পিতা পুত্রকে – ৬

চাণক্য সেন

ছয়

স্বদেশি সংগ্রামের হাওয়াকে রুখতে কর্তৃপক্ষ আরও একটা হাওয়া গণেশপুরে নিয়ে এলেন। এ হাওয়ার নাম মুসলিম লীগ। স্কুলের স্থাপন মুসলমান জমিদারদের হাতে। তাঁদের অট্টালিকা বা প্রাসাদের সংলগ্ন স্কুল। কিন্তু মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা খুব কম, মুসলমানরা খুব গরিব, ছেলেরা একটু বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে যায় বাবা কাকা দাদাদের সঙ্গে, স্কুলে তাদের পাঠানো হয় না। নিচের ক্লাসে যদিও বা দু-দশটা মুসলমান ছাত্র আসত, সেভেন-এইটে তাদের প্রায় সবাই কেটে পড়ত। আমার সঙ্গে ক্লাস এইটে একটি মাত্র মুসলমান ছেলে ছিল। আবদুল খালেক। তার সঙ্গে ছিল আমার গভীর বন্ধুত্ব।

মাস্টারমশাইদের মধ্যেও মাত্র দুজন মুসলমান। একজন মৌলবী, তিনি ছাত্রদের আরবি, উর্দু পড়াতেন, আমাদের সঙ্গে ছোট একটা কথাও বলতেন না। চেহারা থেকে বোঝা যেত তিনি বাঙালি নন। ইত্তর ভারত থেকে আমদানি—থাকতেন জমিদার বাড়িতে—জমিদারদের ছেলেমেয়েদের আরবি, উর্দু শেখানোই ছিল তাঁর প্রধান কাজ।

দ্বিতীয় শিক্ষক ছিলেন মান্নান সাহেব। সরু চেহারা, লম্বা দেহ, দাড়ি সাদা হয়ে গেছে। ছোট্ট ছোট্ট চোখে এমনভাবে তাকাতেন যেন বিশেষ কিছু দেখতে পেতেন না। সেজন্য তাঁর বিশেষ কিছু অসুবিধা হতো না। সর্বদা সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরতেন, মাথায় সাদা মুসলমানি টুপি। মিহি স্বরে কথা বলতেন মান্নান সাহেব। আমরা সবাই তাঁকে ভালোবাসতাম। তিনি সত্যিকার ভালোমানুষ ছিলেন। মান্নান সাহেব অঙ্কের মাস্টার ছিলেন বলেই সম্ভবত গণিতে আমার আতঙ্ক ও অনীহা জন্মেছিল। কোনোকিছুকে আকর্ষণীয় করার ক্ষমতা বা প্রচেষ্টা ছিল না মান্নান সাহেবের। নিজেকেও না।

কিন্তু ক্লাস এইটে পড়বার সময় এক নতুন এসিসটেন্ট হেড মাস্টার এলেন। রহমান আজিজ সাহেব। তিনি চুড়িদার ও সেরওয়ানি পরতেন, মাথায় আরবি টুপি, বয়স নিশ্চয়ই কম ছিল, দাড়ি, গোঁফ, চুল কালো। সরু কপাল, খাঁদা নাক, হঠাৎ ভেঙে পড়া চিবুক, চোখে মুখে সর্বদা একটা তীব্রতা। অমন চেঁচিয়ে পড়াতে দেখিনি আর কাউকে। আমাদের ইংরেজি পড়াতেন রহমান আজিজ সাহেব। ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত তিনি ইংরেজির শিক্ষক।

দু-তিন মাসের মধ্যে দেখা গেল স্কুলে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দূর দূর গ্রাম থেকে তারা গণেশপুর হাইস্কুল ভর্তি হলো। কেউ কেউ ছোট ডিঙ্গি নৌকা করে আসত। কয়েকজনের জন্য তৈরি হলো স্কুলের পিছনে মুসলমান ছাত্র হোস্টেল। এ সব ছাত্ররা হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে দরকার না হলে কথা বলত না। আমার ক্লাসে ও একজন এসে বসতে লাগল। লেখাপড়ায় তার একেবারেই মন ছিল না। নেহাৎ ক্লাস আসতে হবে তাই আসা। কিন্তু তার দুষ্টুবুদ্ধি বেশ প্রখর ছিল। আবদুল খালেক ও আমার মধ্যে বন্ধুত্ব সে সহ্য করতে পারত না।

আবদুলই বলল কথাটা আমাকে।

“জানিস, ঐ যে মহম্মদ আকরাম, যে সামনের বেঞ্চে বসে, আর ঘুমোয়, ওর একদম ইচ্ছে নেই আমি তোর সঙ্গে মিশি।”

আমি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, “কেন?”

আবদুল বলেছিল, “ও বলে হিন্দু-মুসলমানে বন্ধুত্ব হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়।’

“কিন্তু আমরা তো বন্ধু।”

“ও চায় না আমরা বন্ধু থাকি। বলে আমি যদি তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখি, ওরা মারবে আমাকে।”

“ওরা?”

“দেখছিস না কত মুসলমান ছাত্র হঠাৎ স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এরা সব মুসলিম লীগের লোক। এদের নিয়ে এসেছেন আজিজ সাহেব। আজিজ সাহেবকে আনিয়েছেন ছোট চৌধুরী সাহেব। তিনি এ এলাকায় মুসলিম লীগ তৈরি করছেন।”

আমি খুব ভাবনায় পড়ে গেলাম। আমার জন্যে আবদুল ওদের হাতে প্রহৃত হতে পারে এই সম্ভাবনাটা আমাকে ভীষণ কাবু করে দিল।

বললাম, “তুই তাহলে আমার সঙ্গে মিশিস না।”

আবদুল চুপ করে রইল।

তারপর বলল, “আমাদের এতদিনের বন্ধুত্ব ভেঙে যাবে? দেখি কী করে ওরা! এক্ষুনি আমি তোকে ছাড়ছি না।”

সারা বছর স্কুলে একটা উৎসব হতো ছাত্রদের উদ্যোগে। সরস্বতী পূজা। মুসলমান জমিদাররা কোনোদিন আপত্তি করেনি। স্কুলের পিছনে একটা ছোট ঘর ছিল। টিনের চাল। টিনের দেওয়াল ও মাটির মেঝে। বিশেষ একটা ব্যবহার হতো না। সামনে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা, ঘাস সবুজ। সরস্বতী পুজো হতো ঐ ঘরে। কুমোরপাড়া গণেশপুরের গায়েই, সেখান থেকে ছাত্ররা মূর্তি নিয়ে আসত। স্কুলেরই কোনো না কোনো ব্রাহ্মণ শিক্ষক পূজা করতেন। টাকা তোলা হতো ছাত্রদের কাছ থেকে। পূজার দিন রাত্রে ভোগ হতো। একশোর বেশি ছাত্ররা খেত, ভাইবোনদের সঙ্গে আনা নিষিদ্ধ ছিল না। বিকেলে কবিতা প্রতিযোগিতা হতো, কোনো কোনো বছর ছেলেরা নাটক করত। জমিদারদের আদেশ ছিল পূজার পরদিন ঘর ও সংলগ্ন এলাকাকে পুরো সাফ করে দিতে হবে। এ কাজে ছাত্ররা কোনো ত্রুটি রাখেনি। সরস্বতী প্রতিমা বিসর্জন করা হতো না। কোনো না কোনো ছাত্র তা নিজের বাড়ি নিয়ে যেত। পূজার দায়িত্ব থাকত ক্লাস নাইনের ছাত্রদের উপর। একখানা সরস্বতী প্রতিমা আমাদের ঘরেও স্থান পেয়েছিল।

রহমান আজিজ সাহেব ঘোষণা কররেন স্কুলের মুসলমান ছাত্ররা ঈদ উৎসব করবে। রমজানের পুরো একমাস মুসলমান দিনে আহার করে না। মাস শেষ হলে ঈদের চাঁদ আকাশে দেখার পরে ঘোষিত হয় উৎসবের দিন ও সময়।

সরস্বতী পূজায় স্কুলের সব ছাত্র নিমন্ত্রিত হতো। ঈদের উৎসবেও সবাইকে নিমন্ত্রিত করা হলো। উৎসবের প্রারম্ভে আজিজ সাহেব এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। তাতে কংগ্রেস ও তার নেতাদের তীব্র নিন্দা করা হলো।

মুসলমানদের ‘জাতীয় দাবি’ জোরের সঙ্গে হলো উচ্চারিত।

তখনও মুসলমান লীগ ‘পাকিস্তান তার একমাত্র লক্ষ্য’ এই সংকল্প ঘোষণা করেনি। সারা দেশে ১৯৩৫ সালের ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ অনুসারে প্রাদেশিক নির্বাচনের কথাবার্তা চলছে। বঙ্গদেশের প্রধানমন্ত্রী মৌলবী ফজলুল হক। তিনি তখনও মুসলমান লীগে সামিল হননি। লীগের নেতা নাজিমুদ্দিন ঢাকার নবাব বংশের প্রমুখ রাজনৈতিক চরিত্র। রহমান সাহেব মুসলমান ছাত্রদের বললেন, সমবেত শক্তিতে তাদের রক্ষা করতে হবে নিজেদের স্বার্থ, মনে রাখতে হবে মুসলমান স্বার্থ হিন্দুদের হাতে নিরাপদ তো নয়ই, বরং বিপন্ন। সন্ত্রাসবাদ ইংরেজদের ভীত করে তুলছে, তারা কংগ্রেসের সঙ্গে পরামর্শ করতে এগোচ্ছে। মুসলমানদের সন্ত্রাসবাদ থেকে দূরে থাকতেই হবে, ইংরেজদের পরিষ্কার জানিয়ে দিতে হবে কংগ্রেস ব্রিটিশ কম্প্রোমাইজ তারা সহ্য করবে না। “প্রয়োজন হলে আমাদের ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি তুলে সংগ্রামে নামতে হবে…’

সভার সভাপতির আসনে উপবিষ্ট ছিলেন জমিদার বাড়ির ছোট চৌধুরী সাহেব। বেঁটে মোটা, ফর্সা, টাকমাথা, চশমা পরা, চোখ ট্যারা।

হেড মাস্টার মশাই থেকে সব শিক্ষক ও অনেক হিন্দু ছাত্র গণেশপুর হাইস্কুলের প্রথম ঈদ উৎসবে উপস্থিত ছিলেন। “ঈদ মোবারক” মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বে ও সমত্বের ধ্বনি, তাতে সব মানুষের মঙ্গল কামনা। ছোট চৌধুরী সাহেব বক্তৃতা করলেন না। সভার শেষ হেড মাস্টার মশাই ও অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। করলেন আজিজ সাহেবও, তাঁর মুখে কিন্তু হাসি-আনন্দ অনুপস্থিত। আবদুল ও আমি দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গনবদ্ধ হলাম।

সকল অধ্যায়

১. পিতা পুত্রকে – ১
২. পিতা পুত্রকে – ২
৩. পিতা পুত্রকে – ৩
৪. পিতা পুত্রকে – ৪
৫. পিতা পুত্রকে – ৫
৬. পিতা পুত্রকে – ৬
৭. পিতা পুত্রকে – ৭
৮. পিতা পুত্রকে – ৮
৯. পিতা পুত্রকে – ৯
১০. পিতা পুত্রকে – ১০
১১. পিতা পুত্রকে – ১১
১২. পিতা পুত্রকে – ১২
১৩. পিতা পুত্রকে – ১৩
১৪. পিতা পুত্রকে – ১৪
১৫. পিতা পুত্রকে – ১৫
১৬. পিতা পুত্রকে – ১৬
১৭. পিতা পুত্রকে – ১৭
১৮. পিতা পুত্রকে – ১৮
১৯. পিতা পুত্রকে – ১৯
২০. পিতা পুত্রকে – ২০
২১. পিতা পুত্রকে – ২১
২২. পিতা পুত্রকে – ২২
২৩. পিতা পুত্রকে – ২৩
২৪. পিতা পুত্রকে – ২৪
২৫. পিতা পুত্রকে – ২৫
২৬. পিতা পুত্রকে – ২৬
২৭. পিতা পুত্রকে – ২৭
২৮. পিতা পুত্রকে – ২৮
২৯. পিতা পুত্রকে – ২৯
৩০. পিতা পুত্রকে – ৩০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন