যে যেখানে যায় – ৭

বাণী বসু

যশোধরা আর মধুক্ষরা কারও কথা শোনেনি। সোজা দার্জিলিং চলে এসেছে। স্বামীদের নিরুৎসাহ দেখে, স্রেফ ছেলেমেয়েদের বলল—ভোটাধিকার হয়ে গেল, সংসার সামলাতে শেখো। কবে যে তারা হোটেল বুক করেছে, কাকে দিয়ে যে কাঞ্চনজঙ্ঘার টিকিট কাটাল কেউ বোঝেনি। তবে দীর্ঘ দিনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকেরই ফল এসব বোঝাই যাচ্ছে। পাবলো এবং শম্পি আকাশ থেকে পড়েছিল।

সংসার সামলানো মানে? দু’জনেই চলে যাচ্ছ? বাঃ চমৎকার। হলিডের দরকার তো আমাদের। আমরাই পরীক্ষা দিয়ে উঠলুম, শম্পি বলে।

হ্যাঁ, সব দরকারই তো তোমাদের। গিন্নিদের মায়েদের আর কোনও দরকার অধিকার থাকতে নেই। ও—সব আমরা জানি।

কিন্তু মানছ না—এই তো! পাবলো বলে—ঠিক আছে। কিন্তু আমরা আমাদের মতো চালাব। সেখানে কোনও রিমোট কন্ট্রোল চলবে না।

হুঁ, রিমোট কন্ট্রোল। যশো হাসে, দড়িদড়া ছিঁড়ে চলে যাচ্ছি। কোনও পিছটান রাখছি না। তবে সার কথাটি শুনে রেখো, সুহৃৎবরণ আর মিহিরকিরণ খেটেখুটে এসে যেন শোবার বিছানা, চানের জল, খাবার—দাবার পায়। এই খবরটি রাখব।

.

দুঃখের বিষয় কাঞ্চনজঙ্ঘার এসি টু—তে বহু পরিচিতর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মিনি, তাঁর স্বামী বিজেনদা প্রথমেই।

এ কী মিনি? তোরা যাচ্ছিস জানতুম না তো!

নেমে যাবি ভাবছিস নাকি!

কী যে বলিস! তা মধুবন কই?

সে—ও বেড়াতে গেছে।

বন্ধুদের সঙ্গে?

উঁ। তারা দু’ভাইবোন গেছে পরিদের গাঁয়ে। ঋজু কী সব পেপার করছে। পরিদের গ্রাম টার্গেট। ঝুলোঝুলি করে মধুবনও গেছে। আমরা ফ্রি।

পরি কে? জলপরি না স্থলপরি।

ও আমাদের কাজের মেয়ে। মুড়কিশোলা বলে একটা গ্রামে থাকে।

বলো কী! অমনি পাঠিয়ে দিলে! যদি অ্যাবডাক্ট হয়ে যায়! মধু বলল।

দেব না কেন? বড় হয়েছে, নিজেরা ঘুরুক ফিরুক দেখুক শুনুক।

বিজেন বললেন—আরে ভাবছেন কেন! আমাদের রুস্তম হয়েছে সঙ্গে। পরি মেয়েটাও খুব রেসপন্সিবল।

আর আপনাদের চৌকি?

তাকে কেনেলে দিয়েছি। সে—ও হলিডে কাটাচ্ছে।

ট্রেন ছাড়তেই ওদিক থেকে একটি উল্লসিত পুরুষকণ্ঠ বলে উঠল—আরে যশো না! মধুও তো রয়েচিস!

সামনে এগিয়ে আসছে ব্যাঙাদা। মাথা—ভরতি পাকা চুল। দাড়িফাড়ি কামায়নি, আজকাল এই এক ফ্যাশন হয়েছে।

ওগো এদিকে শুনে যাও একবার—গলা ছেড়ে ডাকলেন ব্যাঙাদা। ওদিক থেকে একটি পুতুল—পুতুল সুন্দরী মহিলা উঠে এলেন।

আলাপ করো। এই হল যশোধরা ব্যানার্জি—একসময় দারুণ নাচত। আমাদের হার্টথ্রব ছিল। আর এই ওর বোন মধুক্ষরা—মধুর মতোই গলা ছিল, আহা। সিরিয়াস হলে আজ অনেকের ভাত মারতে পারত। যশো দেখ—এই হল তোদের শান্টুবউদি। ফিগার দেখছিস তো। শ্যামা সাজে। চিত্তপ্রসাদের ট্রুপে।

আহ তোমার যত্ত—শান্টুবউদি বলে উঠলেন।

ভালই হল। তোরাও দার্জিলিং আমরাও।

হেঁ হেঁ—যশোর মুখে এর চেয়ে বেশি কথা জোগাল না।

চলে যেতে নিচু গলায় মধু বলল—তুমি যাও দুর্জয়লিঙ্গে ব্যাঙা যায় সঙ্গে।

তুই চুপ কর। ব্যাঙার বেঙিটিকে দেখলি।

হুঁ, চালু মাল। কত তফাত হবে বল তো বয়সের?

বছর কুড়ি বলে মনে হচ্ছে, তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। চুলটা পরচুলো।

সে কী রে? কী করে বুঝলি?

নাট্যশালা, বুঝলি না! দ্যাখ না কত রকম চুলের কায়দা বেরোবে। অন্তত তিন—চারখানা উইগ নিয়ে এসেছে।

তার মানে কি ন্যাড়া? না টাক?

ভগবান জানেন, ক্রমশ প্রকাশ্য।

যাই বল দিদি। তুই একটু বেশি ক্রিটিক্যাল, রাইভ্যাল তো! হিংসে হয়েছে!

হুঁঃ হিংসে। হিংসে! হিংসে করার আর লোক পেল না যশো।

জলপাইগুড়িতে নামতে দেখা গেল স—শাশুড়ি পঙ্কজের বাবা বিনোদ ও মা সন্তোষ হাজির। এঁদের যশোরা চিনত না। কিন্তু ওঁরা কোন ছবিতে এঁদের দেখেছিলেন। তাতেই চিনে গেলেন। কী ছবি? না ‘রোজগেরে গিন্নি’। তাতে যশো, মধু, তাদের ছেলেমেয়ে (প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও) উপস্থিত ছিল। খুবই উৎসাহ নিয়ে যশোর নাচ দেখেছিলেন ওঁরা। যশোর নাচ, মধুর গান।

সঙ্ঘমিত্রও নামলেন স—স্বামী।

তুমিও?

অসুবিধে হল? সঙ্ঘমিত্রা হেসে জিজ্ঞেস করলেন।

ছেলে?

বাড়িতে আছে। জ্যাঠাইমার তত্ত্বাবধানে। আমরা কেটে পড়েছি।

পড়ে যশো তার বোনকে বলে—সঙ্ঘদির হাসিটা কীরকম গা—জ্বালানি দেখলি?

মধু আবারও বলে—আমি তো তেমন কিছু দেখলুম না। তুমি একটু বেশি ক্রিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছ দিদি।

যাক ভাল ওদের হোটেলে অন্তত কেউ ওঠেনি। কোনও চেনা মুখ না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দু’জনে দুটো চেয়ারে কাত হল।

যশো বলে—কী মজা হাঃ হাঃ হাঃ।

মধু বলে—শেষ পর্যন্ত ফিরি। যা হালকা লাগছে। যেন দু’মনি বোঝা চেপেছিল ঘাড়ে। অমন জানলে কে বিয়ে—থা করত?

যশো বলল—বাবার যা ছিল দু’বোনের হেসেখেলে চলে যেত, বল। আজ দার্জিলিং, কাল গোয়া…

মধু বলল—পরশু সিঙ্গাপুর তরশু ইউরোপ। সত্যি এই সংসারের ঝক্কি ঝামেলা…

এই রে! হঠাৎ যশো তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।

কী হল?

চাবিটা আলমারিতে ঝুলিয়ে এসেছি।

তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। লোকজন আসার আগে পাবলো দেখে ফেলবে এখন।

ওইখানেই তো ভয়! ও ছেলে যে কী হাপিস করবে আর কী করবে না—বন্ধুবান্ধব মিলে…

মধু বলল—ইসস আমিও তো একটা মহা ভুল করে ফেলেছি!

কী?

মিহিরের ব্লাড সুগার এসেছে। খাওয়া—দাওয়ার রেসট্রিকশন করতে বলেছে। আমি তো শম্পিকে কিচ্ছু বলে আসিনি! এমনকী মিহির নিজেও জানে না।

তা হলে তো ফোন করতে হয়।

দু’জনেই ফোনে অনেকক্ষণ টেপাটেপি করেও কোনও কল পেল না। সমানে বলে যাচ্ছ—সুইচড অফ, সুইচড অফ।

আসলে কী জানিস তো। ওই যে বলল রিমোট কন্ট্রোল চলবে না, তাই বোধহয় বন্ধ করে রেখেছে।

তাই বলে একটা পৌঁছোনোর সংবাদ দেব সে প্রভিশন রাখবে না। তা ছাড়া মোবাইল অফ করে রাখলে ওদের চলবে? হাজার গন্ডা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গুলতানিটা হবে কী করে?

ল্যান্ডফোনও দেখা গেল পিঁ পিঁ করছে। রাত্তিরে অবশেষে ডক্টর সুবল মিত্রর বাড়ি ফোন গেল—

মিসেস সুবল ধরেছেন।—বউদি আমি যশোধরা বলছি, আমাদের বাড়ির কোনও ফোন কাজ করছে না। একটা মেসেজ দিয়ে দেবেন? কিছু না পাবলো বা শম্পি যাকে হোক। ওদের বাবাদের হলেও কোনও ক্ষতি নেই। জাস্ট বলে দেবেন, পাবলো যেন আলমারি বিষয়ে সাবধান হয় আর শম্পি যেন বাবাকে সুগার—ফ্রি ডায়েট দেয়।

এতক্ষণে ডাক্তার—গিন্নি কথা বললেন—কিন্তু মেসেজটা দেবে কে? গম্ভীর গলা।

কেন? মানে…

মানে আমাদের তো সন্তানদি নেই। আমি নিজেও ব্যস্ত। মেট্রন হয়ে গেছি। ডিউটি নিয়ে জেরবার।

কেন? মানে ডাক্তারবাবু!

উনি তো দার্জিলিং—এ বেড়াতে গেছেন।

অ্যাঁ?

আপনি কোত্থেকে বলছেন?

যশো ততক্ষণে ফ্যাকাশে হয়ে ফোন রেখে দিয়েছে।—সব্বোনাশ!

কী হল? মধুক্ষরা বলল।

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। সুবলদা তোর পেছন পেছন এখানে ধাওয়া করেছে।

সুবলদা? এখানে? তাতে আশ্চর্যের কী আছে! আসতেই পারে।

বেছে বেছে এখানেই আসতে হবে! দিঘা ছিল, পুরী ছিল, মিরিক, কালিম্পং, কার্শিয়ং সবই তো ছিল। লাভা লোলেগাঁও যেতে পারত। সিকিম, ভুটান সব তো হাতের কাছে আয় আয় করে ডাকছে। আসলে তুই, মধু যেখানে সুবল ভ্রমর সেখানেই তো আসবে!

দ্যাখ দিদি, বাড়াবাড়ি করছিস। মধুক্ষরা ভারী বিরক্ত হয়ে বলে—দার্জিলিংটাই গরমে লোকের আগে মনে পড়ে। আমরাও যে কারণে এসেছি সুবলদাও…

না রে মধু, ভোলাটাকে টিকিট করতে দিয়েছিলুম। ও ব্যাটা বোধহয় সুবলদারও এজেন্ট। এজেন্ট মারফত জেনে গেছে। ওখানে তো বউ বাঘিনির মতো বসে আছে।

তো কী? কী করবে? কী করবেটা কী শুনি!—মধুক্ষরা একেবারে রণং দেহি মূর্তিতে ধেয়ে এল।

যশো তার মূর্তি দেখে আপস করতে বাধ্য হয়। ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে। সুবলদা এমনি এমনি এসেছে। একেবারে এমনি এমনি। আমরা যেমন এমনি এমনি হরলিক্স খাই।

এরপর দুই বোন আরও কয়েক বারের চেষ্টায় ল্যান্ডফোনটা পেয়ে যায়। ধরেছেন মিহিরকিরণ।

কী হল! ল্যান্ডফোনটা তো খারাপ ছিল, এত তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেল?

কে বললে খারাপ হয়েছিল। রিসিভারটা ঠিক করে ক্রেডলে রাখেনি সব। এমন একেকখানি উদোমাদা ছেলেমেয়ে তৈরি করেছ! ভালভাবে পৌঁছেছ তো?

সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ফার্স্ট থিং তোমার জন্যে বড্ড চিন্তায় আছি!

আমার জন্যে? মধু ডিয়ার, সে তো বিয়ের আগে আগে থাকতে। এখন…

বাজে কথা বোলো না। আজ কী খেয়েছ?

তা ভালই ব্যবস্থা তোমার মেয়ের। ময়রার দোকান উঠিয়ে এনেছে। অফিস থেকে ফিরে মিষ্টিযোগ—রসগোল্লা, বালুসাই, ক্ষীরমোহন যা যা ভালবাসি।

অ্যাঁ?

তারপরে শোনো না। রাতে আজ এত গরমে প্রাণটা ভাতের জন্যে আইঢাই করছিল। বেশ করে ভাত দিয়ে চিংড়িমাছের মালাইকারি, শেষ পাতে রাবড়ি।

উ হু হু, চুপ করো চুপ করো।

কেন?

তোমার ব্লাড সুগার। বলা হয়নি। সে দিন ব্লাড টেস্ট হল না?

তাতে কী হল?

তাতে সুগার এসেছে। দুশোর কাছাকাছি। এক বেলা এক কাপের বেশি ভাত খাবে না। মিষ্টি নো। চায়ে স্যাকারিন। শম্পিকে দাও।

শম্পিকে দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে মধুক্ষরা টেলিফোনটি রেখে দিলেন।

.

প্ল্যাটফর্মহীন এক শূন্য মাঠে একটা নড়বড়ে প্যাসেঞ্জার ট্রেন এসে দাঁড়াল। ব্যাকপ্যাক নিয়ে নামল তিন মক্কেল। মধুবন তার দাদা ঋজুরুস্তম এবং জিনপরি বা শুধু পরি। পরিরও ব্যাকপ্যাক, মধুবন গুছিয়ে দিয়েছে—নতুন জামা, জাঙিয়া, প্যান্ট, টি—শার্ট, পুরনো সালোয়ার কামিজ, ধারের দিকে ছোট করা। মধুবন ক্রমশই আড়ে বেড়েছে, তার সালোয়ার কামিজগুলো নানান স্টেজে পরিত্যক্ত হয়েছে। সেই বিভিন্ন স্টেজের সালোয়ার কামিজ প্রায় নতুন। এই প্রায়—নতুন সালোয়ার কামিজের এবং শাড়ির একটি অতিকায় বান্ডিল ঝুলছে পরির হাত থেকে। আরও কী কী আছে এদের হাতেনাতে সে সব ক্রমশ প্রকাশ্য বলে মনে হয়।

কিন্তু আপাতত টাকপড়া এক এবড়ো খেবড়ো মাঠ। একদিকে এক চিলতে স্টেশন ঘর—টিকিট কাউন্টার, একখানা টিনের বেঞ্চ, তার ওপরে ছায়া করে রেখেছে বিরাট এক শিরীষ গাছ। টিনের বেঞ্চিটি পক্ষীবিষ্ঠায় ভরতি। অদূরে একটি টিউবওয়েল। আশ্চর্যের বিষয় ওরা তিনজন ছাড়া আর কেউ এখানে নামল না। বিকেল প্রায় শেষ। ঘষা কাচের মতো আকাশ, যেন ঘষা কাচের দেয়াল। বোঝাই যাচ্ছে গ্রিন হাউস গ্যাসদের না বেরোতে দেবার মতলবে আকাশ এই ব্যবস্থা করেছে।

ঋজুরুস্তম পাঁচ এগারো লম্বা। রং ফরসা। মুখচোখ কেমন, তার চেয়ে আগে চোখে পড়ে তার ক্ষুরধার বুদ্ধি। চার দিকে চোখ। কোনও কিছু দেখলেই যেন সেটা তিরের মতো বিঁধে ফেলবে চোখ দিয়ে। তার পরনে খাকি রঙের ডেনিম, ছাপা কুর্তা গায়ে। চোখে গাঁধীচশমা, বাঁ হাতে মোটা রুপোলি ধাতুর ব্যান্ডসুদ্ধু গাবদা ঘড়ি। তার নাম ঋজু, মাথার চুলও ঋজু, অর্থাৎ খাড়া খাড়া। আজকাল চুল শজারুর কাঁটা করবার একটা ফ্যাশন এসেছে। তা কোনও লোশন, স্প্রে, কোনও কায়দা ছাড়াই ঋজুর চুল এমনই। বর্তমান ফ্যাশনের সঙ্গে মানিয়ে যাওয়ায় প্রথম দর্শনেই ঋজুরুস্তম খুব সমীহ পায়। অনেকে মনে করে ঋজু শিগগিরই মডেলিংয়ে নামবে। তার চলাফেরা, টুক করে লাফিয়ে খানা—খন্দ পার হওয়া, হেলান দিয়ে দাঁড়ানো দুটো পা ক্রস করে, অপাঙ্গে তাকানো, কখনও হেলেদুলে কখনও সোজা হেঁটে আসা—সবই মডেলোপম। তাকে পারতপক্ষে কিছুই শিখতে হবে না। নামটিও অনুকূল। শুধু পদবিটা বর্জন করলেই ঋজুরুস্তম একটা দারুণ শো ম্যান নাম।

কিন্তু হায়!

এ জগতে হায় সে—ই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি। ঋজু আরও চায়। সে কেন আরও চার—পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হল না, এর জন্যে সে মনে মনে তার বেঁটে বাবাকে দোষ দেয়। কেন তার গায়ের রং আর একটু কালো হল না। এর জন্যে সে সোজাসুজি তার মাকে দোষ দেয়। কেন তার আরও বুদ্ধি হল না, এর জন্যে সে কলঘরে তার চোদ্দোপুরুষকেই গালাগালি করে। সে খুব খু—উ—ব একজন বিশেষ মানুষ হতে চায়। এইচ এস—এর পর সে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বলে একটা বিষয় পড়তে ক্যানবেরা ইউনিভার্সিটিতে চলে যায়। সেখানে পি এইচ ডি করবার আহ্বান নিয়ে সে বিষয় বেছেছে ভারত/প ব। ফিরে এসেছে এবং কাজ করছে। কখন সে যে কোথায় থাকে, কোথায় থাকে না, বলা মুশকিল। তবে এবারে পরির সঙ্গে তার খুব ভাব হয়েছে এবং পরিদের ‘গেরাম’ যে তার গবেষণাপত্রের জন্য ‘স্বপ্নস্থান’ সেটা বুঝতে পেরে সে তুরন্ত এদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে।

মধুবন ৫/২// এবং একটি গোল মাখনের ডেলা। তার ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিকস ৪২—৪২—৪৮। সে অনেক কষ্টে অধ্যবসায়ে একটু নেমেছিল। কিন্তু আই এস সি পরীক্ষা দিতে গিয়ে মায়ের আদরে একটু বেশি খেয়ে ফেলে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেছে। মধুবনের রং খুবই ফরসা। তাতে একটু হলুদ আভা আছে—তাইতে মাখনের ডেলার সঙ্গে তার তুলনাটা আরও যথাযথ মনে হয়। তার চুল বব—ছাঁট। মুখশ্রী খুব কাটাকাটা, সুন্দর কিন্তু সবই মাখনে ডোবানো। মধুবন একটা পাতলা কাপড়ের গোলাপি ঢোলা প্যান্ট বা পাতলুন আর সাদার ওপর গোলাপি ছাপা টপ পরেছে। তার পায়ে ড. শূলজ্—এর ডিজাইনের জুতো। পরি, যাকে এরা ভাইবোনে মাঝে মাঝেই জিনপরি বলে ডেকে থাকে সে একটি এ কাটের ম্যাগিয়া হাতা ফ্রক পরেছে। ৫/২// লম্বা। ভীষণ রোগা ছিল। কিন্তু মাস তিনেক খাওয়া—দাওয়া করেই তার চেহারা ফিরে গেছে। সে যে নেহাত খুকিটি নয়, মধুবনের চেয়ে ছোট মোটেই নয়, সেটা বোঝা যাচ্ছে। তার চুল সে বিনুনি করে সযত্নে কাঁটা দিয়ে খোঁপা করে রেখেছে। রং ময়লা কিন্তু তাতে এখন নগুরে চাকচিক্য। মুখচোখগুলো ফুটে বেরিয়েছে। দেখা যাচ্ছে সে বেশ চটপটে চালাককতুর চটকদার একটি কিশোরী যার বাস্তব অভিজ্ঞতা বাকি দু’জনের থেকে অনেক বেশি। জায়গাটা তার নিজের। কাজেই তার স্মার্টনেসও এখন বেশ বেড়ে গেছে।

শিরীষগাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মধুবন, গরম মতো কী তার মাথায় পড়ল।

এ মা দিদি গো। তোমার মাথায় যে কাগে হেগে দিল। গাছের তলায় দাঁড়াতে আছে?

মধুবন ভ্যাটকা মুখে উবু হয়ে বসে এবং পরি গাছের পাতা, তার নিজের রুমাল (তার অনেক রুমাল, বেশিরভাগই নিজের হাতে এমব্রয়ডারি করা) দিয়ে—টিউকলের জল ব্যবহার করে মধুবনের মাথা পরিষ্কার করে দেয়।

তুই আবার হ—য়ে একার গ—এ একার বললি? মধুবন বিরক্ত মুখে বলল।

কাগের ইয়েকেও কি পটি বলতে হবে নাকি? হিহি।

ওহ তোকে নিয়ে আর পারা যায় না।

ইতিমধ্যে ঋজুরুস্তম বেশ খানিকটা তত্ত্বতালাশ করে এসেছে। টিকিট কাউন্টার থেকে জেনেছে, একটা ভ্যান গাড়ি খারাপ। আর একটা এক্ষুনি মাল নিয়ে গেছে। গো—গাড়ি আগে থেকে বলা না থাকলে পাওয়া যাবে না। অতএব আজ মুড়কিশোলা পৌঁছোতে হলে হন্টন। তিন—চার ক্রোশ হবে। টিকিটের ঘর থেকে বলেছে।

তিন ক্রোশ মানে তিন হাজার হাত গুনে নিয়ে রুস্তম হাঁটা দিল। তার সামনে—পেছনে পরি আর মধুবন। হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে…। হাঁটছে তো হাঁটছেই।

মধুবন বলল একেই কি বলে তেপান্তরের মাঠ?

কেউ জবাব দিল না। সবাইকারই ভেতরটা গরম হয়ে উঠেছে। মাঠের মধ্যে যদি ঘাস থাকত, গাছপালা থাকত তা হলে হাঁটার একটা মানে হত। কিন্তু এ—মাঠে ঘাসটাস নেই। গাছ আছে ছোট বড় দূর দূর। কিছুক্ষণ পর মধুবন বলল একেই বোধহয় ডেজার্ট বলে। মরুভূমি।

কেউ জবাব দিল না। পরি আগে আগে হাঁটছে। এই দিক—দিশাহীন মাঠে সে—ই একমাত্র ঠিকানা—অলা লোক, সে—ই সেথো, দিশারি। একটা আলাদা দায়িত্ববোধ এসেছে তার চলাফেরায়। একটা বেশ কর্তৃত্বের ভঙ্গি হাঁটাচলায়। শহুরে দাদা—দিদিকে সে নিজের গেরাম দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। সোজা কথা! সোজা দায়িত্ব?

কিছুক্ষণ পর মধুবন বলল—এরই নাম কি কান্তার? দুর্গমগিরি কান্তার মরু…। কেউ কোনও জবাব দিল না।

জবাব দিচ্ছিস না যে বড়? এবার সে রেগে গেছে।

কিছু বললি?—রুস্তম বলল।

ভালই শুনতে পাচ্ছিস।

তুই আগে ঠিক কর তেপান্তর না মরুভূমি না কান্তার। অতগুলো জবাব একসঙ্গে দেওয়া যায়? যাই হোক তুই যে কথা বলার অবস্থায় আছিস এই—ই যথেষ্ট। ক্রোশ বলতে এরা কী বোঝায় সেটা আমায় জানতে হবে।

সামনে থেকে পরি মুখ ফিরিয়ে বলল—পা চালিয়ে দাদা—দিদি, সন্ধে হয়ে গেলে মহা মুশকিল হবে—এখানে তো আর রাস্তায় আলো নেই।

আমার কাছে পাঁচ সেলের টর্চ আছে—সংক্ষেপে বলল রুস্তম। এবং বলা নেই কওয়া নেই মধুবন হঠাৎ নদগদ করতে করতে ছুটতে লাগল।

এ কী রে বাবা, মাথা খারাপ হয়ে গেল, নাকি? রুস্তম আপন মনেই বলে।

পরি বলল—সন্ধে নামার কথায় দিদি ঘাবড়ে গেছে। কিন্তু একটু ছোটাই বোধহয় এখন ভাল।

হঠাৎ ঘষা কাচের মতো আকাশটা ঘষা বেগুনি হয়ে গেল এবং অদূরে সূর্যটি টুপ করে ডুবে গেল। শুকনো মাঠে এখনও এ—দিক ও—দিক আলো ছড়িয়ে রয়েছে। তার প্রকৃতি অদ্ভুত, ভৌতিক।

পরি বলল—একে আমরা বলি সুযযি—ডোবা—আলো। পা চালিয়ে দাদা।

রুস্তমকে টর্চ বার করতে হল। মধুবনও একটা টর্চ বার করল। একজন রাস্তার দিকে আলো ফেলছে আর একজন চোখের সোজা। কিন্তু অন্ধকারকে কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা গেল না। হুড়ুম করে লাফিয়ে পড়ল মাঠভরতি অন্ধকার। এমনই নিকষ যেন নিরেট দেয়াল। একমাত্র ভরসা আকাশে একটি—দুটি তারা ফুটিফুটি করছে।

উই যে গেরাম।—মধুবন তিন বার ঠোক্কর খাবার পর পরির গলায় উল্লাস শোনা গেল।

অনেক দূরে টিমটিম করে কিছু চলন্ত আলো। শুধু আলোই, জোনাকির মতো। সে আলোয় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে কী আছে, কারা আলোকধারী। কিছুই না।

রুস্তম বলল—এদের ফর্ম আছে তো রে!

মধুবন বলল—খবরদার ভয় দেখাবি না দাদা।

মাঠের মধ্যে দিয়ে পরি এবার ছুটতে লাগল—ও বাবা! ও মা! আমি পরি এইচি গো! আলো দেখাও শিগগিরই।

মুখের দু’পাশে হাত জড়ো করে পরি চেঁচাচ্ছে, কিন্তু তেপান্তরের মাঠ সর্বস্ব গিলে নিচ্ছে। অন্তত অন্য দু’জনের তাই মনে হল।

মধুবন এবার বসে পড়ল—আমি আর পারছি না। কেউ আলো নিয়ে আসুক তবে উঠব।

পরি চেঁচিয়েই যাচ্ছে। সে প্রস্তাব দিয়েছিল এগিয়ে গিয়ে লোক ডেকে আনবে। কিন্তু মধুবন তাকে যেতে দেয়নি—চালাকি পেয়েছিস না? তারপর নিজের লোকেদের কাছে যাবি আর আমাদের কথা বেমালুম ভুলে যাবি। ও সব চলবে না। কবে তোকে কখন বকাঝকা করেছি এমনি করে তার শোধ নিচ্ছিস? গদ্দার কোথাকার!

পরি আর দ্বিতীয়বার ও প্রস্তাব করেনি। তবে দু’—দুটো টর্চ জ্বেলে নিবিয়ে জ্বেলে নিবিয়ে ওরা বারবার জানান দিয়েছে যে, এখানে মনুষ্য আছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে গোটা দুই কঙ্কালসার লোক অন্ধকারের মধ্যে আরও এক পোঁচ অন্ধকারের কাঠি হয়ে এগিয়ে এল। রুস্তম বলল—আনন্দমঠ।

কে?

আমি গো! পরি! সঙ্গে আমার দাদা দিদি। যেনাদের বাড়ি আমি কাজ করি।

আবার দাদা দিদি। একজন লোক ব্যাজার হয়ে বলল।

অন্যজন বলল—আপনি পায় না খেতে শংকরাকে ডাকে।

রুস্তম বলল—যা ব্বাবা!

পরি বলল—কী বাজে কথা বলছ! দাদা দিদির বাড়ি ফ্রিজ—ভরতি খাবার। ওরা কি তোমাদের এখানে খেতে এয়েচে নাকি! সনাতন কাকা, আমার মান রেকে কথা বোলো। এখন আমি রোজগেরে মনিষ্যি, যে সে নেই আর।

হাতমুখ নেড়ে নেড়ে পরি ইত্যাকারে সব বলবার পর লোক দুটি বলল—তা আসেন।

মধুবন গোমড়া মুখে বলল—রাতটা কোনওমতে কাটিয়ে কালই আমরা ফিরে যাব দাদা।

সে দেখা যাবে—দাদার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

গেরামে যখন ওরা পা দিল যে যেখানে আছে সব একধার থেকে এসে দাঁড়াল। অন্ধকারে সারে সারে কঙ্কাল।

পরির বাবা জনার্দন মাজি এগিয়ে এসে বলল—একটা পোস্টোকার্ড তো লিকে দিবি!

দিয়েচি তো! পাওনি!

কোতায়!

পরি বলল—দাঁড়াও আমি ব্যবস্থা করছি। আগে একটু জল দাও ওদের। কতটা পথ হেঁটে এসেচে জানো তো!

রুস্তমের ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের মগ বেরিয়ে এল। সে বলল—টিউবওয়েল কোথায়? আমি ভরে নিচ্ছি।

টিউকল ঢনঢন করচে—জনার্দন জবাব দিল—কুয়োর ঠেঙে জল দিচ্চি—আসেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন