আপিলা-চাপিলা – ৪০

অশোক মিত্র

চল্লিশ

আপিলা-ঢাপিলা ঘন-ঘন কাশি। নিজেরই ঝেড়ে কাশতে ইচ্ছা করছে। চারদিকে বিরক্তিসূচক প্রশ্ন, এই ঘ্যানঘেনে পাঁচালী আর কত দিন টানা হবে। কেউই খুশি নন। যাঁরা চেয়েছিলেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মকথন, তাঁরা হতাশ, লোকটা বাবা-মার কথা, আত্মীয়-স্বজনের কথা, ঘরবাড়ির কথা, প্রায় কিছুই জানালো না। যাঁরা একটি বিশেষ কালের বিশ্লেষণাত্মক রাজনৈতিক বৃত্তান্ত চেয়েছিলেন, তাঁরা সাহিত্যপ্রসঙ্গের নিরন্তর অনুপ্রবেশে তথা লেখকের ইতস্তত লঘুতাবিহারে বীতরাগ চেপে রাখতে পারছেন না। আর কাব্য-সাহিত্যের যাঁরা বারোমেসে ভক্ত, দেশ-সমাজ-নচ্ছার রাজনীতিকলার সাতকাহনে তাঁরা অবসন্ন।

জীবনের উপান্তে পৌঁছে প্রগল্‌ভতা যদিও বাঞ্ছনীয় নয়, অসাধুতাও কিন্তু নয়। বাঙালি মধ্যবিত্তের চরিত্র জুড়ে গুরুচণ্ডালী মিশ্রণ, চরিত্রহীনতাই তার স্বভাবের প্রধান লক্ষণ। আমার মাঝে-মাঝে কবিতা বা কবিকাহিনীতে অথবা বান্ধবস্মৃতিমেদুরতায় ডুবে না গিয়ে উপায় নেই। অথচ সমাজের মূল সমস্যাগুলি নিয়ে ভাবনায় অচিরে প্রত্যাবর্তনও সমান স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে, ঘটে-যাওয়া নানা কাহিনীর অক্ষৌহিণী বাহিনীকে অবজ্ঞা তো মস্ত ব্যাকরণবহির্ভুত ব্যাপার। অতএব কখনও কখনও ভুলে যাওয়া, খানিক বাদে ফিরে আসা, ফের ভোলা, ফের ফেরা, আপিলা-চাপিলারা ধরা দেয়, অথচ দেয়ও না।

তা ছাড়া, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিনাতিক্রম, এখন কবুল করতেই হয়, নিজেরও প্রিয়ভাজন আমি নই, অন্যদের তো নই-ই। হঠাৎ কাহিনীটি মনে পড়লো। আটাত্তর সাল, নয় তো তার পরের বছর। উত্তর বঙ্গের এক শহরে কার্যব্যপদেশে গিয়েছি। সন্ধ্যাবেলা হাতে যেহেতু কিছু ফাঁকা সময়, এক পিসতুতো দিদির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দিদির এক ছেলে সদ্যপরিণীত, নববধূটি কিছুতেই বাইরের ঘরে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করবে না। অনেক সাধ্যসাধনার পর এলো, ভয়চকিতা হরিণীসমা, বাচ্চা মেয়ে, বালিকাবধূই বলা চলে। একটু-একটু করে তার জড়তা কাটলো। ঘণ্টা দুই বাদে যখন বিদায় নিচ্ছি, তার সরলতম কবুলতি; ‘কেন প্রথমটা আপনার সামনে আসতে ভয় পাচ্ছিলাম জানেন? আমাদের চন্দননগরের বাড়িতে আমরা তো ওই পাঁচলাখি কাগজটা পড়ি, ভেবেছিলাম আপনি খুব খারাপ লোক।’

সংবাদপত্রটির উপর ক্ষোভ পুষে কী লাভ, সত্যিই তো আমার স্বভাবে অনেক উচ্চাবচতা, মেজাজ কখনও সপ্তমে চড়ছে, কখনও বরফকুচির মতো শীতল হচ্ছে; বচনে কর্কশতা, ঔদার্যের ছোঁয়া যদিই বা কখনও লাগে, তা আকমিক অঘটন। ব্যবহারিক জীবনে সর্ব ঋতুতে একে-ওকে-তাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার দিকে আমার ঝোঁক, কাছে টানার আগ্রহ আদৌ নেই। মানুষটা উচ্চস্বরে কলহপরায়ণ হতে ভালোবাসে, গলা চুলকে ঝগড়া করে পর্যন্ত। যেখানে ঠেস দিয়ে কথা না বললেও চলে, সে অবধারিত ঠেস দেবেই। এমন মানুষের আখেরে তাই নিঃসঙ্গতাই একমাত্র অবলম্বন: ক্রান্তির লগ্ন সমাগত হলে সে যন্ত্রণায় দগ্ধ হবে, কেউ তাকে বাঁচাতে আসবে না। এই উপসংহারসম্ভাবনাকে অনেকেই হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাবেন, সে নিজেও হয়তো জানাবে।

‘অথচ মানষটা জ্ঞানপাপীও। সে তার বাঙালি মধ্যবিত্ত জাতককাহিনী ভুলতে পারে না। ঐতিহ্যের অন্তঃস্থিত স্ববিরোধিতা তাকে অহরহ ছিঁড়ে-খুঁড়ে খায়। প্রথম সংকটমুহূর্ত থেকেই সে জেনেছে, একা বাঁচা যায় না, সমাজের শরীরে লীন হয়ে গিয়ে বাঁচতে হয়, সমাজই বাঁচায়। এটাও তার জ্ঞানের বৃত্তের বাইরে নয়, যেহেতু সে অভিশপ্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত, একলব্যঋণ তাকে শোধ করতেই হবে। মধ্যবিত্তসুলভ স্বার্থপরতার উদ্দাম স্রোতস্বিনীপ্রবাহ যদিও তার চেতনায়-ধমনীতে, তা হলেও, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যে কথা বলেছিলেন, তার উপরই দেনা শোধবার ভার; লোকায়ত সমাজব্যবস্থার বশ্যতা স্বীকার না-করে কে কবে কোথায় পালাবে, শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের লিখন মান্য না-করা অসম্ভব। পৃথিবীর ইতিহাস তো নিঃস্ব জনের মুক্তির ইতিহাস, নিঃস্ব মনের বিকচনের-উন্মোচনের বৃত্তান্ত। মানুষ সামাজিক, সেই সঙ্গে সমান অসামাজিক মানুষ একা সৃষ্টি করে, জনারণ্যে মিশে গিয়েও করে; একাকী অঙ্গীকার, যুথবদ্ধ অঙ্গীকার। মানুষ যখন কবিতা রচনা করে, সে একা; যখন সামগান উচ্চারণ করে, সে সমষ্টির অন্যতম। মানুষ সরল, মানুষ কুটিল, মিথ্যাবাদী, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত মানুষ। ‘আপিলা-চাপিলা’ এমন বিশেষ একটি ব্যক্তির এলোমেলো বহুধাবিচ্ছিন্ন জীবনচর্যার উচ্ছৃঙ্খল উপাখ্যান। এই মানুষটা নিজেকে ঘোর অপছন্দ করে, নিজের গোটা জীবনটাকেই করে, সেই প্রকাশ্য কবুলতির অশ্লীলতা থেকে নিজেকে সে, গোঁয়ার গোবিন্দ, বঞ্চিত করবে কোন ছুতোয়।

এক অতি সম্মাননীয় বাঙালি জ্যেষ্ঠজন জীবনসায়াহ্নে অকপট বিষণ্ণ স্বীকারোক্তি করেছিলেন, তাঁর জীবন সফল হয়নি; যে লক্ষ্য, আদর্শ ও ব্রত নিয়ে তাঁর জীবনসংগ্রামের আরম্ভ, তাদের কোনও-কিছুই সার্থকতার মুখ দেখেনি। ‘আপিলা-চাপিলা’-র বর্ণনাকারের অতটুকু ভণিতা সাজাবারও সুযোগ নেই। তার চরিত্রহীনতাকেই সে বার বার বলেছে, স্থিত ভব, স্থিতি ভব, লক্ষ্যশূন্যতাতে আবিষ্ট হও; দিনের পর দিন যত লাঞ্ছনাতেই কাটুক না কেন, কৃত অকর্মের জন্য সাফাই গাওয়ার চেষ্টা কোরো না। মানছি, সমাজ বা দেশের সমস্যাবলী থেকে উদ্ভূত চিন্তার বিবেকপীড়নে সে নিরন্তর প্রহৃত। তা হলেও সে জানে কোথাও তার পালিয়ে যাওয়ার নেই মানা, কী মনে-মনে, কী প্রকাশ্যে। সুতরাং যাঁরা হতাশ হলেন, বিরক্তিতে যাঁরা মুখ কুঞ্চন করছেন, তাঁদের কাছে একমাত্র ক্ষমা চাওয়ার পালা বাকি। তবে যে-পাপীতাপী সে জানে ক্ষমারও সে অযোগ্য, তার জন্য কেবল অপেক্ষমাণ উজ্জ্বলন্ত নরককুন্ড।

ভাবনাহীন ভাবনালীন কথা তাড়া করে ফেরে। কোন প্রলয় উপকূলে গিয়ে দাঁড়াবে ভারতবর্ষ, বাঙালিদেরই বা কী গতি হবে সেই পর্যায়ে, এই হতভাগ্য দেশে যাঁরা অনন্তকাল ধরে শোষিত-পেষিত, তাঁদের দুঃস্বপ্নের রাত্রির কি কখনও-ই অবসান ঘটবে না? যে ভারতবর্ষের প্রতীক বর্তমানের হিংসালোলুপ গুজরাট রাজ্য, আমরা কি গোবেচারা ভালোমানুষের মতো তা মেনে নেবো তথাকথিত জাতীয় ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে? কে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থাকতে হবে, স্পষ্ট করে কেন বলতে পারবো না, গান্ধিজী কল্পিত রামরাজ্যই অন্তিম পরিণাম হিশেবে ভারতবর্ষকে ধর্মান্ধতার অন্ধগলিতে পথভ্রষ্ট করেছে। গান্ধিজী ভেবেছিলেন রামরাজ্যের পৌনঃপুনিক উল্লেখ-সঞ্জাত প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গণদেবতার যুথবদ্ধ মানস ধর্মভাবে আপ্লুত হবে, সেই বিশাল বিস্তৃত ধর্মানুভূতির পবিত্র পলিমাটিতে স্বাদেশিকতার বীজ বপন করে জাত্যভিমানী দেশবাসীদের তিনি বিদেশী শাসনমুক্ত করবেন। কিন্তু জনগণ তো বহুলাংশে ন্যূনতম অক্ষরপরিচয়ের সৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত। তাঁরা গান্ধিজীর আত্মজীবনী পাঠ করেননি, ‘হরিজন’ পত্রিকার পুরনো দস্তাবেজ ঘাঁটেননি, গান্ধিজীর সর্বধর্মসমন্বিত দার্শনিকতার বাণী তাঁদের উপলব্ধির বাইরে থেকে গেছে। আটপৌরে শাদামাটা বিশ্লেষণের বিচরণভূমিতে রামরাজ্য ভাবনা থেকে তাঁরা রামরাজ্য পরিষদে অবলীলায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, সেই প্রস্থান ভূমি থেকে নির্মোহ অকরুণ নিষ্ঠুর ব্যাপক নরহত্যার লীলাক্ষেত্রে। কায়দাকানুন সহ সংবিধান রচনা করে আদৌ লাভ হয়নি, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অঙ্গীকার সংবিধানের যে-ধারায় বলা হয়েছে, তার অতি উদারচরিত ব্যাখ্যায় প্রতিটি প্রধান মন্ত্রী নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। তাঁদের পরিভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা সব ধর্ম থেকে সমান দূরত্বে রাষ্ট্রের অবস্থান নয়, সব ধর্মকে রাষ্ট্র-কর্তৃক সমান অবজ্ঞা প্রদর্শন নয়, সব ধর্মের প্রতি সমান অন্যমনস্কতা জ্ঞাপন নয়, বরঞ্চ সব ধর্মকে গলা জড়িয়ে উৎসাহ দান করা। কালচক্রে যদি দেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বীদের নিপাট আধিপত্য ঘটে, কী আর করা, উক্ত বিশেষ গোষ্ঠীই সরকারি ঝোল একটু বেশি কোলে টানবে, বেতারে-টেলিভিশনে তাদের পুরাণ কথাই বর্ণিত হবে, অন্যান্য ধর্মগুলি তো সেদিনকার ছোকরা, তাদের জাতক বা পুরাণ বলতে কিছু নেই-ই। তবে রাষ্ট্রীয় সংকটের এটা তো মাত্র সূচিমুখ। যাঁরা দেশের হাল ধরে আছেন, তাঁরা বিশ্বায়ন পছন্দ করেন, তা তাঁদের কাছে তোমার-ফুলবাগিচায়-রইবো-চাকর-আমায়-চাকর-রাখো-জী এই সমবেত সংগীত গাইবার সুযোগ মেলে দিয়েছে। যারা গোলাম হতে রাজি, তাদের গোলামত্বে বরণ করাতে ভিন্‌দেশিদের কোনও অসুবিধা নেই; গোলামরা যদি তাদের পুরাণ-ব্যাকরণের ফলিত প্রয়োগে উৎসুক হয়, তা-ও ক্ষমাঘেন্না করে নিতে সমস্যা নেই; ভিন্‌দেশিদের অসাধারণ চারিত্রিক নমনীয়তা, তাঁদের কার্যসিদ্ধি হলেই হলো, পৃথিবীর যে যেখানে যত নমুনার শ্ৰেণীস্বার্থান্ধ প্রতিক্রিয়াপন্থীরা থাকুক না কেন, তাদের জন্য ভিন্‌দেশিদের অভ্যর্থনা সমিতি সদা প্রস্তুত। ভিন্‌দেশি প্রভুরা অতীতে ইরানে খোমেইনিদের তোল্লা দিয়েছেন, আফগানিস্থানে তালিবানদের একদা তাঁরা মুখ্য পৃষ্ঠপোষক, ভারতবর্ষে ত্রিশূলওলাদের ভরসা জোগাতেও তাঁরা সমান উৎসাহী। তাঁরা ঝালে আছেন, ঝোলে আছেন, অম্বলেও আছেন; মানবসভ্যতার সর্বনাশ যে-পন্থাতেই সাধন সম্ভব, তাঁরা তার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করবেন, বখরার ভাগটুকু পেলেই তাঁরা তুষ্ট।

অন্য ভয়ঙ্কর সমস্যাও তো এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। ভিন্‌দেশিদের ফরমানে দেশে যে-অর্থব্যবস্থার বৃক্ষ রোপিত হয়েছে, লক্ষণ দেখে মনে হয়, তার শিকড় আরও গভীরে অনুপ্রবেশ করবে। প্লেটোর নন্দিত আদর্শে আর্থিক পরিকাঠামো তৈরি হবে তখন, সমস্ত সামাজিক সম্পত্তির সুযোগসুবিধা মুষ্টিমেয় একটি-দু’টি গোষ্ঠীর কুক্ষিগত হবে, সাধারণ মানুষ অসহায়তায় আঙুল চুষবেন। বিদেশী শস্যে দেশের বাজার ছেয়ে যাবে, বিদেশী শিল্পদ্রব্যেও। কারখানার পর কারখানা প্রতিদিন বন্ধ হবে, কর্মসংস্থানহীনদের ক্রমশ বিস্ফারিততর ভিড়, নবমূল্যবোধের নিরিখে মুনাফার হার ধ্রুবতারা রূপে পরিগণিত হবে: যে-যে বৃত্তিতে লাভের বহর কম, তারা বরবাদ; খুন-ডাকাতি-চুরি-রাহাজানি করে যদি বাহির ও অন্দর মহলে সোনা-মোহর-টাকাকড়ির ঝঙ্কারনিনাদ সতত শোনা যায়, সে-সব বৃত্তিতে উপনীত হওয়াই তো শ্রেয়। এই পরিস্থিতিতে বছর যতই গড়াবে, সামাজিক হাহাকার আরও পরিব্যাপ্ত হবে, দেশের বেশির ভাগ মানুষ চরম খিন্নতায় ভুগবেন।

যাঁরা ভাবছেন, গোটা দেশে সামন্ততান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা রমরমিয়ে চলুক না কেন, কোনও চিন্তা নেই, এই অঙ্গ রাজ্যে-ওই অঙ্গ রাজ্যে বড়ো লোকদের অস্ত্র দিয়েই তাদের ঘায়েল করা যাবে, তাঁরা, বলতে বুক ফেটে যায়, মতিভ্রমে আক্রান্ত। প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে নেমে আমরা যদি কেন্দ্রীয় সরকার ও অন্যান্য রাজ্য সরকারের মতো বিদেশীদের কাছে হাত কচলাই, বেসরকারি মালিক ও বাক্সওলাদের কাছে গিয়ে বলি যথা নিযুক্তোহম্মি তথা করোমি, সমবায় ভিত্তিতে কৃষি-উৎপাদন তথা উপার্জন বৃদ্ধির দুরূহ কর্তব্যের সহজ বিকল্প হিশেবে ফল-ফুল রপ্তানি মারফত গ্রামাঞ্চলে ঐশ্বর্যসঞ্চারের যতই স্বপ্ন দেখি, ভাগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা কিন্তু শূন্যই থেকে যাবে। গোটা দেশ যেখানে বিশ্বায়ন হেতু মুখ থুবড়ে পড়ছে, পশ্চিম বাংলা তারই মধ্যে আমরা-চলি-সমুখপানে-কে-আমাদের-বাঁধবে গেয়ে বুক চেতিয়ে এগিয়ে যাবে, তা অবাস্তব প্রস্তাব। বড়ো জোর খানিক-খানিক কালনেমির লঙ্কাভাগ ঘটবে, বেপথুমান ইশারায় কারও কারও পদস্খলনের পাশাপাশি, কিন্তু অন্য কোনও শাঁসালো শিকে ভাগ্যে ছিঁড়বে না। না-ঘরকা-না-ঘাটকা বঙ্গনিবাসীরা কোথায় যাবো তখন? কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতা দখল না-করতে পারলে, আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্ত নীতিনিয়মের খোল-নল্‌চে পরিবর্তন ঘটাতে না-পারলে, পশ্চিম বাংলার আদর্শ-অস্খলিত অভিযাত্রা সম্ভবপরতার পরপারে। মানছি, যদি আদর্শকে বিসর্জন দিতে সম্মত হই, তা হলে হয়তো হত লঙ্কার সামান্য একটু বাড়তি ভাগ আমাদের বরাদ্দে পড়বে; তা নিয়ে যদি খুশি থাকি, ইতিকথার তা হলে তো সেখানেই যবনিকা পতন। বাংলা ভাষাও তা হলে, ভারতবর্ষের সীমানার অন্তর্গত বর্গক্ষেত্রে, আর টিকে থাকবে না। মহাদেশের অন্যত্র যদি টেকে তাতে আমাদের কী, আমরা তো রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে যেতে চাই, সন্দেহ হয়, এড়িয়ে যেতে চাই। একবিংশ শতকীয় বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবনচর্চার যে-সম্ভাব্য নিদর্শন হালে নন্দিত হতে দেখি, তা থেকে সংশয় ক্রমশ প্রতীতিতে পৌঁছয়, চকিতে-বিজুলি-আলো-চোখেতে-লাগালো-ধাঁধার এক ভিন্ন অভিজ্ঞানে আমরা ইতিমধ্যেই উত্তীর্ণ।

সামনের দিকে তাকিয়ে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, মধ্যবিত্ত মানসিকতা সেই অন্ধকারকেই আলো বলে আলিঙ্গন করতে হাঁকুপাকু। তবে এখানেই হেঁয়ালি, এখানে ভরসাও শেষ পর্যন্ত। মানব-ইতিহাস তো শেষ পর্যন্ত গড়বেন পদাতিকবাহিনী, অগণ্য অসংখ্য সাধারণ মানুষ, যাঁরা সহস্র প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিদ্রোহের প্রকরণ ভুলে যাননি, যান না; ভুলে যাওয়াটা ইতিহাসের নিয়ম নয়। মধ্যপদলোপী শব্দরূপের মতো, মধ্যবিত্ত শ্রেণীনির্ভর সমাজচিন্তাও ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য। মধ্যবিত্তশ্রেণীভুক্তরা নিজেদের নিশ্চিহ্ণ করে দিয়েই ইতিহাসের ঋণ শোধ করতে পারেন, আমাদের এই ভূখণ্ডেও শোধ করবেন: এটা অভিশাপ নয়, প্রার্থনা।

হায়, যদি আশার ভেলায় ভেসে সমস্যার ভয়ংকর মহাসমুদ্র নিটোল শান্তিতে পেরনো যেতো! আপাতত পশ্চিম বাংলায় বামপন্থীদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলতে ধর্তব্যের মতো কেউই নেই, পঁচিশ বছর-আগে-পরমপরাক্রান্ত-অবিশ্রান্ত-গদা-ঘোরানো সংবাদপত্রসমূহের পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেওয়া অবস্থা। তা হলেও ফিরতে হয় সেই অপ্রিয় বাক্যের নিহিত ভর্ৎসনার সারমূলে: অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে।

কনিষ্ঠরা রাজ্য প্রশাসনে হাল ধরেছেন, সর্বাত্মক শুভেচ্ছার ডালি সাজিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানিয়েছি। অনুজ সম্প্রদায় আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, প্রসিদ্ধ লোকবচন, ‘কন্যাকর্তা স্বয়ং কন্যা, বরকর্তা ঘর, মদনরাজার জয় হোক ভাই, তোরা ঘরকন্না কর’, আবৃত্তি অন্তে নিঃশব্দে নেপথ্যচারী হতে আপাতত সম্ভবত তাই বাধা নেই। অথচ যা মনে হয় অনেক ক্ষেত্রেই তো তা নয়। মানছি, ঊষর-রুক্ষ-রক্তাক্ত ভারতবর্ষে পশ্চিম বাংলা এই মুহূর্তে মরূদ্যানপ্রতিম। কিন্তু যদি আমাদের সতর্কতা অব্যাহত না থাকে, এই মরূদ্যানও অতি দ্রুত মরীচিকার মতো মিলিয়ে যেতে পারে। চোখের মণির মতো ভারতবর্ষের ঐক্য ও সংহতিকে রক্ষা করতে হবে বলে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ; সারা দেশ জুড়ে জনগণের চেতনা সমোচ্ছল উন্মেষের কল্পনায় বিভোর হয়ে থাকি। কিন্তু মনকে চোখ ঠেরে কী লাভ, জাতির একটি অতুচ্ছনীয় অংশ পুরাণের অন্ধকারে ফিরতে অত্যাগ্রহী, সেই অন্ধকার থেকে বের হতে আসলে অনেকে শুরুই করেনি। সমালোচনায় মুখর হয়ে অন্ধকারপ্রেমিকদের যদি গালও পাড়ি, দেশের এই মর্মান্তিক অবস্থার জন্য বামপন্থীরা স্বয়ং কিন্তু কম দায়ী নয়। সমস্যার অন্তঃস্থলে না-ঢুকে তাঁরা সস্তায় কিস্তি মাত করতে চেয়েছেন ; যা হবার নয়, তা হয়নি, কিছুদূর গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছেন। তাঁদের ব্যর্থতা তথা সাময়িক বিবেচনাহীনতার সুযোগ গ্রহণ করেই তো প্রতিক্রিয়ার সাধকরা সর্বত্র সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসেছে। এই অভিযোগ সামান্য আতিশয্যদোষদুষ্ট তা যদি স্বীকার করেও নিই, সমস্যার তাতে নিরসন হয় না।

বরঞ্চ দ্বন্দ্বের পীড়ন আরও বেশি করে চেতনার ঘাড়ে চেপে বসে। পুরাণপ্রেমে মাতোয়ারাদের দল যতদিন দেশের দখলদারি কজা করে রাখবে, ততদিন কী করবেন বামপন্থীরা? জাতীয় সংহতি রক্ষার যূপকাষ্ঠে নিজেদের বিসর্জন দেবেন, চোখ বুজে সাম্যবাদী আদর্শের নাম জপ করবেন, পরস্পরকে বোঝাবেন, হঠকারী হওয়ার চেয়ে বড়ো পাপাচার নেই, এবং যেহেতু নেই, কবে সর্বভারতীয় রাধা নাচবে, তার জন্য অপেক্ষামগ্ন থাকাই একমাত্র পন্থা, এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন?

এই আমরাই কিন্তু কিছুদিন আগেও নিজেদের চিমটি কেটে বলেছি, সুযোগ হাতে এসেছে, আমাদের আদর্শ দিয়ে, পরিচিকীর্ষা দিয়ে, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের দৃষ্টান্ত দিয়ে গোটা ভারতবর্ষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবো, সংবিধানের সীমাবদ্ধতা ও শ্রেণীবিন্যাসের কিম্ভূতাকৃতি সত্ত্বেও প্রমাণ করে দেবো, নিছক অলীক স্বপ্ন নয়, বৈদেহী স্বপ্নকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনা সম্ভব; আদর্শভিত্তিক আন্দোলন, আদর্শভিত্তিক সংগঠন, সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিনম্র লোকপ্রীতিউদ্দীপক আচরণ-বিচরণ ইত্যাদি সব মিলিয়ে পশ্চিম বাংলাকে সোনা দিয়ে ঠিক মুড়ে না দিলেও, অন্তত এক সুষম গেরস্থালি সচ্ছলতার প্রান্তদেশে উত্তীর্ণ করবে, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলকে মোহিত-চকিত করবে, বামপন্থী বিকল্পের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। অথচ সব-কিছু কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। অর্ধশতাব্দীরও অধিক আগে কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত কবিতায় উচ্চারিত আকূতির প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে, লীলাময় রায়ের বয়ানে অন্নদাশঙ্কর রায় মন্তব্য করেছিলেন: ‘কামাক্ষীপ্রসাদ যতই বলুন, মৈনাকরা সৈনিক হয় না, সৈন্যরাই মৈনাক হয়’। গত দশ-বারো বছরের ঘটনাবলী যেন সেরকম বিষণ্ণ আশঙ্কার কথাই ব্যক্ত করছে। গোটা দেশেই প্রতীপমুখিতার ঝোড়ো হাওয়া, সুবিধাবাদের বিবেকবিহীন আস্ফালন, একদা আশার জাল যাঁদের নিয়ে বোনা হয়েছিল, বুনেছিলাম, সেই ফারুখ আবদুল্লা-গোছের লোকদের হাল দেখুন: রামসেবকদের পরমানুগত মেষশাবক!

পশ্চিম বাংলার শতকরা পঁচাশি ভাগ মানুষ গ্রামে-গঞ্জে ছড়ানো। প্রশাসন ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় এখনও পুঞ্জীকৃত অসাফল্য, অস্বচ্ছতা, হতাশা-উদ্রেককারী শ্লথতা, কোথাও-কোথাও, অকপটে স্বীকার করা প্রয়োজন, দুর্নীতির সংক্রমণ: কেউ-কেউ ব্যঙ্গ করে বলেন, দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ। তবে জল তো উপর থেকে নিচের দিকেই গড়ায়। সীমিত সাধ্য সত্তেও গত পঁচিশ বছরে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে যে-পরিমাণ উন্নতি সম্ভবপর ছিল, তা অবশই অনায়ত্ত থেকে গেছে। সব-কিছু মেনে নিয়েও দাবি করবো যতটুকু উত্তম সাধিত হয়েছে তা-ও অভূতপূর্ব, বামপন্থীদের প্রতি রাজ্যময় গরিবগুর্বোদের পৌনঃপুনিক সমর্থনজ্ঞাপন তার নিশ্চিত প্রমাণ। নগরাঞ্চলে বিনিয়োগ নেই, শিল্প ধুঁকছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সার্বিক নীতিসিদ্ধান্তহেতু শিল্প সংস্থার পর শিল্প সংস্থা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কর্মহীনদের সংখ্যা প্রত্যহ বিস্ফারিততর। চোখের সামনে অহরহ যা দৃশ্যমান, জীবিকার সুযোগের অভাবে ছেলের দল বিপথগামী হচ্ছে, গুণ্ডা-ছ্যাঁচোড়-তস্কর-জোচ্চোরদের সংখ্যাবৃদ্ধি করছে, বেঁচে থাকার দায়। আরো যা মারাত্মক, চেতনার শরীরে হঠাৎ যেন চটুলতার প্রলেপ পড়ছে। শুধু আদর্শের চিন্তার নির্ভরই নড়বড়ে হচ্ছে না, রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারও ক্রমশ শিথিল থেকে শিথিলতর। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা কদাচিৎ এখন মাতৃভাষায় একটি আস্ত বাক্য উচ্চারণ করতে পারে, মুম্বই চলচ্চিত্রের হতকুচ্ছিত নিদর্শনের হুবহু বাংলা সংস্করণে বাজার ছেয়ে যাচ্ছে, ছেলেমেয়েদের নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি-আচারকলার যে আগাপাশতলা পাল্টে-যাওয়া, তা ঢের ছাপিয়ে এক সার্বিক ভোগলিপ্সার উগ্রতা, বাঙালি মধ্যবিত্ত আর যেন ঠাহর করতে পারছে না, আদর্শবোধের সংজ্ঞা কী, কাকেই বা বলে ঐতিহ্য, ঐতিহ্যের প্রত্যাখ্যানই যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের লাঠির মতো, আদর্শেরও দিন গিয়েছে। আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে আদর্শবাদী রংরুটদের শ্ৰেণীত্যাগের আবশ্যকতা শেখানোর চেষ্টা হতো, মধ্যবিত্ত নির্মোক জীর্ণ বস্ত্রের মতো পরিত্যাগ করে বিত্তহীনদের মিছিলের সঙ্গে নিজের শরীর-সত্তা মিশিয়ে দেওয়ার চেয়ে মহত্তর অভিজ্ঞতা, বলা হতো, পৃথিবীতে আর কিছু নেই। ব্যবহারিক জীবনে অনেকেই সেই পরীক্ষায় সফল হতে পারতেন না, কিন্তু অন্তত চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁদের শ্রেণীগত রূপান্তর ঘটতো। বিগত দশকের বিশ্বায়নবিস্তারের পরিণামে বাঙালি মধ্যবিত্তের মানসিকতায় যুগান্তকারী পরিবর্তন : সেই কবে কোন্ প্রসঙ্গে রুশ অনুগামীদের নিকোলাই বুখারিন উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘বড়োলোক হও’; আমাদের মলিন জরাজীর্ণ দেশে এত যুগের ব্যবধানে হঠাৎ তার প্রতিধ্বনি। এই অন্যচারিতার একটি তত্ত্বের ভিত্তিভূমি অবশ্য আছে: গরিবদের আমরা ভুলিনি, ভুলছি না, তবে আমরা মধ্যবিত্তরা যদি সর্বাগ্রে নিজেদের আখের গুছোতে পারি, আমাদের বর্ধমান উপার্জন তা হলে বাজারে চাহিদা বাড়াতে সাহায্য করবে, ফলে জাতীয় অর্থব্যবস্থায় সজীবতা আসবে, যা থেকে কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, গরিবগুর্বোদেরও হাল ফিরবে।

যুক্তির সারণি ক্রমশ আরো প্রলম্ব হয়। মধ্যবিত্তদের উচ্চবিত্তদের হবে প্রগতির স্বার্থে, তাঁদের উচ্চবিত্ততর হওয়ার প্রয়াসে বাধা দিতে নেই, তাঁদের কদর জানাও, আদর করো, তাঁদের ‘অতি বিশিষ্ট ব্যক্তি’ হিশেবে বিবেচনা করে সুরক্ষার ব্যবস্থা করো, সুরক্ষার পরিখা আরো মজবুত করার লক্ষ্যে এর পরে তাদের ‘অতি অতি বিশিষ্ট’ বলে আখ্যাত করতে শুরু করো। যেন এক ঘোরের মধ্যে অবস্থান করছি।

মধ্যবিত্তস্বভাবজ এই বিভ্রান্তি। শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পে ভণ্ড সাধক গদগদ কণ্ঠে ‘মা, কলা খাও’ মন্ত্রোচ্চারণ করে খোসা ছাড়িয়ে নিজেই কদলীভক্ষণ করতো, অনেকটা সেরকম। এতদিন-পর্যন্ত-বামপন্থী আঁতে ঘা লাগে, তাই তর্ক জুড়ে অজুহাত পেশ করা হয়, গোসা করছেন কেন, চীন যা করেছে, করছে, আমরাও তাই করছি। যাঁরা ইত্যাকার বলেন, অন্তত তিনটি প্রমাদের শিকার তাঁরা। চীনের কর্তাব্যক্তিরা গোটা দেশের প্রধান-প্রধান গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্তের নিয়ামক; অন্য পক্ষে পশ্চিম বাংলা ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্য মাত্র, কোনও ব্যাপারেই স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার রাজ্যের নেই। চীনের আর্থিক অগ্রগতির গোড়ার কথা বিপ্লবোত্তর পর্বে সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন, যা দেশের মানুষের চেতনা আদ্যন্ত নতুন ছাঁচে গড়ে তুলেছে; কী ভারতবর্ষে, কী পশ্চিম বাংলায়, সে ধরনের আমূল সমাজ সংস্কারের জন্য কত যুগ প্রতীক্ষা করতে হবে কে জানে। তৃতীয়ত, চীনের অনাবাসী নাগরিকরা যে-বিরাট অঙ্কের অর্থ দেশে বিনিয়োগের জন্য পাঠিয়েছেন, তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। প্রবাসী বাঙালিরা, অন্তত বেশির ভাগ, চাকুরিজীবী; যদি ইচ্ছাও থাকে, দেশের মাটিতে বিনিয়োগে টাকা ঢালবার সামর্থ্য তাঁদের অতি সীমিত। স্পষ্ট কথাটি তাই স্পষ্ট করেই বলতে হয়: তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছর আগে ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ হরিধ্বনি যেমন গোলমেলে ছিল, হালের ‘চীনের অর্থনীতিই আমাদের অর্থনীতি’ উচ্চনাদও সমপরিমাণ কল্পনাকণ্ডুয়ন।

বাস্তবতায় না-ফিরে উপায় নেই আমাদের। বিশ্বায়নের জাদুতে যদি মজতে চাই, চৈনিক আকাশকুসুম ভুলে গিয়ে ভারতবর্ষে গত এক দশক ধরে কী হয়েছে, আরও কী হতে যাচ্ছে, সেদিকেই নজর ফেরানো দরকার। তোমার-প্রাণ-আমার-হোক-আমার-প্রাণ-তোমার-হোকের এই বিশ্বায়িত দশ-এগারো বছরে ভারতবর্ষে কৃষি উৎপাদনের হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের নিচে নেমে গেছে, শিল্পোন্নতির হার পূর্ববর্তী দশকের হারের অর্ধেকেরও কম, সরকারি নীতির প্রকোপে অসংখ্য কারখানা—যাদের একটি বড়ো অংশ পশ্চিম বাংলায়— বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কর্মহীনদের সংখ্যা হু-হু করে বাড়ছে, অবাধ আমদানির ফলে কৃষি-শিল্পের ভবিষ্যৎ ঘোর অনিশ্চিত, বৈদেশিক শক্তি আমাদের ঘাড়ে নিশ্চিত চেপে বসা। একশো বছর আগে যা ছিল সাম্রাজ্যবাদের স্বর্ণযুগ, একশো বছর বাদে তার নবসংস্করণকে আমরা নব-সাম্রাজ্যবাদ বলতেও লজ্জা পাই, ঘুরিয়ে বলি বিশ্বায়ন। একটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন অবশ্য চোখে পড়বার মতো: পরিষেবার চমকপ্রদ ব্যাপ্তি, ব্যাংক-বীমা ব্যবস্থায়, ভ্রমণে, বিনোদন শিল্পে। তথাচ সমস্যা; পরিষেবার প্রসারে কর্মসংস্থান বাড়ে না, কমে; বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির অনুপ্রবেশে এক লক্ষ করণিকের কাজ চলে যায়, পরিবর্তে সম্পন্ন ঘরের চালাকচতুর বড়ো জোর হাজারখানেক ছেলেমেয়ে মস্ত মাইনের চাকরিতে বহাল হয়, কম্পিউটার তাদের ধ্যানজ্ঞান; দেশে বেকারি বাড়ে, ধনবণ্টনের বৈষম্যও।

দেখে-শুনে ভয় হয়, সমগ্র ভারতবর্ষকে বামপন্থী বিকল্প পথ দেখাবার প্রতিশ্রুতি যেন ধূসর থেকে ধূসরতর, বিশ্বায়নের সোনার হরিণ ধাওয়া করতে গিয়ে পশ্চিম বাংলা, কে জানে, হয়তো ক্রমশ কেন্দ্রীয় সরকারের বশংবদ অমাত্যে পরিণত হবে দু’দশ বছরের মধ্যে। ছায়া এই ঋতুতে অবশ্যই পূর্বগামিনী। পুঁজিপতি-ব্যবসাদারদের বেশি খুশি করে গুজরাট-মহারাষ্ট্র থেকে ভাগিয়ে নিয়ে আসবো, এই উচ্চাশার পাশাপাশি কেন্দ্রকে ভজনা করে যদি কিছু বাড়তি রেস্ত সংগ্রহ করা যায় তেমন উদ্যোগ। পুঁজিওলা-ভজনা, আমার বিবেচনায়, আর একবার বলি, পণ্ডশ্রম, কারণ কেন্দ্র-দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি শিল্পে টাকা ঢাললেই তবে সাধারণত শিল্পপতিদের গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠা। ওঁরা উত্তম পুরুষ নন, সব সময়ই দ্বিতীয় বা তৃতীয় পুরুষ। তাই শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রই ভরসা, কেন্দ্রকে তোয়াজ করে যতটুকু পাওয়া যায়। ঘুরিয়ে বলে লাভ নেই, কেন্দ্রের রামভক্ত সরকার পশ্চিম বাংলার জন্য ভালোবাসায় উথলে উঠবে না, যদি না পশ্চিম বাংলার অধিবাসীবৃন্দও সবংশ রামভক্ত বনে যান, বামপন্থার ভূত চিরতরে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে।

বামপন্থী আদর্শের আর বাজারদর নেই, বহুকীর্তিত পশ্চিম বাংলায়ও, সন্দেহ হয়, নেই: প্রভুর সংস্কৃতিই প্রজাকুল সন্নতমস্তিষ্কে গ্রহণ করে। হাতের কাছেই একটি চমৎকার উদাহরণ। নতুন দিল্লির নিরাপত্তা-সংস্কৃতি ইতিমধ্যে আমাদের রাজ্যেও বৃহৎ পরিমাণে সংক্রামিত। দেশের রাজধানীতে সামাজিক মর্যাদা নিরাপত্তার তুলনাগত সমারোহের উপর নির্ভরশীল। দু’শো-আড়াইশো বছর আগে বাংলা দেশের গ্রামে কুমারী মেয়েরা শীতঋতুতে উঠোনে বা বাড়ির ছাদে সারি দিয়ে বড়ি দিতে বসতো। তাদের উদ্দীপনা সঞ্চারের জন্য বলা হতো, যার বড়ি যত উঁচু, তার বরের নাক তত উঁচু। প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র: উন্নতনাসা রাজপুত্র-কামনায় প্রতিটি কুমারী বাড়তি উৎসাহ নিয়ে বড়ি আরও নিখুঁত করতে মনোনিবেশ করতো। নতুন দিল্লিতে আপাতত একই ধরনের সংস্কৃতিপ্রবাহ: যাঁর নিরাপত্তা যত জমকালো, তিনি তত বড়ো নেতা। পশ্চিম বাংলাতেও, আশঙ্কা হয়, সেই অতল জলের আহ্বান আস্তে-আস্তে এসে পৌঁছুচ্ছে। তবে কারো-কারো আশঙ্কাই তো অন্য কারো-কারো ক্ষেত্রে আশার রূপ নিয়ে আবির্ভূত।

নরকের কোন অতলে যে-অবতীর্ণ হওয়ার আশঙ্কা, তার একটি নমুনা স্মৃতিকে এখনও শিহরিত করে। নারায়ণদত্ত তেওয়ারী তখন কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী, দিল্লির উদ্যোগ ভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছি! তেওয়ারী মশাইয়ের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে লখনউ-ই শিষ্টাচার, দেখা হলেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আলিঙ্গনবদ্ধ করেন, নিয়ম করে একবার শরীরের ডান দিকে জড়িয়ে ধরে, আর একবার বাঁ দিকে। তাঁর বাহুপাশে আপ্যায়নে-এলিয়ে-পড়া আমি ওই অবস্থাতেই হঠাৎ দেখি, উভয় দিক থেকেই একজন প্রহরী আমাকে লক্ষ্য করে বন্দুক উঁচিয়ে।

জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে। ভারতীয় ঐক্য-ও সংহতি কামনায় আমরা আবিষ্ট, জাতীয় দুরাচার-দুর্নীতির প্রভাবও তাই আর এড়াবো কী করে। চীনে ঠগ-জোচ্চোরদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, কিংবা গুলি করে মারা হয়, আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা সম্ভব নয়। তবু, এতদিন পর্যন্ত অন্তত, দেশের অন্য সর্বত্র যে-ধরনের পুকুরচুরি ঘটে, তার তুলনায় পশ্চিম বাংলায় দুর্নীতি অনেকটাই নিষ্প্রভ। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় বা সরকারের এই বিভাগে-ওই বিভাগে ভ্ৰষ্টাচার নিয়ে অনেক গালগল্প প্রচারিত। তবে সেসব অধিকাংশই ছিঁচকে দুর্নীতি, ফাইলের গতি বাড়াবার জন্য কুড়ি-পঁচিশ টাকার প্রসাদ যাচ্ঞা, কোনও রাজপুরুষের হয়তো কোনও ব্যবসাদারের কাছ থেকে এক বোতল বিদেশি হুইস্কি উপহার গ্রহণ, কোনও হাবাগোবা মন্ত্রী এক বালতি রান্না-করা মুর্গির মাংস ভেট পেয়েছেন এক দালালের কাছ থেকে, সার্কিট হাউসে দরজা-জানালা বন্ধ করে সপরিবারে তার সদ্ব্যবহার। দিল্লি-মুম্বই-চেন্নাই-পটনা ও অন্যত্র যে হাজার-হাজার কোটি জনসাধারণের অর্থ দুর্নীতির বেপরোয়া চোরাপথে অদৃশ্য হয়ে যায়, তা ভীরু বাঙালির জাগতিক সম্পত্তিসৃষ্টির প্রলোভনকল্পনার বাইরে। তবে, কে জানে, জাতীয়তাবোধের মোহিনী মায়া, সুরক্ষা দৃঢ় করবার ক্ষেত্রে যেমন, দুর্নীতির ব্যাপারেও পশ্চিম বাংলা সম্ভবত এখন থেকে আর পিছিয়ে থাকতে অসম্মত হবে, অভীপ্সা যেহেতু এক জাতি-এক প্রাণ-একতা।

মহাকরণে থাকাকালীন কিছু-কিছু ছিঁচকে দুর্নীতির বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা এই সুযোগে না-হয় লিপিবদ্ধ করি। আবগারি দপ্তরের দায়িত্বে আছি। খবর পৌঁছুলো দপ্তরের কর্মচারীরা চোলাই ধরতে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে এক বাজারে হানা দিয়েছিলেন, চোলাইকারীদের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়েছে, বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মী জখম হয়েছেন, একজন আবগারি ইন্সপেকটরের আঘাত গুরুতর, তাঁকে হাসপাতালে দেখে এলাম, বহু ব্যান্ডেজে জর্জরিত শরীর। আবগারি দপ্তরের সচিবকে বললাম, ‘ইন্সপেকটরটি কর্তব্য সম্পন্ন করতে গিয়ে প্রহৃত হয়েছেন; এসব ক্ষেত্রে তো নিয়ম আছে বিশেষ পুরস্কার ঘোষণার। আপনি দয়া করে ফাইল চালু করুন, আমি এঁর জন্য পুরস্কার মঞ্জুর করবো।’ সপ্তাহ যায়, মাস যায়, দু’একবার সচিবকে মনে করিয়ে দিয়েছি, কিন্তু ফাইল আর চালু হয় না। একদিন সচিবকে চেপে ধরলাম: ‘কী ব্যাপার বলুন তো, আপনি প্রস্তাবটি পাঠাচ্ছেন না কেন?’ সচিব কাঁচুমাচু জবাব দিলেন, ‘স্যার, এই ক্ষেত্রে পুরস্কার ঘোষণা বোধ হয় সমীচীন হবে না।’ আমি অবাক, কেন? সচিব জানালেন, একটি বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে; ইন্সপেকটরটি দলবল নিয়ে গিয়ে আগের রাত্তিরে মাসের তোলা নিয়ে এসেছেন; পরের সন্ধ্যায়, কী অন্যায়, চোলাই উদ্ধারে গেছেন, বিশ্বাসভঙ্গের এর চেয়ে বড়ো উদাহরণ আর কী হতে পারে।

তেমন ভয়ানক কিছু কিন্তু নয়। একটু-আধটু পুকুরচুরি করে বহুতল বাড়ি তোলা হচ্ছে কলকাতায় ও আশেপাশে, লাভের বখরা অনেকে পাচ্ছে, এ সব তো সর্ববিদিত সত্য। তবে বাঙালি কল্পনাশক্তি এখনও প্রধানত কাব্যচর্চা ও খুদে পত্রিকা বের করবার খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রভাবে সেই প্রতিভা যে-গতিধারা বদলাবে না, তঞ্চকতার মহাসমুদ্রে গিয়ে মিশবে না অদূর ভবিষ্যতে, কে বলতে পারে?

এবংবিধ আতঙ্ক অমূলক বলা চলে না। এখন তো দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিই বলছেন, সারা দেশে বিচারকদের মধ্যে শতকরা তিরিশ ভাগ অসাধু, তাই বৃত্তান্তটি বর্ণনা করতে অস্বস্তিবোধ হচ্ছে না। এক জেলার আবগারি সুপারিন্টেন্ডেন্ট, খবর পাচ্ছি, প্রচুর উৎকোচ গ্রহণ করছেন; খবর পাকা, কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। একটি বিশেষ, প্রশাসনিক কারসাজির সুযোগ গ্রহণ করে ঘুষখোর ব্যক্তিটিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। পুজোর মাস, প্রচুর টাকা কামাবার মওকা এভাবে ব্যর্থ হবে, আবগারি কর্মীটি সোজা হাইকোর্টের অবকাশকালীন বিচারপতির কাছে চলে গেলেন। বিচারপতির ঝটিতি রায় ঘোষণা, এই অফিসারকে অবিলম্বে কোনও ভালো জেলায় বহাল করতে হবে। খুব লোভ হয়েছিল সরকারি উকিল মারফত বিচারপতিকে জিজ্ঞাসা করি, ভালো জেলার সংজ্ঞা কী, যে-জেলায় সহজে কাঁড়ি-কাঁড়ি ঘুষের টাকা অর্জন করা যায়, যে-টাকা তারপর ‘মঙ্গলভস্মের পর’ কবিতার সন্ন্যাসীর ধাঁচে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়া যায়? ফের বলি, পশ্চিম বাংলায় এখন পর্যন্ত যা ঘটছে তা স্রেফ নস্যি। তবে ভারতবর্ষ যত সংহত ও ঐক্যবদ্ধ হবে, নস্যি আর নস্যি থাকবে না।

সবচেয়ে বেশি মনস্তাপ অবশ্য কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক সম্পদের পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে শুরু-করা আন্দোলনের অপমৃত্যুহেতু। বামফ্রন্টের তরফ থেকে যখন রাজ্যের হাতে অধিক অর্থের দাবিতে ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য সমস্যা নিয়ে সত্তরের দশকের উপান্তে চিৎকার শুরু করেছিলাম, ফ্রন্টে-তখন-আর-নেই এমন-এক-বামপন্থী দলের নেতারা প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁদের যুক্তি অতীব স্বচ্ছ: কেন্দ্রীয় সরকারের অবশ্যই পুঁজিবাদী চরিত্র, কিন্তু ভারতে পুঁজিবাদী বিকাশ না ঘটলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও ঠেকে যাবে, আগে ধনতন্ত্র, পরে সমাজতন্ত্র; কেন্দ্র থেকে রাজ্যের হাতে বেশি টাকা-পয়সা চলে এলে কেন্দ্র আর্থিক দিক থেকে দুর্বল হবে, ধনতন্ত্রের দ্রুত বিকাশ ব্যাহত হবে, সমাজতান্ত্রিক সূর্যের উদয়ও তাই পিছিয়ে যাবে; অতএব যাঁরা রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার জন্য আন্দোলন করছেন, তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল, সমাজতন্ত্রের শত্রু। সে সময় যুক্তির উদ্ভট কুশলতায় কৌতুক বোধ করেছিলাম, এখন আবিষ্কার করছি, নবরূপে সেই যুক্তির মঞ্চে পুনরাবির্ভাব। তত্ত্ব রচিত হচ্ছে, রাজ্যে-রাজ্যে বিভিন্ন হারে কর আরোপ জাতীয় অর্থব্যবস্থার পক্ষে হানিকর, বিক্রয় করের হার রাজ্যে-রাজ্যে যদি তফাৎ হয়, গাড়ির উপর কর আজ এক রাজ্যে বেশি, পাশের রাজ্যে কম, কাল এই রাজ্যে কম, পাশের রাজ্যে বেশি, পুঁজিপতি-ব্যবসাদারদের তাতে মহা অসুবিধা, শিল্পে-ব্যবসায় তা হলে অস্থিতি আসতে বাধ্য। ভারতবর্ষ এগোলে, পশ্চিম বাংলাও এগোবে, সুতরাং পশ্চিম বাংলার স্বার্থেই বিক্রয় কর ব্যবস্থা তুলে দিয়ে কেন্দ্র-নিয়ন্ত্রিত বিকল্প এক কর ব্যবস্থার কথা ভাবা হোক: সারা দেশে কোথাও আর তখন বিক্রয় করের হুজ্জুতি থাকবে না, পরিবর্তে বিশেষ এক কেন্দ্রীয় কর বসবে, প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রে যার হার সারা দেশে সমপরিমাণ; শিল্পবাণিজ্য তা হলে ফুলে-ফেঁপে উঠবে।সবচেয়ে মারাত্মক সংবাদ, আমাদের রাজ্য নাকি এই অভিনব প্রস্তাবের প্রধান উদ্যোক্তা; জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে।

এটা তো প্রমাণিত সত্য, প্রচুর গোপন নির্দেশিকা ওয়াশিংটন থেকে দিল্লিমুখো হয়েছে গত কুড়ি বছরে, বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের তরফ থেকে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকারের উপর কাঁড়ি-কাঁড়ি উপদেশ বর্ষণ করা হয়েছে, রাজ্যগুলিকে আর্থিক অসুবিধায় ফেলে কেন্দ্র নিজের ঘর ভালো করে গুছোক; রাজ্যগুলি যত বেশি অসাচ্ছল্যে পড়বে, তত তারা পথে আসবে, তাদের তেঁটিয়া ভাব তত নিষ্প্রভ হবে, তত তারা নতুন দিল্লির পদলেহনে আগ্রহবান হবে। বিক্রয় কর বিলোপ করে প্রস্তাবিত পরিবর্ত ব্যবস্থা এই অনুসৃত চক্রান্তের অন্যতম উদাহরণ মাত্র।

অপরাপর বাস্তব সমস্যাগুলিও তো গর্তে মুখ লুকিয়ে থাকবে না। আশির দশকের মাঝামাঝি কোনও সময়, ইতালির নতুন দিল্লিস্থ রাষ্ট্রদূত মহাকরণে দেখা করতে এলেন: পিয়েত্রো নেনী-প্রতিষ্ঠিত সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য, চিন্তায়-কর্মে বামপন্থী। ইতালীয় প্রকৌশল অনুসরণ করে হিমালয়ের সানুদেশে ব্যাপক ফল চাষের সাফল্য-সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর মনে ন্যূনতম দ্বিধা নেই, রোমে কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে ইতালি সরকারের কাছ থেকে সেই উদ্দেশে একটি বিশেষ সাহায্যপ্রকল্পেরও ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর বিশেষ ইচ্ছা সাহায্যের বৃহদংশ বামপন্থী পশ্চিম বাংলার দার্জিলিং-শিলিগুড়ি অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ হোক। কিন্তু নতুন দিল্লির রাজপুরুষদের কিছুতেই রাজি করাতে পারছেন না, তাঁরা পুরো টাকাটা পঞ্জাব-হিমাচল প্রদেশ-উত্তর প্রদেশ-মহারাষ্ট্র-কর্ণাটকের জন্য বরাদ্দ করবেন, পশ্চিম বাংলার জন্য পাই-পয়সাও নয়। নতুন দিল্লিতে রামসেবক বা নেহরু-গান্ধি আসক্ত যাঁরাই হাল ধরে থাকুক না কেন, ভিন্ন আদর্শ-অনুগত অঙ্গরাজ্য সরকার সম্পর্কে এই বিদ্বিষ্ট চিন্তা তো আগামী দিনে স্বতই মিলিয়ে যাবে না। নিখাদ ত্রিশূল-উঁচোনো রামভক্তিতে অথবা পারিবারিক সামন্ততন্ত্রের প্রতি অনুরাগে যদি আমরা আপ্লুত হই, তা হলে অবশ্য অন্য কথা।

পেশাদারি নৈরাশ্যসদাগরের হয়তো ভূমিকা আমার, স্বর্ণসুখের কল্পনা আবিষ্ট করে না। তবু ভয় হয়। যাঁদের সমর্থনে ও আশীর্বাদে পশ্চিম বাংলায় বামপন্থী আন্দোলনের পুষ্টি ও বর্ধন, কিছু-কিছু সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে তাঁদের প্রতি কি অন্যমনস্ক ঔদাসীন্য প্রদর্শিত হচ্ছে না? শ্ৰেণীত্যাগের প্রসঙ্গ না-হয় শিকেয় তোলা থাক, সমাজবিপ্লবও যেখানে বহু দূরের আকাশ, হঠাৎ শ্রেণীসমন্বয়ের হতভম্ব-করা বার্তা কী মঙ্গল দান করবে হতদরিদ্র-আজন্মলাঞ্ছিত কোটি-কোটি সাধারণ মানুষকে? আতঙ্কে আরও লীন হতে হয় যখন চোখে না-পড়ে পারে না, যাঁরা সাম্যবাদী চিন্তা ও আদর্শের চরম বৈরী বলে এতদিন পরিচিত ছিলেন, তাঁরাই এখন প্রধান শুভানুধ্যায়ী ও পরামর্শদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়; মুশকিল হলো, কিছু-কিছু বিজ্ঞজনের ধারণা, সুসময়ের অক্ষয় জীবনায়ু।

জাতীয় ঐক্য ও সংহতি যেহেতু বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে, জাতীয় রাজনীতির কারাগারে স্বেচ্ছাবন্দী আমরা, আদর্শশূন্য নীতিহীনতার ফসল কুড়িয়েই সম্ভবত অনির্দিষ্ট কাল বাঁচতে হবে। কংগ্রেস-ভারতীয় জনতা পার্টির অনুগামীদের মধ্যে প্রভেদীকরণ যেমন সহজ নয়, চমকপ্রদ অন্য দৃশ্যাবলীও তো দেখতে হচ্ছে, দলিতদের নায়কত্ব যাঁরা দাবি করেন, মুখ্যমন্ত্রিত্বের টোপ ফেললেই তাঁরা মনুবাদীদের সঙ্গে ভিড়ে যান, তথাকথিত সমাজবাদীরা বাঘা-বাঘা পুঁজিওলার তল্পিবাহকে পরিণত হন, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী সংগঠনের মস্ত চাঁই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে পাকিস্তান বিজয়ের সুখস্বপ্নে বিভোর হতে ভালোবাসেন। এঁদের কারও কারও সঙ্গে মিতালি করে ভারতবর্ষকে সুস্বাস্থ্যে প্রত্যাবর্তন করানো সম্ভব, যদি কেউ এমন দাবি করেন, ঢোঁক গেলা ছাড়া উপায় থাকবে না আমার।

এবং সেজন্যই, যে-প্রবক্তরা বলেন বিরাট ভুল হয়েছিল ছিয়ানব্বুই সালে, জ্যোতিবাবুকে প্রধান মন্ত্রী করার প্রস্তাবে সম্মতি দিলে ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে যেতো, মনে হয়, তাঁরাই ভুল বলছেন। আর্যাবর্তের নীতিরহিত দানবদের সামলানো শিবের বাবার অসাধ্য, এদের ক্ষুদ্র স্বার্থ, অথচ প্রচণ্ড লোভ, এদের দিয়ে কোনও নীতি বা আদর্শের পাটিগণিত-ধারাপাতই মানানো যেতো না, মনে হয় না জ্যোতিবাবুও সফল হতেন; কোনও চরম প্রতিক্রিয়াপন্থী ব্যক্তি অর্থমন্ত্রীরূপে সমারূঢ়, প্রধান মন্ত্রীকে সমীহ করার ব্যাপারে তাঁর নিশ্চয়ই কোনও মাথাব্যথা থাকতো না, তাঁর ফরমান, যেমনটা হয়ে আসছে, আসতো খোদ ওয়াশিংটন থেকে। ছিয়ানব্বুই সালে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছিলেন, প্রায় জড়ভরত হয়ে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। মানছি, তিনি যে-সব অসুবিধা থেকে ভুগতেন, জ্যোতিবাবু সেগুলি খানিকটা এড়াতে পারতেন, কিন্তু প্রধান সমস্যাদি অপরিবর্তিতই থাকতো, প্রাক-পুরাণিক ঐতিহ্যের গর্বসমাচ্ছন্ন বিশাল ভূখণ্ডে যুক্তির সুবিন্যস্ত বাণী প্রচারের প্রয়াস ব্যর্থ পরিহাসে পর্যবসিত হতো। প্রাগিতিহাসপ্রেমিকরা কৌশলপ্রক্রিয়ার প্রয়োগে আদর্শবাদীদের অতি অবলীলায় বধ্যভূমিতে তুলে নিয়ে যেতে পারদর্শী।

স্বধর্মে নিধন অবধারিত এই হীনম্মন্যতা চেপে বসেছে অনেক একদা-আদর্শবাদীর চেতনার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। তাঁরা ক্লান্ত, তাঁরা ভুলে যেতে চান ঐতিহ্যের শপথ, চোখ-কান বুজে পরধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করলেই যেন বিবেকের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন তাঁরা। পরধর্ম যে ভয়াবহ তা নিয়ে আমার মনে অন্তত দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। স্বধর্মকে মান্ধাতাগন্ধী বলে যদি গাল পাড়াও হয়, তা হলেও সেই আদি আশ্রয়ভূমিতে স্থিত থাকতেই আমার উন্মুখতা। যাঁরা আমার সিদ্ধান্ত অপছন্দ করবেন, তাঁদের দিকে অল্প হেসে যুবাবয়সে আত্মস্থ কবিতার পঙ্‌ক্তি আবৃত্তি করবো: দক্ষিণ পথে মেলে যদি দক্ষিণা, ভেবে দেখো তবু সেই পথ ঠিক কিনা।

খানিকটা আক্ষেপ, খানিকটা স্মৃতিরোমন্থন। দুই দশক আগে ইন্দিরা গান্ধি ও তাঁর অর্থমন্ত্রী বেঙ্কটরামন আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের কাছ থেকে জাতির-পক্ষে-অবমাননাকর শর্তে ঋণ নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করছেন, নির্দিষ্ট শর্তগুলি মানলে আমাদের অনেকের বিবেচনায় দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন না-হয়ে পারে না। পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ উচ্চারিত হলো, কলকাতায় প্রতিবাদী সম্মেলন গোটা দেশ থেকে জড়ো-করা অর্থনীতিবিদদের নিয়ে। কলকাতা ও পশ্চিম বাংলাতেই পড়ে রইলাম না আমরা, প্রস্তাবিত ঋণগ্রহণের নিন্দা বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হলো, দেশ জুড়ে গড়া হলো প্রতিরোধের ব্যূহ, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার যে-গোপন চুক্তি সই করতে উদ্যত, তৎসংক্রান্ত দস্তাবেজ সংগ্রহ করে তা জনসাধারণের কাছে ফাঁস করে দেওয়া। ঋণের শর্তাদির বিপজ্জনক দিকগুলি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রায় রাতারাতি বই লিখিয়ে তা প্রকাশ, রাজধানী দিল্লিতে ধিক্কার মিছিল, যে-মিছিলের শেষ পর্বে সংসদ ভবনে ধর্ণা। হুলস্থূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সফল হয়েছিলাম আমরা, ভারত সরকারের আতঙ্কে কুঁকড়ে আসা। শেষ পর্যন্ত যদিও চুক্তিটি পুরোপুরি আটকে দেওয়া সম্ভব হয়নি, কয়েকজন সংশ্লিষ্ট রাজপুরুষ পরে আমাকে জানিয়েছিলেন আমাদের প্রতিবাদের ফলেই আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার কতিপয় অতি আপত্তিজনক শর্ত শিথিল করতে বাধ্য হয়েছিল।

অন্য যুগ। বিশ্বায়নের প্রকোপে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলির ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, ভারতবর্ষও সমান বিপন্ন, বিশ্ব ব্যাংক-আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার-বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-মহাপ্রভু মার্কিন সরকারের সম্মিলিত দাপটে আমাদের অস্তিত্ব আপন্ন। অথচ কলকাতায়, পশ্চিম বাংলায় প্রতিবাদের রণধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে না, আমরা বলতে গেলে উল্টোরথ যাত্রা করছি। এই মহাদেশে-ওই মহাদেশে বিভিন্ন আক্রান্ত দেশে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। ফুটবলের কল্যাণে পশ্চিম বঙ্গবাসী এখন রোনাল্ডিনহোর নাম জানেন। এই খেলোয়াড় ব্রাজিলের রিও গ্রান্দে দো সুল প্রদেশের বাসিন্দা। ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় সরকার বরাবর সম্যকরূপে প্রতিক্রিয়াশীল, কিন্তু রিও গ্রান্দে দো সুল-এ নিকষ বামপন্থী সরকার, প্রতিক্রিয়া-অধ্যুষিত ভারতবর্ষে পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্ট সরকার যেমন মরূদ্যানসদৃশ, সেরকম। গত কয়েক বছর ধরে এটা হয়ে আসছে, রিও গ্রান্দে প্রাদেশিক সরকারের উদ্যোগে প্রাদেশিক রাজধানী পোর্তো এ্যাইগ্রে-তে সপ্তাহব্যাপী বাৎসরিক নিখিল বিশ্ব বিশ্বায়ন-বিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ছয় মহাদেশ ঝেঁটিয়ে হাজার-হাজার প্রতিবাদী মানুষের জড়ো হওয়া, বিভিন্ন দেশে বিশ্বায়ন-বিরোধী ঘটনার চুল-চেরা সালতামামি, বক্তৃতা-বৈঠক-শোভাযাত্রা-গণসংগীত-গণনাট্যের সমারোহ। গোটা পৃথিবীর বিশ্বায়ন-শোষিত জনগণের প্রতিজ্ঞা সম্মেলনে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, আগামী দিনের প্রতিরোধ কর্মসূচি নির্ধারিত হয়। আমার মনে একটি সঙ্গোপন কল্পনা সন্তর্পণ বাসা বেঁধে আছে, রিও গ্রান্দে দো সুল প্রদেশের সরকার ও পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্ট সরকার পরস্পরের সঙ্গে আলাপান্তে নিখিল বিশ্ব বিশ্বায়ন-বিরোধী জমায়েতের যৌথ দায়িত্ব গ্রহণ করবে, সম্মেলন পালা করে এক বছর পোর্তো এ্যাইগ্রে-তে, পরের বছর কলকাতায়, এমন করে প্রতি বছর অনির্দিষ্ট কালের জন্য, যতদিন না দরিদ্র পৃথিবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে। ওই ধরনের সম্মেলনই হবে যথার্থ বিশ্বায়ন, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ধুঁকেপুকে-বেঁচে-থাকা শোষিত-অবহেলিত মানুষজনের আলিঙ্গনবন্ধন। কিন্তু কল্পনা তো কল্পনাই। সঙ্গে-সঙ্গে বুঝতে পারি, আমাদের প্রান্তদেশে যে-রজনী গেছে তাকে ফেরানো আর বোধহয় আপাতত সম্ভব নয়: আমরা ছুটকো-ছাটকা একজন-দু’জন পোর্তো এ্যাইগ্রে-তে গিয়ে হয়তো পৌঁছুবো, পোর্তো এ্যাইগ্রে থেকে কেউ কলকাতায় আসবেন না, কলকাতা তো অপর বিশ্বায়নে এই মুহূর্তে আসক্ত।

এক দিকে পুরাণপ্রেমে, অন্যদিকে সামন্ততান্ত্রিক মোহের জালে আবদ্ধ দেশের বর্তমান হাল দেখে গলা-টিপে-হত্যা করা একটি বিকল্প সম্ভাবনার ছায়াছবি ক্রমশই অনুশোচনায় বিষণ্ণ করে। যদি সেই উনিশশো সাতচল্লিশ সালে অথবা তার পরবর্তী কোনও পর্যায়ে ভারতবর্ষকে চার-পাঁচটি উপ-দেশের আদল দেওয়া হতো, তা হলে গোটা দেশের চেহারা-চরিত্রই অন্যরকম হতো। উপ-দেশগুলি কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে শুধু পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করতো, অবশিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রে উপ-দেশগুলি সার্বভৌম, আর্থিক ক্ষেত্রেও কেন্দ্রের অধিকার সীমিত, রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার উপ-দেশগুলির এখতিয়ার-ভুক্ত, কেন্দ্রের জন্য সামান্য পরিমাণ বরাদ্দের ব্যবস্থা থাকতো। এমন পরিকাঠামোর অনুশাসনে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুচিত ছড়ি ঘোরাবার সুযোগ কুঁকড়ে আসতো, প্রতিরক্ষার নামে অপরিমিত ব্যয়ের মোচ্ছব নিগড়ে বাঁধা পড়তো, নিরন্ন-নিরক্ষর-অস্বাস্থ্যে ধুঁকতে থাকা সাধারণ মানুষজনের স্বার্থচিন্তা পাশে সরিয়ে রেখে পারমাণবিক বোমা নিয়ে লোফালুফির ঋতুরও অতএব যবনিকা, উপ-দেশগুলি পরস্পরের সঙ্গে লোকহিতসাধনের প্রতিযোগিতায় শুধু নিমগ্ন। ফলে আর্থিক বিকাশের হার যেমন বহুগুণ বৃদ্ধি পেত, তার সুষম বণ্টনও সম্ভব হতো। অন্যত্র একটি-দু’টি দেশে যে-ধরনের ব্যবস্থা আছে, যে-কোনও বৈদেশিক চুক্তি প্রতিটি উপ-দেশের বিধানসভার সম্মতি ব্যতীত বৈধ বলে বিবেচিত হতো না; রাতের অন্ধকারে দেশকে বিদেশী মহাপ্রভুদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া চরম প্রতিক্রিয়াশীল কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষেও অসাধ্য হতো।

আপাতত তো এই স্বপ্নকে নিধন করা হয়েছে। এখন তাই ক্ষোভ-অনুতাপের সুদীর্ঘ অধ্যায়। সেই সঙ্গে নিজের মধ্যে কুঁকড়ে এসে স্মৃতির হাহাকার। স্মৃতিসর্বস্বতায় অজস্র চড়াই-উতরাই। অনুশোচনার স্মৃতি, কৃতজ্ঞতার স্মৃতি, লজ্জাবোধের স্মৃতি, অপরাধবোধের স্মৃতি, মুগ্ধতায় মুহ্যমান হওয়ার স্মৃতি। সুদূরতম, অথচ এখনও কাতর-করা স্মৃতি, পাঁচ বছরের ক্ষীণকণ্ঠ বালক, ঘনিষ্ঠ জমিদারবাড়িতে পুজোর ঋতুতে বেড়াতে গেছি, আদরে প্রসাধিত দিনযাপন, অষ্টমীর দিন এ-গ্রাম ও-গ্রাম থেকে দরিদ্র প্রজাকুল ঠাকুর দেখতে এসেছেন, জমিদারপ্রাসাদ-সংলগ্ন উঁচু নহবতখানা, সামান্য কৌতূহলবশত এক শীর্ণা ছিন্নবস্ত্রা কৃষকরমণী সিঁড়ি বেয়ে নহবতখানায় উঠে এসেছেন, কোলে ছ’মাসের বাচ্চা, মলিন আঁচল ধরে বছর চারেকের আর একটি শিশু.: বিনা অনুমতিতে উপরে উঠে আসা, এত স্পর্ধা, জমিদারের পেয়াদা কর্তৃক তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া, দুই শিশুকে আঁকড়ে ধরে ভয়ব্যাকুল মহিলার সিঁড়ি বেয়ে ত্রস্ত নিচে নেমে যাওয়া। দীর্ঘ সাত দশক ধরে, বিবিধ পাপকর্মের ফাঁকে-ফাঁকে, সেই অপস্রিয়মাণা নারীর কাছে অক্ষমের ক্ষমা প্রার্থনা করে যাচ্ছি।

মফস্বলের হাবা ছেলে আমি, বয়স আঠারো-ঊনিশ হবে হয়তো, আমাদের কালের প্রখ্যাত ছাত্র নেতা প্রশান্ত সান্যালের দিদি, অশ্রুকণা ভট্টাচার্য, কয়েকটা মাস আমাকে স্নেহের নিগড়ে বেঁধে রেখেছিলেন। অশ্ৰুদি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত ভালো ছাত্রী, ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই চমৎকার লিখতেন, তবে প্রথাগত লেখাপড়ার চর্চায় জড়িয়ে থাকেননি, বড়ো জোর কোনও কলেজে বা স্কুলে মাঝে-মধ্যে পড়িয়েছেন। প্রায়ই আমার সঙ্গে গল্প করতেন অশ্রুদি, সাহিত্যের গল্প, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিধ কেচ্ছাকাহিনী, কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতায় দ্রুত প্রভাব বিস্তারের বৃত্তান্ত, নারী আন্দোলনে নানা সমস্যার প্রসঙ্গ। ওঁর সঙ্গে আলাপচারিতা থেকে জীবনের সেই পর্বে প্রচুর প্রেরণা পেয়েছি, সাহিত্যিক তথা রাজনৈতিক প্রেরণা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, তবু তিনি আমার গতিবিধির খেয়াল রাখতেন, গোটা-গোটা অক্ষরে মাঝে-মধ্যে চিঠি দিতেন কুশল অনুসন্ধান করে। অশ্ৰুদি যখন মৃত্যুশয্যায়, খবর পাঠিয়েছিলেন, কী কারণে দেখতে যেতে পারিনি, এখন তো শুধু মনস্তাপ।

সম্ভবত আটাত্তর অথবা ঊনআশি সাল, জ্যোতিবাবুর সঙ্গে দিল্লি যাচ্ছি, আমরা বিমানের দোরগোড়ায় পাশাপাশি দুটি আসনে উপবিষ্ট, ডান দিকে তাকিয়ে দেখি একই সারণিতে চার-পাঁচটি আসন পেরিয়ে ভূপেশ গুপ্ত বসে আছেন, তিনিও দিল্লি যাচ্ছেন। ভূপেশবাবু আমাদের সহযাত্রী জ্যোতিবাবুকে তা জানালাম, জ্যোতিবাবুর নিরাসক্তি, যেন শুনেও শোনেননি, কিংবা ওধরনের সমাপতন তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, উনি গা করলেন না। জ্যোতিবাবুর উচ্ছ্বাসহীনতায় আমি থতমত, নিজেও উঠে গিয়ে ভূপেশবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসা থেকে বিরত রইলাম। খানিক বাদে ভূপেশবাবু একটি কম্বলে সারা শরীর ঢেকে ঘুমিয়ে পড়লেন, অন্তত তা-ই মনে হলো। পরের সপ্তাহে বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আমার ঘরে ঢুকলেন, ভূপেশবাবু নাকি দুঃখ করে বলেছেন, ‘জ্যোতি বসু-অশোক মিত্র কেউই আমাকে চিনলেন না।’ লজ্জায় শীর্ণ হয়ে বিশ্বনাথবাবুকে সেদিনকার ঘটনার বিবরণ দিলাম, অমার্জনীয় অপরাধ করেছি সেই স্বীকারোক্তি-সহ। এমনই ভাগ্যলিখন, কিছুদিনের মধ্যেই ভূপেশ গুপ্তের মৃত্যু, ওঁর সঙ্গে দেখা করে ক্ষমাভিক্ষার সুযোগ আর হলো না।

ষাটের দশকের বেশ কিছুটা সময় মধ্য কলকাতায় একটি সরকারি ফ্ল্যাটে অবস্থান করছিলাম। ওই ঠিকানায় এক ব্যস্ত দপ্তর, একশো-দেড়শো মানুষ হয়তো কাজ করতেন। প্রত্যহ ভোরবেলা চোখে পড়তো শতচ্ছিন্ন শাড়ি-পরিহিতা এক মধ্যবয়সী মহিলাকে, এক হাতে তোলা উনুন ঝোলানো, অন্য হাতে ময়দা-সব্জি-রান্নার সরঞ্জাম, কপালে চওড়া সিঁদুর, জিনিশের ভারে শরীর ঝুঁকে পড়েছে, সারা দিন দপ্তরের কর্মীদের চা-খুচরো খাবার পরিবেশন করতেন, সন্ধ্যার অন্ধকার নামলে দিনাতিপাতের সমস্ত ক্লান্তি নিয়ে ফিরে যেতেন, হয়তো মনোহরপুকুরের বস্তিতে, হয়তো যাদবপুরে উদ্বাস্তু কলোনির আশয়ে: দিনের পর দিন একই দৃশ্য। দেশভাগে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে যে-লাঞ্ছনা ও গ্লানির ঢল, ওই মহিলার গরিমাহীন বেঁচে থাকার সাধনার মধ্যে যেন সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রতিচ্ছায়া দেখতে পেতাম। অপরাধবোধে ডুবে যেতাম, এখনও যাই: আমার মতো কয়েকজন বাস্তুচ্যুত হওয়ার অভিশাপ থেকে ভাগ্যগুণে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছি, উনি পারেননি, লজ্জা আমাদের, ওঁর নয়, ওঁর কাছে আভূমিলম্বিত হয়ে যদি ক্ষমাপ্রার্থনা না করি, সেটা আমার কাপুরুষতা।

সাহস ও চিত্তঅবৈকল্যের একটি অত্যাশ্চর্য দৃষ্টান্ত। রাজ্যসভার অধিবেশনের ফাঁকে কী কারণে একদিন-দু’দিনের জন্য কলকাতা এসেছি। জনৈকা নিকটাত্মীয়া মাসখানেকের উপর অসুস্থ, কিছু খেতে পারছেন না, যাই-ই খাচ্ছেন বেরিয়ে আসছে, পাড়ার চিকিৎসকরা ধরতে পারছেন না ব্যাধির উৎস। সঙ্গে করে দিল্লি নিয়ে এলাম, পরদিন হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে তন্ন তন্ন পরীক্ষা, সোনোগ্রামে সন্ধ্যাবেলা ধরা পড়লো, কর্কট রোগ দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে, বাইরে অথচ কোনও ব্যথানুভব নেই, কলকাতার চিকিৎসকরা তাই ধরতে পারেননি; এখন যা অবস্থা, আয়ু সম্ভবত আর মাত্র মাসখানেক-মাসদেড়েক। মহিলা কলকাতায় ফিরতে চাইলেন, ফেরার পর অস্ত্রোপচার, কিন্তু কয়েক সপ্তাহের বেশি বাঁচলেন না।

যেদিন দিল্লিতে রোগ ধরা পড়লো, সন্ধ্যাবেলা পাণ্ডারা পার্কের বাড়ির বারান্দায় সবাই নিচু টেবিল ঘিরে উপবিষ্ট। আমাদের মুখে কথা সরছে না, একমাত্র সেই মহিলা নিজে অকুতোভয়। পরম উৎসাহে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি প্রকৃতি ও প্রেমের গান গাইলেন দাপটের সঙ্গে, এমনকি ‘আসিবে ফাল্গুন পুন, তখন আবার শুনো, নব পথিকের গানে নূতনেরই বাণী…’। এখানেই সাঙ্গ দিলেন না, আমাদের সঙ্গে মস্ত আলোচনায় যোগ দিলেন, ‘প্রকৃতি’ ও ‘প্রেম’ পর্যায়ের কোন-কোন গানগুলি কার কতটা পছন্দ, তাঁর নিজের কোন-কোনগুলি বেশি পছন্দ। যেন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি, যেন তাঁর ক্ষেত্রেও পৃথিবী প্রতিদিন যথানিয়মে সূর্যের চারপাশে আবর্তিত হবে, ব্যত্যয়ের প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। প্রাচীন সাহিত্যে এই মহিলাদেরই বোধহয় বীরাঙ্গনা বলে অভিহিত করা হতো।

বর্ধমানের কৃষ্ণচন্দ্র হালদার, কৃষক নেতা, প্রাক্তন রাজ্যমন্ত্রী ও সাংসদ, বয়সে আমার চেয়ে হয়তো দশ বছরের বড়ো, আস্তে কথা বলেন, আলাপে রুচির স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। রানীগঞ্জ না আসানসোল ঠিক মনে নেই, অন্য কমরেডদের সঙ্গে কেষ্টবাবুও আমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে যেতে এসেছেন। একটু হড়বড় করে নামতে গেছি, পা পিছলোবার উপক্রম, কেষ্টবাবুর অসমর্থ শরীর, লাঠি নিয়ে হাঁটেন, পতনোদ্যত আমাকে নিজের শারীরিক অসুবিধার কথা ভুলে গিয়ে দৃঢ় বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন, মস্ত দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচালেন, ধন্যবাদ দিতে গিয়ে লজ্জায় স্তব্ধ হয়ে এলাম। তাঁর সঙ্গে ইদানীং দেখা হয় না, প্রতিদিন মনে-মনে সম্ভাষণ জানাই।

যে যা-ই বলুক, পৃথিবীতে মহত্ত্বেরও শেষ নেই। জোন রবিনসন, বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনবিজ্ঞানী, আমাকে স্নেহদানে ধন্য করেছেন পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। চিন্তার দিক থেকে শ্ৰেণীত্যাগের তাঁর চেয়ে বড়ো উদাহরণ আমার অভিজ্ঞতায় চোখে পড়েনি৷ পিতা প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বৃটিশ সৈন্যাধ্যক্ষ, জোন ঐশ্বর্যের মধ্যে মানুষ হয়েছেন, কেমব্রিজে কেইনসের প্রিয় ছাত্রী, প্রথম জীবনে কেইনসের আদর্শ-ও তত্ত্ব ঘেঁষা জোনের গবেষণা-বইপত্তর। বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগ থেকে বিবেকের অলিন্দে উত্তরণ, উদারনীতি বর্জন করে সাম্যবাদে প্রত্যয়, তারপর একটু-একটু করে বাম থেকে অতিবাম বৃত্তে। আমাকে সঙ্গী করে তিনি পঞ্চান্ন সালে দশদিন ধরে মধ্যপ্রদেশের মন্দির-পর্বত-উপত্যকা ঘুরে বেরিয়েছিলেন, খজুরাহোর স্থাপত্যসৌন্দর্যে দৃশ্যত তাঁর একাগ্রতা নেই, ধৈর্য ধরে তিনি আমাকে বোঝাচ্ছেন সোভিয়েট নেতারা ‘লৌহ যবনিকা’ তৈরি করে সমাজের মহৎ উপকার করেছেন, পশ্চিমের কুরুচির নিদর্শনাদি আর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে ঢুকতে পারছে না। এই গোছের মতামত চেঁচিয়ে কেমব্রিজের রাস্তাঘাটে ব্যক্ত করতে তাঁর ন্যূনতম জড়তা ছিল না। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঘোর-লাগা মরশুমে চীন গিয়েছিলেন, বেজিং থেকে সোজা দিল্লি, মাও পোষাকভূষিতা, ভারতবর্ষে যে ক’দিন রইলেন, সর্বদা ওই পোশাকে। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন মাঝে-মাঝে কেমব্রিজ যেতাম, হইহই রইরই, জোন রবিনসন, যেন উৎসবের ঋতু, বামপন্থী অর্থনীতিবিদদের জড়ো করতেন, এক সঙ্গে আমরা ঘুরবো-ফিরবো-ভোজনকক্ষে প্রবেশ করবো, অন্যরা তাকিয়ে দেখুক পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আমাদের হাতের মুঠোয়, চিন্তার কন্দরে।

নির্বাচনের মাস, উদ্‌ভ্রান্তের মতো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, জেলা থেকে জেলান্তরে, বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছি। বাঁকুড়া জেলার মেদিনীপুর-ঘেঁষা এক প্রত্যন্ত গ্রাম, হয়তো রায়পুর কেন্দ্রে, হয়তো তালডাংরায়, ঊর্ধ্বশ্বাস বক্তৃতা দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমেছি, পাঁচ মাইল দূরে অনুষ্ঠেয় পরের নির্বাচনী সভায় যথাশীঘ্র পৌঁছুতে হবে। দু’টি আদিবাসী মেয়ে, ঠিক যুবতী নয়, কিশোরীই বলা চলে, সুন্দর সেজেছে, কপালে কাঁচপোকার টিপ, পুঞ্জিত অভিমান নিয়ে রাস্তা আটকে শাসন করলো: ‘এত কম সময় লিয়ে আসিস কেনে?’ তাদের ভর্ৎসনা বুকে কশাঘাতের মতো বাজলো। এদের স্নেহ-অনুরাগ-আনুগত্য আমরা কি স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছি? এরাই তো বাঁচায় আমাদের, অথচ এদের জন্য আমাদের সময়ের বরাদ্দ উড়ো-খই-গোবিন্দকে দেওয়ার মতো অবহেলার উপচার: এই পাপেরও তো ক্ষমা নেই। আসলে যতই গলাবাজি করি, বঞ্চনাদ্বীপ পার হয়ে এদের জনসমুদ্রের ঠিকানা দেখিয়ে দেওয়ার মুরোদ আমাদের নেই, এরা নিজেরাই পথ কেটে এগোবে।

বছর সতেরো আগে নরওয়েতে যে-দু’মাস কাটিয়েছিলাম, শেলী নাম্নী একটি বাংলাদেশী মেয়ে, মনসুর হবিবুল্লাদের সম্পর্কে জ্ঞাতি, আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়েছিল, তার সুনিপুণ গৃহস্থালির কাছে আত্মসমর্পণ করে নিশ্চিন্ত ছিলাম, তার বকুনি-শাসনের কাছেও আত্মসমর্পণ করে। বহুদিন তার খবর পাই না; যে-আদর তাকে যথাযোগ্য ফিরিয়ে দিতে পারিনি, তার স্মৃতি এখন অহরহ তাড়া করে ফেরে।

অন্য এক স্মৃতি। সকাল দশটা কি সাড়ে দশটার ব্যস্ত সময়, ক্যামাক স্ট্রিট দিয়ে এগোচ্ছি, মিডলটন স্ট্রিটের মুখে সুভো ঠাকুর রাস্তা পেরোচ্ছেন। গাড়ি থেকে নেমে আমার প্রীতিসম্ভাষণ: ‘সুভোবাবু, কেমন আছেন?’ পরনে শৌখিন বাটিকের-কাজ-করা লুঙ্গি, আজানুলম্বিত রঙিন কুর্তা, এক গাল হেসে সুভোবাবুর প্রত্যভিবাদন: ‘চোখে ভালো দেখতে পাই না, কানে শুনি না, দাঁতগুলো সব খসে পড়েছে, লিভারে পচন, জানেন তো স্ত্রীবিয়োগ ঘটেছে, নিদারুণ অর্থকষ্ট, কিন্তু খাশা আছি।’

কলেজ স্কয়্যারের কফি হাউসে, হয়তো পঞ্চাশ দশকের মধ্যক্ষণে, নয়তো ষাটের দশকের উত্তাল মুহূর্তে, প্রায়ই এক সতত-অস্থির যুবকের সঙ্গে দেখা হতো। অপুষ্টিতে শীর্ণ শরীর, আর্থিক দৈন্যের ক্লিষ্টতা তাকে জড়িয়ে, মলিন আকাচা পরিধেয়, পায়ে ক্ষয়ে-যাওয়া চটি, অথচ চোখ দু’টি এক অজ্ঞাত আবেগে জ্বলছে। গ্রাসাচ্ছাদনের সামর্থ্য নেই, কিন্তু, কখনও-কখনও পয়সার অভাবে পায়ে হেঁটেই, যুবকটির প্রত্যহ আলিপুরে জাতীয় গ্রন্থাগারে গিয়ে পুঁথি ঘাঁটা চাই, সে গবেষণায় ব্যাপৃত, বিষয় অষ্টাদশ শতকীয় ফরাশি রন্ধনশিল্প। বাঙালি সাহস, বাঙালি রোমান্টিকতা, অসম্ভবকে হাতের নাগালে পাওয়ার দুর্মর দুরাশা। কোথায় সেই যুবক হারিয়ে গেছে জানা নেই, তার সাহসের স্মৃতি অথচ অহরহ প্রহার করে।

নিরন্তর প্রহৃত হই এক ক্ষোভযুক্ত গ্লানিবোধ থেকেও। পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী সুশীল চৌধুরী, প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে প্রায় বার্ধক্যে উপনীত, নিষ্ঠা, সততা ও ভালোত্বের মাপকাঠিতে তাঁর তুলনা নেই, নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেলেন, অথচ আজ পর্যন্ত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই অকৃতকার্যতার দায়ভার কেউ-ই তো আমরা এড়াতে পারি না, বিবেককে কোন প্রণালীতে ঘুম পাড়িয়ে রাখবো?

উত্তপ্ত রাজনৈতিক তর্ক চলছে, আদর্শ ও নীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ; যুক্তির প্রয়োগে অসফল বলেই হয়তো, আমার দিক থেকে বিবেকের প্রসঙ্গ উত্থাপন; এক শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক নেতা আমাকে উদ্দেশ করে কেটে-কেটে বললেন, ‘মশাই, আপনি ধরে নিয়েছেন আপনার একারই বিবেক আছে, আমাদের নেই?’ যে-ভর্ৎসনা আমার প্রাপ্য, তা-ই পেলাম। যার নম্রতা নেই সে নিঃস্ব। ভোরের বেলার তারার কাছে আমার কিছু কথা আছে, কিন্তু এমন কথা লক্ষ-কোটি অন্য মানুষদেরও তো আছে, তাঁদের কাছে তাঁদের কথার গুরুত্ব আমার কাছে আমার কথার গুরুত্ব থেকে কোনও অংশে কম নয়। নিজেকে সংবৃত রাখার চেয়ে বড়ো কর্তব্য তাই, মানতেই হয়, অচিন্তনীয়।

সেই ন্যূনতম কর্তব্যপালনে আমি বরাবর ব্যর্থ। সুভো ঠাকুরের অবিচল নিরাসক্তিও আমার আয়ত্তের বাইরে। আরও যা যোগ করতে হয়, ‘এক বর্ষার বৃষ্টিতে যদি মুছে যায় নাম,/এত পথ হেঁটে, এত জল ঘেঁটে কী তবে হলাম’, অন্তরঙ্গ কবিবন্ধুর এই আর্তবিলাপের শরিক হওয়ারও আমি সমান অনুপযুক্ত। সায়াহ্ণসময়ে নিঃশেষ, নিশ্চিহ্ণ হয়ে যেতে চাই আমি, যে-কারও স্মৃতির ঝোলায় আমার একদা-অস্তিত্বের কুটোটিও যেন না পড়ে থাকে।

তা হলেও এই অকিঞ্চৎকর জীবনে দু’টি আলাদা, পরিস্বচ্ছ, চরিতার্থতাবোধ: এক, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমার জন্ম; দুই, আমার চেতনা জুড়ে মার্কসীয় প্রজ্ঞার প্লাবিত বিভাস।

আপিলা-চাপিলাদের পালা ফুরোলো।

অধ্যায় ৪০ / ৪০

সকল অধ্যায়

১. আপিলা-চাপিলা – ১
২. আপিলা-চাপিলা – ২
৩. আপিলা-চাপিলা – ৩
৪. আপিলা-চাপিলা – ৪
৫. আপিলা-চাপিলা – ৫
৬. আপিলা-চাপিলা – ৬
৭. আপিলা-চাপিলা – ৭
৮. আপিলা-চাপিলা – ৮
৯. আপিলা-চাপিলা – ৯
১০. আপিলা-চাপিলা – ১০
১১. আপিলা-চাপিলা – ১১
১২. আপিলা-চাপিলা – ১২
১৩. আপিলা-চাপিলা – ১৩
১৪. আপিলা-চাপিলা – ১৪
১৫. আপিলা-চাপিলা – ১৫
১৬. আপিলা-চাপিলা – ১৬
১৭. আপিলা-চাপিলা – ১৭
১৮. আপিলা-চাপিলা – ১৮
১৯. আপিলা-চাপিলা – ১৯
২০. আপিলা-চাপিলা – ২০
২১. আপিলা-চাপিলা – ২১
২২. আপিলা-চাপিলা – ২২
২৩. আপিলা-চাপিলা – ২৩
২৪. আপিলা-চাপিলা – ২৪
২৫. আপিলা-চাপিলা – ২৫
২৬. আপিলা-চাপিলা – ২৬
২৭. আপিলা-চাপিলা – ২৭
২৮. আপিলা-চাপিলা – ২৮
২৯. আপিলা-চাপিলা – ২৯
৩০. আপিলা-চাপিলা – ৩০
৩১. আপিলা-চাপিলা – ৩১
৩২. আপিলা-চাপিলা – ৩২
৩৩. আপিলা-চাপিলা – ৩৩
৩৪. আপিলা-চাপিলা – ৩৪
৩৫. আপিলা-চাপিলা – ৩৫
৩৬. আপিলা-চাপিলা – ৩৬
৩৭. আপিলা-চাপিলা – ৩৭
৩৮. আপিলা-চাপিলা – ৩৮
৩৯. আপিলা-চাপিলা – ৩৯
৪০. আপিলা-চাপিলা – ৪০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন