াছিলেন। কিন্তু সম্ভবত মোজেজাদর্শনের ইচ্ছায় কহিলেন, হজরতের ইচ্ছা হইলে আপত্তি করি, সাধ্য কী? তবে মস্তানটি অর্ধ-নাঙ্গা! একটু অপেক্ষা করুন। লাসটি ঢাকা দিতে একটুকরা কাপড় সংগ্রহ করি। পশ্চাতে উহার নিকট যাইবেন।….

“হা খোদা! কাকে দেখিয়াছিলাম? কাপড় তুলিতে মুখখানি দেখামাত্র আমার মাথায় যেন বাজ পড়িল। সারা অজুদ শিহরিয়া উঠিল। অতি কষ্টে মনোভাব দমন করিলাম। ছোটগাজিছাহেব হয়ত ভাবিয়াছিলেন, লাসটিকে আমি জিন্দা করিব। তাঁহাকে হতাশ দেখাইতেছিল। মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া আছি, আত্মসম্বরণ করিতেছি, ছোটগাজিছাহেব কহিলেন, বেশরা মস্তান রাত্রে এখানে পড়িয়া থাকিলে শৃগাল-কুকুরে ছিঁড়িয়া খাইবে। জবাবে কহিলাম, জন্মকালে উহার কানে নিশ্চিত আজান শোনানো হইয়াছিল। সেকারণে বেশরা হইলেও এ-ব্যক্তি মোছলেম গণ্য হইবেক। উহার দাফন কাফন করা কর্তব্য। ঘোটগাজিছাহেব ঘন মাথা নাড়িয়া আমার ফতোয়ায় সায়। দিলেন।…..।

“সেইদিন সন্ধ্যার মধ্যে শরা-ভ্ৰষ্ট বেচারা ফরিদ-উদ-জামান-এর লাসের দাফন কাফন হইল। শাদি-মহফিলের তাবৎ লোক লাসের জানাজায় সমবেত হইয়াছিল। তাহারা নিশ্চয়ই আমার এই ফতোয়ায় বিস্মিত হইয়াছে ভাবিয়া এশার নমাজে কৈফিয়ত দিব ভাবিলাম। কিন্তু মুখে কথা সরিতেছিল না। বেরাদানে এছলাম। সম্বোধন করিয়াই কান্না আসিল। তাহা দেখিয়া সকলেই ক্রন্দন করিতে লাগিল।

“রাত্রে চাঁদনী ছিল। এবাদতখানায় দাঁড়াইয়া আছি, সেইসময় দেখিলাম পুষ্করিণীর পানির উপর দিয়া একটি ছায়া হাঁটিয়া আসিতেছে! ঘাটের সোপানে উঠিয়া ছায়াটি হাওয়ার স্বরে কহিল, এইবার তুমি সত্যই বদি-উজ-জামান হইলে!…..

“কহিলাম, কেন একথা কহিতেছ?……

“সে কহিল, তুমি আলেম লোক। বদি কথার অর্থ জান না? বদি হইল পাপ। তুমি এতদিনে জমানার পাপ হইলে।

“কুদ্ধভাবে কহিলাম, আমার নাম ওয়াদি-উজ-জামান। জমানার (কালের) নদী। বাঙ্গালায় ওয়াদি বদিতে পরিণত হইয়াছে। ওয়াদি অর্থ নদী। আমার নামের অর্থ…..

“সে বাধা দিয়া পূর্ববৎ হাওয়ার স্বরে কহিল, খামোশ। তুমি কী করিয়াছ, জান না।….

“কী করিয়াছি, তুমিই বলল….

“ওই লড়কির দিকে তাকাইলেই বুঝিতে পারিবে। উহার চুল, উহার চক্ষু, উহার চাহনি…..

“এ কী বলিতেছ?….

“বদি-উজ-জামান! তুমি আজ হইতে জমানার বদি। তোমার জন্য সুনিশ্চিত দোজখ।

“আমি চিৎকার করিয়া উঠিলাম, ফরিদুজ্জামান! তুমি কি সেই কথা বলিবার নিমিত্ত শাদির মজলিশে ঢুকিতে গিয়েছিলে?….

“ছায়া হাওয়ার আওযাজে হাসিতে২ মিলাইয়া গেল। দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বসিয়া পড়িলাম।…..

“ভাবিয়াছিলাম, সাইদাকে এই গোপন তত্ত্ব জানাই এবং রফিকুজ্জামানকে নির্দেশ জারি করিব জে, জুলেখাকে তালাক দিতে হইবে। কিন্তু ইহার জন্য কী কৈফিয়ত দিব খুঁজিয়া পাই নাই। রফিকুজ্জামান আমার হুকুম তামিল করিবে কি? যদি সে তাহা করে, সাইদা বাধা দিবে। সাইদা ওই লড়কিকে জান দিয়া রক্ষা করিবে। সাইদা আর সে-সাইদা নহে। অধিকন্তু এই গোপনীয় তত্ত্ব শুনিয়া সে আরও হিংস্র হইয়া কলঙ্ক বাধাইতে পারে।…..

“পবিত্র কেতাবে বর্ণিত আছে জে, এইপ্রকার গোনাহে সাদ ও গোমরাহ নামক দুইটি শহর খোদা জ্বালাইয়া দেন। আমি সেই গোনাহ করিয়াছি সন্দেহ হয়। নাকি নিতান্ত মানসিক ভ্ৰম?…..

“পরদিবস হইতে এবাদতখানায় ইত্তেকাফ হইলাম। সাইদা বিস্মিত হইয়াছিল কি? জানিতে পারি নাই। কালো মশারির ভিতর আত্মগোপন করিয়া রহিলাম। পার্শ্বে সাইদা বা অন্য কেহ আসিয়া খাবার রাখিয়া যাইত। খাইতে পারিতাম না। দুনিয়া আঁধারে ঢাকিয়া যাইতেছিল।……

“কালো মশারির ভিতরে গোপনে ক্রন্দন করিতাম। আমার জন্য এক্ষণে মউত বরাদ্দ হউক। কারণ জিন্দেগীতে খোকা সৃষ্টি হইলে উহা নিদারুণ ক্ষতস্বরুপ। এক্ষেত্রে মউতই নিষ্কৃতি…

.

জেলা সমাচার পত্রিকার সম্পাদকীয়

“এ হে হরিষে বিষাদ হইল দেখিতেছি! পূর্বসংখ্যায় আমরা আহ্লাদিত হইয়া পাঠকদিগের জানাইয়াছিলাম যে, কুখ্যাত নরঘাতক দস্যু ছফিজামান ওরফে ছবিলালের ফাঁসির দণ্ড মহামান্য হাইকোর্টে বহাল করিয়াছেন এবং নির্লজ্জ কতিপয় চক্রান্তকারীর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। গতকল্য নরাধমের ফাঁসিরূপ পুণ্যকর্ম ঘটিলে আমরা আনন্দসম্বাদ দিবার নিমিত্ত লেখনী ধারণ করি। কিন্তু ভয়ানক পরিতাপের বিষয়, নগরীর রাজপথে এ কী অদ্ভুত দৃশ্য আমাদিগের দেখিতে বাধ্য করা হইল? দেশে শাসনের নামে দুঃশাসন চলিতেছে; অথবা শাসকবৃন্দের কুম্ভকর্ণদশা ঘটিয়াছে; নতুবা ইহা সম্ভব হইত না। আমরা বিলক্ষণ অবগত আছি যে ওই ছবিলাল বিস্তর কিংবদন্তীর নায়করূপে নিজেকে গ্রাম্য নিরক্ষরদিগের আদিম মানসে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল। ইহাও সত্য হওয়া সম্ভব যে, সে জাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। তাই বলিয়া ছবিলালের ঘৃণ্য শবদেহে পুষ্পসজ্জা, শোভাযাত্রা, বিবিধ ধ্বনি নির্ঘোষ প্রভৃতি ঘটনা কল্পনাও কবি নাই। বহুদূর গ্রামাঞ্চল হইতে চাষাভুষা বন্যপ্রকৃতির লোকসকল আসিয়া এই নগরীতে সমবেত হইল। তাহাদিগের সঙ্গে বহু তথা কথিত শিক্ষিত (?) ভদ্রলোকবেশী কতিপয় ব্যক্তিকেও দেখা গিয়াছে। আরও দুঃখ ও ঘৃণার কথা, শবদেহের উপর পুষ্প এবং খৈ নিক্ষিপ্ত হইতেছিল। আমরা উলুধ্বনি ও শঙ্খনাদও শুনিয়াছি বলিয়া ভ্রম হয়। অবলা নির্বোধ স্ত্রীলোকেরা কাহাদের প্ররোচনায় কুখ্যাত নবঘাতককে বীর বলিয়া গণ্য করিল, ইহা বুঝা কঠিন। ইহার মধ্যে মীরজাফর-জয়চাঁদদিগের তৎপরতা অনুমান কৰা যায়। আশ্চৰ্য্য এমন কথাও কেহ-কেহ রটাইতেছে যে, ছবিলালের শবদেহ জীবিত ব্যক্তির ন্যায় কোনও কোনও স্থলে উঠিয়া দাঁড়ায় এবং মৃদুহাস্যে অভ্যর্থনাগুলিন গ্রহণ করে। দেশে গাঁজাখোরদের সংখ্যাধিক্য ঘটিয়াছে বটে! তবে আরও মর্মান্তিক দৃশ্য অবলোকন করিয়া আমরা স্তম্ভিত হইয়াছি। পুলিশবৃন্দ চিত্রার্পিত বৃক্ষবৎ দণ্ডায়মান ছিল। মাননীয় কালেক্টর বাহাদুরকে আমরা জিজ্ঞাসা করি, এইরূপ মতিচ্ছন্ন দশার কারণ কী? আমরা শুনিয়াছি, দস্যু ছবিলালের পিতা নাকি মৌলাহাট গ্রামের একজন মুসলমান ধর্মগুরু পীর ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনিও নাকি বিস্তর কেরামতি দেখাইতে সমর্থ ছিলেন। সেইহেতু অনুমান করা চলে, তাঁহারই প্রভাবে প্রভাবিত শিষ্যগণ এই দুষ্কর্মের আয়োজন করিয়া থাকিবে। ইহা ছাড়া ঘটনার ভিন্ন ব্যাখ্যা হয় না। ধর্মগুরু পীর এক্ষণে জীবিত নহেন শুনিয়াছি। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ে তাঁহার প্রভাব ছিল। তবে তাঁহাকে ধন্যবাদ দেওয়া চলে যে, তিনি তাঁহার দস পুত্রকে মৃত গণ্য করিয়াছিলেন। এমন অবস্থায় আমরা ধন্দে পড়িয়াছি। যে দৃশ্য দেখিলাম, উহার প্রকৃতি হেতুগুলিন কী? পরবর্তী সম্বাদে এই রহস্য ফাঁস করিবার আশা রাখি। পাঠকবৃন্দকে অনুরোধ, তাঁহারা ধৈৰ্য্য ধরুন। শীঘ্রই দ ছবিলালের শবদেহ লইয়া পৈশাচিক শোভাযাত্রা এবং বিলাপের রহস্য-যবনিকা উন্মোচিত করিব বলিয়া আমরা প্রতিশ্রুতি বদ্ধ রহিলাম।……’

In strange and hidden places thou dost move
Where women cry for torture in their love.
Satan! at last take pity on our pain.

-Baudelaire

বৃদ্ধা দিলরুখ বেগমের আজকাল হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়। নাতনি কচির বকাঝকায় পাতাকুড়ুনি স্বভাবটি ছাড়তে হয়েছে। অথচ শশুর-হজরতের এবাদতখানার ধ্বংসস্তূপ ও জঙ্গলটিতে তিনি প্রতিদিনই দুপুরবেলা চুপিচুপি যান। নির্জনে বসে থাকেন একটুকরো লাইমকংক্রিটের চাঙড়ের ওপর। পুকুরের বাঁধানো ঘাটটি ভেঙেচুরে জঙ্গল গজিয়েছে। সেদিকে তাকাতে তাঁর ভয় করে। জলের ভেতর একটা উলটো দুনিয়া আছে। সেই উলটো দুনিয়ার দিকে তাকালে হয়তো সেই উলটো মানুষটিকে দেখে ফেলবেন।

দিলরুখ বেগম জঙ্গলে ঢাকা ধ্বংসস্তূপটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর সামনে তার শ্বশুর-হজরতের কবর, যেটিকে মাজার’ বলে লোকেরা। মাজারের উত্তর শিয়রে সেই অজানা দীর্ঘ গাছটির দিকে তাকিয়ে তাঁর গা ছমছম করে। কচি বলেছিল, গাছটির গায়ে হাত রাখলে জ্যান্ত মনে হয়। হয়তো সত্যি। বৃদ্ধা মুখ নামিয়ে নিঃশব্দে কাঁদেন। এ কান্না অপরাধবোধে। ল্যাংড়া-ভ্যাংড়া এক মানুষ, ওই এবাদতখানায় একা পড়ে থাকতেন। এক সকালে তাকে মৃত দেখা গিয়েছিল। সেই মৃত্যু নিয়ে কত গুজব রটেছিল। হজরত পিরসাহেবকেও কালো মশারির ভেতরে একইভাবে মৃত দেখা গিয়েছিল এবং একইভাবে গুজব রটেছিল। কালো জিনের হাতে মৃত্যু। সত্যিই কি কালা জিনের মানুষকে বাগে পেলে মেরে ফেলে? তাহলে তাঁকে তারা মেরে ফেলছে না কেন? এভাবে তিনি একা এসে বসে থাকেন, সেই কালা জিনেরা তাঁকে মেরে ফেলুক এই ইচ্ছা নিয়ে। সহসা পূর্বের জঙ্গল থেকে এক দমক হাওয়া আসে। ঝরঝর করে পাতা খসে পড়ে শেষ শীতের গাছপালা থেকে। চমকে ওঠেন, ওরা কি আসছে তাহলে? হাওয়া থেমে যায়। আবার হঠাৎ শুকনো পাতায় খসখস শব্দ। ঘুরে দেখেন একটা কাঠবেড়ালি। অথচ কোনও-কোনও সময় এই জনহীন পারিপার্শ্বিকে ফিসফিস কথা শুনতে পান, কারা কিছু বলতে চায়, যে-ভাষা তিনি বোঝেন না সেই ভাষায়।

দিলরুখ মুখ নামিয়ে বসে থাকেন। এতকাল পরে বুঝতে পারেন, তাঁর অর্ধমানব স্বামী তাকে আসলে পরিত্যাগ করেছিলেন। মাথাকোটার মতো করে মনে-মনে বলেন, আমাকে ক্ষমা করো! আমাকে ক্ষমা করো!

…তুমি কি সন্দেহ করেছিলে আমি তোমার ছোটো ভাইয়ের প্রতি অনুরক্ত ছিলাম? দেখো, ফাঁসির আগে তিনি শুধু আমারই সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন? আমি তো যাইনি! বারিচাচাজি বলেছিলেন, নিজের মুখে সব দোষ কবুল করলে কোন্ আইন দিয়ে তাকে বাঁচাব আমরা? এমন কী জজ তাকে যখন বললেন, যে কাজ আপনি করেছেন, তার জন্য আপনি কি অনুতপ্ত? শফি বলল, যা করেছি সজ্ঞানে করেছি। বলল, জজসাহেব! আপনাকেও খুন করতে বড়ো ইচ্ছা, কিন্তু আমার হাতে-পায়ে ভারী শেকল। আরও সাংঘাতিক কথা, সে থুতু ছুড়ল জজসায়েবের দিকে।

….মওলানা ভাসুরসায়েব ফতোয়া জারি করেছিলেন, শফি হিন্দু ছবিলাল। তার দাফনকাফন হারাম। তার লাস যেন মৌলাহাটে না আসে। খবর পেয়ে হাঙ্গামার ভয়ে বারিচাচাজি দেওরসায়েবের লাস সদর শহরে দাফন-কাফন করেন। উনি চুপিচুপি আমাকে বলেছিলেন, রুকু, তুমি কি কবরজেয়ারতে (মৃতের জন্য শান্তি প্রার্থনায়) যেতে চাও? দেখো, আমি যাইনি। শাশুড়িসায়েরা বেঁচে থাকলে হয়তো যেতেন। কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিতে চাইলে আমি যেতাম না। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যেতাম না। তাঁকে আমি ঘৃণা করতাম।

বৃদ্ধা মনে-মনে এইসব কথা বলেন। শেষে প্রার্থনার মতো নিজেকে নত করে বলেন, আমাকে মাফ করো! আমাকে মাফ করো। তিনি কখনও ঘাসে শুকনো পাতার কৃপে বসে অঝোরধারায় কাঁদেন। গোপনে, শব্দহীন ক্রন্দন। সহসা আবার পিছনে খসখস শব্দ হয়। ঘুরে দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু শরীর পাষাণভার। দম। আটকে আসে। আর এভাবে এক দুপুরে পারিপার্শ্বিকের চুপিচুপি উচ্চারিত কথাগুলির ভাষা তাঁর বোধগম্য হয়। তিনি স্পষ্ট শুনতে পান শফির কণ্ঠস্বর, রুকু! রুকু! রুকু!

অমনি দিলরুখ বেগম চিৎকার করে ওঠেন, না! তারপর শুকনো পাতার ওপর লুটিয়ে পড়েন।…..

.

উপসংহার

কচি প্রাইভেট পড়ে ফিরে আসছিল। বাজারে ডাকপিওন তাকে একটি পোস্টকার্ড দিল। পোস্টকার্ডটি পড়ে কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইল সে। চিঠিটি লিখেছেন তার বড়ো দাদাজি মওলানা নুরুজ্জামান। বাঙলায় লেখা চিঠি, কিন্তু উরদুতে নামসই। গত বছর ওঁরা সম্পত্তি বিনিময় করে খুলনা চলে গেছেন। যাওয়ার আগে দিল আফরোজ বেগম বোনকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। দিলরুখ বেগম যাননি। পরে লোকমারফত খবর আসে, পুবের মাঠের তিনবিঘে জমি দিল আফরোজ বোনের জন্য রেখেছেন। দিলরুখ শক্তমুখে বলেছিলেন, ও জমি হারাম। শ্বশুর-হজরতের। হুকুম অমান্য করতে পারব না। কচি গোপনে কামালস্যারের সাহায্য জমি ভাগচাষে। দিয়েছিল। এ বছর সেই ফসলবেচা টাকা সে ডাকঘরে জমা রেখেছে মাঝে মাঝে প্রয়োজনে টাকা তোলে এবং দাদিমাকে বলে, সরকারি বৃত্তির টাকা। দাদিমা কিছু টের পান না। সেকেলে মানুষ। পৃথিবীর কোনও খবরই রাখেন না। শুধু স্মৃতির মধ্যে ডুবে থাকেন। স্মৃতির ভেতর থেকে কথা বলেন। কিন্তু এই চিঠিটির খবর কীভাবে দাদিমাকে জানাবে ভেবে পাচ্ছিল না কচি। খুলনায় সম্প্রতি দিল আফরোজ বেগমের মৃত্যু হয়েছে।

বাড়ির কাছে এসে কচি পোস্টকার্ডটি ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দিল।

বাড়ির আবরু রক্ষার দেয়ালগুলি ভেঙে পড়েছে। খড়ের চাল সেই জমির খড় দিয়ে মেরামত করিয়েছে কচি। দাদিমাকে জানায়নি এ খড় কোন জমির। ভাঙা দেয়ালের ভেতর উঠোন বাইরে থেকে দেখা যায়। কচি থমকে দাঁড়াল। খোকা জলের বালতি থেকে উঠোনে জল ছেটাচ্ছে। অনেকদিন পরে খোকাকে ফিরতে দেখে নয়, ওর কাণ্ড দেখে অবাক হয়েছিল কচি। ছুটে বাড়ির ঢুকে সে আবার থমকে দাঁড়াল।

উঠোন জুড়ে ছাই চাপচাপ ছাই। খোকা খাপ্পা হয়ে বলল, হঠাৎ এসে না পড়লে কী হত দেখছিস? দাদিমা একেবারে বেহেড, বুঝলি রে? কী সব কাগজপত্তর পুড়িয়েছেন উঠোনে। এসে দেখি, আগুন জুগজুগ করছে। হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। একটু হলেই চালে গিয়ে পড়ত, আর ব্যস!

কচি ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর হন্তদন্ত ঘরে ঢুকল। সামনের ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে দাদিমা নেই। পাশের ঘরও ভোলা। সেখানেও উনি নেই। সে চিৎকার করে ডাকল, দাদিমা!

সাড়া না পেয়ে আবার আগের ঘরে গেল। আবিষ্কার করল, সিন্দুকের ডালা খোলা। ভেতরে হাত ভরে কচি প্রথমে সেই রোজনামচাগুলি খুঁজল, তার সন্দেহ হয়েছিল।

সেগুলি নেই। তার মানে, দাদিমা পুড়িয়ে ফেলেছেন। সে ডাকল, খোকা!

খোকা জবাব দিতে যাচ্ছিল, সেই সময় একটা লোক এসে হন্তদন্ত বলল, খোকামিয়াঁ! এবাদতখানার জঙ্গলে তোমার দাদিজি মরে পড়ে আছেন। শিগগির যাও!

ভাইবোন ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

.

নিঃশব্দ নির্জন এবং অত্যন্ত গোপন একটি মৃত্যু, অথবা চরম আত্মসমর্পণ। ভাই-বোন থমকে দাঁড়িয়েছিল অতর্কিত একটি পতনের সামনে, বিমূঢ় ও বাকহারা। আর ভিড়টিও ছিল ছোট্ট। মড়কদফতরের এক শ্রমিক দৈবাৎ জৈবকর্মে এই খণ্ডহর কীর্ণ প্রকৃতিতে ঢুকেছিল, এক কাঠকুড়োনি মেয়ে অন্যমনস্ক পা ফেলে বন্যময় আনার গাছটির কাছে এসে পড়ে, যেটি একদা পবিত্র ঐশী সভ্যতার প্রতীক ছিল এবং এখন বন্ধ্যাত্বের অভিশাপে হিংস্র দেখায়, দুজন খেতমজুর বাজারে চা খেতে খেতে সর্টকাট করেছিল, আর এক বৃদ্ধ বিশ্বাসী হুজুর পিরসাহেবের বিধ্বস্ত সমাধিতে ভক্তি জানাতে আসেন, তাঁর মাথায় টুপি ছিল, মোটমাট এই পাঁচজন মানুষ। সকলেই স্তব্ধ, মৃত্যুর তীব্র গন্ধে জর্জরিত। ঘনঘাসের ওপর লুটিয়ে পড়া একখানি শীর্ণ লোল হাত প্রতিবন্ধী স্বামীর কবরের দিকে প্রসারিত, মৃতদেহটি তারা দ্রুত সনাক্ত করেছিল। আর বহুবছর পরে আবার একটি মোজেজা ঘটছিল, অথবা বিভ্রম, হুজুর হজরত মৌলানা সৈয়দ বদিউজ্জামান আল-হুঁসায়নি আল-খোরাসানির পবিত্র মাজারের শিয়রে দাঁড়ানো ঋজু ও উদ্ধত অজ্ঞাতপরিচয় সেই গাছটি থেকে একটি কালো সাপ নেমে এসে মৃতদেহের কপাল চুম্বন করে চলে যায়, তারপর সহসা একটি ঘূর্ণি হাওয়া আসে, শুকনো পাতার রাশি মৃতদেহ ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে, পারিপার্শ্বিকে বৃক্ষলতাগুল্মে শ্বাসপ্রশ্বাসে কী এক বার্তার ঘোষণা ছিল, প্রকৃতির গভীরতম কেন্দ্র থেকে কোনও উচ্ছ্বাস অনুভূত হয়। তারপর সেই অর্মত্য মায়ার ওপর আছড়ে পড়ে ‘দাদিমা’ এই মানবিক ও তীব্র বাস্তবতার আর্তচিৎকার,কচি তার দাদিমার কাছে নত হয়, এবং তখন বৃদ্ধ বিশ্বাসী অনুচ্চস্বরে আবৃত্তি করিয়াছিলেন মৃতদের আত্মার জন্য আরবি শান্তিবাক্য, তিনি হাত দুখানিও ঈশ্বরের উদ্দেশে উত্থিত করেছিলেন।

দিলরুখ বেগমের মৃতদেহ তার প্রতিবন্ধী স্বামীর কবরের দক্ষিণে, পায়ের দিকে কবর দেওয়া হয়েছিল, কচির ইচ্ছা অনুসারেই। বৃদ্ধ বিশ্বাসী শেষাবধি উপস্থিত ছিলেন। কবর হতে বেলা পড়ে যায়। লোকসকল যখন প্রথা অনুযায়ী কবরের দিকে আর পিছু না ফিরে চলে যাচ্ছে, তখন বৃদ্ধ খোকার কাঁধে হাত রেখে আস্তে বলেন, আমি জালালুদ্দিন। খোক অবাক হয়ে তাঁকে দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধ কাতর একটু হেসে পুনঃ বলেন, হুজুর আমার হাতেই তোমার মাকে তালিমের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তোমার মা জুলেখা বেগম–

খোকা দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে, শুনেছি।

লোকসকল ততক্ষণে মাজার এলাকা থেকে সড়কে পৌঁছেছে। একদা যেখানে এবাদতখানার ফটক ছিল, সেখানে ধ্বংসস্তূপের কেন্দ্র থেকে একটি প্রকাণ্ড কাঠমল্লিকার ।গাছ মাথা তুলেছে। বৃদ্ধ জালালুদ্দিন সহসা খোকার দুটি হাত চেপে ধরে বলেন, আমাকে মাপ করো। আমি এক গোনাহগার।

তাঁর চোখে জল ছিল। তিনি আত্মসম্বরণের চেষ্টা করছিলেন। বিস্মিত খোকা বলে, একথা কেন?

জালালুদ্দিন বলেন, আমার মনে পাপ ছিল। তোমার ছোটদাদাজি শফিউজ্জামান এক রাত্রে মৌলাহাট এসেছিলেন। এতিমখানায় আমার ঘরে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। তিনি হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হুজুর তখন এই এবাদতখানায় ইন্তেকাফে’, দেখা হওয়া অসম্ভব ছিল। কিন্তু আমার খুব ভয় হয়েছিল শফিসাহেবকে দেখে। জালালুদ্দিন কান্নাজড়িত স্বরে বলেন, জানতাম উনি এক খুনী মানুষ। তাঁর নামে হুলিয়া ছিল। আমি পুলিশে খবর দিয়ে তাঁকে ধরিয়ে দিই। ভেবেছিলাম, হুজুরের কোনও ক্ষতি করতেই এসেছেন।

খোকা তাঁকে আঘাতের জন্য হাত তুলেই নামিয়ে নেয়। তারপর দ্রুত চলে যায়। জালালুদ্দিন তাকে ডাকছিলেন, আরও কিছু বলার কথা ছিল, কিন্তু খোকা পিছু ফেরে না। বৃদ্ধ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়াল। সন্ধ্যার বাসে বহরমপুর, তারপর ট্রেনে রানাঘাট হয়ে তিনি কুষ্টিয়া যাবেন। সেখানে তাঁর একটি বড় সংসার আছে। বহু বছর পরে তিনি হুজুরের মাজার দর্শনে এসেছিলেন। হুজুরকে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন এবং তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়েন। বিশেষ কথা, তাঁর কাছে পাশপোর্ট-ভিসা ছিল না। তাই এই সফরটিও ছিল অত্যন্ত গোপনীয়।

অধ্যায় ২৩ / ২৩

সকল অধ্যায়

১. ০১. কালো জিন এবং শাদা জিন বৃত্তান্ত
২. ০২. বিম্ব এবং প্রতিবিম্ব
৩. ০৩. নতুন বাসস্থান
৪. ০৪. দেওয়ান সাহেবের আবির্ভাব
৫. ০৫. এশার নামাজের পর
৬. ০৬. খানবাহাদুর দবিরউদ্দিন চলে যাওয়ার পর
৭. ০৭. ঘোড়া এবং তলোয়ার
৮. ০৮. কালো ঘোড়াটির পিঠে
৯. ০৯. স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ
১০. ১০. জ্যোৎস্নার মৃত্যুর ঘ্রাণ
১১. ১১. সব পাখি ঘরে ফেরে
১২. ১২. কানা ঘোড়ার সওয়ার  
১৩. ১৩. শনশন শব্দ
১৪. ১৪. একটি কথোপকথন
১৫. ১৫. চান্দ্রমাস জেলহজ্জের দশম দিবসে কেয়ামত
১৬. ১৬. বেদা’য়াতে সাইয়্যেয়া
১৭. ১৭. নারী এবং প্রকৃতি
১৮. ১৮. কেশবপল্লীতে হাজারিলালের কুটিরে
১৯. ১৯. স্বাধীন মূর্ছিতা রত্নময়ীর চেতনা
২০. ২০. হুল্‌ হুল্‌ জুল্‌ জুল্‌ উম্‌কি বুস্‌বার জুর্‌
২১. ২১. পদ্মার চরে ঘুরতে
২২. ২২. উন্মাদ হইবার পূর্বে রাজা লিয়র
২৩. ২৩. রফিকুজ্জামানের সহিত জুলেখার শাদির দিন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন