বকরীদ

কাজী নজরুল ইসলাম

বকরীদ

‘শহিদান’দের ঈদ এল বকরীদ!
অন্তরে চির-নওজোয়ান যে তারই তরে এই ঈদ।
আল্লার রাহে দিতে পারে যারা আপনারে কোরবান,
নির্লোভ নিরহংকার যারা, যাহারা নিরভিমান,
দানব-দৈত্যে কতল করিতে আসে তলোয়ার লয়ে,
ফিরদৌস হতে এসেছে যাহারা ধরায় মানুষ হয়ে,
অসুন্দর ও অত্যাচারীরে বিনাশ করিতে যারা
জন্ম লয়েছে চিরনির্ভীক যৌবন-মাতোয়ারা, –
তাহাদেরই শুধু আছে অধিকার ঈদ্গাহে ময়দানে,
তাহারাই শুধু বকরীদ করে জান মাল কোরবানে।
বিভুতি, ‘মাজেজা’, যাহা পায় সব প্রভু আল্লার রাহে
কোরবানি দিয়ে নির্যাতিতেরে মুক্ত করিতে চাহে।
এরাই মানব-জাতির খাদেম, ইহারাই খাক্‌সার,
এরাই লোভীর সাম্রাজ্যেরে করে দেয় মিসমার!
ইহারাই ‘ফিরোদৌস-আল্লা’র প্রেম-ঘন অধিবাসী
তসবি ও তলোয়ার লয়ে আসি অসুরে যায় বিনাশি।
এরাই শহিদ, প্রাণ লয়ে এরা খেলে ছিনিমিনি খেলা,
ভীরুর বাজারে এরা আনে নিতি নব নওরোজ-মেলা!
প্রাণ-রঙ্গিলা করে ইহারাই ভীতি-ম্লান আত্মায়,
আপনার প্রাণ-প্রদীপ নিভায়ে সবার প্রাণ জাগায়।
কল্পবৃক্ষ পবিত্র ‘জৈতুন’ গাছ যথা থাকে,
এরা সেই আশমান থেকে এসে, সদা তারই ধ্যান রাখে!
এরা আল্লার সৈনিক, এরা ‘জবীহুল্লা’-র সাথি,
এদেরই আত্মত্যাগ যুগে যুগে জ্বালায় আশার বাতি।
ইহারা, সর্বত্যাগী বৈরাগী প্রভু আল্লার রাহে,
ভয় করে নাকো কোনো দুনিয়ার কোনো সে শাহানশাহে।
এরাই কাবার হজের যাত্রী, এদেরই দস্ত চুমি!
কওসর আনে নিঙাড়িয়া রণক্ষেত্রের মরুভূমি!
‘জবীহুল্লা’র দোস্ত ইহারা, এদেরই চরণাঘাতে,
‘আব-জমজম’ প্রবাহিত হয় হৃদয়ের মক্কাতে।
ইব্রাহিমের কাহিনি শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ?
আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু ছাগ?
আল্লার নামে, ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি
পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী?
সেই মুসলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম করি তারে,
ঈদ্গাহে গিয়া তারই সার্থক হয় ডাকা আল্লারে।
অন্তরে ভোগী, বাইরে যে রোগী, মুসলমান সে নয়,
চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য যে পরিচয়!
লাখো ‘বকরা’র বদলে সে পার হবে না পুলসেরাত
সোনার বলদ ধনসম্পদ দিতে পার খুলে হাত?
কোরান মজিদে আল্লার এই ফরমান দেখো পড়ে,
আল্লার রাহে কোরবানি দাও সোনার বলদ ধরে।
ইব্রাহিমের মতো পুত্রেরে আল্লার রাহে দাও,
নইলে কখনও মুসলিম নও, মিছে শাফায়ৎ চাও!
নির্যাতিতের লাগি পুত্রেরে দাও না শহিদ হতে,
চাকরিতে দিয়া মিছে কথা কও– ‘যাও আল্লার পথে’!
বকরীদি চাঁদ করে ফরয়্যাদ, দাও দাও কোরবানি,
আল্লারে পাওয়া যায় না করিয়া তাঁহার না-ফরমানি!
পিছন হইতে বুকে ছুরি মেরে, গলায় গলায় মেলো,
কোরো না আত্ম-প্রতারণা আর, খেলকা খুলিয়া ফেলো!
উমরে, খালেদে, মুসা ও তারেকে বকরীদে মনে কর,
শুধু সালওয়ার পরিয়ো না, ধরো হাতে তলোয়ার ধরো!
কোথায় আমার প্রিয় শহিদল মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ?
এসো ঈদের নামাজ পড়িব, আলাদা আমাদের ময়দান!

সকল অধ্যায়

১. রবির জন্মতিথি
২. বড়োদিন
৩. নবযুগ
৪. শোধ করো ঋণ
৫. মোহররম
৬. আর কত দিন?
৭. বিশ্বাস ও আশা
৮. ডুবিবে না আশাতরি
৯. কোথা সে পূর্ণযোগী
১০. হুল ও ফুল
১১. সুখবিলাসিনী পারাবত তুমি
১২. জাগো সৈনিক-আত্মা
১৩. কেন আপনারে হানি হেলা?
১৪. নবাগত উৎপাত
১৫. নারী
১৬. নিত্য প্রবল হও
১৭. আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন
১৮. চির-বিদ্রোহী
১৯. ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা
২০. সকল পথের বন্ধু
২১. তোমারে ভিক্ষা দাও
২২. ছন্দিতা
২৩. পুরববঙ্গ
২৪. আরতি
২৫. পার্থসারথি
২৬. আত্মগত
২৭. কাবেরী-তীরে
২৮. অমৃতের সন্তান
২৯. শাখ-ই-নবাত
৩০. কবির মুক্তি
৩১. টাকাওয়ালা
৩২. কচুরিপানা
৩৩. বকরীদ
৩৪. আল্লার রাহে ভিক্ষা দাও
৩৫. একি আল্লার কৃপা নয়?
৩৬. মহাত্মা মোহ্‌সিন
৩৭. এক আল্লাহ্‌ ‘জিন্দাবাদ’
৩৮. গোঁড়ামি ধর্ম নয়
৩৯. জোর জমিয়াছে খেলা
৪০. বোমার ভয়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন