১৫. ইলিং থেকে আলবানি স্ট্রীট

সৈয়দ শামসুল হক

ইলিং থেকে আলবানি স্ট্রীট দূর হলেও সোজা রাস্তা। ওয়েস্টার্ন এভ্যেনু ধরে গেলেই হলো। মাদাম ত্যুসো-র মোমপুতুলের যাদুঘর পেরিয়ে একটু পরেই বাঁ হাতি রাস্তা। ভাইয়ানের হাতে গাড়ি উড়ে চলে। মাহজাবীন অনেকক্ষণ কোনো প্রসঙ্গ তোলে না বলে, তার সন্দেহ হয়, মেয়েটি তাকে অপছন্দ করছে না তো?

ভাইয়ান অনেক ভেবে কোনো প্রসঙ্গ না পেয়ে হাতের কাছে যা খুঁজে পায় তাই তোলে। গাড়ি কেমন?

মাহজাবীন সংক্ষেপে উত্তর দেয়, উত্তম।

তুমি কি একেবারেই বাংলা বলতে পার না?

কিছু কিছু পারি। অনেক বুঝি।

এই তো সুন্দর বাংলা বলছ।

ভালো একসপ্রেশন হয় না।

চেষ্টা করলেই হবে। বাঙালি মেয়ে, বাবা-মা বাঙালি, চেষ্টা করলেই হয়ে যাবে। ইংরেজ তো আর নও।

 লোকটির কথা শুনে গাড়ল মনে হয় মাহজাবীনের। তবু অলবানি স্ট্রীটে লোকটার ঘাড়ে চেপে যাওয়া যাচ্ছে, মাহজাবীন মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখে।

পেছন থেকে অনেকক্ষণ পর বারী মুখ খোলে। মাহজাবীনকে লক্ষ্য করে বলে, বুঝতে পারছেন না? বাংলায় একটা কথা আপনার মুখ থেকে শুনতে চায়। গাড়ির কথা জিগ্যেস। করছিল, গাড়ি কেমন? গাড়ি নয়, নিজে কেমন সেটাই আসল প্রশ্ন। দিয়ে দিন উত্তর। বলে হা হা করে হাসে লোকটা।

বুঝিলাম না।

জানিতে চায়, গাড়ি নয়, গাড়ির মালিক আপনার পছন্দ হইয়াছে কি?

বড় স্কুল মনে হয় মাহজাবীনের। এক ঘণ্টার আলাপেই এরা একটি মানুষের পাজামার ভেতর ঢুকে পড়তে চায়। নিষ্ঠুরভাবে সে খেলাতে শুরু করে তখন। বারীকে বলে, আপনি বিবাহিত?

না। সৌভাগ্যবান নহি।

বিবাহ করিবেন?

কন্যা পাইলে করিব।

কন্যা পান নাই।

পাইয়াছি অনেক। পছন্দ হয় নাই।

এখনো বাজার করিয়া চলিয়াছেন?

হাঁ, আশা ছাড়ি নাই।

মুল্যহ্রাসের আশায় রহিয়াছেন কি?

রসিকতাটি ঠিক রসিকতা নয় বলে বারীর সন্দেহ হয়। সে হাসতে গিয়েও আধখানা হেসে বিসদৃশভাবে চুপ হয়ে যায়।

লক্ষ রাখিবেন, ইতিমধ্যে স্বয়ং আপনার মূল্য না হ্রাস হইয়া যায়। ঈশ্বর না আপনার দেহে বিরাট মূল্যহ্রাস ঝুলাইয়া দেন।

গুম হয়ে যায় বারী। গোড়াতেই তাকে যে এতদুর টেনে আনা হয়েছিল, এর জন্যে আবার সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে মনে মনে।

মাহজাবীন এবার ভাইয়ানকে নিয়ে পড়ে। তার ওপর রাগটা আরো বেশি, কারণ এই লোকটিই তো ইয়াসমিনকে গাভীর মতো ব্যবহার করতে চায়।

আপনি কী রকম বাজার করিয়াছেন?

আমি? না, একেবারেই না, মোটেই না।

আমিই প্রথম?

ভাইয়ান আমতা আমতা করে।

মাহজাবীন বলে, সত্য বলিলে কিছু মনে করিব না।

ভাইয়ান বলে, মিথ্যে করে বলে, এই প্রথম কন্যা দেখিতে আসিলাম।

ইংরেজিতে মিথ্যে কথাটা বলে ততটা অপরাধী মনে হয় না নিজেকে।

আমাকে পছন্দ হইয়াছে?

তোমার কী মনে হয়?

মাহজাবীনও মেয়েলিপনা করে, সুর তুলে, বাংলা জবাব দেয়, কেন বলব? মেয়ে বলে না। ছেলে বলে।

ভাইয়ান শরীরের ভেতরে শিহরণ অনুভব করে। এমনকি সে গিয়ার বদলাবার ছুতোয় মাহজাবীনের উরু ছুঁয়ে দেয়। রাগে ভেতরটা দপদপ করতে থাকে মাহজাবীনের। একটা নিষ্ঠুর খেলা তার মাথায় আসে। আর সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়ে ফিরে যায় সে।

চুপ করিয়া আছেন কেন? উত্তর দিন। পছন্দ হইয়াছে?

হাঁ খুব পছন্দ তোমাকে।

সত্য?

ঈশ্বর উপরে। আমার বিষয়ে কিছু বলিলে না?

কী বলিব?

আমাকে পছন্দ কিনা?

আমরা যেরূপ শিক্ষা পাইয়াছি, পুরুষের পছন্দকেই একমাত্র জ্ঞান করি। আমি আপনার উপযুক্ত হইতে পারিব কিনা কে জানে, আপনি যে আমাকে দয়া করিয়া পছন্দ করিয়াছেন, আমি সৌভাগ্য বিবেচনা করিতেছি।

ভাইয়ান হাতে চাঁদ পাবার সুখ অনুভব করে। অন্তরে বাঙালি বাইরে ইংরেজ, সোনায় সোহাগা আর কাকে বলে? একেবারে জাত ইংরেজ মেয়ে ঘরে আনতে তার যেমন ভয়, তেমিন পুঁইশাকের গন্ধমাখা বাঙালি মেয়ে তার বিবমিষার উদ্রেক করে। অথচ দুটোরই মজার দিক সে লুটতে চায়। এরকম ভাগে ভাগ আর সে কোথায় পেত। খুশিতে সে মাহজাবীনের কাছে একটা হাতই ক্ষণকালের জন্যে ছুঁইয়ে দেয় বিনা ছুতোয়।

পেছন থেকে খসখসে গলায় বারী বলে, মাদাম তুসো পেরিয়ে গেলাম, ডাক্তার সাহেব। আলবানি স্ট্রীটে যাচ্ছেন তো?

সকল অধ্যায়

১. ০১. শনি আর রোববার ছুটির দিন
২. ০২. তিনটে শোবার ঘর
৩. ০৩. ইয়াসমিন চা নিয়ে আপিস ঘরে এলো না
৪. ০৪. ম্যানচেস্টার থেকে নটার দিকে
৫. ০৫. বজুলল করিম সাহেব আসবেন
৬. ০৬. ইয়াসমিন আজ নবজন্ম গ্রহণ করিল
৭. ০৭. রাগের মাথায় বললেও
৮. ০৮. মাহজাবীন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে
৯. ০৯. এক প্রস্থ ধোঁয়া গেলার পর
১০. ১০. শাপলা ট্রাভেল এজেন্সির সাইনবোর্ড
১১. ১১. অত্যন্ত নিশ্চিত ও মূল্যবান সামগ্রী
১২. ১২. আপিস ঘরে বারী আর ভাইয়ান
১৩. ১৩. গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে
১৪. ১৪. বজলুল করিম টিকিটটা ভালো করে দেখে
১৫. ১৫. ইলিং থেকে আলবানি স্ট্রীট
১৬. ১৬. অধিকার বোধের পাখায় ভর করে
১৭. ১৭. নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছি
১৮. ১৮. ঘুম আসে না ইয়াসমিনের

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন