আপিলা-চাপিলা – ২৭

অশোক মিত্র

সাতাশ

এক হিশেবে পরিকল্পনা দপ্তর হাতে থাকায় সুবিধা হলো। মস্ত কাজ সত্যব্রতবাবু, যোজনা পরিষদের মধ্যবর্তিতায়, আমাদের কারও-কারও ক্ষীণ সাহায্য নিয়ে, যা সম্পন্ন করেছিলেন তা পশ্চিম বাংলার পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ পরিকাঠামোর সম্পূর্ণ বিন্যাস রচনা! কোথাও ঠেকে গেলে আমরা বিনয়দার কাছে উপদেশ গ্রহণের জন্য যেতাম, কখনও বা কথা হতো প্রমোদবাবু অথবা বিনয় কোঙারের সঙ্গে, কিন্তু গ্রামীণ উন্নয়নের সামগ্রিক ছক, পঞ্চায়েত-ভিত্তিক বিকেন্দ্রিক ব্যবস্থাতে মিশিয়ে দেওয়া, অনেকটাই সত্যব্রতবাবুর চিন্তা-ভাবনার ফসল। গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের মধ্যে কর্তব্য বিভাজন, প্রতি স্তরে পদাধিকারীদের মধ্যে দায়িত্বের বণ্টন, কোন স্তরে কোন ধরনের উপদেষ্টা বা সাহায্যকারীকে যুক্ত করা উচিত, হিশেব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কৃত্যের সূচী, পঞ্চায়েত কর্মীদের শিক্ষা ও অনুশীলনের নির্ঘণ্ট, পঞ্চায়েতসমূহের উপর উন্নয়নমূলক ক্রিয়াকর্মের প্রধান দায়িত্ব অর্পণ করা হলে মহাকরণে বিভাগীয় মন্ত্রীদের কতটা অসন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা, জেলায়-জেলায় বিধায়করাও নিজেদের হঠাৎ কর্মসংস্থানহীন মনে করবেন কিনা, এ ধরনের বিভিন্ন সমস্যা এবং কীভাবে তাদের নিরসন সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন, তারপর উত্তর জোগানো। সমান জরুরি অন্য কিছু সমস্যা: প্রতিটি স্তরে সরকারি আমলাদের দিয়ে কাজ করাতে হবে, তাঁদের উপরওলা হবেন রাজনীতি জগতের মানুষজন, যাঁরা লেখাপড়ায় ততটা হয়তো দড় নন, পোশাকে-আশাকেও অত্যন্ত শাদামাটা। তেমন রাজনৈতিক মানুষদের সঙ্গে রাজপুরুষেরা মানিয়ে চলতে পারবেন কিনা, নাকি প্রথম থেকেই সংঘাত দেখা দেবে, কী উপায়ে সে সব জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে আমাদের নিত্য নতুন তর্ক, আলোচনা, আলোচনার পর আলোচনা করে মুশকিল আসানের হদিশ। আমাদের সমাজে যে ধরনের প্রথাগত ইতিহাস লেখা হয়, তাতে, আমি নিশ্চিত, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ইতিবৃত্তে সত্যব্রত সেনের নাম-গন্ধও থাকবে না, কোনও হামবড়া আমলা বেশির ভাগ জায়গা দখল করে থাকবেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তো ইতিহাস ভুল-ভ্রান্তি-অসত্যে ঠাসা।

প্রশ্ন উঠলো, আমরা কি কংগ্রেস-প্রবর্তিত পুরননা পঞ্চায়েত আইন পাল্‌টে নানা গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী ঢুকিয়ে তার পর পরিকল্পিত কর্মসূচি রূপায়ণে উদ্যোগ নেবো? যদিও কংগ্রেস আমলে বিধানসভায় পঞ্চায়েত-সংক্রান্ত একটি আইন গৃহীত হয়েছিল, যেমন গৃহীত হয়েছিল ভূমিসংস্কার-সংক্রান্ত আইনও, কার্যত উভয় ক্ষেত্রেই কাজের কাজ কিছু হয়নি, খাস জমি দখলের কাজ যেমন পিছিয়ে ছিল, উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিলোনোর কাজও মুলতুবি ছিল, কর্ষিত জমিতে ভাগচাষীদের আইনি দখল দেওয়ার কর্তব্যও পালন করা হয়নি। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও অবস্থা সমান শোচনীয়। দেশের শ্রেণীচরিত্রের ছায়া: গোটা পশ্চিম বাংলায় পঞ্চায়েতের মধ্যবর্তিতায় বছরে মাত্র দু’-তিন কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ হতো, বিভিন্ন স্তরে পঞ্চায়েতের দায়িত্বে থাকতেন সরকার-মনোনীত কিছু পেটোয়া মানুষ, জমিদার-জোতদার-মহাজন প্রভৃতি শ্রেণীভুক্ত। অথচ ইতিমধ্যে-বিধানসভায়-মঞ্জুর-হওয়া আইনের ভিত্তিতেই আরও অনেক কিছু করা যেত, কংগ্রেসিরা করেননি। নিজেদের মধ্যে আলোচনা হলো, জ্যোতিবাবু-প্রমোদবাবুর সঙ্গে, পার্টির বিভিন্ন স্তরে, শরিক দলগুলির সঙ্গেও, সবাই একমত হলেন। আইন পাল্‌টাবার প্রয়াসে গোড়াতে মনোনিবেশ করলে কিছুটা ঝুঁকি থাকে, হয়তো প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাবার জন্য বিধানসভায় প্রস্তাব উঠবে, যা এড়ানো মুশকিল, অথচ যার ফেরে পড়লে এক বছর-দু’বছর, কে জানে, স্বচ্ছন্দে গড়িয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত হলো পুরনো আইনই আপাতত থাকুক, তা মেনেই ত্রিস্তর গণতান্ত্রিক নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হোক, তা-ও যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে, যা বাস্তবায়িত করতে কংগ্রেসিরা শ্ৰেণীস্বার্থহেতু সাহস পাননি।

আটাত্তর সালের জুন মাসে পঞ্চায়েত নির্বাচন হলো, গ্রামাঞ্চলে বিপুল উৎসাহ, কাতারে-কাতারে গরিব মানুষ তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ভোট দিতে এলেন। ভোটের দিনই গভীর রাত থেকে ফল বেরোতে শুরু করলো, বামফ্রন্টের একচ্ছত্র আধিপত্য ভোটের মারফত সুপ্রমাণিত। কয়েক মাসের ব্যবধানে ভূমি-সংস্কার আইন প্রণীত হলো, ভাগচাষীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আইনও। কিন্তু সংবিধানের এমন বিচিত্র লীলা, যদিও ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিষয়টি রাজ্যগুলির পুরোপুরি এখতিয়ারে, আবিষ্কার করলাম এই সংক্রান্ত আইনও কার্যকরী করতে গেলে অনুমতির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে হবে, সংবিধানের ৩১(ক) না (খ) কোনও ধারা অনুযায়ী। দিন যায়, মাস যায়, বছর যাওয়ার উপক্রম, রাষ্ট্রপতির, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের, অনুমতি আর আসে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল গোল বেধেছে প্রস্তাবিত একটি বিশেষ সংশোধনী নিয়ে। পশ্চিম বাংলায় প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল, চমৎকার ধেনো জমিতে রাতের অন্ধকারে আল কেটে খাল বা নদী থেকে জল ঢুকিয়ে দাবি করা হতো ওটা মেছো ভেড়ি, ভূমিসংস্কারের আওতায় আসে না। অন্য কায়দাও ছিল: ফসল ঘরে বা গোলায় তোলা হয়েছে, ন্যাড়া কৃষিভূমি পড়ে আছে, একটা লেবুগাছ বা আমগাছের চারা পুঁতে উচ্চকণ্ঠে দাবি উচ্চারণ, ‘ধেনো জমি কোথায় গো, এটা তো আমাদের পরিবারের বরাবরের বাগিচা, ’যেহেতু বাগ-বাগিচাও কংগ্রেসি ভূমিসংস্কার আইনের বাইরে। বামফ্রন্ট সরকার এ সমস্ত ছলচাতুরি বন্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আইনে একটি সংশোধনী ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, এখন থেকে মেছো ভেড়িই হোক আর ফুলবাগান বা ফলবাগানই হোক, সব জমিই ভূমি সংস্কার আইনের কবলে পড়বে। বিধানসভায় প্রতিপক্ষ কংগ্রেস ও জনতা দলে ভেড়িওয়ালা ও তৎসম সম্প্রদায়ের ঘোর প্রতিপত্তি, যেদিন সংশোধনীটি বিধানসভায় ভোটে গৃহীত হবার কথা, তাঁরা মস্ত শোরগোল তুলে সভা থেকে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে-সঙ্গে দিল্লিগামী ট্রেন-প্লেন ধরলেন, দেশের রাজধানীতে পৌঁছে ওখানকার মন্ত্রী-আমলাদের বোঝালেন এমনধারা সংশোধনী আইনে অনুমতি দিলে লক্ষ্মীছাড়া কমিউনিস্টদের কোনও দিনই পশ্চিম বাংলা থেকে হটানো সম্ভব হবে না। তাঁরা অবশ্যই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন।

কিছুদিন বাদে অনুরূপ আর একটি অদ্ভুত ঘটনা। প্রশান্ত শূর যুগপৎ পৌরমন্ত্রী ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী, তিনি সকলের সঙ্গে আলোচনা করে কলকাতার খাটাল সমস্যা দূর করার জন্য বিশেষ একটি প্রস্তাব রাখলেন: কলকাতার চৌহদ্দির মাইল কয়েক দূরে কিছু জায়গা বেছে নিয়ে মহানগর থেকে সমস্ত গরু-মহিষ সরিয়ে নিয়ে এ সমস্ত জায়গায় বসানো হোক, খাটালের মালিকদেরও সেই সঙ্গে স্থানান্তরিত করা হোক। তদনুযায়ী বিধানসভায় আইন গৃহীত হলো, যথানিয়মে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো অনুমতির জন্য। পুরনো কাহিনীর পুনরাবৃত্তি, দিল্লির পূর্ণিমা-নিশীথিনীসম নীরবতা। বছর দুয়েক কেটে যাওয়ার পর অবশেষে দিল্লি থেকে সারগর্ভ চিঠি এলো, সংবিধানের ৩০৩ না কোন ধারা অনুযায়ী দেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য কোনও অঞ্চলে বাণিজ্যিক যাতায়াতে বাধাদান অবৈধ, আমরা যে আইন প্রয়োগ করতে চাইছি তাতে গরু-মহিষের অবাধ ও স্বাধীন বিচরণের অধিকার লঙ্ঘিত হবে, অতএব রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া সম্ভব নয়। কে অস্বীকার করবেন, এ ধরনের বালখিল্য অজুহাত উপস্থাপনের একমাত্র লক্ষ্য যেনতেনপ্রকারে বামফ্রন্ট সরকারের কর্মসূচি যত্রতত্র আটকে দেওয়া।

শত বিঘ্ন সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলে মস্ত পরিবর্তনের উদ্যোগ সফল হলো, ঝগড়াঝাঁটি করে ভূমিসংস্কার আইন পালটানো হলো, বাড়তি জমি খাস করবার বন্দোবস্ত হলো, সেই জমি যথাসত্বর বিলনোও হলো। পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে বহু ছোটো-মাঝারি সেচের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো, যেমন হলো সর্বস্তরে রাস্তাঘাট তৈরির উদ্যোগ, জল নিকাশি ব্যবস্থা প্রণয়ন। উন্নত বীজশস্য, সার, কীটনাশক ওষুধসমেত নানা সরঞ্জাম বড়-মাঝারি-ছোটো কৃষক পেতে শুরু করলেন; উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ টাকা প্রতি বছর একটু-একটু করে বাড়িয়ে গ্রামে-গ্রামে পৌঁছে দেওয়া শুরু হলো। গত কুড়ি বছরে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের প্রসারও যথেষ্ট ঘটেছে, তবে এখনও অনেক জায়গায় ঘাটতি, যথাযথ বিতরণব্যবস্থার অভাবে; উৎপাদনক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বহু জায়গায় বিদ্যুৎ পৌঁছুনো যাচ্ছে না।

কয়েক বছরের মধ্যেই সুফল টের পাওয়া গেল, গ্রামে-গ্রামে উন্নতির ছোঁয়া। গ্রামাঞ্চলে উন্নতি যে ঘটছে তার একটি প্রামাণিক সংজ্ঞা প্রমোদ দাশগুপ্ত বলতেন; আগে দরিদ্র কৃষকের ঘরে এক কিলো-দু’কিলো চালও সঞ্চিত থাকতো না, খরার মুহূর্ত এলেই সমগ্র পরিবার নিরন্ন অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়তো। বামফ্রন্টের প্রথম পাঁচ বছরেই অবস্থার গুণগত পরিবর্তন, প্রায় প্রতিটি গ্রামে দরিদ্রতম সংসারেও পাঁচ-ছয় কিলো চাল মজুত, সুতরাং খরার ঋতুতেও, যতদিন সরকারি সাহায্য এসে না পৌঁছুচ্ছে, তাঁদের ঠিক না খেয়ে আর থাকতে হচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলে অবস্থা ফেরার অন্য একটি নিরিখও উল্লেখ করতে পারি। সাতের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাজ্যে অন্নাভাব দেখা দিলে কাতারে-কাতারে গ্রামের মানুষ কলকাতায় এসে জড়ো হতেন, খোলা আকাশের নিচে, উদ্‌ভ্রান্ত, খাদ্যের সন্ধান করতেন ইতস্তত ঘুরে-ঘুরে। বামফ্রন্ট সরকার হাল ধরার পর এই প্রবণতা বন্ধ হয়েছে, চরম খারার সময়েও গ্রামে অন্নের সংস্থান থাকছে, কলকাতায় ছুটে যাওয়ার আর প্রয়োজন পড়ে না। এমন নয় যে কলকাতায় অভাবী মানুষের ভিড় এখন বাড়ছে না। বাড়ছে, তবে এই মানুষগুলি আসছেন বিহার থেকে, ওড়িশা থেকে, উত্তর প্রদেশ ও অন্ধ্র প্রদেশ থেকে, এমন কি অসম ও নেপাল থেকেও। আদমসুমারিতে কলকাতার জনসংখ্যায় অবাঙালিদের অনুপাত ক্রমবৃদ্ধির এটাই অন্যতম কারণ।

অন্য সমস্যাও আছে। গত দুই দশক জুড়ে কলকাতায় ও মফস্বল শহরগুলিতে পৌর উন্নয়নের কাজ অবশ্য প্রচুর হয়েছে: বাইরে থেকে যাঁরা আসেন, তাঁদের অভিমত কলকাতার রাস্তাঘাট অনেক পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে, আবর্জনা কম, বিদ্যুৎ সমস্যা তো প্রায় অবলুপ্ত। বস্তিতে-বস্তিতে অনেক সংস্কার হয়েছে, জল সরবরাহ থেকে শুরু করে দেয়াল-মেঝে-ছাদ মেরামত, পয়ঃপ্রণালী নির্মাণ থেকে শুরু করে অন্যান্য উন্নত পরিষেবা ব্যবস্থা। এখানেই জটিলতার সৃষ্টি। পৌর অবস্থার সামান্য উন্নতি ঘটলেই, পরিবেশের চেহারা খানিকটা ভালোর দিকে এগোলেই, সঙ্গে-সঙ্গে যে এলাকায় উন্নতির বহর কম, সেখান থেকে লোকজন ছুটে এসে অপেক্ষাকৃত উন্নত অঞ্চলে ভিড় করে, সুতরাং উন্নতি টিকিয়ে রাখা দুষ্কর। দেশ জুড়ে যেহেতু আকীর্ণ বেকার সমস্যা, এবং বাংলার বাইরে থেকে লোকজন আগমনের হার অব্যাহত থাকছে, এই আধাখ্যাঁচড়া পরিস্থিতি না মেনে উপায় নেই।

গোটা ভারতবর্ষেই কর্মসংস্থান কেন্দ্রে নাম-লেখানো মানুষের হার বর্ধমান, পশ্চিম বাংলায় বৃদ্ধির হার তার সঙ্গে সমতা রেখে, তবু রূঢ় সত্য তো এড়ানো যায় না: যতদিন শিল্পোন্নয়নের নিস্তেজ ধারাকে শুধু এই রাজ্যে নয়, গোটা দেশে ফের স্রোতবতী করা না যাচ্ছে, নাগরিক সমস্যা বাড়তে বাধ্য, গ্রামের চেহারা পাল্‌টালেও মূল সমস্যার তেমন হেরফের হবে না। যা যোগ করতে হয়, শিল্পে প্রসার ঘটলে কারখানায়-কারখানায় শ্রমিকের চাহিদাও বাড়বে, যা মেটাতে গ্রাম থেকে মানুষ শহরে যাত্রা করবেন, শহরে কাজ পাবেন তাঁরা, পাশাপাশি গ্রামে কৃষিকর্মে ও ক্ষুদ্র শিল্পে নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষের অনুপাত কমবে, মানুষগুলির জীবিকার মানও ঊর্ধ্বগতি হবে।

রাজ্যের সার্বিক সমস্যা সমাধানের সূত্র বামফ্রন্ট সরকার সাতের দশকের উপান্ত থেকে হাতড়ে-হাতড়ে বেড়াচ্ছে। সূত্রগুলি যে পুরোপুরি মিলছে না, তার প্রধান কারণ অবশ্যই অর্থসামর্থ্যের অভাব। বিশেষ করে সংগঠিত শিল্পের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। ষাটের দশকের গোড়া থেকে বামফ্রন্ট সরকারের মহাকরণে প্রবেশ করার সময় পর্যন্ত, বেসরকারি পুঁজি একটু-একটু করে রাজ্য থেকে সরে গেছে। হেতু অনেক। কিছু-কিছু পুঁজিপতি রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে বহু দিন থেকেই ভাবিত ছিলেন। কংগ্রেস আমলে বিদ্যুতের হাল ফেরাবার কোনও তন্নিষ্ঠ চেষ্টা হয়নি, রাস্তাঘাট বেহাল, শরণার্থীদের প্রতি কেন্দ্রের চরম অন্যমনস্কতা, সব মিলিয়ে অবস্থা আদৌ পাল্‌টাচ্ছিল না বলে সেই পর্ব থেকেই বাঙালিদের মানসিকতায় ক্রমবর্ধমান নাস্তিকতা: এ সব কিছুই নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিক। তবে সমান প্রাসঙ্গিক কেন্দ্রীয় সরকারের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিও।

বেসরকারি মালিকরা যখন অপস্রিয়মাণ, শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াবার তিনটি বিকল্প উপায়: (ক) রাজ্য সরকারের তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ করা। যে সরকারের ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না, তার পক্ষে সেরকম ব্যবস্থা নেওয়া আদৌ সম্ভব নয়; (খ) কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট থেকে রাজ্যে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ। দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা পর্বের পর স্মৃতি ঢুঁড়েও পশ্চিম বাংলায় তেমন-কোনও কেন্দ্রীয় বিনিয়োগের উল্লেখ সম্ভব নয়; এবং (গ) বিভিন্ন কেন্দ্র-নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান— যেমন জীবন বীমা নিগম, সাধারণ বিমা নিগম, ইউনিট ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইনান্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি—থেকে রাজ্যে বিনিয়োগের ব্যবস্থা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই এ সমস্ত সংস্থার কাছে কেন্দ্রের ফরমান পৌঁছয়: পশ্চিম বঙ্গে গড় জাতীয় আয় অন্য অনেক রাজ্যের চেয়ে বেশি, এই রাজ্যের দিকে বাড়তি নজর দেওয়ার তাই তাদের দরকার নেই, তারা অন্যত্র ঝুঁকুক। পঞ্চাশ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলি গুজরাটে-মহারাষ্ট্রে কর্ণাটকে-তামিলনাড়ুতে-পঞ্জাবে-হরিয়ানায় অঢেল টাকা ঢেলেছে, পশ্চিম বাংলার ভাগ্যে শিকেটি ছেঁড়েনি। আমরা সাতাত্তর সালে রাজ্য প্রশাসনে ঢুকে ঈষৎ বিদ্রুপ করে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রককে বলতে শুরু করলাম, আপনাদের উদ্দেশ্য তো সাধিত হয়েছে, পশ্চিম বাংলায় আমরা গরিব হয়ে গেছি, এবার আমাদের এখানে আপনাদের আর্থিক সংস্থাগুলিকে একটু টাকা ঢালতে বলুন না কেন, মহাভারত কী আর এমন অশুদ্ধ হবে!

একাধিক আরও সমস্যার কথা বলা সমান জরুরি। স্বাধীনতা-উত্তর কালে সংগঠিত শিল্পে যে কারও পক্ষে যে কোনও নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্‌অনুমতির প্রয়োজন ছিল। অভিজ্ঞতায় ধরা পড়লো, পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে সেই অনুমতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। লিখিত-পড়িত কোনও অনুশাসন ছিল না, কিন্তু ভারত সরকারের শিল্প মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিরা লাইসেন্স প্রার্থী শিল্পপতিদের ঠারে-ঠোরে জানিয়ে দিতেন, দেশের অন্য যে-কোনও রাজ্যে শিল্প-স্থাপনের জন্য আবেদন করলে তা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হবে, পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে নৈব নৈব চ। সিদ্ধান্তটি প্রধানত রাজনীতিগত কারণেই, কমিউনিস্টরা পশ্চিম বাংলায় চড়ে বসেছে, ওদের শিল্পবিস্তারে সাহায্য করলে কংগ্রেস দলের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা। কংগ্রেস মন্ত্রীরা পর্যন্ত এই অভিযোগ সহজে অস্বীকার করতে পারতেন না।

দ্বিতীয় সমস্যাটি শুধু পশ্চিম বঙ্গ নয়, গোটা পূর্ব ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী একটি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত। ১৯৫৬ সাল, টি. টি. কৃষ্ণমাচারী কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, তিনি নিজেও তামিলনাড়ুতে বড়ো গোছর শিল্পপতি, হিশেব কষলেন, শিল্পক্ষেত্রে পূর্ব ভারতের আপেক্ষিক অগ্রগতি রোধ করতে হলে, সেই সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলে শিল্পের প্রসার ঘটাতে গেলে, নিয়মনীতির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ কৌশল খাটাবার সমূহ প্রয়োজন। বাংলা-বিহার অঞ্চলে খনিজ পদার্থের প্রাচুর্য, লোহা আছে, কয়লাও আছে, উভয় খনিজ উত্তোলন করে কয়লা দিয়ে লোহা গালিয়ে শস্তায় ইস্পাত তৈরি সম্ভব, সেই ইস্পাত পিটিয়ে কলকব্জা-যন্ত্রপাতি তৈরি করাও, যার প্রসাদে পূর্ব ভারত জুড়ে, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায়, ব্যাপক এঞ্জিনিয়ারিং শিল্প একদা গড়ে উঠেছিল, যার নির্ভরে, ইংরেজ আমলে, এবং স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক বছর, এই রাজ্যে শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সম্ভব হয়েছে, অন্যান্য অঞ্চল তুলনায় ধুঁকেছে। টি. টি. কে. মাথা খাটিয়ে কৌশল উদ্ভাবন করলেন, সারা দেশে লোহা ও ইস্পাতের পরিবহন মাশুলের হার সমান করে দেওয়া হলো, যার ফলে সারা দেশে লোহা ও ইস্পাতের দাম এক হয়ে গেল। কয়লার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাটি হলো আরও মজাদার: যত বেশি দূর কয়লা বহন করে নিয়ে যাওয়া হবে, মাইল প্রতি পরিবহন মাশুল তত কম পড়বে। অর্থাৎ রানীগঞ্জ থেকে দুর্গাপুরে কয়লা টন প্রতি যে দামে বিকোবে, ত্রিচিনাপল্লীতে বা পুনেতে বা জলন্ধরে তার চেয়ে কম দামে। কেন্দ্রের এই মারাত্মক সিদ্ধান্তের পরিণামে নিছক এঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের ক্ষেত্রেই নয়, সব শিল্পের ক্ষেত্রেই, পশ্চিম বাংলা খরচ-খরচার ব্যাপারে যে-আপেক্ষিক সুবিধা ভোগ করে আসছিল, তা চকিতে উবে গেল।

অথচ বিধানচন্দ্র রায় তখন পশ্চিম বাংলার হাল ধরে আছেন, নতুন দিল্লিতে সবাই, জওহরলাল নেহরুসুদ্ধু, তাঁকে প্রচুর সমীহ করেন, তিনি তেড়ে-ফুঁড়ে প্রতিবাদ জানালে গণেশ এমনভাবে উল্টে দেওয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু টি. টি. কে. প্রখ্যাত কুম্ভকোণম্‌ গ্রামের ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন আয়েঙ্গার গোষ্ঠীভূক্ত ব্রাহ্মণ, বিধানবাবুকে ল্যাজে খেলালেন: ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার রাজ্যের স্বার্থে কেন্দ্রের টাকায় আমরা দুর্গাপুরে মস্ত শিল্পাঞ্চল গড়ে দিচ্ছি, একটা ঝা-চকচকে নতুন ইস্পাত কারখানা পর্যন্ত। পশ্চিম বাংলার ভবিষ্যৎ অগ্রগতি নিয়ে আপনি তাই নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারেন।’ বাংলার রূপকার হিশেবে বিধানচন্দ্র রায়ের রাজ্যে খ্যাতি, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় গদগদ বিনত ভাব অনেকের মানসে এখনও অটুট। কিন্তু না বলে পারছি না, পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে বিধানবাবু প্রায়-স্থবিরত্বে পৌঁছে গিয়েছিলেন, তাঁকে যা বোঝানো হতো, তাই-ই নিরুত্তর মেনে নিতেন! মুম্বাই শহরে শচীন চৌধুরী, সর্ব ঋতুতে অর্থাভাবগ্রস্ত, টটরমটর করে কোনওক্রমে সপ্তাহে-সপ্তাহে ইকনমিক উইকলি বের করছেন, মাশুল সমীকরণ নীতির ফলে পশ্চিম বাংলার যে ভয়ংকর সর্বনাশ হবে, তা ভেবে তিনি অস্থির-উদ্বিগ্ন। নিজের পয়সায় টিকিট কেটে কলকাতায় চলে এলেন, বিধানবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন, অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, এখনও সময় আছে, উনি যদি রাগে ফেটে পড়ে প্রধান মন্ত্রীকে বলেন, এই নীতি কিছুতেই প্রয়োগ করতে দেবেন না, তাতে পূর্ব ভারতের ভবিষ্যৎ ঘোর তমসাচ্ছন্ন হতে বাধ্য, প্রধান মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ভয় পেয়ে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবেন। কে শোনে কার কথা। বিধানবাবুর একই বচন বারবার করে উচ্চারণ: ‘ওরা আমাকে দুর্গাপুর দিচ্ছে, আমি এখানে আমার মতো করে ইন্ডাস্ট্রি গড়বো। ওরা দিল্লিতে বসে যা খুশি করুক গে।’ মাশুল সমীকরণ নীতির সঙ্গে পূর্ব ভারতে শিল্প প্রসারের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নিয়ে বিধানবাবুকে কিছুতেই বোঝানো গেল না, শচীনদা ব্যর্থমনোরথ হয়ে মুম্বাই ফিরলেন, ভগ্নদূত তিনি, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে তাঁর পত্রিকায় প্রতিবাদী সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখে চললেন।

এমনকি বামপন্থী আন্দোলনেও মাশুল সমীকরণ নীতি সম্পর্কে সে সময় খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ততা ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি সর্বভারতীয় দল, সারা দেশের স্বার্থ তাকে দেখতে হবে। টি. টি. কে. যা বলছেন, তা থেকে, পূর্ব ভারতের সামান্য ক্ষতি সত্ত্বেও, যদি অন্য সর্বত্র শিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটে, তা হলে মেনে নিলেই তো হয়, খুব বেশি চেঁচামেচি না করে। মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি, রাজ্যের কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে একমাত্র নীরেন ঘোষ সমস্যাটির গভীরে একেবারে গোড়া থেকেই প্রবেশ করতে পেরেছিলেন, অন্যান্য নেতাদের ভ্রূকুটি-নিষেধ উপেক্ষা করে।

সাতাত্তর সালে আমরা যখন মহাকরণে পৌঁছুলাম, পশ্চিম বাংলার সর্বনাশ আর শঙ্কাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের ব্যাপার নয়। পূর্ববর্তী বছরগুলিতে যে বিশিল্পায়নের অধ্যায় সূচিত হয়ে গেছে, প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাতেই তা প্রকট। জ্যোতিবাবুও বুঝেছেন, এখন সর্ব শক্তি দিয়ে কেন্দ্রীয় নীতিসমূহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, শুধু মাশুল সমীকরণ নীতি বিলোপ নিয়েই নয়, কেন্দ্র-রাজ্যে আর্থিক ব্যবস্থার সার্বিক পুনর্বিন্যাস নিয়ে, বিদ্‌ঘুটে লাইসেন্স প্রথা রদ করার দাবি নিয়ে, দিগন্তদৃষ্টি আরও উদার করে এমনকি প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও রাজ্যের অধিকার ব্যাপ্ততর করবার লক্ষ্য নিয়ে। এটা কেন হবে, সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে কথায়-কথায় রাজ্য সরকারগুলিকে বরখাস্ত করা হবে, তাঁর জমানায় ইন্দিরা গান্ধি যেমন ষাট-সত্তরবার করেছিলেন; এটা কেন হবে, রাজ্যগুলির সম্মতি না নিয়ে কেন্দ্রের ধামা-ধরা যে-কাউকে রাজ্যে-রাজ্যে রাজ্যপাল করে পাঠানো হবে; এটা কেন হবে, এমনকি ভূমি সংস্কার আইন প্রয়োগে করার ক্ষেত্রে পর্যন্ত কেন্দ্রের সম্মতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে, কেন ভারত সরকার নোট ছাপাতে পারবে, রাজ্য সরকারগুলি পারবে না; বাজারে ঋণপত্র ছেড়ে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, কেন তার নয়-দশমাংশেরও বেশি কেন্দ্রীয় সরকার স্রেফ নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করবে, রাজ্যগুলি বসে-বসে বুড়ো আঙুল চুষবে! জ্যোতিবাবুর কাছে কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই, আমাকে তিনি যথেচ্ছ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, আমার মতো করে খসড়া তৈরি করে তাঁকে দিয়ে সই করিয়ে দিল্লিতে পাঠাতাম, কখনও-কখনও নিজেই সই করে পাঠাতাম, মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে বা জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে জ্যোতিবাবুকে দিয়ে কড়া-কড়া ভাষণ দেওয়াতাম, তিনি যে-সব বৈঠকে যেতেন না, আমি গিয়ে সরব হতাম, অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের দলে টানতে প্রয়াসবান হতাম, কলকাতায়, দিল্লি ও অন্যত্র যে কোনও ছুতোয় সাংবাদিকদের আহ্বান করে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক আশু পুনর্বিন্যাসের আত্যন্তিক আবশ্যকতা নিয়ে গলা ফাটাতাম। লোকসমক্ষে আসতে আমার সাধারণত গভীর অনভিরুচি, তবে রাজ্যগুলির স্বার্থে এ ধরনের চ্যাঁচামেচি যে প্রয়োজন তা নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, জ্যোতিবাবু-প্রমোদবাবুকে বোঝাতে পেরেছিলাম, মনে হয় পার্টির অন্যান্য নেতাদেরও। সুতরাং যা হবার তাই-ই হলো, দুই-এক বছরের মধ্যে সারা দেশে সংবাদপত্রে নিন্দা-প্রশংসা-জল্পনার খোরাক হয়ে গেলাম। সি পি আই-এর অন্যতম প্রধান নেতা, কিছুদিন কেরল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, লোকসভাতেও ছিলেন, বাসুদেবণ্‌ নায়ার, বেশ কয়েক বছর বাদে একদিন তিরুবনন্তপুরমে দেখা, হেসে বললেন: তোমার ভয়ে ঐ ক’বছর কেন্দ্রীয় সরকার কাঁপতো।’

কথাটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়, ১৯৭৭-৭৯ সালে যিনি প্রধান মন্ত্রী ছিলেন, মোরারজী দেশাই, তিনি অন্তত কম্পমান হতেন না। মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে তাঁর ঘ্যানঘেনে লম্বা বক্তৃতায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে যখন কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ে বা আমাদের অন্যান্য সমস্যার উল্লেখ করতাম, বৃদ্ধ প্রধান মন্ত্রী বিরক্তি প্রকাশ করতেন, বকুনি দিয়ে আমাকে থামাতে চাইতেন, আমি বেপরোয়া, আমার পাশ থেকে ওঁরই দলভুক্ত বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুর চোখ টিপে আমাকে উৎসাহ দিতেন, যেন চালিয়ে যাই, আমার কথা যে তাঁরই মনের কথা। মোরারজী দেশাই একগুঁয়ে মানুষ ছিলেন, প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ ছিলেন, ছিটগ্রস্ত মানুষ ছিলেন, তা হলেও আমার ধারণা হয়তো পুরোপুরি খারাপ মানুষ ছিলেন না, ঝগড়া করতে-করতেই এক ধরনের সম্প্রীতি গজিয়ে গেল ওঁর সঙ্গে। একটি নজির দিই। মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলন দিল্লির বিজ্ঞানভবনে শুরু হবে, জ্যোতিবাবু যাননি, আমি তাঁর প্রতিনিধিত্ব করছি সকাল দশটা কি সাড়ে দশটায় আমরা বাইরে জড়ো হয়েছি সভাকক্ষে ঢোকবার জন্য, প্রধান মন্ত্রী আমাকে দেখে লাঠি উঁচিয়ে কপট বিরক্তিতে বাক্যবাণ ছুঁড়লেন: ‘তোমরা আমার কাছ থেকে একটা কানাকড়িও পাবে না।’ আমার ঠ্যাটা প্রশ্ন: ‘তাহলে আমাদের এখানে ডেকেছেন কেন?’ মুহূর্তের মধ্যে মোরারজী দেশাইর শাণিত প্রত্যুত্তর: ‘ডেকেছি এটা জানাতে যে আমার কাছ থেকে কানাকডিও পাবে না।’ অনেকবার জ্যোতিবাবুর সঙ্গে অথবা একা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে ওঁর দফতরে বা বাড়িতে গিয়েছি, প্রথম দিকে অধৈর্যপনার ইঙ্গিত দিলেও, দমে না গিয়ে তর্ক চালিয়ে গেলে, উনি শুনতেন, খানিক বাদে ঠাণ্ডাও হয়ে আসতেন। তবে বাই-ওলা মানুষ, একবার জ্যোতিবাবু আর আমি গঙ্গার নাব্যতা নিয়ে কথা বলতে গেছি, একটা-দুটো বাড়তি ড্রেজারের জন্য অনুরোধ জানিয়েছি, হলদিয়া বন্দরের উন্নতি বিধানের জন্য একাধিক অনুরোধ জ্ঞাপন করছি, পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি ওসব প্রসঙ্গ নিয়ে আমাদের এগোতে দিলেন না: ‘তোমাদের কমিউনিস্টদের নিয়ে আর পারা গেল না। এই তো গুজরাট-মহারাষ্ট্র অঞ্চলে আমার মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় মদ্যপানের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা চালু হয়েছিল, তার ফলে ওই অঞ্চলের এত অগ্রগতি, মানুষেরা কত ভালো আছে, কিন্তু পশ্চিম বাংলায় এ ব্যাপারে কোনও আগ্রহই নেই তোমাদের। অথচ এই তো বুলগানিন আর কোসিগিন এখানে এসেছিলেন, তাঁরা তো তোমাদের চেয়ে ঢের বড়ো কমিউনিস্ট, তাঁদের দেশে সবাই মদে চুর হয়ে থাকে, আমি তাঁদের দু’ঘণ্টা ধরে বোঝালাম, মদ বন্ধ না করলে তাঁদের গতি নেই। সোভিয়েট নেতারা মুগ্ধ হয়ে আমার কথা শুনলেন, আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত জানিয়ে বিদায় নিলেন।’ সৌজন্যবশত না জ্যোতিবাবু, না আমি, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম না, সোভিয়েট নেতৃদ্বয় মস্কোয় ফিরে গিয়ে তাঁকে কি জানিয়েছিলেন, মদ্যপান ওদেশে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন কিনা, কতটা বহাল তবিয়তে তাঁদের অতঃপর জীবনযাপন-জীবনধারণ চলছে।

সকল অধ্যায়

১. আপিলা-চাপিলা – ১
২. আপিলা-চাপিলা – ২
৩. আপিলা-চাপিলা – ৩
৪. আপিলা-চাপিলা – ৪
৫. আপিলা-চাপিলা – ৫
৬. আপিলা-চাপিলা – ৬
৭. আপিলা-চাপিলা – ৭
৮. আপিলা-চাপিলা – ৮
৯. আপিলা-চাপিলা – ৯
১০. আপিলা-চাপিলা – ১০
১১. আপিলা-চাপিলা – ১১
১২. আপিলা-চাপিলা – ১২
১৩. আপিলা-চাপিলা – ১৩
১৪. আপিলা-চাপিলা – ১৪
১৫. আপিলা-চাপিলা – ১৫
১৬. আপিলা-চাপিলা – ১৬
১৭. আপিলা-চাপিলা – ১৭
১৮. আপিলা-চাপিলা – ১৮
১৯. আপিলা-চাপিলা – ১৯
২০. আপিলা-চাপিলা – ২০
২১. আপিলা-চাপিলা – ২১
২২. আপিলা-চাপিলা – ২২
২৩. আপিলা-চাপিলা – ২৩
২৪. আপিলা-চাপিলা – ২৪
২৫. আপিলা-চাপিলা – ২৫
২৬. আপিলা-চাপিলা – ২৬
২৭. আপিলা-চাপিলা – ২৭
২৮. আপিলা-চাপিলা – ২৮
২৯. আপিলা-চাপিলা – ২৯
৩০. আপিলা-চাপিলা – ৩০
৩১. আপিলা-চাপিলা – ৩১
৩২. আপিলা-চাপিলা – ৩২
৩৩. আপিলা-চাপিলা – ৩৩
৩৪. আপিলা-চাপিলা – ৩৪
৩৫. আপিলা-চাপিলা – ৩৫
৩৬. আপিলা-চাপিলা – ৩৬
৩৭. আপিলা-চাপিলা – ৩৭
৩৮. আপিলা-চাপিলা – ৩৮
৩৯. আপিলা-চাপিলা – ৩৯
৪০. আপিলা-চাপিলা – ৪০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন