পিতা পুত্রকে – ২৯

চাণক্য সেন

ঊনত্রিশ

বলা হয়ে থাকে ইতিহাস তৈরি করে ঐতিহাসিকরা। অতীতকে পুনর্গঠন করে সাজিয়ে গুছিয়ে তাকে জনসাধারণের কাছে পরিবেশন করা ঐতিহাসিকদের কাজ। ইংরেজের একশো বছর ভারতবর্ষের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গঠন এবং দুশো বছর সাম্রাজ্যবাদী শাসন, এই তিনশো বছর নিয়ে অনেক ইংরেজ ইতিহাস লিখেছেন। তাদের মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে বিখ্যাত ভিনসেন্ট স্মিথ ও পরসিভ্যাল স্পিয়ার। স্মিথের তৈরি ‘দি অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ প্রথম প্রকাশ ১৯১৯ সালে। তৃতীয় সংস্করণ পরসিভ্যাল স্পিয়ার কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৫৮ সালে। প্রথম ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। সেই থেকে গত বিশ বছরে এই পুস্তকটির এগারোটি সংস্করণ ছাপা হয়েছে।

বঙ্গে যে মহা দুর্ভিক্ষে ৩৫ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল, সেই দুর্ভিক্ষের কারণ এই পুস্তকে একটি প্যারাগ্রাফে সেরে দেওয়া হয়েছে। কারণ দেখানো হয়েছে বার্মার পতন, রেলপথে সৈন্য চলাচলের বাধ্যতামূলক প্রাধান্য, ভারতবর্ষের ধান্য শস্যের ভীষণ ঘাটতি এবং চোরা-কারবারিদের মানুষের দুঃখ ভাঙিয়ে মুনাফা তোলা। এই দুই সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকদের মধ্যে চালের কমতি ছিল কেবল মাত্র পাঁচ শতাংশ কিন্তু প্রশাসনের বণ্টন ও কন্ট্রোল ব্যাপক কালোবাজার তৈরি করেছিল এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এই ইতিহাস পুস্তকে স্বীকার করা হয়েছে যে, ১৯৪২-৪৩ সালে বঙ্গ থেকে চাল একেবারে উধাও এবং সমস্যার মোকাবিলায় বঙ্গ সরকারের ব্যর্থতা। এখন ভাবতে হাস্যকর মনে হয় যে স্মিথ ও স্পিয়ার দুজনেই লিখেছিলেন, এই ব্যর্থতার জন্য তৎকালীন দিল্লিস্থ ইংরেজ প্রশাসনের ‘প্রাদেশিক অটোনমিকে অতিরিক্ত প্রশয়’ দেওয়াটা অন্যতম কারণ। ১৯৪৩ সালে অক্টোবর মাসে লর্ড ওয়াভেলের আবির্ভাব অবস্থাকে শাসনে নিয়ে আসে। ইংরেজ সৈন্যদের উপরে দুর্ভিক্ষে জীর্ণশীর্ণ মানুষদের ত্রাণের দায়িত্ব সঁপে দেওয়া হয়। দুজন ঐতিহাসিকই লিখেছেন, “ব্রিটিশ সৈন্যেরা ভারতবর্ষে এর আগে কখনো এত জনপ্রিয় হতে পারেনি।”

স্টেটস্ম্যান অফিসে চাকরি করে বুঝতে পারলাম অ্যাংলো—ইন্ডিয়ানদের ও আমার ঐতিহাসিক দৃষ্টি একেবারে আলাদা। ‘৪২-এর মন্বন্তর ইংরেজের ভারত শাসনের ইতিহাসে বিংশ-শতাব্দীর সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায়। ‘৪২-৪৩ সালে কলকাতার রাস্তায় ক্ষুধার যন্ত্রণায় অর্ধমৃত ও মৃতের সংখ্যা প্রত্যেক পথচারীকে আতঙ্কিত ও স্তম্ভিত করত। “ফ্যান দাও”, “ফ্যান দাও” আর্তনাদে প্রতিদিন প্রতি গৃহস্থের কান ও মনকে বিদ্ধ করত। অথচ এই যে লক্ষ লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যু এবং তার চেয়েও অনেক বেশি লোকের মৃত্যুর দিকে অবধারিত দৈনন্দিন পদক্ষেপ, এটা কোনো ‘সংবাদ’ ছিল না। ভারতবর্ষে বা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সংবাদপত্রে এই ‘খবর’ ছাপা হতে পারেনি। ইংরেজ আমলে ‘ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ সমস্ত পৃথিবীর কাছ থেকে ইতিহাসের অন্যতম সবচেয়ে কুখ্যাত ‘মানুষে তৈরি দুর্ভিক্ষকে’ সম্পূর্ণ লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল। কেবলমাত্র রেঙ্গুন থেকে প্রচারিত আইএনএ বেতারে কিছু কিছু খবর ঘোষিত হতো। কিন্তু বেতার শোনা ছিল ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে প্রজাদের পক্ষে বেআইনি। ধরা পড়লে জেল।

এই সময় স্টেটসম্যানের সম্পাদক ইয়ান স্টিফেন্স দুর্দান্ত সাহসের পরিচয় দিলেন। সারা কলকাতার মানুষ, ও সারা ভারতবর্ষের মানুষও প্রথম এক পৃষ্ঠায় দুর্ভিক্ষের খবর পেল। স্টেটসম্যানের একদিনের সংখ্যায় একপৃষ্ঠা ভরে দুর্ভিক্ষে মৃত ও মৃতপ্রায় মানুষদের ছবি ছাপানো হলো।

এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য স্টিফেন্স গভর্নিং বডি অথবা তার ইংরেজ সহকর্মীদের অনুমতি নেননি। তখন চারজন ইংরেজ সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতেন। বৃদ্ধ ওয়ার্ডওয়ার্থ, বিখ্যাত কবির পৌত্র। তিনি ভারত সরকারের শিক্ষা বিভাগ থেকে অবসর নিয়ে স্টেটসম্যানে ঢুকেছিলেন। সিনিয়র এডিটর হিসেবে। অতিশয় অন্যমনস্ক ছিলেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। অফিসের কাছাকাছি চৌরঙ্গিতে একা বাস করতেন। অফিসের শেষে গাড়ি প্রস্তুত থাকত তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেবার জন্য। অনেক সময় গাড়ি তার নজরে পড়ত না, হেঁটেই চলে যেতেন বাড়ি, পিছু পিছু মন্থর গতিতে চলত গাড়ি। মাসের প্রথম দিনে মাইনের চেক হাতে নিয়ে বাড়ি যাবার পথে অন্যমনস্ক হয়ে দুমড়ে মুচড়ে এক সময় দৃষ্টিপথে আগত ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। তাঁর সেক্রেটারি পুস্তক আকীর্ণ, পত্র-পত্রিকায় জঙ্গলাকীর্ণ অফিসঘর সাফ করতে গিয়ে প্রায়ই বেশ ককতগুলো চেক পেতেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ লন্ডন টাইমস-এর সংবাদদাতাও ছিলেন।

তারপর ছিলেন জনসন সাহেব। ইনি স্টিফেন্সের পরে এডিটর হয়েছিলেন। এঁরা দুজনেই ছিলেন কট্টর গোঁড়াপন্থী। স্টিফেন্সের অক্ষমনীয় অপরাধে অতিশয় ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত। সংবেদনশীল ও সমর্থক ছিলেন একমাত্র অ্যালেক রীড। কিন্তু আগেই বলেছি ইংরেজ সমাজে তাঁর পাত্তা ছিল না। চতুর্থ ইংরেজ একেবারেই উল্লেখযোগ্য নন। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিবিম্ব প্রতিনিধি ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ক্যাপিটাল’। তার সম্পাদক টাইসন সাহেব।

স্টেটসম্যানে দুর্ভিক্ষের খবর অনেক ছবির সঙ্গে প্রকাশিত হবার পরের দিনই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। আমি দেখতে পেলাম আপিসে যারা সব থেকে বেশি ক্ষেপে আগুন, তারা নিউজ রুমের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাব-এডিটর গোষ্ঠী। এরাই প্রতিদিন সংবাদ সাজিয়ে গুছিয়ে জনসাধারণের কাছে উপস্থিত করত। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ভাষা সাধারণত কদর্য। তাদের ব্যবহৃত শব্দগুলো সর্বদা নিউজ রুমের সামান্য ক’জন ভারতীয় সাব-এডিটরকে বিদ্ধ করত। এখন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের গালিগালাজের লক্ষ্য হয়ে উঠলেন ইয়ান স্টিফেন্স। গুজব রটে গেল স্টিফেন্সকে গ্রেপ্তার করা হবে ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া রুল্সে।

ঠিক এই সময় আমি স্টিফেন্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ কাজকর্মের কিছুটা সুযোগ পেয়েছিলাম। একজন ভারতীয় সহকারী সম্পাদক প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকীয় প্রবন্ধের সারাংশ সাজিয়ে গুছিয়ে স্টিফেন্সকে পাঠাতেন। ইনি তিন মাসের জন্য ছুটিতে গেলে এই দায়িত্বটা পড়েছিল আমার উপরে। স্টিফেন্স ছিলেন অবিবাহিত। গুজব ছিল তিনি হোমোসেক্স্যুয়াল। একটি অতি সুপুরুষ পাঠান যুবক ছিল তাঁর “ম্যান ফ্রাইডে”। সবকিছু কাজ সে-ই করত। একদিন স্টিফেন্স আমাকে একসঙ্গে পাঁচশো টাকা দিয়ে বললেন, “আব্দুল একটা ঘড়ি চাইছে। তুমি আর্মি নেভি স্টোর থেকে একটা ভালো ঘড়ি ওকে কিনে দাও।” আর্মি নেভি কেন, কলকাতার কোনো বড় দোকানেই ঢুকতে আমার বুক কাঁপত, পা সরত না। তবু যেতে হলো এবং যে বস্তুটির আমি কিছুই জানি না, আব্দুলের পছন্দমতো তাই কিনে দিতে হলো।

ইয়ান স্টিফেন্স পাকিস্তানকে বিষয় করে একটি সুদীর্ঘ ও সুলিখিত পুস্তক লিখেছিলেন। তাতে বিশেষ করে পাঠানদের সৌন্দর্য বারবার ফুটে উঠেছিল। পাঠান মানে পুরুষ পাঠান। অনেকে এই পুরুষ পাঠানের সৌন্দর্যপ্রীতি স্টিফেন্স সাহেবের হোমোসেক্সুয়্যালিটির প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করতেন।

১৯৪৩ সালে লর্ড ওয়াভেল একদিন কলকাতায় কয়েক ঘণ্টার জন্য থেমেছিলেন বার্মা সীমান্ত থেকে দিল্লি ফেরার পথে। আব্দুল, ইয়ান স্টিফেন্সের চুল কাটছিল। টেলিফোন এল লাট সাহেবের বাড়ি থেকে, বড়লাট স্টিফেন্সের সঙ্গে দেখা করতে চান।

স্টিফেন্সের তখন মাথার চুলের একপাশ কাটা হয়েছে। সেই অবস্থাতেই তিনি চলে গেলেন লর্ড ওয়াভেলের সকাশে। ওয়াভেলের ঘরে যখন ডাক পড়ল, করমর্দনের সঙ্গে সঙ্গে বড়লাট নাসিকা কুঞ্চিত করে স্টিফেন্সের মস্তক দেখতে লাগলেন।

স্টিফেন্স বললেন, “আমি চুল কাটছিলাম, আপনার ডাক পেয়ে আধা চুল কাটা অবস্থায় চলে এসেছি। আমি জানি আপনার সময় কত মূল্যবান।”

দুজনের মধ্যে কথাবার্তার কোনো উল্লেখ নেই গত কয়েক বছরে প্রকাশিত ইংরেজ রাজত্বের শেষ অধ্যায় নিয়ে বহু নথিপত্রের কোথাও। অফিসের গুজব কারখানায় তৈরি সংবাদে জানতে পারলাম ওয়াভেল স্টিফেন্সকে শুধু তিরস্কারই করেননি, দেশদ্রোহিতারও অভিযোগ করেছেন। উত্তরে স্টিফেন্স বলেছেন, “আমি এক্ষুনি পদত্যাগ করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার পদত্যাগ ভারতে না হলেও ইংল্যান্ডে অবশ্য প্রকাশিত হবে। ছড়িয়ে পড়বে সারা দুনিয়ায়।”

এই ঘটনার এক বছর পরে স্টিফেন্স স্টেটস্ম্যান থেকে পদত্যাগ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। ভারতবর্ষ নিয়ে তাঁর ভূমিকা এখানেই শেষ। বিলেতে বসে আরও দুখানা পুস্তক লিখেছিলেন একখানাও বিশে সাড়া জাগাতে পারেনি।

আমার পক্ষেও স্টেটসম্যানে কাজ করা অসম্ভব হয়ে আসছিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, ইংরেজের তিনশো বছরের প্রাচীরকে প্রচণ্ড ধাক্কা মারছে। সারা দুনিয়ার কাছে পরিষ্কার, ইংরেজের কাছেও, সে যুদ্ধজয়ের পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তাকত গেছে শেষ হয়ে। সাম্রাজ্যের ভার বহন করার মতো শক্তি তার নেই। যদিও উইনস্টন চার্চিল ঘোষণা করেছেন, “সম্রাটের সাম্রাজ্যের অবলুপ্তির পৌরোহিত্য করতে আমি প্রধানমন্ত্রী হইনি”, তথাপি তাঁকে পাঠাতে হয়েছে ক্রিপস মিশন। ১৯৪৫ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে লেবার পার্টি সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করেছে, “ইংরেজ ভারত থেকে বিদায় নেবে।” এই সময় ‘স্টেটস্ম্যানে’র নিউজ রুমে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেবদের মুখে খিস্তি সহ্য করে চাকরিতে বহাল থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল।

১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গার সময়, মহাত্মা গান্ধী যখন আমৃত্যু অনশনে ব্রতী, তখন একদিন দেখলাম এক দীর্ঘ সম্পাদকীয় ছাপাঘর থেকে মুদ্রিত হয়ে আমাদের কাছে এসেছে সযত্নে রক্ষা করে উপযুক্ত সময়ে ব্যবহারের জন্য। সম্পাদকীয় প্রবন্ধের প্রথম লাইনটি আমার এখনও মনে আছে, “মিস্টার গান্ধী হ্যাজ বীন এ গ্রেট ম্যান অন সেভারেল অকেসান্স।” সমস্ত প্রবন্ধে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকার তীব্র সমালোচনা ও স্বাধীন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে নৈরাশ্য। প্রবন্ধটি অবশ্যই মুদ্রিত হতে পারেনি কারণ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী মৃত্যুবরণ করে ‘স্টেটসম্যানে’র সম্পাদককে বাধিত করেননি।

আমি সংকল্প করলাম এখানে কাজ আর নয়। কিন্তু যাব কোথায়? অমৃতবাজার পত্রিকায় আবেদন করে স্থান হলো না। তখন অধুনা প্ৰায় বিস্মিত কিন্তু আমাদের যৌবনে বিখ্যাত, রামারাও জহওরলাল নেহেরু কর্তৃক স্থাপিত ন্যাশনাল হেরল্ডের সম্পাদক ছিলেন। আমার সঙ্গে বিন্দুমাত্র পরিচয় ছিল না। তথাপি আমার বেদনা, দ্বিধা সংশয় ও সংকল্পের কথা বিস্তারিত জ্ঞাপন করে তাঁকে চিঠি লিখলাম ।

দিন দশেকের মধ্যে জবাব এল। রামারাও লিখেছেন, “নাগপুর টাইমস্ নামক একটি দৈনিক পত্রিকা আছে যার মালিক পণ্ডিত রবিশঙ্কর শুক্ল, যিনি কয়েক মাসের মধ্যেই সি.পি. ও বেরার প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। পত্রিকাটির অবস্থা মোটেই ভালো নয়। শুক্লাজি নতুন সম্পাদকের খোঁজে আছেন। আমি তাঁকে তোমার কথা লিখেছি। যদি একটি ছোট দৈনিক কাগজ নিয়ে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাও তাহলে শুক্লাজির কাছে চিঠি লেখ এবং রায়পুরে গিয়ে দেখা কর।”

পণ্ডিত রবিশঙ্কর শুক্লাকে চিঠি লেখার সপ্তাহখানেকের মধ্যে জবাব এল। আমি ‘ফ্রেঞ্চ লিভ’ নিয়ে রায়পুরে চলে গেলাম। অর্থাৎ অফিস থেকে ছুটি নিতে হলো না। সকালে হাওড়া স্টেশনে বম্বে এক্সপ্রেস-এ চেপে বিকেল চারটেয় রায়পুর এবং সন্ধের সময় আর একটা ট্রেনে চড়ে সকাল হতে না হতে কলকাতা।

এক ভদ্রলোক স্টেশনে আমাকে নিতে এসেছিলেন। পরিচয় হলো ইনি শুক্লাজির প্রথম পুত্র অম্বিকাচরণ। একটা পুরোনো গাড়ি চেপে আমি রবিশঙ্কর শুক্লার বাড়িতে হাজির। তিনি তাঁর বৈঠকখানায় দরবার করছিলেন। জানতেন, আমি মাত্র কয়েকঘণ্টার জন্য রায়পুর থাকব। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমার পিঠে হাত দিয়ে স্বাগত জানালেন। সুদীর্ঘ গৌরবর্ণ চেহারা, দেহে মাংসের বাহুল্য নেই। সবচেয়ে বড় নজরে পড়ে তুলোর মতো সাদা বিরাট একজোড়া গোঁফ।

বললেন, “আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন, একটু সামান্য আহার করুন, আমি পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব।”

কথা বলার জন্য তাঁর বৈঠকখানায় ঢুকলাম। চেয়ার টেবিল কিছুই নেই। আছে শুধু বিরাট এক চৌকি, তার উপর তোষক এবং সাদা ধবধবে চাদর, কয়েকটি তাকিয়া। রবিশঙ্কর শুক্লা তাঁর পত্রিকার কথা বলতে একেবারেই স্ফীত-বাক্য হলেন না।

“দৈনিক কাগজ। ছ’হাজার কপি ছাপা হয়, হাজার তিনেক বিক্ৰি। বিজ্ঞাপন থেকে আয় নেই। সব খরচই আমাকে মেটাতে হয়। আমার দ্বিতীয় পুত্র কাগজের ম্যানেজিং এডিটর। সে কিছু দেখে না। ভগবতীচরণের দেখবার যোগ্যতাও নেই। তোমাকেই সবকিছু দেখতে হবে। পারবে?”

“পারব মনে করেই তো এসেছি।”

“তুমি স্টেটস্ম্যান ছাড়ছ কেন?”

আমার মুখে সব কথা শুনে বললেন, “খুব ভালো একটা চাকরি ছেড়ে ছোট একটা অজানা অচেনা পত্রিকায় আসছ? তোমার সাহস আছে। এই প্রদেশে হিন্দি ও মারাঠি সহবাস করে। আমার এতদিনের সম্পাদক ছিলেন জনৈক মারাঠি। রাজনীতির জন্য এমন একজন সম্পাদক চাই যে হিন্দিও নয় মারাঠিও নয়, অর্থাৎ দলীয় রাজনীতিতে বাঁধা পড়বে না। এজন্যেই আমি রামারাওকে লিখেছিলাম। তিনি তোমাকে সুপারিশ করেছেন, তাঁর কাছে লেখা তোমার চিঠিও আমাকে পাঠিয়েছেন।”

একটু থেমে প্রশ্ন করলেন, “তোমার বয়স কত?”

“চব্বিশ।”

“তুমি তো ছেলেমানুষ। কাগজ ছোট হলেও এটা হবে প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাগজ, দায়িত্বটা বেশ ভারী। এত অল্প বয়সে তুমি পারবে?”

“আমার বয়সটা কি আমার বিরুদ্ধে যাবে? একবার পরখ করেই দেখুন না।”

মাইনেপত্র, বাৎসরিক বৃদ্ধি সব ঠিক হয়ে গেল। পাঁচশো টাকা মাসিক বেতন, পঞ্চাশ টাকা বাৎসরিক বৃদ্ধি, বিনা ভাড়ায় একটি বাংলো, ভালো পাড়ায়।

১৯৪৬ সালের মে মাসে আমার কলকাতা ত্যাগ। চাকরির জন্য ১৯৭৭-৭৮, এই এক বছর ছাড়া আমি আর কলকাতায় কাজ নিয়ে ফিরিনি।

সকল অধ্যায়

১. পিতা পুত্রকে – ১
২. পিতা পুত্রকে – ২
৩. পিতা পুত্রকে – ৩
৪. পিতা পুত্রকে – ৪
৫. পিতা পুত্রকে – ৫
৬. পিতা পুত্রকে – ৬
৭. পিতা পুত্রকে – ৭
৮. পিতা পুত্রকে – ৮
৯. পিতা পুত্রকে – ৯
১০. পিতা পুত্রকে – ১০
১১. পিতা পুত্রকে – ১১
১২. পিতা পুত্রকে – ১২
১৩. পিতা পুত্রকে – ১৩
১৪. পিতা পুত্রকে – ১৪
১৫. পিতা পুত্রকে – ১৫
১৬. পিতা পুত্রকে – ১৬
১৭. পিতা পুত্রকে – ১৭
১৮. পিতা পুত্রকে – ১৮
১৯. পিতা পুত্রকে – ১৯
২০. পিতা পুত্রকে – ২০
২১. পিতা পুত্রকে – ২১
২২. পিতা পুত্রকে – ২২
২৩. পিতা পুত্রকে – ২৩
২৪. পিতা পুত্রকে – ২৪
২৫. পিতা পুত্রকে – ২৫
২৬. পিতা পুত্রকে – ২৬
২৭. পিতা পুত্রকে – ২৭
২৮. পিতা পুত্রকে – ২৮
২৯. পিতা পুত্রকে – ২৯
৩০. পিতা পুত্রকে – ৩০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন