১৪. বজলুল করিম টিকিটটা ভালো করে দেখে

সৈয়দ শামসুল হক

বজলুল করিম টিকিটটা ভালো করে দেখে নিয়ে বেশ যত্ন করে পকেটে রেখে, চোখ থেকে চশমা নামিয়ে খাপে পুরে, খাপটি কোটের পকেটে রেখে, টেবিলে দুহাত জড়ো করে বলেন, আলি সাহেব, একটা ইনফরমেশন দিতে পারেন?

বলুন।

ঢাকায় তো যাচ্ছি। ঢাকা থেকে সঙ্গে কাউকে আনতে হলে, তার টিকিট কি এখান থেকে কেনা যায়? আমি শুনেছি, ঢাকায় লন্ডনের টিকিট কেনা অনেক ঝামেলা। পারমিশনের ব্যাপার আছে।

ব্যবসা ছেড়ে দিতে নেই। আলি বলেন, এখান থেকে টিকিট নিয়ে যাওয়াই ভালো। আপনি এখানে দাম দেবেন, অ্যাডভাইস চলে যাবে ঢাকায়, টিকিট সেখানে নিয়ে নেবেন। ভেতরের কলকজা আর বিশেষ খুলে বললেন না আলি।

তাহলে আপনি তাই অ্যাডভাইস করছেন?

হাঁ। আমিই আপনাকে করিয়ে দিতে পারি। কজন আসবে?

একজন। সেই একজনই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যবসাটা পাবার জন্য আলি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন।

তা এ রকম বোঝা তো আমাদের বইতেই হয়। তবু তো আপনি এখানে আছেন, পাউন্ড রোজগার করছেন, দেশের বোঝা যতই হোক, অতটা নয়। টাকায় উপার্জন করে বোঝা। টানা, সে যারা টানে তারা বোঝে।

তা অবশ্য।

ভদ্রলোককে বেশ বিচলিত দেখায়। আলির চোখ এড়ায় না।

যাকে আনতে চান তার এনট্রি পারমিট এ-সব আছে তো? সে কিন্তু লম্বা ঝামেলা। বিশেষ করে এখন।

না, না, সে-সব আছে। কোনো অসুবিধে নেই। আমারই মেয়ে, এখানে এতদিন আমার কাছেই ছিল।

আলি হঠাৎ ব্যবসায়ী থেকে পিতা হয়ে যান। কৌতূহল হয় তার।

আপনার মেয়ে?

হাঁ, আমার মেয়ে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। তাকে আনতেই দেশে যাচ্ছি। আর বলবেন না। ভদ্রলোক সখেদে উচ্চারণ করে গুম হয়ে বসে থাকেন খানিক।

পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কেন?

না পাঠিয়ে উপায় ছিল না। বাঙালিয়ানা সব ভুলে যাচ্ছিল। আমাদের ফ্যামিলিতে ও-সব তো চলে না। একেবারে বাড়াবাড়ি দেখে বহুকষ্টে জোরজার করে বছরখানেক আগে ঢাকা পাঠিয়ে দিই আমার শশুরের কাছে।

আলি ব্যগ্র হয়ে জিগ্যেস করেন, তারপর?

একে সেখানে বাবা নেই, মা নেই, নানা-নানী। আলি সাহেব, অনেকদিন থেকেই আপনাকে জানি, নিজের লোক মনে করি, তাছাড়া আপনারও ফ্যামিলি আছে, ঢাকা নাকি এখন লন্ডনকেও ছাড়িয়ে গ্যাছে।

বলেন কী? এত অভাব অভিযোগ।

রাখুন সাহেব অভাব অভিযোগ। সে তো নিচের তলায়। আর অভাব অভিযোগের সঙ্গে তো আপনার, কী বলে, ভ্যালু জাজমেন্ট বা মরালিটির কোনো সম্পর্ক নেই। ঢাকায় মেয়েরা এখন যা করছে অনেক ইংরেজ মেয়েও নাকি তা করতে দুবার চিন্তা করবে।

প্রতিবাদ করতে প্রেরণা পান আলি, কিন্তু নিজের মেয়ের কথা টেনে যখন বলছেন, ভদ্রলোককে অবিশ্বাস করবার কোনো কারণ থাকে না।

করিম সাহেব বলেন, যাকগে, এখন ঠিক করেছি ফিরিয়ে আনব। আমার কাছেই রাখব। কাছে থেকেই সহ্য করতে পারি নি, দূর থেকে শুনে কি সহ্য হয়? আপনি তাহলে মেয়ের একখানা টিকিটের ব্যবস্থা করে দিন।

শুকনো গলায় আলি বলেন, করব। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি দিয়ে আসব। আপনার বাসায়।

সে তো ভালোই হয়, খুব ভালো হয়। আমার যা মনের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। মেয়েকে নিয়ে না আসা পর্যন্ত শান্তি নেই। সে তো আসতেই চায় না। তাই যাচ্ছি।

আসতে চায় না কেন?

তেতো গলায় করিম সাহেব বলেন, নিজে বোঝেন না? সেখানে সুযোগও আছে, স্বাধীনতাও আছে।

টিকিটের দাম চেক লিখে দিয়ে বজলুল করিম ধীর পায়ে বেরিয়ে যান।

সকল অধ্যায়

১. ০১. শনি আর রোববার ছুটির দিন
২. ০২. তিনটে শোবার ঘর
৩. ০৩. ইয়াসমিন চা নিয়ে আপিস ঘরে এলো না
৪. ০৪. ম্যানচেস্টার থেকে নটার দিকে
৫. ০৫. বজুলল করিম সাহেব আসবেন
৬. ০৬. ইয়াসমিন আজ নবজন্ম গ্রহণ করিল
৭. ০৭. রাগের মাথায় বললেও
৮. ০৮. মাহজাবীন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে
৯. ০৯. এক প্রস্থ ধোঁয়া গেলার পর
১০. ১০. শাপলা ট্রাভেল এজেন্সির সাইনবোর্ড
১১. ১১. অত্যন্ত নিশ্চিত ও মূল্যবান সামগ্রী
১২. ১২. আপিস ঘরে বারী আর ভাইয়ান
১৩. ১৩. গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে
১৪. ১৪. বজলুল করিম টিকিটটা ভালো করে দেখে
১৫. ১৫. ইলিং থেকে আলবানি স্ট্রীট
১৬. ১৬. অধিকার বোধের পাখায় ভর করে
১৭. ১৭. নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছি
১৮. ১৮. ঘুম আসে না ইয়াসমিনের

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন