যে যেখানে যায় – ১

বাণী বসু

লেক গার্ডনস ফ্লাই ওভারটার দু’পাশ জুড়ে কৃষ্ণচূড়া ফুটতে শুরু করে দিয়েছে। বেগুনি ফুল ঝুপ্পুস দুলছে লেকের বাইরে, ভেতরে। বসন্ত আসতে না আসতেই চিকচিকে সবুজ, ঝকঝকে দুলদুলে পাতা। ফেশিয়াল করে এসেছে যেন। ফাইন! এদিকে চৌকিটার এইসা জোর হয়েছে গায়ে যে, চেনটা ধরে রাখা যাচ্ছে না। তাকেই বরং দৌড় করাচ্ছে ব্যাটা। উঃ, ক্রিকেট কোচিংয়ের স্কুলটা শেষ অবধি এসে গেল। তিন রাউন্ড হল, এখনও এক রাউন্ড বাকি। মধুবন বলল—উফ একটু জিরোতে দে রে চৌকি! প্লিজ! মুশকিল হচ্ছে, জিরোতে হলেও সেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জিরোতে হবে। একবার চেন আলগা দিলেই গেছ! এই বিদঘুটে কাজটা তার বাবার। কিন্তু মেদ কমানোর জন্য যেহেতু তার প্রাতঃহন্টনের দণ্ড হয়েছে এবং বাবা আপাতত দিল্লি গেছে, বাবার জায়গায় মধুবনকে ফিট করা হয়েছে। প্রাতঃহন্টনের পর বাড়ি গিয়ে সে সামান্য কিছু খেতে পাবে। প্রচুর জল প্রথমেই। তারপর ঝিঁঝির পাতের মতো পাতলা দুটো মাখনহীন টোস্ট, এক কাপ স্কিনড মিল্ক, গুটিকতক শসা। পড়াশোনার কাজটা এই ‘শসাফাস্টে’র পরেই করে থাকে সে। দু’খানা হাতেগড়া রুটি, গাজর, বিন, পেঁপেসেদ্ধ টিফিনে ভরে দেয় মা। চোখ পাকিয়ে বলে—’ক্যান্টিনে বসে কাটলেট ধবংস কোরো না আবার। এত দিনের পরিশ্রম জলে যাবে। মনে রেখো, পঁচাত্তর কেজি ওজন ইকোয়ালস—হার্ট, প্রেশার, বাত, ডায়াবিটিস…। যখন স্কুল চলে তখন এইরকম।

আচ্ছা মা, নিজের মেয়ের জন্যে এতগুলো মারাত্মক মারাত্মক অসুখ প্রেসক্রাইব করতে বাধছে না তোমার?

অসুখ প্রেসক্রাইব করছি? মারব এক চড়। যা, বেরো এবার।

অন্য লোকের মায়েরা যখন মালাই নিয়ে ছেলেমেয়েদের সাধাসাধি করছে, তখন তার মা গরম টোনড মিল্কের ওপর পড়া সরটাও শ্যেনদৃষ্টিতে দেখছে এবং চামচ দিয়ে নির্মমভাবে তুলে ফেলে দিচ্ছে। সেই সব বালকবালিকা, কিশোরকিশোরী যারা দুধ এবং দুধের সরের নামে নাক কুঁচকোয়, মধুবন তাদের দলে পড়ে না। সে ভালবাসে বেশ মোটা সর—পড়া গোদুগ্ধ। সম্পূর্ণ দুধ যাকে বলে। সে ভালবাসে তাজা ক্রিম। নানারকম টুকরো টুকরো করে কেটে একটা বড় কাচের বাটিতে রাখো। তারপর তাতে দরাজ হাতে ক্রিম ঢালো। এক মুঠো বড় দানার সাদা সাদা চিনি। ব্যস।

এবং যেহেতু সে এরকম ভালবাসে তার জানাশোনা মাসি—পিসিরা যাঁরা যাঁরা ছেলেমেয়েদের দুগ্ধজাত খাওয়াতে পেরে ওঠেন না তাঁদের সমস্ত স্নেহরস ঝরে পড়ে মধুবনের ওপর বা ঠিকঠাক বলতে গেলে তার খাদ্যাখাদ্যের ওপর।

মিল্কশেক করেছি মধুবন। খাবি তো?

আইসক্রিম ফ্লোট ভাসিয়েছ কি মাসি?

শিয়োর শিয়োর! আইসক্রিমের বাক্সটা তা হলে আছে কী করতে?

আমাকে যেন স্ট্র দিয়ো না। ওভাবে শেক খাওয়া যায় না। তা হলে তো কোক, থামস আপ খেলেই হয়!

সব মাসিরাই তাকে ভালবাসেন। কিন্তু পাবলোর মা যশোমাসি একটু স্পেশ্যাল।

স্পেশ্যাল। কেননা, তাঁরও ওই একই রোগ। তাঁরও ব্লাউজের তলায় মোটা মেদের বেল্ট, তারও মুখ আর ধড়ের মাঝখানে ঘাড় অদৃশ্য। তাঁকেও হাঁসফাঁস করতে করতে প্রাতঃহন্টন করতে দেখা যায় এবং মধুবনকে মিল্কশেক দিয়ে তিনি নিজেও অন্য একটি মিল্কশেক নিয়ে মুখোমুখি বসবার পক্ষপাতী। কিন্তু দু’জনেই এখন প্রভূত বিপদে পড়ে গেছেন।

সে দিন বাড়ি এসেই মধুবন বলল—ব্যস দু’কেজি কমে গেছি।

হ্যাঁ। এক কেজি হাঁটার জন্যে। আর এক কেজি চৌকির জন্যে। যা ছুট করিয়েছে, বাপস!

তা হলে তো তোর এক মাসে তিরিশ দু’গুণে ষাট কমে যাচ্ছে। বাকি রইল বারো কেজি, বাঁচবি কী করে রে?

মা, নিজের মায়ের পাঁচফোড়ন হল—আবার আইসক্রিম, সর, ক্রিম, রেওয়াজি পাঁঠার গরগরে ঝোল। চড়চড় করে উঠে যাবে। যশোমাসি আছে কী করতে?

এক হপ্তা পরে ডাক্তারখানায় গিয়ে সে সত্যি দেখে এল—এক কেজির মতো কমেছে। ডাক্তারকাকু বললেন,—ঘাবড়াচ্ছ কেন? এসব আলগা ফ্যাট শটাশট ঝরে যাবে। কিন্তু ডায়েট মেনটেন করতে হবে স্ট্রিক্টলি।

যশোমাসি আর মধুবনের যখন এইরকম বিপদ তখন আরমান আর সম্পৃক্তার কেস শুনুন। সম্পৃক্তার প্রবলেম হল ও যতই খায় আটচল্লিশ কেজির বেশি ওঠে না।

কোথায় ওয়েট নিস? সিনেমা হলে? শপিংমলে?—মধুবনের স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে।

আজ্ঞে না। রীতিমতো ডাক্তারখানায়। ক্লিনিকে।

অনেক ডাক্তার গড়বড় যন্ত্র কমদামে কিনে এনে চেম্বার সাজায়, তুইও আটচল্লিশ, হাতিও আটচল্লিশ।

আর তুইও আটচল্লিশ। তো চল আজই তোকে নিয়ে যাই।—সম্পৃক্তা সঙ্গে সঙ্গে রেডি।

অগত্যা মধুবন পিছু হটে। অন্য পথ নেয়। আসলে তুই খাস না—উত্তর হল—ওই আনন্দেই থাক।

খাচ্ছেদাচ্ছে ওয়েট বাড়ছে না। সম্পৃক্তার ডেলি রুটিন কী! দাঁড়া ব্যাটা, একটু গোয়েন্দাগিরি না করলে আর চলছে না।

প্রথমেই মধুবন যশোমাসির ইন্টারভিউ নেয়। কারণ যশোমাসি সম্পৃক্তার সাক্ষাৎ মাসি। এবং বলতে গেলে এক বাড়িতেই থাকেন। যশোমাসির বাবা বহুত বড়লোক ছিলেন। সেই বিশাল বাড়ি তাঁর দুই মাত্র মেয়ে যশোধারা আর মধুক্ষরাতে বর্তেছে। যশোমাসির ছেলে পাবলো আর মধুমাসির মেয়ে সম্পৃক্তা দু’জনেই মধুবনের ইয়ার। সেকেন্ড কাজিনও বটে। ওদের বাড়ির মাঝখানে একটা দরজা। এ—দিকে যশোমহল। ও—দিকে মধুমহল।

মধুবন জিজ্ঞেস করে—আচ্ছা যশোমাসি, শম্পি কখন জিমে যায় গো!

শম্পি জিমে? যায় না তো! কেন যাবে? এমনিতেই তো ডিগডিগুনি!

না খেয়ে থাকলে আর ডিগডিগে হবে না তো কী?

যশোমাসি বললে,—শম্পি না খেয়ে থাকে? তোকে বলেছে বুঝি? পাউরুটিতে মোটা মাখন লাগিয়ে তার ওপর মুঠো মুঠো চিনি ছড়িয়ে খায়টা তবে কে? ছানার মালাই কোফতা রেসিপি এনে আমাকে দিয়ে তবে কে রাঁধাল? আমাকে চোখ রাঙিয়ে বললে, মাসি, খবরদার কিন্তু টেস্ট পর্যন্ত করবে না। তা হলেই ফেটে যাবে। পাবলোকে একটা—দুটো দিল কি না দিল। সে অবশ্য কেয়ারও করে না। তা সে যাই হোক ন’—দশটা বাকি ছিল। নিজে সব ক’টি সাঁটাল। শম্পি নাকি না খেয়ে আছে! ওর ধাতই ওইরকম।—ওর বাবার মতো কেঠো ধাত। তুই আমি জল খেলেও ফুলছি। আর ওরা খাচ্ছেদাচ্ছে ফুরফুরেটি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একেই বলে ভগবানের বিচার। বলতে বলতে মাসি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললে।

আরমান এদিকে সকালে জিম, বিকেলে ফুটবল, সন্ধেয় যোগাসন বা ইয়োগা, রাত্তিরে খাওয়ার পর এক ঘণ্টা বাদে পাঁচ মাইল হাঁটে। সুদ্ধু নাকি ফিট থাকবে বলে। পাবলো বলে, ফিট থাকবে বলে? বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাসনি। খাবে বলে, স্রেফ গাঁউগাঁউ করে খাবে বলে। এদিকে ওজন বাড়লে ওর কোচ বাঁড়ুদা ওকে ইয়া খিস্তি করবেন না। তাই আরমান যা খায় সব চেষ্টাচরিত্র করে পুড়িয়ে ফেলে। খাওয়ার জন্যে এটুকু কষ্ট নাকি ওর নস্যি। যে—কোনও রকমের মিষ্টি, সে বালুসাই—ই হোক আর কদমাই হোক, রসমুন্ডিই হোক আর শোনপাপড়িই হোক, কেক পেস্ট্রি চকোলেট সব রকমের দিশি—বিদেশি মিষ্টির দারুণ সমঝদার আরমান।

ভোরবেলা বেশ কিছু মেসো পিসে গোছের ভদ্রলোক শর্টস পরে কেডস পায়ে হনহন হাঁটেন, কারও হার্ট, কারও ডায়াবিটিস। এই সময়টাই পছন্দ করে মধুবন। সবাই তখন খুব নিবিষ্ট হন্টক। এর ওর তার দিকে দৃষ্টি দেবার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই। ভুঁড়ি হার্টের ওপর ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে, কোলেস্টেরল হাই, ইউরিক অ্যাসিড বাড়ছে রক্তে, গাঁটে গাঁটে ব্যথা। কে তখন অন্যের মেদ নিয়ে মাথা ঘামায়। বিকেল হলেই ক্রাউডটা হয়ে যাবে মহিলাপ্রধান এবং তার মধ্যে বেশিরভাগই চেনাশোনা। বড়দের থেকে পরামর্শ, সমবয়স্কদের থেকে টিটকিরি ইয়ারকি একেবারে খইবৃষ্টির মতো চার দিক থেকে ছুটে আসতে থাকে এবং বর্ষিত হয়। ‘কী রে মধুবন, কমল? যশোধরাদির বাড়ি যাওয়া বন্ধ কর, বন্ধ কর—এক্ষুনি হাঁটা সেরেই তো তিনটে আইসক্রিম সাঁটাবি, কমবে কী করে?’

ও—দিক থেকে একজন দু’হাত দোলাতে দোলাতে চলতে চলতে বলবে—এই ভাবে হাঁটো ভাই, এইভাবে, হাত পা ছুড়ে ছুড়ে। তবে না তোমার আর্ম আর থাইয়ের মাংস খসবে! কেউ বুঝবে না, তার হাতে রয়েছে চৌকি নামে একটি বিশালাকায় অ্যালসেশিয়ানের চেন। হাত সে ছুড়বে কী করে! আর পা? সে তো চৌকিই ছোড়াচ্ছে! সেটা লোকে দেখতে পায় না।

বেল্টটা চমৎকার! আর একজন কেউ মন্তব্য করে গেল। বেল্ট বলতে কী বোঝায় মধুবন এখন ভালই বুঝে গেছে, কিন্তু কাউকে ধরার উপায় নেই।

এই আমাকে বেল্ট বললে কেন?—এটা বলা যায়? বিশদ করে বলতে হবে,—আমার কোমর থেকে পাঁজরের নীচ পর্যন্ত বেড়ি সদৃশ্য যে চর্বির চাকা বিরাজ করছে, তাকে বেল্ট টেল্ট বলে ইয়ারকি মারলে কেন!—এভাবে বললে নিজেকেই নিজে কনডেম করা হয়। আবার কেউ বলতে বলতে যাবে—ভাল বেশ। শীত করবে না।

জিরো ডিগ্রির তলাতেও?

জিরো ডিগ্রির তলাতেও। মাইনাস চার—পাঁচ হেসে খেলে চলে যাবে।

বলতে গেলে বলবে—আমরা নিজেদের মধ্যে আবহাওয়া, সেন্টিগ্রেড, শীতের জামাকাপড় নিয়ে কথা বলছি। তুমি কে হে? গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে এসেছ!

ম্যাক্সিমাম হল একজন বলল—ট্যাঁপারি।

দ্বিতীয়জন বলল—ধ্যার গোলগাপ্পা।

তৃতীয়জন বলল—ট্যাঁপারিটা বেশি জুতসই। গোলগাপ্পা তো কামড় দিলেই ফুট্টুস।

এ ক্ষেত্রেও কিছু করবার নেই।

তাই বিকেলবেলাটা মধুবন জিমে যায়। সে প্রাণপণে ম্যানুয়াল ট্রেডমিল করে যায়। পাশে একটি হিপোপটেমাস ওয়েট নিয়ে কসরত করতে করতে বলে—কবে যে অন্তত তোমার মতো হব!

আহা কী মধুর! মধুর! কেউ অন্তত পৃথিবীতে তার মতো হতে চাইছে। তার পরেই অবশ্য, সনা সেরে স্লিম বিউটি বেরিয়ে আসেন একজন। সিরিয়ালে অভিনয় করেন। কৃপার দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকান, একটু হাসেন, চলে যান। হিপো এবং সে পরশ্রীকাতরতায় বড্ড কষ্ট পায় সে সময়টা।

কিন্তু ভোরবেলাতেও শত্রুপাত হল। আরমানের মূর্তিতে। আরমানের আপাদমস্তক পেটা চেহারা। ফুটবল খেলে। কালীঘাট ক্লাবে। তিনি দৌড়োচ্ছেন। কৃষ্ণচূড়াগুলো মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল মধুবনের চোখে।

কী রে মৌবটিকা? তুই হন্টন ধরেছিস নাকি?

মধুবন ওকে এড়িয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু আরমান ছাড়বে কেন?

হুঁ। এক অক্ষরে উত্তর মধুবনের।

কাল নেমন্তন্ন ছিল, বুঝলি, একেবারে এই পর্যন্ত—গলাটা দেখিয়ে দিল আরমান। জগিং করতে করতে বলল ল্যাম চপ, ঢাকাই পরোটা, বিরিয়ানি, জিলিপি গরমাগরম ভেজে দিচ্ছিল, বুঝলি! আর আজকাল তো আইসক্রিম পার্লার বসাচ্ছেই। কুলফিও ছিল। দুটোই খেলাম। ন্যাচার‍্যালি। বহুত হয়ে গেল। সো পোড়াচ্ছি।

 যা ক্যালারি পুড়ে

 জিলিপি যা উড়ে।

মধুবন আর থাকতে পারল না। বলল—

 ক্রিম ক্ষীর যা জমে চর্বিগুলো ক্রমে

 গালের ওপর গাল হোক

 পেটের ওপর পেট

 তোর জন্মদিনে কোক পাঠাব

 ক্রেটের ওপর ক্রেট।

বুড়ো আঙুল নেড়ে আরমান জানিয়ে দিল তাতেও ওর কিস্যুই হবে না।

বাড়ি এসে এক চক্কর। ক’দিন ধরেই বাড়িতে কুরুক্ষেত্র চলছে। মায়ের ভার্শন সর্বকর্ম সম্পাদক বা আপ্তসহায়ক যা—ই বলো বিদায় নিয়েছে। বিদায় নিয়েছে বলতে সে তার ‘গেরামে’ গেছে। মহা চালু। কিছু দিন অন্তর অন্তরই তাকে ‘গেরামে’ পায়, ইতিমধ্যে মাকে ফুসলে ফাসলে ব্ল্যাকমেল করে করে সে বেশ কিছু হাতিয়ে নিয়েছে বলে বাবার সন্দেহ। এখন হাতানো কমপ্লিট। দেশেঘরে বা গেরামে জমি—জায়গা বাড়িটাড়ি সব হয়ে গেছে তাই পরের চাকরিতে ইস্তফা। ‘ইস্তফা দিবি তো তা—ই দে না বাপু।’ মা ঝম্পক তালে বলে। ‘না বলে এমন ফেরার হবার মানেটা কী?’ ‘মানে আলমারিতে খোঁজো’—বাবার উপদেশ—তোমার আলমারি থেকে তো সদাসর্বদা চাবি ঝুলছে। সবাইকার সামনে ঝনাত করে খুলছ আর টাকা বার করছ, শাড়ি বার করছ, গয়না বার করছ।

দ্যাখো, তুমি গা জ্বালানো কথা বলবে না। ও আমার আটপৌরে আলমারি। ওতে ওসব থাকে না। আর গয়না কোথাওই থাকে না। জানো না যেন সে—কথা!

আর ক্যাশ টাকা?

মা মধুর হাসে—টাকা তো ব্যাঙ্কে ডার্লিং। হাতে একশো টাকায় এসে ঠেকলে তখন রাত বিরেতে ঢং করে এটিএম থেকে তুলে আনো! টিপে টিপে! পিঁপড়ের পেছন টিপলেও এর চেয়ে বেশি মধু বেরোয়।

আচ্ছা মা, আটপৌরে আলমারিটা কী?—মধুবনের দাদা ঋজুরুস্তম জিজ্ঞেস করে।

মা দুই কোমরে হাত রেখে রণং দেহি মূর্তিতে দাঁড়ায়।—আটপৌরে! আটপৌরে? আটপৌরেটা নিয়ে তোমার অসুবিধে না আলমারিটা নিয়ে।

আলমারি ইজ অল রাইট, বাট হোয়াট ইজ আটপৌরে!

মিনস ক্যাজুয়াল—মাই ডিয়ার

মানে তোমার ক্যাজুয়াল ড্রেস রাখো মামণি, না?—মধুবন মাকে সাহায্য করতে চায়।

আজ্ঞে না। শুধু জামাকাপড় না, আর যা কিছু রোজ দরকার হয়, তেমন দামি নয় সে সবই।

ঋজু বলে—বাট আটপৌরে—আলমারি! আই জাস্ট কান্ট টেক মাম্মি।

মা গম্ভীরভাবে বলে—তোমাদের দাসী খাটতে খাটতে ব্যাকরণ—ট্যাকরণ ভুলে গেছি তবু চেষ্টা করছি—আটপৌরে জিনিস রাখার আলমারি। কর্মধারয় সমাস—বাংলা মতে। ইংরেজি মতে—ট্রান্সফার্ড এপিথেট। আলমারির জিনিসগুলো আটপৌরে, জিনিসগুলোর বিশেষণ ট্রান্সফার্ড হয়েছে আলমারিতে—ঢুকল মাথায়?

ওরে বাপ—মাদার এ তো ক্যালকুলাসের চেয়েও শক্ত!

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার কাছে জলের মতো সোজা, তোমাদের মতো বিজ্ঞান—নবিশদের কাছে ইটের মতো শক্ত। আই কিউ সবেতেই লাগে ঋজুরুস্তম। আর তাই যদি বলো তো তোমার নামটির মানেই আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো না!

নাথথিং—ঋজুরুস্তম সব উড়িয়ে দেওয়া হাসি হাসে—ঋজু মিনস স্ট্রেট অ্যান্ড রুস্তম মিনস আ ব্রেভ ম্যান, হিরো।

তা হলে দাঁড়াল একজন স্ট্রেট ফরোয়ার্ড হিরো। যেটা নাকি সোনার পাথর বাটি।

অতশত জানি না। তোমরা ঋজু নাম দিয়েছিলে। আমার পছন্দ ছিল রুস্তম, দুটো জুড়ে নিয়েছি—এই তো আমার অপরাধ!

ঋজুরুস্তম নামটির পেছনের ইতিহাস এই। ঋজু নামটি ঠাকুরদার দেওয়া। কিন্তু স্কুলে বহু ভাষাভাষী বহু প্রদেশীয় বহু ধর্মীয় বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে ঋজুর মনে হয়েছিল তার নামটি যথেষ্ট আন্তর্জাতিক নয়। অন্ততপক্ষে সর্বভারতীয় বা এশীয় হলেও তার এমন জাত যেত না। বেশিরভাগই তার স্কুলে হসন্তান্ত—প্রসন, অকশয়, সাদিক, রোহান, কুলদীপ, তাই সে নিজেকে সময় সুবিধে মতো ঋজুরুস্তম—এ পরিণত করেছে। বাবা ততটা খেয়াল করেনি। কেননা বাবার কাগজ পড়বারও সময় নেই। কিন্তু মাতৃদেবী প্রচুর রাগ করেন।

তোমার জন্ম যেমন দিয়েছি, নামটাও তেমন আমরা গুরুজনরাই দিয়েছি। তুমি যদি নতুন নাম নাও সেটা ছদ্মনাম বা পেননেম হতে পারে। তুমি কি লিখতে শুরু করছ?

পাগল নাকি?

ঠিকই। পাগল না হলে কেউ তোমাকে একজন দায়িত্বশীল কল্পনাপ্রবণ পড়ুয়া লেখক হিসেবে কল্পনা করবে না। মায়ের রাগত প্রস্থান।

যাই হোক, মধুবন মা আর দাদার এইসব দ্বৈরথে থাকে না। পাঁচ—ছ’রাউন্ড প্রাতঃহন্টন সেরে গলদঘর্ম হয়ে বাড়ি ফিরে সে দেখল—একটি ঝিঁঝির পাতের মতো মেয়ে তার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মা তাকে দু’হাত নেড়ে কী সব সমঝাচ্ছেন। মেয়েকে যে এখন কিছু খেতে দিতে হবে মায়ের এ খেয়ালই নেই। অভিমানে দশখানা হয়ে মধুবন তোয়ালে দিয়ে ভাল করে নিজেকে মুছল তারপর স্রেফ শুয়ে পড়ল এবং শুয়ে পড়লেই যেহেতু তার ঘুম পেয়ে যায় সে ঘুমিয়ে পড়ল।

বাজখাঁই আওয়াজে ঘুম ভাঙল। কে আর? মাতৃদেবী।

আজ কোচিংয়ে যেতে হবে না না কী?

চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল মধুবন। জঠরে দাবানল। ব্যাপারটা সে এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না। মাতৃদেবী তাকে জানিয়ে দিয়েই সরে পড়েছেন। মধুবন দেখল তার সামনে ঝিঁঝির পাতের মতো দেখতে সকালের সেই মেয়েটা। মধুবন কাতরে উঠল পেটে হাত দিয়ে। ওরে বাবা উঃ, কী আগুন জ্বলছে রে বাবা।

মেয়েটা খুব নিশ্চিন্ত গলায় বলল—ওবেবস হয়ে যাবে।

মানে? আমার পেট ব্যথা করছে আর তুমি বলছ অভ্যেস হয়ে যাবে।

পেট ব্যথা তো নয়। আগুন জ্বলছে বললে না দিদি! তাই বললুম—খিদে, খিদের আগুন জ্বলে জ্বলে ঠিক একদিক খাক হয়ে যাবে তখন আর তত কষ্ট হবে না।

যা ববাবা! মধুবন তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে ধপাস করে খাটের ওপর বসে পড়ে।

প্রথম প্রথম মাথা ঘুরবে অমন—ঝিঁঝির পাতা বলে ওঠে।

মা! ও মা!—মধুবন রান্নাঘরের দিকে হাঁউ মাউ খাঁউ করে যেতে থাকে, তখন মেয়েটা বলে—আমি তো তখন থেকে তোমার খাবার টেবিলে ঢাকা দিয়ে দাঁইড়ে আছি। এই নাও।

ওর হাত থেকে প্লেটটা ছিনিয়ে নেয় মধুবন। দু’খানা আটার রুটি। পেঁপে মরিচ, গাজর শসা বিন দিয়ে স্যালাড। মধুবন প্রায় একটা গোটা রুটিই মুখে পুরে দিচ্ছিল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হবে, এবং এই ফুচকা দু’খানা রুটি দু’গরাসে পেটে চালান হয়ে গেলে খাদ্যের সেই অপূর্ব স্বাদ সে আর পাবে না।

ও বাবা। মেয়েটা বাটি খুলে একটা সেদ্ধ ডিম বার করছে।

ওটা কার?

তোমার।

তুই কি জিনপরি!

নির্বিকারে ঘাড় নাড়ল সে, বলল—জিনপরি নই। শুধু পরি।

পরিই বটে। ফুঁ দিলেই তো উড়ে যাবি।

হ্যাঁ গত এক বছরে খুব রোগা হয়ে গেছি।—জবাব হল।

এবার মেয়েটা সেই সরহীন দুধ বার করছে। পরম আধো গরম সেই দুধে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ একবার চোখ তুলেছিল মধুবন। দেখে মেয়েটা নির্নিমেষে জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। পেছন ফিরে জানলা দিয়ে রোদ খাঁ খাঁ রাস্তা ছাড়া কিছু তো দেখা গেল না।

দুধটা শেষ করে ওর হাতে গ্লাসটা দিয়ে মধুবন বলল—কী দেখছিলি ওখানে?

কিছু তো না। মেয়েটা কেমন জড়সড় হয়ে গেল। তার মনে হল মেয়েটা তার খাওয়াটা দেখতে চাইছিল না। কেন রে বাবা?

আজ থেকে কাজে লাগলি, না কী?

হ্যাঁ দিদিমণি।

আবার মণিফণি নয়। স্রেফ দিদি। কোথায় বাড়ি?

বাড়ি? বাড়ি ঘর নেই—বলে পরি আর দাঁড়াল না।

ঘড়িতে বারোটা বাজছে। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে কোচিংয়ের দিকে রওনা দিল মধুবন। বড্ড সুখী—সুখী লাগছে আজ। অনেক দিন পরে গরম গরম লাঞ্চ খেয়ে বেরোতে পারছে সে। শান্তি আর কাকে বলে। আহা, তাকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে মায়ের মনে ক্ষুধিত মেয়ের জন্যে করুণা জেগেছে। নিজের কঠোর ভাবমূর্তি পাছে গলোগলো হয়ে যায় তাই জিনপরিকে পাঠিয়ে দিয়ে চান করতে ঢুকে গেছে। আর তাই—ই আজকে ডিমটা এক্সট্রা।

আরএনজি—র ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ মধুবন খেয়াল করল সে এখনও ডিমের কথা, নরম গরম রুটির কথা ভেবে যাচ্ছে। শম্পি যখন ক্লাসের শেষে বলল—তুই একখানা দেখালি বটে মৌবটিকা, না হয় একটু দেরিতেই ঢুকেছিস। তাই বলে আরএনজি—কে ওইরকম একস্ট্রা মনোযোগ দিতে হবে?

পাবলো বলল—যাকে বলে অভিনিবেশ! মুখখানা এক্কেবারে গোলগাপ্পা হয়ে গিয়েছিল। স্যারসুদ্ধু হাঁ হয়ে গেছেন।

তো মুখে একটা সেদ্ধ ডিম পুরে দিলে পারতিস। মধুবন রাগ করে ক্লাসরুম থেকে বেরোতে বেরোতে শোনে—শম্পি বলছে—দেখেছিস পাবলো মধুবন সব সময়ে, অলয়েজ টকস ইন টার্মস অব ফুড আইটেমস। সেদিন আমাকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে বলল—কাঁচকলা! ক’দিন আগে কাকে যেন বলছিল কোচিংয়ের কেমিস্ট্রি সারের পেটটা ঠিক তরমুজের মতো।

এ তো ভাল, স্বাভাবিক। কাঁচকলাটলা আমরা বলেই থাকি। কিন্তু পরশু দেখি নীলাঞ্জন আর পিকলু উত্তেজিত হয়ে তর্কাতর্কি করছে, গদগদ করে তোর কাজিন এগিয়ে গেল, বলল—কী রে পাপকর্ন ভাজছিস নাকি?—পাবলো বলল।

আই অবজেক্ট। তোর কাজিন মানে কী? মধুবন কি তোরও কাজিন নয়! নাকি ডিজওন করছিস?

করছি না এখনও তবে অদূর ভবিষ্যতেও ও যদি ওরকম নদগদে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, করতে পারি।

এই পর্যন্ত মধুবনের কানে গিয়েছিল।

পাবলো, সেই পাবলো যার সঙ্গে সে একটা গলদা চিংড়ি ভাগ করে খেয়েছে, যাকে সে তার ফেভারিট নলি হাড় এবং মেটের টুকরো দিয়ে দিয়েছে কত কত বার, কেক কাটতে গিয়ে টুকরো অসমান হয়ে গেলে সানন্দে বড় টুকরোটা যে পাবলোকে দিয়েছে। সে—ই পাবলো তাকে ডিজ…ওন করবে? কা…জিন বলে স্বীকার করবে না!!! গদ্দার! গদ্দার! অসম্ভব সব প্রতিহিংসার দুঃস্বপ্ন মধুবনের মনে ধোঁয়ায়। সে মিলিটারি ভঙ্গিতে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে।

অধ্যায় ১ / ১২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন